Friday, May 5, 2017

বিশুমামার গল্প - ৫

বিশুমামার মালকোশ।।


বিশুমামা তখন আমাদের শহরেই থাকে। এখানকার স্থানীয় অফিসার্স ক্লাবে গান শেখায়। তার তখন অনেক ছাত্রছাত্রী, শেষে এমন অবস্থা যে গুল দেওয়ার সময়ও নেই। আমরা যেখানে আড্ডা দিই, মানে যাদবচন্দ্রের চায়ের দোকানের সামনের রাস্তাটা আগে মামার গুলের খুশবুতে ম ম করত, আমরা তার নাম দিয়েছিলাম গুল্মার্গ।ইদানীং মনে হচ্ছে সে রাস্তাও তার খ্যাতি হারাতে চলেছে।
'ওরে এর থেকে ত ভাল ছিল বিশুমামা যখন দুর্গাপুরে ছিল, ছুটিছাঁটায় তবু দর্শন পাওয়া যেত, এখন ত তাঁর সাধনা করতে হচ্ছে।' কানু বলে।
'তাহলে নিজের নামটা বদলে দিই, কি বলিস! দেবদুর্লভ চক্রবর্তী নামটা কেমন হবে?' চমকে তাকিয়ে দেখি বিশুমামা কখন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে।
'আরে তুমি! কই ছিলা এদ্দিন?' খুশীতে সুজয়ের মুখ থেকে তার দেশোয়ালী ঢাকাই ভাষা বেরিয়ে আসে।
'আর বলিস কেন! গেছিলাম দুর্গাপুর। সে এক কাণ্ড। খবর পেলাম আমার মেজদা শীর্ষেশ্বর ওরফে শিশু এক শিশুসুলভ কাজ করে ফেলেছেন।'

শিশুমামার সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় থাকলেও ওঁর আমাদের বাসায় আসা যাওয়া না থাকায় কানু বা সুজয় তাঁকে চেনেনা। তিনিও আরেক ওস্তাদ, স্বয়ং ভীষ্মদেবের শিষ্য ছিলেন, কিন্তু কার দাদা দেখতে হবে ত-  শখের ওস্তাদ হয়েই থেকে গেলেন। মৌশিকিতে ম্যহফিলে নাম হল প্রচুর, কিন্তু ছাত্রছাত্রী ত দূরের কথা, নিজের ছেলেমেয়েদেরকে গান শেখাবার কথাও তাঁর মাথায় আসেনি কোনোদিন। এহেন মানুষ আবার কি শিশুর মত কাণ্ড করে থাকতে পারেন? আমরা ত কিছু ভেবে পাইনা। শিশুরা কি করে, এক হিসু ছাড়া!

সংকট থেকে উদ্ধার করলেন বিশুমামা স্বয়ং। হয়েছে কি? আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বাইরে বৃষ্টি শুরু হতে দেখে মেঘরাগে 'তিমিরময় নিবিড় নিশা, নাহি রে নাহি দিশা' গাইতে গাইতে তিনি বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন। জলে ভেজা বারান্দা, দিশা হারিয়ে পা পিছলে পপাত ধরণীতলে! তারপর পা ভেঙে হাসপাতালে- বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বিশুমামা।
'সেকি গো, তাহলে ওদের চলছে কি করে? ছেলেদুটোই ত ছোট, খাবার-দাবার পৌঁছনো, ডাক্তারের সাথে পরামর্শ, এসব করছে কে?'
'বৌদি সামলাচ্ছে কিছুটা। তাছাড়া বন্ধুবান্ধব আছে। তোদের পড়াশুনা আছে, তাই আর খবর দেয় নি। তা পারিস যদি যা না দেখে আয়। তবে আগামী সপ্তাহে বোধহয় ছেড়ে দেবে।'

আমি ঠিক করলাম একবার ঘুরেই আসি দুর্গাপুর। বহুদিন আগে একবার গেছিলাম, তবু মনে আছে জায়গাটা। সেই শুক্রবারদিন কলেজের শেষ দুটো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ব্ল্যাক ডায়মণ্ডে চেপে বসলাম। পরদিন শিশুমামাকে ছেড়ে দিল হাসপাতাল থেকে, তবে পায়ে প্লাস্টার করে। এখন তিন সপ্তাহ ঝাড়া রেস্ট। শিশুমামা বাড়ি ফিরে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আয়েস করে তানপুরা টেনে নিলেন কোলে।

রবিবার রাত্রে আমি কোলফিল্ডে ফিরেছি। পরদিন বিকেলে যাদবের দোকানে যেতেই দেখি সুজয় আর কানু হা-পিত্যেশ করে বসে আছে আমার আশায়। তিনটে চা নিয়ে যাদব আসতেই শুনলাম পেছন থেকে হেঁড়ে গলার আওয়াজ- 'আরেকটা চা দিয়ে যা রে।' বিশুমামা আজ একটু সকাল সকাল ফিরেছে ট্যুইশন সেরে।
'কিরে কেমন দেখলি মেজদাকে? ছাড়া পেয়েছে?' বিশুমামার প্রশ্ন।
'হ্যাঁ, বিশুমামা, পরশুই ছেড়েছে। এখন তিন সপ্তাহ প্লাস্টারে রাখবে।'
'তা কেমন আছে এখন? আমাকে কি যেতে হবে একবার?'
'তুমি মালকোশ নিশ্চয় জান। কিন্তু হিন্দোল? কিম্বা ললিত কিম্বা, কি যেন, হ্যাঁ, সোহিনী রাগ?'- আমার প্রশ্ন।
'কি পাগলের মত বকছিস?' এবার সুজয় ধমকে ওঠে আমাকে, 'শিশুমামার শরীরের সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক?'
'হয়ত আছে। তা নইলে শিশুমামা বাড়ি ফেরার পর থেকে ওই রাগগুলো শুধু গেয়ে চলেছে কেন?'

হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে বিশুমামা। 'ওঃ মেজদা একটা আস্ত পাগল' বলেই চায়ের পয়সা না দিয়েই সাইকেল নিয়ে কেটে পড়ে। আমাদের হাঁ মুখটা আরো বড় হয়ে যায়।
'ব্যাপারটা কি ঘটল বল ত?' এবার সুজয়ের প্রশ্ন। 'তোরা কি কিছু বুঝলি?'
কানু মুচকি মুচকি হাসছিল। 'আমি কিছু বলি?' ও শুধোল। কানু একটু গান-টান শিখেছে, সুতরাং রহস্যের উদ্ধারে ওরই শরণাপন্ন হই আমরা।
'শিশুমামার পা ভেঙেছে বললি না! তাহলে জেনে রাখ- মালকোশ, হিন্দোল, ললিত বা সোহিনী সবই পঞ্চম বর্জিত রাগ, একটাও গাইতে পা লাগে না। 'পা' ব্যবহার না করে আর কি গাইবে?'

আমাদের দুজনের হাঁ মুখটা সেসময় যদি কেউ দেখত!