Friday, July 23, 2021

অফিসের গল্প -৮ । দাদা।।

অফিসের গল্প (৮) 


দাদা।


'উঃ, লম্বা লাইন ছিল টেলারের কাউন্টারে'- সিনহাদা বন্ধ ভিজে ছাতাটা অফিসের কোনায় খুলে শুকোতে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন। 'হাজার টাকা তুলতে হাজারটা ঝামেলা' বলে আরেকবার নোটের বান্ডিলটা পকেট থেকে বের করে দেখে আবার ঢুকিয়ে রাখলেন। আমি একবার তাকিয়ে দেখে আবার হাতের ফাইলে মনোনিবেশ করলাম।
আশির দশকের গল্প। এটিএম কথাটা শোনা গেলেও বস্তুটি ভারতীয়রা তখনও চোখে দেখেনি। ব্যাঙ্ক কর্মচারিরা তখন যথেষ্ট চাপে থাকতেন আর মাঝে মাঝে রোয়াবও দেখাতেন বেশ। 'আরে!' হঠাৎ সিন্‌হাদা বলে উঠলেন, 'মনে হল একশ'র বান্ডিল ঢোকালাম পকেটে। কী সর্বনাশ!'
'কী হল, দাদা', আমি শুধোলাম।
'এই, তোমার ছাতা আছে? যাবে আমার সাথে একবার ব্যাঙ্কে? দেরি করলে আবার ট্রান্স্যাকশান আওয়ার বন্ধ হয়ে যাবে।'
'কেন, গোলমাল হয়েছে কিছু?'
'গোলমাল বলে গোলমাল! দশের বদলে একশ'র নোটের বান্ডিল ধরিয়ে দিয়েছে মেয়েটা ভুল করে। বেচারা মারা পড়বে একেবারে।' অগত্যা ছাতা হাতে আমরা দুজন আবার ব্যাঙ্কের কাউন্টারে।
সিন্‌হাদা মাস দুই হল কলকাতা অফিস থেকে বদলি হয়ে এসেছেন বোম্বে অফিসে। মধ্যবয়সী মানুষ, ছেলেমেয়েরা কলকাতায় পড়াশুনা করে বলে আমাদের মেসবাড়ি আলো করে একাই থাকেন আর অবসর সময়ে ব্রিজ খেলেন আমাদের সাথে। হিন্দি এমনিতেই কম বোঝেন, মুম্বাইয়া হিন্দি তো আরো ভয়ংকর।
মেয়েটা প্রথমে কিছুই বোঝেনি ব্যাপারটা। সে তো শোনেই না কিছু- 'আপনি আগে নোট গুণে নেননি কেন, এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, যান ম্যানেজারের কাছে, কোই পরোয়া নেহি!'
'আরে হাম বোলতা কম, তোম শুনতা বেশি।' দমদম-মার্কা অননুকরণীয় হিন্দিতে সিন্‌হাদা বোঝাতে গেলেন। 'তেমনি মাংতা কম, দেতা বেশি! এইঠো এক হাজার হ্যায় না দশ হাজার? তোমকো তিনমাসকা মাইনে কাটা জায়েগা ম্যানেজার কো বোলেগা তো!'
এইবার দাদার ওই ভাঙা হিন্দি বক্তব্য মরাঠি মেয়েটার মাথায় ঢুকল। না, ও কোন ধন্যবাদ দেয়নি পরিবর্তে। বরং কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে সিন্‌হাদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল।

kabitaashram@gmail.com, Amit Saha Editor www.kabitaashram.com

অফিসের গল্প- ৯ লাঠি।।

 অফিসের গল্প-

লাঠি।।

পিনাকীদার লেখা পড়ে বন্ধুরা খনিজ তেলের অনুসন্ধান নিয়ে হয়ত কিছু জেনেছেন ইতিমধ্যে, না জেনে থাকলেও আমার এ বিষয়ে মুখ খোলার তেমন অধিকার নেই। আমি মাটি খোঁড়ার মিস্ত্রি, ভূগর্ভশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত মানুষেরা যে জায়গাটা দেখিয়ে দেন, সেখানে একটা পরিমাণ-মতো গর্ত খুঁড়ে তেল উৎপাদনের পথ তৈরি করে দিই মাত্র। এই খোঁড়াখুড়ি শুরু করার আগে ল্যান্ড একুইজিশন, সিভিল ও ইলেকট্রিক ইঞ্জিনীয়াররাও যথেষ্ট সাহায্য করেন আমাদের।
১৯৯৯ সালের একটা দিনে আমাদের কারাইকাল(পণ্ডিচেরি) অফিসের বাইরের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছি সিভিলের বন্ধু তন্ময় বাসুর সঙ্গে। এমন সময় একজন অন্ধ ভদ্রলোক লাঠিটা হাতড়ে আমাদের কাছে এসে প্রজেক্ট হেডের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। তামিল হলেও ইংরেজি বলেন ভালই, বললেন এক্সপ্লোরেশনের ব্যাপারে কথা বলতে চান। আমরা ভাবলাম, একটু মজা দেখা যাক, প্রোজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন না, ড্রিলিংএর হেড নাম্বুদ্রির কাছে নিয়ে এলাম ওঁকে।
সেখানে এসে ভদ্রলোক যা বললেন, শুনে তো আমাদের চোখ কপালে। ওঁর লাঠির সাহায্যে এক বিশেষ অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার বলে উনি নাকি মাটির নীচে জলের উপস্থিতির কথা বলে দিতে পারেন। এই ক্ষমতা জানার পর থেকে এলাকার গ্রামবাসীরা মাটির নীচে জলের সন্ধানের জন্যে ওঁকে নিয়ে যান, বলতে গেলে এটাই ওঁর পেশা। এখন উনি এই ক্ষমতা খনিজ তেলের সম্বন্ধে খাটে কিনা তা একটু পরখ করে দেখতে চান। এ ক্ষেত্রে তিনি কোন পারিশ্রমিক নেবেন না, শুধু সাহায্য চান। আমরা যেখানকার তথ্য জানি সেরকম কোন স্থানে যদি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করার কোন সুযোগ দেওয়া হয়, খুব খুশি হতেন!
নাম্বুদ্রি সাহেব ঠিক বিশ্বাস করতে না পারলেও কৌতূহলী হলেন। আমি এধরণের কিছু আধিভৌতিক হাতুড়ে ওঝার কথা পড়েছিলাম জোনাথন ব্ল্যাকের 'অয়েল' উপন্যাসে, তবে এখানে তেমন কাউকে দেখতে পাব আশা করিনি। যাহোক মি: নাম্বুদ্রি ভদ্রলোককে নিরাশ করলেন না, হয়ত জিনিষটা সম্পর্কে তাঁর নিজেরও কিছুটা আগ্রহ ছিল। তাই তন্ময়কেই দায়িত্ব দিলেন গাড়িতে করে ওঁকে কোন তৈলকূপে নিয়ে যেতে। আমিও চললাম সঙ্গে।
'এই যে স্যার, কমলাপুরম এসে পড়েছি আমরা। নিন আপনার যন্তরটা বের করুন'- তন্ময় বলে। এখানে কদিন আগেই তেল পাওয়া গেছে, পরীক্ষার উপযুক্ত জায়গা। ভদ্রলোক ডাক শুনেই গাড়ি থেকে নেমে লাঠি হাতড়ে এগিয়ে চললেন। এ কি! উনি তো দেখছি রিগের দিকে যাচ্ছেনই না, সাইটের গেটে না ঢুকে সম্পূর্ণ উল্টো পথে এগিয়ে চলেছেন। আমি ইশারায় তন্ময়কে চুপ করতে বলে ওনাকে ফলো করতে লাগলাম। প্রায় আধ কিলোমিটার হেঁটে একটা পুকুরের ধারে এসে থামলেন ভদ্রলোক। 'সামনে জল আছে মনে হচ্ছে, আর এগোতে পারছি না। তবে আমার যন্ত্র যা দেখাচ্ছে, তাতে মনে হয় সামনেই কোথাও মাটির নীচে তেলের ভাণ্ডার আছে। পুকুরের তলায় থাকাও বিচিত্র নয়।'
'হয়েছে, ওঝাগিরি শেষ', তন্ময় হেসে বলল, 'চল অফিস ফিরি- এনার মুরোদ জানা গেল।' আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
'ভদ্রলোক কিন্তু একশ ভাগ ঠিক বলেছেন, তন্ময়', আমি গাড়িতে চেপে বাংলায় বললাম। কমলাপুরমে টেস্টিং-এ হাইড্রোকার্বন পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু রিজার্ভয়েরের ট্র্যাপটা আসলে জলের তলেই। জলের উপর রিগ বসবে না বলে আমরা ডেভিয়েটেড ড্রিলিং করেছি।'
নাম্বুদ্রি সাহেব সব কথা শুনে ভদ্রলোককে চা আর ইডলি খাইয়ে বিদায় দিলেন। একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে দিয়ে উনি বিদায় নিলেন। লোকটা চলে যেতেই নাম্বুদ্রি কার্ডখানা ছিঁড়ে ওয়েস্ট বিনে ফেলে দিলেন। 'কি করলেন, স্যার', তন্ময় হাঁ হাঁ করে উঠল, 'এরকম একটা প্রতিভা!'
'আমাদের এই কোম্পানীতে অন্তত: হাজারখানেক এক্সপ্লোরেশন জিওলজিস্ট আর জিওফিজিসিস্ট আছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই মোটা মোটা বই পড়ে, অনেক খেটে-খুটে ডিগ্রী নিয়েছেন, তারপরেও ফীল্ডে পরিশ্রম করেছেন। তাদের সবাইকে কি তাহলে একটা করে লাঠি ধরিয়ে দেব বলতে চাও?' মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিলেন উনি।
আমরা দুজনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।