Monday, December 23, 2013

আত্মা ।। Bengali Micro-fiction 18



 আত্মা ।।

কবরটার উপর উঠে বসে ছিল জালাল । কথা হচ্ছিল পাশের শ্যাওড়া গাছটাতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা পাণ্ডুরঙ্গার সাথে । দু-দিন আগের ঘটনা নিয়ে তারা কথা বলছিল । পাণ্ডুর বাঁশের লাঠিতে জালালের মাথাটা দু-ফাঁক হওয়ার মুহূর্তেই তার হাতের ছুরি বিঁধেছে পাণ্ডুর বুকে, তারপর ঐ দাঙ্গার আগুনের মাঝ থেকে বের করে কি করে ওদের দেহগুলোর সৎকার হল সে আর এক গল্প । তারপরেও পাক্কা দুদিন লেগেছে ওদের বুঝতে যে ওরা বেঁচে নেই ।

- হ্যাঁরে, এরপর আমাদের কি হবে? পাণ্ডু জিগ্যেস করল জালালকে ।...
- আর কি হবে, নরকে যাবি । শালা, আমাকে খুন করেছিস ।
- আর তুই কি বে হারামী? সাধু, না দরবেশ ! এবার দুজনেই হেসে উঠল, যা থাকে কপালে ।

দু-জনে তো ওরা বন্ধুই ছিল, কি করে কি হয়ে গেল... বাবরি মসজিদটা কি বস্তু- খায়, না মাথায় দেয়, কোনও ধারণাই ছিল না তাদের । একই কারখানায় কাজ করত, টিফিনের সময় রুটি-সব্জি-হালুয়া ভাগাভাগি করে খেত দুজনে ।
- জালালরে, নরকটা শুনেছি আমাদের কারখানার ফারনেসের মত, ওর মধ্যে ছেড়ে দেয় আর উঠতে চাইলেই যমদূতরা ডাঙ্গশের বাড়ি মারে ।
- এখন নাচতে এসে ঘোমটা পরলে তো চলবে না । শালা আমাদের দোজখটাই বা কম কিসে ? ...আরে, এটা আবার কি শুরু হল, পাণ্ডুয়া রে...।

জালালের কথা আর শেষ হল না, একটা তুমূল ঝড় এসে ওদেরকে কোথায় যে উড়িয়ে নিয়ে গেল । মনে হয় একটা ব্লাস্ট ফার্নেস জাতীয় কিছু, আত্মাদুটো তার ভিতরে পড়ে অন্য সব আত্মাদের সাথে ঘুরপাক খেতে লাগল । ধর্ম, জাতি, রূপ, দোষ-গুণ সব বাইরের পোষাকের মত খসে পড়তে লাগল একে একে । তারপর......।

দূর মশাই, বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছুই তো লিখলাম, কাঁচামাল বলতে তো ৯৩এর মুম্বাই কম্যুনাল রায়টে জালাল আর পাণ্ডুরং নামে দুই শ্রমিকের মৃত্যু । কল্পনার দৌড় আর কত এগোবে ! বাকীটা আপনারা ভাবুন না

নবকুমার ।। Bengali Micro-fiction 17


।। নবকুমার ।।

আমি তখন স্কুলের উচ্চতম ক্লাসে, একটা চাপা অহংবোধ কেন জানিনা মনে মনে কাজ করত । এক বর্ষার দিনে কিভাবে যেন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় আমি আর আমার মৈথিলি বন্ধু প্রমোদ মিশ্র পায়ে হেঁটে ও ভিজে বাড়ী ফিরছি । এমন সময় দেখি একটি প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা ছাত্র একটি পাথরের উপর একা বসে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে । ওদের ক্লাস তো দু-ঘণ্টা আগেই শেষ হয়ে গেছে । আমি তাকে নাম-ঠিকানা জিগ্যেস করায় সে কিছুই বলতে পারেনা । শেষে প্রমোদ বুদ্ধি করে শুধোয়, তোদের বাড়ীর সামনে কি আছে, মাঠ, না স্কুল না বাড়ী । কারখানা আছে- ও বলে, ধোঁয়া বেরোয় ।
- আর কি আছে ?
- অনেক গরু ।...
- খাটাল ?
- হ্যাঁ । বলে সে আবার কাঁদতে লাগল ।

ফ্যাক্টরির সামনের মজদুর কলোনীর মনে হচ্ছে, প্রমোদ বলল, চ, একে বাড়ী পৌঁছে দি ।
- কিন্তু আমাদের বাড়ীর রাস্তায় নয় যে, তাছাড়া বৃষ্টি হচ্ছে-
- আরে হায়ার ক্লাসের ছাত্র হয়ে এটুকু করতে পারব না আমরা ! তাছাড়া আজকে ছিঁকন পণ্ডিত কি পড়াল- 'পরোপকারায় সতাং বিভূতয়ঃ', নয় কি ?
- হুঁ, আমি সংক্ষেপে সায় দিলাম । যেটা বলতে পারলাম না সেটা এই যে আমরা ত সাধু-সন্ত নই রে বাবা, আমাদের কি দায় পড়েছে পরোপকারের !
- ঠিক আছে, আমি বাচ্চাটিকে বললাম, চ আমাদের সাথে । বাড়ি চিনতে পারবি ত?
- হ্যাঁ । ছেলেটি কান্না থামিয়ে বলল ।
যথাস্থানে ছেলেটিকে জমা দেওয়ার সময় কিন্তু আমাদের সেই হিরো-ভাবটা আর থাকেনি । ছেলেধরা সন্দেহে বস্তিবাসিরা তাড়া করায় প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাই দুজনে ।

পরোপকার করার ভাল পুরস্কার জুটল রে আজ- বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে আমি যখন এগুলো প্রমোদকে শোনাচ্ছি, আমাকে অবাক করে দিয়ে সে যে কথাগুলি বলল তার সোজা মানে হচ্ছে -'তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন ?'
- এই তুই বঙ্কিমের 'কপালকুণ্ডলা' পড়েছিস নাকি ?
- 'কপালকুণ্ডলা'- উও কোন সি চিড়িয়া কা নাম হ্যায় ?

বোঝা গেল এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের যুগেও নবকুমাররা সর্বত্রই আছেন, নব নব রূপে, নব নব নামে ।

সাস ভি কভি......।। Bengali Micro-story 16


সাস ভি কভি......।।

এম-কে-জি ফিজিক্স পড়াচ্ছেন, নিউটন'স ল অফ কুলিং । আমরা মনে মনে ভাবছি এই নিউটন নামক ভদ্রলোকের কি খেয়ে-দেয়ে আর কোনও কাজ ছিল না, পদার্থ, রসায়ন, গণিত সর্বত্র নাক গলান ছাড়া । ছাত্রদের জীবন্গুলোকে একাই দুর্বিষহ করে তুলেছেন, আপেলের বদলে কেন যে তিনি নারকেল গাছের তলে বসেননি! এদিকে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট টেস্ট চলছে, অথচ শোনার উপায় নেই ।
হঠাৎ দেখি প্রফেসার লেকচার থামিয়ে ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন । পেছনের সীটে বসে কোনও ইডিয়ট ট্রান্‌জিস্টর শুনছিল, বিশ্বনাথ বাউন্ডারি মারায় হঠাৎ করে ভল্যুমটা বেড়ে গেছে । এম-কে-জি ধরে ফেলেছেন কালপ্রিটকে । প্রাইভেট কলেজ, তাও আবার মিশনারিদের, জানিনা কি হতে চলেছে । রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি আমরা ।
খট-খট-খট... কাঠের স্টেপ্স-এ প্রফেসারের পায়ের শব্দ এগিয়ে গেল যেখানে বসে শৈলেশ জৈন, বেচারা সেটটা পকেটে ঢোকাবার সুযোগ সুদ্ধ পায়নি । প্রফেসার শৈলেশের সীটের কাছে গিয়ে... দাঁড়ালেন, তারপর ধমকানোর সুরে বললেন-

- ইয়েস, হোয়াট ইস দ্য স্কোর ?

দু-শ থেমে থাকা নিঃশ্বাস একসাথে সশব্দে বেরিয়ে এলো ।

এভাবেও হয়।। Bengali Micro-story 15


 ।।এভাবেও হয়।।

বহুদিন পর শুভর সাথে দেখা । শুভ মানে আমার স্কুলের বন্ধু শুভাশিস ব্যানার্জি । শেষবার দেখেছিলাম যখন ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ত আর হোস্টেল পায়নি বলে বিডন স্ট্রীটের কাছে হর্তুকিবাগান লেনের একটা মেসে থাকত । এবার আমাকে প্রায় জোর করে কসবায় ওর বাসায় নিয়ে গেল ।

- তোর মনে আছে, সেবার হেদুয়া থেকে বাস ধরতে গিয়ে একটা মেয়ে আমাকে সময় জিগ্যেস করেছিল ? শুভ আমায় বাড়িতে বসিয়ে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল ।...
- দূর, অত কি কারু মনে থাকে ? তারপর কি হয়েছিল ?
- আমি বলেছিলাম- ন'টা । 
তারপর হল কি, রোজই ওই মেয়েটা আমায় বাসষ্টপে এসে সময় জিগ্যেস করে, আর কি আশ্চর্য, প্রতিদিন সে সময় ঠিক ন'টাই বাজতো ।
- তারপর ?
- তারপর আর কি, একদিন কিভাবে জানিনা ও পাঁচমিনিট আগেই এসে পড়েছে । কটা বাজে জিগ্যেস করতেই আমি গম্ভীরভাবে বললাম, 'এখনও বাজেনি ।' ব্যস, সেদিনই আলাপ হল ।
- বলিস কিরে !
- ওর নাম স্নিগ্ধা । লেডি ব্রাবোর্নে পড়ত, থাকত স্কটিশেরই উল্টোদিকে একটা লেডিস হোস্টেলে । সেই শুরু । তারপর একই পাড়ায় থাকি, কাছাকাছি কলেজ, একই রুটে । পরের বছর আমরা দুজনেই কলেজের হোস্টেল পেয়ে গেলাম । তারপর গত বছর পাশ করে আরো কাছাকাছি এসে গেছি ।
- আরো কাছে মানে ?
- মানে বলছি । কই গো, কোথায় গেলে, হাঁক পাড়ল শুভ ...। এই যে, আলাপ করিয়ে দিই, তুই তো আগে দেখেছিস...স্নিগ্ধা মিত্র, এখন ব্যানার্জি । চা এনেছ তো, রাখ এখানে...আমার ছেলেবেলার বন্ধু ।
- আর বন্ধু বলিসনা আমাকে । শালা, এত বড় খবরটা চেপে ছিলি এতক্ষণ !

- আপনার বন্ধুকে চেনেন যখন ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না । সেরকম কিছুই হয়নি - স্নিগ্ধা হেসে বলল ।
- তাহলে কিরকমটা হয়েছিল শুনি !
জবাবে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিল শুধু । আমি- তখনও ব্যাচেলার, কিছু না বুঝে আরও হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম ।

Bengali Micro-story হতে পারতো


হতে পারতো ।।

বান্দ্রা ইষ্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি, ষ্টেশন থেকে বোরিভিলি লোকাল ধরব । সাথে সেই হাজরাদা । ওভারব্রিজের বাঁকটা ঘুরেই দেখতে পেলাম দৃশ্যটা । ওভারব্রিজে এক আর দু-নম্বর প্ল্যাটফরমের মাঝের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ওরা দুজন । লম্বা ছেলেটি ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, আর মেয়েটি তার জামার বোতামে হাত দিয়ে । দু-জনেই নিমগ্ন, কেউ দেখছে কি না সেদিকে কোনও হুঁশ নেই ।

একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছিস, হাজরাদা বলল, বম্বেতে কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না । কলকাতা হলে চারপাশে ভিড় জমে যেত ।...
- কিন্তু ওরা করছেটা কি । মেয়েটাকে খুব দুঃখী মনে হচ্ছে । হয়ত বাড়ি থেকে অন্যত্র সম্বন্ধ করছে । কিন্তু দেখো, ছেলেটার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, ও যেন পালাতে পারলে বাঁচে ।
- আরে ছেলেদের তো ওটাই প্রব্লেম । ওরা ভেতরে চোট পেলেও বাইরে এক্সপ্রেশনলেস থাকে । কাপল হিসেবে কিন্তু ঘ্যাম হবে, মাইরি ।

কথা বলতে বলতে আমরা ওদের কাছাকাছি এসে পড়েছি । মেয়েটি ততক্ষণে তার দুপাট্টার খুঁটটা ছেলেটির জামার বোতাম থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে । 'থ্যাঙ্কস্‌' ও 'ইয়ু আর ওয়েলকাম' বলে এবার দুজনে দুদিকে ।

একটা জমাটি গল্প হতে হতেও হল না ।