New

Monday, December 8, 2014

লাউডগা ।।
(গল্প)

ছোটবেলায় আমরা থাকতাম বিহারের একটি সুন্দর ছোট শহরে। পাকাবাড়ি, বাঁধানো রাস্তাঘাট, ইলেক্ট্রিকের আলো-পাখা আর বাজার-হাট-ক্লাব-হাসপাতাল-কারখানা ছিল বলেই শহর, তা নইলে প্রকৃতি ও নির্জন পরিবেশের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তাকে গ্রাম বলাই ভাল। সে শহরে যেমন ছিল সার ও সিমেন্টের নামকরা কারখানা, ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, তেমনি ছিল একদিক দিয়ে কুলুকুলু করে বয়ে চলা দামোদর নদ, অজস্র মাঠ, পুকুর ও গাছপালা-ঝোপঝাড়। পুটুস বলে একরকম খুব ছোট-ছোট ফল ফুটে থাকত বাগানের বেড়ার গায়ে গায়ে, পাকলে ওগুলো কালো হয়ে যেত আর কি মিষ্টি লাগত খেতে। অবশ্য বাবা-মাকে লুকিয়ে খেতে হত, কারণ তাঁদের মতে ওগুলো ছিল অখাদ্য নিষিদ্ধ ফল। এছাড়া গোপাল বলে নলখাগড়া জাতীয় একরকমের অসংখ্য আগাছা ছিল চারপাশে। কারো কোনও কাজে না লাগলেও আমরা তার নরম অথচ মজবুত ডাল ভেঙে গোবর-ডান্ডা বলে একরকমের খেলা খেলতাম। মোটকথা নাম-কে-ওয়াস্তে শহরে বাস করলেও পুকুর-মাঠ-নদী-গাছপালা এরাও ছিল আমাদের খেলাধুলার অন্যতম সঙ্গী।

আমরা কারখানার অফিসার কলোনিতে থাকলেও প্রত্যেককে বাগান করার জন্যে যথেষ্ট জমি দেওয়া হয়েছিল কোয়ার্টারের লাগোয়া। অনেকে তাতে করতেন ফুলের চাষ, কেউ বা সুন্দর ঘাসের লন। আমাদের বাসার সামনের দিকে ফুল ও লন থাকলেও বাগানের পেছন দিকে ছিল বেশ কিছু বড় গাছ, যেমন সজনে, আম, পেয়ারা আর টোপাকুল। বলা বাহুল্য, আমাদের ছোটবেলাটা মাটিতে কম আর গাছে গাছেই বেশী কেটেছে। আমার এক পিসতুত দাদা খোদনদা ডাক্তারি পড়ত, মাঝে মাঝে বেড়াতে এলেই শাসিয়ে যেত। বলত, জানিস, ডারউইন সাহেব বলেছেন মানুষ আগে বাঁদর ছিল, গাছে গাছে ঘুরে বেড়াত। তারপর যখন সভ্য হয়ে গাছ থেকে নেমে এল, অমনি লেজ পড়ল খসে, ওরা মানুষ হয়ে গেল। আমার তাই শুনে একটাই ভয় হত। মাঝে মাঝে পেছনে হাত দিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতাম কি জানি অজান্তে লেজ বেরিয়ে গেল কিনা। 

পেয়ারাগাছ। কুলগাছের কথাও বলেছি, কিন্তু কাঁটা ছিল বলে তাতে চড়া যেত না, তাই আমি আর গণেশ ঢিল ছুঁড়েই কুল পাড়তাম। সেদিকে ছিল আর এক বিপদ। ঢিল প্রায়ই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পেছনের নিন্নিদের বাসায় চলে যেত আর নিন্নি এসে রেগেমেগে পাঞ্জাবি ভাষায় ঝগড়া করত। তাই বিশাল পেয়ারাগাছটাই ছিল আমাদের বন্ধুদের দলের শীতের দুপুরের আড্ডা। আমাদের গাছটাতে প্রায় সারাবছরই মিষ্টি পেয়ারা ফলত, তবে গরমকালে তার স্বাদই হত আলাদা। পাকা পেয়ারার লোভে উড়ে এসে জুড়ে বসত যতরাজ্যের টিয়াপাখি, আমাদের কম্পিটিশন ছিল তাদের সাথে। আর ছিল শুঁয়োপোকা, গায়ে লাগলে আর রক্ষে নেই, জ্বালিয়ে মেরে দেবে। আবার তারা কদিন পরেই ছোট্ট কাঠের টুকরোর বাক্স বানিয়ে তার ভেতর ঢুকে পড়ত, আমরা জানতাম, ছমাস পরে তারা বেরিয়ে আসবে সুন্দর  সুন্দর রংচঙ্গে প্রজাপতি বা মথ হয়ে। তবে সেই পেয়ারাগাছেই ছিল আরেকজাতের অতিথি, যাদেরকে প্রায় দেখাই যেত না, অথচ তাদের উপস্থিতি দস্তুরমত টের পেয়েছিলাম একবার, আসছি সে কথায়। 

দেখা যেত না শুনে কি তোমরা ভাবছ ভূত? আরে না না। দেখা না যাওয়ার আরেকটা প্রাকৃতিক কারণ আছে যাকে ইংরেজিতে বলে 'ক্যামুফ্লেজ' (camouflage)। জন্তু-জানোয়ারদের শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে বা শিকার ধরার সুবিধের জন্যে এটা একটা প্রকৃতির দেওয়া বিশেষ সুবিধা। যেমন বাঘের হলুদ-কালো ডোরা ঝোপেঝাড়ের রঙের সাথে খাপ খাওয়ায় বাঘ সবার সামনে থেকেও লুকিয়ে থাকতে পারে। বহুরূপী গিরগিটিরা তো পরিবেশের রঙের সাযুজ্যে নিজের গায়ের রঙই বদলাতে থাকে তাই তাদের chameleon বলা হয় ইংরেজিতে। তা এতসব আগে জানা থাকলে কি এরকম হত সেদিন আমার সাথে? অন্যদিনের মতো পেয়ারাগাছে চাপার পর দেখি উপরের ডালে মস্ত একটা ডাঁশা! পেয়ারার গুণগ্রাহীরা জানবে সত্যিকারের ডাঁশা পেয়ারার স্বাদ পেতে দেবতারাও মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাইবে। অগত্যা আমিও তরতরিয়ে উপরের ডালে উঠতে থাকলাম। পেয়ারার ডালের বিশেষতঃ এই যে ওগুলো বাশ চিমড় হয়, একটা সরু ডালের উপরও উঠে দাঁড়ান যায়, ভেঙে পড়ে না। কিন্তু বিপদ এলো অন্য দিক থেকে। হঠাৎ যেন একটা সবুজ বিদ্যুৎ চোখের উপর ঝলসে উঠল, আর তার পরেই বাঁ হাতের কব্জির ওপর অসহ্য ব্যথা। গাছের উপর থেকে কোনও মতে পড়ে যাওয়া থেকে সামলে নিয়ে ওই সবুজ বস্তুটা নিয়েই তরতরিয়ে নেমে এলাম। তখন চোখে পড়ল জিনিনান।গাছের ডালের সাথে রং এমন ভাবে মিলিয়ে ছিল যে এতও কাছে থেকেও চোখে পড়ে নি। একটা লাঊডগা সাপ! ব্যস, মুহূর্তেই আমি অজ্ঞান।

বন্ধুরা তো ভাবল আমি মরেই গেছি। ভাগ্যিস সেই সময় খোদনদা গরমের ছুটিতে এসেছিল, এক বন্ধু বুদ্ধি করে তাকেই ডেকে নিয়ে এল। সাপটাকে ততক্ষণে সাহসী বন্ধুরা মেরে ফেলেছে। দেখে খোদনদা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ও, Vine snake. চিন্তার কিছু নেই, কিছু হবেনা। না, না, বাঁধন দেওয়ারও দরকার নেই। স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছি, আর এককাপ গরম দুধ- ওতেই সেরে যাবে। আহা, তোরা নিরীহ সাপটাকে মেরে ফেললি, আরে ওদের বিষ থাকে না। দাঁড়া তোদের একদিন food chain system টা বোঝাতে হবে, তবে যদি কিছুটা শিক্ষা হয়!
- তাহলে ও অজ্ঞান হয়ে গেছল কেন, খোদনদা, তোতোন জিগ্যেস করল।
- সে তো ভয়ে, যখন বুঝতে পারল ওকে সাপে কামড়েছে। কি রে, ঠিক বলি নি? শেষ প্রশ্নটা আমাকে, ততক্ষণে উঠে বসেছি। আর যদি বিষ থাকতোই, তোদের ঐ বাঁধনে কাজ হত কচু।
- কেন আমরা তো কামড়ের জায়গার দু-তিন ইঞ্চি ওপরেই বাঁধছিলাম, একজন উত্তর দিল।
- দূর বোকা, বাঁধন যদি শিরায়চেপে না বসে কি লাভ তাতে। কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত এক জোড়া হাড় গেছে, তাদের নাম ulna আর radius, বিষাক্ত রক্তের শিরা যদি অবস্থান দুটোর মাঝে থাকে, তবে যত চেপেই বাঁধো, শিরায় চাপ পড়বেনা কিছুতেই।
- তাহলে কি উপায়?
- উপায় আছে। কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত গেছে একটি মাত্র হাড়, humerus, অতএব সেখানে বাঁধন দিলে হাতের যে কোনও শিরায় চাপ পড়তে বাধ্য। যাক্‌ গে সাপ মরল, লাঠিও ভাঙ্গল না, কিন্তু আমার ফী কে দেবে?
- আমার কাছে তো পয়সা নেই, বাবাকে বলব।
- ওরে বাবা, মামার কাছে চাইবি আমার ফী, তুই আমার মামাবাড়ি আসা বন্ধ করবি দেখছি। যা, যেটা দেখেছিলি, ওই পেয়ারাটা পেড়ে এনে আমায় খাওয়া, তাহলেই হবে।
- আবার চাপব গাছে? আমি ভয়ে ভয়ে শুধোলাম।
- আলবাত চাপবি, একশোবার চাপবি...দেখলি তো লাউডগা সাপের কোনও বিষ নেই। তাছাড়া ওই কবিতাটা আছে না, 'কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে...' , তারপরের লাইনটা কি যেন? কই, বলনারে!

কে বলবে? আমি তো ততক্ষণে গাছের মগডালে!

৮ই ডিসেম্বর, ২০১৪।
 


Posted by Pallab Chatterjee at 5:16 AM No comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest

Saturday, December 6, 2014

বিশেষ রচনা- ট্রৈনন্দিন ১-৫ ।।

ট্রৈনন্দিন- ১ ।।


অনেকদিন আগের ঘটনা। পিসেমশাইএর সাথে এসেছি তাঁর বেয়াই বাড়ি অশোকনগরে, শেয়ালদা-বনগাঁ লাইনে। বিকেলে পিসেমশাই বললেন তাঁর এক বাল্যবন্ধু অবস্থার বিপাকে পড়ে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন, তিনি গোবরডাঙ্গা গিয়ে টাকাটা সেই বন্ধুর হাতে দিয়ে আসতে চান- আমি সাথে গেলে ভাল হয়। আমি বসে থেকে কি করব, এক পায়ে খাড়া যাবার জন্যে। ভ্যান-গাড়িতে করে হাবড়া স্টেশনে এলাম, বনগাঁ আপ লোকাল ধরতে।

স্টেশনে আসতেই দেখি পিসেমশাই হড়বড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে ব্যস্ত, টিকিট না কেটেই। আমি একবার মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ইশারায় আমাকে চুপ করিয়ে দিলেন। উনি কোনও গরিব বা কিপ্টে মানুষ নন, আরবে থেকে ভালই রোজগার করেন। আমি তাঁর এই ব্যবহারের মাথামুণ্ডূ বুঝলাম না।
যা হোক, ট্রেন এল, আমরা উঠলাম এবং যথারীতি গোবরডাঙ্গা এলে নেমেও পড়লাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটছি, পিসেমশাই নিজেই মুখ খুললেন।

- জানি, তোর মনে খটকা লেগে আছে, তাই খুলেই বলছি ব্যাপারখানা। এই লাইনের বাসিন্দারা বারাসত বা শেয়ালদা না গেলে কেউ টিকিট কাটে না, এখানকার এটাই দস্তুর। এখন আমি যদি কাউন্টারে গিয়ে বলতাম, দুটো গোবরডাঙ্গা দিন, দাদা, পকেটমার বা ছিন্‌তাই পার্টি বুঝে যেত আমি এই অঞ্চলে নতুন। পকেটে পাঁচ হাজার নিয়ে বেরিয়েছি, রিস্ক হয়ে যেত রে, বুঝলি না......

আমি আর কি করি? তাই বললাম মনে মনে যা দু-আড়াই হাজার বছর আগে আলেকজাণ্ডার বলে গিয়েছিলেন সেনাপতি সেলুকাসকে!



ট্রৈনন্দিন- ২ ।।


৪ নং ডাউন কলকাতা মেল দাদারে এসে দাঁড়াতেই দেখি ফুলের মালা ইত্যাদি নিয়ে হৈ-হৈ কাণ্ড, রৈ-রৈ ব্যাপার। কি, না সি-আরের একজন চীফ ইঞ্জিনিয়ার সদ্য ডিজিএমে প্রমোটেড হয়ে চলেছেন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের দায়িত্ব নিতে। গাড়িতে ফার্স্ট এসি ছিলনা, তাই উনি এসি টু টায়ারেই চলেছেন আমাদের সঙ্গে।
তারপর ত প্রতি স্টেশনে মাল্যার্পণ ও অভিনন্দন, ভদ্রলোকও দেখলাম অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। আমার টিকিট ছিল ধানবাদের, চাপার আগেই খবর পেয়েছিলাম বাড়ির লোকজন সবাই গেছে আসানসোল, আমার মামাবাড়িতে কি একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। অগত্যা টিকিটখানা আসানসোল পর্যন্ত এক্সটেন্ড করাতে মনোযোগ দিলাম। ইতিমধ্যে আরেকজন রেলের অফিসার উঠেছেন জব্বলপুরে। তিনি বাঙালি, আসানসোলে কমার্শিয়াল সুপার। এদিকে আমি যতবার টিটিইকে ধরছি, তিনি কোনও না কোনও বাহানা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। শেষে চেপে ধরতে বললেন, 'মোগলসরাইয়ে ইস্টার্নের টিটিই চাপবে, তাঁকে বলুন'। অগত্যা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এদিকে মোগলসরাইএ একজন বাঙালি টিটিই চাপাতে একটু আশা জাগল, কিন্তু তিনিও হতাশ করলেন আমাকে। বললেন, 'আমার কাছে ত এক্সট্রা টিকিটের রসিদবই নেই, আপনি বরং ধানবাদে নেমে একটা আসানসোলের টিকিট কেটে নিন, ওখানে দশ মিনিট দাঁড়াবে'।
সে ত আমি জানিই। কিন্তু এক্সটেনশানে লাগবে দশ টাকা, আর ফ্রেশ টিকিট নিলে পঁচাত্তর। তাছাড়া, সময় অল্প, যদি ট্রেন ছেড়ে দেয়! ধরলাম ভি-আই-পি ভদ্রলোককে। উনি তখন ঘুমোবার তোড়জোড় করছেন, বললেন, 'দেখুন, আমি ত টেকনিক্যাল লোক, এ সব ব্যাপার ঠিক বুঝি না। আপনি বরং এনাকে ধরুন', দেখিয়ে দিলেন উনি কমার্শিয়াল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ভদ্রলোককে। উনি বললেন, 'হেঁ হেঁ, কোই পরোয়া নেই। আমি আসানসোলেই নামব কাল সকাল ন'টায়। আপনি আমার সাথে নেমে পড়বেন।'
ডিজিএম সাহেব বরাকরেই নেমে পড়েছিলেন। আসানসোল এল, আমরা দুজনেই নামলাম। 'হেঁ হেঁ, আপনি লোকো শেড হয়ে হাটন রোড বা গির্জা মোড়ের রাস্তা চেনেন ত। আমি হ্যাঁ বলতেই 'দেন ফলো মি' বলে লাইন ধরে এগিয়ে গেলেন । আমরা স্টেশন অতিক্রম করে লোকো শেডের ভেতর এসে পড়লাম।

'আপনার টিকিট জার্নি এক্সটেণ্ড করে টিটিইর ত কোনও লাভ নেই, হেঁ হেঁ', যেতে যেতে ভদ্রলোক কৈফিয়ৎ দিতে শুরু করলেন, 'তাছাড়া আমাদের সামনে সে কিছু চাইতেও পারবে না। কিন্তু টিসি-টিটিইদের ধর্মই হোল, হেঁ হেঁ, বুঝলেন কিনা, উপরি ছাড়া কোনও কাজ করা মানা, আমিও তো টিসি ছিলাম এক কালে। তাই সবদিক বজায় রাখতে মধ্যপন্থা বেছে নিলাম, হেঁ হেঁ, ঠিক করিনি?'



ট্রৈনন্দিন- ৩ ।।

শেষ দিন পর্যন্ত সবকটা রিজার্ভেশন কনফার্ম হল না। তবে যখন ব্যাণ্ডেল স্টেশনে কামরূপ এসে দাঁড়াল, দেখি আমারটা কনফার্ম, আমার স্ত্রী আর মায়ের টিকিট দাঁড়িয়েছে আর-এ-সিতে। তাও ভাল, কোচে ওঠা যাবে, নামিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই কারও। খোঁজাখুঁজি করে নির্দিষ্ট সীটে বসে জিনিষপত্র রাখতে রাখতেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

'হবে, হবে, অত অধৈর্য হচ্ছেন কেন?' মৃদু ধমক দিলেন কোচ কণ্ডাক্টার। দুটো এসি থ্রী-টায়ারের জন্যে একজন সিসি। বাঙালি, তবে নামটা আজ আর মনে পড়ছে না। 'আরে মশাই, আপনার তবু একটা কনফার্ম, দুটো আরেসি। অনেকের ত ওয়েটিংই ক্লিয়ার হয়নি। তাদের দেখতে হবেনা!' আমি ত হতভম্ব। বলে কি? ওয়েট-লিস্টেড প্যাসেঞ্জারের ত রিজার্ভ কামরায় ঢোকাই বে-আইনি। উনি দেখলাম অম্লানবদনে বাঁ-হাতে টাকা নিচ্ছেন আর ডান হাতে রিজার্ভেশন স্লিপ দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক, আমার কোনও কথা কানে না তুলে।

 এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। নবদ্বীপঘাট না কাটোয়া কি যেন একটা স্টেশন গেল। এবার একটু ফাঁকা পেয়ে ধরলাম ভদ্রলোককে। 'দেখুন, আপনি কিন্তু আর-এ-সি ক্লিয়ার না করে ওয়েট-লিস্ট কনফার্ম করে যাচ্ছেন। জানেন এটা বে-আইনি?' বললাম আমি। 'আমি জানি, তবে পরোয়া করি না', তাচ্ছিল্যের সাথে তিনি বললেন। 'তবু আপনি বাঙালি বলেই বলছি, আমি একটু ধর্মসংকটে পড়েছি।'
'লেন-দেন ছাড়া কাজ করলে অধর্ম হবে, তাই তো? ঠিক আছে, কত চান বলুন? যদিও আপনি কোনও ফেবার করছেন না, কিছু দেওয়ার কথাও নয়। তবু আমার মায়ের বার্থ বলেই দিচ্ছি' বলে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম। 'আপনি এখনও পুরোটা বোঝেননি', কণ্ডাক্টার বললেন। 'ধর্মসংকটের একদিকে আছে আমার চাকরি, অন্যদিকে মা। টাকা না নিয়ে কাজ করলে আমার শুধু লসই নয়, এ লাইনে অনেষ্ট বলে বদনামও হবে- কলিগদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। না না, আইন দেখাবেন না, আইনকানুন শুধু প্যাসেঞ্জারদের জন্যে, আমাদের জন্যে নয়। কিন্তু আমার মা আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছেন, ওরে কোনও মহিলার কাছে কখনও উপরি নিস নে। সে কথাও ত অমান্য করতে পারি না।'

'আপনার সাধুতা দেখে মুগ্ধ হলাম মশাই! সে কথা তো আগে বললেই পারতেন। ভালই হল, আমার মাও আমাকে অসৎ কাজ করতে মানা করেন।' এবার আমার বলার পালা, 'আপনার পকেটের ঐ এক্সট্রা  কলমটার দাম কত? আমাকে দিন না? এমনি দিতে হবে না, পঞ্চাশ টাকা অফার করছি। কলমটা আর কত হবে, পাঁচ টাকা?  আপনি অফিসে সগর্বে বলতে পারবেন পঁয়তাল্লিশ টাকা বাঁহাতে কামিয়েছেন। আর মা জানবেন পেন বিক্রি করেছেন।'

'আমি পাঁচ টাকার কলম পঞ্চাশ দিয়ে নিচ্ছি কেন? কেন, পাঁচকে মানুষ ভুল করে পঞ্চাশ পড়ে না? একটা শূন্যেরই তো হেরফের। এবার সীট দুটো লিখে দেবেন কি দয়া করে, ঘুম পেয়েছে...।'



ট্রৈনন্দিন- ৪ ।।

না, গল্পটা আমার নয়। আমি জ্ঞান হবার পর শুধু পুরুলিয়া-কোটশিলা ন্যারো গেজ লাইনই দেখেছি, তবে বাবার মুখেই শোনা যে ১৯১০ সালে চালু হবার পর পুরুলিয়া-রাঁচি-লোহারদাগা পুরো সেকশানটাই ছিল ন্যারো গেজ যার উপর দিয়ে কু-ঝিক-ঝিক করে যে রেলগাড়ি চলত তাকে বলা হত টয়-ট্রেন। বাবারা তাঁদের জ্যেঠু অর্থাৎ আমার বড়দাদুর বাসা রাঁচিতে ছুটিছাঁটায় যেতেন ঐ গাড়ীতে চেপে।
আমার ঠাকুমা আমাদের ছেলেবেলায় একটা ছড়া শোনাতেন-
'গড়গড়-গড়গড়ি চলিছে রেলের গাড়ি, জানালায় দিয়ে সারি রমণীরা দেখিছে-
ধন্য ধন্য সুকৌশল, পরিতপ্ত করি জল, বার করি বাষ্পানল বেগে কল ছুটিছে।'
জানিনা এটা এই ট্রেনের উদ্দেশ্যেই লেখা কিনা। বেগে ছোটার নমুনা সম্বন্ধে বাবা বলতেন-'এর জানলার পাশ দিয়ে, ওর বেগুন-ক্ষেতের বেড়ার গা ঘেঁসে, ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। খেলাগাড়ি বলে পাছে কেউ পাত্তা না দেয় তাই মাঝে মাঝেই সশব্দে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভার। মাঝে মাঝে তো এমন স্পীড তুলছে যে যখন-তখন নেমে পড়তেও ভয় লাগে। নামতে হয় কেন? বা রে, ট্রেনে বাথরুম নেই যে! স্টেশনে নেমে তো সবার সামনে করা যায় না।'
তা একদিন জোনা ষ্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে অনেকে খেয়াল করল- একি, গাড়ি পেছনে যায় কেন? কিছুটা খাড়াই আছে বলে মুরী-রাঁচি সেকশনে ডবল ইঞ্জিন লাগানো হয়, তবে কি একটা ইঞ্জিন কাজ করছে না? কেউ কিছু বুঝতে পারছে না, সবাই যেমন খুশি কল্পনা করে নিচ্ছে। সবছেয়ে ভয়ের ব্যাপার, যদি পাহাড় ঠেলে উঠতে না পারে আর ব্রেক ফেল করে, শেষে থামতে পারবে তো!
কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি থামল। গার্ড-সায়েব (সত্যিকারের সাহেব) নেমে গিয়ে নিজের টুপিখানা কুড়িয়ে নিয়ে এলেন, গাড়ি আবার সমুখপানে রওনা হল।



ট্রৈনন্দিন- ৫ ।।

পুরুলিয়া থেকে চেলিয়ামার পথে রুকনী-গোবিন্দপুর একজোড়া গা-লাগোয়া গ্রাম, যুগ্ম-গ্রাম যাকে বলে। গ্রাম ছোট হলেও বিখ্যাত, তবে এই খ্যাতি- না, পুলিশ-সুপার কাম জমিদার তেজচন্দ্র (আমার ঠাকুর্দার বাবা), রাঁচির পুলিশ সুপার হরিপদ (তাঁর বড় ছেলে), ট্রিপ্ল এম-এ, বিএল উকিল ভোলানাথ (আমার ঠাকুর্দা), ঝুমুর-কবি শ্রীপতি দত্ত, লেপ্রসির ডাক্তার সত্যনারায়ণ সরকার- এঁদের কারো জন্যে নয়। সত্যি বলতে কী, আশেপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষের চোখে এ গ্রামের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষটি ছিলেন রেলের আদ্রা ডিভিশনের গার্ডসাহেব শান্তি চক্রবর্তী। জানি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কথাটা সত্যি। তাহলে বরং একটা নমুনাই দিই।
গ্রামের মানুষ আমার বাবা, মটর কাকু (ডাঃ সরকার, যাঁর কথা আগেই বলেছি) আর সুবল ঘোষাল ছিলেন ছোটবেলাকার বন্ধু, যাকে বলে হরিহর-আত্মা। বাবা আর সুবলজ্যেঠু ছিলেন সিন্দ্রি সার কারখানায় আর মটরকাকু বাঁকুড়ার গৌরীপুর লেপ্রসি হাসপাতালের ডাক্তার, পরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে অবসর নেন। কয়েকদিনের ছুটি ছিল, বাবা পুরুলিয়া গেছিলেন, সেখান থেকে আদ্রা এসেছেন, মটর কাকু বাঁকুড়া থেকে আদ্রা। খবর পেয়ে সুবল জ্যেঠু সাইকেল নিয়েই দামোদর নদ পেরিয়ে চেলিয়ামা হয়ে পৌঁছে গেছেন আদ্রা জংশন, এবার একসঙ্গেই সকাল এগারোটার আদ্রা-গোমো প্যাসেঞ্জার ধরে দুই স্টেশন পরের রুকনী রওনা হবেন।
এটুকু ছিল ব্যাকগ্রাউন্ড। ট্রেন এসে দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। সুবলজ্যেঠুর সাইকেল ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে আরাম করে বসেছেন তিনবন্ধু মিলে। খুব আড্ডা জমেছে বহুদিন পরে তিনজন একত্তর হওয়াতে। কিন্তু এগারোটা বেজে গেল, গাড়ি ছাড়ে না কেন? একজন রেলের খালাসিগোছের কেউ ছুটে ইঞ্জিনের দিকে যাচ্ছিল, জিগ্যেস করায় বলে- শান্তিঠাকুর সিন্হা‌নে গেছেন!
তার মানে? শান্তিঠাকুর মানে গোবিন্দপুর গ্রামের শান্তি চক্কোত্তি রেলের গার্ড, সেটুকু সকলে জানে, বাকিটা বোঝা গেল না। কী ব্যাপার জানতে এঁরা তিনজনে এঞ্জিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আর একটি ছোকরা হন্তদন্ত হয়ে ড্রাইভারকে এসে জানাল- শান্তিঠাকুর খেতে বসেছেন। বোঝো কাণ্ড! প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন করে ভগ্নদূত আসে আর খবর দিয়ে যায়- ঠাকুর আঁচাচ্ছেন, ঠাকুর জুতা পরলেন। শেষে প্রতীক্ষার সমাপন, শেষ দূত এসে খবর দিল, শান্তি ঠাকুর আসছে-এ-এ-ন! শান্তি ঠাকুর (গ্রামের দিকে ব্রাহ্মণকে সম্মানার্থে ঠাকুর সম্বোধন করা হত) পান চিবোতে চিবোতে গার্ডের কেবিনে উঠলেন, ট্রেন ছাড়ল।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু কিছু নাটক তখনও বাকি ছিল। তিন বন্ধুর গল্প আর শেষ হয় না, রুকনী স্টেশনে নেমেও কথা বলতে বলতে এগিয়েছেন তিনজনে। গাড়ি ছেড়ে সাঁওতালডি অভিমুখে রওনা হল। গাড়ির শেষ কামরা পেরিয়ে গেল। হঠাৎ যেন সুবলজ্যেঠুর চমক ভাঙল। উনি দু'হাত তুলে 'থামাবে হে, থামাবে হে', বলে পাগলের মত ছুটতে থাকলেন গাড়ির পিছু পিছু। 'কী হে, ঘোষালঠাকুরের মাথাটাথা বিগড়ে গেল নাকি' বাবা অবাক হয়ে শুধোলেন মটর-কাকুকে। তিনি নিরুত্তর, তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন, 'কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু ওভাবে ছুটলে কি ট্রেন থামে, হলেই বা প্যাসেঞ্জার গাড়ি?'
কিন্তু গাড়ি থামল। ধীরে সুস্থে নেমে এলেন গার্ড-সাহেব। তাঁকে কিছু একটা বলে জ্যেঠু এগিয়ে গেলেন। তারপর হড়বড় করে কামরা থেকে নামালেন নিজের সাইকেলটি!
গাড়ি ছেড়েছে। 'এইবার বুঝলি তো সুব্লা‌, গাঁয়ের খুড়া-জ্যাঠা গার্ড হলে কত সুবিধা?'- চলন্ত ট্রেনের গার্ডের কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে কথাটা ছুঁড়ে দিলেন শান্তি চক্কোত্তি।



ট্রৈনন্দিন- ৬ ।।

কেউ ফেরে না
খাণ্ডোয়ায় ট্রেনটা থামতেই নেমে পড়লেন পুনর্বসু ভট্টাচার্য। এদিক ওদিক তাকালেন একবার। ঐ তো, অর্জুন গাছটা ঠিকই আছে প্ল্যাটফর্মের এককোণে, কিন্তু না আছে সেই ময়না পাখিটা, না গাছের তলার সেই কুকুরটা। তপনই বা কোথায় গেল? এসি কামরাটা দাঁড়ায় প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষে, একটা চা-ওলা শুদ্ধু মেলেনা সেখানে। আর থাকবেই বা কেন? বাবুরা ঠাণ্ডায় ঘুমোবেন বেলা পর্যন্ত, তার পর কেটারিং-এর বাসি স্যান্ডুইচ আর ঠাণ্ডা চা খাবেন আরাম করে। এই পুনর্বসুবাবুর মত দু-চারটে পাগলাটে লোকের জন্যেই বোধহয় তপনের দোকান চলত।

দুর্গাপুরের তপন চক্রবর্তী নিঃস্ব অবস্থায় খান্ডোয়া স্টেশনে কিভাবে এল সে এক অন্য গল্প। বুড়ো ঠেলাওয়ালা বুধন কুশোয়াহার দয়ায় তারই সাথে পাঁউরুটি সেঁকার কাজে লেগে পড়েছিল, সেও প্রায় সাত বছর হল। অপুত্রক বুধনের ঠেলাগাড়ি এখন তপনেরই, বুধনের বিধবা তার আম্মা। আগে এই বোম্বে মেলের শেষ বগিটা ছিল ভীড়ে ঠাসা জেনারেল, একদিন ছক বদলে এসি কামরাগুলো দিয়ে দেওয়া হল সেখানে, ঝপ করে সেল কমে গেল তপনের। তখন সে শুরু করল অমলেট বানানো, তাতে কিছুটা অন্ততঃ সুরাহা হল।

কিন্তু হল কি ছেলেটার, পুনর্বসুর একটু চিন্তা হয় বৈকি! তিনি জব্বলপুরে রেলের ইঞ্জিনিয়ার, তিন কুলে কেউ নেই, অকৃতদার, শখের মধ্যে ব্রিজ খেলা আর বংশসূত্রে পাওয়া সংস্কৃত-চর্চা। পুনর্বসু ভট্টাচার্যের সম্বন্ধে আমার এত কিছু জানার কথা নয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে জেনে ফেলেছি, একই ট্রেনের একই কামরায় বার তিনেক দেখা হওয়ার পর। তখন আমি মুম্বাইয়ের সমুদ্রে পেট্রোলিয়াম রিগে কাজ করি, দুই সপ্তাহ একটানা হাড়ভাঙা খাটুনির পর ধানবাদে বাড়ি ফিরি ওই ট্রেনের এসি টু-টায়ারে। বলা বাহুল্য, তেল কোম্পানি এই টিকিটটুকু কেটে দেয়। একদিন ট্রেনের বগিতে বসে ভাসরচিত 'মধ্যমব্যায়োগ'এর বাংলা অনুবাদ পড়ছি, উনি দেখে বললেন, 'মূল সংস্কৃতে পড়লে আরো ভাল লাগত।' বললাম, 'স্বীকার করছি, কিন্তু উপায় নেই। গীতগোবিন্দম বা মেঘদূত পড়ে তবু কিছু বোঝা যায়, ভাসের ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি। নেহাৎ পরশুরামের গল্পের ভীম আর হিড়িম্বার পুনর্মিলনের আসল ঘটনাটা পড়ার ইচ্ছে ছিল, তাই।'

উনি হাসলেন। বোঝা গেল আমাকে মনে ধরেছে। আলাপ হল। ব্রিজে আমারও খুব আগ্রহ, যদিও রেগুলার পার্টনারের অভাবে আজকাল আর খেলা হয়না। তারপর আমরা স্টেম্যান আর ব্ল্যাকউড নিয়ে মেতে উঠলাম। দেখলাম গোরেন আর ডরোথি হেডেন ট্রাসকটের লেখা বইগুলো ওঁর গুলে খাওয়া।

'আচ্ছা, আপনি গোমাংশ খেয়েছেন?' হঠাৎ প্রশ্নে আমি ঘাবড়ে গেলাম। 'আমি গোমাংশ খাই, এমনকি নরমাংসও।' বলাতে আমি কথা বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। পুনর্বসু হো হো করে হেসে উঠলেন। 'ভিরমি খাবেন না। ভাটপাড়ার বামুন আমি, 'স' ওলা গোমাংস খাওয়ার প্রশ্নই নেই। তবে অপভ্রংশ ভাষায় 'গোমাংশ' বলে একটা শব্দ আছে যার মানে ভাঙা গম বা দালিয়া- সংস্কৃত গোধূম থেকে বাংলায় গম হবার আগে 'গোম' হয়েছে, তারই 'অংশ'।'

'আর নরমাংস?' আমি ভয়ে ভয়ে বললাম।
'ওটা আর বললাম না। আপনার লেখাপড়ার শখ আছে, নিজেই খুঁজে নিন।' আর কিছু সেদিন বলেননি তিনি।
পুনর্বসু ভট্টাচার্যের সম্পর্কে এত কিছু বলার প্রয়োজন ছিলনা, শুধু মানুষটা খ্যাপাটে হলেও যে সম্পূর্ণ রীতি-বহির্ভূত একজন মানুষ, তা বোঝাতেই এত কথা।

তপনকে আমিও দেখেছি প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে ঠেলা নিয়ে পাঁউরুটি-ওমলেট বেচতে। নামটা বুকের ব্যাজে জামার উপর লাগানো ছিল বলেই সেটা জেনেছি। হ্যাঁ, সুদূর খান্ডোয়ায় হঠাৎ একটা বাঙালি ছেলে দেখে আমিও অবাক হয়েছি একটু। তবে ভেবেছিলাম নিশ্চয় ব্যাটা কিশোরকুমারের ফ্যান, এসেছিল দেখা করতে, আর ফিরতে পারেনি। এরকম তো অনেক হয়। তবে পুনর্বসু মানুষটাই আলাদা। বারবার অফিসের কাজে ভুসাওয়াল যেতে-আসতে প্রতিবার দেখা এই নিঃসহায় ছেলেটার প্রতি ওঁর একধরণের মায়া পড়ে গেছিল। ওকে নিজের সাথে নিয়ে যেতেও চেয়েছেন, তপনই রাজী হয়নি। এদিকে গাড়ি ছাড়ছে। উনি কি ভেবে কামরা থেকে ব্যাগটা নামিয়ে গাড়ি ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর এগিয়ে গেলেন।

ঠিক ট্রেন ছাড়তেই দেখা গেল তপনের ঠেলা। 'ওরে অকাল-কুষ্মাণ্ড, কুঞ্জকুঞ্জর, বন্যবরাহ, দস্যু-বর্বর!' বলতে বলতে পুনর্বসু তপনের হাতদুটো ধরলেন। 'আমি তোর খোঁজে গাড়ি ছেড়ে দিলুম, আর তুই ব্যাটা স্কন্ধকাটা আমাকে ফাঁকি দিতে এখানে এসে বসেছিস!'

'কি করছেন জ্যাঠাবাবু, লোকে দেখছে। এখন আর গাড়ি নেই, চলুন পুরোন জায়গায় গিয়ে বসি'- ওরা এলো সেই অর্জুন গাছটির নীচে। 'আচ্ছা জ্যাঠাবাবু, আপনার কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি কিসের নেশায় আমি স্টেশনের এই এককোণায় এসে ঠেলা লাগিয়ে বসে থাকতাম'?

'কি আবার, তুই তো আমার ব্যাটা, আমারই মত পাগল!'
'অনেকটা তাই বলতে পারেন। এখানে এসেই আমার চোখে পড়ে এই গাছটা, ওই ময়না পাখিটা যে মাঝেমধ্যেই মিষ্টি গলায় শিস দিয়ে উঠত আর গাছের তলায় নেড়িকুত্তাটা সারাক্ষণ মুগ্ধ হয়ে পাখিটাকে দেখত। আপনাকে আবার বলছি, জ্যেঠাবাবু, আমি ওদের কেউ নই, কিন্তু ওই দুটিকে ছেড়ে বেশিক্ষণ কোথাও গিয়ে টিকতে পারতাম না। পাখিরা কদ্দিন বাঁচে জানি না, একদিন ময়নাটা ফট করে মরে গেল। কুকুরটা তিন-চারদিন কোথাও নড়ে নি, আমি পাঁউরুটি দিলে খেত না, তারপর জানিনা কোথায় চলে গেল। তারপর আম্মাও গেল দু'মাস আগে, এখন আর শহরে আমার নিজের বলতে কেউ নেই'- একটু যেন রুক্ষ শোনাল তপনের গলা, কান্না শুকিয়ে গেলে যেমনটা হয় মানুষের।

'তবে আর দেরী কিসের? আমিও একা, তুইও একা। আমার সঙ্গে চল, পড়াশুনা করবি, তারপর রেলে ঢুকিয়ে দেব, কেমন?'

'যাব, জ্যাঠাবাবু। তবে একবার বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসি। তারপর নিশ্চয়ই যাব।'

মাসছয়েক পরে পুনর্বসুর সঙ্গে আবার দেখা, সেই একই কামরায়, তবে ডাউন ট্রেনে, খান্ডোয়ায় চাপলেন এসে। 'স্যার, নরমাংস নিশ্চয় মানুষের মাংস নয়। ভেবে দেখলাম নরম আর অংস, মানে কাঁধ, সন্ধি হয়েও তা হয়, ছাগলের নরম কাঁধ খাওয়াও যায়।'
তবে এত কিছু বলা পরেও ওঁর কোন ভাবান্তর দেখলাম না। 'স্যার, তপনের কী খবর?' শুধোলাম, 'ওর ঠেলা আজকাল দেখিনা!'

'নাঃ কোন খবর নেই। কেউ কথা রাখে না, কেউ ফেরে না।' নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন উনি।


পুনর্বসু প্রতিবার ভুসাওয়াল যাওয়া-আসার পথে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন খাণ্ডোয়া স্টেশনের দিকে। নাঃ, তপনের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে- সাক্ষী থাকে নীরব একটি অর্জুন গাছ।

Posted by Pallab Chatterjee at 3:56 AM No comments:
Email ThisBlogThis!Share to XShare to FacebookShare to Pinterest
Newer Posts Older Posts Home
Subscribe to: Comments (Atom)

Blog Archive

  • ►  2022 (8)
    • ►  June (3)
    • ►  May (1)
    • ►  April (3)
    • ►  March (1)
  • ►  2021 (11)
    • ►  July (2)
    • ►  June (2)
    • ►  May (4)
    • ►  March (3)
  • ►  2020 (20)
    • ►  December (2)
    • ►  November (1)
    • ►  October (1)
    • ►  August (2)
    • ►  July (3)
    • ►  June (1)
    • ►  May (5)
    • ►  April (4)
    • ►  January (1)
  • ►  2019 (40)
    • ►  December (2)
    • ►  November (5)
    • ►  October (11)
    • ►  September (4)
    • ►  August (16)
    • ►  January (2)
  • ►  2018 (12)
    • ►  November (2)
    • ►  October (1)
    • ►  April (9)
  • ►  2017 (25)
    • ►  December (3)
    • ►  October (2)
    • ►  August (5)
    • ►  May (1)
    • ►  March (2)
    • ►  February (12)
  • ►  2016 (10)
    • ►  September (1)
    • ►  July (1)
    • ►  May (8)
  • ►  2015 (30)
    • ►  December (4)
    • ►  August (2)
    • ►  July (10)
    • ►  May (4)
    • ►  January (10)
  • ▼  2014 (45)
    • ▼  December (2)
      • লাউডগা ।।(গল্প)ছোটবেলায় আমরা থাকতাম বিহারের একটি ...
      • বিশেষ রচনা- ট্রৈনন্দিন ১-৫ ।।
    • ►  November (15)
    • ►  August (4)
    • ►  June (2)
    • ►  April (12)
    • ►  February (10)
  • ►  2013 (41)
    • ►  December (5)
    • ►  October (36)

About Me

Pallab Chatterjee
View my complete profile
Simple theme. Powered by Blogger.