Monday, December 8, 2014

লাউডগা ।।
(গল্প)

ছোটবেলায় আমরা থাকতাম বিহারের একটি সুন্দর ছোট শহরে। পাকাবাড়ি, বাঁধানো রাস্তাঘাট, ইলেক্ট্রিকের আলো-পাখা আর বাজার-হাট-ক্লাব-হাসপাতাল-কারখানা ছিল বলেই শহর, তা নইলে প্রকৃতি ও নির্জন পরিবেশের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তাকে গ্রাম বলাই ভাল। সে শহরে যেমন ছিল সার ও সিমেন্টের নামকরা কারখানা, ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, তেমনি ছিল একদিক দিয়ে কুলুকুলু করে বয়ে চলা দামোদর নদ, অজস্র মাঠ, পুকুর ও গাছপালা-ঝোপঝাড়। পুটুস বলে একরকম খুব ছোট-ছোট ফল ফুটে থাকত বাগানের বেড়ার গায়ে গায়ে, পাকলে ওগুলো কালো হয়ে যেত আর কি মিষ্টি লাগত খেতে। অবশ্য বাবা-মাকে লুকিয়ে খেতে হত, কারণ তাঁদের মতে ওগুলো ছিল অখাদ্য নিষিদ্ধ ফল। এছাড়া গোপাল বলে নলখাগড়া জাতীয় একরকমের অসংখ্য আগাছা ছিল চারপাশে। কারো কোনও কাজে না লাগলেও আমরা তার নরম অথচ মজবুত ডাল ভেঙে গোবর-ডান্ডা বলে একরকমের খেলা খেলতাম। মোটকথা নাম-কে-ওয়াস্তে শহরে বাস করলেও পুকুর-মাঠ-নদী-গাছপালা এরাও ছিল আমাদের খেলাধুলার অন্যতম সঙ্গী।

আমরা কারখানার অফিসার কলোনিতে থাকলেও প্রত্যেককে বাগান করার জন্যে যথেষ্ট জমি দেওয়া হয়েছিল কোয়ার্টারের লাগোয়া। অনেকে তাতে করতেন ফুলের চাষ, কেউ বা সুন্দর ঘাসের লন। আমাদের বাসার সামনের দিকে ফুল ও লন থাকলেও বাগানের পেছন দিকে ছিল বেশ কিছু বড় গাছ, যেমন সজনে, আম, পেয়ারা আর টোপাকুল। বলা বাহুল্য, আমাদের ছোটবেলাটা মাটিতে কম আর গাছে গাছেই বেশী কেটেছে। আমার এক পিসতুত দাদা খোদনদা ডাক্তারি পড়ত, মাঝে মাঝে বেড়াতে এলেই শাসিয়ে যেত। বলত, জানিস, ডারউইন সাহেব বলেছেন মানুষ আগে বাঁদর ছিল, গাছে গাছে ঘুরে বেড়াত। তারপর যখন সভ্য হয়ে গাছ থেকে নেমে এল, অমনি লেজ পড়ল খসে, ওরা মানুষ হয়ে গেল। আমার তাই শুনে একটাই ভয় হত। মাঝে মাঝে পেছনে হাত দিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতাম কি জানি অজান্তে লেজ বেরিয়ে গেল কিনা। 

পেয়ারাগাছ। কুলগাছের কথাও বলেছি, কিন্তু কাঁটা ছিল বলে তাতে চড়া যেত না, তাই আমি আর গণেশ ঢিল ছুঁড়েই কুল পাড়তাম। সেদিকে ছিল আর এক বিপদ। ঢিল প্রায়ই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পেছনের নিন্নিদের বাসায় চলে যেত আর নিন্নি এসে রেগেমেগে পাঞ্জাবি ভাষায় ঝগড়া করত। তাই বিশাল পেয়ারাগাছটাই ছিল আমাদের বন্ধুদের দলের শীতের দুপুরের আড্ডা। আমাদের গাছটাতে প্রায় সারাবছরই মিষ্টি পেয়ারা ফলত, তবে গরমকালে তার স্বাদই হত আলাদা। পাকা পেয়ারার লোভে উড়ে এসে জুড়ে বসত যতরাজ্যের টিয়াপাখি, আমাদের কম্পিটিশন ছিল তাদের সাথে। আর ছিল শুঁয়োপোকা, গায়ে লাগলে আর রক্ষে নেই, জ্বালিয়ে মেরে দেবে। আবার তারা কদিন পরেই ছোট্ট কাঠের টুকরোর বাক্স বানিয়ে তার ভেতর ঢুকে পড়ত, আমরা জানতাম, ছমাস পরে তারা বেরিয়ে আসবে সুন্দর  সুন্দর রংচঙ্গে প্রজাপতি বা মথ হয়ে। তবে সেই পেয়ারাগাছেই ছিল আরেকজাতের অতিথি, যাদেরকে প্রায় দেখাই যেত না, অথচ তাদের উপস্থিতি দস্তুরমত টের পেয়েছিলাম একবার, আসছি সে কথায়। 

দেখা যেত না শুনে কি তোমরা ভাবছ ভূত? আরে না না। দেখা না যাওয়ার আরেকটা প্রাকৃতিক কারণ আছে যাকে ইংরেজিতে বলে 'ক্যামুফ্লেজ' (camouflage)। জন্তু-জানোয়ারদের শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে বা শিকার ধরার সুবিধের জন্যে এটা একটা প্রকৃতির দেওয়া বিশেষ সুবিধা। যেমন বাঘের হলুদ-কালো ডোরা ঝোপেঝাড়ের রঙের সাথে খাপ খাওয়ায় বাঘ সবার সামনে থেকেও লুকিয়ে থাকতে পারে। বহুরূপী গিরগিটিরা তো পরিবেশের রঙের সাযুজ্যে নিজের গায়ের রঙই বদলাতে থাকে তাই তাদের chameleon বলা হয় ইংরেজিতে। তা এতসব আগে জানা থাকলে কি এরকম হত সেদিন আমার সাথে? অন্যদিনের মতো পেয়ারাগাছে চাপার পর দেখি উপরের ডালে মস্ত একটা ডাঁশা! পেয়ারার গুণগ্রাহীরা জানবে সত্যিকারের ডাঁশা পেয়ারার স্বাদ পেতে দেবতারাও মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাইবে। অগত্যা আমিও তরতরিয়ে উপরের ডালে উঠতে থাকলাম। পেয়ারার ডালের বিশেষতঃ এই যে ওগুলো বাশ চিমড় হয়, একটা সরু ডালের উপরও উঠে দাঁড়ান যায়, ভেঙে পড়ে না। কিন্তু বিপদ এলো অন্য দিক থেকে। হঠাৎ যেন একটা সবুজ বিদ্যুৎ চোখের উপর ঝলসে উঠল, আর তার পরেই বাঁ হাতের কব্জির ওপর অসহ্য ব্যথা। গাছের উপর থেকে কোনও মতে পড়ে যাওয়া থেকে সামলে নিয়ে ওই সবুজ বস্তুটা নিয়েই তরতরিয়ে নেমে এলাম। তখন চোখে পড়ল জিনিনান।গাছের ডালের সাথে রং এমন ভাবে মিলিয়ে ছিল যে এতও কাছে থেকেও চোখে পড়ে নি। একটা লাঊডগা সাপ! ব্যস, মুহূর্তেই আমি অজ্ঞান।

বন্ধুরা তো ভাবল আমি মরেই গেছি। ভাগ্যিস সেই সময় খোদনদা গরমের ছুটিতে এসেছিল, এক বন্ধু বুদ্ধি করে তাকেই ডেকে নিয়ে এল। সাপটাকে ততক্ষণে সাহসী বন্ধুরা মেরে ফেলেছে। দেখে খোদনদা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ও, Vine snake. চিন্তার কিছু নেই, কিছু হবেনা। না, না, বাঁধন দেওয়ারও দরকার নেই। স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছি, আর এককাপ গরম দুধ- ওতেই সেরে যাবে। আহা, তোরা নিরীহ সাপটাকে মেরে ফেললি, আরে ওদের বিষ থাকে না। দাঁড়া তোদের একদিন food chain system টা বোঝাতে হবে, তবে যদি কিছুটা শিক্ষা হয়!
- তাহলে ও অজ্ঞান হয়ে গেছল কেন, খোদনদা, তোতোন জিগ্যেস করল।
- সে তো ভয়ে, যখন বুঝতে পারল ওকে সাপে কামড়েছে। কি রে, ঠিক বলি নি? শেষ প্রশ্নটা আমাকে, ততক্ষণে উঠে বসেছি। আর যদি বিষ থাকতোই, তোদের ঐ বাঁধনে কাজ হত কচু।
- কেন আমরা তো কামড়ের জায়গার দু-তিন ইঞ্চি ওপরেই বাঁধছিলাম, একজন উত্তর দিল।
- দূর বোকা, বাঁধন যদি শিরায়চেপে না বসে কি লাভ তাতে। কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত এক জোড়া হাড় গেছে, তাদের নাম ulna আর radius, বিষাক্ত রক্তের শিরা যদি অবস্থান দুটোর মাঝে থাকে, তবে যত চেপেই বাঁধো, শিরায় চাপ পড়বেনা কিছুতেই।
- তাহলে কি উপায়?
- উপায় আছে। কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত গেছে একটি মাত্র হাড়, humerus, অতএব সেখানে বাঁধন দিলে হাতের যে কোনও শিরায় চাপ পড়তে বাধ্য। যাক্‌ গে সাপ মরল, লাঠিও ভাঙ্গল না, কিন্তু আমার ফী কে দেবে?
- আমার কাছে তো পয়সা নেই, বাবাকে বলব।
- ওরে বাবা, মামার কাছে চাইবি আমার ফী, তুই আমার মামাবাড়ি আসা বন্ধ করবি দেখছি। যা, যেটা দেখেছিলি, ওই পেয়ারাটা পেড়ে এনে আমায় খাওয়া, তাহলেই হবে।
- আবার চাপব গাছে? আমি ভয়ে ভয়ে শুধোলাম।
- আলবাত চাপবি, একশোবার চাপবি...দেখলি তো লাউডগা সাপের কোনও বিষ নেই। তাছাড়া ওই কবিতাটা আছে না, 'কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে...' , তারপরের লাইনটা কি যেন? কই, বলনারে!

কে বলবে? আমি তো ততক্ষণে গাছের মগডালে!

৮ই ডিসেম্বর, ২০১৪।
 


No comments:

Post a Comment