Friday, May 1, 2015

বাংলা ছড়া - পেটুকের বারমাস্যা ।।

পেটুকের বারোমাস্যা ।।


বৈশাখে শাঁখ বাজে বৈকালে শোন তা
ঝড়ে পড়া আম খাই দিয়ে ঝাল নোনতা।
জৈষ্ঠেতে জষ্টির মধু খাই টাটকা  
সাথে কাঁঠালের কোয়া কিছু আল-টপকা।

আষাঢ়ে অসাড় দেহে বসে খাই মিষ্টি
ঝরঝর বরিষণ, একটানা বৃষ্টি।
শ্রাবণে বনের মাঝে ময়ুরের নৃত্য
আনারস রসধারে ভরে ওঠে চিত্ত।

ভাদ্রটা অভদ্র প্যাচপেচি গরমে
তালবড়া নাহি পেলে রাগ ওঠে চরমে।
আশ্বিনে অশ্বটা ছুটিয়ে বাজার ধাই
পুজোয় খিচুড়ি ভোগ চুটিয়ে দেদার খাই।

কার্তিকে কার দিকে ছুটব তা বল না
দেওয়ালির লাড্ডু সে শুধুই কি ছলনা?
অঘ্রাণে কার ঘ্রাণে ভুলি সব চিন্তা!
নলেন গুড়ের টানে নাচে মন ধিন তা।

পৌষে আউশ কাটি, মাতি পিঠে পরবে
উঠোনে মরাই বাঁধা, বুক ফোলে গরবে।
মাঘেতে শীতের ভয়ে পালায় পালাক বাঘ
লেপমুড়ি মাখা-মুড়ি-- কি খাওয়ার অনুরাগ।

ফাল্গুনে কালগুনে দেখি যে সময় নাই
বসন্ত জাগ্রত যাহা পাই, তাহা খাই।
চৈত্রের রাত্রের কি বাহার ভাব রে,
মহুয়ার নেশা ভাঙ্গে নববর্ষ ভোরে।


নববর্ষ, ১৪২২ সাল।

বাংলা কবিতা - আজাদী ।।

আজাদী ।।

আজাদী-স্বরাজ সব জেনে গেছি, তার মানে ভাত নুন,
আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, ওরে তাকে বলে পোড়া বেগুন।
এলো গেল কত পনের আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারী,
দু-দিনই আমরা রাস্তার মোড়ে পতাকা বিক্রি করি।
আমি আর ভাই তিনশ বেচেছি, ফারুক-আসিফ দুশ,
সাত দিন পেট ভরে তো খেয়েছি, যতই মোদের দূষ।
তাকেই তো বলে স্বাধীনতা যাতে মেটে এ পেটের আগুন,
দু'বেলা দু থালা ভাত-ডাল, কিছু নুন আর পোড়া বেগুন!

১৮ই এপ্রিল, ২০১৫, কুয়েত।

বাংলা অণুগল্প ৪১ ।। মরুবিজয় ।।

মরুবিজয় ।।

পুরুলিয়ার দাঁদা গ্রামের রূপলাল মাঝি ছিল আমাদের ভাগীদার। না, সে অঞ্চলে অনাবাসী জমিদার খুব একটা না থাকায় তেভাগার আঁচ সেরকম লাগে নি, মালিক-ভাগীদার সম্পর্ক ভালই ছিল। তাছাড়া খাটতে পারত বলে দাদু তাকে গোবিন্দপুর পাঠশালার বাগানের দায়িত্বও দিয়েছিলেন, তাতে খানিকটা হলেও অতিরিক্ত একটা আয় থাকত। এছাড়া আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল রূপলালের। প্রহ্লাদ বাউরির ঝুমুর গানের সাথে তার মাদলে সঙ্গত সেইসময় আর পাঁচটা গ্রামে নাম কুড়িয়েছিল। একদিন বন মহোৎসবের উপলক্ষ্যে ওদের ডাক পড়ল শান্তিনিকেতনে। নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কিন্তু রূপলালের মনে তার প্রভাব পড়েছিল।
আমরা আজ যাদেরকে 'পেগানিস্ট' বলে বিশেষ সম্মান করি, আবার গালাগালও দিই, এই দেশেরই কিছু উপজাতির মানুষরা কিন্তু বংশ-বংশান্তরে, হয়ত অবচেতনাতে প্রকৃতিদেবীর একনিষ্ঠভাবে উপাসনা করে আসছে। ওখানে প্রহ্লাদের ঝুমুর বেশ জনপ্রিয় হয় বটে, তবে ফিরে আশার পর রূপলালের প্রথম প্রশ্নটা দাদুকেও বিস্মিত করে তোলে। ও জানতে চেয়েছিল-'মরুবিজয়ের কেতন' মানে কি? তারপরেই ও মাঝে মাঝে শহরে চলে আসত আমার বাবার কাছে 'মাটি পরীক্ষা', 'সয়েল প্রিজার্ভেশান' ইত্যাদি সম্বন্ধে গভীরভাবে জানতে। বাবা তাকে সয়েল টেস্টিং ল্যাবে নিয়ে গিয়ে লোম ও অ্যালুভিয়াল সয়েলের বিশেষত্ব, টপ সয়েল নষ্ট হবার কারণ ও তার পরিণতি, কম্পোস্ট, ইউরিয়া, সুপার ফসফেট ইত্যাদি সারের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার বেশ যত্নসহকারে বোঝাতেন।
তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। বহুকাল পরে এসেছি গ্রামে। সঙ্গে কাকা, সদ্য ইটালি থেকে ফিরেছেন, হাতে একটা নতুন ধরণের যন্ত্র- একটা স্পুল টেপ-রেকর্ডার। খবর পেয়েই প্রহ্লাদ আর রূপলাল এসে হাজির, বেশ কিছু ঝুমুর গান রেকর্ড করা হল। বিকেলে রূপলাল আমাদের নিয়ে বেরোল। কি আশ্চর্য সবুজ চারিদিকে! দাঁদার মরা জঙ্গল থেকে যে টাঁড় জমি লালপুর হয়ে মৌতোড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সব সবুজ হয়ে গেছে গাছে গাছে। এত গাছ কে লাগাল? উত্তরে শুধু মৃদু হাসে রূপলাল মাঝি। 'ফরেস্টের রেঞ্জার সায়েব বাধা দিয়েছেন, কিন্তু খুড়ার ধমক শুনে আর কিচ্ছুটি কইতে পারেনি। তবে জঙ্গলটা চেলিয়ামা রেঞ্জের দখলে এখন, আমাকে অবশ্য আর কিছু বলার সাহস পায় না ওরা।' বুঝলাম শান্তিনিকেতনের মরুবিজয়ের কেতন ওড়ান দেখেই এই রূপলালের নবজন্ম। বিস্তীর্ণ হাজার একর জমিকে সবুজ করে তুলে ওর নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।
গতকাল মৃত্যু ঘটেছে পদ্মশ্রী রূপলাল মাঝির। আমি নিজে গিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছি। এবার থেকে তিনি বসবেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ, পরিবেশ মন্ত্রকের উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। তবে মহীরূহ মরলেও তার শেকড় থেকে জন্ম নেয় আরো অসংখ্য তরুলতা, তাই ক্ষীণ হলেও কিছুটা আশা রাখি পরবর্তী প্রজন্মের উপর।

২৪শে এপ্রিল, ২০১৫, কুয়েত।

বাংলা অণু-গল্প ৪০ ।। এ কি প্রেম নয়!

এ কি প্রেম নয়!
অণু-গল্প


'শোনো, তুমি বরং চাকরিটা ছেড়েই দাও। চুল-দাড়ি গেলে আর শিখদের কি রইল, শুনি?' অনুযোগের সুরে বলল সুরিন্দর। শুনে ঈশ্বর একটু মুচকি হাসল শুধু।
' না, তবু সিরিয়াসলি ভাব একটু। ধর্ম বেচে রুটি খাওয়ার কথা কি আমাদের জাতে কেউ কোনদিন শুনেছে? অন্য কোথাও কিছু পাওয়া যায় না কি?' এবার একটু ঝাঁঝ পাওয়া গেল সুরিন্দরের কথায়।

ঈশ্বরের বাবা উত্তম সিংহ গিল কাজ করতেন ওমানের তেলের খনিতে, ওয়ার্কওভার অপারেশনস বিভাগে। সেদিনও রুটিনমত টিম নিয়ে বেরিয়েছিলেন ওয়েল ইন্সপেকশনএ। সোহারের ৩১২ নম্বর কুপের একটা লিকেজের রিপোর্ট ছিল। উত্তম সেলার পিটের উপর থেকেই গেজে ৩০০০ কিলোপাস্কলের মত প্রেসার দেখতে পাচ্ছেন। 'দেখা যাক, ব্লিড করা যায় কিনা' এই বলে তিনি ব্রিদিং মাস্ক পরতে লাগলেন।
'স্যার আপনি কেন নাবছেন, আমি গিয়ে দেখছি'- সর্বনা বলে ওঠে।
'আরে ছড ইয়ার, পাঞ্চ মিটার থললে হি তো জানা হ্যায়, অভি হো আতা হুঁ।' বলে নেমে পড়লেন উত্তম।
ভালভ খুলে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তো আছেনই, কি হলো স্যারের- সর্বনা আর গুপ্তে হাঁ করে ভাবছে। হঠাত কি ভেবে গুপ্তে বলল, 'ম্যায় জাতা হুঁ, তু ভি আ'.......মাস্ক পরে তৈরী হয়ে নিল তারা।
আজ ঘটনাটার ছয় বছর হয়ে গেল, ভাবছিল ঈশ্বর। সেই সকালে উত্তমের অচেতন দেহটাকে দুজনে মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। প্রচুর পরিমানে হাইড্রোজেন সালফাইড নি:শ্বাসের সাথে রক্তে মিশে মৃত্যু ঘটে তাঁর। লম্বা চুল-দাড়ি থাকায় ব্রিদিং মাস্ক সীল করেনি, এই হলো সেফটি কমিটির রিপোর্ট। ওরা অবশ্য অম্রুতা অর্থাত উত্তমের স্ত্রীকে একটা কেরানির চাকরি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ঈশ্বর তখন স্কুলের পরীক্ষায় ভাল ফল করে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকে পড়ায়, তিনি পরিবর্তে ছেলের ভবিষ্যতে উপযুক্ত চাকরির কথাটা আদায় করে নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। আজ অম্রুতাও ইহলোকে নেই। ক্যানসার ধরা পড়তেই অপরিণত বয়েসেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী দেখে তিনি গেছেন।

ঈশ্বরের সাথে ছেলেবেলা থেকে প্রেম সুরিন্দরের। বিয়ের পর থেকে ওরা কাছছাড়া হয়নি কখনো। এই চাকরিটা সে নিয়েছে কারণ শুধু মাইনে বেশি বলেই নয়, সুরিন্দর সাথে থাকতে পারবে।তাছাড়া মায়ের চিকিত্সায় বেশ কিছু ধারও হয়ে গেছে. যদিও অয়েল-ফিল্ডে কাজ বলে কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী তাকে দাড়ি কেটে 'মোনা' হতে রাজি হতে হয়েছে। তারপর আজ গিয়ে চুল-দাড়ি কেটে, মাস খানেকের মধ্যেই যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

পরদিন সকাল থেকেই মন খারাপ সুরিন্দরের। 'আরে বাবা আজই তো যাচ্ছি না। আর তাছাড়া তুমিও ত যাবে সাথে, তাই না', সান্ত্বনা দেয় ঈশ্বর। আজ সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে সে। চুল শুকনো, বাঁধার বালাই নেই, ফটাফট তৈরী, এবার ভিসার জন্যে ফটো তুলতে যাবে সে। পাসপোর্টে যদিও একজন শিখ যুবকের ছবি আছে, তবু ভিসা পেতে অসুবিধা হবেনা, ওরা জানিয়েছে। কিন্তু সুরিন্দর একটানা কেঁদেই চলেছে, তাকে বোঝায়, কার সাধ্যি!
কথায় বলে মেয়েদের মনের কথা স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝতে পারেন না, আর ইনি তো নামেই ঈশ্বর। ও কি করে জানবে, কাল পর্যন্ত যে সুরিন্দর কাছে না থাকলে তার চুল ধোয়া, শুকোনো, পরিপাটি করে আঁচড়ে দেওয়া, পাগড়ি পাট করতে সাহায্য করা কিছুই হত না, আজ সে কর্মহীনা। সে যে দশ মিনিটে একা একাই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল, এটা সুরিন্দর মাত্র দু-বছরের বিবাহিত জীবনে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

(একটি পাঞ্জাবি গল্পের ছায়া অবলম্বনে)