Monday, August 31, 2015

Bengali Humor- যাচ্ছেতাই ।।

যাচ্ছেতাই ।।
(১)


কিছু কিছু লোক আছেন যাঁরা মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে এমন অনেক কথা বলে যাবেন, শুনে মনে হবে সেসব বিশ্বের গভীরতম রহস্য ও তার সন্ধান একমাত্র তিনিই জানেন। পরে একটু চিন্তা করলেই সব ভড়ং বোঝা যায় কিন্তু সেই মুহূর্তে অন্য কিছুই আর মাথায় আসেনা। এরকম একজন ছিলেন আমার বিশ্বেশ্বর ওরফে বিশুমামা।
বিশুমামার গানবাজনার খুব শখ ছিল। নিজে কতটা বুঝতেন জানি না, তবে আনকোরাদের ভড়কি দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। 'সেবার রাজাভাতখাওয়া সংগীত উৎসবে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা'- এইরকম একেকটা চমক দিয়ে শুরু হত তাঁর গল্প। আমি হয়ত রাজাভাতখাওয়া জায়গাটা কোথায় তা জানতে চেয়েছি, কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে মামা বলতেন- 'সে এক মজার জায়গা। পৃথিবীর সব রাজাদের অন্নপ্রাশন হত সেখানেই। তা এরকম একটা জায়গার সংগীত সম্মেলন বলে কথা। ওস্তাদ আর পণ্ডিতদের বিশাল জমায়েত হয়েছে।'
- আচ্ছা মামা, এই ওস্তাদ আর পণ্ডিতের মধ্যে তফাৎ কি? দুজনেই তো গান গায়!
- হ্যাঁ, তফাত তো সুকুমারবাবুই বুঝিয়ে গেছেন, পড়িসনি? 'ওস্তাদেরা লেপমুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে,/ টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে?' ইতিমধ্যে কানু আমাকে বোঝাতে লেগেছে যে মুসলমান গায়কদের ওস্তাদ আর হিন্দু গায়কদের পণ্ডিত বলে। ব্যাপারটা বিশুমামার নজর এড়ায় নি। 'হ্যাঁরে কানু, ওস্তাদি করছিস, না পণ্ডিতি ফলাচ্ছিস? দুটোই কিন্তু এখানে নিষিদ্ধ।' যাক, ব্যাপারটা শেষমেষ ভালয়-ভালয় মিটে গেল। বিশুমামার গল্প আবার শুরু হল।
- সে অনুষ্ঠানে লোকজন কিন্তু ভালই হত। গায়ক-বাদকরা দূর দূর থেকে আসতেন। শুধু হিন্দুস্থানী নয় কর্ণাটকি পণ্ডিতরাও আসতেন দক্ষিণ দেশ থেকে।
আমি আবার জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম কর্ণাটকি নিয়ে কিছু একটা। সুজয় কানে কানে বলল, 'আরে করিস কি! এখনি বলে দেবে যারা নাটক করে তারাই কর্ণাটকি।' শুনে আমি চুপ করে গেলাম।
- সেবার এক পণ্ডিত এসেছেন উলানবাটোর থেকে। এদেশের শাস্ত্রীয়সংগীতে তাঁর বেজায় দখল। বলেন, ওঁদের গ্রামটা নাকি ধারোয়ারের কাছে, কর্ণাটকি আর হিন্দুস্থানী দুই ধারাই সমান চলে সেখানে। এতগুলো গায়ক-বাদক দেখে তো তিনি রেগে কাঁই। বলেন, 'আজীব বাত হ্যায়। একা আমিই তো রাতভর টানতে পারি, বাকিরা তবে কি করবে, হাঁ? এক-আধ ঘন্টে মে ক্যা হোতা হ্যায়? আরে ভাই শাস্ত্রীয় সংগীত কো ক্যা সমঝ রাখা হ্যায় তুমলোগ!'
এই শুনেই তো অর্গানাইজারদের হয়ে গেছে। সর্বনাশ! বিসমিল্লা, করিম খাঁ, শিবকুমারের মত তারকারা রয়েছেন আজ রাত্রে। তাঁরা তাহলে কি করবেন? যথারীতি বিনয়ের সাথে একটু ভেবে দেখতে বললেন তাঁরা। জবাবে পণ্ডিত কি বললেন ঠিক বোঝা গেল না। উনি শুধু বললেন, আমি রাগরাগিনী ঘড়ি ধরে গাই। সন্ধ্যার পূরবী দিয়ে শুরু করব, আর সেই রাগের সময় পেরিয়ে গেলে আর সেটা গাইব না। এই বলে তিনি পূরবীতে আলাপ শুরু করলেন।
- তারপর? আমরা তিনজন শ্রোতা একত্রে বলে উঠলাম।
- তারপর পূরবীর আলাপ শেষে ধরলেন ইমনকল্যাণ, মালকোশ। তারপর খাম্বাজে একটা বন্দিশ শেষ করে যখন বেহাগে তারানা ধরেছেন তখন রাত্রি দুটো। শেষপাতে যখন ভৈরবের পর আশাবরীর একটা তান দিয়ে শেষ করলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে আর উদ্যোক্তারা মাথার চুল ছিঁড়ছেন।
- সে কি, আর অন্য ওস্তাদেরা?
- আরে সেটাই তো কেউ বুঝতে পারছে না যে সবাই এত শান্ত কেন। শেষে ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ তাঁর সানাইটা মাথায় ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'সমবেত শ্রোতাগণ, গত দু-ঘণ্টায় উলানবাটোরের পণ্ডিতজি আমাদের সন্ধ্যে থেকে সকালের চার প্রহরের আটটা বিভিন্ন রাগ গেয়ে শুনিয়েছেন। অাল্লাহ কা করিশ্মা দেখিয়ে, জেইসা রাগ ওইসা সময় দিখাই দিয়ে হামারি আউর আসমান কি ঘড়ি মেঁ।' সত্যি সবাই তাকিয়ে নিজের নিজের ঘড়িতে দেখে রাত্রি ন'টা বাজছে মাত্র। হল হাততালিতে ফেটে পড়ে।
হঠাৎ কি যেন একটা জরুরি কাজ মনে পড়ায় বিশুমামা চটপট উঠেই পিট্‌টান দিলেন।
আমরা তখনও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি, কানু বলে উঠল, 'ইয়ার্কি পেয়েছে! একটা রাগের আলাপ থেকে অন্য রাগের মুখড়া, মালকোষের অন্তরার পরে খাম্বাজের তা্রানা। মালকোষ পঞ্চম বর্জিত রাগ, তবলা-তানপুরা সব মধ্যমে বাঁধতে হয়- ততক্ষণ পাবলিক হিপনোটাইজড হয়ে বসে থাকবে!'
- 'উলানবাটোর থেকে ওস্তাদ! উলানবাটোর ধারোয়ারের কাছে! গুল মারার আর জায়গা পায়নি। উলানবাটোর মঙ্গোলিয়ার ক্যাপিটাল- যেন আমরা জানিই না।' সুজয় বলে উঠল, ও আমাদের মধ্যে একটু সিরিয়াসলি পড়াশুনা করে।
- 'যদি জানতেই তবে বলতে পারলে না কেন, চাঁদ? নাকি তোমরাও হিপ্নোটাইজড হয়ে গেছিলে' - বলার পালা এবার আমার।
- 'হয়তো তাই'- আমরা সবাই একসাথে বলে উঠি।

মুম্বাই- ২৭শে আগস্ট, ২০১৫।

No comments:

Post a Comment