Saturday, October 7, 2017

বেগম আখতার- বিশেষ রচনা।

"ইয়ে না হামারি কিসমত মে থী"-  এই কি আমার ভাগ্যে ছিল?

দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ দশক তার জাদুকরী কণ্ঠসুধায় মোহাবিষ্ট ছিল ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের গজলভক্তরা। তিনি গজল সম্রাজ্ঞী বেগম আখতার। তার জন্মশতবার্ষিকী পেরিয়েছে নয় বছর আগে।
সঙ্গীত জগত তাঁকে গজল সম্রাজ্ঞীর আসনে বসালেও বেগম আখতারের ব্যক্তিজীবন ছিল যেন যন্ত্রণার এক অন্তহীন যাত্রা। শিশুকালেই পিতা তাকে পরিত্যাগ করেন। বয়স তখন মাত্র চার- এসময়ে সম্পত্তিলোভী কুটিল আত্মীয়রা বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা চালায় যমজ দুবোনকে। কিন্তু সকল প্রতিকূলতা আর ভয়াবহ শত্রুতাকে দূরে ঠেলে এক প্রাকৃতিক শক্তির মতই জেগে উঠেছিলেন বেগম আখতার যেন কষ্টের সাগর পান করা নীলকণ্ঠ।

তাঁর মৃত্যুর পর লখনউয়ের ‘পসন্দাবাগ’-এ সমাধিটার উপর জমেছে শুকনো ঝরা পাতাদল;  জ্বলেছে হাজার মোমবাতি। কখনো কোনো ভক্ত এক গোছা রক্তিম গোলাপ রাখতে গিয়ে মাটিতে আলগোছে ছড়িয়ে দিয়েছে কয়েকটা পাপড়ি। প্রকৃতির নান্দনিক ছন্দে সেখানে মাঝে মাঝে  ভেঙে গেছে  অনন্ত নীরবতা। যাঁর কণ্ঠের  এক প্রান্তে ‘রুহি-গুলাবের’ গন্ধমাখা ঠুমরি, দাদরা কিংবা গজলের স্মৃতিসুধা। তারই  অন্য প্রান্তে, জমে থাকা বিরহ, বিষণ্নতা আর যন্ত্রণা। আর এ দুয়ের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে বিবি, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি থেকে বেগম আখতার হয়ে ওঠার নস্টালজিক ও ট্র্যাজিক কাহিনি। এবং ঔপনিবেশিক যুগে তথাকথিত অভিজাত মুসলমান পরিবারের কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে নারীসত্তার লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠার সত্য-গল্পও তাঁর জীবনের নিবিড় অথচ করুণ অংশ।

ভারতের উত্তর-প্রদেশের ভাদ্রাসা গ্রামে আইনজীবী আসগর হোসেনের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় স্ত্রী মুসতারী ১৯১৪ সালের ৭ অক্টোবর জমজ কন্যা জন্ম দেন। বাবা আদর করে তাদের নাম রাখেন জোহরা ও বিব্বি।
তবে মুশতারিকে পরবর্তীতে স্বীকারই করেননি স্বামী সৈয়দ আসগর হুসেন। আসগর ব্যারিস্টার এবং অভিজাত সৈয়দ বংশের সন্তান; এর বিপরীতে অসামান্য সুন্দরী হলেও মুশতারি সামান্য এক ব্যবসায়ীর মেয়ে, বংশমর্যাদা নেই। ফলে, যমজ কন্যার জন্ম দিয়েও একা থাকতে হত মুশতারিকে। বাচ্চাদের চার বছর বয়সকালে একদিন তাদের হাতে বিষ মাখানো মিষ্টি দিয়ে গেল পিতৃকূলের স্বজনরা। মারা গেল জোহরা, বেঁচে থাকল বিবি।
এরপর তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল সৈয়দ বংশের ভাড়া করা গুণ্ডারা, তবু বেঁচে রইল মা-মেয়ে। স্বামীর বাড়ি ছাড়লেন মুশতারি। এরপর অনেক কষ্টের জীবন কাটে বিবিকে নিয়ে। মা চেয়েছিলেন লেখাপড়া করাতে। কিন্তু মেয়ে চায় গান শিখতে। এই ছোট্ট বিবিই পরে পরিচিতি পান আখতারি বাই ফৈজাবাদী; কাকোরির বেগম ইশতিয়াক আহমদ আব্বাসি, বেগম আখতার প্রভৃতি নামে।

 ১১ বছর বয়সে কলকাতায় এক চ্যারিটি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে নির্দিষ্ট গায়কদের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ সুযোগ পান বেগম আখতার। এখানে তার কণ্ঠইন্দ্রজালে মোহাবিষ্ট সবাই। এই সেই আসর যেখানে সানাই গুরু বিসমিল্লাহ খান প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিবেশনা করেন- তার কিশোর বয়সে। আখতারির পরিবেশনার প্রশংসায় তখন ভাসছিলেন কলকাতার অভিজাত সম্প্রদায় আর পত্রিকাওয়ালারা। মেগাফোন কোম্পানির বড়কর্তা জে এন ঘোষ চুক্তি করলেন আখতারির সঙ্গে। গাড়ি-বাড়ি হল, এল নাম ডাক। তার বাবা অসগর হুসেন তখন জাস্টিস। লখনৌতে তার বাড়ির একেবারে বাড়ির উল্টো দিকে নিজের মহল গড়লেন বেগম আখতার- নাম দিলেন আখতারি মঞ্জিল। ‘রোটি’সহ মুম্বাইয়া কয়েকটি সিনেমায় অভিনয়ও করেন, গানও করেন। তবে ফিল্ম জগৎ তাকে টানেনি।
কেরিয়ারের শুরুর দিকটায়, ওই ১১/১২ বছর বয়সে বেরেলির বাসিন্দা ও পারিবারিক আধ্যাত্মিক গুরু পীর আজিজ মিয়া আখতারিকে বলেছিলেন, ‘শোহরত তুমহারি কদম চুমেগি, দৌলত তুমহারি বান্দি হো কর ঘুমেগি’।
পীরের কথা মতো দৌলত-শোহরত, প্রেম-বিয়ে সবই হয়েছিলে তার।

কিন্তু হয়নি সুখ। নির্মম ঘটনাটি ঘটে তখনকার উর্দুভাষী অভিজাতদের অবক্ষয় জর্জরিত বিহারে।   সেবার সেখানকার এক রাজার দরবারে গান শোনাতে গেছেন। সেই রাজা কুদর্শন হলেও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি ছিল। দরবারে গানের আসর শেষে নিজের তাঁবুতে ফিরে এলেন আখতারি, এমন সময় রাজবাড়ি থেকে ফের ডাক পড়ল। এরপর সারা রাতে ফিরলেন না। ভোররাতে দারোয়ান তাঁবুতে ফেলে দিয়ে গেল আখতারির সংজ্ঞাহীন রক্তাক্ত দেহ। ‘সঙ্গীতপ্রিয় রাজা’ ধর্ষণ করেছেন তাকে। ছ’দিন পর জ্ঞান ফেরে আখতারির। ততদিনে মা মুশতারি তাকে নিয়ে লখনৌ চলে এসেছেন। সেখানেই নয় মাস পরে মেয়ের জন্ম দিলেন আখতারি। তখন তার ১৪ বছর বয়স। মেয়ের নাম রাখা হল শামিমা। দেখতে শিশুটি তার বাবার মতই হয়েছিল। বিহারের ওই রাজার নির্মম লালসার ফসল এই শিশুটিকে সামাজিক নিরাপত্তা দিতে তার নানী (মুশতারি) নিজের সন্তান অর্থাৎ বেগম আখতারির বোন বলে পরিচয় দেন- বাকি জীবন ভর।

চোদ্দ বছর বয়সে আখতারি যোগ দিলেন থিয়েটারে। সেখানে অভিনয়েও নিজের দক্ষতার পরিচয় দেন। এর পরেই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বম্বে থেকে ডাক আসে। পাশাপাশি আসতে থাকে বিভিন্ন রাজপরিবারে সঙ্গীতের মেহফিলে গান গাইবার অনুরোধ। ‘নলদময়ন্তী’ ছবিতে অভিনয়ের পরে ‘রোটি’তে তিনি অভিনয় করেন। ছবিতে অভিনয়ের আমন্ত্রণের সংখ্যা এর পর যায় বেড়ে। কিন্তু বম্বের জীবনযাত্রা আখতারির না-পসন্দ। তাই তিনি ফিরে এলেন লখনউতে। সেখানেই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বসত গানের মেহফিল।

এরই মাঝে হঠাৎই আখতারির ডাক পড়ল উত্তরপ্রদেশেরই রামপুরের নবাব-দরবারে। নিমন্ত্রণ রাখলেন আখতারি। কিছু দিন সেখানে থাকার পর, নবাব আখতারিকে নিকাহ্ করার প্রস্তাব দেন। তবে, আখতারি শুধু তা নাকচই করেননি, রামপুর ছেড়ে চলে গেলেন। 

এভাবেই নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আখতারির জীবন। আচমকাই তাঁর সঙ্গে দেখা হল, বিয়েও হল পেশায় ব্যারিস্টার কাবুলির নবাব ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসির। বিয়ের পর তিনি পেলেন শিক্ষিত-সুপুরুষ স্বামীর ভালবাসা, অর্থ, প্রতিপত্তি সব কিছুই। শুধু জীবন থেকে বিদায় নিল গান, কেননা বিবাহে আব্বাসি সাহেবের শর্তই ছিল আখতারিকে গান ছাড়তে হবে। কাজেই জীবনের অর্থ বদলে গেল আখতারির কাছে। সব আছে, অথচ কিছুই নেই! সন্তান ধারণ করলেন আখতারি। গর্ভপাত হল এক বার নয়, সাত-সাত বার। কৈশোরের যৌন নিপীড়নের শোধ তাঁকে এভাবেই দিতে হল। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, আখতারির পক্ষে আর মা হওয়া সম্ভব নয়। মানসিক অবসাদ গ্রাস করল তাঁকে। ডাক্তার বললেন, একমাত্র গানই বাঁচিয়ে রাখতে পারে তাঁকে। আব্বাসি সাহেব অমত করলেন না, কিন্তু শর্ত, বাইরে গাওয়া চলবে না। সেই শর্ত অবশ্য রাখলেন না আখতারি। এক দিন আব্বাসি সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া হল। তিনি কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই রেডিয়ো স্টেশনে ফোন করলেন আখতারি। সেখানে ছিলেন তাঁর বহুপরিচিত এল কে মালহোত্রা। আব্বাসি সাহেবের অজ্ঞাতসারে স্টুডিয়োয় রেকর্ডিং সেরে বাড়ি ফিরলেন আখতারি।

বাড়ি ফিরেই নতুন দুশ্চিন্তা। রেডিয়োয় তাঁর নাম ঘোষণা মানেই আব্বাসি সাহেবের নামটাও জড়িয়ে যাওয়া। সেই অভিজাত পুরুষের অসম্মান। স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম ছিল আখতারির, আর ছিল কৃতজ্ঞতাবোধ। একটা অসম্মান ও অনিশ্চিতায় ঘেরা আক্রান্ত ও মর্যাদাহীন জীবন থেকে বেগমের মর্যাদা দেওয়ার কৃতজ্ঞতা। মালহোত্রা বুঝলেন সমস্যাটা। তাঁর কৌশলে গান বেগম আখতারের নামে প্রচারিত হয়। আখতারিবাঈ পেলেন এক নতুন নাম। 

শূন্য জীবনে নতুন করে আবার শুরু হল গান। গান গাওয়ার পাশাপাশি আখতারি এ বার গান শেখাতেও শুরু করেন। আকাশবাণীর লখনউ-র স্টেশন ডিরেক্টর, আরেকজন বাঙালি সঙ্গীত-সমঝদার সুনীল বসু ইতিমধ্যেই আব্বাসি সাহেবের বাড়ি গিয়ে অনেক কাকুতিমিনতি করে বেগমের গান রেকর্ড করতে তাঁকে রাজি করান। আখতারি গান গাইবেন শুনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিল। তবে আর আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি নয়! জন্ম হল এক নতুন শিল্পীর বেগম আখতার। সেই নামেই প্রকাশিত হল দু’টি বিখ্যাত গান- ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’। শুরু হল বেগমের গানে ভরা নতুন জীবন। একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছিল রেকর্ড। পাশাপাশি দেশ জোড়া খ্যাতি আর অসংখ্য অনুষ্ঠান। আখতারি যেন নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পেলেন। গজল গায়কির আজকের ধারার প্রবর্তন করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, কলকাতা ও বাঙালি সমাজের সঙ্গে আখতারির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বহু দিনের। জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ  ও সুনীল বসু ছাড়াও আরেকটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সে আরেক ইতিহাস, তবে পর্দার। জমিদার বিশ্বম্বর রায়ের ছেলের উপনয়নের সেই সন্ধে। জলসাঘরে গানের আসরে দুর্গাবাঈ ধরলের পিলু রাগে ঠুমরি ‘ভরি ভরি আয়ি মোরি আঁখিয়া’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে আশ্রয় করে সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর সেই গানের মায়াবী মাদকতায় আজও আচ্ছন্ন সঙ্গীত রসিকেরা, সেই সঙ্গে চিরস্মরণীয় দুর্গাবাঈর চরিত্রে বেগম আখতার। কিংবা ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়ির সেই আড্ডা, বা রাত একটার সময় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি গান শুনতে যাওয়ার সেই ঘটনার কথা আজ হয়ত কারোই মনে নেই। তবুও বাঙালির হৃদয়ে ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘পিয়া ভোলো অভিমান’, ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ ইত্যাদি গান আজও নবীন। ‘আই মোহাব্বত’,‘উয়ো যো হাম মে তুম মে’ কিংবা মির্জা গালিবের রচিত ‘ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ’ আপামর গজলপ্রেমীদের কাছে কোনোদিনই পুরনো হবে না। এছাড়াও তাঁর গাওয়া ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’, ‘ও জো হামমে তুমমে কারার থা ও তুমহে ইয়াদ হ্যায় কি ইয়াদ নাহি’ এখনও শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট করে ফেলে মুহূর্তেই।

লবণাম্বু-সমৃদ্ধ অতল অপার বারিধি-সমান বেদনার জীবনে আত্মমগ্ন, গানের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ ও আনন্দ খুঁজে পেতেন বিব্বি অথবা আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি; সবার কাছে চেনা বেগম আখতার। ‘মালেকা-ই-গজল’ অর্থাৎ গজল সম্রাজ্ঞী বেগম আখতার ১৯৭৪ সালে আহমেদাবাদে এক অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৩০ অক্টোবর, মাত্র ৬০ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

আজ এই অক্টোবরে, যা তাঁর জন্মমাস, মৃত্যুর মাসও- শ্রদ্ধা জানাই রাগপ্রধান, গজল ও ঠুমরির অবিস্মরণীয় সম্রাজ্ঞী মালিকা-এ-তরন্নুম বেগম আখতারকে।


Wednesday, October 4, 2017

কোজাগরী- এক অন্য পাঁচালী।।Miscellaneous- Bengali

কোজাগরী- এক অন্য পাঁচালী।।


পুরাণে কথিত আছে লক্ষ্মী ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের রাজপুরীতে অধিষ্ঠাত্রী দেবী আর তাঁর সব সম্পদের উৎস। দুর্বাসার দেওয়া পারিজাতের মালার অনাদর করায় মুনির শাপে তিনি লক্ষ্মীছাড়া হন। মানে অন্যায় করলেন ইন্দ্র আর শাস্তি পেলেন লক্ষ্মী, স্বর্গচ্যুত হলেন, ইন্দ্র হলেন বৈভব-হারা। যাই হোক, দুর্বাসা মুনির শাপ দেওয়ার ব্যাপারে বড়ই কুখ্যাতি ছিল, তাই পুরাণে কিছু উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটাতে হলেই টানাটানি হত ঋষি দুর্বাসাকে নিয়ে, মূলতঃ শুধুমাত্র অভিশাপ দেয়ানোর জন্যেই।

এদিকে লক্ষ্মী দেবী তো মর্তে এসে পড়লেন, কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, 'কোথায় আলো, ওরে কোথায় আলো' বলে খুঁজে চলেছেন রাতের আশ্রয়, তখন কে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল? এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পুরাণে নেই, তবে জানা যায় ধন-সম্পত্তির দেবী লক্ষ্মীর শেষ আশ্রয়লাভ হয় রত্নাকর সমুদ্রের গভীরে। 'শ্রী' নামে সেখানে তিনি থাকেন বহুযুগ ধরে। পরে সমুদ্রমন্থনের সময় দেব-দানবে মিলে তাঁকে উদ্ধার করেন, বিষ্ণু তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। তবে সেই স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে বছর-বছর লক্ষ্মীদেবী মর্তে আসেন কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে, একটু আশ্রয়ের আশে। পার্থিব ধন-বৈভবলাভের সেটুকু আশাই আমাদের জাগিয়ে রাখে সে রাত্রে, শ্রী-সম্পদের আরাধনায়। পুজোর মন্ত্র সেই একই-
নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে
যা গতিস্ত্বৎপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াৎ ত্বদর্চনাৎ |
অর্থাৎ ‘হে হরিপ্রিয়ে,তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করিয়া থাক, তোমাকে প্রণাম করি | যাহারা তোমার শরণাগত হয়, তাহাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয় |’

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা আদতে বাংলার মেয়েদের একান্ত হৃদয়ের আটপৌরে ব্রত-পার্বনের মত, মানে আলিম্পন- সজ্জা, ঘট-স্থাপন আর মূর্তিপূজো দিয়ে শুরু, ব্রতকথা ও পাঁচালিতে তার শেষ। সে পাঁচালিও বহুপঠিত-বহুশ্রুত, 'দোল-পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ। মৃদুমৃদু বহিতেছে মলয়-বাতাস।। লক্ষ্মী-নারায়ণ বসি বৈকুণ্ঠ মাঝারে। আনন্দ অন্তরে তাঁরা আলাপন করে।।' এমন সময় চির-কোঁদুলে নারদের আবির্ভাব, মর্তের দুরাচারের সংবাদ নিয়ে। তারপর কিভাবে লক্ষীদেবী মর্তে গিয়ে নিজের পূজার প্রচার করে এসে সবার দুঃখ দূর করে তাদের সম্পদশালী করে তুললেন, সেই বিবরণ। তবে এখন যেটা আমি বলতে চলেছি তা সম্পূর্ণ আলাদা, এ বিবরণ বহুশ্রুত হলেও কোন পাঁচালী বা মঙ্গলকাব্যে লিপিবদ্ধ হয় নি।

মারোয়াড় রাজ্যের নাগোর শহরের বাসিন্দা হীরালাল সাহু, যাঁর পূর্বপুরুষ গিরিধর সিং গেহলোট একসময় শ্বেতাম্বর জৈনের ধর্ম গ্রহণ করেন, ১৬৫২ খ্রীষ্টাব্দে ঘটনাক্রমে দেশ ছেড়ে পাটনায় চলে আসতে বাধ্য হন, ও সেখানেই ব্যবসা বিস্তার করেন। তাঁরই এক পুত্র মানিকচাঁদ ছিলেন বাংলার নবাবদের দ্বারা 'জগৎশেঠ' উপাধি দিয়ে সম্মানিত বংশের পূর্বপুরুষ, যিনি বাংলার তৎকালীন রাজধানী ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। তখন মুর্শিদকুলি খান ছিলেন বাংলার শাসক আজিম-উষ-শানের (ঔরঙ্গজেবের দৌহিত্র) দেওয়ান, মানিকচাঁদের সঙ্গে তাঁর ভালরকম 'দোস্তি' হয়। তাই যখন মুর্শিদকুলির আজিমুষশানের সঙ্গে একটি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে প্রাণসংশয়ের উপক্রম হয়, মানিকচাঁদের সাহায্যে তিনি সম্রাট ঔরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন গঙ্গার তীরে মকসুদাবাদে। মানিকচাঁদও বন্ধুকে অনুসরণ করে সেখানে চলে আসেন ও দুজনে মিলে মুর্শিদাবাদ নামে শহরটিকে গড়ে তোলেন।

এবার আসা যাক, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর কথায় | ‘কো জাগরী’ অর্থাৎ ‘কে জাগে |’ এই পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী বরদান করার উদ্দেশে জগৎ পরিক্রমা করে দেখেন, কে নারকেল জল পান করে সারারাত জেগে আছেন |
কথিত, দেবী এও বলে থাকেন,’আজ রাতে যে ব্যক্তি জেগে থেকে পাশাখেলা করবে তাকে আমি ধনবান করব।’ তাই ভক্তিপূর্ণ চিত্তে এদিন লক্ষ্মীর পুজো করার পরে প্রথমে বালক, বৃদ্ধ ও আতুরদের আহার করাতে হয়| পরে ব্রাহ্মণ ও বন্ধুবান্ধবদের নারকেল জল ও চিঁড়ে আহার করিয়ে তবে তা নিজে গ্রহণ করতে হয়|

মুর্শিদাবাদকে গড়ে তোলাই শুধু নয়, বাংলা অঞ্চল থেকে দু'কোটি মুদ্রা খাজনা আদায় করার পেছনে মানিকচাঁদের কৃতিত্বই বেশি ছিল, পরে মুর্শিদাবাদে টাঁকশাল স্থাপিত হলে শেঠ পরিবারই তার পরিচালনার দায়িত্ব পান। এইসব কৃতিত্বের খবর দিল্লীশ্বর জানতে পারলে তিনি মানিকচাঁদকে দেখতে চান | এরপর মানিকচাঁদ দিল্লি গেলে রাজা তাঁর কথাবার্তায় খুশি হয়ে তাঁকে বলেন,তোমার উপর আমি অত্যন্ত প্রীত| তুমি যা চাইবে আমি দান করব| তখন মানিকচাঁদ বাড়ি ফিরে মাকে সব বলেন| বুদ্ধিমতী জননী পুত্রের মঙ্গলের জন্য বলেন, সম্রাটকে দিয়ে আদেশ জারি করিয়ে নিতে যে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে শহরে কোনও গৃহস্থ বাড়িতে যেন আলো না জ্বালায়| সম্রাটের নির্দেশে ওই রাতে কেউ আলো জ্বালালো না| শেঠ মানিকচাঁদের মা ঘি-এর প্রদীপ জ্বেলে ঘর আলো করে দরজা খুলে বসে থাকলেন| যথাসময়ে দেবী এলেন এবং বললেন, আমি খুব পরিশ্রান্ত| আমাকে একটু আশ্রয় দেবে? মা দেবীর ছলনা বুঝতে পারলেন| তিনি দেবীকে ঘরে আশ্রয় দিলেন এবং বললেন, আমি নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি| কথা দিন, আমি ফিরে না আসা অবধি আপনি এখানে থাকবেন| দেবী তাতে রাজি হলেন| এবার মা নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করলেন| ফলে সেদিন থেকে দেবী জগৎশেঠদের ঘরে থেকে গেলেন| অবশ্য অনেকের মতে এ ঘটনাটি ঘটেছিল মানিকচাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র ও দত্তক-সন্তান ফতেচাঁদের সঙ্গে, তিনি দিল্লীশ্বর মহম্মদশাহের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তবে জৈনধর্মাবলম্বী জগৎশেঠরা কেন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা করলেন তার কোন ব্যাখ্যা আমি পাইনি।
 
যাই হোক, আজও ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থ বাড়িতে সারারাত ঘি-এর প্রদীপ জ্বালানো হয় | তবে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই ওই রাতে জুয়া খেলে থাকেন, জানিনা এ অনাচার ধর্মের স্বীকৃতি পায় কি করে |