(১)
তখন বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিয়েছি। জামশেদপুরে গেছিলাম জ্যেঠতুতো দিদির বিয়ে উপলক্ষ্যে। বাসরে গানের আসর বসেছে। ভাল গায়ক-গায়িকার
অভাব নেই সে অঞ্চলে। কৌতূহলে উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে
দাঁড়িয়ে পড়লাম। না গান শুনতে নয়, আমাদেরই বয়সী একটা
ছেলের আচরণ বড় অদ্ভুত ঠেকছিল চোখে। দিদির এক বন্ধু 'বাজিবে সখী, বাঁশী বাজিবে' শেষ করতেই
ছেলেটার আবদার- 'সোনাদি, ওই ওটা হয়ে
যাক- সুধাসাগরতীরে'। 'দূর বোকা, এই আসরে
ধামার গাইতে পারব না, আর পাখোয়াজ কে বাজাবে?'
ছেলেটা দমে না। আর একজনের কাছে দাবী- 'মধুছন্দাদি, তাহলে চম্পা
চামেলি গোলাপেরি বাগে- হোক। ওটা তো ডবল দাদরা, তাই না?'
- 'আরে তুই এত বুঝিস, গান শিখিস না
কেন?' আমার দিদির প্রশ্ন।
আমার কিন্তু ছেলেটার ন্যাকামি আর সহ্য হচ্ছিল না, যদিও
গানবাজনায় আমার শখও কিছু কম ছিল না। আরে পুরুষমানুষ
বিয়েবাড়িতে কোথায় কাজে-কম্মে থাকবে, নিদেন পক্ষে সুন্দরী মেয়ে-টেয়ে খুঁজে নিয়ে একটু-আধটু
ইয়ে.....আমি ওখান থেকে বেরিয়ে এসে সমবয়সী ছেলেদের দলে
ভীড়ে গেলাম।
পরের দিন সকালে চা খেতে গিয়ে আলাপ হল ছেলেটির সঙ্গে। অনিরুদ্ধ সান্যাল। আমার জ্যেঠুর পাড়াতেই থাকে। আমি রাঁচী কলেজে জিওলজি
অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে চাই শুনে কী খুশি!
- 'বন্ধু,জিওলজি কেন?'
- 'আমার একটা নামও আছে, রুদ্র-
রুদ্রাক্ষ বিশ্বাস। আর কারণ? আমি শুনেছি, ওই সাবজেক্টে যথাসম্ভব ফাঁকি মেরেও ভাল নম্বর তোলা যায়।' ফীল্ড
ওয়ার্কে যে যথেষ্ট ন্যাক থাকা চাই, ন্যাকামি নয়, সেটা আর
বললাম না।
-'তাহলে আমিও তাই করব, বন্ধু। খুব
বেশী লেখাপড়া করার ইচ্ছে বা অধ্যবসায় কোনোটাই আমার
ধাতে নেই। আমি তাহলে নেক্স্ট মাসেই রাঁচী যাচ্ছি।'
রাঁচী কলেজে, তারপর ইউনিভার্সিটিতে আমাদের
দিনগুলো পড়াশুনায়-ঘোরাঘুরি-আড্ডায়-গল্পে গড়িয়ে চলতে লাগল।
জিওলজির ছাত্রমাত্রেই স্বীকার করবেন যে জিওলজি
ফীল্ডওয়ার্কের জন্যে ছোটনাগপুর প্লেটুর জুড়ি নেই।গন্ডোয়ানাল্যান্ডের
দুর্লভ স্ট্র্যাটিগ্রাফি আর কয়লা থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম ওর
পর্যন্ত, কী নেই সেখানে? দুর্লভ
রিকাম্ব্যান্ট ফোল্ড বা আনকনফর্মিটি দেখতে চাও, চলে যাও কোন
রেলওয়ে সেকশান কাটিং বরাবর।আর্কিয়ান বা নিষ্প্রাণ
যুগের আগ্নেয় শিলা যেমন পাবে, তেমনি ক্যাম্ব্রিয়ান থেকে কার্বনিফেরাস যুগের ফসিল বা জীবাশ্মের সংগ্রহ জমা করে
রাখতেও জুড়ি নেই এই ছোটনাগপুরের। তাই আমরাও সুযোগ
পেলেই কাঁধে ঝোলা, ক্যামেরা আর কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম পথে পথে। শিক্ষার সাথে
সাথে অ্যাডভেঞ্চার চলত সমান তালে।
তখন আমি আর অনিরুদ্ধ ইউনিভার্সিটি হোস্টেলের পাশাপাশি দুটো কিউবিকলে থাকি। দুই রুমের মাঝের দেয়ালের ওপরটা খোলা, দুজনে বেশ
কথাবার্তা বলা যায়। আমাকে ক'দিন ধরে যেন
গানে পেয়েছিল। এক রাত্রে আলো নিভিয়ে গান ধরেছি-
'কে সেই সুন্দর কে?
আমি যার নূপূরের ছন্দ, বেণুকার সুর।'
এই পর্যন্ত গেয়েছি, দেয়ালের ওপার থেকে একটু নড়াচড়ার
শব্দ পেলাম। অনিরুদ্ধ মনে হল যেন বিছানায় উঠে বসল।
-'ওই সঞ্চারীর অংশটা গা না
রুদ্র....যার শিখিপাখা লেখনী হয়ে....' আমি গাইলাম।
'যার শিখিপাখা লেখনী হয়ে
গোপনে মোরে কবিতা লেখায়
সে রহে কোথায় হায়!
আমি যার বরষার আনন্দ কেকা.....'
-'থাক থাক, ওটুকুতেই
হবে। আসলে এই গানটার সঙ্গে আমার বিশেষ একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু
চাই না এ জীবনে।'
- 'আর কিছু বলেনি অনিরুদ্ধদা এই
ঘটনা নিয়ে?' অমৃতা জিগ্যেস করল।
(২)
আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে আত্মগত হয়ে কথাগুলো বলছিলাম। ঘরের মধ্যে অমৃতার উপস্থিতি যেন মাথাতেই ছিল না। অথচ ওর অনুরোধেই
ত শুনিয়ে যাচ্ছি অনিরুদ্ধের আর আমার বন্ধুত্বের এই উপাখ্যান।
অমৃতা আমার জ্যেঠতুতো বোন। ওর দিদির বিয়েতে যখন জামশেদপুর গেছিলাম তখন ও ক্লাশ নাইনে পড়ত। আই-এ-এস অফিসার ওর বর বোম্বাইয়ে
বদলি হয়ে এসেছে। আমি তো ওকে প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলে আমাকে দেখে ও যে কিভাবে আমাকে চিনল
জানিনা,হয়তো মেয়েদের মানুষকে মনে রাখার, চিনতে পারার
একটা বিশেষ শক্তি থাকে। তারপর আমার স্ত্রীর বিশেষ অনুরোধে ওদের
দুজনকে টেনে আনা হল আমাদের বাসায়। আর আশ্চর্য, ওর বর বিশেষ
কাজ আছে বলে আমাদেরকে ওর রঙিন বাতি দেওয়া গাড়িতে
করে আমাদের বাড়িতে ছেড়ে দেওয়া সত্বেও ও কোন আপত্তি না জানিয়ে গুটিগুটি
আমাদের সঙ্গে চলে এল দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম।
আমার লিভিং রুমে বসে অমৃতা গৃহসজ্জা দেখছিল। হঠাৎ ওর নজর গেল একটা কোলাজের
মাঝে আমার ছাত্রজীবনের একটা গ্রুপ ফটোর দিকে।
- এটা কবেকার ফটো রুদ্রদা? তোমার পাশে
দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধ তো?
- হ্যাঁ, অনিরুদ্ধই ত।
এটা চাইবাসার কাছে একটা চিনেমাটির কোয়ারি। রুংটাদের। আমরা
বি-এস-সি পড়ার সময় একটা এক্সকার্সনে গেছিলাম। ও হ্যাঁ, তোর তো অনিরুদ্ধকে চেনারই কথা, একই পাড়ায়
ছিলি।
- দিদির বিয়েতে আলাপ হয়েছিল। তার
আগে অবশ্য মুখচেনা ছিল। তোমার ক্লাশমেট ছিল বুঝি?
- ও একটা অদ্ভুত ছেলে ছিল। দিদির
বিয়েতে তোদের ওখানে না গেলে হয়্ত ও আমার বন্ধু হতনা কোনদিনও। কি জানি, হয়্ত সেটা না
হলেই ভাল ছিল।
- তোমার কথায় কেমন যেন একটা
রহস্যের আভাস পাচ্ছি। আপত্তি না থাকলে খুলে বলবে গল্পটা?
তারপর গল্প এসে কোথায় থামল সে ত আগেই জানিয়েছি।
ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে চা-মিষ্টি নিয়ে। অগত্যা কিছুক্ষণের বিরতি।
আবার শুরু করলাম।
(৩)
এমনিই কাটছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো। এমনিতে বেশ হাসিখুশি দেখতাম অনিরুদ্ধকে। নিজে গান গাইতে না পারলেও অসাধারণ সুর
তালজ্ঞান ছিল ওর। তাই কাউকে কিছু গাইতে দেখলেই
ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো তাকে গান শোনাবার জন্যে। ওর পাল্লায় পড়ে
জোর-জবরদস্তি গাইতে গাইতে আমিই একদিন প্রতিষ্ঠিত গায়ক হয়ে উঠলাম,অবশ্য কলেজ
লেভেলে। আর একটা নেশা ছিল ওর, ছুটি-ছাঁটা পেলেই টেনে নিয়ে যেত দুর্গম বনে-পাহাড়ে, ডিপ-মিটার, পেট্রোলজিক্যাল
মাইক্রোস্কোপ জাতীয় যন্ত্রপাতি, একটা মিনি
জিও-ল্যাব যাকে বলে। তবে ঐ পর্যন্তই। প্রকৃতির মাঝখানে
একবার পড়লেই শুরু হয়ে যেত ওর গান শোনার বায়না। কখনও বা নিজে শুরু করত আবৃত্তি-
'সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই
মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।
তারে আমি
রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার
উদ্দেশে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে'।
জানিনা, শেষের কবিতায় কী মোহ, কী মুগ্ধতা
ছিল ওর।
এরপর সেবার দেওয়ালির ছুটিতে জামশেদপুর গেল ও। আমিও দুয়েকবার গেছি ওর সঙ্গে, সোনারিতে
সুবর্ণরেখা আর খড়কাইয়ের সঙ্গমের কাছে দোতলা বাসাখানা ছিল ওদের, সে হয়ত তুই
জানিস। খুব শান্ত মনোরম পরিবেশ, একটু এগিয়েই ভারত সেবাশ্রম সংঘের আশ্রম- তবে এবার ও একাই গেল। তারপর ফিরে এলো সে
এক অন্য অনিরুদ্ধ। আর আবৃত্তি করে না, আমার কাছে
গান শোনার আবদার করে না, একেবারে ভীষণ শান্ত হয়ে গেল। আমি একবার সে কথা বলতেই তার পালটা প্রশ্ন- 'এই, তোরা কী জাত
রে?'
- কী আবার, আমরা মাহিষ্য, জানিসই তো!
- আর আমরা জানিস, বর্ণশ্রেষ্ঠ
ব্রাহ্মণ, তাও আবার বারেন্দ্র। একটা সময়
ছিল তোদের হাতে আমরা জলও খেতাম না!
এ কী বলছে অনিরুদ্ধ? ধানবাদে কতবার আমাদের বাসায়
এসেছে, মায়ের আপত্তিতে কর্ণপাত না করে
জোর করে প্রণাম করেছে।
- 'একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!' আমি জোর করে
হাসলাম।
হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল অনিরুদ্ধ। তারপরেই গম্ভীর হয়ে বলল, 'কাল ছটপুজোর ছুটি, শনিবার হাফ
ডে গুলি মার, রবিবার নিয়ে তিনদিন, চল বড়জামদা
থেকে ঘুরে আসি, কিম্বা কিরিবুরু। ওদিকে শুনেছি
হেমাটাইটের মাঝে মাঝে ফেল্স্পারের ভাল কৃস্টাল
গ্রো করে, অ্যাগেটও পাওয়া যেতে পারে।
- 'আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। অমৃতা মাঝে
বাধা দিল। রুদ্রদা, ওটা কি?' ওর ইশারা আমার কাঁচের শো-কেসের দিকে। 'তুমি কাঁচের
খোলা আলমারিতে সোনা সাজিয়ে রেখেছ?'
- 'তুমি কি পাগল হলে, অমৃতা? সোনা কেউ
বসার ঘরে সাজিয়ে রাখে?' এবার আমার গিন্নি বললেন।
- 'ধোখা খা গয়ী না!' আমি হাসলাম।
আরে ওটা 'ফুল্স্ গোল্ড'; মুর্খের
সোনা। এরও মধ্যেও অনিরুদ্ধ আছে। আমি ওই গল্পটাই বলতে
যাচ্ছিলাম এখন।
তা সেবার গেলাম কিরিবুরু। এবার সঙ্গে ছিল শিশিরও, ওর বাবা
বড়াজামদা-গুয়া রুটে রেলের গার্ড ছিলেন তখন, চক্রধরপুর
থেকে রাউরকেল্লা ওর নখদর্পণে। রাঁচি থেকে বাস ধরা
যেত, কিন্তু শিশিরের কল্যাণে টাটানগর
হয়ে বড়বিল রুটের ট্রেন ধরলাম, একপয়সা
টিকিটের খরচা লাগলো না। সারাণ্ডা মানে সাতশো পাহাড়ের দেশের একটা পাহাড়
কিরিবুরু- যার স্থানীয় ভাষায় মানে হল হাতি-পাহাড়...।
- 'জানি, জানি। তোমার
আর ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে কাজ নেই', বিষয়বস্তু থেকে সরে যাচ্ছি দেখে বাধা দিল অমৃতা, 'জামশেদপুরের
মেয়ে, কিরিবুরু--মেঘাহাতুবুরু-কেওঞ্ঝর
সব ঘোরা আমার। তারপর কী হল বল।'
- একদিনে কত আর শুনবি? আমার আর
অনিরুদ্ধের গল্প শেষ হবে না সহজে। সেক্রেটারি সাহেব তো চলে আসবে এবার।
- সেক্রেটারিদের কাজ এত শিগ্গির
শেষ হয় না। তোমার সোনার গল্পটা শুনিই না।
অগত্যা আবার শুরু করলাম আমার কাহিনী।
(৪)
স্টীল অথরিটির একটা গেস্ট হাউস ছিল কিরিবুরুতে, সেখানে
কিভাবে জানিনা একটা তিন-বিছানার কামরা জোগাড় করে ফেলেছিল
অনিরুদ্ধ। সেদিনটা পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন সেইলের লৌহ আকরিক হেমাটাইটের খনিগুলো চষে বেড়ালাম। সাতশো পাহাড়ের রাজ্য
সারাণ্ডার বেশিরভাগ পাহাড়ই এই হেমাটাইটে গড়া, কিছুটা
দূর-দূর অন্তরে ছোট ছোট ব্লাস্ট-হোল ড্রিল করে তাতে
জিলেটিন জাতীয় বিস্ফোরক পুরে ইলেক্ট্রিক ডিটোনেটার দিয়ে অনেকটা দূর থেকে সেগুলো ব্লাস্ট করা হচ্ছে। তারপর উপড়ে পড়া
নরম মাটি-পাথর শাভেল বা এক্সকেভেটারের বাকেট দিয়ে তুলে
তুলে বড় বড় ডাম্পার ট্রাকে লোড করে নিয়ে যাওয়া হয়
প্রাইমারি প্রসেসে। সেখানে ওগুলো গুঁড়ো করে বালি-পাথর ছেঁকে মালগাড়ি করে
পাঠানো হয় রাউরকেলা বা বোকারো স্টীল কারখানায়।
- 'জামশেদপুরে যায় না?' আমার স্ত্রীর
প্রশ্ন।
- 'দুর্গাপুর বা বার্ণপুরে গেলেও
জামশেদপুরে আয়রণ-ওর যায় টাটার মাইনস্ থেকে- গুয়া বা নোয়ামুণ্ডির'- আমার হয়ে
অমৃতাই জবাব দিল এবার।
ঠিক তাই। তবে গুয়াতে সেইলেরও লৌহ-আকরিকের খনি আছে, বার্ণপুর
ইসকোর আমলে আকরিক গুয়া আর চিড়িয়া থেকেই যেত। যাকগে সে সব কথা। আমরা যখন
যাই তখনও মেঘাতুবুরুতে মাইনিং শুরু হয়নি। কিন্তু আমি জানি
ওখানে হেমাটাইট, ম্যাগ্নেটাইট দুটোই আছে। একটা
লাল পাহাড় থেকে নামতে নামতে শিশিরের পা হড়কে গেল। কোনমতে
সামলে যেখানে থামল সেখানে কী যেন একটা চকচক করছে, ঠিক সোনার মত। 'সোনা, সোনা' -অনিরুদ্ধের
গলায় উচ্ছ্বাস।'Fool's gold'- আমি বলে উঠলাম। এ তো পাইরাইট, আয়রণ ওরের
সঙ্গে মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়। শিশির ততক্ষণে আমাদের মিনি
ল্যাব খুলে বসে গেছে। 'চ্যা্ল্কোপাইরাইট', একটা
ফ্লুওরাইটের গায়ে টুকরোটা ঘষতে ঘষতে ও বলে, হার্ডনেস
প্রায় চার'।- 'ঠিক আছে, সোনা নয়, কপারের ওর তো
বটে...হোয়াট এ ডিসকভারি, হুর্রে!' আমরা
কিছুক্ষণ পরে গেস্ট হাউস ফিরলাম। পরে
ক্রিস্টালোগ্রাফি করে দেখি tetragonal, অগত্যা কপার পাইরাইটই বটে।তারপর থেকে কথা নেই বার্তা নেই হেঁড়ে
বেসুরো গলায় গেয়ে উঠত-'সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা,আর এমনি
মায়াবী-রাত মিলেদুজনে শুধায় যদি তোমারে কি দিয়েছিআমারেই তুমি কিবা দিলে।।'পরদিন হাতে
একদিন সময় থাকা সত্বেও অনিরুদ্ধ আমাদিগকে প্রায় জোর করে রাঁচি ফেরত নিয়ে এল।
একদিন রাত্রে জোর করে চেপে ধরায় নিজের জীবনের একটা পেজ-মার্ক দিয়ে মুড়ে রাখা
অধ্যায় আমার কাছে খুলে ধরেছিল অনিরুদ্ধ।
মেয়েটার নাম বলেনি। তবে অব্রাহ্মণ। ভাল করে আলাপ হয় ঝুমুরদির
বিয়ের রাত্রে, আশ্চর্য, আমি ছিলাম
সেখানে কিন্তু জানতে পারিনি কিছু। একটা গান শুনিয়েছিল নাকি সে।
নজরুলের 'কে সেই সুন্দর কে- আমি যার নূপূরের ছন্দ......'।
- 'সে রহে কোথায়, হায়?' বলে মেয়েটা
যখন দৃষ্টিতে হাহাকার ভরে শূন্যে তাকিয়ে উঠল, আমার মনে হল
সে চোখের চাওয়া আর কিছু নয়, আমাকেই
খুঁজছে। আশ্চর্য, ওইটুকু মেয়ের এমন গভীর
অন্তর্দৃষ্টি! না কি আমার চোখের ভুল? কত বয়েস হবে, চৌদ্দ, পনের? আমি গানের
আসর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম।
- 'একটু পরে মেয়েটা খুঁজে বের করেছে আমাকে। 'কি হল, এমন ছুটে
পালিয়ে এলেন যে! এতই কি বাজে গেয়েছি আমি?' আমি জবাব দিতে পারিনি। চৈত্রের সেই রাতে কে যে কার চোখে
কখন কিভাবে সর্বনাশ দেখেছিল তার কিছুই বুঝিনি, তবে মহুয়ার
গন্ধে মাতাল এই মাসকে মধুমাস বলে বলেই ভয় ছিল, তার কিছুদিন
আগেই 'মিডসামার নাইট্স্ ড্রীম' বইটা
পড়েছিলাম কিনা।
- 'পরের সপ্তাহে ঝুমুরদি অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়িতে
এলে দেখা করতে যাই, সেখানে ভালভাবে পরিচয় হয়। বাইরে
থেকে পড়াশুনা করে বলে আগে দেখিনি কখনও, বা দেখে
থাকলেও আলাপ হয়নি। তবে তার পর কিন্তু আর
এড়িয়ে যেতে বা পালিয়ে বেড়াতে পারিনি। যখনই সুযোগ পেয়েছি, দেখা করেছি। তবে না দেখাই হয়ত ভাল ছিল।
- 'তারপর কি হল?' অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করল অমৃতা।
আমার কিন্তু ওর গলাটা কেমন যেন লাগল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি দু-চোখে জল
টলটল করছে, যেন বাঁধ ভাঙ্গার অপেক্ষায়।
'অমৃতা!' আমি একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে ওর
দিকে তাকালাম, 'তুই?'
- 'তুমি কি ভাবছিলে এতক্ষণ?' আমার স্ত্রীর
মন্তব্য, 'একটি বিবাহিতা বোন তার খুড়তুত
দাদার সঙ্গে এতদিন পরে দেখা হতেই এক স্বল্পপরিচিত
বন্ধুর কথা এত খুঁটিয়ে কেন জানতে চায়? এখন কাঁদালে ত মেয়েটাকে!'
- 'না বউদি, ওর সব কথা শুনতে চাই। প্লীজ, বলতে দাও
রুদ্রদাকে।'
তার আগে বল ত, তোদের বিয়েটা হল না কেন?
- 'বলব। আগে তুমি বল আমার শিখিপাখার লেখনী কোথায়?'
আমি অবাক। ওটা আমার কাছে আছে কে বলল তোকে?
- 'আমি আন্দাজ করতে পারি।'
আমি ঘরের ভেতর থেকে একটা ময়ূরের পালক এনে দিই ওর হাতে।
পালকটার গোড়ার দিকটা কলমের আকারে ছুঁচোল করে কাটা।
দেখতেই আমার হাত থেকে ওটা কেড়ে নিল অমৃতা। 'এটা আমার
গানের খাতার ভেতরে থাকত। যার জন্যে যত্ন করে রেখেছিলাম সে এটা চুরি করল কেন! আর চুরি করলই যদি শুধু এটুকু নিয়েই কেন
সন্তুষ্ট থাকল?' এই বলেই হু-হু
করে কান্নায় ভেঙে পড়ল অমৃতা। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, 'তোমার ভগ্নীপতি এসে পড়ার আগেই আমার কাছে শোন আমাদের কাহিনী।
শেষটা কিন্তু রুদ্রদা বলবে।'
অমৃতা নিজেকে সামলে নিয়ে শুরু করল তার এতদিনের কাউকে না বলা জীবনকাহিনী।
- 'আমি যার নূপূরের ছন্দ গানটা দিয়ে শুরু। তারপর যতবার দেখা হয়েছে গান শুনতে চেয়েছে অনিদা। আমি বিশ্বভারতীতে পড়লেও যে তার সঙ্গে
সংগীতভবনের কোনও সম্পর্ক নেই এটা বোঝাতে পারতাম না ওকে। প্রথম প্রথম
ভাল লাগত এই ভেবে যে আমার গান কেউ এত মনোযোগ দিয়ে
শুনতে চাইছে, এছাড়া আর কিছু তখন মাথায় আসত
না। একদিন সুবর্ণরেখার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি
বহুদূর, প্রায় নির্জনে একটা পাথরের উপর বসেছি দুজনে।বলার মত কথা আর কিছুই
নেই তখন, অনিদা দাবী করে বসল, গান শুনবে। তুমি ত জানই, ও শুনতে
চাইলে আর পরিত্রাণ নেই। অগত্যা ধরলাম
রবীন্দ্রসংগীত-
"আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে,
তুমি জান নাই, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা
সাধনে।।"
- 'গান শেষ হতেই আবার স্তব্ধতা। নভেম্বরের
অস্তরাগের আবছা আলোয় সুবর্ণরেখার জলে সন্ধ্যাসূর্যের প্রতিবিম্বের
ঝিকিমিকির দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টে। হঠাৎ যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে এল অনিদার গলা- 'তুমি ত আমাকে
পেয়েছ অমৃতা, এবার আমি তোমাকে কি ভাবে পাই বল ত? তুমি এখন
সাবালিকা। তাই তুমি নিজের দাবী চেয়ে আজ সোচ্চার হতেই পার।' '
- 'লোকে বলে সুবর্ণরেখার বালিতে নাকি সোনা পাওয়া
যায়। তবে সে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। কে জানত আমাদের ভাগ্যে কি লেখা ছিল। নয়ত যেদিন অনিদা বড় মুখ করে আমাকে নিজেদের
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাবা-মার কাছে আমাকে
নিয়ে তার স্বপ্নের ইঙ্গিত দিয়েছিল, সেদিন আমাকে
একা ফিরতে হয়েছিল একরাশ লজ্জা আর অপমান বুকে বয়ে। সে বাড়িতে
আমার বধূরূপে পা রাখা নাকি কোনমতেই সম্ভব নয়।'
আমি এ গল্পের পরিণতি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। এর পরেই
হোস্টেলে ফিরে অনিরুদ্ধ আমাকে আমার জাত জিজ্ঞেস করে আর
নিজের উচ্চবর্ণের ঝুটো অহংকার দেখায়। আজ সব কিছু যেন
জলের মত পরিষ্কার হয়ে উঠল আমার কাছে।
- তাহলে অনিরুদ্ধের বাবা-মার আপত্তি ছিল! কিন্তু
ওর নিজের কি কোনও জোর ছিল না এ ব্যাপারে? না না, এ সব সেকেলে ধ্যান-ধারণা সমর্থনের যোগ্য নয়- আমি বললাম। অবশ্য তার
পরে-পরেই ওর বাবার একটা হার্ট-অ্যাটাক হয়, একেবারে যমে-মানুষে
টানাটানি।
- 'সেসব পরে শুনেছিলাম। আমি তখন বিশ্বভারতীর
হোস্টেলে, বারো ক্লাসের পরীক্ষা দিচ্ছি।
আমার বাবা তাঁকে হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করতে গেছিলেন, তাঁকে
অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়, আর গভীর রাত্রেই
মেসোমশাইয়ের স্ট্রোক হয়। আমার বাবাও কেমন যেন মেন্টাল ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়েন। ফলে আমাদের সম্পর্কের সেখানেই হয়
ইতি। তারপর খবর পাই অনিদা এম-এস-সি পাশ
করে চাকরি পেয়েছে। আমিও গ্র্যাজুয়েট হতে হতেই ভাল পাত্র পাওয়া মাত্রই
বাড়ি থেকে আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তুমি কিন্তু আমার বিয়েতে আসনি
রুদ্রদা!'
তারপর অনিরুদ্ধের আর কোনও খবর পাস নি?
- 'পেয়েছি বই কি, কিছুটা ভাসা ভাসা। তাই ত তোমাকে
ধরেছি। সব না শুনে আমার ত মুক্তি নেই।
(৫)
তাহলে শোন। আমি নিশ্চিত যে অনিরুদ্ধ হনুমানের মত বুক চিরে
দেখালে ওর মধ্যে শুধু তোর নামটাই লেখা পাওয়া যেত।
বড্ড নাটকীয় শোনাচ্ছে, না? কি করব, সত্যিটা যে তাই। অথচ সে নামখানি আমাদের সামনে কখনও মুখ ফুটে
উচ্চারণ করেনি, কারণ জানত, তাহলেই হয়ত
আমাদের প্রাণপণ চেষ্টায় ক্ষতস্থানের গভীরতা আরও বেড়ে যাবে। জাতের অভিমান
মানুষের ভীষণ বড় অভিশাপ রে। তাই নিজের ক্ষত প্রাণপণে বুকে চেপে ধরে
রেখে গিয়েছিল সে চিরকাল।
আমরা একদিন মাস্টার্স হলাম। আমি কোয়ার্জের ক্রিস্টালের
পিজো-ইলেক্ট্রিক এফেক্ট নিয়ে একটা গবেষণার কাজে লেগে
পড়লাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিরুদ্ধ কিন্তু আর
রিসার্চের দিকে এগোল না। জিওলজিস্টের ইন্টারভ্যুতে কল পেয়েছিল ওএনজিসিতে, সেখানে
পর্যন্ত গেল না। শেষে ঝাড়খণ্ডের (তখন বিহার) গুয়াতে একটা প্রাইভেট
আয়রণ ওর মাইনে কাজ নিয়ে চলে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল সব। জিওলজিস্টদের তো পাহাড়-জঙ্গলে
ছোটাই চিরকালের কাজ, এতে কে কি মনে করতে পারে? আমি মাঝে
মাঝে ঠাট্টা করে বলতাম, 'ও হে শোভনলাল
দি গ্রেট! হিস্ট্রি রিপীট করানো অনেক হল। তোর লাবণ্যের
নামটা বল একবার, তাকে পিঠে করে তুলে নিয়ে আসি।' ও শুধু হেসেছিল।
তারপর সে আরেক চৈত্রমাসে আমার ক'দিনের ছুটি
ছিল, এক সকালে আড্ডা দিচ্ছি, শিশির আর অনিরুদ্ধ এসে হাজির যাদবপুরে আমার হোস্টেলে। শিশির
তখন হিন্দুস্তান কপার, ঘাটশিলায়। কী
একটা কাজ নিয়ে কলকাতায় এসেছিল যেন। 'কী ছুটিতে
হোস্টেলে বসে গ্যাঁজাচ্ছিস! চল আমার ওখানে কাটিয়ে আসবি ক'দিন,' হৈ-চৈ চিৎকার
জুড়ে দিল অনিরুদ্ধ। তারপর আমাদের কোন কথা না শুনে টেনে
নিয়ে এল গুয়ায় ওর কর্মস্থলে।
গুয়া জায়গাটা জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা এক মনোরম বন্য পরিবেশের
মধ্যে। হাওড়া-বড়বিল জনশতাব্দী তখনও চালু হয় নি, স্টীল ধরে
এলাম টাটানগর, সেখান থেকে টাটা-গুয়া প্যাসেঞ্জার। রাজখরসোয়ানের সিঙ্গাড়া বিখ্যাত- বলে
প্রায় একঝুড়ি গরম সিঙ্গাড়া পাগলের মত নিয়ে এল অনিরুদ্ধ। কি করব, পড়েছি মোগলের
হাতে! বড়াজামদার পর থেকে শুরু হল সবুজের সমারোহ। গুয়া
স্টেশনে নেমে দেখি ওদের কোম্পানীর জীপ দাঁড়িয়ে আছে
আমাদের পিক-আপ করতে। বন-জঙ্গলের মাঝে মাঝে লাল-লাল
ছোট-বড় পাহাড়। সাধারণ বাঙালিদের কাছে শান্তিনিকেতনের খোয়াই বলে ভুল হতে পারে। তবে খোয়াইয়ের ল্যাটেরাইট নয়, এমনকি
পুরোপুরি হেমাটাইটও নয়, এগুলোকে বলে BHQ বা Banded
Haematite Quartzite- হেমাটাইটের মাঝে মাঝে কোয়ার্জাইটের
স্তর। প্রথমে টাটার খনি, তারপর স্টীল
অথরিটির, তারপর ওদের কোম্পানীর, তাদের খনিজের
মধ্যে আবার জেসপারের ব্যাণ্ডও পাওয়া যায়, যাকে এরা বলে BHJ।
'আমাদের পাহাড় কাটতে হয় না', অনিরুদ্ধ বলে, আমরা ওপেন
কাস্টের মত মাটি কাটি। তবে কোলিয়ারির মত
ওভার-বার্ডেন থাকে না বললেই চলে, প্রায় পুরোটাই ট্রাকে করে প্রিলিমিনারি প্রসেসে চলে যায়'।
(৬)
দু-দিন খুব হৈ-হুল্লোড় করে কাটল। আমাদের ইয়ং বয়েস, পাহাড়-জঙ্গলে
ছুটোছুটি করা তখন কোনও ব্যাপারই নয়। তারপর এল পূর্ণিমার সেই রাত। 'আজ
বুনো-মুরগীর ঝাল রেঁধেছে আমাদের হিরো সিল্ভেস্টার স্ট্যালোন।' কালো
গ্রানাইটের মত পেটানো কালো চেহারার ওঁরাও রাঁধুনী
সিলভেস্টার খ্যালখোকে ওই নামেই ডাকত অনিরুদ্ধ। 'আজ খেয়ে-দেয়ে
বেশ একটা দিবানিদ্রা দেওয়া যাক বুঝলি, তারপর
জ্যোৎস্না রাতে সবাই যাব বনে। আজ রাত্রে আর ঘুমোব না, কী রাজী তো?'
- জী হুজুর। রোমে যখন এসেছি, সম্রাট নীরোর আজ্ঞা পালন করতেই
হবে। আমি বলি।
- 'কী? আমি নীরো? রোম পুড়ছে আর
উনি বেহালা বাজাচ্ছেন! আরে, আমি তো
বেহালা-বাঁশি কিছুই বাজাতে জানি না'- বলে হো হো করে খুব একচোট হেসে নিল অনিরুদ্ধ।
খাওয়াটা জম্পেশ হয়ে গেছিল। বিকেল চারটের পরে আমাদের ঘুম ভাঙল। চা খেতে খেতে
হঠাৎ অনিরুদ্ধ গেয়ে উঠল তার স্বভাবসিদ্ধ বেসুরো গলায়-
'তার কাছে যেতে যদি কাঁটা বেঁধে পায়-
যদি শাশুড়ি-ননদী মুখে কালি দিতে যায়,
তবু, নিকটে যাইব তার না মানি সমাজ।।'
তারপর কি ভেবে বলে উঠল- 'আচ্ছা রুদ্র, শিশির, বলতে পারিস, সেই কোনকালে
রাধা যেটা ভাবতে পেরেছিল, আজকের ছেলেমেয়েরা ততটা আধুনিকও হয়ে উঠতে পারল না কেন?' তারপরে যেন
আত্মগত ভাবেই বলে উঠল, 'কাকেই বা দোষ দিচ্ছি...'আমি স্বখাত
সলিলে ডুবে মরি শ্যামা'!' বুঝছি ওর মনের মধ্যে
ঝড় বইছে। তখন কি আর জানি যে তোর বিয়ের কথাবার্তা চলছে অন্যত্র। আচ্ছা অমৃতা, একটা কথা বল
তো...
- 'কী, বল।'
তোদের শেষ দেখার সময় কী হয়েছিল?
- 'ও শান্তিনিকেতনে এসেছিল। সন্ধের আকাশে মস্ত
চাঁদ উঠেছিল। কোপাইয়ের ধারে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অনি জিজ্ঞেস করল আমি 'সেদিনের
সোনাঝরা সন্ধ্যা' গানটা জানি কিনা। বললাম, জানি, তবে কখনও গাই নি। ওটা তো শ্যামল মিত্রের গান। ও বলল এ গানের
আবেদন সর্বজনীন, সর্বকালীন। তখন আমি কিছুটা
গাইলাম। তারপর অনি বলল...'
কী বলল?
- 'আমি সব ভুলে ওকে বিয়ে করতে চাই কিনা। আমি
রাজী হই নি, কারণ তা করলে ওর পরিবারের অমতে
করতে হত, আর উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণত্বের অহংকারে স্ফীত ওদের গোঁড়া পরিবার একটা
মাহিষ্য-পরিবারের মেয়েকে কিছুতেই মেনে নেবে না।'
তুই ভুল করেছিলি।
- 'কী বললে?'
ঠিকই বলেছি আমি। কারণ চাঁদ ওঠার পর থেকেই শুরু
হল ওর পাগলামি। এতদিন গান শুনত, সেটা তবু ভাল ছিল। আজ যাচ্ছেতাই রকম বেসুরে অথচ পুরো দরদ দিয়ে ধরল-
'দু'জনে শুধাই যদি তোমারে কি দিয়েছি,
আমারেই তুমি কি বা দিলে! সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা...'।
গান গাইতে গাইতে কোয়ার্টার ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগল
অনিরুদ্ধ, পেছন পেছন আমি আর শিশির। 'সাহেব, আগে জ্যাদা
দূর মত যাইয়ে, পিছলে হফতে কা সীম অভভি খুলা হ্যায়...' চেঁচিয়ে উঠল
সিলভেস্টার। কে শোনে কার কথা। আসলে নতুন একটা সীম ওপন করার পর
কিছুটা গভীর হলে তার তিনপাশটা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়, যাতে কোন
হাতি বা অন্য বন্য-জন্তু খাদে না পড়ে যায়, মানুষ আর কেই
বা যায় সেদিকে!
অনিরুদ্ধের গলা ধীরে ধীরে দূরে সরতে লাগল। আমরা
দুজন তখন চন্দ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। জঙ্গলে গভীর রাতে মায়াময় জ্যোৎস্না যখন ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির উপর, সে এক
স্বর্গীয় দৃশ্য। চাঁদের বুক থেকে তরল
রূপো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের চূড়ায়, গাছের মাথায়, সেখান থেকে
গলে গলে যেন গড়িয়ে যাচ্ছে নীচে, মাটির
উপর......ঠিক মনে হচ্ছে প্রকৃতিদেবী যেন অবিশ্রাম
স্নান করে চলেছেন গলিত রজতধারায়। শিশির তো ডি-লা-মেয়ার থেকে আবৃত্তি শুরু
করে দিল-
'Slowly, silently, now the moon
Walks the night in her silver shoon;
This way, and that, she peers, and sees
Silver fruit upon silver trees;
One by one the casements catch
Her beams beneath........'
হঠাৎ নৈশ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেসে এল কার
আর্ত চিৎকার- 'বাঁচাও...'। খেয়াল হল
অনিরুদ্ধের গান থেমে গেছে অনেকক্ষণ
আগেই। সিলভেস্টার বারান্দার সিঁড়িতে বসে ঝিমোচ্ছিল, এক ঝটকায় উঠে ছুট দিল শব্দ লক্ষ্য করে, পেছন পেছন
আমরাও।
(৭)
- 'তারপর?' অমৃতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল যেন
বহুদূর থেকে।
কোয়ার্টার থেকে প্রায় তিনশ'-সাড়ে তিনশ' মিটার দূরে
ছিল উন্মুক্ত খাদ, যার কথা সিলভেস্টার বলছিল।
সেইখানে প্রায় আশিফুট নীচে থেকে উদ্ধার করা হল অনিরুদ্ধকে, ক্ষতবিক্ষত
শরীরে মৃতপ্রায় অবস্থায়। সেখান থেকে নোয়ামুণ্ডির টিস্কো হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়া হল ওদের কোম্পানীর মেডিক্যাল
অ্যাসিস্ট্যান্টের সাহায্য আর তৎপরতায়। তারপর তিনদিন ধরে
যমে-মানুষে টানাটানি। তোর তখন গায়ে-হলুদ হচ্ছে। হয়ত জামশেদপুর নিয়ে গেলে খবরটা পেতিস যথাসময়ে, তবে
কাকাবাবু-কাকীমা চেষ্টা করলেও ও তখন আর মুভ করার মত
অবস্থায় ছিল না। অবশ্য টিস্কো হাসপাতালের চিকিৎসা-ব্যবস্থা বেশ ভাল। ও বাঁচত হয়ত, যদি বাঁচতে
চাইত। শেষ সময় পর্যন্ত কিন্তু ভুলেও কারো নাম মুখে আনে নি।
শুধু অবান্তর কিছু কথা যেমন.....'মেঘাতুবুরুতে কপার পাওয়া গেল না, না? শিশির, তোদের
ঘাটশিলার শিলাতে কি কান্না জমে? আমার টেবিলে ফুল্স্ গোল্ড আছে, যার শিখিপাখা
তাকে দিয়ে দিস রুদ্র, প্লীজ......।'
ওগুলো কার, কাকে দেব? অনিরুদ্ধ, বল কাকে দেব?
'খুঁজে নিস, রুদ্রাক্ষ বি-শ্বা-স' অনেক কষ্টে
টেনে টেনে বলল সে, তারপরেই চুপ, চিরনিদ্রায় ঢলে
পড়ল অনিরুদ্ধ।
- 'মাসিমা-মেসোমশাই কিছু বলেননি আমার সম্বন্ধে?' আকুল হয়ে
শুধোয় অমৃতা।
না, আমরাও কিছু জানতে চাইনি। এখন
বুঝতে পারছি আমার পুরো নামটা বলে কী বোঝাতে চাইছিল ও।
আরে, এস এস অনিন্দ্য, কতক্ষণ এসেছ? দেখি ভেজানো
সদর দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রায় ঢুকে পড়েছে আই-এ-এস অফিসার অনিন্দ্য
চট্টোপাধ্যায়, আমার সদ্যপরিচিত ভগ্নীপতি।
- 'তা এসেছি অনেকক্ষণ। আপনাদের কথাবার্তায় ইচ্ছে করেই ব্যাঘাত ঘটাইনি।'
- 'তাহলে তো সবটুকুই শুনেছ?' অমৃতা বলে।
- 'সে কি আজ? কুড়ি বছর আগেই শুনেছি সব। তোমাকে বিয়ের পরে আমাদের যেন ছন্দে ঠিক মিলছিল না।
তাই শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলি। কাউকে বলিনি
বাকি খবর পেয়েছি শিশিরের কাছে ঘাটশিলায় গিয়ে, ও ছিল আমার
স্কুলের বন্ধু, নেতারহাট স্কুলে আমরা পড়েছি
একসাথে।
- 'তারপরেও আমাকে বল নি কিছু?' অবাক প্রশ্ন অমৃতার।
- 'কি হবে বলে? মুর্খের সোনা আর সত্যিকারের সোনার মধ্যে আমি তফাৎ করতে পারি। এই যে
ব্রাহ্মণ হয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি, তাতে কি আমার
লেজ গজিয়েছে, নাকি মাথায় দু'টো শিং? আমার কষ্ট হয় অনিরুদ্ধের বাবা-মায়ের জন্যে। সব হারিয়ে জানিনা তাঁরা
কি মোক্ষলাভ করলেন!'
আমরা নির্বাক হয়ে রইলাম। আমাদের কারো খাওয়া-দাওয়া হয়নি, কিন্তু আমার
গৃহকর্ত্রী গল্প শোনার ফাঁকে নিজের কর্তব্যটুকু করে গেছেন। লাঞ্চ
রেডি, আমরা নিঃশব্দে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম।
যাবার সময় কপার পাইরাইটের টুকরোটা অমৃতাকে দিতে গেলাম- 'এটা এখন তোর
সম্পত্তি'। আমাকে অবাক
করে দিয়ে ও সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল- 'আগে ভাবতাম যে
আসল সোনা হারিয়ে আমি নকল সোনা পরেছি গলায়। আজ সে ভুল ভাঙল। আজ
জানলাম যে আমার গলায় আজও আসল সোনাই আছে। তাই এই
স্মৃতিচিহ্নে আমার আর কোনও কাজ নেই, রুদ্রদা ওটা তুমিই রেখে দাও।'
(শেষ)