Wednesday, December 13, 2017

রবিবারের ম্যাজিক।।


বাবা বেঁচে থাকতে আমরা রবিবারটাকে 'মাংসবার' বলেই জানতাম, কারণ সেদিন সকাল থেকেই আমাদের বাড়িতে থাকত উৎসবের মেজাজ। সকাল সকাল বাবা ইসমাইলের দোকান থেকে খাসির মাংস নিয়ে আসতেন, একটু বড় হবার পর সে দায়িত্বটা আমি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করি। তারপর শুরু হত রান্নাঘরের পর্ব। ভাইবোনেরা মিলে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়ানো, হামানদিস্তায় গরমমশলা গুঁড়ো করা...। বাবা একসময় স্নানে যাবার আগে মশলা বেঁটে যেতেন- তাঁর ধারণা ছিল এটা পুরোপুরি পুরুষোচিত কাজ। আর রান্নার বাকি কাজটা মা করতেন। সে মাংস এত টেস্টি হত যে বাড়ির ঠিকে ঝি কোনোদিন কোনও কারণেই রবিবারদিন ছুটি নিত না।

 তারও আগে, মানে ঊনিশশো পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি নাগাদ একই ধারা ছিল পুরুলিয়ায় আমার ঠাকুর্দার বাড়িতে। রবিবার মানেই পাঁঠার মাংস। ভাগ্যিস বৈঠকখানা থেকে রান্নাঘরের মাঝে একখানা উঠোন ছিল, নয়ত গন্ধে দাদুর ওকালতির কাজকর্ম মাথায় উঠত, মক্কেলরাও অর্ধভোজন সেরে নিত। তবু কি গন্ধ চাপা থাকত? তাহলে দক্ষিণাদাদু সেদিন ঘরে ঢুকেই হাঁক পাড়লেন কেন- 'কী মাংসই রাঁধছেন বৌঠান, নীলকুঠিডাঙায় ঢুকেই গন্ধ পেয়েছি!' গল্পটা যাঁকে নিয়ে সেই দক্ষিণাদাদুকে হয়ত আজকের দিনের লোকজন চিনবেন না, তিনি ছিলেন আমার ঠাকুর্দার অনুজপ্রতিম বেলকুঁড়া গ্রামের বাসিন্দা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী। এমনিতে বেশ মজার মানুষ, তবে তন্ত্রমন্ত্রের সাধক গুণীন হিসেবে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিল পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে।

  দাদু মারা যাবার বছর-দুই পরে পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন একটা খাতা পেয়েছিলাম খুঁজে। তাতে লেখা ছিল বেশ কিছু মন্ত্র। ছিল বাটি চালান, জল-পড়া, হলুদ-পড়া, নখ-দর্পন, বশীকরণ, বিষ নামান, ঝাড়-ফুঁক এরকম অজস্র পদ্ধতি আর তাদের মন্ত্র। তবে সব শেষে ছিল দাদুর হাতে লেখা একটি মারাত্মক উক্তি- 'সব মন্ত্র পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কিছুতে কোনও কাজ হয় না। ব্যাটা দক্ষিণা ডাহা ঠকাইয়াছে! তবু এখনও অবাক হইয়া ভাবি, মাংস রান্নার সময় সে সেদিন কী করিয়াছিল?'

আমার মনে ছিল ঘটনাটা আগাগোড়া, যদিও আমার বয়স তখন বড়জোর ছয়।

দাদুর বয়স হয়েছে, পাবলিক প্রসিক্যুটারের পদ থেকে অবসর নিলেও তখনও উকিল হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে চলেছেন পুরুলিয়া জেলা আদালতে। সেদিনও ছিল এমনই এক রবিবার। ঠাকুমা পাঁঠার মাংস রান্না করছেন। ছুটির দিন বলে দাদুর কাছারি বন্ধ থাকলেও তিনি বৈঠকখানাতে বসে মুহুরি আর মক্কেলদের সাথে আলোচনা করছেন চলতি কেসের খুঁটিনাটি নিয়ে। এমন সময় কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে দক্ষিণাঠাকুর এসে হাজির। দাদুকে ব্যস্ত দেখে বললেন, তোমার সাথে পরে কথা হবে, আগে বৌঠানকে দেখে আসি। আমাদের বাড়িতে তাঁর ছিল অবারিতদ্বার।

'কি রাঁধছেন গো বৌঠান? পাঁঠা নাকি! আহা, পাড়ায় পা রাখতেই গন্ধ পেয়েছি গো। তা আর কদ্দুর?'
'এই তো হয়ে এল। তা দক্ষিণা, এলেই যখন, একেবারে খেয়েই যেয়ো।'
'সে...... আপনার পাঁঠা যদি দয়া করে সেদ্ধ হন,' উনি হাঁড়িটা ধরে ভেতরটা একবার দেখে নিলেন, 'আমি দাদার কাছে বসছি গিয়ে ততক্ষণ'।

এরপর শুরু হল নাটক। যে মাংস পাঁচ মিনিটে সেদ্ধ হবার কথা, যদিও তখন প্রেসার কুকার ছিলনা, একঘণ্টা, দেড়ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, বারোটা থেকে দুটো বেজে গেল, তার সেদ্ধ হবার নাম নেই, সেই একই রকম শক্ত। দাদুর মক্কেলরা চলে গেছেন একে একে। শেষে দাদু কিছু একটা সন্দেহ করে পা বাড়ালেন রান্নাঘরের দিকে। 'কি হল গো, মাংস সেদ্ধ হয় না কেন? মহা অবাধ্য পাঁঠা তো!' হাঁক দিলেন দাদু। তারপর সব কথা শুনে বসার ঘরে এসে দক্ষিণাদাদুকে বললেন, 'তুমি আর জাদুবিদ্যা দেখাবার লোক পেলে না, রাগ ঝাড়লে শেষে ঐ নিরীহ পাঁঠার উপর!' দক্ষিণাঠাকুর হেসে আবার ছুটলেন রান্নাঘর। হাঁড়িটা একটু নেড়ে দিয়ে ঠাকুমাকে বললেন- 'বৌঠান, মাংস দু'ঘণ্টা আগেই সেদ্ধ হয়ে গেছে। খামখা আপনি রাগ করছিলেন।'

সেদিন আমাদের ভাগ্যে গলে পাঁক হয়ে যাওয়া মাংস জুটেছিল। তবে দক্ষিণাদাদুর ম্যাজিক ছিল উপরি পাওনা যার কথা এখনও মনে আছে। কিন্তু...... তাহলে উনি দাদুকে যে মন্ত্রগুলি লিখে দিয়েছিলেন, সেগুলো কাজ করেনি কেন? উত্তর খুব সোজা। জাদুকরেরা কি মন্ত্রের জোরে ম্যাজিক দেখান? তাহলে তো আজ ঘরে ঘরে পিসি সরকার জন্মাত!

No comments:

Post a Comment