তটতটতোটয় তটিনীতীরে।
(গল্প)
নদীর নাম তটতটতোটয়। এই নদীর দুই তটে দুই শহর, বা সঠিক বলতে দুই রাজ্য- রাজপুর আর সাম্যনগর। রাজপুরের রাজা দুর্ধর্ষ মহাবীর, রাজ্যের প্রজা তাঁর পরাক্রমে তটস্থ। এই রাজ্যের দিকে নদী একটা বাঁক নিয়েছে বলে প্রতি বর্ষায় পাড় ভাঙা আর বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি লেগেই আছে কিন্তু তা নিয়ে জনতার মনে কোন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নেই। আর ক্ষোভ থাকবেই বা কেন? তারা তো জানে যে মানুষ সর্বদাই নিজের কর্মফল ভোগ করে। কর্মফলেই নিম্নবর্ণের মানুষের জন্ম, দারিদ্র্য রোগবালাই আর অকালমৃত্যু, এতে রাজার বা অন্য কারো দোষ তারা দেখতে পায় না। তাই সব অবিচার-অনাচার দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়ে ওরা সুখেই আছে।
তবে সাম্যনগরের রাজা- না না, রাজা নেই সেখানে। সাম্যতন্ত্র বিরাজিত সেখানে, ধনী-দরিদ্রে ভেদ নেই, মানুষ না খেয়ে মরে না খুব একটা। হ্যাঁ, সম্বুদ্ধ নামে শাসক আছেন একজন, ছোট একটা দলবল নিয়ে নিয়মমাফিক হুঁহাউ দেশের আচারসংহিতা মেনে রাজ্যশাসন করেন তিনি। এই রাজ্যে ঈশ্বরের পূজা হয় না, হুঁহাউ দেশের অধিপতিকেই ভগবান মনে করে স্তব করে লোকে। এখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু নেই, ধন-উপার্জনের অধিকার মৌলিক অধিকারের আওতায় পড়ে না, এমনকি ব্যক্তি-জীবনের উপরেও রাষ্ট্রের অধিকার, শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই অনেক দূরের ব্যাপার, সামান্য মৌখিক প্রতিবাদ করার অধিকারও নেই কারো। হাসিমুখে না হলেও শুধুমাত্র বেঁচে থাকার স্বার্থে এই সংবিধানও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে জনগণ।
এ হেন দুই রাজ্যের জনসাধারণ কিন্তু এক ব্যাপারে একমত। দুই রাজ্যই একে অপরকে শত্রু বলে মনে করে, একটা চিরস্থায়ী রেষারেষি পরস্পরের মধ্যে রয়েছে যুগান্তকাল ধরে। রাজা আর শাসকদের মধ্যে মাঝে মাঝেই কূটনৈতিক আলোচনা হয়, কিন্তু পরমুহূর্তেই দুর্ধর্ষ আর সম্বুদ্ধ নিজের নিজের রাজ্যের জনতার সামনে একে অন্যের দেশের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
নদীর ঠিক মাঝামাঝি আছে একটা ডিম্বাকার দ্বীপ, যার আদি নাম ব্রহ্মস্ফুট। কথিত আছে এই দ্বীপেই পুরাকালে ব্রহ্মগুপ্ত নামে বিজ্ঞানী ঋষি নির্জনে বসে জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করতেন, বৃত্ত আর বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নিয়ে দ্বীপজুড়ে অনেক আঁকাজোকা করে ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত বলে এক বিশাল বই লেখেন তিনি এই দ্বীপে বসে। এই দ্বীপ নামে একসময় গোল বা বৃত্তাকার ছিল, পরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে উপবৃত্তীয় থেকে অণ্ডাকার হয়েছে এখন, নামটাও সাধারণ লোকে উচ্চারণ করতে পারে না, বলে 'বোমফটকা'।
এই বোমফটকা দ্বীপে সভ্য মানুষ এখন আর থাকেনা। ধিগড়ি নামের কিছু উপজাতীয় মানুষ এর একপ্রান্তে হাঁস-মুরগি-শুয়োর ইত্যাদি পালন করে, দুই রাজ্যের লোকই যখন খুশি নৌকোয় করে গিয়ে খাদ্য-রসদ কাপড়চোপড়ের বিনিময়ে সেসব নিয়ে আসে।
একদিন এই দ্বীপে সপার্ষদ শিকারে এসেছেন দুই দেশের শাসক। সম্বুদ্ধ দেখলেন একটা শুয়োরকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বর্শা হাতে প্রায় জন দশ-বারো ধিগড়ি যুবক। অন্য দিক থেকে দুর্ধর্ষও লক্ষ্য করলেন যে শুয়োরটা ওদের হাতের কাছাকাছি বার কয়েক এসে পড়লেও ওরা তাকে মারছে না, বরং পালাতে দিচ্ছে আর অহেতুক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় আধঘন্টা পরে সবাই মিলে ঘিরে শেষে পশুটাকে গাঁথল, আশ্চর্য, তার আগে নয়। 'কী রে, শুয়োরটা খোঁয়াড় থেকে পালিয়েছিল বুঝি?'- সাম্যনগরের শাসক জানতে চাইলেন। ততক্ষণে রাজপুর-রাজও এসে পড়েছেন সেখানে। দুই ক্ষমতাবান পুরুষকে একত্রে দেখে হাতজোড় করে ওরা জানাল- 'আজ্ঞে না, ওদেরকে আমরাই ছেড়ে দিয়েছিনু, শিকার করব বলে।'
- সে কী রে, পোষা প্রাণীর শিকার! কেন?
- এজ্ঞে, বেশ ভাল করে ছোটালে শরীল গরম হয় এদের, রক্ত জোরে ছোটে। তখন মারলে মাংসের খুব স্বাদ হয়।
রাজপুরের রাজবাড়ির আর সাম্যনগরের শাসকদের খাবার জন্যে মোরগ আসে এই দ্বীপ থেকেই। হলুদ-ঝুঁটি মোরগগুলো রাখা হয় রাজপুরের জন্যে আর লালঝুঁটিগুলো সাম্যনগরের জন্যে। এর অন্যথা হবার উপায় নেই। দুই রাজ্যপ্রধানই গোটা-বিশেক করে মোরগ নিয়ে এল নিজের নিজের রাজ্যে। আসার আগে ধিগড়িদের বানানো এক-এক পাত্র মাধ্বীসুরা দুজনে মিলে গিলে কিছু গোপন আলোচনা করে নিজের নিজের রাজ্যে ফিরলেন, দু চারজন পারিষদ ছাড়া কেউ জানল না সে কথা। দু মাস নিঃশব্দে কেটে গেল।
(২)
'আসচে শনিবার বিকালে রাজপুরের সঙ্গে সাম্যনগরের মোরগের লড়াই হবে। তোটয় লদির ধারের কেল্লার মাঠে সবাই আসবেন গো!'- ঢ্যাঁড়া বাজিয়ে ঘোষণা করে গেল রাজ্যের পাড়ায় পাড়ায় রাজবাড়ির ঘোষক। একইরকম ঘোষণা সাম্যনগর রাজ্যেও সর্বত্র করা হল। দুই রাজ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। শনিবার সকাল থেকেই সাম্যনগরের অধিবাসীরা দলে দলে নদী পার করে কেল্লার মাঠে জমা হতে লাগল।
দুই পক্ষেরই পরস্পরের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষপূর্ণ উল্লাসের মধ্যে শুরু হল মোরগের লড়াই। পাশাপাশি দুই বিশাল চাঁদোয়ার তলে দুই রাজ্যের কর্তাব্যক্তিরা, বিলাসবহুল গদি আঁটা আসনে বসে লড়াই দেখতে উদগ্রীব। হলুদ চাঁদোয়ার তলে রাজাধিরাজ দুর্ধর্ষ সভাসদবেষ্টিত হয়ে আর পাশের লাল চাঁদোয়ার নীচে সপার্ষদ সম্বুদ্ধ। সময় হতেই একজন পীতাম্বর মোরগপাল দশখানা হলুদ ঝুঁটিওয়ালা মোরগকে সগৌরবে ছেড়ে দিল মাঠের মাঝখানে বিশেষভাবে তৈরি বৃত্তাকার গর্তের আখড়ার মধ্যে। পরিবর্তে লালকাপড় পরা প্রশিক্ষক ঠিক দশটা লালঝুঁটি মোরগকে নামিয়ে দিল ওই যুদ্ধ-গহ্বরে। প্রতিটা মোরগের বাঁ পায়ে শক্ত করে বাঁধা অর্ধচন্দ্রাকৃতি সুতীক্ষ্ণ ছুরি যাকে বলা হয় কাইত। এই দু-মাস ধরে মোরগগুলোকে বোমফটকা দ্বীপে গিয়ে গিয়ে যুদ্ধ-বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছে দুই রাজ্যের মোরগ-প্রশিক্ষকেরা। আজ তাদেরও তাই পরীক্ষা। দু-তিনজন সরকারি জুয়া-পরিচালক যাদের দুরোদর বলে থাকে লোকে, দর্শকদের কাছে গিয়ে গিয়ে জুয়ার দর জানিয়ে নাম লিখে মুদ্রা সংগ্রহ করতে লেগে গেল। আজ এযাবৎকাল নিষিদ্ধ কৈতব কলা সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ায় জনসাধারণ উল্লসিত। তারা মহাসমারোহে বাজি রাখতে লাগল।
খেলা শুরু হল। প্রবলপরাক্রম সাম্যবাদী মোরগদের কাছে রাজতন্ত্রী মোরগরা নখ-দন্ত আর ক্ষুরধার কাইতের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বেশ কিছু মোরগ মারা যেতেই দুই পক্ষে আরো পাঁচটা পাঁচটা করে মোরগ ছাড়া হল যুদ্ধের গহ্বরে। এবার সাম্যবাদীরা হারতে শুরু করল। যুদ্ধ শেষ হতে দেখা গেল লালঝুঁটি মোরগগুলো সবকটা শেষ, তিনটি হলুদঝুঁটি বেঁচে থাকতে রাজপুরের হর্ষোল্লাসের মাঝে লড়াই শেষ হল। রাজপুরের সুপকার সাঁইত্রিশখানি প্রবল সংগ্রামের ফলে মৃত মোরগ সৈনিকদের শবদেহ তুলে পাকশালার দিকে রওনা হল। 'চলুন সম্বুদ্ধ, আমার প্রাসাদে আজ আমার আতিথ্যে কাটিয়ে যাবেন আজ রাতটুকু'- রাজা দুর্ধর্ষ সাদর আমন্ত্রণ জানালেন সাম্যনগরের মহামান্য শাসককে।
- রান্নাটা জমিয়ে করেছে হে তোমার সুপকার, সম্বুদ্ধ একটা মোরগের পা-এর টুকরোতে কামড় দিয়ে বললেন।
- সতেরটা মোরগ শেষ করতে হবে যে! মৈরেয় সুরার পাত্রটা তো অর্ধেকও খালি হয়নি এখনও।
- আমার বুদ্ধিটা তাহলে কাজে লেগেছে, কী বল রাজা? যুদ্ধের মত পরিশ্রম করে মরা জীবের স্বাদই আলাদা। ভাগ্যিস লড়াইয়ের কথাটা আমার মাথায় এল!
- সে তো আমিই বললাম ধিগড়িদের ছুটিয়ে শুয়োর মারা দেখে। এর পরের বারের খেলা আর ভোজটা কিন্তু তোমার রাজ্যে।
- তা আর বলতে। জুয়া থেকে কত আমদানী হল হে? সুরা আছে আর?
- মদ? কত চাও? মাধ্বী, মহুয়া, বদর, উদুম্বর, ন্যগ্রোধা......তোমার শাগরেদরা তো চুটিয়ে ফুর্তি করছে, কোনটাই ছাড়ছে না।
- বদরটা কী?
- তাও জানোনা? কিসের প্রশিক্ষণ দেয় তোমাদেরকে হুঁহাউ দেশে? বদর হয় টোপাকুল থেকে আর উদুম্বর হল ডুমুর থেকে তৈরি মদ। আমার সভাসদরা তো রীতিমতো দীক্ষিত প্রতিটি প্রকারে।
- পরের বারে আমার রাজ্যে কিন্তু জুয়ার সমস্ত আয়টা যাবে আমাদের রাজ্যের কোষে।
- সে আর বলতে!
এইভাবেই চলতে লাগল দুই শত্রু দেশের অধিপতিদের খানাপিনা আর আড্ডা। আশ্চর্যের কথা, কোন মাংসের টুকরোটা হলুদ ঝুঁটির আর কোন পা-টা যে লাল ঝুঁটি মোরগের, এই বিভেদের কথা একবারও কারো মাথায় এল না।
-
No comments:
Post a Comment