হারানো শহর।
(বিস্মৃত শহরের স্মৃতিচারণ)
(আমাদের প্রায়-বিস্মৃত অথচ মনের মণিকোঠায় বরাবরের জন্যে ঠাঁই নেওয়া শহর সিন্দ্রি নিয়ে একটা গল্পচ্ছলে তথ্যমূলক ধারাবাহিক লেখা লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১৬-১৭ তে। সে সময় অনেক সমমনস্ক প্রাক্তনী আর নবীনেরা অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন নানা তথ্য হিয়ে সাহায্য করে আর আলোচনায় অংশ নিয়ে। সে সময় কাজের চাপে লেখা শেষ করতে পারিনি , তাই আজ আবার নতুন করে শুরু করছি লেখাটা। সিন্দ্রির এক প্রাক্তন বাসিন্দা এক দাদু তাঁর মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন এক হারিয়ে যাওয়া শহরের ইতিকথা।)
(১)
'আমাদের একটা শহর ছিল।'
- এখন নেই শহরটা?
'না দাদুভাই। সহর-পুরাটা আছে, পুরা সহরটা মানে শহরটা আর নেই।'
- সেকি দাদু! শহর কোথায় যাবে? সে কি হাঁটতে পারে?
'কেন? রবি ঠাকুর কলকাতাকে 'নড়িতে নড়িতে' চলতে দেখেছিলেন না! সে শহরটাও একদিন কোথায় চলে গেল।'
- দাদু, তোমাদের শহরের গল্প বল না। কেমন ছিল, কিভাবে গেল, কোথায় গেল। আমি কখনও শহর কেন, একটা বাড়িকেও কোথাও যেতে দেখি নি।
দাদুর গল্প শুরু হল। নাতিবৃহৎ নাতি, যার নাম অর্ঘ্য, মুগ্ধ শ্রোতা। এক গল্প বারবার শুনেও তার আশ মেটে না।
'আমাদের শহরে ছিল অনেক গাছপালা। বর্ষাকালে কদম গাছ আর ছাতিম গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে যেত। সেখানকার লোকে বৃষ্টির নেশায় না কাঁঠালিচাঁপার গন্ধের নেশায় সন্ধে হতেই বলরামের চেলা হয়ে যেত, কেউ তা জানত না। আর বসন্তকালে? আমাদের স্কুলের মাঠে একটা বিশাল মহুয়া গাছ ছিল। কি যে মিষ্টি গন্ধ ছড়াত কি বলব।
'আমাদের একটা নদী ছিল। দামোদর। কোনও দর-দাম না করেই সে আমাদিগকে ঠাণ্ডা মিষ্টি জল খাইয়ে যেত সারাবছর ধরে। আর ছিল অজস্র খেলার মাঠ। আমরা সারাদিন ফুটবল, ক্রিকেট, পিট্টু আর গোবরডান্ডা খেলে বেড়াতাম।'
- তোমরা পড়াশুনা করতে না?
'নিশ্চয় করতাম। তবে মাস্টারমশায়রা তখন স্কুলেও পড়াতেন। তাই বাড়িতে তেমন না পড়লেও চলত। আর ছিল রাস্তা জুড়ে গরু-মোষ-ছাগল-গাধা। ওরা কখনও নড়ত না। গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে হত।
'আমাদের একটা পার্ক ছিল, প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরার নামে- তাতে সাত-সাতখানা লেক। সবচেয়ে বড় লেকটাতে ছিল একটা দ্বীপ।'
- দ্বীপ, মানে আইল্যাণ্ড তো!
'হ্যাঁ রে বাবা। সেই আইল্যাণ্ডে থাকত দুটো হরিণ আর একটা ময়ূর। আমরা একটা লেকে ছুটির দিনে সাঁতার কাটতে যেতাম।'
- সুইমিং পুল ছিল না?
'হয়েছিল। তবে অনেক পরে।'
এমন সময় দাদুর মোবাইলের রিং-টোনে সলিল চৌধুরির গান বেজে উঠল।
'ডাকিনী যোগিনী এলো শত নাগিনী
এলো পিশাচেরা এল রে।শতপাকে বাঁধিয়া নাচে তাতা-তাথিয়া নাচে রে!'
- দাদু এই গল্পটা আমিও শুনব- নাতনি আস্থা ছুটতে ছুটতে এল।
'কোন গল্পটা দিদিভাই? এসব ত তুমি অনেকদিন ধরে শুনছ। সব ত জান।'
- না আমি জানিনা এই গানটা তুমি রিং-টোনে কেন লোড করেছ। সেই গল্পটা শুনতে চাই।
'সব কথাই একে একে আসবে। বুঝলি দাদুভাই, আমরা কুল, পেয়ারা, কাঁচা আম কখনও কিনতাম না।'
- হ্যাঁ দাদু, তুমি একবার বলেছিলে। তোমাদের অনেক ভাইবোন থাকত বলে অনেক কিছুই কিনতে পারতে না।
'দূর বোকা! সে কথা নয়। সবার বাড়িতেই তো বাগান ছিল। সেই বাগানে সামনের দিকে লাগানো হত ফুলগাছ, মাঝখানে কেয়ারি করে ঢ্যাঁড়স-বেগুন-ফুলকপি-টম্যাটো আর ধারে ধারে থাকত আম, জাম, পেয়ারা আর সজনে গাছ।'
- কুলগাছও লাগাত লোকে।
'না, কুলগাছ কেউ লাগাত না। সে এমনিই গজিয়ে উঠত। যেমন আমাদের বাগানে ছিল। শীতের দুপুরে আমি আর গণশা ঢিল মেরে কুল পাড়তাম। জানুয়ারির নরম রোদে ঘরের লোকেরা উঠোনে বা বাগানে বসে আড্ডা দিত, মেয়েরা উল বুনত। হঠাৎ পেছনের উঠোনে ঢিল চলে গেলেই ছুটে আসত নীনা, অনর্গল পাঞ্জাবি ভাষায় ঝগড়া করে যেত। আমরা বুঝতাম না বলে পাত্তাই দিতাম না।'
- খুব দুষ্টু ছিলে না, তোমরা? তাহলে আমি দুষ্টুমি করলে বক কেন?
- না বকবে না, আদর করবে! তুই আমার ওয়াটার কালারের বক্স কেন নিয়েছিলি ভাই? আস্থা বকতে বকতেই ঢুকল।
- এই দিদি, তোর নাম না হওয়া উচিত ছিল নীনা!
এই আকস্মিক প্রসঙ্গের খেই খুঁজে না পেয়ে বেচারা আস্থা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। দাদু আর নাতি দুজনেই হেসে উঠল হো হো করে।
'আমাদের নতুন পাড়ায় কোনও ক্লাব ছিল না। কিন্তু ছিল রামকৃষ্ণের আশ্রম। কি সুন্দর শান্ত পরিবেশ। সন্ধের সময় আরতি হত। আমরা গেলে স্বামিজী প্রার্থনায় গলা মেলাতে বলতেন। গান হত-
'খণ্ডন ভব-বন্ধন জগদ্বন্দন বন্দি তোমায়।'......
- এখন নেই আশ্রমটা নেই?
'নিশ্চয় আছে। সে ত রবীন্দ্র পরিষদ, ক্লাব, খেলার মাঠ, স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে। তবে শরীর থাকলেও কি জানি তাদের আত্মাগুলো আছে কিনা।'
-দাদু মাঝে মাঝে এমন একেকটা কথা বলে না! স্কুল-হাসপাতালের আবার আত্মা থাকে নাকি? ওরা কি মানুষ থেকে ভূত হয়ে গেছে নাকি? একটু ঝাঁঝের সঙ্গে বলে আস্থা।
'থাকে গো, দিদিভাই, সবারই প্রাণ থাকে। মরে গেলে ওরাও ভূত হয়। তবে স্কুল-হাসপাতাল-কারখানা আর বেশ কিছু ঘরবাড়ি মরে গেলেও বাকি সবার শরীরগুলোও আছে। তবে শহরের প্রাণবিন্দু ছিল একটা সারের কারখানা। সেটা ছিল শুধু এ দেশের নয়, এশিয়ার সবচেয়ে বড় সারের কারখানা একসময়, এই দেশের গর্ব। আমার রিং-টোনের গানটাও আসলে তারই গল্প যদিও সলিল চৌধুরি অন্য গ্রাম নিয়ে এটা লিখেছিলেন।'
- তাহলে বল না সে গল্প। অবশ্য তুমি না বললে আমি গুগল বা উইকি থেকে পড়ে নেব।
'ওরে দিদিভাই, এসব কি গুগল জানে? হ্যাঁ, উইকিপেডিয়াতে কিছুটা আছে, সেটা কালকে শোনাব। আজ এটুকুই থাক। দেখ, ভাইএর ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট, দিদিভাই।'
- গুড নাইট, দাদু।
(২)
-এই দিদি তুই জানিস, দাদু কোন শহরের কথা বলে? ভাইয়ের প্রশ্ন। আজ দাদু নেই বাড়িতে। কলেজের কোন বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছেন।
- হ্যাঁ, জানি ত। দাদুর মন জুড়ে ত একটাই জায়গা আছে, সিন্দ্রি। উইকিতে দেখছিলাম, ওখানে একটা সারের কারখানা ছিল, একটা পিডিআইএল নামে গবেষণার অফিস, একটা সিমেন্ট কারখানা, একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর আশেপাশে কিছু কয়লাখনি আছে। তার মধ্যে সার-কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেছে, তাতে হয়েছেটা কী!
- অতবড় কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল? অনেক লোক কাজ করত নিশ্চয়। ওরা তাহলে কোথায় গেল?
- কি জানি কোথায় গেল! দাদুও ত ওখানে চাকরি করত। কারখানা যখন বন্ধ হল তখন ত মায়ের বিয়েই হয়নি। তারপর ত এখানে এসে কোচিং স্কুল খুলেছে। জানিস, দাদু এত বুড়োধাড়ি- অথচ ঠিকমত কম্পিউটারটাও অপারেট করতে জানেনা। আমি কত প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে দিয়েছি কতবার। দুই ভাইবোন হেসে ওঠে একসাথে।
- কি ব্যাপার, কে ডাউনলোড করতে পারেনা বলে এত হাসি হচ্ছে, অর্ঘ্য-আস্থার মা অম্বালিকা ঢোকেন ঘরে। মেয়ের শেষ কথাটা কানে গেছে তাঁর। হেসে বলেন, তোর মাকে যে ডাউনলোড করেছে দাদু, তার বেলা?
দুপুর দুটো নাগাদ অর্ঘ্য-আস্থার দাদু ধুর্জটি সরকার ওরফে পানুবাবু ঘরে ঢোকেন। ‘আজ আর কিছু খাব না রে, বিকাশ একগাদা মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছে’- মেয়ের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন তিনি। অম্বা বাবার এই স্বভাবের সাথে বিলক্ষণ পরিচিত, তাই বলে – শুধু একটু দইভাত খেয়ে ঘুমিয়ে নাও। আজ ত ক্লাস নেই।
'সে গল্প যে ফুরোবার নয় দিদিভাই। তবু শোনো।
তখন আমরা স্কুলে পড়ি। রাজেন্দ্র স্কুল। আর শনিবার বিকেলে বাবার সাথে সাইকেলে চেপে বাজার-হাটে ঘুরে বেড়াই।'
- তোমার বাবাও ওখানে কাজ করত?
তা না হলে আমরা সেখানে মানুষ হলাম কি করে? বাবা ছিলেন কারখানা শুরুর গোড়া থেকে। তখন কারখানা তৈরি হচ্ছে। কলোনী গড়ে ওঠে নি। ডোমগড়ের পাম্প হাউস তৈরি হয় নি, সেটলিং ট্যাঙ্কে জল পাঠানোর কাজ সেট আপ হয়েছে সবে, বাবা সেই কাজ দেখত। সে সময় সিন্দ্রি বস্তি বলে দামোদর নদীর ধারে একটা গ্রামে ওদেরকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। বাজার হাট খাওয়া-দাওয়ার ভীষণ অসুবিধে। সেই সময় লাম্বা নামে এক পাঞ্জাবী ছোকরা একটা ধাবা খুলে বসল সেখানে। ব্যস, দুর্ভিক্ষপীড়িতদের দেশে জমে গেল ওর দোকান। বাবারা সেখানে সবাই মাস-কাবারি রেটে খাওয়া-দাওয়া করতে লাগল।
- কেউ বাড়িতে রান্না করত না?
বাড়িতে কে রান্না করবে? বিয়েই হয়নি কারো। অবশ্য ধীরে ধীরে একজন-দুজন করে বিয়ে করে আনতে লাগল। আমার মাও ত প্রথম এসে ওই সিন্দ্রি বস্তির ব্যারাকের মত কোয়ার্টারেই ওঠে। তারপর আমার জন্মের আগে কলোনী জমে উঠলে রাঙ্গামাটি বলে একটা পাড়ায় বাসা পেয়ে যায়। তারপর কি হল সেটা জানবে রাত্রের খাওয়াদাওয়ার পরে, কেমন?
‘বাড়ি হোগা, গাড়ি হোগা, এক রুপয়া মেঁ লাখোঁ কি লাটরি...আইয়ে রাজস্থান সরকার দে রহী হ্যায়...।‘ মাইক হাতে লটারিওয়ালাকে এড়িয়ে একটু এগোতেই দেখি কল্যাণেশ্বরী বস্ত্রালয়ের সামনের ছোট ফাঁকা জায়গাটাতে একটা লোক মরা সাপ-ব্যাংএর শুকনো শরীর মাটিতে বিছিয়ে লোক ডেকে যাচ্ছে- ‘ছিপকিলি কা তেল, সারে দর্দ কা দাওয়া...আইয়ে বাবু লে যাইয়ে জোড়োঁ কা দর্দ, কমর দর্দ, সরদর্দ সব হাওয়া...।‘ সাথে সাথে মাইকে গান বেজে উঠল- ‘সর জো তেরা চকরায়ে...।‘ তিন দিকে দোকান দিয়ে ঘেরা জায়গার মাঝে তখন হাট বসত, আলু, পেঁয়াজ, পটল, ঝিঙ্গে, মুলো, কপি মাটিতে পেতে বিক্রি করছে। আর উঁচু লম্বা বেদির মত জায়গাতে বসত ভি-আই-পি হাটুরেরা, তাদের কাছে সব জিনিষের দাম একটু বেশী। তবে ভি-আই-পিদের কাছে পাওয়া যেত অচেনা সব সবজি, যেমন- সিমলা লঙ্কা, রাজমহলের পটল, ওলকপি, লালমুলো, শিলিগুড়ি থেকে আসা স্কোয়াশ আর ঘি-করলা। তাছাড়া থাকত অফ-সিজনের তরকারি যেমন গরমের দিনে রাঁচি থেকে আসা ফুলকপি আর পালং শাক। দেখে লোভ লাগত, তবে শত ডাকাডাকিতেও বাবা তার দিকে তাকাতই না। সোম-বুধ-শনি তিনদিন হাট বসত। সোম আর বুধ বাবা ডিউটি-ফেরত হাট করে আনত বলে শনিবার আমি সঙ্গী হতাম তাঁর। সেদিন যাওয়া হত আরো দুটো দোকানে। মাসকাবারি হিসেবে খাতা চলত এল টাইপের লাম্বার গোলধারি দোকানে। লম্বার দোকানের কর্মচারি বুটিবাবু আমি গেলেই একটা লজঞ্চুস ধরিয়ে দিত হাতে, তার লোভও বড় একটা কম ছিল না। তারপর করালি-মুরুলি দুই বাঙালি ভাই একসময় দুটো মুদির আর একটা কাপড়ের দোকান খুলে বসল আর শহরের বাঙালিদের অনুরোধ-অনুনয় করে খদ্দের বানানো শুরু করল। বাবাও তখন যেতে শুরু করলেন করালি দাসের কমলা ভাণ্ডারে, কল্যাণেশ্বরী বস্ত্রালয়ে বা ঝুপড়ি মার্কেটে মুরুলির গন্ধেশ্বরী দশকর্মা ভাণ্ডারে।
'মনে আছে বাড়ির কাছেই একটা লাল লম্বা টানা বাড়ি ছিল, সবাই বলত লাল-ইস্কুল। সেখানে একদিন আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। গোড়ার দিকে সে বড় ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল। হেডমাস্টার ছিলেন মস্ত কড়া। মনে আছে টিচার্স রুমের সামনে দিয়ে ছুটে গেছিলাম বলে একদিন আমায় কান ধরে উঠবোস করানো হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম স্কুলের নাম রাজেন্দ্র প্রাইমারি স্কুল। মাস্টারমশায়দের প্রায় সবাইকেই ভুলে গেছি, তবে ভালবাসতেন বলে মনে আছে অভয় চক্রবর্তী আর সরখেল মাস্টারমশাইকে যাঁর কানভর্তি চুল ছিল। কিরে তোরা যে কিছু বলছিস না, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?
- তারপর একদিন বাবার প্রমোশন হয়ে জুনিয়ার অফিসার হয়ে গেল। সবাই অভিনন্দন জানালেও বাবা কেমন মনমরা হয়ে গেল।
- কি অদ্ভুত, কেন?
- আর ওভারটাইম যে পাবে না! তবে আমরা ততদিনে তিন ভাই-বোন, তাছাড়া দাদু-ঠাকুমা গ্রাম থেকে প্রায়ই এসে থাকতেন। ছোট কোয়ার্টারে জায়গা কুলোচ্ছিল না বলে বাবা একদিন একটা ট্রাক নিয়ে এল, সব জিনিষপত্র নিয়ে আমরা কেডির নতুন বাসায় এলাম। এবার আমাদের একটা বড় বাড়ি হল।
(৩)
পানুবাবুর আজ শরীরটা তেমন ভাল নেই। ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট শীতল চক্রবর্তী বার দুয়েক ফোন করেছিল কোচিং স্কুল থেকে, তাঁকে তিনি দুটো ক্লাস নেবার প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বাইরের ঘরের সোফা-কাম-বেডে শুয়ে একটা বই পড়ছিলেন। বইটা ইংরেজি, নাম ‘Saga of Sindri’. বইটা অর্ঘ্য আর আস্থা অনেকদিন ধরেই এই বাড়িতে দেখছে, দাদু প্রায়ই ওটা পড়েন, কিন্তু ওরা উল্টে-পাল্টে কয়েকবার দেখেও বুঝতে পারেনি ওই বইতে এতকি পড়ার আছে। ওটা কিসের বই, দাদু?- নাতি শুধোল।
'দাদুভাই, এই বইটা সিন্দ্রির গৌরবের দিনগুলোর সাক্ষী। ইংরেজ আমল থেকেই ভারতে একটা বড় রাসায়নিক সার কারখানা খোলার কথা শুরু হয়েছিল, কিন্ত রাজত্ব যেতে চলেছে ভেবে সাহেবরা তখন আর তেমন গা করেনি। স্বাধীনতা পাবার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দেশগঠনের রূপরেখা তৈরি করতে শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে সিন্দ্রি সার কারখানার পরিকল্পনা রূপায়িত হয়ে এর নির্মাণ শুরু হয়, ৫১ সালে কারখানা তৈরি মোটামুটি শেষ হয়ে ৫২ সালের মার্চ মাসে অ্যামোনিয়াম সালফেট নামে সার তৈরি শুরু হয়ে যায়। সার আর মাটি নিয়ে নানারকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে চালু হয় প্ল্যানিং অ্যাণ্ড ডেভলাপমেন্ট (P&D) নামে একটা গবেষণাকেন্দ্র। তারপর ৫৬-৫৭ সালে এর উৎপাদন ৯৬০ টন প্রতিদিন হারে হতে থাকে, যা তখন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী।'
-দাদু, সার তো গোবরে হয়, এই অ্যামোনিয়াম জিনিষটা কি? আস্থার প্রশ্ন।
'দিদিভাই, গোবর থেকে যে সার তৈরি হয় তাকে বলে কম্পোস্ট, সমস্ত দেশের চাহিদার তুলনায় তা আর কতটুকু? তবে সার গোবর থেকে হোক বা রাসায়নিক উপায়ে, তার মূল উপাদান হল K-P-N, পটাশিয়াম, ফস্ফোরাস আর নাইট্রোজেন এর অন্ততঃ একখানা। তুমি এখন ছোট আছ দিদিভাই, বড় হলে জানতে পারবে যে অ্যামোনিয়া আর ইউরিয়া- এই দুটি বস্তুতেই আছে প্রচুর নাইট্রোজেন, আর ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট আর সুপার ফসফেটে আছে ফসফোরাস। সিন্দ্রিতে এইসব বিভিন্ন ধরণের সার প্রচুর পরিমানে তৈরি হত একসময়। তখন দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর চোখে দেশকে চাষ-বাস, ব্যবসা-শিল্প-উদ্যোগ-বিজ্ঞান সবকিছুতে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। ঝরিয়া-রানীগঞ্জের কয়লা, সিংভূমের লোহার আকর নিয়ে টাটারা জামশেদপুরে গড়ে তুলেছেন ইস্পাত-উদ্যোগ, এবার শস্য উৎপাদনে দেশকে আত্মনির্ভর করে তোলার ইচ্ছে নিয়ে সিন্দ্রিতে পুরোপুরি একটা পরিকাঠামো গড়ে তোলা হল। কয়লা তো চারপাশেই আছে, তা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্যে তৈরি হল ৮০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট। এছাড়া অ্যামোনিয়া তৈরির কাঁচা মাল হিসেবে চাই শুদ্ধ কয়লা, যাকে বলে কোক। সাধারণ কয়লা থেকে কোক তৈরির জন্যে চালু হল কোক-ওভেন প্ল্যান্ট। গরম কোক-কয়লার সাথে জলবাষ্প আর হাওয়ার নাইট্রোজেন মিশিয়ে বানানো হতে লাগল সেমি-ওয়াটার-গ্যাস, এই বিক্রিয়াটা ঘটানো হত ক্রোম-ম্যাগ্নেটাইট ক্যাটালিস্ট স্তরের মধ্যে দিয়ে। একটা নিয়ন্ত্রিত তাপমান আর চাপে এগুলোকে রাখতে পারলেই ব্যস তাতে হেবার-বশ পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া তৈরি! এসব তোমরা আরো বড় হয়ে বুঝবে। তারপর রাজস্থান থেকে আসত জিপসাম বলে একরকম খনিজ-পদার্থ, যার সাথে অ্যামোনিয়া মেশাতেই তৈরি অ্যামোনিয়াম সালফেট সার। মজার ব্যাপার হল, না চাইতেই তার সাথে সাথে আরেকটা জিনিষ তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল, যার নাম ক্যালসিয়াম কার্বোনেট বা প্রেসিপিটেটেড চক। এটা আবার সিমেন্ট তৈরিতে কাজে লাগে।'
- তাহলে ত পাশে একটা সিমেন্ট কারখানা বসিয়ে দিলেই হয়।
'ঠিক তাই হল। নামকরা সিমেন্ট কোম্পানী এসিসি এগিয়ে এল। সমস্ত চূনাপাথর কনভেয়ার বেল্টে করে পাশের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে যেতে লাগল। ফলে কিছুই আর ফেলা যায় না।'
- বাঃ, বেশ মজা ত! কিন্তু দাদু, জিপ্সামটাই এত দূর থেকে আসত, যদি সময়ে না পৌঁছয় তাহলে তো কারখানা বন্ধ!
- দাদু, তুমি না খুব দাঁতভাঙ্গা কথা বল মাঝে মাঝে। বাই-প্রোডাক্ট, সোহাগা- আর যেন কি একটা বললে, হ্যাঁ, ক্যাটালিস্ট। তার মানে কি?
-আস্থা, অসুস্থ শরীরে আর দাদুকে বকবক করিও না, চল সবাই খেয়ে নেবে। মায়ের এই ডাক এড়াবার ক্ষমতা কারো নেই। সবাই খাবার টেবিলে এসে পড়ল একে একে।
(৪)
-দাদু, তোমাদের পাড়ার গল্প, স্কুলের গল্প বলবে না? অর্ঘ্যের আবেদন। আজ পানুবাবু ভালই আছেন, তবে আর ক্লাস নেন নি, শীতলবাবুকে ‘চার্জ’ বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। চাকরি-জীবনে এরকম অনেক করতে হয়েছে, উপযুক্ত লোক পেলে তার উপর অক্লেশে ভরসা করে কখনও তিনি ঠকেননি।
- না দাদু, আজ ফ্যাক্টরির গল্পটা শেষ করতে হবে। তোমাদের এম-ডির গল্প, সেই যে পাগলাটে গোছের একজন ছিলেন- নাতনি নাছোড়বান্দা।
ইতিমধ্যে অম্বা এসে ঢুকেছে ঘরে কখন কেউ টের পায়নি। ‘বাবা তোমাদের এম-ডি কেআর চক্রবর্তীকে দেখে কে এক লেখক নাকি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন!’ তাঁর প্রশ্ন।
'কে এক নয় রে, স্বনামধন্য সাহিত্যিক শংকর মানে মণিশংকর মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘আশা-আকাঙ্ক্ষা’ উপন্যাসের নোয়েল দিগম্বর বোনার্জি চরিত্রটা ওঁকে দেখেই লিখেছিলেন। সিন্দ্রি কারখানা চালু হবার গোড়ার দিকে উনি সেখানে ঘুরে আসেন কিনা। সেই সময় চরিত্রটাকে দেখে শংকর আকৃষ্ট হন। সত্যি এরকম কাজ-পাগল লোক দু-চারটে ছিল বলেই না দুনিয়ার যত অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। কারখানা চালু হবার সময় তিনি ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন, আমরা তখন জন্মাইনি। পরে জিএম হন। ১৯৬৯এ তিনি যখন ম্যানেজিং ডিরেক্টার, আমরা তখনও মোটামুটি ছেলেমানুষ। A-1 কে এম-ডি বাংলো করে গড়ে তোলা হলেও তিনি প্রথম দিকে জিএম বাংলোতেই থাকতেন, পরে দিল্লি চলে যান। A-1 হয়ে যায় ভিআইপি গেস্ট হাউস, উনি মাঝে মাঝে এসে থাকতেন সেখানে। তখন সেটা হাই সিক্যুরিটি জোন, আমরা কেউ ভয়ে পা বাড়াতাম না সেদিকে।
- তাহলে তোমরা খেলতে কোথায়, দাদু? নাতির এসব সিরিয়াস আলোচনা ভাল লাগছে না।
খেলার জায়গার আবার অভাব ছিল নাকি দাদুভাই। সিন্দ্রিতে তখন অজস্র খালি জায়গা। রাঙ্গামাটির আর-এম-এল’এর বিশাল মাঠ, এন-এ-সি মাঠ, জয়হিন্দ ক্লাবের মাঠ- সেখানে প্রতি বছর যাত্রা বা সার্কাস আসত, আর একপ্রান্তে পরে অরবিন্দ কেন্দ্র তৈরি হয়। সহরপুরার কল্যাণকেন্দ্রের মাঠ ত ছিলই, স্টেডিয়াম তৈরি হল আমাদের চোখের সামনে। এছাড়া ছিল রেনবো ক্লাব, তরুণ উদয়, রেনেসাঁ, ইয়ুথ ক্লাব, ভ্রাতৃসঙ্ঘ, পশ্চিমাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল, ডোমগড় ইউনাইটেড, সেন্ট্রাল- পরে সেখানে কয়েকবছর হাটও বসে, আর ছিল পোস্ট অফিসের পাশের মাঠ-তবে সেখানে কেউ খেলত না তেমন।
- আর কেডি-এফডি পাড়ায়?
'না, আমরা যখন যাই, সেই ৬৫ সালে, পাড়াটাতে তেমন কোনও খেলার মাঠ ছিল না। সামনে প্রচুর ঝোপঝাড়ে ভরা বিক্রি হয়ে যাওয়া চাষের জমি, তারপর সার কারখানার দেয়াল, অবশ্য তখন সেটা ছিল না, ৭০ সাল নাগাদ মডার্নাইজেশনের আগে জায়গাটা ঘিরে ফেলা হয়। হঠাৎ একদিন সামনের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে কিছু লোক একটা মাঠ বানিয়ে ফেলল ছোটখাট। আমরা ত মহাখুশি, বেশ একটা খেলার জায়গা হবে। ও বাবা, তার পরদিন থেকে শুরু হল খোঁড়াখুঁড়ি। বেশ কিছু ইঁট-পাথর লোহা লক্কড় পড়ল। দেখা গেল একটা মিলিটারি ব্যারাক গোছের তৈরি হচ্ছে। পরে দেখা গেল ওগুলো ব্যাচেলার হোস্টেল হল, শিক্ষানবীস বা অ্যাপ্রেন্টিসদের জন্যে ডর্মিটরি ধাঁচের।
'এদিকে সেই বছর, মানে ৬৬ সালে পাড়ার দাদারা আর কিছু কমবয়েসি কাকুরা মিলে একটা ক্লাব গড়ল, নাম দেওয়া হল- মিলনী। হায়রে, ১৬ সালে তার পঞ্চাশ বছর পুরোল, কিন্তু সেলিব্রেট করার কেউ নেই। তখনকার ধনুদা, বাবুকাকা, দমকলের মিঠুচাচা, গোরাদা, দশরথ ভাইয়া, বাবলুদা- কে কোথায় আছে আজ কে জানে। সহরপুরার এল-টাইপ কোয়ার্টারে এককালে খোলা হয়েছিল শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রম- ছোট্ট করে, সন্ধ্যারতি আর পূজার্চনা হত, একটা দাতব্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয়ও ছিল। তবে জায়গায় কুলোচ্ছিল না। ইতিমধ্যে সার কারখানার রিজার্ভ করা জমি বেশ খানিকটা লং-টার্ম লিজে পেয়ে রামকৃষ্ণ মিশন একটা স্থায়ী আশ্রম খুলে ফেলল স্থানীয় মানুষদের সাহায্য আর পৃষ্ঠপোষকতায়।
- ইস, আশ্রমের নামে নবমীর দুপুরের সেই খিচুড়ি-প্রসাদ মনে পড়ে যায়, অম্বা বলেন, অত টেস্টি খিচুড়ি আর কোথাও খাই নি, এখনও ওটা খুব মিস করি, বাবা।
'যা বলেছিস, বুড়ি।' আনন্দের চোটে খেয়াল থাকে না নাতি-নাতনিদের সামনেই মেয়েকে ছোটবেলার আদরের ডাকনামে ডেকে ফেলেছেন পানুবাবু। মেয়ের কিন্তু উচ্ছ্বাসে ঘাটতি পড়ে না তাতে। বাপ-মেয়ে দুজনেই যেন একসাথে কোথায় হারিয়ে যেতে থাকেন।
ইতিমধ্যে জামাই শরদিন্দু এসে ঢোকে ঘরে। ও একটা কলেজের কেমিস্ট্রির লেকচারার, কিন্তু অবসর সময়ে ছেলে না পড়িয়ে কলেজ ল্যাবে গবেষণা নিয়েই কাটায়। বিপত্নীক পানুবাবু নিজে এখনও রোজগার করেন বলে তাঁর কোন হীনমন্যতা নেই একমাত্র মেয়ের বাড়িতে থাকার ব্যাপারে। মেয়ে-জামাইও খুশি এই ব্যবস্থায়।
'দেখ, ইতিহাস তো শুরু হয় সেই ১৯৪৪ থেকে, তবে মূলতঃ অ্যামোনিয়াম-ইউরিয়া উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই '৪৭ সালে কারখানা তৈরি শুরু হয়ে '৫১ সালে ৯৬০ টন প্রতি দিনের ক্ষমতা নিয়ে অ্যামোনিয়াম সালফেটের উৎপাদন শুরু হয়। তার কিছু আগেই ৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হয় কারখানা আর কলোনীর বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্যে, পরে অবশ্য দামোদর উপত্যকা যোজনা বা ডিভিসির সঙ্গে পাওয়ার গ্রিড জোড়া হয়। এর পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ১৯৫২ সালে সালফেট প্ল্যান্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। গোড়ার দিকে কোক কোথা থেকে আসত জানিনা, তবে ৫৪ সালে কারখানার নিজস্ব ৬০০টন পার ডে'র কোক ওভেন প্ল্যান্ট চালু হলে সে সমস্যাও মিটল। ইউরিয়া পাইলট প্ল্যান্ট আর ডাবল সল্ট প্ল্যান্ট চালু হয় ৫৬ সালে।'
- ডবল সল্টটা কী? অ্যামোনিয়াম সালফেট-নাইট্রেট?
- বাঃ, ঠিক ধরেছ!
- আর কী তৈরি হত সেখানে?
- কি দারুণ ছিল ঐ গোলাদুটো- অম্বা বলে। 'প্রতি বিশ্বকর্মা পূজোয় আমরা ফ্যাক্টরি যেতাম আর ওগুলোর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখতাম, ভাবতাম যদি কখনও ফেটে যায়!'
(৫)
'বুঝলে দাদুভাই, তোমার দাদু নতুন পাড়ায় এসে কিন্তু আরেকটা অসুবিধায় পড়ল, লাল স্কুল থেকে চলে এল অনেক দূরে, সেটা ছাড়তে হল।'
- কেন, স্কুলের বাস ছিল না?
'না, দিদিভাই, রাঙ্গামাটি আর ডোমগড়ের রাজেন্দ্র স্কুলের তখন বাস ছিল না। কিন্তু সহরপুরা মিডল আর হাইস্কুল দুটোরই বাস আসত সব জায়গায়। আমি রাজেন্দ্র মিডল স্কুলে ভর্তি হলাম ক্লাস এইটে। সকাল এগারোটা থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত স্কুল। বাসের জন্যে দাঁড়াতে হত বেশ খানিকক্ষণ, আর তখনই ছিল আমাদের নানাধরণের খেলা, কুস্তি, মারামারি, গল্পগুজব সব কিছু। মাস্টারমশাইরা ছিলেন মিঠে-কড়া, সব বুঝতেন, শাসন করতেন, আবার প্রশ্রয়ও দিতেন খুব। বোধহয় তাঁরাও ছোটতে ওমনিই ছিলেন, তাই আমরা মিথ্যে বললেও ঠিক ধরে ফেলতেন। কিন্তু সত্যি বললে যদি ক্ষমা পাওয়া যায় তবে আর মিথ্যে বলা কেন? তাই আমাদের সৎসাহসের কখনও অভাব হয় নি।'
- ইস্, আমার মা যদি কথাটা বুঝত! একটু মৃদুস্বরেই বলে দুষ্টু ছেলেটা যদিও মায়ের কানে কথাটা গেছে ঠিকই। এবার কিন্তু হেসে ফেললেন অম্বা। সত্যি, এই ছেলেকে কি বলা যায়!
- সেটা আবার কোথায়?
'মিডল স্কুলের পাশেই। একটা মস্ত দোতলা বিল্ডিং ছিল, আর একপাশে ছিল গোল টিনের ছাত দেওয়া গুদামঘরের মত দুটো লম্বাটে ব্লক।'
'ও, তোরা ভুলিস নি বুঝি? সেটা বোধহয় এখনও আছে, যদিও স্কুল-বিল্ডিংটা এখন সি-আই-এস-এফের অফিস না ব্যারাক কিছু একটা হয়ে গেছে এখন। হাই স্কুল আর মিডল স্কুলের মাঝে ছিল বেশ খানিকটা খালি জায়গা। সেখানে টিফিনের সময় ভীড় জমাত যত বাদামভাজা, ফুচকা, আইসক্রীম, পেয়ারা, কুলের আচার আর চুরণওলার দল। একজন আইসক্রীম নিয়ে আসত, তার বাক্সের গায়ে ইংরেজিতে লেখা থাকত ‘খান্না’। আমরা অনেকদিন ধরে ওই লোকটাকেই খান্না বলে জানতাম। একদিন ফুচকা-চাটওলা সুরেশ ওকে ডাকাডাকি করায় জানা গেল ওর নাম ছিল শ্যামনন্দন। লাল স্কুলে ছিল ভুনেশ্বরের আইসক্রিম আর হীরার চুরন, এখানে তো পাশাপাশি দুটো স্কুল, সব কিছু ডবল-ডবল।'
- ইস, কি মজার!
'অনেক দিন ধরে খান্নারই ছিল বোলবালা। তারপর একদিন একটা বছর কুড়ি বয়েসের একটা ছোকরা ‘কোয়ালিটি’ লেখা আইসক্রীমের ঠেলা নিয়ে এসে বসল এককোনায়। প্রথম দিকে কেউ ওকে তেমন পাত্তাই দিত না। তারপর একদিন আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ও নিজের মনেই গড়গড় করে মুখস্থ বলে যাচ্ছে ইংরেজিতে-‘Rabindra Nath Tagore wrote Gitanjali and translated that book in English as ‘Songs Offerings’. He was awarded the prestigious Nobel prize in 1913. ….’ আমরা অবাক হয়ে ছুটে গেলাম ওর দিকে। ‘এগুলো ত আমাদের rapid reader ‘Good and Great’ বইতে আছে, তুমি জানলে কি করে?
‘আমি দু-বছর আগে ম্যাট্রিক পাশ করেছি ঝরিয়ার স্কুল থেকে’- লোকটা বলল। আমরা রীতিমত শক্ড। ম্যাট্রিক পাশ করেও যে কেউ আইসক্রীম বিক্রি করতে পারে তখন আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। ফলে আমরা অনেকেই নতুন আইসক্রীমওলার ফ্যান হয়ে গেলাম। মাঝখান থেকে শ্যাম-ভাইয়ার বিক্রি গেল কমে। এরকম কত গল্পই যে ঘটত রোজ, বলে কি আর শেষ করা যায়?
- আর তোমাদের ক্লাস, বন্ধুরা, টিচারদের কথা বলবে না?
'বুঝলি, হাইস্কুলে এসে একটা নতুন ব্যাপার হল, আর বাঙ্গালিদের আলাদা সেকশন রইল না। সব মিলেমিশে তিনটে ম্যাথ, একটা বায়োলজি আর একটা আর্টসের সেকশন করা হল।
- তাহলে কি তোমাদের মিডিয়াম ইংলিশ হয়ে গেল?
'দূর বোকা, তা কেন হবে? আমরা বাঙালিরা বাংলা মিডিয়ামেই পড়তাম, বিহারী আর অবাঙালিরা পড়ত হিন্দি মিডিয়ামে। তবে আমাদের আর ওদের হিন্দি ছিল আলাদা। তাই আমাদের বাংলা বা হিন্দি ক্লাসের সময় ওদের হত হিন্দি ফার্স্ট বা সেকেন্ড পেপার। সব বাঙালিরা উঠে চলে যেতাম বারান্দায়, হলে বা বাইরে গাছের তলায়, সেখানে হেলানে স্ট্যান্ড দেওয়া ব্ল্যাকবোর্ড বসিয়ে ক্লাস নিতেন চ্যাটার্জী স্যার বা দাস স্যার। খুব এনজয় করতাম ঐ খোলামেলা ক্লাস, আমরা মজা করে বলতাম ‘শান্তিনিকেতন’।'
'শরীরগুলো পড়ে আছে, আত্মাটা উধাও'- হাহাকারের মত শোনাল পানুবাবুর গলা।
(৬)
- দাদু, তোমাদের স্কুলে তাহলে মেয়েরা পড়ত না?- আস্থার প্রশ্ন।
'প্রাইমারি ক্লাসে একসাথে ছিল। তারপর ওরা চলে যেত মেয়েদের স্কুলে, হ্যাঁ মনে পড়ে, ফাইভ থেকে। তবে কেজি স্কুলে, পরে নাম পালটে হয় মডেল ইংলিশ স্কুল, ছেলে মেয়ে একসাথে পড়ত। তবে সেটা তখন ক্লাস সেভেন পর্যন্তই ছিল, তাই এইট থেকে ওদের ছেলেমেয়েরা চলে আসত রাজেন্দ্র বয়েস বা গার্লস স্কুলে, কিম্বা চলে যেত ডিগোয়াডির ডি নোবিলি কিংবা কারমেল স্কুলে। সহরপুরা সার্কেল থেকে যে রাস্তাটা সোজা এসিসি ঢুকে গেছে তার ডানপাশ ঘেঁসে ছিল পরপর তিনটে স্কুল গার্লস মিডল আর হাই স্কুল, প্রাইমারি আর বয়েজ মিডল স্কুল আর বয়েজ হাই স্কুল। আবার আমাদের স্কুলেই বিকেলের দিকে নাইট কলেজ বসত, পরে নতুন বিল্ডিং হতেই সিন্দ্রি কলেজ নামে ওটা আলাদা হয়ে মনোহরটাঁড়ের নতুন টাউনশিপে চলে যায়, মেয়েদের সেকশন চালু হয় চার্চের পেছনে একটা বিল্ডিং-এ।'
- আর স্কুল ছিলনা?
'ছোট শহরে আর কত থাকবে। তবে পরে লোক বাড়তে আরো অনেক স্কুল খুলে যায়। রাজেন্দ্র নামের স্কুলগুলো তো ছিলই, এছাড়া একে একে আসে এন-এ-সি স্কুল, গোশালা ডি-এ-ভি, সরস্বতী শিশু মন্দির, লায়ন্স স্কুল, সিন্দ্রি ডি’নোবিলি, রবীন্দ্র পরিষদ স্কুল, নন্দ গোকুলম......আর মনে পড়ছে না। তখন ধর্ম-আর্চা করার জন্যে সহরপুরায় ছিল একটা শিবের মন্দির, পরে ডোমগড়ে একটা হয়, দুটো চার্চ, একটা মসজিদ, গুরুদ্বারা আর রামকৃষ্ণ মিশন আর মনোহরটাঁড়ে ঢোকার মুখে গড়ে ওঠে আয়াপ্পা মন্দির। সাহিত্য আর কালচারের জন্যে সরকারি উদ্যমে বানানো হয় অফিসারদের জন্যে সিন্দ্রি ক্লাব আর সব কর্মচারীদের জন্যে কল্যাণ কেন্দ্র। বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা তৈরি করে রবীন্দ্র পরিষদ, রাজেন্দ্র সাহিত্য-সদন, অরবিন্দ আশ্রম, বিদ্যাপতি পরিষদ আর সবেধন নীলমনি সিনেমা হল- কল্পনা। তখন ত আর এত মাল্টিপ্লেক্স ছিলনা, ঐ কল্পনাতেই আমরা ভাল সিনেমা এলেই মা-কাকীমাদের সাথে আর একটু বড় হতে বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে দেখতে ছুটতাম। বাংলা বই এলে সপ্তাহে চারদিন একটা করে শো থাকত আর ভীষণ ভীড় হত। সপ্তাহে একটা শো ইংরেজি ছবি দেখানো হত। এছাড়া ভাল ছোটদের বই এলে স্কুল থেকে হল ভাড়া নিয়ে নামমাত্র পয়সায় ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানো হত।'
- মা, দেখেছ, দাদু ফিল্মকে বই বলছে! আস্থা একটু অবাক হয়।
- তার কারণ হল আগে কোন নামকরা বই থেকে স্ক্রীনপ্লে তৈরি করে সিনেমা বানানো হত, গল্পের একটা বড় ভূমিকা থাকত তাতে- মা বোঝালেন।
খাওয়াদাওয়ার পর অম্বা গেছেন ঘরের কাজ গুছিয়ে নিতে, নাতি-নাতনীরা আবার এল দাদুর কাছে। ‘দাদু, মাল্টিপ্লেক্স ছিলনা, শপিং মল ছিলনা, এমনকি বড় হবার আগে তোমরা টিভিও দেখনি, তাহলে সময় কি করে কাটত তোমাদের? শুধু খেলতে আর পড়তে?’
'তা কেন, দিদিভাই? এবার হাসলেন পানুবাবু। ওই যে বললাম না, খেলাধূলা ত ছিলই, তাছাড়া কল্যাণ কেন্দ্র, সিন্দ্রি ক্লাব আর রবীন্দ্র পরিষদ ছিল আমাদের বাঙ্গালিদের কালচারাল হাব, তার বাইরে কিছু করার সময়ই থাকত না। আমার বাবার ছিল গল্পের বই আর ব্রিজ খেলার নেশা, তখন নেতাজি পাঠাগার নামে একটা বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি ছিল, তা থেকে রেগুলার বই আনা হত। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায় আর বদলে রবীন্দ্র পরিষদে খোলা হয় চমৎকার একটা লাইব্রেরি। নিমাইদা আর জিতেনদা সারাক্ষণ সামলাতেন সেই বইয়ের ভাণ্ডার। ছিল নাটক। সুনীলদা, ভবেশদা, শ্যামলদা, জীবনদা, মণিদা, নাদুদা, তরুণদাদের মত কিছু নাটক পাগল মানুষ গড়ে তোলেন ফ্রেণ্ডস থিয়েট্রিক্যাল গ্রুপ। তারপর একে একে আসেন অচিন্ত্যদা-বিজয়াদি, পরে ওঁরা বিয়েও করেন, বাঁশীদা, বৈশাখদা, তৈরি হয় এন-এল-টি-জি। অবশ্য আমি নাটক দেখতাম, গ্রীনরুমের খোঁজ রাখতাম না। তবে সিনিয়ারদের মধ্যে ডাঃ বাগচি, অতীন মুখার্জি, প্রণব ব্যানার্জি, সুশীল বোস, তুফান চক্রবর্তী, অনাথ মুখার্জি, রোমু চ্যাটার্জি, সুনীল মৈত্রদের নিয়ে গড়ে ওঠা খেয়ালখুশি আর গ্যাস-প্ল্যান্টের অ্যামেচিওর গ্রুপগুলো অপেশাদার হলেও যথেষ্ট ম্যাচিওরড ছিল, সে যারা সেসময় অঙ্গার বা লৌহকপাট দেখেছে তারাই বলতে পারবে। যাদবপুর আর শিবপুর কলেজের অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশন থেকেও খুব উচ্চস্তরের নাটক আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্টেজ করা হত তখন।'
-বাবা, এতসব যে বলে যাচ্ছ, ওরা কি কিছু বুঝছে? অম্বা কখন ঘরে ঢুকেছে কেউ টের পায়নি।
'ওরে, আজ না বুঝলেও কথাগুলো কিছুটাও যদি মনের মধ্যে গেঁথে যায়, সেটা হবে আমার স্মৃতির সহর সিন্দ্রির পক্ষে অনেক বড় পাওনা। আজকের মাল্টিপ্লেক্স আর ফোর-জি যুগের দুটি শিশু যে মনোযোগ দিয়ে এতসব শুনছে সেটাই কি কম কথা?'
- আস্থা-অর্ঘ্য এবার তোরা শুয়ে পড়, দাদুকে আর কত জ্বালাবি? এবার জামাই শরদিন্দু বা শরৎ এসে ঢোকেন ঘরে। ছেলেমেয়েদের স্কুল আছে সকালে, চিন্তা ত তাঁরও। বাচ্চারা বাবাকে ভয় করে, ওরা বিনাবাক্যব্যয়ে চলে যায় শোবার ঘরে।
তোমরাও তাহলে এবার শুয়ে পড় শরৎ, রাত জাগা ভাল নয়।
- তুমি থাম ত বাবা, ও ত বারো ঘণ্টা অফিসেই কাটায়। একটু নাহয় গল্প করলই আজ। সিন্দ্রির কালচারাল অ্যাক্টিভিটির কথা কি বলছিলে বল না। বাচ্চাদের শোনার জিনিষ ছাড়াও ত অনেক গল্প থাকে।
'চিন্তায় ফেললি মা, দাঁড়া একটু চিন্তা করি। সিন্দ্রিতে মন্দির মসজিদ-গির্জা তো ছিলই, তবে যা উঁচুদরের নাটক বা কালচারাল অনুষ্ঠান লাগে থাকত তার তীর্থক্ষেত্র ছিল কল্যানকেন্দ্রের ইনডোর আর আউটডোর স্টেজ, সিন্দ্রি ক্লাব-হল, চার্চ হল, পরে হয় রবীন্দ্র পরিষদের ভেতর আর বাইরের স্টেজ আর বিহারিদের উদ্যোগে রাজেন্দ্র সাহিত্য পরিষদ আর মৈথিলিদের গড়ে তোলা বিদ্যাপতি পরিষদের স্টেজ। তবু কম বা ছোট পড়ত, নামীদামী কেউ এলে আলাদা করে স্টেজ, টেন্ট বা প্যান্ডাল করে আয়োজন করতে হত। এখানকার সাংস্কৃতিক কাঠামোটা কতটা মজবুত ছিল সেটা বিস্তারিত বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে, অবশ্য সব আমার মনেও নেই।'
(৭)
'হ্যাঁ, কালচারাল অ্যাক্টিভিটির কথায় মনে পড়ল, সিন্দ্রির নাটকের গ্রুপগুলো। অঙ্গার, লৌহকপাটের মত বড় মাপের নাটক মাঝে-মাঝেই স্টেজ হত, তাছাড়া কত যে একাঙ্ক নাটক করে তারা বহু পুরস্কার নিয়ে এসেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আমি এদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম না, তবে 'কেয়াকুঞ্জ', বাদল সরকারের ‘ভোমা’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘পাগলা ঘোড়া’ রাধারমণ ঘোষের ‘হইতে সাবধান’, নরেন মিত্রের ‘রস’, সুনীল গাঙ্গুলির ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’ এগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। নাটক হত কল্যাণ কেন্দ্রের হলে, মুক্তমঞ্চে, রবীন্দ্র পরিষদের দুই মঞ্চে, চার্চ হলে, সিন্দ্রি ক্লাবে......আর বাংলা-বিহার-অন্ধ্র-উড়িষ্যা কোথায় নাট্য-উৎসব আর কম্পিটিশনে যায়নি দল?'
'নাট্য-ব্যক্তিত্ব আর নাটকের দলই বা পিছিয়ে থাকে কেন? এসেছে বহুরূপী, তৃপ্তি মিত্র করেছেন তাঁর একার অভিনীত নাটক 'অপরাজিতা', আর শম্ভু মিত্রের সঙ্গে করেন 'রাজা অয়দিপাউস' আর 'পুতুল খেলা'। পরে বহুরূপী আবার এলে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আর কেয়া চক্রবর্তী মিলে করেন 'চাক ভাঙা মধু' আর 'রক্ত করবী'। নান্দীকারের প্রাণপুরুষ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এই অঞ্চলেই মানুষ, তাঁর ছোট ভাই মোহিত ছিলেন ধানবাদের মাইনিং কলেজে কাকার সহপাঠী, অজিতেশ নিয়ে আসেন 'শের আফগান', 'নাট্যকারের সন্ধানে ছ'টি চরিত্র', 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' আর 'নানা রঙের দিনগুলি'। মঞ্চস্থ হয়েছে সবিতাব্রত দত্তের 'চলচিত্ত চঞ্চরী', বিভাস চক্রবর্তীর 'হয়তো'।'
- আর শুধু কি নাটক? বাবা বল, অন্য সেলিব্রিটিদের কথা যাঁরা সিন্দ্রি মাতিয়ে গেছেন। বিশ্বশ্রী মনোহর আইচ এসেছিলেন না? আর মাইমের যোগেশ দত্ত।
'ঠিক বলেছিস। তারপর ম্যাজিক! আমরা এসি সরকার, ডি পুষ্পা আর কে লালকে তো দেখেছিই, শুনেছিলাম পিসি সরকার সিনিয়ারও নাকি এসেছিলেন ইয়ুথ ক্লাব ময়দানে। সানাইয়ে মাতিয়ে গেছেন বিসমিল্লা খান, সঙ্গে ভিজি যোগ, তুই যেবছর জন্মালি। বাঁশিতে এসেছেন পান্নালাল, হিমাংশু বিশ্বাস আর অন্ধ ডালিম চ্যাটার্জি। এসেছেন সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত,শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,শংকর, সমরেশ বসু, বিখ্যাত কুচিপুড়ি আর ওডিশি ড্যান্সার ইন্দ্রানী রহমান (যিনি ১৯৫২তে মিস ইন্ডিয়া হয়েছিলেন) থেকে শুরু করে বলিউড ক্যাবারের জয়শ্রী টি!'
- বলেন কী! সিন্দ্রিতে ক্যাবারে?
'তবে? একেই বলে ভার্সাটাইলিটি! তবে এখনই শেষ নয়। কয়লাখনি আর কারখানা অঞ্চলে মানুষ খুব বড়লোক না হলেও জীবনযাত্রা ছিল সচ্ছল। এই সচ্ছলতার গ্রাম্য নাম হল যাত্রা। এই যাত্রাপালা তখন শহুরে হাওয়া পেয়ে কিছুটা আধুনিক হয়েছে। বিখ্যাত যাত্রা-ব্যক্তিত্বরা তো ছিলেনই, বাজারের নামে যাত্রা তখন টানছে অজিতেশ, ভানু, উৎপল দত্ত, চিরঞ্জিৎ এমনকি সৌমিত্র-মাধবীর মত ব্যক্তিত্বদেরকে। পুজো পেরোলেই শুরু হত খোঁজখবর, কোথায় কী যাত্রা আসছে এবার। সার্কাস না থাকলে জয়হিন্দ ময়দানে নয়ত সেন্ট্রাল মাঠে, পোস্ট অফিস মাঠে, ডোমগড় শিবমন্দির, এন-এ-সি মাঠ, রবীন্দ্র পরিষদের মাঠ, সিন্দ্রি বস্তি- কোথাও না কোথাও তাঁবু লেগে যেতই প্রতি বছর। তরুণ অপেরার শান্তিগোপাল তো একাই মাতিয়ে দিতেন হিটলার, লেনিন, আমি সুভাষ, মাও-সে-তুং এর নামভূমিকায়। সত্যম্বর অপেরা, নট্ট কোম্পানি, লোকনাট্য, ভারতী অপেরার শিল্পী স্বপনকুমার-স্বপ্নাকুমারী, অরুণ দাশগুপ্ত, বীণা দাশগুপ্ত, তপনকুমার, শিবদাস মুখার্জী, গুরুদাস ধাড়া, মাখন সমাদ্দার, শিবানী ভট্টাচার্য। এসেছে শোনরে মালিক, রাইফেল, অরণ্যের ঘুম ভাঙছে, জালিয়ানওয়ালাবাগ, নটি বিনোদিনী, হো-চি-মিনের মত উচ্চস্তরের পালা।'
'এর পরই আসবে গান-বাজনা। এখানে এসে গেয়ে গেছেন দিকপাল শিল্পীরা। রবীন্দ্রসংগীতের শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা, প্রসাদ সেন, অশোকতরু, সাগর সেন (এসেছিলেন, কিন্তু গাইতে পারেন নি), চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, আধুনিকে হেমন্ত, মান্না দে, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী, জটিলেস্বর মুখোপাধ্যায়,আরতি ও আরো অনেকে। লোকগীতি গেয়ে গেছেন সবিতাব্রত, পূর্ণ দাস বাউল। কিছু দেখেছিলাম আবার তার অনেককিছুই দেখা হয়নি। দাঁড়াও মান্নাদের গল্পটা তোমাদের শোনাই। বেশ মজার।
মান্না দের সাথে এক গাড়িতে এসেছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ভায়রাভাই হরিসাধন মুখার্জির বাসায় উঠবেন। পুলকের তখন গানের কথার খরা চলছে, অথচ সামনে পুজো, নতুন গান লিখতেই হবে। কিন্তু সিন্দ্রির বাড়িগুলো যে সব একরকমের, কোন বাড়িটা হরিসাধনের। শেষে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে পুলক বললেন, মান্নাদা, মনে হচ্ছে এইটা। আপনি দু’মিনিট গাড়িতে বসুন, চট করে গিয়ে দেখে আসছি।
দু মিনিট পরে পুলক ফিরলেন খুশী উপচে পড়ছে চোখেমুখে। মান্নাদা, এই বাড়িটা নয়, তবে একটা গান পেয়ে গেছি। যাচ্চলে, সে আবার কি? জানা গেল কড়া নাড়তেই এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা দরজা খুললেন। আজ্ঞে না, এখানে কোনও মুখার্জি থাকেন না বলে তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। ব্যস আমার কাজ হয়ে গেল- শুনুন গানের কথাগুলো, এবার পুজোয় আপনাকেই গাইতে হবে -
“ও কেন এত সুন্দরী হল?
এমন করে ফিরে তাকাল,
দেখে ত আমি মুগ্ধ হবই-
আমি ত মানুষ।।“
- বাবা ভারি রসিক আছেন কিন্তু, শরদিন্দু মন্তব্য করেন।
'আরে মান্না দে ঘটনাটা তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ বইতে লিখে সিন্দ্রিকে বিখ্যাত করে দিয়ে গেছেন, নয়ত এসব আমার জানার কথাই নয়। কিন্তু ওই সুন্দরীটি কে ছিলেন তা আজও জানা যায়নি। মান্না দে রসিক ছিলেন, সেই সাথে ষোল আনা বাঙালী। উনি সিন্দ্রির বাঙ্গালিদের জন্যে যখন তাঁর সেরা বাংলা গানগুলো গেয়ে চলেছেন, একশ্রেণীর পাবলিক হিন্দি, হিন্দি করে চেঁচিয়ে উঠল। মান্নাও কম যান না, উনি এসেছেন সিন্দ্রির বাঙালিয়ানার টানে- এত ভাল ভাল গান থাকতে ধরলেন তাঁর গাওয়া সবচেয়ে ওঁচা হিন্দি গানটি ‘পাগলা কহিঁ কা’ ছবি থেকে- ‘মেরা ভ্যাঁয়স কো ডান্ডা কিঁউ মারা’! অবশ্য পরে 'খালি ডাব্বা খালি বোতল' আর কিছু ক্লাসিক হিন্দি গানও নাকি গেয়েছিলেন।
তবে একটা কথা জানাই। পরে বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারি যে রেনেসাঁ ক্লাবের সেক্রেটারি বাদল চৌধুরী, মেম্বার বাবলু মল্লিক আর তপন গাঙ্গুলী এই তিনজনে ধানবাদ থেকে মান্না দে, পুলকবাবু ও তবলা বাদক রাধাকান্ত নন্দীকে আনার সময় সিন্দ্রি নয় পাথরডিতে ঐ সুন্দরী মহিলার সাথে সাক্ষাৎ হয় আর ওই গানের কথাটা সিন্দ্রী ক্লাবে বসেই নাকি লেখা হয়।
- বিসমিল্লা, নির্মলা মিশ্র- এঁরা কবে এসেছিলেন?
নির্মলা এসেছিলেন ১৯৭৬ এ সার কারখানার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। উনি রবীন্দ্র জৈনের লেখা ও সুরে দুটি হিন্দি গান গেয়েছিলেন। আসলে ওঁকে বলা হয়নি যে সিন্দ্রিতে এত বাঙালী থাকে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা ‘ও তোতাপাখি রে’ বা ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’র মত গান শুনতে পেলাম না। কাল এই রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান আর অনেককিছু নিয়ে আরো আলোচনা হবে, আজ এইটুকু থাক, কেমন?
(৮)
পরদিন রবিবার। পানুবাবু সকালে ক্লাস নেন, বিকেলটা ফ্রী রাখেন। খাওয়াদাওয়ার পর অর্ঘ্য আর আস্থা ঘুমোচ্ছে, মেয়ে-জামাই এল ঘরে। ওরা জানে বাবা দুপুরে ঘুমোন না। তাই কালকের অসমাপ্ত গল্প শুনতে এসেছে।
- বাবা, সিলভার জুবিলীর আর অন্য গল্পগুলো শুনতে এলাম।
'বস তোমরা', পানুবাবু বললেন। 'সিলভার-জুবিলীর ভেতরের গল্প তো কিছু নেই। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে সারের কারখানার প্রথম সালফেট উৎপাদন চালু হয়, যদিও তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় তার চার মাস পরে। সেই হিসেবে ১৯৭৬এর শেষদিকে রজতজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিশাল কাণ্ড, পুরো কল্যাণকেন্দ্রের স্টেডিয়াম জুড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। সিন্দ্রির সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তির একজন স্টলোয়ার্ট ছিলেন মডেল স্কুলের প্রধানা গীতা বর্ধন, উনি নিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দায়িত্ব। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে দিয়ে গাওয়ানো হল 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা' আর হেমন্তের সুরে 'বন্দেমাতরম'। সুরের কথাটা বলার উদ্দেশ্য আছে। শ্রীমতী বর্ধন প্রতিবছর গণতন্ত্র-দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে 'বন্দেমাতরম' গাওয়াতেন ভিন্ন ভিন্ন সুরে। তারপর ছিল হিমাংশু বিশ্বাসের বাঁশি আর নির্মলা মিশ্রের গান- রবীন্দ্র জৈনের লেখা কিছু হিন্দি গান গেয়েছিলেন তিনি।
- আচ্ছা, এত সব অনুষ্ঠান হচ্ছে, বাইরের নামকরা শিল্পীরা, সেলিব্রিটিরা আসছেন, সিন্দ্রির স্থানীয় প্রতিভার বিকাশ নিশ্চয় হয়েছিল তার ফলে? শরদিন্দুর প্রশ্ন।
'হয়নি আবার? নাটকের কথা তো বলেইছি। তবে কার নাটক দেখে কার বিকাশ হয়েছিল বলা কঠিন, সিন্দ্রির নাট্য-জগৎ তখন এতটাই উন্নত ছিল। গ্যাস-প্ল্যান্ট, খেয়াল-খুশি, এফটিজি, এনএলটিজি ও ছোটখাট অল্পখ্যাতদের মধ্যে ট্রেনিং সেন্টার, চৈতালি বা তরুণ-উদয়ের মত মাল্টি-অ্যাক্টিভিটি ক্লাবগুলো। গ্যাস-প্ল্যান্ট বাইরে যায়নি কখনও, কিন্তু ওদের আর খেয়াল-খুশির শিল্পীরা ছিলেন সুশীল বোস, অনাথ মুখার্জী, রোমু চ্যাটার্জী, প্রণব ব্যানার্জি, তারা ভট্টাচার্য, ডাঃ বাগচি, সুনীল মৈত্র, মদন দাস, দীপু গুপ্ত, আরতি চ্যাটার্জি, এলা সেন, তুষার আর তরুণ রায়, তুফান চক্রবর্তী, গোরা দাস, পাহাড়ি ও বৈশাখ গুপ্ত, প্রবীর চৌধুরি, জীবন দাস, ভন্তাদা এঁদের অভিনয়, লাইট, সাউন্ড আর পরিচালনার মান এত উন্নত ছিল আর নাম এতটাই ছড়িয়েছিল যে 'পথিক' নাটকে সেই টানে জহর রায়, সুমিতা সান্যাল পর্যন্ত ছুটে এসেছেন এঁদের সঙ্গে অভিনয় করতে, 'সাজাহান' নাটকে অভিনয় করতে এসেছেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ উদয়ের 'ক্যাম্প থ্রী' নাটকের রিহার্সেল দেখে তারিফ করে গেছেন স্বনামধন্য অজিতেশ আর রুদ্রপ্রসাদ এবং তপাদার। শোনা যায় বৈশাখদা,পাহাড়িদাদের বাড়িতে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘর অন্ধকার করে একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন। 'ক্যাম্প থ্রী'র অভিনয়ে ছিলেন বিপ্লব রায় চৌধূরী, ছোটুদা, রথীন দাসগুপ্ত,বিনোদপ্রসাদ,রবিদা,গোপালদা ও আরো অনেকে। পরে ফ্রেন্ডস থিএট্রিক্যাল গ্রুপ বা এফটিজি ১৯৬৫ থেকে ধানবাদ, জামসেদপুর, এলাহাবাদ, মাইথন, রাঁচী, দুর্গাপুর কলকাতায় বিভিন্ন নাট্য-উৎসবে আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, অনেক পুরস্কার নিয়ে ফেরে। ১৯৬৯-এ এদের একাং ক "কেয়াকুঞ্জ" প্রথম হয়। এর মূল অভিনেত্রী বিজয়া ভট্টাচার্য (সরকার) কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের জন্যে ডাক পান।.তার পরেই নাট্যপ্রতিভা সুনীল রায় FTG থেকে বেরিয়ে কিছু ছেলেদের নিয়ে NLTG দলের গঠন করেন। এই অভিনেতারা ছিলেন সোমেন মুখার্জি, প্রবীর পাল, বাবুল চক্রবর্ত্তী, ভবেশ সরকার, সুনীল রায়, চন্দন ধর, রতন ধর, তপন বিশ্বাস এবং আরো অনেকে। যাকগে, এই ইতিহাস শেষ হবার নয়। NLTG খ্যাত সোমেন মুখার্জির ব্লগ খুঁজে দেব, আগ্রহ থাকলে বাকিটা পড়ে নিও।'
- গানের জগৎ নিয়ে কিছু বলবেন না?
'গানের জগৎ সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। মান্না দের গল্প তো বলেইছি, জয়শ্রী টি'র নাচের মাঝে মাঝে দর্শকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বার্তালাপ খুব জনপ্রিয় হয় শহরে। তবে অ্যারেঞ্জার (ইমপ্রেসারিও কথাটা তখন তেমন চালু ছিল না) হিসেবে শেতল চৌধুরির নাম না করলে কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গানের বা শিল্প-জগতের দিকপালদের সিন্দ্রি নিয়ে আসতে তাঁর জুড়ি ছিল না। একটা মজার ঘটনা বলি, মণিদার কাছে শোনা। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এসেছেন, তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়ে একটা ডর্মে, মোটামুটি ছিমছাম। কিন্তু ঢুকেই তিনি 'শেতল, শেতল' করে হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। 'শেতল, তোমাকে বলেছিলাম একটা আরশি রাখতে, আরশি নেই কেন রুমে?' বিহারের বাঙালি, আরশি কেউ বোঝে না! 'ওঃ আয়না!' কে একজন বলল। আয়না পেয়ে তবে চিন্ময়বাবুর শান্তি। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন। পরিপাটি পোশাক, নিখুঁত চুল, মেক-আপ রাখতেন আর গাইবার সময় হারমোনিয়ামের পাশে থাকত পারফ্যুমের শিশি!'
- বাঃ! কিন্তু গান-বাজনা কিছুটা হলেও নাটকের মত পুরোপুরি গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি তো নয়। শেখাতেন কে এসব?
'শিক্ষকও ছিলেন। শক্তিবাবু আসতেন ঝরিয়া থেকে, চিৎবিলাস চ্যাটার্জি ছিলেন- তিনি মারা যেতে আসানসোল থেকে বিজয় চক্রবর্তী এসে ছিলেন কয়েক বছর। সিন্দ্রির সংগীত শিক্ষকরাও কম যেতেন না। নিত্যগোপাল চক্রবর্তী, দিলীপ সেন(সেতার) ও তাঁর স্ত্রী, গৌরি গোস্বামী, মহাদানী-দম্পতি, নাদুদার দাদা ধনঞ্জয় দাশগুপ্ত, রত্না রায়, সঞ্জয় চৌধুরি, প্রবীর চৌধুরি, হরিনারায়ণ চক্রবর্তী- এঁরা শুধু শিক্ষক নন, শিল্পি হিসেবেও নাম করেছিলেন। পরে সমরেশ চৌধুরি আর গিরিজা দেবীর ছাত্র সিন্দ্রির দেবদাস অধিকারির ছেলে দেবপ্রিয় উচ্চাঙ্গসংগীতে দেশ-বিদেশে খ্যাতি পায়। আর নাচে তখন সুন্দরী শেষাদ্রির ভরতনাট্যমের ক্লাস- যাঁর মেয়ে বলিউড অভিনেত্রী মীনাক্ষী, আলো চ্যাটার্জি, অজন্তা মুখার্জি (ঝা), নাদুদা, তিওয়ারিজি, দত্তদা, সনৎ চ্যাটার্জি তবলায় মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। সংগীত-অনুষ্ঠানের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে শ্রীমতী বর্ধন তো ছিলেনই, রাঙামাটির সেনগুপ্ত পরিবার, লীনা দে চৌধুরি, মঞ্জুলা ঘোষ, উত্তরা রায়চৌধুরি একেকটা অনুষ্ঠান জমিয়ে তুলতেন। দেবপ্রিয়ের মত সিন্দ্রি মেয়ে রীণা চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া মুখার্জি, কেতকী মণ্ডল- এঁরাও বহির্জগতে খ্যাতি পান।'
- এই আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে তোমরা এখানে জমিয়ে গল্প করছ!- আস্থা ঘরে ঢোকে, পেছনে তার ভাই। অগত্যা আড্ডা তখনকার মত ভঙ্গ হয়।
'
(৯)
'আজ তো আর কিছু হবে না দিদিভাই, তোমাদের হোম টাস্ক আছে তো!' পানুবাবু বললেন।
- সে তো সকালেই হয়ে গেছে। ঠিক আছে, তুমি চা-জলখাবার খেয়ে নাও, আমরা এখন খেলতে যাচ্ছি। সন্ধের সময় বাকি গল্পটা শুনবই।
ভবী ভোলার নয়। সন্ধ্যার পর দু'জনে এসে বসল দাদুর কাছে। তিনি শুরু করলেন।
'নাটক-যাত্রা-অভিনয় নিয়ে অনেক বলা হয়ে গেছে। এবার আসি খেলাধুলো নিয়ে। খেলার জন্যে সবচেয়ে জরুরি কী জিনিষ বল তো দিদিভাই?
- আমি বলি দাদু, অর্ঘ্য চটপট বলে ওঠে- মোবাইল ফোন! তবে ক্রিকেট-অ্যাপটা ডাউনলোড করতে পারছি না কিছুতেই। অ্যাই দিদি, করে দিবি একটু।
- না, দেব না। আচ্ছা ভাই, তোর কি মনে হয় দাদুরা মোবাইলে গেম খেলত সিন্দ্রিতে, এত বড় বড় মাঠ থাকতে?
'ঠিক কথা দিদিভাই। সিন্দ্রিতে তখন ছিল পাড়ায় পাড়ায় বিশাল একেকটা মাঠ। কল্যাণ কেন্দ্রের মাঠটা তো বিশাল, সঙ্গে স্টেডিয়াম, নাঙ্গল হোস্টেলের মাঠ। তারপর ছিল রাঙামাটির আর-এম-এলের রেনেসাঁ, আরএমকেফোরের বিশাল মাঠের একপ্রান্তে জয়হিন্দ ক্লাব, অন্যদিকটা ফাঁকা থাকত, সেখানে একদিন গড়ে উঠল শ্রীঅরবিন্দ কেন্দ্র। তারপর পশ্চিমাঞ্চল, সেন্ট্রাল, এস-কেফোর, এসিসি, ইয়ুথ ক্লাব, আরএল, মনোহরটাঁড়, হাসপাতালের পেছনের আর-কে-১ এর মাঠ, যার পাশে আয়াপ্পা মন্দির তৈরি হয়েছিল, ভ্রাতৃসংঘ, পোস্ট-অফিসের মাঠ, ডোমগড় ভ্রাতৃসংঘ আর ডোমগড় কে-ফোরের মাঠ, বিআইটি স্টেডিয়াম, বিআইটি এনজি কলোনির মাঠ, রাজেন্দ্র স্কুলের পাশের ময়দান- খেলার জায়গার অভাব ছিল না। তাই পাড়ায় পাড়ায় ভাল ভাল খেলোয়াড় তৈরি হয়ে উঠেছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, হকি, অ্যাথলেটিক্স- ইনডোরে শারীর-চর্চা, কুস্তি-বক্সিং, টেবল টেনিস, ক্যারম, ব্রিজ, চেস প্রায় সব খেলাতেই সিন্দ্রির একটা সুনাম ছিল। হ্যাঁ, সাঁতার বাদ দিয়ে, কারণ সিন্দ্রিতে কোন সুইমিং পুল ছিল না। আমরা সাঁতার কাটতাম প্রিয়দর্শিনীর পুকুরে, সেখানে কম্পিটিশন সম্ভব ছিল না। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে পুল তৈরি হয় ৮০ সালে, কিন্তু মেন্টেন হত না। শেষমেশ ৮৭ না কোন সালে যেন কল্যাণকেন্দ্রে জিম পেছনদিকে একটা পুল তৈরি হয়।'
- আর অন্য খেলাগুলোয়?
'ছোট শহর সিন্দ্রি কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তৈরি করে বেশ কিছু ভাল খেলোয়াড়। ফুটবলে সার কারখানার টিমে খেলতেন প্রণব ব্যানার্জি, অতীন মুখার্জি, অজিত চ্যাটার্জি, অমল বিশ্বাস, কাজল ব্যানার্জি, অশোক প্রামাণিক, টুলটুল ঘোষ, ধীমান দত্ত, যমজ ভাই পান্না-জহর। তাছাড়া বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলতেন অসীম ব্যানার্জি, সমর মজুমদার, অঞ্জন চ্যাটার্জি, মানু দত্ত, খোকন, ছোটন চৌধুরি, রামস্বরূপ রজক, রতন মজুমদার, তপন গাঙ্গুলি, সমরেশ (মিষ্টিমুখ), বিশ্বজিৎ (মিঠু), ফিরোজ খান, দেবুদা, মন্টাদা, সুসীমদা, সাংগা, লাকড়া, প্যাট্রিক, মদন সিং, দদ্দন সিং, সুরিন্দর সিং - এক-সে-বঢ়কর-এক সবাই। তাও তো সবার নাম মনে নেই। ক্রিকেটেও বেশ কিছু নাম ছিল, যেমন ডক্টর রাজ, কালিদা-পুনিদা, অশোকদা, অরুণদা-অলোকদা, পূর্ণেশদা, ধীমান দত্ত। টেবল-টেনিসে সিন্দ্রির রত্ন ছিলেন মিহির সান্যাল, স্টেট চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় খুব কম বয়সেই তাঁকে চলে যেতে হয়। ইন্ডিয়া টিমের ডিবি ভাস্করকে কম লোক চিনত, কিন্তু তাঁকে কল্যান কেন্দ্রের একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ইন্দু পুরিকে হারাতে দেখেছি। আর কমপ্লিট স্পোর্টস্ম্যান ছিলেন উমেশ ভার্মা, অজিত চ্যাটার্জি টেনিস খেলতেন দারুন। আর দদ্দন সিং- যে খেলায় নামিয়ে দাও তাতেই মাত। একবার বেঙ্গল টিটি চ্যাম্পিয়ান নাচু মুখার্জি এসেছেন খেলতে, প্র্যাকটিস করবেন কল্যাণ-কেন্দ্র ইনডোর হলে। কে প্র্যাকটিশ দেবে? কে একজন দাদ্দনভাইয়াকে ধরিয়ে দিল একটা শক্ত পাটা র্যাকেট। তাই দিয়েই নাচুকে নাচিয়ে দিলেন তিনি!
ব্যাডমিন্টনে সুরজিত বা তোতন ছাড়া এই মুহূর্তে কারো নাম মনে পড়ছে না, হ্যাঁ জুনিয়রে একটি ছেলে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল- কি ব্যানার্জি যেন। বাস্কেটবলে সচদেবের খেলা মনে আছে, টিমটা বেশ ভাল ছিল।
'বাস্কেটবলের কথায় একটা মজার কথা মনে পড়ল। একবার একটা টুর্ণামেন্টে এসেছেন ইন্ডিয়া টিমের দুই লম্বু- সুনীল পান্ডা আর প্রদীপ শ্রীবাস্তব, সাত ফুটের উপর লম্বা দুজনেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে নেট করতেন। ওঁরা জামশেদপুরে থাকতেন, বিপদ ছিল বসন্ত বা নটরাজে সিনেমা দেখতে গেলে। পেছন থেকে দর্শকরা চেঁচাতো- ও ভাইসাব বৈঠ জাইয়ে- আরে বাবা ওরা বসেই তো দাঁড়ানোর সমান, তাই ম্যানেজার ওঁরা এলেই রেখে দিত সব চেয়ে পেছনের দুটো সীট!
- কী মজা, না? অর্ঘ্য হাততালি দিয়ে উঠল।
'তবে আজ আর না। অনেক রাত্রি হল। পরের দিন অন্য খেলার গল্প বলব, সেটা ভিডিও গেম থেকেও সুন্দর।'
(১০)
পরদিন দাদুর আর সময় হল না। সিন্দ্রির কিছু পুরনো বন্ধুবান্ধব ফোন করেছিলেন, তাদের সঙ্গে গল্প করেই কেটে গেল সারা সন্ধ্যা। সিন্দ্রির ক্রীড়া-সংস্কৃতি জগতের একসময় যাঁরা শীর্ষে ছিলেন তেমন কিছু মানুষ এখনও ফোন বা ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন, যেমন বৈশাখ গুপ্ত, প্রবীর চৌধুরি, অভিজিৎ সেন, সঞ্জয় চৌধুরি, গৌরী গোস্বামী, তড়িৎ বিশ্বাস, নীলাঞ্জন চ্যাটার্জি, দিলীপ সচদেব, শম্ভুনাথ সিং, অলোক ব্যানার্জি, দেবদাস অধিকারি, বাঁশি মুখার্জি, সোমেন মুখার্জি, কিশোর রায়চৌধুরি, অনুপম চ্যাটার্জি, সমীর মুখার্জি, বিজয়া সরকার, সীমা গাঙ্গুলি, পুষ্কল ব্যানার্জি, অজয় সান্যাল, প্রিয়দীপ ঘোষ, অপূর্ব বড়াল ও আরও অনেকে। তাই স্মৃতিচারণে কিছুটা সময় মন্দ কাটে না মাঝে মধ্যে।
আজ তাই নাতি-নাতনিরা এসে পড়তেই আরও অনেক পুরনো দিনের কথা মনের মধ্যে ভীড় করে এল। ওদের অবশ্য পুরনো কাসুন্দিতে তেমন আগ্রহ নেই, তবু কিছু মজার ক্ষণের প্রত্যাশা নিয়ে ওরা বসে শোনে সে সব গল্প। একাবিংশ শতাব্দীর শিশুদের কাছে এসব যেন রূপকথা। মোবাইল, মল, মাল্টিপ্লেক্স নেই, টেলিভিশন- সেই প্রাচীন কালের অ্যান্টেনাওলা, একটি চ্যানেল আসত তাতে, কম্প্যুটার-ইন্টারনেট বিহীন- খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন আর রেডিও নির্ভর এক দুনিয়া। তবু তারা মুগ্ধ হয়ে শোনে মাঠের মাঝে পর্দা টাঙিয়ে ১৬ মিলিমিটারের সিনেমা দেখা, সরস্বতী পুজোয় রাতজেগে প্যান্ডেল সাজানো, মিষ্টি আর মাংসের ঘুগনির লোভে পুজোর পর বাড়ি-বাড়ি ঘুরে দল বেঁধে বিজয়ার প্রণাম করতে যাওয়া, দোলের আগের দিন এর বেড়ার কাঠ, ওর বাড়ির ভাঙা কাঠের বাক্স যোগাড় করে বুড়ি পোড়ানো আর পরের দিনের উদ্দাম হোলিখেলা, পাড়ার সবার কালীপূজার রাত্রে বাড়ির মাথায় আকাশ-প্রদীপ টাঙানো, ভাইবোন-পাড়ার বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, বাজি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বোরওয়াঙ্কারদের ছাতে মাঝরাত পর্যন্ত বন্ধুরা মিলে পটকা ফাটানো, রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে গাইতে যাতে গলা খারাপ না হয়ে যায়, ওই গরমের দিনেও শুধু গরম জল খাওয়া আর আদা চিবোনো- সব কিছু। অর্ঘ্য আর আস্থা সে সব শুনতে শুনতে পৌঁছে যায় কোন মায়াবী দুনিয়ায়। ওরা অবাক হয়ে শোনে যে ছেলেদের হল্লায় নাইট-ড্যুটি করে শোয়া চ্যাটার্জি-কাকুর কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় পাড়াসুদ্ধ বাচ্চা পিটুনি খেল, ভাবতে পারবে আজকের দিনে কেউ? আবার তিনিই যখন গ্রামে যান মায়ের হাতের গুড়ের নাড়ু পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের বিলোন, আত্মপর ভেদ থাকে না। এসব কি এই পৃথিবীতেই ঘটত না অন্য কোন গ্রহে। আজ পানুবাবুও যেন এ নিয়ে ভাবতে বসেন।
- ও দাদু, কী ভাবছ একমনে, আমরা যে গল্প শুনব বলে তখন থেকে বসে আছি।- অধীর হয়ে ওঠে তাঁর তৃতীয় প্রজন্ম।
'ও, তোমরা এসে পড়েছ? হোমটাস্ক শেষ?'
- হোমটাস্ক কাল করব। স্কুল নেই তো কাল, দোলের ছুটি। দাদু, এই নাকি তোমরা ছোটবেলায় কত হোলি খেলতে, তাহলে এ বছর আমাদের খেলা বন্ধ কেন?
'দোষটা তোমারও নয়, দোলেরও নয় দাদুভাই। একটা অদ্ভুত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে আজকাল দেশে বিদেশে, কী যেন একটা ভাইরাস থেকে হচ্ছে। যদিও এখনও তেমন বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি, কিন্তু যতদিন না এর কোন ওষুধ আবিষ্কার হয়, ততদিন এটা ছড়াতে থাকবে, খুব সংক্রামক। তাই এবছর একটু সাবধানে থাকাই ভাল।
- আজ কিন্তু ন'টার সময় পাড়ার মোড়ে ন্যাড়াপোড়া আছে। দেখতে যেতে দেবে তো?
'যেয়ো, কিন্তু বেশি ঘেঁষাঘেঁষি কোরো না কারো সঙ্গে। একটু দূর থেকে দেখবে।
-তাহলে গল্পটা আবার শুরু হোক!
নাতির হুকুম, দাদুকে শুরু করতেই হল।
'আজ আর নতুন কিছু নয়, এতক্ষণ ফোনে আর ফেসবুকে সিন্দ্রির যে সব গল্প হল তার থেকে শোনাই দু-একটা মজার গল্প। সিন্দ্রি বাজার ছাড়িয়ে রাঙামাটির দিকে যেতে পড়ত একটা উঁচু ঢিপি, আমরা মজা করে বলতাম হিমালয়। তার উপর ছিল ইস্টবেঙ্গল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। আর বাজারের পথে পড়ত মিষ্টিমুখ। সেই দোকানের মালিক সমরেশদা ছিলেন সিন্দ্রির বিখ্যাত গোলকীপার। এদিকে তপন গাঙ্গুলি মানে আমাদের তপনদা রেনেসাঁ ক্লাবের দুর্দান্ত স্ট্রাইকার, অদ্ভুত সুন্দর ড্রিবলিং। অ্যাপ্রেন্টিস হোস্টেলের মাঠে টুর্ণামেন্টের খেলা চলছে, হঠাৎ দেখা গেল সমরেশদা তপনদার পায়ের কাছে ঝাঁপাল আর তারপরেই তপনদা পড়ে গেল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, ড্রিবলিং সামলাতে না পেরে সমরেশদা ওর পায়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। মজার ব্যাপার জানিস, কেউ কিন্তু সেদিন সমরেশদার দোষ দেয়নি। সেদিন বাঁশিদাও বলে, তপনের এমন পায়ের কাজ, স্টপার বা গোলকীপার কী করবে? আমি থাকলে আমিও পা কামড়ে দিতাম!'
দাদুর গল্প শুনে তিনজনেই হেসে উঠল। তিন নম্বরটি আবার কে? ও বাবা ছেলেমেয়েদের খেতে ডাকতে অম্বা কখন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। বলে, বাবা তোমার মনে আছে ইস্টবেঙ্গল মিষ্টির দোকানের পাশে ছিল একটা ধোপার গুমটি, আর তার ছিল এক গাধা- কি মজা করে ঘ্যাঁকো ঘ্যাঁকো করে ডাকত রাতদিন। শুধু ওই গাধার ডাক শুনতে বাবাকে টেনে নিয়ে যেতাম ওই মিষ্টির দোকানে, আর বাবা ভাবত ওদের মিষ্টি এমন কী স্পেশ্যাল!
অম্বা আর দুই নাতি-নাতনি হাসতে হাসতে চলে গেল খাবার টেবিলের দিকে।
(১১)
- আচ্ছা দাদু, সিন্দ্রিতে মেয়েরা কিছু খেলত না? প্রশ্ন আস্থার।
'তাইত দিদিভাই, আমি সেখানে মেয়েদের নাচ-গান-অভিনয় এসবের মধ্যেই বেশি দেখেছি। খেলাধূলা নিশ্চয় করত, তবে তখন তো এমনিতেই স্পোর্টসের জগতে মেয়েদের তেমন প্রতিষ্ঠা হয়নি, তারপর সিন্দ্রির মত একটা মফঃস্বল শহরে। তবে আমরা ৮৭ সালে মেয়েদের ন্যাশনাল ফুটবল টিমকে সিন্দ্রিতে খেলতে দেখেছি, ধানবাদ টিমের বিরুদ্ধে ওরা খেলেছিল। মেয়েরা তখন ফুটবলে নতুন, খেলা দেখতে ভীড় উপচে পড়েছিল। আর সিন্দ্রির মেয়েরা তখন টেবল টেনিস, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন খেললেও, চোখে পড়ার মত পারফর্ম্যান্স মনে পড়ছে না কারো।'
- বাইরে থেকে আর কারা খেলতে আসত?
'ফার্টিলাইজার ইন্টার জোনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়েছে বার দুই। খেলে গেছেন কলকাতার রাজা মুখার্জি, শিবাজি ব্যানার্জি, সমর মুখার্জি, রাজু মুখার্জি। তখন সিন্দ্রি দলে খেলতেন গায়িকা আরতি মুখার্জির ভাই সমীর, সরদার ফিরোজ, অলোক ব্যানার্জি, তাছাড়া অন্য দলের হয়ে খেলেছে সিন্দ্রির বিধান-বিমান চ্যাটার্জি ভাইয়েরা। ৭৭এ যখন বিহার-বাংলা রণজি ম্যাচ হল ডিগোয়াডির টিস্কো স্টেডিয়ামে, বাংলার খেলোয়াড়দের এক সন্ধ্যায় নিমন্ত্রণ করা হল এক প্রীতিভোজে, সেদিন সিন্দ্রি ক্লাবে দেখানো হয়েছিল মোহনবাগানের মেয়ে ছবিটি। অম্বর রায়, গোপাল বোস, পলাশ নন্দী, সুব্রত গুহ, রুশী জিজিভয় অনেকে এসেছিলেন সেদিন। ফুটবলে মোহনবাগান খেলে গেছে সিন্দ্রি কল্যাণ কেন্দ্রের স্টেডিয়ামে। অনেক নামকরা কোচ এসে ঘুরে গেছেন যেমন সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদার, অমল দত্ত, সুভাষ ভৌমিক আর মেওয়ালাল।'
- ও দাদু, গল্প কোথায়? নাতি একটু অধৈর্য।
'ও আচ্ছা, এগুলো বুঝি গল্প নয়! তাহলে একটা মজার ঘটনা বলি। সিন্দ্রিতে তখন দাপিয়ে খেলেন দুই যমজ ভাই জহর আর পান্না বোস, একেবারে এক দেখতে, সিয়ামীজ টুইন্স যাকে বলে।..পান্নাদা:নিজে গল্পটা বলছেন আমাদের অপূর্ব বড়ালের বাবাকে- 'আর বলবেন না দাদা, ঐ যে গোয়ালাটা প্রতিদিন দুধে জল মিশিয়ে আমাদের মানে বাঙালীদেরকে ঠকাতো, কিছু বললেই বলতো- বাবু, ইতনা খাঁটি দুধ বাঙালী বাবুলোগ কো পচেগা নহী..ইসলিয়ে থোড়া বহুত পানি মিলানা পড়তা হায়......তাই আজকে বাগে পেয়ে আমরা দু ভাই মিলে ওকেই জব্দ করলাম।
- সে কিরে..সেটা কিরকম?
- ব্যস খালি ওকে একটু গরম করে দিয়ে বললাম- তুমহারা দুধ মে কোই জান নেহী হ্যায়, হম অকেলে এক বালটি পী যায়েঙ্গে.....(পান্না এদিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আর জহর ভেতরের ঘরে সেম ড্রেস পরে বসে রয়েছে)।
"অকেলে পী যায়েঙ্গে" বলাতেই গোয়ালাটি রেগে গিয়ে আমাদের পুর্ব পরিকল্পিত ফাঁদে পা দিয়ে ফেলল। বললে- ঠিক হ্যায় বাবু, ইয়ে বাল্টি ভরা দুধ আপ পী যাও তো আপকা, নহি তো দো বাল্টি দুধ কা পয়সা দেনা পড়েগা। গল্পটা বেশ জমে উঠেছে, পান্নাদা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলো-
- ঠিক হ্যায় তুম্হারা শর্ত মঞ্জুর হ্যায়, লেকিন হামারা ভি একগো শর্ত হ্যায়। হাম দো-তিন গ্লাস দুধ পীনে কা বাদ অন্দর বাথরুম করকে আয়েগা, ফির পিয়েগা।
-ঠিক হায়..বাবু হম সমঝ গয়ে আপ বাথরুম মে কাহে যানা চাহতে হ্যাঁয়।
ব্যস, এবার খেলা শুরু। পান্না দুধ খেয়ে ভেতরে যায়....আর জহর আসে দুধ খেতে। আবার জহর ভেতরে যায়, পান্না আসে দুধ খেতে। দেখতে দেখতে গোয়ালার দুধের বালতি খালি।
'যমজ ভাইয়ের এই হলো মহিমা!'
(১২)
পানুবাবুর বয়স হয়েছে আর কে না জানে জগতে বুড়ো আর শিশুদের জন্যে কিছু নিয়ম প্রায় একই রকম, তাই তাঁর রাতের খাওয়াদাওয়া বাসায় থাকলে আটটাতেই হয়ে যায় নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। আজও সেভাবে খাওয়াদাওয়া সেরে এসে নিজের ঘরে বসেছিলেন, ঘরে ঢুকল নাতি আর নাতনি। তাদের গল্প যে এখনও শেষ হয় নি। অগত্যা দাদুকে আবার শুরু করতে হয়।
- দাদু আরো খেলার আর খেলোয়াড়দের গল্প বল। নাতির দাবী। ওর কী ভাল লেগেছে ও-ই জানে।
' ঠিক বলেছো দাদুভাই। কত খেলা আর কত নাম! ইনডোর খেলার কথা তো তেমন বলাই হয়নি। কল্যাণ কেন্দ্রের এককোণে ছিল একটা ব্যায়ামাগার, যাকে তোরা জিমনাসিয়াম বা জিম বলিস। ওখানকার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ছিল শেখরদা আর ইন্দর লাম্বার মত পালোয়ান যার বিশাল নাম ছিল ক্যারাটেতে। ইনি হচ্ছেন সিন্দ্রির সেই প্রথম খাবারের হোটেল, মুদির আর কাপড়ের দোকানের মালিকের ছেলে। এত জনপ্রিয় মানুষটা কয়েক বছর আগে সুইসাইড করল কেন কে জানে!
- কী বলছো বাবা, ইন্দর আঙ্কল মারা গেছেন? অম্বা কখন ঢুকেছে খেয়াল করেননি পানুবাবু।
'হ্যাঁ মা, আর একজন ভাল মানুষ এইভাবেই আত্মহত্যা করলেন সে বছর। কাজলদা। দুর্ধর্ষ ফুটবলার, রেফারি আর পরোপকারি নিখুঁত ভদ্রলোক। এই কাজল ব্যানার্জি আর গোপাল চক্রবর্তী রক্ত না দিলে বাবার আলসার অপারেশনে বাঁচানো যেত না সেবার।'
- দাদু, দুঃখের গল্প শুনব না, খেলার কি বলছিলে বল।
'হ্যাঁ দিদিভাই, সে তো চলছেই। জহর পান্নাদের ফুটবলের কথা বলেছি, ওঁরা কিন্তু খুব ভাল অ্যাথলীটও ছিলেন, চ্যাম্পিয়ান স্প্রিন্টার। এছাড়া কমেডিতেও ওঁদের জুড়ি ছিল না, হাসিয়ে মারতেন সবাইকে। পরে অ্যাথলেটিক্সে আসেন কপিল আর ভীম সিং। বক্সিং রিং কাঁপাতেন চিত্ত সেন আর শেখর নাহা। টেবিল টেনিসে মিহিরদা তো ছিলেন কিংবদন্তি, আরো ছিলেন চৌরাশিয়া, আমিরুল্লা, তারা দত্ত, সুমন সেনগুপ্ত, ছোটন সেনগুপ্ত। তবে সিন্দ্রি বিখ্যাত ছিল তাসের ব্রিজ খেলায়। স্টেট লেভেলের অনেক খেলোয়াড় ছিলেন- নিরঞ্জন রায়, ডাঃ বাগচি, এইচ-এল আচার্য, মণীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ডাঃ অখৌরি, বক্রেশ্বর চ্যাটার্জি, জেপি ভার্মা, বি এন সিনহা, ডাঃ এইচ এল সিনহা, বল্টু সরকার। এঁরা বিহারে বা ফার্টিলাইজার টুর্নামেন্টে যেখানে খেলতে গেছেন প্রাইজ নিয়ে এসেছেন। দাবার খেলোয়াড়ও অনেক ছিল, তবে এত বুদ্ধি আর ধৈর্যের খেলা আমি খেলতাম কিন্তু আনন্দ পাইনি কখনও। সিন্দ্রিতে আমাদের হেডমাস্টার প্রতাপ সিং ভাল খেলতেন।'
- আচ্ছা, ওখানকার সাহিত্যচর্চা নিয়ে কিছু বললে না তো- অম্বা শুধোন।
'সাহিত্যের জন্যে প্রথমে দরকার বই পড়া, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মেলামেশা, কিছু লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ- এই সব। তা বেশ কিছু পণ্ডিত লোক ছিলেন এ ব্যাপারে উৎসাহী। শংকর, সমরেশ বসু, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দু এসেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। সিন্দ্রিতে বাংলা বইয়ের গোটা দুই-তিন লাইব্রেরি ছিল, সব বন্ধ হয়ে গড়ে উঠল রবীন্দ্র পরিষদ গ্রন্থাগার। মিত্র-ঘোষ প্রকাশনের অন্যতম অংশীদার সুমথনাথ ঘোষের মেয়ে ছিলেন সিন্দ্রি কলেজের অধ্যাপিকা, সাহিত্যমনস্ক জামাতা অলক তালুকদার প্রায় একক প্রচেষ্টায় শুরু করলেন সম্পাদন আর প্রকাশনা 'ঢেউ' নামে ত্রৈমাসিক বাংলা পত্রিকার। সেটা উঠে গেলেও সিন্দ্রির বিদগ্ধ বাঙালি সমাজ শুরু করল রবীন্দ্র পরিষদ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিবিম্ব। নিয়মিত লিখতেন শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জী, অলক তালুকদার, প্রদীপ ঘোষ, সুকুমার ঘোষ, সাধন বসু, চিত্ত পাল ও আরো অনেকে। প্রায় বছর তিনেক চলে পত্রিকাটি। দাঁড়া তোরা, একটা সংখ্যা বোধহয় এখনও আছে আমার কাছে।'
পানুবাবু আলমারি খুলে সযত্নে বের করে আনেন প্রতিবিম্ব আশ্বিন ১৩৯০ সংখ্যা।
'এই কবিতাটা শোন। সন্ধ্যা মুখার্জি নামে এক বাচ্চা মেয়ের লেখা হলেও খুব পরিণত লেখা আর সিন্দ্রির এত সুন্দর বর্ণনা আছে, তোদের ভাল লাগবে।
'এবার পুজোয় সিন্দ্রি ভ্রমণ
ভালই হল, জানলি সুমন
কী আর এমন থাকবে হোথায়?
বলছি ভেবে দু-চার কথায়।
হাওড়া থেকে যেমন ওঠা
ট্রেন ছুটে যায় রেসের ছোটা
ওই দিকেতে কয়লাখনি
কাজের মানুষ গরীব ধনী।
কয়লার গুণ স্মরণ করি
রাখেন গুণী ট্রেনের নাম
কোলফিল্ড আর ব্ল্যাক ডায়মন্ড
বুঝলি কিসের বাড়লো দাম?
মানুষ ভরা কলকাতাতে
রাস্তা চলি প্রাণটা হাতে-
পাশ ঘেঁসে যায় ট্রাকের চাকা
সিন্দ্রিতে ভাই রাস্তা ফাঁকা।
পুটুস ফুলের ঝোপের বাহার
রক্ষা করে দুপাশ তাহার।
কোয়ার্টারের পাশেপাশে
স্কুটার দাঁড়ায় সবুজ ঘাসে।
সখ যদি হয় রিক্সা চড়া
যাও রোড়াবাঁধ সহরপুরা।
সহরপুরায় মস্ত বাজার
লোক দেখা যায় হাজার হাজার।
কুদরি পটল মিঠাই কোবি
হাটের দিনে মিলবে সবই।
স্বাধীনতা হেথায় ভালো
সাইকেলে নেই ঘন্টা আলো,
পথ জুড়ে ভাই গাদাগাদা
ঘুমোয় গরু মহিষ গাধা।
ওদের কানের খুলতে তালা
হর্ণ ছিঁড়ে দেয় ট্যাক্সিওলা
এরাও তো ভাই পূর্ণ স্বাধীন,
পথ ছাড়েনা কেউ কোনদিন।
ছাতিম গাছের কুসুম তাজা
সিন্দ্রি পথে- রাতের রাজা,
থোকায় থোকায় শুভ্রবর্ণ
ফুলটি ফোটায় সপ্তপর্ণ।' '
শারদ রাতের পলেই আভাষ
ছাতিম ছড়ায় নবীন সুবাস
মন্দিরে শিউ, গৌরী, কিষণ,
রামকৃষ্ণের শান্তি মিশন।
আনন্দময়ী দশভূজা
আস্তে ধীরে নিলেন পূজা।
মন্দিরা ঢোল বাজায় ক'জন
মাইক বিনা ভক্তি-ভজন।
সবার মাথাই পড়ল নুয়ে
আলপনাময় পৈঠা ছুঁয়ে।
বিজয়াতে মণ্ডা-মেঠাই
বাদ পড়েনি সেও কোনটাই।।
(১৩)
ইতিমধ্যে জামাই শরদিন্দু এসেছে, এসেই ছেলেমেয়েকে ধমক দিয়ে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সিন্দ্রির কবিতা নিয়ে গল্প করতে করতে দু'ভাইবোন শুতে চলে গেল। 'কী নিয়ে গল্প চলছিল, নিশ্চয় সিন্দ্রি?' শরতের প্রশ্ন। 'একটা কবিতা শুনলাম মনে হল?'
- হ্যাঁ, বাবা একটা সিন্দ্রির উপরে লেখা কবিতা শোনালেন। তবে আমার সংগ্রহেও একটা আছে। মোবাইলে ফেসবুক খুলে ব্রাউজ করে বের করে অম্বা, '
সিন্দ্রী ২০১৭'- প্রভাস মিত্রের লেখা, শোনো-
তুই যে আমার ভালোবাসা
ভুলতে কি তাই পারি
রাত স্বপ্নের ঘুম ভাঙা ভোর
তবু, তোর সঙ্গেই আড়ি।
তুই কি হাসিস
তুই কি কাঁদিস
আমার জন্য আজও
আষাঢ় শ্রাবণ খোঁপা খুলে
স্নানেতে যাস আজও?
শীতে খোঁপায় গোলাপ গুঁজিস
আগের মতো আজও
বারান্দাতে পোয়াস কি রোদ
অলস হয়ে আজও?
তোর হাসিটা আধখানা চাঁদ
আধখানা ঠোঁট আলো
মাইরি বলছি তোকে ছাড়া
আর লাগেনা ভালো।
সবুজ শাড়ি পরতিস তুই
দা-রু-ন তোকে লাগতো
নষ্ট আমার ছিঁচকে দু'চোখ
তোকেই চেয়ে থাকতো।
এখন কি তুই জেগে থাকিস
মনখারাপের রাতে
খাবার সময় আনমনা হোস
মন থাকেনা ভাতে?
তুই যে এখন অনেক দূরের
ওই ওপাড়ার তারা
হাত বাড়ালেই পাইনা তো
তাই,বাঁচছি তোকে ছাড়া।
কতদিন দিসনি চুমু,
ঝাঁপিয়ে ভালোবাসা
হারিয়ে তোকে সত্যি কি তাই,
পেলাম ভালো বাসা?
'বাঃ চমৎকার!' উচ্ছ্বসিত পানুবাবু।
'আচ্ছা বলতো, সিন্দ্রির কী কী মিস করে পুরনো লোকেরা? কেন তাকে মনে রাখে, মনে পড়ে বার বার?'
- আপনিই বলুন না। আমার তো কোন স্মৃতি নেই সেই কল্পনায় একবার দলবেঁধে বাংলা সিনেমা দেখা আর ডোমগড় পাম্প হাউসে পিকনিক করা ছাড়া।- শরত বলে।
'শোন তবে কিছু সিন্দ্রি স্পেশ্যালের লিস্টি।
কল্পনা টকিজ, ইস্টবেঙ্গলের কালাকান্দ, মঙ্গল সিং এর হার্টিকালচার গার্ডেন, প্রিয়দর্শিনী পার্ক, জিএম.পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন, শিবমঙ্গলের দুর্গাপ্রতিমা, পথের দু'ধারে কদম আর ছাতিম গাছ আর সেই ফুলের গন্ধ, চার্চের পাশের জল ট্যাঙ্ক, ফ্যাক্টরিতে বিশ্বকর্মা পূজো আর বাচ্চাদের ভেপু বাজানো, তাঁবু খাটিয়ে যাত্রাপালা, বিজয়াদশমীতে রাবণ বধ।'
- রাবণ জ্বালানোর ব্যাপারটা ছিল ইউনিক, বল? বাচ্চাদের বোলো, ওরা খুব এনজয় করবে।
'এ জিনিষ না দেখলে বোঝা যায় না। তবু দুর্গা-কালী-সরস্বতীপুজো তো সবজায়গাতেই ধূমধাম করে হত, সিন্দ্রির বিশেষতঃ ছিল বিশ্বকর্মা পুজোয়, ঐ একটা দিন কারখানায় আমাদের অবাধ প্রবেশ ছিল। তবে আজ আর এ নিয়ে কথা নয়, দাদু-দিদিভাইরা মিস করবে। তবে প্রায় চল্লিশটা বছর কাটিয়ে কি এক-আধটা দুঃখ-কষ্টের দিন যায়নি? ষাটের দশকের আগের কোন স্মৃতি নেই আমার, যেটুকু আছে সব শোনা কথা। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে কারখানা তৈরি শুরু হল, মুখার্জিসাহেব ছিলেন ডিরেক্টার আর কক্সসাহেব জেনারেল ম্যানেজার। প্রজেক্ট ম্যানেজার কে-আর চক্রবর্তী অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৫১ সালের অক্টোবরে সিন্দ্রি সার কারখানার কমিশনিং, শুরু হল অ্যামোনিয়াম সালফেটের উৎপাদন। তারপর ৫২ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এসে করলেন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। ৫৪ সালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মানিত করল চক্রবর্তীকে, সম্মানিত হল সিন্দ্রি।
- আচ্ছা, সিন্দ্রির থেকে আর কেউ পদ্মশ্রী বা বড় কোন সম্মান পাননি তার পরে?
'বিআইটি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ আর পিডিয়াইএলের কিছু টেকনোক্র্যাট আর বিজ্ঞানী, সিন্দ্রির কিছু কলাকুশলী পরবর্তীকালে নানা পুরস্কার আর সম্মান পেয়েছেন। তবে ২০১৮ সালে পদ্মশ্রী পান একমাত্র সিন্দ্রি রাজেন্দ্র স্কুল আর বি-আই-টির ছাত্র অমিতাভ রায়। ইনি ভাভা অ্যাটমিক রিসার্চ কমিশনে পরমাণু-বিজ্ঞানী ছিলেন আর নিউক্লিয়ার বর্জ্য-পদার্থে পুণর্ব্যবহারের উপরে উল্লেখনীয় কাজ করেন। আমার সিন্দ্রিবাসী বন্ধুরা তাঁকে ডেকে এনে বিশেষ সম্বর্ধনা দেয় রবীন্দ্র পরিষদে একটি অনুষ্ঠানে।'
- বাবা রবীন্দ্র পরিষদের ব্যাপারে আমরা খুব কম জানি। কী সুন্দর ছাদের ডিজাইন ছিল মনে আছে। দু'খানা স্টেজ, হলঘর, স্কুল, লাইব্রেরি, বিশাল মাঠ, বল না সেসব গল্প।
'ঠিক বলেছিস, সে এক কাহিনী। সিন্দ্রিতে অন্ততঃ ২০-২৫ প্রতিশত বাঙালি থাকলেও তাদের মেলামেশার সুবিধের জন্যে তেমন কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। এল টাইপের একটা ঘরে ধর্মচর্চার জন্যে রামকৃষ্ণ আশ্রম, এমনই আরও দুটো কোয়ার্টারে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা দুটো লাইব্রেরি, অধ্যাত্ম-চর্চার জন্যে তেমনি এক অরবিন্দ সোসাইটি থাকলেও সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালিদের সংস্কৃতিচর্চার জন্যে ১৯৬১ সালে প্ল্যান করা হয় রবীন্দ্র পরিষদের। পাহাড়ি গুপ্ত, সমীর ঘোষ, মানব দাস, প্রদীপ ঘোষ ও আরো অনেকের মিলিত উদ্যমে তৎকালীন সার কারখানার প্রধান কৃষ্ণচন্দ্র শর্মা আর রজত ঘোষের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হল নৌকোর মত ছাত-সম্পন্ন এর একতলা ভবনটি। ভেতরে একটি স্টেজ, হল, অফিস, স্টোর আর লাইব্রেরি। পরে তৈরি হয় মুক্তাঙ্গন বিশাল স্টেজটি বাইরের দিকে। ১৯৬৫ থেকেই এই পরিষদকে ঘিরে নানা কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। জলসা, বিচিত্রানুষ্ঠান, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-নেতাজি জন্মদিন উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, গানের প্রতিযোগিতা। বাইরের বড় স্টেজখানা হবার পরে নান্দীকার, বহুরূপীর মত বিখ্যাত দলগুলোর নাটক করার সুযোগ হল। তারপর ওই পরিসরেই শুরু হল রবীন্দ্র বিদ্যালয় আর নজরুল ভবনের। ২০০২ তে সিন্দ্রি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবার পর বাঙালির সংখ্যা কমে গেলেও, এখনও চলছে এর কর্মকাণ্ড। কয়েকবছর আগে সিন্দ্রির বাসিন্দা আর ছেড়ে যাওয়া বাঙালিরা মিলে একটা ফেসবুক গ্রুপ গড়ে তোলে, ২০১৬র ডিসেম্বরে একটা মিলনোৎসবের আয়োজন করা হয় যাতে যোগ দেয় অনেক পুরনো সিন্দ্রিবাসীরা। এঁদের অনেকে এখনও সিন্দ্রিতেই আছেন, অনেকে আসেন ধানবাদ, আসানসোল, দুর্গাপুর, কলকাতা এমনকি দিল্লি থেকেও। এই সুযোগে শুভা ব্যানার্জি একটা কবিতা পাঠান ফেসবুকে, শোন-
"ভাবিনি এত আনন্দ ভালবাসলে,
মূহূর্তটাই বড়... সময়ের দীর্ঘতা নয়..
মন আমার ছুঁয়েছে শুরু থেকে শেষ...
অনেক কথা আর নানা রঙের রেশ...
হয়ত বা ছাড় গেছে খাওয়া - দাওয়া,
সকালের আড্ডা,সন্ধ্যার গান গাওয়া,
কিন্ত সকলের টানে পৌঁছে গেছি...
ভালবাসার তোড়ায় স্বাগত হয়েছি..
মহা প্রসাদ স্বরুপ পেয়েছি পায়েস,
কি তার স্বাদ..কি তার আবেশ..
চোখের জলেতে, মুখের হাসিতে..
ভরেছি নিজের ঝুলি ফুলের তোড়াতে..
কিছু নাম ছিল জানা, কিছু অজানা,
কিন্তু 'শুভা' যে ছিল সবার চেনা..
অতুলনীয় ....আমি যা পেয়েছি ..
প্রকাশের ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি..
সিন্দ্রীর মাটি ও বাতাস আমি ছুঁয়েছি..
সিন্দ্রীতে কাটান সময়কে সাথে নিয়েছি.
সিন্দ্রী আমার সুন্দর স্মৃতি আজি,
রবীন্দ্র পরিষদ আমার পরিবার..
সেই স্মৃতি আমার কাছে এক আলো..
সব ভাল যার শেষ ভাল।" '
(১৪)
- বাবা, তুমি সিন্দ্রির কথা এমনভাবে বলছ, বাচ্চারা ভাবছে ওখানে কেউ লেখাপড়া করতই না। এত নামকরা স্কলার আর প্রতিভা বেরিয়েছে, তাদের কথাও বলবে কিছুটা।
- আচ্ছা বাবা, আপনি দুটো লাইব্রেরির কথা বলেছিলেন সেদিন। তার একটা শুনেছি নেতাজি পাঠাগার। অন্যটা কোথায় ছিল, কী নাম?
'ঠিক কথা বলেছ তোমরা। ভাল স্কলারদের কথা তো বলতেই হবে। আর শরত, লাইব্রেরিটার নাম আমারও মনে ছিল না। তবে ইদানীং জানতে পেরেছি ওর নাম ছিল বাণীশ্রী, J-9 কোয়ার্টারে চুনীলাল বোস আর শান্তিরঞ্জন দত্তচৌধুরি মিলে শুরু করেন, পরে রবীন্দ্র পরিষদে লাইব্রেরি শুরু হতে বাণীশ্রীর বইগুলি ওঁরা পরিষদকে দান করে দেন। এই তথ্য পেলাম শান্তিবাবুর কন্যা নমিতা আর প্রণব ব্যানার্জির ছেলে পুষ্কলের সৌজন্যে, অবশ্যই অলক তালুকদার মশাইয়ের স্মৃতিচারণ কিছুটা সাহায্য করেছে।
'তবে পাবলিক না হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পুস্তকালয় সর্বত্রই ছিল। পি অ্যান্ড ডি, এফসিএই ট্রেনিং সেন্টার, স্কুলগুলোতে, রামকৃষ্ণ মিশনে, রাজেন্দ্র সাহিত্য পরিষদ, বিদ্যাপতি পরিষদ তো বটেই, পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবগুলোর উদ্যমে গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট লাইব্রেরি। আমাদের কেডি পাড়ায় অজয় আর শ্যামাশিস নিজেদের প্রচেষ্টায় এমনি একটা বানিয়েছিল, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বই দেয়া-নেয়া করত।'
- ঠিকই তো। বই না পড়লে শুধু মেধা দিয়ে তো কেউ বিদ্বান বলে প্রতিষ্ঠা পাবে না। এই ক্লাব, সংগঠন আর লাইব্রেরিগুলোই হচ্ছে সমাজের সংস্কৃতিচেতনার প্রাণ। শরৎ পণ্ডিত মানুষ, জামাই হলেও ওর কথার গুরুত্ব দিয়ে থাকেন পানুবাবু।
- বাবা, রবীন্দ্র পরিষদের কথা তো বললে। রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের কথা কিছু বলবে না?।
'বলতে তো হবেই, সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাও। প্রথমে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রসঙ্গে আসি। মুখ্যতঃ অনিল বিশ্বাস আর শৈলেন দত্তের প্রচেষ্টায় এল-টাইপের ছোট একটা দু-কামরার ঘরে মিশনের স্থাপনা হয়- সে একেবারে সিন্দ্রির ইতিহাসের গোড়ার দিকে। আশ্রমের কাজে সিন্দ্রির মহিলাদের যোগদান ছিল চোখে পড়ার মত। একটা দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল, একজন ডাঃ চ্যাটার্জি রোগী দেখতেন, ওষুধ দিতেন। বেলুড় মঠ, রামকৃষ্ণ মিশন বা তার বাইরে থেকেও অনেক সাধু-মহাত্মা-গুণীজন আসতেন সেখানে। একসময় বেলুড় মঠের স্বামী যুক্তানন্দ এসে ঠাকুরের জীবন ও বাণী নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেন সাউথ হোস্টেলে। তাতে জনগণের আগ্রহ দেখে ১৯৬৩-৬৪ সালে বি এই টি ১৬ নম্বর গেটের উল্টোদিকে গোশালা মোড়ের মুখে বেশ খানিকটা জমি কোম্পানির থেকে লীজ করে বেশ কয়েকজন ভক্তদের উৎসাহে আর মূলতঃ বিআইটির তৎকালীন নির্দেশক ডাঃ কামাখ্যাপদ গুপ্তের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সঙ্গে নরেন দাশগুপ্ত, উমাতোষ চক্রবর্তী, চক্রধর সরকারদের নিরলস পরিশ্রমে আশ্রম চালু হয় ১৯৬৪ তে, পরে ৬৬ সালে নতুন মন্দিরটি গড়ে ওঠে। একটা লাইব্রেরি, চিকিৎসালয়, অতিথিশালা, মহারাজদের কক্ষ, রান্নাঘর, ভাঁড়ার, মন্দির আর দুর্গাপুজোর মঞ্চ- সব তৈরি হয় একে একে, উদ্বৃত্ত জমিতে ধানচাষ হয় এখনও। বেলুড়ের সঙ্ঘ থেকে একজন সন্ন্যাসী নিজুক্ত থাকেন দৈনিক পূজার্চনার জন্যে।
'তবে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম সিন্দ্রিতে শুধু একটা মন্দির বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটা সিন্দ্রির ইতিহাসের একটা স্মৃতিফলক, একটা আইডেনটিটি মার্ক, যেমন আছে আরো দুটি শিব মন্দির- শহরপুরা আর ডোমগড়ে, মনোহরটাঁড়ের মুখে গড়ে ওঠা আয়াপ্পা মন্দির, সহরপুরায় নবনির্মিত সাঁইবাবা মন্দির আর রাঙামাটির অরবিন্দ সেবা প্রতিষ্ঠান।'
- এতশত জানতাম না। তবে আশ্রমের কালীপূজো আর মহানবমীর খিচুড়ি প্রসাদ এখনও মুখে লেগে আছে। তাছাড়া উদ্বোধন প্রেসের বইএর সম্ভার, রোজকার সন্ধ্যারতি, ছোটখাটো অথচ আন্তরিক গানবাজনার অনুষ্ঠান- ছৌ নাচ, বাউল গান, ভক্তিগীতি- এই সবের, কম ছিল তখনকার দিনে!
'বাঙালিদের দেখাদেখি সিন্দ্রির অবাঙালিদের মধ্যেও কিন্তু একটা সংস্কৃতিচেতনা গড়ে উঠছিল। তার ফলে তৈরি হল রাজেন্দ্র সাহিত্য পরিষদ আর বিদ্যাপতি পরিষদ- বিহারি আর মৈথিলি সমাজের প্রচেষ্টায়। ওরাও মাঝে মাঝে ভাল ভাল কবি সম্মেলন, শাস্ত্রীয় সংগীতের বা বৈষ্ণব পদাবলি কীর্তনের আসর বসাতেন, আমাদের মাস্টার মশাই প্রতাপ বাবু, জগদীশ স্যার, ওস্তাদ তানরাজ, তবলচি তেওয়ারি চাচা থাকতেন বিশিষ্ট ভূমিকায়। চার্চের হলঘর ভাড়া নিয়ে অনেক নাটক, জলসা, গীতিনাট্য হয়েছে এককালে, কত আর বলব? তবে আজ আর নয়। কাল-পর্শু বাচ্চাদের শোনাব বাকিটা, তোমরাও চাইলে থাকতে পার।'
চুপ করলেন পানুবাবু। সেদিনকার মত আসর শেষ হল।
(১৫)
ছাত্রদের হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা ছিল সামনে, পরদিন থেকে দাদু বেশ ক'দিন ধরে ব্যস্ত হয়ে থাকলেন তাঁর কোচিং ক্লাস নিয়ে। ইতিমধ্যে দুই ভাইবোন মিলে উইকিপেডিয়া থেকে সিন্দ্রি সম্বন্ধে যা কিছু লেখা ছিল পড়ে নিয়েছে। ভাবখানা এই যে দাদু এলেই একেবারে তাক লাগিয়ে দেবে। পানুবাবু প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেছিলেন ঠিকই, যখন আস্থা তাঁকে সিন্দ্রি থেকে ধানবাদের মাঝের সবকটা স্টেশনের নামগুলো গড়গড় করে বলে গেল। তবু উনি শুধোলেন, 'সিন্দ্রি নামটা তিনবার বললি যে দিদিভাই!'
- বা রে! প্রথমটা সিন্দ্রি টাউন, তারপর সিন্দ্রি মার্শালিঙ ইয়ার্ড, তারপর সিন্দ্রি ব্লক। সিন্দ্রি টাউন থেকেই সব ট্রেন ছাড়ে ত।
'একদম ঠিক। জান ত দাদুভাই, সিন্দ্রির জন্মের সময় থেকেই এই সিন্দ্রি-ঝরিয়া-ধানবাদ, এই যাত্রাটা ছিল সবচেয়ে মাথাধরার জিনিষ। ভারি ভারি কয়লা-বোঝাই ট্রাক চলে চলে রাস্তাগুলোর আর কিছুই থাকত না, ভেঙ্গেচুরে একসা। এই রুটে কটা মাত্র বাস চলত তখন। এস-কে বাস - এটা ছিল আমাদের পাড়ার গোরাদার দাদুর বাস, কন্ডাক্টার আমাদের কাছ থেকে ইচ্ছে করেই ভাড়া চাইতে ভুলে যেত, ডাক বাস- বোধহয় ELBS লেখা থাকত। ছিল রোডমাস্টার, সেটা আসানসোল পর্যন্ত যেত। আর ছিল শেয়ারের ট্যাক্সি, পরে আসে মিনিবাস, মাটাডোর ভ্যান আর ট্রেকার। সিন্দ্রী থেকে ধানবাদ রুটে যে মিনিবাসগুলো চলত সেগুলো ছিল ওমনি, কল্যাণী , শঙ্কর , শঙ্কর-শম্ভু , NKT- এগুলোর মধ্যে একমাত্র NKT টাই সহরপুরা থেকে ভায়া ডোমগড়-বেলিয়াপুর রুট ধরে ধানবাদ যেত। আরেকটা ছিল বোধহয় পরেশ- যেটা ভোরবেলায় ধানবাদ থেকে কোলফিল্ড ধরাতো। তারপর ফ্যাক্টরিতে কয়লা আর কাঁচামাল আনার জন্যে যে রেলপথ পাতা হয়েছিল, ১৯৮৪তে রেলমন্ত্রি গনি খান চৌধুরির দৌলতে তার উপর দিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালানোর কাজ চালু হয়। এখন বরং রাস্তাঘাটের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে রাস্তার ভীড় সেই তুলনায় অন্ততঃ দশগুণ বেড়েছে। তবে ট্রেকারের বদলে এ রাস্তায় এখন চলে অটো আর টোটো!'
-আচ্ছা দাদু, মইনুদ্দীন হেয়ার ড্রেসার, গোঁসাই শালিগ্রাম আর অজন্তা ঝা কারা বল তো?- উইকিপিডিয়াতে এ সব বিবরণই পড়ে ফেলেছে আস্থা আর অর্ঘ্য।
'পরীক্ষা নিচ্ছ, দিদিভাই। তাহলে তোমাকে সিন্দ্রির কয়েকজন পরিচিত মুখের কথা জানাই। সিন্দ্রি ক্লাবের রত্ন ছিল মইনুদ্দীন। ছোট শহরে লেটেস্ট ফ্যাশনে চুল ছাঁটার আর্টের জন্যে ও বিখ্যাত আর সবার খুব প্রিয় ছিল। হিন্দি কবি সম্মেলন, মুশায়রা ইত্যাদির প্রাণ ছিলেন শালিগ্রাম, মহেশ্বর মিশ্র, প্রতাপ নারায়ণ, জগদীশবাবু। অজন্তা ঝা মানে মিঠুদির নাচের স্কুল এখনও চলছে, যদিও ছাত্রীদের সংখ্যা জানিনা কত এখন। সহরপুরা বাজারে দীপু অপটিক্যাল বোধহয় এখনও আছে, তবে বাঁকুড়া সুইট্স, মিষ্টিমুখ, মেডিকো উঠে গেছে। রমরমিয়ে চলছে শম্ভুর ডি-এন স্টুডিও, দিলীপ সচদেবের কাটপিস সেন্টার, জনতা আর পপুলার মেডিক্যাল হল, উপ্পল স্টোর ও আরও অনেক পুরনো দোকান। ডি-এন স্টুডিওর উল্টোদিকে বিশাল আড্ডা বসত প্রতিদিন, থাকতেন শ্যামবাহাদুরজি, কাজল ব্যানার্জি, গোপাল চক্রবর্তী, অজিত চ্যাটার্জি, রমেন ঘোষ, শৈলেন চৌধুরি ও আরও অনেকে। এখন তাঁরা আর কেউ নেই ওখানে।
'জানিস, সিন্দ্রিতে সারের কারখানা ছিল বলে কিনা জানি না, ওখানে যে যা করতে ইচ্ছে করত, মাটির উর্বরতার জন্যে কিনা জানিনা, সাফল্য পেতে দেরি হতনা। কিন্তু ছোট জায়গা বলে প্রচারের আলো তেমন পেত না। মোহনবাগানের মত টিম, অমল দত্ত তখনও খেলেন, তরুন বসু, শিবাজি ব্যানার্জির মত খেলোয়াড় এসে আমাদের অশোক প্রামাণিক, ফিরোজ, জহর-পান্না, মিঠু চৌধুরিদের খেলা দেখে অকুণ্ঠ তারিফ করে গেছে। ক্যারাটে-পালোয়ান ইন্দর লাম্বাকে চেনে না এমন লোক বিহারে কম ছিল। বরং পাওয়ার লিফটিংএ স্টেট চ্যাম্পিয়ান বিমান দাসকেই চিনত না কেউ খুব একটা।'
- আচ্ছা দাদু, বারবার তুমি সিন্দ্রির নাটক-যাত্রা-গানবাজনা আর খেলাধুলো নিয়ে বলে যাচ্ছ একটানা, পড়াশুনায় কেউ তেমন ভাল ছিল না বুঝি?
'ইস্, একদম ভুলে গেছি রে বলতে! বুঝলি, সিন্দ্রির আশেপাশে ছিল অজস্র কয়লাখনি। আর জানিস তো, তখন নিউক্লিয়ার-টিয়ার হয়নি অত, তেল আর গ্যাসের বড় ভাণ্ডারও আবিষ্কার হয়নি, কল-কারখানার জ্বালানি বলতে শুধু কয়লা। তাই ধানবাদকে ঘিরে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল স্বাধীন ভারতের নতুন সরকার। সার কারখানা, প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট, অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানি, বিহার সুপারফস্ফেট কারখানা- এসবের প্ল্যান চলছে যখন, সেই স্বপ্ন সফল করতে প্রয়োজন পড়ল অনেক অনেক ইঞ্জিনীয়ারের। কয়লাখনি অঞ্চলে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা মেটাতে সিন্দ্রির থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ভাগা মাইনিং পলিটেকনিক কলেজ চালু করা হয় সেই ১৯০৫ সালে, তারপর আরো আধুনিক উচ্চশিক্ষার জন্যে ধানবাদে ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইন্স্ চালু হয় ১৯২৬ সালে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে সিন্দ্রিকে ঘিরে যে ঔদ্যোগিক কর্মকাণ্ডের শুরু হয় তাতে উচ্চশিক্ষিত কর্মীদের চাহিদা মেটাতে ১৯৪৯ সালে বিহার সরকার সিন্দ্রিতে স্থাপন করে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ বিহার ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজি, ১৯৫৩ সাল থেকে মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, সিভিল, কেমিক্যাল, মেটালার্জিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক্স, প্রডাকশন আর মাইনিং- এই বিভাগগুলোতে পাশ করে ইঞ্জিনীয়ার হয়ে বেরিয়ে আসে একের পর এক মেধাবী ছাত্রেরা। তারপর ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্য তৈরি হলে এই কলেজের নাম বদলে রাখা হয় বিরসা ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজি- আদতে কিন্তু সেই বি আই টি-ই থাকে।'
- এই বি আই টির স্টুডেন্টরা সবাই কি ভাল ছিল লেখাপড়ায়? তবে ওরা তো সিন্দ্রির বাসিন্দা নয়, তাই না দাদু?
'দ্যাখ দিদিভাই, তখন গোটা বিহারে দুটি মাত্র টেকনিক্যাল কলেজ- পাটনা আর সিন্দ্রিতে, পরে হয় মুজঃফরপুর, ভাগলপুর আর জামশেদপুরে। তবু সিন্দ্রির বি আই টি ছিল সেরা। উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন না পেলে সেখানে ভর্তি হওয়াই যেত না। তাহলে ওরা ভাল ছাত্র ছিল না সবাই?
'আর ছাত্রেরা সবাই বাইরের ছিল না। সিন্দ্রিতেও অনেক মেধাবী ছাত্র ছিল যারা শুধু BITই নয়, IIT, ISM, AIIMS, IISc বা IIM-এর মত প্রাইম শিক্ষাসংস্থাগুলোতে পড়তে সুযোগ পেত নিজের ক্ষমতায়। সিন্দ্রির রাজেন্দ্র স্কুলের শিক্ষক উমানাথ ঝায়ের ছেলে সুধাকর হায়ার সেকেন্ডারিতে বিহারে সিক্সথ হয়। অমর দত্তের দুই ছেলে, কেতকী মণ্ডল আর তার ভাই প্রমথ একে একে খড়গপুরে ঢোকে, কেতকী বিহারে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছিল। মিঃ জেঠানন্দানির ছেলের সিনিয়ার কেম্ব্রিজে ফোর পয়েন্টের রেকর্ড বহুদিন কেউ ভাঙতে পারেনি।'
- আচ্ছা দাদু, তখন এনট্রান্স পরীক্ষা হত না?
'ইঞ্জিনীয়ারিংএর জয়েন্ট বোধহয় শুরু হয় ৭২ সালে। হ্যাঁ, আরেকটা রেকর্ড- এই সিন্দ্রিরই সমীর মুখার্জি ৭৬-এর জয়েন্টে বিহারে প্রথম হয়, এটা একটা অ্যাচীভমেন্ট! আরো অনেকেই অনেক ভাল রেজাল্ট করে সিন্দ্রির নাম উজ্জ্বল করেছে, সবার কথা আমার মনে নেই। তবে এ সবকিছু ছাড়িয়ে সিন্দ্রি যাদেরকে মনে রাখবে চিরকাল, যাদের নিয়ে গর্ব করবে, এমন কিছু মানুষের কথা কাল তোমাদের শোনাব, কেমন?
- আর সিন্দ্রির ইউ-এস-পিও শুনব, কেমন?
'সেটা এক কথায় হবার নয়। কাল বরং আমরা আলোচনা করব রামলীলা আর রাবণ পোড়ানো নিয়ে।'
(১৬)
আজ থেকে দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হয়েছে। করোনা-ভাইরাসের প্রকোপ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (W.H.O) বিশ্ববাসীকে কয়েক সপ্তাহ ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে যাতে রোগ-জীবানু ছড়াতে না পারে। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নির্দেশে জরুরী পরিষেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ, অহেতুক কেউ বাড়ির বাইরে বেরোবে না। সুতরাং, স্কুল কলেজ, পানুবাবুর কোচিং ক্লাস সব বন্ধ। অগত্যা সময় কাটাতে মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি সবাইকে নিয়ে বসেছেন তিনি, পুরনো স্মৃতি রোমন্থন চলছে।
'বুঝলে দিদিভাই, লক-ডাউনের শুরুতে নার্ভাস হয়ে অনেক পুরনো বন্ধুরা কাল ফোন করেছিল। ওদের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক কথা মনে পড়ে গেল। একজন মনে করিয়ে দিলেন সিন্দ্রির প্রথম বাসের নাম সিলভার কুইন, সিন্দ্রি রিভারসাইড থেকে ছাড়তো। তার পর আসে ডাক বাস, যার পেছনদিকে একটা ডাকবাক্স ঝোলানো থাকত। আরো কয়েকটি বাস ছিল। রাজমুকুট, বিহার ট্রান্সপোট, লালবাস, ওরফে দেশলাইবাক্স, সামনে নাক একটি লোহার হেন্ডেল দিয়ে মোচড় দিয়ে স্টার্ট হত। বাস স্ট্যান্ড ছিল কল্পনা টকিজ এর সামনে গোলচক্করে। সামনে দুটো বিখ্যাত মিষ্টির দোকান, উল্টোদিকে রিকশা-আড্ডা। সে যুগের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা ছিল। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে বাস থেকে নেমেই বাঁকুড়া মিষ্টান্ন ভান্ডারে সেরখানেক রসগোল্লা বা সিন্দ্রির বিখ্যাত কলাকান্দ কিনে হাতে ঝুলিয়ে রিকশায় চেপে বসতেন- চলো রাঙামাটি চাটুজ্যে-মাস্টারের বাড়ি। রিকশাওলার জন্যে এটুকু বললেই যথেষ্ট ছিল। স্কুলের টিচার, ডাক্তার, পুরোন লোকদের বাসা থাকত সবার নখদর্পণে।
'তবে আজ তো ঠিক করেছি সিন্দ্রির USP বা Unique Selling Proposition সম্বন্ধে আলোচনা করব। ঠিক কী নিয়ে আমরা সিন্দ্রিবাসী হিসেবে গর্ববোধ করতে পারি!'
- বাবা, সেলিং কথাটা কি ঠিক হল এক্ষেত্রে? আমরা কি মূল্যবোধ বিক্রি করতে পারি?- শরদিন্দু বলেন।'
'বলছ! তাহলে এটাকে UVP বলা যাক, Unique Value Proposition। যদিও তার আগে কতকগুলো বৈচিত্র্যের কথা বলতে হবে, দাদুভাইদের কথা দিয়েছি। হ্যাঁ, সিন্দ্রির মানুষজনের ধর্মপালন আর উপাসনার জন্যে চারটি সৌধ বহুকাল আগেই তৈরি হয়, সবকটি সহরপুরাতেই। মেন রোডের উপর দুটি চার্চ, বাজারের পাশে শিবমন্দির আর গুরুদ্বারা, এসিসির পাশের রাস্তায় মসজিদ। তা সত্বেও ভারতীয়দের বারো মাসে তেরো পার্বন, বেশিরভাগই কোন মাঠে মারাপ বেঁধে, সাজিয়ে-গুছিয়ে করা হত, যেমন দুর্গা-কালী-সরস্বতী আর বিশ্বকর্মা পুজো। আমাদের সময়ে ৩১শে ভাদ্র দিনটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেদিন সার-কারখানার গেট খোলা হত সর্বসাধারণের জন্যে, প্রতি প্ল্যান্টে, ওয়ার্কশপ আর টেকনিক্যাল অফিসে হত বিশ্বকর্মা পুজো। সেযুগে সাজসজ্জার এমন অভিনব সম্ভার শুধু ছোট ছেলেমেয়ে নয়, বড়দেরও মুগ্ধ করত।
'বিশ্বকর্মা পূজোর সময় কারখানার গেটের ভিতর ঢুকতেই একটা অজানা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হত। বিরাট বিরাট বিদঘুটে যন্ত্র, দৈত্যাকার বয়লার, চিমনি, সাইলো আর বাগ-ব্লোয়ারগুলো, বিশেষ করে বিশাল অ্যামোনিয়া-ভর্তি গোলক দু'খানা, অদ্ভুত সব যান্ত্রিক শব্দ, বিশাল আকারের ওভারহেড পাইপলাইন আর কনভেয়ার বেল্টগুলো, বিচিত্র একটা অদেখা পরিবেশ, আর চারপাশে রোমাঞ্চকর উদ্ভট যত রাসায়নিকের গন্ধ ... হতবাক্ হয়ে সেই বয়সে কেবল ওগুলোই দেখতে থাকতাম আর মাঝে মাঝেই বাবাকে প্রশ্ন করে উত্যক্ত করতাম। পরের অন্যতম আকর্ষনটা ছিল বিভিন্ন পূজো স্থলে যন্ত্র পরিচালিত নানান ধরনের ঘটনা ও দৃশ্যের প্রদর্শন! সম্পূর্ণ অটোমেটিক যন্ত্রের কারুকার্যে সেই সব ঘটনা গুলো দেখানো হতো৷ গ্যাস প্ল্যান্টের বিখ্যাত ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল পুতুল-নাচ ছিলই, সেফটি আর ইলেকট্রিক্যাল সেকশনের পুজো মানেই মজার কিছু ইনোভেটিভ সাজসজ্জা থাকবেই। যন্ত্রের শ্রমিক বয়লারে কয়লা ঢালছে, নেহাইয়ে লোহা পিটছে, যন্ত্রের মেয়েরা বিশ্বকর্মার মূর্তিকে দু'পাশ থেকে হাওয়া করছে- আরো কত কী! প্রসাদ-ভোগের আকর্ষণও কম ছিল না। বাবার প্ল্যান্টে গেলেই তো যত পার তত খাও, চাইতেও হত না। আর গেটের বাইরে বেরিয়েই মেলা- বাঁশি, বেলুন কিনে কাগজের চরকি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ি ফেরা।'
'তারপর আসত দুর্গাপুজো। আমরা একটু বড় হতেই তো রামকৃষ্ণ আশ্রমের পুজোর সঙ্গেই দিনরাত লেগে থাকতাম। সারা রাত্রি জেগে সন্ধিপূজা আর নবমীর খিচুড়ি প্রসাদের স্বাদই ছিল অতুলনীয়। সে সময় সিন্দ্রিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় কুড়িখানা পুজো হত। রাঙামাটি, এসিসি, মাতৃপূজা, জয়হিন্দ, পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, সেন্ট্রাল, ভ্রাতৃসঙ্ঘ, পোস্ট-অফিস, মনোহরটাঁড়, ডোমগড়ে তিনটে, বি আই টি কলোনি আরো বোধহয় ছিল দু-একটা। ডেকোরেশন বা জাঁকজমক হয়ত তেমন কিছু আহামরি ছিল না, তবে ভাইবোন বা বন্ধুরা মিলে ঘুরে ঘুরে পুজো দেখার মজাই আলাদা ছিল। আর ছিল ট্রাকে করে নাচতে নাচতে মূর্তি-গড়ার একমাত্র কারিগর শিবমঙ্গলের বাসা ছাড়িয়ে জি এম পুকুরে বিসর্জনের পর্ব।'
- আচ্ছা বাবা, জি-এম পুকুরেই কেন হত?
' আসলে ওটাই সিন্দ্রির প্রথম বারোয়ারি পুকুর। কলোনীর গোড়ার দিকে ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার মুখার্জি ছট-বিসর্জন ইত্যাদি ধার্মিক প্রয়োজনে ওটা তৈরি করান। তারপর কৃষ্ণ চন্দ্র শর্মার আমলে হয় সিন্দ্রি লেক আর সবশেষে রজত ঘোষ সাতটা লেক খুঁড়ে তৈরি করেন মনোরম প্রিয়দর্শিনী পার্ক। এই সেদিন পর্যন্ত ওখানে আমরা ছুটির সকালে গিয়ে সাঁতার কেটেছি, শীতকালে পিকনিক করেছি।'
- আর রাবণ জ্বালানো? অর্ঘ্য ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কুতূহলী।
'হ্যাঁ দাদুভাই, সেকথাতেই তো আসছি। সহরপুরা শিবমন্দিরের মাঠে পুজোর আগে থেকে শুরু হত কাঠ আর কার্ডবোর্ড দিয়ে প্রায় ষাট ফুট উঁচু বিশাল দশমাথা রাবণের মূর্তি, যার পেট ভর্তি থাকত বাজি-পটকা, হাউই আর তুবড়ি। বিসর্জনের ঠিক আগেটাতে আমাদের ট্রাক জায়গা দেখে পার্ক করত যাতে আমরা সবাই দেখতে পাই কিভাবে একজন রাম সেজে অগ্নিবাণ ছুঁড়ে রাবণের মুখে আগুন লাগাত। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাবণের শরীর দাউদাউ করে জ্বলে উঠত আর দুমদাম বাজি ফাটতে থাকত তার ভেতর থেকে আগুন লেগে। সেদিন মন্দিরের ভেতরে-বাইরে ভীড় হত দেখবার মত। শুধু সিন্দ্রি নয় আসপাশের আরো অন্ততঃ কুড়ি-পঁচিশটা গ্রামের লোক জমায়েত হত এই অবাক কাণ্ড দেখার জন্যে। এ জিনিষ তো সর্বত্র হয় না!
- কী মজা! ছোট্ট নাতি হাততালি দিয়ে ওঠে। আমরাও যাব তাহলে এ বছর।
- দ্যাখ এ বার পুজো হয় নাকি! অম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, করোনা থাবা সরালে তো!
ঘরের আবহাওয়া একমুহূর্তে আনন্দ-উচ্ছল থেকে থমথমে হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সবাই শুতে চলে যায়।
(১৭)
দুটো দিন লাগল সকলের শান্ত-সুস্থির হতে। কিছু হয়ত হবেনা জেনেও প্রধানমন্ত্রীর সম্মান রাখতে তাঁর নির্দেশ মেনে কাঁসর-ঘন্টা বাজাল একদিন সবাই। একটা ফল হল তাতে, পরিবার আবার একত্র হয়ে আলোচনায় বসল। এরকম আপাতকালীন ঘটনা সেকালের সিন্দ্রিতে ঘটলে কী করা হত, কেমনভাবে লোকে প্রতিক্রিয়া দেখাত, সেটাই আলোচ্য বিষয়। পানুবাবু স্মৃতিচারণে সিন্দ্রির পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে টেনে আনলেন।
'বিংশ শতকের চারের দশকে সিন্দ্রি আর তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল সত্তর ভাগ বাঙালি আর বাকি কুর্মি আর সাঁওতাল, মুণ্ডা আর কিছু ওঁরাও অধ্যুষিত জঙ্গল ঘেরা এলাকা, বন্যজন্তুরও অভাব ছিল না। ভৌগোলিক ভাবে ১৯১২ সালে লর্ড কার্জন মানভূম জেলাকে অবিভক্ত বাংলা থেকে ভাষাভিত্তিক বিভাজন করে বিহার-উড়িষ্যা নামের নতুন রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন, যদিও এ জেলায় বিহারি কম ছিল, মাত্র ১৩%, আর উড়িয়া প্রায় শূন্য। তারপরে শুরু হয়ে গেল মানভূমের ভাষা আন্দোলন- তবে সে প্রসঙ্গ আলাদা। এই সিন্দ্রির উত্তর-পশ্চিমে তখন ঝরিয়াকে ঘিরে বিশাল কয়লাখনি অঞ্চল, ভারতবর্ষের মধ্যে উন্নত শ্রেণীর বিটুমিনাস মেটালার্জিক্যাল কোকিং কোলের সর্ববৃহৎ ভাণ্ডার। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চাপে পড়ে তখন ইংরেজরা এদেশের আর্থিক উন্নতির জন্যে কিছুটা নড়ে-চড়ে বসেছে, তাছাড়া প্রদেশগুলোতে শুরু হয়েছে স্বায়ত্ত শাসন বা আংশিক স্বরাজ। দুর্ভিক্ষের মার ঠেকাতে তাই ঠিক করা হল বেশি ফসল ফলাতে হলে এই খনি অঞ্চলে একটা বড় রাসায়নিক সারের কারখানা চালু করতে হবে। সেই মতে জি-এস গোইং, জে রিগ আর টি-এইচ রিলে- এই তিনজনের একটা টেকনিক্যাল মিশন বসল। ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে জিপসাম আর কয়লা দিয়ে সাড়ে তিন লক্ষ টন প্রতি বছরে উৎপাদনের লক্ষ্যে দামোদর নদের তীরে এশিয়ার সর্ববৃহৎ সারের কারখানার প্রস্তাব রাখা হল। পরের বছর ব্রিগেডিয়ার এম এইচ কক্সের নেতৃত্বে Sindri Fertilizers and Chemicals Limited নামে কোম্পানি চালু হয়ে ১৯৫১র ডিসেম্বরে স্বাধীন ভারৎ সরকারের অধীনে প্রথম সরকারী সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল।
'বুঝতেই পারছ, অনেক আদিবাসী আর স্থানীয় বাসিন্দাদের অপসারণ আর পুনর্বাসন দিতে হয়েছিল সে সময় সরকারকে। অধিগ্রহণ করা হল সিন্দ্রি বস্তি, ডোমগড়, রাঙামাটি, সহরপুরা, মনোহরটাঁড়, রোড়াবাঁধ, গোশালা- এই অঞ্চলগুলো, চারপাশে ঘিরে থাকল ঘড়বড়, বালিয়াপুর, রাজাবস্তি, রক্ষিতপুর, কান্ড্রা, চাসনালা, পরশবানিয়া, টিকোরা, সামলাপুর, আসনবনি, ছাতাবান্ধ, নিমটাঁড়- নামে প্রচুর গ্রাম। তা এরকম তো হয়েই থাকে! সিন্দ্রির মেকিং-এ কিন্তু একটা তফাৎ লক্ষ্য করবে- গ্রামগুলো কিন্তু সিন্দ্রির সঙ্গে কোন বিরোধিতায় নামে নি, অথচ সিন্দ্রি সেসব মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে মিশে গেছে। বিশ্বকর্মা পুজো, দুর্গাপূজা, রামলীলা, যাত্রানুষ্ঠান, রাবণ-পোড়ান, বিভিন্ন মেলায় চারপাশের গ্রামবাসীরা এসেছে, উপভোগ করেছে, প্রয়োজনে স্বতঃস্ফুর্ত সাহায্য করেছে। সিন্দ্রি নিয়ে বরং তারা গর্ব করেছে। এমনটা কিন্তু ভারতের খুব কম জায়গায় হয়েছে। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আর নর্মদা জলাধার নিয়ে তো সরকারই বদল হয়ে গেল। ছত্রিশগড় আর উড়িষ্যায় পুনর্বাসন নিয়ে কত না রাজনীতি! পরবর্তী সময়ে সিন্দ্রির ডেমোগ্রাফি দেখ। বাঙালি-বিহারি-আদিবাসী তো ছিলই, সরকারি সংস্থা বলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামী-দামী লোকেরা সার কারখানা, পি অ্যান্ড ডি আর এসিসিতে কাজ করতে এলেন। বিহার ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজি রাজ্য সরকারের হলেও কোন আপস করা হয়নি। প্রথম নির্দেশক প্রফেসার দত্তাত্রেয় দেশপাণ্ডে ছিলেন মহারাষ্ট্রের মানুষ, তাঁর আমন্ত্রণে বিহার ছাড়াও বাংলা, উড়িষ্যা, অন্ধ্র, তামিলনাডু, পঞ্জাব থেকে প্রফেসাররা এসেছেন, নন-টিচিং স্টাফদের মধ্যেও অন্য রাজ্যের লোক যথেষ্ট ছিল। এই মানুষরা কিন্তু সিন্দ্রিতে এসে আর বাঙালি-বিহারি-ম্যাড্রাসি-পাঞ্জাবি থাকেননি, যেন এক মেল্টিং পটে মিশ্রিত হয়ে গড়ে উঠে তৈরি করেছেন এক সর্বভারতীয় সংস্কৃতি- অথচ নিজের জাতির সংস্কৃতি, ভাষার চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। এই একটা কারণে সিন্দ্রিবাসী ভারতের কোন প্রান্তকেই কখনও বিদেশ-বিভুঁই বলে মনে করেনি, রবীন্দ্রনাথকে সিন্দ্রির মানুষের জন্যে কখনও বলতে হয়নি-
'দেশ দেশান্তর মাঝে যার যেথা স্থান-
খুঁজিয়া লইতে দাও তাহার সন্ধান।'
বরং স্বাধীনতার পরে পরেই রবীন্দ্রনাথের 'এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে'র আদর্শে দামোদরতীরে গড়ে ওঠা এই নতুন তীর্থক্ষেত্র মহামিলনের পুণ্যভূমিই হয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এই নবপ্রতিষ্ঠিত উদ্যোগগুলোকে 'আধুনিক ভারতের মন্দির' নামে আখ্যায়িত করেছিলেন।'
দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে পানুবাবু থামলেন।
- তাহলে এসেন্স অফ সিন্দ্রি হল ভারতের প্রথম কসমোপলিটান বসতি? শরদিন্দু মন্তব্য করেন।
' প্রথম হয়ত নয়। এর আগে বোম্বাই শহর সর্বভারতীয় শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। দিল্লি আর কলকাতা কিছুটা। তবে এত অল্প পরিসরে এত বিভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতির সমাবেশ আর কোথাও ঘটেনি এর আগে, জামশেদপুর কিছুটা বাদ দিলে। এই ছোট শহরে সবাই পাশাপাশি থেকেছে, বাঙালিপাড়া, পাঞ্জাবিপাড়া বা তামিলপাড়া হিসেবে কোন এলাকাভিত্তিক বিভাজন হয়নি। আমরা সবাই হিন্দি শিখেছি, কিছুটা উড়িয়া, মারাঠি আর পাঞ্জাবিও। আমার তামিল আর গুজরাটি প্রতিবেশিরা বাংলা বলে মাতৃভাষার মত, মালয়ালী বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলে গড়গড় করে। আবার বাঙালি মেয়ের ভরতনাট্যম শিখতে বা বিহারি ছেলেদের শিখ বন্ধুর বিয়েতে ভাঙড়া নাচতে অসুবিধা হয়না। ধর্মাচরণ ছিল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে কোন উন্মাদনা ছিল না। তাল কাটতে একবারই দেখেছিলাম ৮৪ সালে ইন্দিরা-হত্যার পর, তবে সেটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা, কোন স্থায়ী দাগ রেখে যায় নি সিন্দ্রির মানুষের মনে।'
- আর কিছু নয়, বাবা? তাহলে সিন্দ্রির টানটা কি শুধু নস্টালজিয়া- যেটা সবারই ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে হয়? অম্বা এত সহজে বাবার কথা মেনে নিতে পারে না।
'না মা, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। শুধুমাত্র মেল্টিং পট বা কসমো বলে সিন্দ্রিকে বোঝনো যাবে না, তাহলে পরবর্তীকালে দুর্গাপুর, কল্যাণী, হলদিয়া, বরৌনী, তালচের বা বোকারো সিন্দ্রি হয়ে উঠতে পারে নি কেন? এরাও তো একই কালচারে তৈরি সর্বভারতীয় টাউনশিপ! এটা বোঝাতে গেলে সিন্দ্রির কিছু শ্রদ্ধেয় মানুষের সম্বন্ধে বলতে হয়। প্রথমে আসি পিডিএল-এর ফিজিক্যাল রিসার্চ উয়িং-এর প্রধান ডাঃ প্রদীপ ঘোষের কথায়। না, তিনি কে বা কেন শ্রদ্ধেয় সে কথা পরে, তাঁর কাছে শোনা একটা গল্প শোনাই। এর মধ্যে কিছুটা বিজ্ঞানের অংশ আছে, শরৎ হয়ত সেটা বুঝবে।'
- দাদু, আমরা কিন্তু কিছুই বুঝছি না- কাতর গলায় বলে আস্থা।
'আজ তুমি বুঝবে না দিদিভাই। বড় হও, জীবন তোমাকে পরে সব বোঝার সুযোগ দেবে। তখন এসব কথা নিজের জীবনে কাজে লাগিয়ে তুমি একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে।
'এই ডাঃ প্রদীপ ঘোষ ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, আমার সেসময়ের ফ্রেন্ড না হলেও ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমি কাকু বলতাম, তিনিও খুব স্নেহ করতেন আমাকে। তিনি একবার একটা অফিসের কাজে দিল্লি চলেছেন, ফার্স্ট ক্লাসের ক্যুপেতে আলাপ হল গোমিয়ার ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভ লিমিটেডের আর-আন্ড-ডির প্রধানের সঙ্গে। কথাপ্রসঙ্গে বিজ্ঞানী ভদ্রলোক এক নতুন বিস্ফোরক জেল নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে একটা সমস্যার কথা বললেন- ভিসকোমিটারে ঘোরালে একসময় কোন এক আর-পি-এমে জেলেশন ভেঙে কলোয়েডের ফেজ বদলে যাচ্ছে, কিন্তু ঠিক কখন ওটা হচ্ছে তাঁরা কিছুতেই ধরতে পারছেন না। ঘোষকাকু তাঁকে পরামর্শ দিলেন ভিসকোমিটারের সার্কিটে জেলের মাঝে একটা লিকুইসোনিক সেন্সার লাগিয়ে দিতে। ওটা একটানা জেলের মাধ্যমে ধ্বনির বেগ মাপতে থাকবে। যে মুহূর্তে জেল ভাঙবে, গতিবেগের পরিবর্তন হবে, ঘুর্ণনের সঠিক আর-পি-এম আর ভিসকোসিটি জানা যাবে।
'তার পরের ঘটনা দু-মাস পরের। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি, দিল্লিযাত্রার একই কামরায় আবার দু'জনের দেখা। এবার বিজ্ঞানী ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত, ঘোষকাকুর সাজেশানে সাফল্য এসেছে। তিনি কাকুকে এবার আই-ই-এলে যোগ দেবার খোলা আমন্ত্রণ দিলেন। গোমিয়াতে একটা ফর্মাল ইন্টারভিউ হবে। সেখান থেকে ফিরে মাসখানেক পরে কাকু আমাকে একটা অফারের চিঠি দেখালেন। সিন্দ্রির ডাবল মাইনে, কোম্পানী গাড়িও দেবে। কিন্তু উনি গেলেন না।'
- কেন? এবার প্রশ্ন শরদিন্দুর।
'চাকরির একটা আবশ্যক শর্ত ছিল, পদমর্যাদায় ম্যাক্সিমাম একধাপ উপরে আর একধাপ নীচের লোকের সঙ্গেই সামাজিক মেলামেশা করা চলবে। তার বাইরে নয়। সিন্দ্রির খোলামেলা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার পর এই প্রস্তাব উনি মানতে পারেন নি। ডবল মাইনের চাকরি হেলায় ছেড়ে দিলেন!'
- নমস্য ব্যক্তি! শরদিন্দু দু-হাত জোড়া করে কপালে ঠেকালেন।
'আজ এই পর্যন্তই। এখন তো আর কাজে যাওয়া নেই, কাল ডাঃ পিকে ঘোষের করুণ জীবন আর সিন্দ্রির অন্য নমস্য ব্যক্তিদের কথা বলব।'
(১৮)
'ওই অঞ্চলে ঝরিয়া তখন অনেক প্রাচীন আর বিখ্যাত শহর। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঝরিয়ার রাজা দুর্গাপ্রসাদ সিংহের রমরমা, তাঁর ছেলে শিবপ্রসাদ সিংহও কোন অংশে কম যেতেন না। রাজা শিবপ্রসাদ প্রতিষ্ঠা করেন ঝরিয়ার বিখ্যাত রাজ (আর-এস-পি) কলেজ। এছাড়াও পিতা-পুত্র দু'জনেই ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের বড় পৃষ্ঠপোষক। তাঁর ম্যানেজার জগন্নাথ সিংহের ছোট মেয়ে গুড়িয়া কমলা ঝরিয়া নামে ভারতবিখ্যাত গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। উইলিয়াম কারের সঙ্গে জুটি বেঁধে কিছু কয়লা খনির অংশীদার তখন জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও হয়ত ছিলেন, নাতি রবীন্দ্রনাথ হয়ত তাই ঝরিয়াতে জিলিপির রেটের খোঁজ করেন('দামোদর শেঠ'- ছড়া)! রসিকতা থাক, এই সমৃদ্ধ শহরের পাশে ধানবাদ তখন একটা গ্রাম। ধানবাদ কথাটার অর্থ হল যে বাইদ জমিতে ধান চাষ করা হয়। বাংলার রাঢ় অঞ্চলে চাষের জমিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয় *, তার মধ্যে বাইদ হল মাঝারি মানের জমি যা গম বা আউষ-ধান চাষের উপযুক্ত। এটা মানভূমের স্থানীয় বাংলা শব্দ, কিন্তু ধানবাদকে বিহারের মানভূম জেলার মহকুমা শহর করার সময় এর হিন্দিকরণের উদ্দেশ্যে তার নতুন উচ্চারণ প্রবর্তন করা হয় 'ধনবাদ' মানে ধনের আবাদ বা বসতি। স্পষ্ট বোঝা যায় এটা বিভ্রান্তিকর বা অপপ্রয়োগ, কারণ ধন+আবাদ হয় ধনাবাদ, যেমন আমেদাবাদ, ইলাহাবাদ, তুঘলকাবাদ ইত্যাদি। যাকগে সে সব রাজনৈতিক চক্রান্তের গল্প, মোটমাট বাঙালিপ্রধান ধানবাদ আর পুরুলিয়া মিলে মানভূম জেলা চলে এল বিহারে।
'এখানে স্বাধীনতার পরবর্তী অধ্যায়ে সিন্দ্রির ব্যাপারে ডাঃ বিধান রায় বা নেহেরুর ভূমিকা কম, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বেশী। সার কারখানা আর কেন্দ্রের টাকায় তৈরি বিহার সরকারের অধীন বি-আই-টি কলেজে স্থানীয় ভূমিপুত্রদের সাথে সাথে সর্বভারতীয় প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, টেকনোক্র্যাট আর শিক্ষকদের সুযোগ দেওয়া মূলতঃ তাঁর প্রচেষ্টায়, অবশ্যই নেহেরুর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিনহা আর রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করে। পরে ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়া বাংলায় চলে যাওয়ার পর অবশ্য সিন্দ্রিতে বিহারের রাজনৈতিক প্রাধান্য বেড়েছে। একসময় উত্তর বিহার থেকে আগত বিহারিদের দাপটে ভূমিপুত্র বাঙালি আর মাহাতো-মাঝিদের অবস্থা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই স্থানীয় বাঙালি আর আদিবাসিদের মসীহারূপে আবির্ভূত হন এক আপাদমস্তক সৎ, নির্ভীক, নির্লোভ ও আপোষহীন মানুষ, কমরেড অরুণকুমার রায় (১৯৩০-২০১৯)। নিঃসন্দেহে তিনি সিন্দ্রির অন্যতম সেরা মানুষ যাঁর জন্যে এই শহর চিরকাল গর্বিত থাকবে। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রিতে এমএসসি করে তিনি সিন্দ্রিতে পিঅ্যান্ডডি (পরবর্তীকালে পিডিআইএল) তে কাজে যোগ দেন। কিন্তু জনদরদী এ কে রায় (এই নামেই তাঁর পরিচয়) স্থানীয় চাষী, দরিদ্র আদিবাসী, কারখানা আর খনি অঞ্চলের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধানবাদ অঞ্চলের কয়লাখনি শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। সরকারি চাকরিতে থেকে এধরণের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না, তাই তৎকালীন ডাইরেক্টার ক্ষিতিশ রঞ্জন চক্রবর্তীর পরামর্শে তিনি চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে রাজনীতিতে নেমে পড়েন। প্রথম জীবনে সিপিআইএম দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে তিনি নিজস্ব বামপন্থী দল এমসিসি (মার্ক্সিস্ট কোঅর্ডিনেশন কমিটি) গঠন করেন। বিহারের ধানবাদ আসন থেকে তিন-তিনবার জিতে (১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৯) তিনি লোকসভায় গেছেন। এর আগে আরও তিনবার (১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২) সিন্দ্রি আসন থেকে জিতে এমএলএ হিসেবে তিনি বিহার বিধানসভারও সদস্য হয়েছেন।
'এ কে রায়ের রাজনৈতিক জীবনের একটি প্রধান কীর্তি হল, পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জন্য আন্দোলন। তিনি লক্ষ্য করেন মানভূম ভেঙে ধানবাদ জেলা বিহারে ঢুকে পড়তেই এখানে উত্তর বিহার থেকে দলে দলে লোকজন আসতে শুরু করে। গয়া সিংহ, সূর্যদেব সিংহের মত বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক মদতপুষ্ট নেতারা কয়লা-মাফিয়াচক্র গড়ে তুলে নিরীহ আদিবাসী প্রধান গ্রামবাসী ও ভূমিপুত্র বাঙালিদের উপর অত্যাচার শুরু করেন। প্রতিবাদে রায় স্থানীয় বাঙালি ও জনজাতির লোকজনকে সংগঠিত করে এর প্রতিবাদ শুরু করেন। সিন্দ্রির ডোমগড় এলাকায় একটি বড়সড় খণ্ডযুদ্ধ হয়। তবে রায় চাইছিলেন বৃহত্তর অর্থে ছোটনাগপুর অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের স্বার্থরক্ষার একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই উদ্দেশ্যে আদিবাসী-প্রধান ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের জন্য তিনি জনজাতির নেতা শিবু সোরেন ও বিনোদ বিহারী মাহাতোর সঙ্গে মিলে ১৯৭১ সালে তীব্র আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। সেই আন্দোলন চূড়ান্ত সফলতা পায় প্রায় তিন দশক পরে, যখন ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর আলাদা রাজ্য হিসেবে ঝাড়খণ্ডের জন্ম হয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজের জন্যে কখনও কিছু চান নি, কোন সম্পত্তি অর্জন করেন নি। অকৃতদার এই 'রাজনৈতিক সন্ন্যাসী'র ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আমৃত্যু ছিল শূন্য। ১৯৮৯ সালে ভারতীয় সংসদের সদস্যদের বেতন-ভাতা বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর জন্য যখন বিল আনা হয়, তখন দেশের কয়েকশো এমপি-র মধ্যে একমাত্র এ কে রায় ওই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামী আনন্দ মাহাতোর কথায়, ‘এমপি-রা নিজেরাই নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নেবেন, এই প্রস্তাব তিনি কিছুতেই মানতে পারেননি। ওই ভূমিকার জন্য সারা দেশ তাঁকে তখন চিনেছিল।’ নেতা শব্দটির বৃহত্তর অর্থ যাই হোক, এ দেশে রাজনীতিতে আসা লোকের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে ক্ষমতা, অর্থ, সম্পত্তি আর জনতার আনুগত্য দখল করা। রায় কিন্তু আপোষহীনরূপে এ সবকিছুর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর কোন সতীর্থই এতটা নির্লোভ হতে পারেননি, তাই অসীম জনপ্রিয়তা পেয়েও মুখ্যতঃ সমর সেনের 'ফ্রন্টিয়ার' পত্রিকায় বর্তমান কম্যুনিস্ট পার্টির আত্মসমালোচনামূলক লেখার অপরাধে তিনি বিতাড়িত হয়েছেন দল থেকে, একঘরে হয়ে থেকেছেন তাঁর তৈরি দল এমসিসি, এমনকি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাতে- যখন কিনা তাঁর ভাবশিষ্য শিবু সোরেন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন! অবশ্য ১৯৯১ সাল থেকেই কার্যতঃ সোরেনের ক্ষমতালোভ তাঁকে দল থেকে একরকম বিচ্ছিন্নই করে দেয়।
'কমরেড একে রায় সম্বন্ধে লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সতীর্থরা লোভের সঙ্গে আপোষ করতে অক্ষম হয়ে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করলেও গরীব দুঃখী শ্রমিক মজুররা তাঁকে ঈশ্বরের সম্মান দিয়ে এসেছে চিরকাল, তিনি যে আজীবন তাদের অধিকার রক্ষার লড়াই করে গেছেন একটি ছোট ভাড়াটে ঘরে থেকে।'
- একে রায় সম্বন্ধে সত্যিই এত কথা জানতাম না বাবা, অম্বা বলে।
- তিনি তো '৭৭-এ জনতা দলের হয়ে লড়েও জিতেছিলেন, তাই না? - শরদিন্দু শুধোন।
'ঠিক বলেছ। তার আগে জ্যোতি বসুর হস্তক্ষেপে পলিটব্যুরো তাঁকে তাড়িয়েছে সিপিএম থেকে, এমসিসি ভেঙে গেছে পৃষ্ঠপোষকের অভাবে। ঝাড়খন্ডের অহির, ডোম, চামার, তেলি, কুর্মি, রাজোয়াড়, ঘটোয়াল, সাঁওতাল, মুণ্ডা আর ভূমিপুত্র বাঙালিদের এই প্রথম কোন নেতা বুঝতে চেয়েছিল, নিজের ভেবে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারপর তাঁর ছত্রছায়ায় একে একে যোগ দিতে থাকেন বিনোদ বিহারী মাহাতো, আনন্দ মাহাতো, শিবু সোরেন, নির্মল মাহাতো, কৃপাশঙ্কর চ্যাটার্জি, গুরুদাস চ্যাটার্জির মত কর্মী নেতারা। একটা সময় এসেছিল যখন ইন্দিরা গান্ধীর মত নেত্রী রায়ের আতঙ্কে ভুগতেন। ৭১-৭২এ একে রায় কংগ্রেসকে সমর্থন দেওয়া সত্বেও তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেননি, এমার্জেন্সির সময় অন্য বিরোধী নেতাদের সাথে তাঁকেও জেলে পুরেছিলেন। এই অবস্থায় তিনি নির্দলীয় হয়ে লড়লেন জনতা দলের সমর্থনে, বিপুল সংখ্যাধিক্যে জিতলেন। বলতে সংকোচ নেই, আমারও সে সময় তাঁর প্রচারের দলে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাঁর বাল্য-সুহৃদ অমিয় বাগচির লেখায় জেনেছি, ২০১৪ সালে তাঁর ছোট্ট বাড়িতে চুরি হয়, চোর তাঁর হাতঘড়ি আর তাঁর একমাত্র সঞ্চয় ২৬০০ টাকা নিয়ে পালায়। তিনি হেসে বলেন, যেতে দাও, চোরের হয়ত আমার চেয়েও বেশি টাকাটার প্রয়োজন ছিল। এমন মানুষের ব্যক্তিগত প্রয়োজন আর কতটুকু ছিল, যিনি নিজের পেনসনের টাকাটাও প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ ফান্ডে দান করে দিতেন!
'আমার মনে হয়েছিল সিন্দ্রি সম্বন্ধে জানতে গেলে এই ইতিহাসটা তোমাদের জানা উচিত ছিল। এবার বলব আরো কয়েকজনের কথা যাদের জন্যে সিন্দ্রিবাসী হিসেবে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।'
(১৯)
'আজ আমি যাঁদের কথা বলব ভাবছি তাঁদের জন্মও সিন্দ্রিতে হয়নি, তবে তাঁদের অবদান সিন্দ্রি নিশ্চয় মনে রাখবে। আচ্ছা অম্বা, তোর মনে আছে, সিন্দ্রিতে কোন রাস্তার দু'পাশে কী কী গাছ ছিল?'
- গাছ বলতে কদম, ছাতিম আর কৃষ্ণচূড়া, কিছু রাধাচূড়া মনে পড়ছে- কিন্তু কোন রাস্তার পাশে কী ছিল অত মনে নেই।
'সিন্দ্রির রাস্তায় কিন্তু শুরুতে এমনভাবে প্ল্যান করে গাছ লাগানো হয়েছিল যে ফুল ফুটলে চোখ-বাঁধা অবস্থায় বেশ বলা যেত কোন রাস্তায় আছি। সহরপুরা সার্কেল থেকে রোড়াবাঁধের দিকে যেতে প্রথমেই পড়ত কদম গাছ, 'এস নীপবনে, ছায়াবীথিতলে' বলে পথিককে ডাকাডাকি করত। তারপর ছিল হর্টিকালচার গার্ডেন বা নার্সারি- ফুলের বীজ আর চাষের হাতেকলমে পরীক্ষাগার। ধরণী মুখুজ্যে দেখাশুনা করতেন আর পুরুলিয়ার উকি মাঝির মত কিছু মালি উদয়াস্ত খেটে শহরটাকে রঙীন রাখার উদ্যমে মেতে থাকত। এখান থেকে ডানদিকে ঘুরে ছিল রাধাচূড়া আর সোজা নর্থ হোস্টেল পর্যন্ত ছাতিম গাছের শ্রেণী। সহরপুরা আর সিন্দ্রি ক্লাবের রাস্তায় বোধহয় ছিল গুলমোহর। বর্ষার শেষ থেকে বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা গন্ধে আমোদিত করে রাখত।'
- বাবা কি কবিতা-টবিতা লিখতেন এককালে- শরৎ মজা করে বললেন।
- তুমি চুপ কর তো! বাবা, এত কী করে মনে থাকে?
'নারে মা, সব মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে, রোড়াবাঁধ সার্কল থেকে ফ্যাক্টরি-গেট আর পোস্টাফিসের ডাইনে বরাবর ছিল শুধু কৃষ্ণচূড়ার সারি। টাউন প্ল্যানিং-এর এই ভাবনাটা কার জানিস?'
- লে কার্বুসিয়ের? আস্থা শুধোল।
' দূর বোকা, সিন্দ্রি কি চন্ডীগড়?' হেসে ফেললেন পানুবাবু। 'এগুলো ছিল সার কারখানার প্রথম ভারতীয় জেনারেল ম্যানেজার বি সি মুখার্জির আইডিয়া। ভাবতে পারিস, সালফেট আর ইউরিয়া উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে সমান তালে কলোনির পরিবেশরক্ষা আর সৌন্দর্যায়ন নিয়ে কত ভেবেছিলেন তিনি! সুখের কথা যে বি আই টির প্রথম নির্দেশক ডাঃ দেশপান্ডেও এভাবেই কলেজটাকেও সাজিয়েছিলেন। এর সঙ্গে এসিসিও সাযুজ্য রেখে গেছে।'
- ঠিক বলেছ দাদু, অর্ঘ্য বলে ওঠে। আমি আর দিদি গুগল আর্থে সিন্দ্রির ম্যাপ দেখছিলাম। শহর তো নয়, জঙ্গল মনে হচ্ছে। গাছপালার আড়ালে বাড়ি-ঘর রাস্তাঘাট কিছুই দেখা যায় না প্রায়।
ওর বলার ধরণে সবাই হেসে ওঠে, কিন্তু কথাটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
'সিন্দ্রি ফার্টিলাইজার কারখানার স্থাপনা আর কাজকর্ম নিয়ে বিসি মুখার্জির অবদান প্রায় প্রত্যেকেই জানে, যদিও ইন্টারনেট নীরব এ ব্যাপারে। ব্রিগেডিয়ার কক্স প্রথম জেনারেল ম্যানেজার হলেও, প্রডাকশন শুরু হতেই বেটন চলে আসে সে যুগের আই-সি-এস অফিসার মুখার্জিসাহেবের হাতে। কারখানার প্ল্যানিংএ ওঁর তেমন হাত না থাকলেও, টাউন প্ল্যান শুরু হয়েছিল ওঁর হাতে। হাসপাতাল, অফিশার্স ক্লাব, কল্যান কেন্দ্র, নার্সারি, স্কুল থেকে শুরু করে হাট-বাজার-মন্দির-পুকুর সব কিছুর নির্মাণেই ওঁর অবদান আছে। এছাড়া ওঁর একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল কাজের লোক চেনার আর তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করার। স্থানীয় আদিবাসীদের পরিশ্রম করার ক্ষমতার আন্দাজ তাঁর ছিল, প্রচুর স্থানীয় মানুষকে কাজে ঢুকিয়েছিলেন। দৈহিক পরিশ্রমে কুর্মি-সাঁওতাল আর বাউরিদের ক্ষমতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তবে মানভূমে মাটি খোঁড়ার লোক, মালী, ঘরামি, মিস্ত্রি পাওয়া গেলেও, ভাল গোয়ালা, ধোপা, নাপিত পাওয়া যেত না, এই শ্রেণীর লোকদেরকে কোম্পানিতে ঢোকাতে না পারলেও উত্তর বিহার থেকে আনিয়ে থাকার জায়গা দিয়েছিলেন।
'এই ম্যানপাওয়ার হান্ট আর রিক্রুটমেন্টের ব্যাপারে আর একজন মুখার্জির নাম না করলে অন্যায় হবে, তিনি এসএফসিএলের ম্যানেজিং ডিরেকটর সুবোধ মুখার্জি। তিনি ছেলেছোকরাদের কর্মক্ষমতা আর প্রতিভা বুঝতেন। তাই ইয়ং ট্যালেন্ট খুঁজে-পেতে তাদের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা আর দক্ষ মানুষদের প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করে তাদের প্লেসমেন্ট, প্রমোশন আর যখন যেখানে নতুন কারখানা চালু হয় পরে- যেমন বরৌনী, গোরখপুর, ট্রম্বে, নাঙ্গলে তাদের পাঠানো, এসব তাঁর অবদান ছিল। ফ্যাক্টরির ট্রেনিং সেন্টারে থিওরি আর হাতেকলমে ট্রেনিং দুইএর সন্তুলিত ব্যবস্থা, কেরিয়ারিস্টদের জন্যে ইন্সটিট্যুট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সঙ্গে AMIE কোর্সের ব্যবস্থা, ট্রেনীদের থাকার হোস্টেল- এ সবের পেছনে ছিল তাঁর মাথা। পরবর্তীকালে কেসি শর্মা, আরকে ঘোষ, চৌরে আর কোহলি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাফল্য পান।'
- বাবা, চক্রবর্তী সাহেবের খুব নাম শুনেছিলাম। তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলবে না?
'কে আর মানে ডাঃ ক্ষিতীশ রঞ্জন চক্রবর্তীর সম্বন্ধে না বললে তো সিন্দ্রির গল্প শুরুই হয় না। ৩৫-৩৬ বছর বয়সের একজন দক্ষ তরুণ ডক্টরেট ইঞ্জিনীয়ার তাঁর মেধা, অসামান্য প্রতিভা, ধীশক্তি, অফুরন্ত উৎসাহ আর পরিশ্রম দিয়ে কিভাবে সিন্দ্রির কারখানায় সার উৎপাদনের সম্বন্ধে গবেষণা আর উন্নতির পরামর্শের উদ্দেশ্যে, ফার্টিলাইজার প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট- সংক্ষেপে পি-অ্যান্ড ডি (হিন্দিতে যোজনা এবং বিকাশ) নামে সংস্থার প্রতিষ্ঠা আর অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাকে দক্ষতার সাথে ম্যানেজার হিসেবে পরিচালনা করে সিন্দ্রিতে অ্যামোনিয়াম সালফেট সারের উৎপাদন শুরু করিয়ে দেন। প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর আসার কথা ছিল মার্চ ১৯৫২তে, তার আগে '৫১র অক্টোবরেই উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। সিন্দ্রি কারখানার স্থাপনার কর্ণধার যদি ব্রিঃ কক্স আর বিসি মুখার্জি হন, সফল অ্যামোনিয়া সংযোগ, প্রক্রিয়ার জন্যে ক্যাটালিস্টের ডিজাইন, ইউরিয়া আর ডাবল সল্টের রূপরেখা তৈরি ছাড়াও মাটির গুণবত্তা অনুসারে সারের গঠন আর প্রয়োগের জন্যে প্রযুক্তিমূলক ফার্মিং- এই সব কিছুর রূপকার তিনি। এই কাজের স্বীকৃতি আসে ১৯৫৪ সালে পদ্মশ্রী উপাধিপ্রাপ্তির মাধ্যমে- শুধু সিন্দ্রিরই প্রথম নয় সারা ভারতে সেটা ছিল এই পুরস্কারের প্রথম বছর, ১৭ জন পদ্মশ্রী প্রাপকের তালিকায় ছিল তাঁর নাম।
'চক্রবর্তী সম্বন্ধে যদি অন্য কোথাও কিছু নাও লেখা থাকে সাহিত্যিক শংকরের উপন্যাস 'আশা-আকাঙ্খা'র নোয়েল দিগম্বর বোনার্জির চরিত্রটা পড়লেই ভাল বোঝা যাবে। ভারতবর্ষের সবুজ বিপ্লবের কর্ণধার তিনি, দেশকে সারের উৎপাদনে স্বনির্ভর করার ক্ষেত্রে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। তিনি দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে গবেষণামূলক বই লেখেন- Science Based on Symmetry আর Energy Field of the Universe and Atom। অ্যাসিড-স্লাজ থেকে আয়ন বিনিময় পদ্ধতির উপর তাঁর একটি পেটেন্টও নেওয়া আছে। পরে তাঁকে ভারত সরকারের প্রযুক্তি উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয় আর ১৯৬৮ সালে CSIR থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদের সেরা সম্মান শান্তিস্বরূপ ভটনাগর পুরস্কার পান। পুরস্কারের জন্যে সাইটেশনে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, আগ্রহ থাকলে লিঙ্ক দিচ্ছি, তোমরা দেখে নিও। http://ssbprize.gov.in/content/Detail.aspx?AID=280 '
(২০)
'সম্ভবতঃ সেটা ১৯৮৪-৮৫ কিম্বা তার কিছু আগের ঘটনা। সিন্দ্রির নিস্তরঙ্গ দিনলিপিতে হঠাৎ ঢেউ তুলল একটা দুরন্ত খবর, সিন্দ্রি আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শুঁড়িখানাগুলোতে দেশী মদে বিষক্রিয়ার ফলে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ দলে দলে অসুস্থ হয়ে সহরপুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই মারা যেতে লাগল, কম লোকই বেঁচে ফিরছিল। গরীব দেশগুলোতে লোভী চোলাইকারীরা মিষ্টতা আর পরিমাণ বাড়াবার উদ্দেশ্যে দেশী ভাটিগুলোতে মদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সস্তাদামের মিথানল কিম্বা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মিশিয়ে থাকে। এতে খরচ কমে অথচ নেশা বেশি হয়, কিন্তু ৩০ মিলিলিটার বা তার বেশি মিথানল পেটে গেলে মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভাবী। ফলে অনেকেই মারা যাচ্ছিল। সেই সময় সিন্দ্রি হাসপাতালের নতুন সার্জন ডাঃ ঘোষ ছুটিতে ছিলেন। ঘটনার দ্বিতীয় দিন তিনি ফিরেই সব শুনে ছুটে এলেন হাসপাতালে। এসে কী করলেন? মেডিক্যাল সায়েন্সের খুঁটিনাটি বিশেষ জানি না। তবে এটা জানি যে ডাঃ ঘোষ চিকিৎসা শুরু করার পর আর একটি মানুষও মরে নি।
'কে এই ডাঃ ঘোষ? কিভাবে তিনি সিন্দ্রিতে এলেন, মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। দেখ মা, ওঁর সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। বিলেত থেকে এফ-আর-সি-এস করে আইরিশ বউ নিয়ে কেন তিনি এই সিন্দ্রিতে এসে ঢুকেছিলেন জানা দুঃসাধ্য, ্তবে সিন্দ্রির মানুষের অশেষ পুণ্যবলে আমরা তাঁকে কয়েক বছরের জন্যে হলেও পেয়েছিলাম। এই বিষ-মদ কাণ্ডের পর অনেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করে এর চিকিৎসার রহস্য, তিনি জবাবে বলেন, হাসপাতালের লাইব্রেরিতেই একটা লেটেস্ট মেডিক্যাল জার্নালে পড়েছিলেন এই চিকিৎসা-পদ্ধতি। হাসপাতালের লাইব্রেরি? অনেক ডাক্তারই অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন শুনে। বস্তুতঃ ডাঃ ঘোষ আসার আগে অনেকেই এই লাইব্রেরির অস্তিত্বের কথা জানতেনই না। জানলেও কার মাথাব্যথা আর কারই বা সময় আছে সেখানে গিয়ে বই পড়ার। কিন্তু ইনি সকাল থেকে রোগী দেখতেন সার্জিক্যালের ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে, বিকেলে থাকত সার্জারির আউট-ডোর মাঝে হাসপাতালের সাউথ গেটের কাছের দোকানে কিছু অখাদ্য চা-স্যান্ডউইচ-সিঙাড়া খেয়ে রাত্রি ন'টা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। নিকটস্থ আর-কে ওয়ানের বাসা থেকে মাঝে মাঝে রাত বারোটা-একটাতেও ওঁকে টহল দিতে দেখা গেছে।
'চারখানা ডিসপেন্সারি বা হেলথ সেন্টার ছাড়াও ২০৬ বেডসম্পন্ন সিন্দ্রি হাসপাতাল ছিল ওই অঞ্চলের এক বিস্ময়। সেকালের নিরিখে বেশ উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল সেখানে। আমাদের সময়ে ডাঃ আলহুওয়ালিয়া, অখৌরি, দ্বিবেদী, চক্রবর্তী, দাস, ঝা, এইচ এল সিনহা, ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জি, রায়, এনকে সিনহা, অ্যানেস্থেসিয়ান ঘোষ, মিস চৌধুরি, মিসেস গুপ্ত, মিসেস মজুমদার ইত্যাদি অনেক ভাল ডাক্তার সিন্দ্রির মানুষকে অসুখ-বিসুখে সুস্থ করে তুলেছেন, বল ভরসা জুগিয়েছেন। তবে ডাঃ ঘোষ যেন একটা অন্য কালচার নিয়ে এলেন আর তাঁর বিশিষ্ট জ্ঞান, সার্জারির স্কিল, নিঃস্বার্থ সেবা-ভাবনা আর ডেডিকেশন দিয়ে সিন্দ্রির জীবনযাত্রায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন। তাঁকে আমরা বেশি দিন রাখতে পারিনি, তবে সিন্দ্রি তাঁকে কখনও ভুলতে পারবে না, এফ-সি-আই হাসপাতাল বলতেই ডাঃ ঘোষের কথা মনে পড়তে বাধ্য।'
- আচ্ছা বাবা, উনি সিন্দ্রি ছেড়ে চলে গেলেন কেন? শুনেছি কারা নাকি পেছনে লেগেছিল!
'তা তো জানি না মা, তবে এর মধ্যে কোন স্বার্থান্বেষী দলের চক্রান্ত ছিল শুনেছি। অবশ্যই আসল খবর না জেনে আন্দাজে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে এটা ঠিক যে ওঁর মাপের মানুষকে এত ছোট পরিধির মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। জানিস, এত ব্যস্ততার মাঝেও ওঁরা স্বামী-স্ত্রী সাইকেল নিয়ে আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে লোকের স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতেন, দুস্থ গ্রামবাসীদের নিখরচায় চিকিৎসা করে বেড়াতেন!'
- আচ্ছা, ইনি তাহলে অন্য লোক, আপনি যেন সেদিন আরেক ডাঃ ঘোষের কথা বলছিলেন, করুণ জীবন বলে?
'হ্যাঁ, তাঁর কথাও বলা প্রয়োজন বলে মনে করি, কারণ সততার মূল্য সিন্দ্রিতে এভাবে আর কেউ চুকিয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাঁর নাম ছিল বিজ্ঞানী প্রদীপ কুমার ঘোষ, এম এস সি, পি এইচ ডি। উনি তখন ম্যানেজার, পিডিআইএলের ফিজিক্যাল রিসার্চ উইং (PRW) এর প্রধান, সেই সঙ্গে দায়িত্ব পেয়েছেন অবিনাশকারী পরীক্ষণ বা non-destructive testing (NDT) বিভাগের। সেই সময় একটা দুর্নীতি-চক্র ওই বিভাগে সক্রিয় ছিল, উনি তাদের প্রায় হাতেনাতে ধরে ফেলেন। এর সঙ্গে হয়ত উপরমহলও জড়িত ছিল, তাই তাঁকে হাজিরা-বিজাপুর-জগদীশপুর পাইপলাইনের টেস্টিং কিংবা ক্যাথোডিক প্রটেকশনের কাজে বরোদায় পাঠান হয়। মোটামুটি সাত-আট মাসের কাজকে তিনি তিন মাসে শেষ করে সিন্দ্রি ফেরেন। এসেই সম্ভবতঃ অপরাধী-চক্রের পাণ্ডার সম্বন্ধে কিছু জেনে ফেলে তাদের শত্রুতাকে আমন্ত্রণ করেন।
- কী সাংঘাতিক! তারপর?
'একদিন সন্ধেয় এক বন্ধু সপরিবারে বেড়াতে এসেছিলেন, তিনি বেরিয়ে যেতেই গেট খুলে ঢোকে কয়েকজন অচেনা লোক। দরজা খোলা মাত্র পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তাঁকে গুলি করে দুষ্কৃতিরা। শ্রীমতী ঘোষ ছুটে আসতে আসতেই ওরা পালায়। অন-দ্য-স্পট তাঁর মৃত্যু হয়, তখন তাঁর অবসর গ্রহণে মাত্র মাসখানেক বাকি! তবে এই খুনের কোন কিনারা হয় নি, দুষ্কৃতিকারীরা পুলিশকে কিনে ফেলে, বিহার পুলিশ এ ব্যাপারে বিখ্যাত তা আর কে না জানে!
'ডাঃ প্রদীপ ঘোষের গল্প আগেও করেছি, কিভাবে উনি সিন্দ্রির সংস্কৃতির পরিচয় বহন করতেন। অপুত্রক এই আপাদমস্তক নিরীহ অথচ দৃঢ়চিত্ত রুচিশীল ভদ্রলোক পদার্থশাস্ত্রী হলেও বহু বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। ভারতীয়র সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত ভাল বুঝতেন, সাহিত্যিক ছিলেন- বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বাংলা-ইংরাজি দুই ভাষায় লিখতেন, মূল গ্যোটে পড়ার জন্যে জার্মান শিখেছিলেন, আমরা একবার ইকবালের শের-এ-হিন্দি কবিতাটি জানার জন্যে উর্দু বইখানা নিয়ে তাঁর কাছে যেতেই তিনি ওটা পড়ে শোনান, আমরা হিন্দিতে লিখে নিই। এছাড়া একবার আমাদের শহরে ভয়াবহ পার্থেনিয়মের বিষাক্ত আগাছার উৎপাত হয়, উনি দলবল জোগাড় করে লম্বা কাঁচি আর তলোয়ার দিয়ে সেগুলো কাটতে নেমে পড়েন। তিনিই আমাকে পরিচয় করান পাতিয়ালা ঘরাণার ওস্তাদ অজয় চক্রবর্তীর গানের সাথে একটা কনফারেন্স থেকে স্পুলে রেকর্ড করা খেয়াল আর রাগপ্রধানের মাধ্যমে- খুব কম লোকই তখন তাঁকে চিনত। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী মিনু ঘোষ ছিলেন বাংলার বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক ত্রিপুরারি চক্রবর্তীর কন্যা, রবীন্দ্রসংগীতে আর হিন্দুস্থানী সংগীতে তাঁর ভাল ব্যুৎপত্তি ছিল। সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্র পরিষদের গড়ে ওঠা আর পরিচালনায় তাঁর অবদান আর একটা সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি গ্রুপের সৃষ্টি তাঁকে ঘিরে। তাঁর কাছের মানুষরা ছিলেন সুবিমল মিত্র, রণবীর রায়, অলক তালুকদার, বিশ্বনাথ ব্যানার্জি, ভার্গব চৌধুরি, বৈশাখ গুপ্ত, সুকুমার ঘোষ ও আরো অনেকে। সিন্দ্রিকে সিন্দ্রি করে গড়ে তুলতে অন্য সবার সাথে এঁদের অবদানও অসামান্য।
(২১)
- আচ্ছা বাবা, 'মহামানবের তীর্থক্ষেত্র তাই শ্রীক্ষেত্র নাম', এই কথাটা পুরী সম্বন্ধে বলেছিলেন এক কবি, আমরা কলেজে পড়েছিলাম। সিন্দ্রি নিয়ে কেউ কিছু বলেনি কেন? - অম্বা বলে।
'ঠাট্টা হচ্ছে? দাঁড়া লিস্ট এখনও শেষ হয় নি। ডাঃ ঘোষদের কথা, মুখার্জিদের কথা বললাম, সিন্দ্রির প্রথম পদ্মশ্রী ডাঃ চক্রবর্তীর কথাও বলেছি। এবার বলতে হয় বি-আই-টির প্রথম ডাইরেক্টার প্রোঃ দত্তাত্রেয় দেশপান্ডের কথা। প্রোঃ দেশপান্ডে ১৯৩১ সালে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এম-এস-সি করে যখন ট্রাভাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডীনের পদে ছিলেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁকে নতুন তৈরি সিন্দ্রির বিআইটিতে নির্দেশক পদে এনে বহাল করেন। তিনি জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে মার্চ ১৯৬১ তে তাঁর অকাল-মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। ৬০ সালের জুলাইয়ে পেটের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে তাঁর ছুটি নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী যোজনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বি আই টিকে স্বয়ংচালিত বিশ্ববিদ্যালয় করে গড়ে তোলার অঙ্গীকারে ছুটি নিলেন না, মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রাণ দিলেন এই কলেজের উন্নতির জন্যে। ওঁর সময়ে বি আই টি ছিল আই আই টি খড়গপুরের পরে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। ডিজেল লোকোমোটিভে আর রেল-ট্র্যাকের ইঞ্জিনীয়ারিং আর নতুন কিছু পাম্পের ডিজাইনের ক্ষেত্রেও প্রোঃ দেশপান্ডের বেশ কিছু অবদান ছিল। তাঁর পরে ভারতের কিছু সেরা পণ্ডিত যেমন ডাঃ কামাখ্যাপদ গুপ্ত, ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ বা ডাঃ রঘুনাথ সহায়ের মত মানুষ নির্দেশক হয়েছেন, কিন্তু প্রোঃ দেশপান্ডের মত একাধারে জ্ঞানী, দক্ষ প্রযুক্তিবিদ আর সেইসঙ্গে নিপুণ সংগঠক এই কলেজে আর কেউ আসেন নি। কলেজের ৬৫০ আসনের সভাগৃহ 'দেশপান্ডে অডিটোরিয়াম' তাঁর নামেই উৎসর্গিত হয়।
(প্রোঃ দেশপান্ডে সম্বন্ধে আরো তথ্য এই লিঙ্কে, তবে লিঙ্কটি নিরাপদ কিনা পরীক্ষা করেই ব্রাউজ করবেন- http://insaindia.res.in/detail/N59-0206 )
'এই কলেজ থেকেই একের পর এক ছাত্র-ছাত্রী শহরের মুখ উজ্জ্বল করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। রথীন সান্যাল, অভিজিৎ সেন, মানব দাস, ছাত্রী হিসেবে সিন্দ্রির অনিল বিশ্বাসের মেয়ে চৈতালির নাম আগেই বলেছি যিনি ও-এন-জি-সিতে প্রডাকশন বিভাগে প্রথম গ্রুপ জেনারেল ম্যানেজার হন। এছাড়া কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অ্যালুমনির নাম জানাচ্ছি, সদ্য একটা লিস্ট থেকে নামগুলো পেয়েছি-
Anil Kumar, Project Director, Alstom, New Delhi, India
Anand Kumar, Director(R&D), Indian Oil Corporation, New Delhi, India
S K Singh -DRDO scientist, CEO at Genesis Futuristic Technologies Ltd.
Bijoy G. Chatterjee , Director, Systems Research, National Semiconductor Corporation, USA
Dr. B. N. Singh, CMD, Rastriya Ispat Nigam, Vishakhapatnam, India
Dr. K. K. Srivastava, Director, DRDO, Hyderabad, India
K. Satya Narain, CMD, Engineers India Limited
Meher Afroz, Senior Director at Microsoft Corporation
Rajiv Bakshi, President , TATA Auto comp
Rajiv Ranjan, President and CEO, Reliance Asset Reconstruction Company, Mumbai
Ramesh K Gupta, C.O.O., TATA International
Ravi Shankar, President and CEO, Dow Kokam, Midland, Michigan, USA
Rustam Ali, Advisor, Department of Telecom, Government of India
Shrawan K Singh (ME 1961), Group Vice President, Xerox Corporation, USA
Subodh Narayan Jha, 2006 Raksha Mantri Award, Retired director of MIDHANI, Hyderabad
Suman Kumar (ME 1973), Director, Hitech Group, Gurgaon
Vibhash Kumar, Senior Vice President (Engg), Lanka IOC PLC
Dr. Yogendra S Chadda (ME 1957), Retd Professor, Mech Engg Dept, Univ of Detroit Mercy, USA
Kamal Nath, Head - Systems Integration India Sales, HCL Technologies Ltd
Ajeet Das [ECE 1985] - Senior Director - Marketing, ARRIS, Atlanta, USA
Prof B.S.Sahay-Founder Director-IIM Raipur
Mr. Anil kumar, Director, Keynote Systems, San Mateo, CA, USA
Mr. Sushil Kumar, Vice President, Oracle, Redwood City, CA, USA
Mr.S.N Verma-CHAIRMAN JSEB(EE,76)
- সিন্দ্রি থেকে আর কেউ পদ্ম-সম্মান পান নি?
'বি আই টি সিন্দ্রির অ্যালুমনিদের মধ্যে ১৯৬০ ব্যাচের শম্ভু শরণ প্রধান পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে দিল্লির থেকে, তিনি সিন্দ্রির আদি বাসিন্দা নন। পুরোপুরি সিন্দ্রিয়ান বলতে একজনই পেয়েছেন। আমাদের অতি-চেনা মানুষ সিন্দ্রিরই রাজেন্দ্র স্কুলের ৭৩এর ম্যাট্রিকুলেট আর বি আই টির ৭৫ ব্যাচের ইঞ্জিনীয়ার অমিতাভ রায় ২০১৮ সালে পদ্মশ্রী পান, সিন্দ্রির দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ হিসেবে প্রথম।'
- আচ্ছা, কী কাজের জন্যে পেলেন?
'অমিতাভ ভাভা পরমাণু কেন্দ্র বা BARC তে ছিলেন, আর নিউক্লিয়ার বর্জ্য-পদার্থের পুনর্ব্যবহার বা recycling এর একটি পদ্ধতির আবিষ্কার করেন ও তাকে develop ও implement করার জন্যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গতঃ জানাই, উনি সিন্দ্রির এককালের বাসিন্দা শ্রী নিরঞ্জন রায়ের সুপুত্র, SK1-23 তে থাকতেন। নিরঞ্জনবাবু দক্ষ ব্রিজ খেলোয়াড় ছিলেন যিনি দলগত ভাবে সিন্দ্রিকে বিহার চ্যাম্পিয়ান করেছিলেন।'
- দারুণ খবর! সিন্দ্রির লোক নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে?
'হয়নি আবার? খবর পাবার পরই সিন্দ্রি রবীন্দ্র পরিষদের বর্তমান সদস্যেরা ২০১৮এর পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানের দিনে তাঁকে একটি সম্বর্ধনা দেয়। অমিতাভও বহুদিন পরে সিন্দ্রি ফিরে এসে উচ্ছ্বসিত হন।'
(২২)
- আচ্ছা বাবা, শুরু করেছিলে তো নাতি-নাতনিদের শোনানোর জন্যে, তা গল্পের মোড় তো অন্যদিকে ঘুরে গেল। এসব কি ওরা বুঝছে না কারো ভাল লাগছে?- অম্বা বললেন।
- মা কেন এমন বল বুঝি না, আস্থা আপত্তি জানায়। 'আচ্ছা, দাদু তো অনেকদিন আগে আমাদিগকে কঙ্কাবতী, তাসের দেশ আর রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্প শুনিয়েছে। কঙ্কাবতীর সঙ্গে বাচ্চা মশার বন্ধুত্ব, তাসেদের খিট-খুট নাচ আর রিপ-ভ্যানের কুড়ি বছর একটানা ঘুমের কথা শুনে তখন মজা পেয়েছিলাম। এখন যখন ওগুলোর আসল মানে বুঝতে পারি, আরো মজা লাগে কি না? ভাই এখন ছোট আছে, কিন্তু আমি স্যোর, ও একদিন সিন্দ্রির গল্পের থীমটাকে ধরতে পারবে।'
- হ্যাঁ গো, আমাদের মেয়েটা যে বড় হয়ে গেল- শরদিন্দু অম্বার দিকে তাকিয়ে বললেন। শহরটা যে সত্যিই হারায়নি, হারিয়েছে তার মানুষগুলো আর সিন্দ্রি যে জাস্ট একটা শহর নয়, সিন্দ্রি মানে একটা ক্যারাক্টার, একটা কালচার, সেটা ও ধরতে পেরেছে। অম্বা উত্তরে হেসে বললেন- 'হবেই তো, ও যে আমাদের মা!'
'তার মানে আমার বকবকানি চালিয়ে যেতে হবে! বেশ শোনো তবে। সিন্দ্রি যাঁদেরকে মনে রাখবে আর এই যে যাঁরা সিন্দ্রিকে সিন্দ্রি করে গড়ে তুলেছেন তাঁরা কখনও এক, কখনও আলাদা। এশিয়ার বৃহত্তম সারের কারখানা আর বিহারের সবচেয়ে নামী প্রযুক্তিবিদ্যার কলেজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকে একটা বিশাল মেল্টিং পটের মত একসঙ্গে গলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে, ভারতের সম্বন্ধে যে বলা হয় 'unity among diversity'- তার একটা সত্যিকারের উদাহরণ হল সিন্দ্রির কলোনী-জীবন। এ সম্বন্ধে তোদের উইকি কি বলছে শোন-
"The communal harmony and social acceptance which was instilled in youngsters growing up in the town made it much easier for them to adapt to a diverse culture. The greatest contribution of Sindri Fertilizer Plant may be in creating a generation of Indians born with multi-cultural values."
'সেদিন ডাঃ প্রদীপ ঘোষের বড় চাকরির অফার ছাড়ার গল্প বলেছিলাম মনে আছে? তার কারণ কিন্তু সিন্দ্রির সমাজ, এর সামাজিক সাম্য। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি যে ডিরেক্টার ডাঃ সুবোধ মুখার্জি, ম্যানেজার ডাঃ ক্ষিতীশ চক্রবর্তী, সি-এম-ও ডাঃ অখৌরি, কম্পাউণ্ডার প্রামাণিক, ডাঃ ঘোষ বা ডাঃ রাজ, চার্জম্যান সুশীল বোস বা অজিত চ্যাটার্জি- এঁরা তাঁদের পদমর্যাদাটুকু অফিস পরিসরের মধ্যেই রেখে আসতেন, টেনিস খেলার কোর্টে অজিতকাকু বা দাদন সিং পদমর্যাদার মান রাখতে উমেশ ভার্মার কাছে হার মানতেন না। আমি নিজের চোখে দেখেছি ডাঃ সিনহা নিয়মিত ওষুধ না খাওয়ার জন্যে বাবাকে যাচ্ছেতাই বকাবকি করলেন, আবার তার পরের দিনই ব্রিজের টেবিলে ভুল কল করার জন্যে তিনি বাবার কাছে অজস্র কথা শুনলেন, দুই ক্ষেত্রেই বলা বাহুল্য, কেউ কিছুই বলতে পারেন নি। গ্যাস প্ল্যান্টের ম্যানেজার মদন দাশের কারখানায় প্রতাপই আলাদা, কিন্তু কল্যাণ কেন্দ্রে নাটকের স্টেজে ওঁকে সুনীল মৈত্র বা প্রণব ব্যানার্জির কথা মেনে চলতেই হত।
- তাহলে দাদু, সিন্দ্রির মহামানবদের গল্প শেষ? আর কিছু নেই? -অর্ঘ্য বলে। 'তুমি কিন্তু সেদিন রাবণ বধ আর বিশ্বকর্মা পুজোর পর সিন্দ্রির সোস্যাল লাইফের বাকি গল্পটা বল নি।'
'এইতো প্রসঙ্গে চলে এসেছি। রাবণ পোড়ানো বলেছি, দুর্গাপুজো বলেছি, কিন্তু নবরাত্রি উৎসব যেটা মহালয়া থেকে দশেরা পর্যন্ত চলে, তাতে সারা উত্তর ভারতীয়দের সমাবেশ হত। গুজরাত-মহারাষ্ট্রের মত দাণ্ডিয়া-রস হয়ত ছিল না, কিন্তু সহরপুরা আর ডোমগড় শিবমন্দিরে চলত দশ দিনব্যাপী রামলীলা উৎসব, যার মূল অভিনেতারা আসতেন উত্তর বিহার থেকে, আর মজার ব্যাপার ছিল, রাম বা রাবণ নয়, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল হনুমানের নাচনকোঁদন আর কথকের সাবলীল গল্প বলার ধরণ। রাম-লক্ষ্মণ বা রাবণের উদ্দেশ্যে নোট ছোঁড়া হত, আর হনুমান পেত নোটের মালা! তবে সিন্দ্রিতে যাকে আমরা রাবণ বলে চিনতাম, জানতাম, তিনি কিন্তু লাম্বা আর করালী-মুরলী দাস ভাইদের মতই একজন, সিন্দ্রির নামে ডাকটিকিট ছাপা হলে এঁদের নাম বাদ দেওয়া চলত না।'
- সত্যি, দাদু? কী করতেন ওঁরা?
'ভাগ্যান্বেষী লাম্বার কথা আগেও বলেছি, কপর্দকশূন্য অবস্থায় এসেও অধ্যবসায় আর সততার জোরে সিন্দ্রির আদি বাসিন্দাদের গভীর বিশ্বাস আর ভালবাসা অর্জন করে প্রচুর টাকা আর তার চেয়েও বেশি মান-সম্মান উপার্জন করেছেন। তাঁর প্রথমে ছিল হোটেল, পরে তা বন্ধ করে চালু করেন মুদিখানা আর কাপড়ের দোকান। করালী-মুরলী ভাইরা বাঙালি সেন্টিমেন্টকে বুঝেছিলেন, তাদের ঠিক যখন যা প্রয়োজন সরবরাহ করেছেন, দুজনেই 'মাসকাবারের খাতা'র হিসেবে ব্যবসা করতেন, একজন গোলধারি আর কাপড়, অন্যজন মুদিখানা আর দশকর্মা। আর রাবণ গোস্বামী? তাঁর আসল নাম ছিল নবকুমার, যে নাম হারিয়ে গেছিল যাত্রাপালায় তাঁর অবিস্মরণীয় রাবণের অভিনয়ের জন্যে। একসময় সিন্দ্রিতে যাত্রা আর নাটকের আদি ও অকৃত্রিম গুরু ছিলেন, পরে অভিনয় ছেড়ে মেক-আপ আর ডেকোরেটারের ব্যবসা ধরেন। একবার একটা নাটকের আগে ঘোষণা হচ্ছে- নবকুমার গোস্বামী, যেখানেই থাকুন গ্রীনরুমে চলে আসুন। স্পষ্ট শুনছেন বসে, কিন্তু নড়ছেন না। আরে ওই নাম তো নিজেই ভুলে মেরে দিয়েছেন, 'রাবণ' নামের জনপ্রিয়তার দৌলতে! সিন্দ্রির ইতিহাসে এঁদের নাম কখনও মুছবে না।
'রামলীলার কথা হচ্ছিল না! সত্যি এসব নিয়ে প্রচণ্ড উন্মাদনা ছিল, কিন্তু ধর্ম বা জাত নিয়ে কোন গোঁড়ামি ছিল না। মহরমের তাজিয়াতে আমরা গেলে বাড়িতে কেউ যেমন কিছু বলে নি কখনও, সৈয়দ বা মুস্তাক আমাদের পুজো-মন্ডপে গেলে বা প্রসাদ খেলে ওদের বাবাদের আপত্তি করতেও দেখিনি। আলিচাচার বাড়িতে বিনা দ্বিধায় আমরা চাঁদা চাইতে চলে যেতাম। আমাদের এক বাঙালি বন্ধুর বাবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় অসহায় পরিবার আশ্রয় পায় গুরুদ্বারায়, কেউ তাদের ধর্ম দেখেনি। একটু ছন্দ কেটেছিল ইন্দিরা হত্যা আর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, তবে সেটা নেহাতই বিক্ষিপ্ত।
(২৩)
'সিন্দ্রির কথা অসমাপ্ত থাকবে সেখানকার হোলি আর দেওয়ালির কথা না বললে। এ ঠিক বাঙালির দোল নয় যে ভদ্র-সভ্য ভাবে শুধুমাত্র আবীর মাখিয়ে খেলা হবে শান্তিনিকেতনী কেতায়, বরং শোলের জয়া ভাদুড়িদের কুমারী জীবনের দোলের মত রঙ আর রঙের খেলা। শুরু হত আগের রাত্রে ন্যাড়া-পোড়া বা বুড়ি পোড়ান দিয়ে। কাঠের জন্যে শুকনো ঝোঁপ-ঝাড়ের অভাব ছিল না, এছাড়া- বলা উচিত নয়, সরস্বতীপুজোয় যে বাড়ি থেকে চাঁদা পাওয়া যেত না তাদের বাগানের গেট বা বেড়ার কাঠ...দরকার ছিল না, তবে জরিমানা দিতে হবে তো! এখানে দোলে চলত উত্তর ভারতীয়- বা বলা চলে শুদ্ধ বিহারী কালচার, মানে মানুষের গায়ে রঙ ঢালা নয়, বরং রঙের মধ্যে মানুষকে চোবানো হত! দলবল নিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরা ছেলেরা 'হোলি হ্যায়' বা 'সা রা রা রা রা' চিৎকার করতে করতে মানুষ সেজে বেরোত, আর খেলাশেষে আস্ত ভূত হয়ে ঝাঁপ দিত কোন পুকুরে, চৌবাচ্চায় বা অভাবে কলের তলায়। এক এক সময় বাড়াবাড়ি হয়ে নানান দুর্ঘটনাও ঘটত, কখনও পুলিশ, কখনও বা হাসপাতালে ছোটাছুটি- ওগুলো আনুষঙ্গিক বিপর্যয়। বিকেলে হত সাদা নতুন পাজামা-কুর্তা পরে শুধুই আবীর খেলা আর বাড়ি বাড়ি মিষ্টি খাওয়া। একটু বড়দের জন্যে থাকত ভাঙের পেড়া বা সরবত। আর কালীপূজা ওখানে শুধু বাঙালির উৎসব নয়। দেওয়ালির বাজি আর আকাশ-প্রদীপসহ আলোর সজ্জা যেমন জাত-ধর্ম-প্রান্ত নির্বিশেষে পালন হত, কালীভক্তির দিক দিয়ে বিহারি, পাঞ্জাবি, তেলেগু, তামিল কেউ কম ছিল না। কালীপুজোর জন্যে বিখ্যাত ছিল তালতলা- এখন সেখানে পাকা কালীমন্দির হয়েছে, আরএমএলের মাতৃপূজা, রামকৃষ্ণ মিশন আর সাউথ হোস্টেলের উল্টোদিকের অমর ক্লাব- শ্মশানের ডেকোরেশনে যাদের জুড়ি ছিল না। '
'এবার আসি সিন্দ্রির বাজারে। বিসি মুখার্জির সময়ে সহরপুরা অঞ্চলের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। সার্কেলের উত্তরে একমাত্র সিনেমা-হল কল্পনার পেছনের অঞ্চলে ছিল একটা পুরনো বাজার। তার পেছনে তৈরি হয় বাঁধানো হাট আর তিনপাশে শপিং সেন্টার। পুরনো বাজারে যেমন ছিল মহাবীর আর প্রবোধের পানের দোকান, মিষ্টিমুখ, দীপু অপ্টিক্যালস, হাটের পরিধির ভেতরে ছিল এশিয়া টেইলার্স, ভটচার্জের চা, লন্ড্রি, মিশ্রা স্যারের ছাত্র পুস্তক সদন, মোহন মিষ্টান্ন ভান্ডার, তিনদিক ঘিরে ছিল কল্যাণেশ্বরী বস্ত্রালয়, কমলা ভাণ্ডার, আমেদের টেলারিং শপ, সিন্দ্রি স্টোর্স, জনতা, লাম্বা আর ভ্যারাইটি ক্লথ স্টোর্স, ডি-এন স্টুডিও, মেডিকো, জনতা মেডিক্যাল, শঙ্কর পুস্তকালয় আর সরকারের সাইকেল দোকান। সার্কেলের ঠিক বাইরে আমাদের এক বন্ধু খোসলা তখন বালসারা কোম্পানীর ডিলারশিপ নেয়, সিন্দ্রিতে নিয়ে আসে প্রথম জলের ডোমেস্টিক ফিল্টার। আশ্চর্য, তার আগে, এমনকি পরেও আমরা কল থেকে সরাসরি জল খেতাম, কোন রোগবীজানু বা ধুলোবালির কথা না ভেবে। এছাড়া ছিল মন্দিরের গা ঘেঁসে পপুলার মেডিক্যাল, গোটাদুই আটাচাক্কি, অন্য দিকে ছিল সিন্দ্রির অন্যতম অভিজাত ডিপার্টমেন্টাল শপ বিহার স্টোর্স- ওই জাতের দোকান তখন আর দুটি মাত্র ছিল, জে-টাইপের মোড়ের শিনোলা আর রোড়াবান্ধ সার্কেলের জয়সোয়াল স্টোর্স, তার গা ঘেঁসে ছিল বড় বাটার দোকান আর সিন্দ্রির একমাত্র বার-কাম-রেস্তরাঁ শাগুফা। এখন এসবের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিহার স্টোর্সের অন্যদিকে ছিল ঝুপড়ি মার্কেট, তার বড় আকর্ষণ ছিল উপ্পল আর অ্যাব্রলদের দোকান, গলির ভেতরে আমাদের বন্ধুর সচদেব কাট-পিস, মন্টুদার ব্লেস-মো টেইলার্স, গন্ধেশ্বরী দশকর্মা আর সনৎ চ্যাটার্জির বাদ্যযন্ত্রের স্টল। বাইরের দিকে ছিল রঞ্জুদের সিন্দ্রি সাউন্ড সার্ভিস- যারা শহরে প্রথম স্টিরিও আর বক্স মাইক আনে, বাঁকুড়া সুইটস আর রাঙামাটির পথে বাঁদিকে ইস্টবেঙ্গল মিষ্টান্ন ভান্ডার।
'আগে সহরপুরা কাঁচা সব্জির বাজার বসত সপ্তাহে তিনদিন- সোম, বুধ, শনি, ডোমগড়ে মঙ্গল-শুক্র আর কান্ড্রায় রবি-বৃহস্পতিবারে, তাই কোন না কোন বাজারে যে কোন দিন যাওয়াই যেত। পরবর্তী কালে রাঙামাটিতে জয়হিন্দ মাঠের উল্টোদিকে একটা সকালের বাজার চালু হয়। এর পরেও শস্তা আর তাজা তরিতরকারির জন্যে আমরা সাইকেল বা স্কুটার নিয়ে চলে যেতাম বালিয়াপুর বাজার। তবে সহরপুরার বাজারে হাটের জায়গা কম পড়ছিল, তাই প্রথমে হাট স্থানান্তরিত হয় সেন্ট্রালের মাঠে, পরে একসময় উঠে যায় গুরুদ্বারার পেছনের মাঠে, সিন্দ্রি লেকের পাশে যার একপ্রান্তে ছিল হিন্দু ঝটকা মাংসের আর মুরগির দোকান।
'শনিবারের হাটের গল্প শুনতে চাও? মূল হাটের আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত লটারির টিকিট বিক্রির বিজ্ঞাপন তারস্বরে মাইক বাজিয়ে আর রাস্তার ধারে মাদারির খেলওয়ালার হাঁকডাক। কোন হাতুড়ে ডেন্টিস্ট সস্তায় দাঁত তুলছে, কেউ বা বাতের অব্যর্থ ওষুধ 'ছিপকিলি কা তেল' বিক্রি করছে, সত্যিকারের কয়েকটা শুকনো মরা টিকটিকি ঝুলছেও দড়িতে! এসব গল্প বোধহয় আগেও করেছি। তবে সেন্ট্রালের মাঠের একটা বড় আকর্ষণ ছিল মাঝে মাঝে এক সপ্তাহ ধরে লাগাতার সাইক্লিং।'
- সেকি, এক সপ্তাহ সাইকেল থেকে নামত না? অর্ঘ্য অবাক হয়।
'না, দাদুভাই। সাইকেলেই ঘুম, নাওয়া, খাওয়া-দাওয়া। অবশ্য রাত্তিরে কী হত কে আর দেখতে যাচ্ছে! তবে আমাদের একটা সমস্যা ছিল- সেটা হোটেলে খাওয়া। হাই-এন্ড শাগুফা বাদ দিলে গুরুদ্বারার উল্টোদিকে ছিল সবেধন নীলমণি ম্যাড্রাস কাফে, পরে হাতবদলে নাম হয় 'মেনকা', পরে অ্যাব্রলরা পাঞ্জাবি আর চাইনীজ ফাস্ট ফুডের রেস্তরাঁ খোলে। তবে ফুটপাথ আর ঠেলাগাড়ি মডেল ঈটারির কোন অভাব ছিল না। আর কে-ই বা তখন বাইরে খায়? কল্পনার সঙ্গে একটা স্টল ছিল এককালে, সেখানে কোকাকোলা পাওয়া যেত। পরে মোরারজির আমলে কোকবিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্টলটাই উঠে যায়। অবশ্য তখনকার মিষ্টির দোকানগুলো ছিল একেকটা দুর্দান্ত দেশী ফাস্ট-ফুড সেন্টার, মাছ-মাংসের ঝোলভাতও পাওয়া যেত কোথাও কোথাও। শাগুফার পেছনদিকে ছিল একটা শস্তা ভাতের হোটেল, বি আই টি স্টুডেন্টদের খুব প্রিয় ছিল, ওরা বলত 'শাগুফি'। আজ এতদিন পরেও সেসব কথা মনে রয়ে গেছে।'
(২৪)
লকডাউনের বিরাম নেই। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ হু-হু করে বাড়ছে। দাদুর এখন সঙ্গী ল্যাপটপ, বাবারও তাই। উপায় নেই, একটা বাসায় আর কত কম্পিউটার থাকে, ছেলেমেয়েদের ই-স্কুলের ভরসা তাই স্মার্টফোন। কিন্তু বস্তির ছেলেমেয়েরা, যাদের ল্যাপটপ দূর-অস্ত, স্মার্টফোন কেনারও সামর্থ্য নেই, তারা অনলাইনে স্কুল করবে কেমন করে? কেউ চিন্তা করে না তাদের কথা। করবেই বা কিভাবে? কাজকর্ম বন্ধ, পেট চালাবে না পড়াশুনা!
পানুবাবু ভেবেছিলেন তাঁর কোচিং সেন্টার থেকে ল্যাপটপ দু'খানা এনে সামনের বস্তির ছেলেমেয়েদের ধার দেন কয়েকমাসের জন্যে। কিন্তু তাতে আর কতজনের হবে? আর একঘরে সবাই ভীড় জমালে তো সেটা স্কুলের মতই ভাইরাস ছড়াবে। তিনি সময় পেলেই এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যাচ্ছেন।
- দাদু, তোমার সিন্দ্রির গল্প আর নেই?- আস্থা সন্ধের মুখে এসে হামলা করে। ওদের খেলাধূলা বন্ধ, অনলাইন স্কুলের হোমটাস্ক নামমাত্র, তাই সময় আর কাটে না।
'দিদিভাই, সিন্দ্রির গল্প তো শেষ হবার নয়। তা তোমাদের আর কী শোনানো বাকি রয়ে গেল?'
- বা রে! রিং-টোনের কথা ভুলে গেলে? ডাকিনী-যোগিনী, এল শত নাগিনী...।
' সে তো আছেই। তবে সিন্দ্রিকে যারা বিখ্যাত করেছে আর সিন্দ্রির যারা বিখ্যাত হয়েছে তাদের গল্প যে এখনও কিছু বাকি আছে। আগে তাদের কথা শেষ হোক!'
- ও বাবা, আরো আছে? নাটক-গানবাজনা-খেলাধূলা-অফিসার-পলিটিক্স-সাহিত্য-পড়াশুনা সব তো হল।' বলতে বলতে অম্বা আর শরদিন্দু এসে ঢোকে ঘরে, পেছন পেছন অর্ঘ্য। 'তাহলে কি শুধু সিনেমা আর সার্কাস বাকি রইল?'
'ঠিক বলেছিস তো! তবে সিনেমা পরে হবে। আর সার্কাসের সঙ্গে সিন্দ্রির কী সম্বন্ধ, জয়হিন্দ মাঠে বা অন্য কোথাও তাঁবু পড়ত, সার্কাস দেখতে যেতাম। ছোটবেলায় ভারত আর জেমিনি সার্কাস দেখেছি আর তোদের মাকে এম্পায়ার না কী যেন দেখাতে নিয়ে গেছিলাম একবার মনে হয়। পেটা-র হস্তক্ষেপে বাঘ-সিংহের খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সার্কাস কোম্পানীগুলো মার খেতে খেতে বুঝি একসময় বন্ধই হয়ে গেল। তবে তার আগে শুধু খেলা দেখানো নয়, শিকারেরও অনুমতি পাওয়া যেত। ভাল শিকারিরও অভাব ছিল না দেশে। তোরা জিম করবেটের নাম শুনেছিস?'
- 'ম্যান ইটার অফ কুমায়ূন'-এর শিকারি করবেট? আস্থা প্রশ্ন করে, মনে হয় সদ্য পড়েছে বইটা।
'হ্যাঁ রে, যাঁর নামে উত্তরাখণ্ডের নৈনিতাল-পৌড়ি গাড়োয়াল অঞ্চলে ভারতের প্রথম ন্যাশনাল পার্কের নাম রাখা হয়েছে। তবে করবেট শুধু শিকারি নন, প্রকৃত পশুপ্রেমী ছিলেন। উনি মারতেন কেবলমাত্র মানুষখেকো বাঘ আর অন্য ক্ষতিকর জন্তুদের। ইনি অন্য মানুষ, কৃষ্ণনগরের করবেট। নদীয়ার শুভব্রত মৈত্রের লেখা থেকে শোনাই তবে-
'আট ফুটের লেপার্ডটা তখন তার সমস্ত শক্তি, সাহস, বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা আর সর্বোপরি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে আসছে। মিডল্যাণ্ড ডাবল ব্যারেল ব্রীচ লোডিং (ডি.বি.বি.এল) টুয়েলভ বোর, মেড ইন ইংল্যান্ড গানের ট্রিগারে আঙুল রেখে নিশানা স্থির করে তাকে আরো কাছে আসতে দিলেন শিকারী। জাঙ্গল বিটাররা নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে ভাবছেন এটা কি করছেন বাবু! এত কাছে আসতে দিচ্ছেন কেন জন্তুটাকে!! মাটিতে তখন দুটো চোখ দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে। একটি হিংস্র আর একটি স্থির সংকল্প। লেপার্ডের মাথা ছোট। রয়্যাল টাইগারের মাথা বড় হওয়ায় দুই চোখের ঠিক মাঝখানে গুলি করা যায় সহজেই। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই রিস্ক নেওয়া মানে যমকে আদর করে ডাকার মতো অবিমৃষ্যকারিতা। রক্ত হিম করা হুঙ্কার দিয়ে প্রকান্ড এক লাফ দিল সে। গর্জে উঠলো শিকারীর বন্দুক। অব্যর্থ নিশানা। সামনের পায়ের ওপরের দিক। গুলির ভিতরের ন'টি পিলেট ততক্ষণে তীব্র গতিতে খুঁজে নিয়েছে লেপার্ডের সামনের পা, চোখ, গলা, ফুসফুস, হার্ট। দিনটা ছিল ৭ই জানুয়ারী, ১৯৫২। স্থান কৃষ্ণগঞ্জ থানার নাইকুড়ো গ্রাম। জেলা নদীয়া।
'এই শিকারির নাম মধুসূদন প্রামাণিক, যিনি রাইফেল শ্যুটিং আর শিকারে আর শখের মাছধরায় সিন্দ্রির একটি প্রবাদপ্রতিম নাম ছিলেন, আমাদের সিনিয়ার তড়িৎদার (শ্যামল) বাবা। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প- খ্যাত ঘুর্ণির বাসিন্দা সিন্দ্রি কারখানার জন্মের ঊষালগ্নে ইনি পারিবারিক ডানলপ টায়ার-টিউব আর ভালকানাইজিং-এর ব্যবসা ছেড়ে এখানকার ট্রান্সপোর্ট বিভাগে কাজ নেন। সে সময় শিকারের কড়াকড়ি ছিল না। অবসর সময়ে সিন্দ্রির আসেপাশের জঙ্গলে, পঞ্চকোট পাহাড়, সুন্দরবন, আসাম, গিরিডি- যখন যেখানে পেরেছেন শিকারের নেশায় ছুটে গেছেন। সঙ্গী আগে ছিল ইংরেজ সাহেবরা, পরে হতেন পার্সোন্যাল ম্যানেজার কেএসএল আনন্দ, ডাঃ ভূষণ, রাজা বদ্যিনাথ রায়, নিশিকান্ত মিশ্র বা সিন্দ্রি-গোশালার মেকানিক জর্জ। তবে তাঁর প্রিয় শিকারের ক্ষেত্র ছিল গয়রার বিল- তখন সেখানে পাখিশিকার নিষিদ্ধ ছিল না, নদীয়ার বেথুয়াডহরির জঙ্গল যেখানে একসময় চিতাবাঘের দাপট ছিল, এখন তা অভয়ারণ্য, বাঘ নেই, তবে চিতল হরিণ, ঘড়িয়াল আর সাপ অজস্র। একবার এক আদমখোর লেপার্ড মেরে তিনি প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন, যার কাহিনী একটু আগে শোনালাম।'
- দাদু, আর শিকারের গল্প নেই ওঁর?- আগ্রহী প্রশ্ন নাতি অর্ঘ্যের।
'আরেকটা গল্প শুনেছি ওঁর, সেটা কৃষ্ণনগরের কাছেই অঞ্জনা নদীঘেঁষে একটা পুকুরে কুমির শিকারের। পুকুরে কুমির? আসলে নদীর স্রোতের সঙ্গে কখন কুমির এসে পড়েছে পুকুরে, সব মাছ খেয়ে ফেলে। পুকুর পাড়ে অজস্র কৌতুহলী চোখের মাঝে দুই শিকারী ভাই মধুসূদন আর জগদীশ (কালো মাস্টার)। জল তোলপাড় করে জলের ওপর এক লহমার জন্যে ভেসে উঠলো বড় বড় দাঁত বের করা বিশালাকার মাথাটা। ঠান্ডা মাথায় অথচ চিতার ক্ষিপ্রতায় টুয়েলভ বোর বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিল মধুসূদনের বহু অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ তর্জনীটি। গুলি গিয়ে সোজা লাগলো ঘাড়ে, ভেঙে দিল স্পাইনাল কর্ড। জলে রক্তের আলপনা আঁকতে আঁকতে ডুব দিল মাথার মালিক।
'পরের গুলিটি অব্যর্থ নিশানায় কালো মাস্টার গেঁথে দিলেন কুমিরের ধড়-লেজের সন্ধিস্থলে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় রাগে খেপে গিয়ে সেই জলদৈত্য পুকুরের জল তোলপাড় করে তুলল। কিন্তু স্পাইনাল কর্ড ভেঙে যাওয়ায় সেই কুমিরীয় দাপট গেল নিভে।
'নাগালের মধ্যে কুমীরটা মাথা তুলতেই মধুসূদন দড়ির ফাঁস পড়িয়ে দিলেন তার গলায়, সঙ্গে একটা হ্যাঁচকা টান। দড়িটা কেপে বসে গেল সেটার গলায়। এরপর সবাই মিলে তাকে তুলল ডাঙায়। দড়ি দিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তোলা হল ঘোড়ার গাড়িতে।
'শহর ভেঙে পড়ল কুমির দেখতে। হাঁ করে খেতে পারতো না, আট দিনের দিন মারা যায় সেটি- নিয়ে আসা হয় পেয়াদা পাড়ার ঘাটে। কুমির মানুষ খেলে পেটের ভেতরে গয়নাগাঁটি পাওয়া যেতে পারে, এই ভেবে চামড়া ছাড়াবার পর চেরা হয় কুমিরের পেট। মেলেনি কিছুই। তবে সেই কুমিরের মাংস কৃষ্ণনগরের অনেকেই নাকি সেদিন তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিলেন।'
- কী ভয়ানক! সেই সঙ্গে মজার, আস্থা বলে।
- তারপর যখন প্রাণী শিকার বন্ধ হয়ে গেল?
'পাখি আর খরগোস শিকার, মাছধরা এসব চলত। বন্ধু মহেন্দ্রবাবু, গুরুচরণ সিং আর সিন্দ্রির বিখ্যাত খবরের কাগজের এজেন্ট কমল বোসদের সঙ্গী করে কাছাকাছি গ্রামের পুকুরগুলোতে, সুযোগ পেলে তোপচাঁচি পর্যন্ত ছুটে গেছেন মাছ-ধরার নেশায়। পরে সিন্দ্রির জি-এম রজত ঘোষের সৌজন্যে গড়ে তোলেন ফিশার্স ক্লাব, প্রিয়দর্শিনী লেকের একটা অংশ মৎস্য-বিলাসীদের জন্যে চিহ্নিত করা হয়। আর একটা বড় কাজ হয় তাঁর হাত ধরে। সহরপুরা স্টেডিয়ামের মাঠের পেছনের অংশে গড়ে ওঠে শ্যুটিং রেঞ্জ, মিঃ আনন্দ প্রচুর সাহায্য করেন তাতে। তবে প্রচুর খরচের স্পোর্টস, সেসময় এত স্পনসর্স ছিল না, তাই ততটা জনপ্রিয় হয়নি এই উদ্যম।'
(২৫)
- ইস, শিকারের গল্প শুনতে শুনতে ন'টা বেজে গেল, চল সবাই মিলে খেয়ে নেবে- অম্বা তাড়া দিলেন।
- কেন মা, এখন তো স্কুলের তাড়া নেই। সাতটায় অনলাইন, সাড়ে ছটায় উঠলেই তো হয়,- আস্থা বলে। ওর এখন ওঠার ইচ্ছে নেই।
- না, সব কাজের নিয়ম, খাওয়া আর ঘুমের সময় মেনটেন করতে হবে। করোনা থেকে ইম্যুনিটি চাই তো!
এমন সময় শরদিন্দুর মোবাইল বেজে উঠল। একটা হিন্দি গানের সুর রিং-টোনে, খুব মিষ্টি সুরটা। 'বাঃ বেশ সুরটা', পানুবাবু বললেন, 'কী গান বল তো?'
- "জব কোই বাত বিগড় জায়ে
জব কোই মুশকিল পড় জায়ে,
তুম দেনা সাথ মেরা, ও হমনওয়াজ।''
বোধহয় জুর্ম সিনেমার গান। ছোটবেলায় দেখা ছবি, তবে সুরটা বেশ ভাল লাগে।
- বাবা আবার সিনেমার গান নিয়ে পড়লে- অবাক হয় অম্বা।
'বলার কারণ আছে। তবে আজ আর নয়। রাত্রি হয়েছে, কাল হবে। তাছাড়া কিছু বলার আগে একটু স্টাডি করে নেওয়া দরকার। হিন্দি ছবির আমার আর কতটুকু জ্ঞান!'
- দাদু এমন করে বলছে যেন এর মধ্যেও সিন্দ্রির গল্প আছে- হাসে আস্থা।
'বলা যায় না, থাকতেও পারে।' সবাই ডিনার করতে রওনা হয়ে পড়ে।
পরদিন সন্ধে হবার আগেই সবাই ছুটে এসেছে দাদুর ঘরে, কৌতূহলের শেষ নেই কারো। পানুবাবু চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে গল্প শুরু করলেন।
'আমেরিকার টেক্সাসের ডালাস শহরের সুগারল্যান্ড অঞ্চলে এক ভারতীয় পরিবার বাস করে। হরিশ মাইসোর নামে টেলিটেক কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাঁর স্ত্রী শেরি আর তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে। শেরি চেরিশ নামে একটি নাচের স্কুল চালান। একদিন তাঁদের আট বছরের মেয়ে কেন্দ্রা স্কুল থেকে ফিরে অবাক হয়ে মাকে প্রশ্ন করে- 'মম, তুমি নাকি ১৯৮১তে মিস ইন্ডিয়া হয়েছিলে, তারপর টোকিয়োতে মিস ইউনিভার্সে কনটেস্ট করেছিলে?'
'হ্যাঁরে, একদম সত্যি কথা', বাবা বলেন, 'তোদের মা তো কিছু বলে না, নিম্মিমাসিকে ফোন কর, সব জানিয়ে দেবে।' দু-বছরের জোশ, মানে কেন্দ্রার ভাই তখন কিছু বোঝেনা, হাঁ করে শুনছে।'
- হ্যাঁ, সত্যি দাদু? অর্ঘ্য অবাক হয়।
- হ্যাঁ রে, ৬০ এর দশকে সিন্দ্রি ফার্টিলাইজারে কাজ করতেন মিঃ শেষাদ্রি আইয়ার নামে এক তামিল ব্রাহ্মণ অফিসার, থাকতেন স্ত্রী, দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে। স্ত্রী সুন্দরী দক্ষ ভরতনাট্টম বিশারদ, সিন্দ্রিতে একটা নাচের স্কুল খোলেন। ছোট মেয়ে শশিকলা বা শেরি তখন কেজি স্কুলের ছাত্রী, খুব কম বয়সেই অদ্ভুত সুন্দর নাচে আর তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে 'অরঙ্গেত্রম' পারফর্মেন্স করে ফেলে। বাবার স্বপ্ন, মেয়েকে দেশের সেরা নৃত্যপটিয়সী করে গড়ে তোলার। সিন্দ্রিতে তার সুযোগ নেই বলে বোধহয় তিনি ৭২-৭৩ সাল নাগাদ সিন্দ্রির চাকরি ছেড়ে দিল্লি চলে আসেন, মেয়েরা ভর্তি হয় ওখানকার কারমেল স্কুলে। সেখানে শেরি ভেম্পতি সত্যম আর জয়া রামারাওএর কাছে ভরতনাট্যম, কুচিপুড়ি, কত্থক আর ওডিসি শেখে। তারপর ৮১র ইভস উইকলি মিস ইন্ডিয়া, তখন তার বয়স মাত্র ১৭। তার পরের বছর ভাই রাজীব গোস্বামীকে নায়ক হিসেবে প্রমোট করতে ফিল্মস্টার মনোজকুমার পেন্টার বাবু নামে একটা ছবি প্রডিউস করেন, মেয়েটিকে হিরোইন নিয়ে। শেরি বোম্বে আসে, কিন্তু ছবিটা চলেনি।'
- ও আচ্ছা, আপনি তাহলে মীনাক্ষি শেষাদ্রির কথা বলছেন? হ্যাঁ, তিনি সিন্দ্রিরই মেয়ে, মনে পড়েছে। তাহলে শশিকলা কে?
'ওটাই তার আসল নাম। পেন্টার বাবু ফ্লপ হলেও, মনোজকুমারের দেওয়া তার এই নামটা বিখ্যাত হয়ে যায়, আর মীনাক্ষী অভিনেত্রী হিসেবে বিখ্যাত হয় তার পরের ছবি, সুভাষ ঘাইয়ের 'হিরো'তে। 'দামিনী'র প্রাইজ-গার্লের কথাটা হয়ত আমার মনে পড়ত না ওর জুর্ম সিনেমার গান তোমার মোবাইলে না বাজলে। আমি মীনাক্ষীর স্বাতী, ঘায়েল, জুর্ম, শাহেনশাহ, ঘর হো তো এইসা, ঘাতক বা দামিনীর নায়িকা হিসেবে নয়, একজন বিশ্বশ্রেণীর নৃত্যশিল্পী যে এই সিন্দ্রি শহরে জন্ম নিয়ে ছোটবেলা কাটিয়েছে তার জন্যে গর্ববোধ করি।'
- আমিও করি- অম্বা বলে। তবে বাবা, ওকে সবাই আইস-গার্ল কেন বলত? ফিল্মি ম্যাগাজিনে পড়তাম।
'বাচ্চারা আছে, তাও বলি। এটা একটা তামিল আইয়ার পরিবারের চিরন্তন মূল্যবোধ, যা তাকে চিত্রজগতে থেকেও চরিত্রটাকে নীচে নামাতে দেয়নি। আরও বলব এটা সিন্দ্রি ঘরানার শিক্ষা যে তাকে কোন অবস্থাতেই কম্প্রোমাইজ করতে দেয়নি, অনেক গসিপ হয়েছে, তবু সে আজ স্বামী-পরিবার নিয়ে সুখে আছে। ঝুটো গ্ল্যামারের মোহে সে বাঁধা থাকেনি অথচ খ্যাতি তার পিছু ছাড়েনি সুদূর আমেরিকাতেও, তার জীবন আর কাজের উপর 'Meenakshi Accept Her Wings' নামে দু-ঘন্টার ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে হলিউডে।'
- বাবার স্টকে এটাও ছিল- শরৎ বলেন, দেখি সিন্দ্রি আর কী কী ম্যাজিক দেখায়!
'না হে, আমার স্টক প্রায় শেষ। তবে শহরটা হারাল কেন তা নিয়ে অনেক কথা জমে আছে মনের মধ্যে, বারান্তরে তা বলব।'
'
(২৬)
'১৯৮৭তে মীনাক্ষী শেষাদ্রি যখন বোম্বের বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় দেশের রাজধানীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উত্তাল করে আবির্ভাব ঘটল আর এক সিন্দ্রি-তনয়ার, যার নাম সাংবাদিক চিত্রা সুব্রহ্মণ্যম। তাঁর বাবা মিঃ আর সুব্রহ্মণ্যম ছিলেন সিন্দ্রি সার কারখানার একজন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, ডি-টাইপ বাংলোয় থাকতেন, পরে তালচেরে বদলি হয়ে যান ও জেনারেল ম্যানেজার হয়ে অবসর নেন।
'চিত্রা সুব্রহ্মণ্যম ডুয়েলার জন্ম হয় ১৯৫৮ সালে সিন্দ্রিতে। দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে ইংরেজিতে গ্র্যাজুয়েশন করার পর উনি ক্যালিফর্ণিয়া, আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা নিয়ে এম-এ আর মাস কম্যুনিকেশনে ডিপ্লোমা করেন। তাঁর বিয়ে হয় সুইটজারল্যান্ড-জেনেভার গণিতজ্ঞ ডাঃ জিয়ানকার্লো ডুয়েলার (Dr. Giancarlo Duella) সঙ্গে, নিতিয়া নামে তাঁদের একটি মেয়ে আর নিখিল নামে ছেলে আছে। চিত্রার নাম তোমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত মানুষদের তালিকায় দেখতে পাবে।'
- 'কিন্তু কেন? কী করেছিলেন তিনি?'
'