স্মরেন্নিত্যং।।
(পুরাণ- নতুন আলোয়)
"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা!"
নারী বিধাতাপুরুষের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। নারী-পুরুষের মিলনেই সৃষ্টিরক্ষা, নারী গর্ভধারণ করে বলেই সন্তান জন্মায়, অব্যাহত থাকে সৃষ্টির গতিশীলতা। কিন্তু কিসের তাগিদে পুরুষ জীবনসৃষ্টির খেলায় মাতবে, কোন প্ররোচনায় তার সমাগম হবে নারীতে? এই প্রশ্নের উত্তরে নারীতে আরোপিত হয়েছে রূপ, মানুষের মধ্যে গ্রথিত হয়েছে একান্ত জৈবিক যৌন আনন্দ। সুতরাং বিশ্বে নারীর প্রয়োজন আছে।
ব্যস, এইটুকুই? তাহলে বুঝি আর সভ্যতার এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসার মধ্যে মানবজাতির আর কোন সার্থকতা রইল না। নারী যদি শুধু যৌনতার একটা উপকরণ হয়, বা আরো একটু উন্নত চিন্তায় 'পুত্রার্থে ক্রীয়তে ভার্যা' বলে শুধুমাত্র প্রজননের একটা উপকরণ-মাত্র বলে চিহ্নিত করে রাখা হয়, তবে নারী নরকের দ্বার, পুরুষের বুকের একটি পাঁজর দিয়ে নারীর সৃষ্টি, নারীর আত্মা নেই- এসব কথা কিছুই অযৌক্তিক নয়।
অথচ আমাদের, অন্ততঃ হিন্দুপুরাণ আর ইতিহাস বলে অন্য কথা। নারীর রূপ বড় বিতর্কিত বস্তু, better half বা fairer sex বলে পশ্চিমীরা তাকে মহিমান্বিত করলেও রবীন্দ্রনাথ যদি বলে থাকেন 'আমি চোখ মেলে বললাম সুন্দর, সুন্দর হল সে', বা 'শুধু বিধাতার সৃষ্ট নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি"- হয়ত তা অতিরুক্তি নয়। যুগে যুগে কবিরা নারীর সৌন্দর্যের চুলচেরা বর্ণনা করে পাঠককে উত্তেজিত করেছে, কেউ কি জানতে চেয়েছে নারীর চোখে পুরুষ কতটা সুন্দর? বস্তুতঃ এর মধ্যে অপ্রাকৃতিক কিছুই নেই। জীবজগতে পুরুষ অধিক সুন্দর আর আকর্ষণীয়, যৌন তাড়নায় সে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবার প্রার্থনা করে, নারী তখন তার কাছে কামক্ষুধা-শান্তির আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ। তার আগে যত স্তব-স্তুতি, আর তা ফুরিয়ে গেলে তুলসীদাসের ভাষায় বিধান দেয়-
"ঢোল, ব্যায়ল, শুদ্র, পশু, নারী-
ইয়ে সভি হ্যাঁয় তাড়ন কে অধিকারী।"
অর্থাৎ ঢোলক, বলদ ও অন্য পশু, শূদ্র আর নারীজাতিকে পেটানোই উচিত। হিন্দুশাস্ত্রে (প্রাচীন শাস্ত্রে নয়, পরবর্তীকালে সংযোজিত) নারীর বেদপাঠ নিষিদ্ধ, ইসলামে তার মসজিদে প্রবেশ মানা। তাহলে নারীজন্মের সার্থকতা কিসে? কেন, পুরুষের মনোরঞ্জনে, তার বিলাসের উপকরণ, সন্তানধারণ আর পালন, গার্হস্থ কর্ম আর সেবাধর্মে। আদিম কালে তবু 'বীরভোগ্যা' ছিল সে, পরে সুসংহত সমাজ গঠনের জন্যে বিবাহের প্রথা চালু হল, অর্থাৎ নারী এক পুরুষের স্ত্রী, দাসী বা ভোগ্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে লাগল। তার চিহ্নস্বরূপ তাকে কোথাও পরানো হল সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র, জেডরত্নের বলয়, শাঁখা-পলা বা অন্য কিছু।
এতটা ভূমিকা দিলাম এইজন্যেই যে এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম নামের এক সমাজ-ব্যবস্থার রক্ষণ-যন্ত্র জুডাস-গ্রীক-খ্রীস্টান-ইসলাম বা এমনকি হিন্দুশাস্ত্রেও
(পুরাণ- নতুন আলোয়)
"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা!"
নারী বিধাতাপুরুষের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। নারী-পুরুষের মিলনেই সৃষ্টিরক্ষা, নারী গর্ভধারণ করে বলেই সন্তান জন্মায়, অব্যাহত থাকে সৃষ্টির গতিশীলতা। কিন্তু কিসের তাগিদে পুরুষ জীবনসৃষ্টির খেলায় মাতবে, কোন প্ররোচনায় তার সমাগম হবে নারীতে? এই প্রশ্নের উত্তরে নারীতে আরোপিত হয়েছে রূপ, মানুষের মধ্যে গ্রথিত হয়েছে একান্ত জৈবিক যৌন আনন্দ। সুতরাং বিশ্বে নারীর প্রয়োজন আছে।
ব্যস, এইটুকুই? তাহলে বুঝি আর সভ্যতার এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসার মধ্যে মানবজাতির আর কোন সার্থকতা রইল না। নারী যদি শুধু যৌনতার একটা উপকরণ হয়, বা আরো একটু উন্নত চিন্তায় 'পুত্রার্থে ক্রীয়তে ভার্যা' বলে শুধুমাত্র প্রজননের একটা উপকরণ-মাত্র বলে চিহ্নিত করে রাখা হয়, তবে নারী নরকের দ্বার, পুরুষের বুকের একটি পাঁজর দিয়ে নারীর সৃষ্টি, নারীর আত্মা নেই- এসব কথা কিছুই অযৌক্তিক নয়।
অথচ আমাদের, অন্ততঃ হিন্দুপুরাণ আর ইতিহাস বলে অন্য কথা। নারীর রূপ বড় বিতর্কিত বস্তু, better half বা fairer sex বলে পশ্চিমীরা তাকে মহিমান্বিত করলেও রবীন্দ্রনাথ যদি বলে থাকেন 'আমি চোখ মেলে বললাম সুন্দর, সুন্দর হল সে', বা 'শুধু বিধাতার সৃষ্ট নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি"- হয়ত তা অতিরুক্তি নয়। যুগে যুগে কবিরা নারীর সৌন্দর্যের চুলচেরা বর্ণনা করে পাঠককে উত্তেজিত করেছে, কেউ কি জানতে চেয়েছে নারীর চোখে পুরুষ কতটা সুন্দর? বস্তুতঃ এর মধ্যে অপ্রাকৃতিক কিছুই নেই। জীবজগতে পুরুষ অধিক সুন্দর আর আকর্ষণীয়, যৌন তাড়নায় সে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হবার প্রার্থনা করে, নারী তখন তার কাছে কামক্ষুধা-শান্তির আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রবিশেষ। তার আগে যত স্তব-স্তুতি, আর তা ফুরিয়ে গেলে তুলসীদাসের ভাষায় বিধান দেয়-
"ঢোল, ব্যায়ল, শুদ্র, পশু, নারী-
ইয়ে সভি হ্যাঁয় তাড়ন কে অধিকারী।"
অর্থাৎ ঢোলক, বলদ ও অন্য পশু, শূদ্র আর নারীজাতিকে পেটানোই উচিত। হিন্দুশাস্ত্রে (প্রাচীন শাস্ত্রে নয়, পরবর্তীকালে সংযোজিত) নারীর বেদপাঠ নিষিদ্ধ, ইসলামে তার মসজিদে প্রবেশ মানা। তাহলে নারীজন্মের সার্থকতা কিসে? কেন, পুরুষের মনোরঞ্জনে, তার বিলাসের উপকরণ, সন্তানধারণ আর পালন, গার্হস্থ কর্ম আর সেবাধর্মে। আদিম কালে তবু 'বীরভোগ্যা' ছিল সে, পরে সুসংহত সমাজ গঠনের জন্যে বিবাহের প্রথা চালু হল, অর্থাৎ নারী এক পুরুষের স্ত্রী, দাসী বা ভোগ্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে লাগল। তার চিহ্নস্বরূপ তাকে কোথাও পরানো হল সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র, জেডরত্নের বলয়, শাঁখা-পলা বা অন্য কিছু।
এতটা ভূমিকা দিলাম এইজন্যেই যে এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম নামের এক সমাজ-ব্যবস্থার রক্ষণ-যন্ত্র জুডাস-গ্রীক-খ্রীস্টান-ইসলাম বা এমনকি হিন্দুশাস্ত্রেও
অহল্যার অধিকার।
(পুরাণ- নতুন আলোয়)
-‘না দেবরাজ, তা হয় না। পতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলে নরকেও যে ঠাঁই হবে না আমার!’
-‘তুমি হাসালে অহল্যে! দেবরাজ ইন্দ্রকে বোঝাচ্ছ স্বর্গ-নরকের পরিভাষা? স্বর্গাধিপতি আমি, আমার রাজ্য দুর্গম হলেও কিন্তু কোন অলক্ষ্য-অলঙ্ঘ্য স্থান নয়। লঙ্কেশ রাবণ সসৈন্যে সেখানে এসে যুদ্ধ করে গেছে, তা জান? অগম্য হলে কি সে সম্ভব হত?’
-‘তবু…..ন্যায়-নীতি, পবিত্রতা, সামাজিক অনুশাসন বলে তো কিছু আছে। আর দেহসুখই কি সব?’
-‘তা আমি বলছি না। তবে ঋষি গৌতমের কোন অধিকার নেই তার বার্ধক্যের শাসনে বেঁধে তোমার প্রাপ্য সুখ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করার।’
-‘আমি বঞ্চিত তা তোমাকে কে বলেছে? ঋষি আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন।’
-‘তবু তোমার মনে কি কখনও অজান্তে-অবচেতনেও সাধ হয়নি পরিপূর্ণতার তৃপ্তি পাবার? অন্ততঃ গোপনে, সত্য বল দেবারাধ্যে!’
-‘যে বস্তুর সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই, তার কথা বলে মনকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না। তাছাড়া এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব, তোমার কাছে তা প্রকাশ করা কি বাধ্যতামূলক?’
-‘আমি যে তোমাকে একান্তভাবে চাই বরাঙ্গিনি! তুমি তৃপ্ত হলে আমি যে পরিমাণ আনন্দ পাব তার কাছে স্বর্গরাজ্যের আধিপত্যসুখ তুচ্ছ। বল সুতনুকে, আমাকে দেখে কি তোমার মনে কখনও পূর্ণতা পাবার সাধ জাগেনি?’
অহল্যা উত্তর দিলেন না। শচীপতির ইঙ্গিত তিনি বুঝেছেন। বুঝেছেন যে তা অশোভন হলেও অযৌক্তিক নয়, অনৈতিক হলেও তাঁর অধিকার-বহির্ভূত নয়। একসময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজের দৈহিক-মানসিক চাহিদা প্রকাশ করতে পারত, তাতে পাপ ছিল না। তবে যৌনতা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সমাজে ক্রমশঃই ব্যভিচার বাড়তে থাকে, ফলে সমাজের শীর্ষে থাকা রাজন্যবৃন্দ ও আইনপ্রণেতা ঋষিগণ বিবাহবহির্ভূত যৌনাচারকে একসময় অসিদ্ধ, অনৈতিক ও অপরাধ বলে ঘোষণা করেন। এতে কিন্তু পুরুষতন্ত্রেরই জয় বলবৎ থাকে। কারণ ইন্দ্র, রাবণাদি পুরুষেরা যথেচ্ছাচার করে লম্পট আখ্যা পেয়ে থাকলেও তাদেরকে সমাজচ্যুত বা দণ্ডিত করার কথা ভাবতে পারেনি এই পুংশাসিত সমাজ। ঋষি পরাশর, জাবালি ইত্যাদি এই একদর্শী নিয়মের বিরোধিতা করেন। জাবালি, চারুবাক এঁরা নাস্তিক, তাই ঋষিসমাজে অপাংক্তেয়। তবে ঋষি জমদগ্নি ইতিমধ্যে চরম কঠোরতা প্রদর্শন করে নিরপরাধ স্ত্রী রেণুকাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অনুতপ্ত- পুত্র ভৃগু ক্ষত্রিয়দ্বেষে কুঠার তুলে নিয়েছেন হাতে, পরশুরাম নাম গ্রহণ করে বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় করার ব্রত নিয়ে। তাই তিনি ও পরাশর এক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হয়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে নারীদের পতি ত্যাগ করে অন্য পতি বরণ করার বিধান দিলেও প্রভাবশালী চক্র, অর্থাৎ মনু, গৌতম, বিশ্বামিত্রদের চাপে তাঁদের প্রণীত বিধান সংহিতার শ্লোকবিশেষ হয়েই রয়ে যায়। তাই ভয় পাচ্ছেন গৌতম-পত্নী অহল্যা, চরম দণ্ডের বিভীষিকা ভাসছে চোখের সামনে, কিন্তু পতঙ্গ কি বহ্নিকে উপেক্ষা করতে পারে?
-‘বল অহল্যে, যদি জেগে থাকে, এই অবদমিত বাসনা কি গোপন সঙ্গমের তুলনীয় নয়?’
নীরবে মাথা নত করেন অহল্যা। মনের গোপন অভিলাষ তিনি অস্বীকার করেন কিভাবে? রতিশ্রান্ত লোলচর্ম শিথিলাঙ্গ ঘুমন্ত ঋষির পাশে জেগে একটি অতৃপ্ত নারীসত্ত্বা যে কাটিয়েছে রাতের পর রাত, কেমন করে ভোলেন তিনি সে কথা? তাঁর মানসিক দ্বিধার সুযোগ নিলেন ইন্দ্র। কথা হল, ঋষির অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে তাঁর অন্তঃপুরে তিনি আসবেন অভিসারে, ছদ্মবেশে। একাধারে আসন্ন সম্ভাব্য সুখের আনন্দ-উত্তেজনা আর তার পরিণতির আশঙ্কায় উদ্বেলিত-কম্পিত হয়ে উঠল অহল্যার হৃদয়।
* * * * *
পক্ষকাল পরের দৃশ্য। বরতনু অহল্যা উদাস হয়ে বসেছিলেন বাতায়নপ্রান্তে। তাঁর প্রতি কঠিন শাস্তি আরোপ করেছেন তাঁর পতি ঋষি গৌতম। প্রস্তররচিত কারাগারে তাঁকে থাকতে হবে যতদিন না স্বয়ং ঈশ্বর সে কারাগার ধ্বংস করে তাঁকে মুক্তি না দেন। তাঁর বিরুদ্ধে কলঙ্কের অভিযোগ, সঙ্গে দ্বিচারিতা, অসতীত্ব। অভিযোগ যে মিথ্যা নয় তা ঋষিও অনুমান করেন, যদিও তাঁর মনে বিশ্বাস যে এর জন্যে দেবরাজই একা দায়ী, গুরু গৌতমের ছদ্মবেশে......।
চমক ভাঙ্গল পরিচিত কণ্ঠস্বরে, তার নাম আহ্বান করছে কে যেন। ‘এ কি, বাসব তুমি! কী সাহসে আবার এসেছ এখানে? আর তোমার শরীরে সর্বত্র এত লোচন আঁকা কেন?’
- ‘ধীরে, অহল্যে, ধীরে। গুরুদেব এখন প্রস্তর-কারাগার নির্মানে ব্যস্ত, এ মুহূর্তে তাঁর এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। আর এগুলো লোচন নয়, যোনি-চিহ্ন, গুরুদেবের অভিশাপ।’
- ‘তার মানে ঋষির শাপে ফল হয়েছে!’
- ‘পাগল!’ ইন্দ্র হাসলেন। ‘তোমার নারীত্বের অধিকারের মর্যাদা দিয়ে অপূর্ণ যৌবনের দাবী আমি মিটিয়েছি, করেছি পুরুষের কর্তব্য। আমি নিজেও ধন্য হয়েছি, তৃপ্ত হয়েছি এ কাজ করে। কিন্তু সমাজের চোখে আমি অপরাধী, নৈতিকতার দিক দিয়েও। ঋষির শাপের মর্যাদা করি, কিন্তু শাপে কি সত্যিই কাজ হয়? তাই ঋষির মান রাখতে ওগুলো শরীরে আমি নিজেই এঁকে নিয়েছি।’
-‘সে কি! তাহলে শাপ আর বর কী জন্যে?’
-‘হয়ত তা নিতান্তই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ আর ক্ষমতার দম্ভ-প্রদর্শন। তা নইলে কেন তপস্যায় তুষ্ট চতুর্মুখ ব্রহ্মা রাবণকে দেব-দানবের হাতে অবধ্য থাকার বর দেন, আবার কেনই বা যমলোকে দণ্ডপাণি যমরাজ যখন তাঁকে বধ করতে উদ্যত, তিনি ছুটে যান যমের কাছে, নিজের মানরক্ষার তাগিদে। তাঁর অনুনয়ে রাবণ-হত্যায় বিরত হন যমরাজ। এই ঋষিও সমাজের শীর্ষস্থানীয় একজন মানী ব্যক্তি, তাঁর মান-সম্মান যাতে অক্ষুণ্ন থাকে তা দেখাও তো আমার কর্তব্য।
- ‘তাহলে অন্য অভিশাপটি? শুক্রকোষ বন্ধ- সে তো প্রায় পুরুষত্ব হারানোরই সমান।’
- ‘সে আর কে বোঝে পোষাকের আড়ালে কী আছে, লোকে যেমন খুশী কল্পনা করে নেবে। তবে তোমার ধারণা ভুল। এতে পুরুষত্ব নয়, শুধু সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাই নষ্ট হয়। তাতে আর কী আসে যায়? মেষের অণ্ডকোষের কাহিনী ইতিমধ্যে মর্ত্যলোকে প্রচারিত হয়ে গেছে। সে যাক, এখন বল অহল্যে, আমার প্রতি তোমার আর কোন অভিযোগ নেই তো?’
- ‘হে দেবরাজ, তুমি আমাকে পূর্ণ করেছ। দিয়েছ নারীর মর্যাদা। বিশ্বাসহনন আর চরিত্রহীনতার সমস্ত দায় তুলে নিয়েছ নিজের উপর। দোষ তো আমারও কম ছিল না। তোমার ঐ ছদ্মবেশ আমি মুহূর্তেই ধরে ফেলেছিলাম, তবু আসন্ন সুখের কামনায় রতিক্রীড়ায় লিপ্ত হয়েছি। শাস্তি তো আমার প্রাপ্য, তার বিরোধও করি না। সেখানে আর কী করতে পার তুমি?’
- ‘দেখ আমি দেবলোকের অধিপতি। স্বর্গমর্তের শৃংখলা রক্ষার ভার আমার উপরে, আর ঋষি গৌতমের হাতে আছে সমাজধর্ম রক্ষার দায়িত্ব। শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তাই আমি দেবর্ষিকে পাঠিয়েছি ঋষি বাল্মীকির কাছে। তিনি ইক্ষাকুকুলপতি রামের জীবনকাহিনী রচনা করবেন। আমার অনুরোধে তিনি ছদ্মবেশ চিনতে না পেরে তোমার এই পতিরূপে উপপতিসেবার বৃত্তান্তই উল্লেখ করবেন সেই কাব্যে।
‘তবে আমার ধারণা’, ইন্দ্র বলে চললেন, ‘বিশ্বের লোক একসময় নারীর চোখ দিয়ে সব কিছু বুঝতে সক্ষম হবে, তাই সেই সময়ের নিরিখে আমার প্রচেষ্টা বলবতী থাকবে এই উদ্দেশ্যে যে ভবিষ্যতের নারী যেন পুরুষের সম-অধিকার পায়, প্রয়োজনে আপন মানসিক ও শারীরিক চাহিদা যেন মুখ ফুটে বলতে পারে অথচ অসতীত্বের কালিমা তাকে স্পর্শ না করে। আমি শপথ করছি যে আগামী দিনগুলিতে আমি অহোরহ সেই প্রচেষ্টায় রত থাকব অন্ততঃ সতীত্বের বা দৈহিক পবিত্রতার পরিভাষা যেন স্ত্রী-পুরুষের ক্ষেত্রে পৃথক না হয়। ভবিষ্যতের কোন ঋষি হয়ত ইঙ্গিতে তোমার দৃষ্টান্ত দিয়ে সমগ্র নারীজাতির অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানাবে কোন কাব্য বা শ্লোকের মাধ্যমে। ভাগ্য আর পুরুষতন্ত্রের হাতে ক্রীড়নক না হয়ে থেকে তাকে জয় করবার দাবী জানাবে বিধাতার কাছে, হয়ত সেই সূত্র ধরে কোনদিন ‘পৌরুষ’ বা ‘পুরুষকার’ শব্দদুটির লিঙ্গ-পরিবর্তনও সম্ভব হবে আগামীদিনের কোন বৈয়াকরণের হাতে।’
দেবরাজ ইন্দ্র বিদায় নিলেন। কখন কোন ঋষি তাঁকে পঞ্চকন্যার শীর্ষে স্থান দিয়ে নিত্যস্মরণীয় করে তুলবেন, অথবা সত্যদ্রষ্টা কোন কবি একদিন লিখবেন- ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা’- সে চিন্তা এখন নেই অহল্যার মনোজগতে। বরং ক্ষণপ্রভার ক্ষণিক ঔজ্জ্বল্যের মত দেবেন্দ্রের সঙ্গে কাটানো কিছু স্বর্গীয় মুহূর্তের সুখস্মৃতিতে বিভোর হলেন তিনি। ভবিষ্যৎ কারাগারের দিনগুলোকে সহনীয় করে তুলতে এই সুখস্মৃতিটুকুই যে তাঁর সঞ্চয়!
No comments:
Post a Comment