টাঙ্গার কোচোয়ান ছিল আমুদে গপ্পবাজ লোক। এতগুলো নতুন মানুষ পেয়ে ও জ্ঞান দিতে শুরু করেছে। 'বোলিয়ে তো সাহেবলোগ, প্রয়াগ তীর্থ ইতনা ফেমাস কিউঁ হ্যায়?'
- 'তেরে মন কী গঙ্গা ঔর মেরে মন কী যমুনা কা
বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি!' অশোক গেয়ে ওঠে মজা করে। 'গঙ্গা-যমুনা কা সঙ্গম হ্যায় ওহাঁ।'
- 'আরে সাহেব, সিরফ গঙ্গা-যমুনা নাহি, একঠো সরসতী ভি থা কিসি টেম, উ আজকাল জমিন মা ঘুসল গয়িল। বহুত পুণ্যস্থান হ্যায়, সারি কথা তো সুনিয়ে।'
এই বলে টাঙ্গাওলা দিলাওয়র হুসেন ভাই পৌরাণিক আর লোককথা মিলিয়ে মিশিয়ে যে কাহিনী শোনাল, তা বহুশ্রুত, তবু সংক্ষেপে বলছি। আসলে যদ্দিন টি-আর-পি থাকে সিরিয়াল টেনে যেতে হয় কিনা, এ সব টিভিওয়ালারাই শিখিয়েছে, নতুন আর কি!
এ গল্পও নতুন নয়। শোনা কথা আবার নতুন করে বলা। দুর্বাসার শাপে লক্ষ্মীছাড়া হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। লক্ষ্মীদেবী স্বর্গচ্যুত হয়ে বসে রইলেন সমুদ্রের নীচে গিয়ে। দেবলোকে হাহাকার, ব্রহ্মার পরামর্শে নারায়ণের তপস্যায় বসলেন ইন্দ্র। প্রীত হলেন নারায়ণ। সিন্ধু কন্যা রূপে লক্ষ্মী দেবীকে জন্মগ্রহণ করতে আদেশ দিলেন তিনি। তারপর দেবতাদের নিয়ে সমুদ্র মন্থন করতে বললেন দেবতাদেরকে। মন্দার পর্বত হল মন্থন-দণ্ড, নাগরাজ বাসুকীকে বানানো হল দড়ি। আর এ বিশাল কাজ শুধু দেবতাদের পক্ষে করা কিছুতেই সম্ভব নয় বলে সঙ্গে অসুরদেরও নিতে বললেন। কথা হল, মন্থনে যা কিছু সম্পদ উঠবে তা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন দেবতা ও অসুরেরা।
সমুদ্র মন্থন শুরু হল। উঠে এলেন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী, কিছু মণি-মাণিক্য, উচ্চৈঃশ্রবা নামে ঘোড়া আর ঐরাবত নামে হাতি। তারপর দেববৈদ্য ধন্বন্তরি উঠে এলেন অমৃতে ভরা কুম্ভ হাতে নিয়ে। দেবতাদের পরমধন অমৃতকুম্ভ পাছে দেবতাদের হাতছাড়া হয়ে অসুরদের হাতে পড়ে, দেবরাজ ইন্দ্র তাই কুম্ভ নিয়ে পালাতে বললেন পুত্র জয়ন্তকে। পিতার আদেশ পাওয়া মাত্র অমৃতকুম্ভ নিয়ে ছুটতে লাগলেন জয়ন্ত, সমুদ্র মন্থনের সার বস্তুই যে অমৃত, যা পান করলে অমরত্ব লাভ করা যায়।
এদিকে অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য ব্যাপারটা লক্ষ করে অসুরদের আদেশ দিলেন জয়ন্তকে ধরতে। আগে আগে জয়ন্ত ছুটছেন অমৃত কুম্ভ নিয়ে- পিছনে ছুটছে অসুররা। এইভাবে সমানে তিনদিন ছোটার পর জয়ন্ত একটু বিশ্রাম নিতে বসলেন গোদাবরী-তীরের নাশিকে। আরো তিনদিন পরে পরে একবার করে বসতে হল শিপ্রাতীরের অবন্তিকা বা উজ্জয়িনীতে, গঙ্গাতীরের হরদ্বারে , আর শেষে এই ত্রিবেণীসঙ্গম প্রয়াগে- বারো দিন ধরে ছোটাছুটি করে ফিরে আসতে হয় সেই সাগর-তীরে অমৃত বিলি করতে। এই চারটে স্থানই হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থ, প্রতি তিন বছরে একবার করে মহাস্নানযোগ আসে একেকটা জায়গায়, যাকে কুম্ভমেলা বলে আর বারো বছরে প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভ ফেরত আসে।
- 'কিন্তু তিন তিন বছরে কেন? ও তো তিন-তিন দিন মে হোনা চাহিয়ে। আর পূর্ণকুম্ভই বা কী জিনিষ?'- আমাদের জিজ্ঞাসা।
- 'হাম মুরখ আদমি হুঁ বাবুসাব, লেকিন ইয়ে শুনা হুঁ কি দেওতা কা এক দিন হামারা এক সাল কে বরাবর হোতা হ্যায়।' সে জন্যে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর চার জায়গায় কুম্ভমেলা হয়, গড়ে একটা পূর্ণ কুম্ভ হয় বারো বছর পরে আর ছ'বছরে অর্ধকুম্ভ। হরিদ্বার আর প্রয়াগে পূর্ণ অমৃত কুম্ভ হয় কুম্ভ নামানোর সময় এই দু-জায়গায় কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল বলে। প্রতি ১৪৪ বছরে নাকি একবার মহাকুম্ভ হয়, জানিনা কোন সালে হবে সেটা।' আমরা অবশ্য এখন জানি সে বছরটা হল ২০২৫।
- 'লেকিন চৌকন্না রহিয়ে সাবজী, পাণ্ডালোগ বহুত পরেশান করতে হ্যাঁয়'- সচেতন করে দিল টাঙ্গাওলা-ভাই। জানা গেল, আগে ওদের উপদ্রব এমনই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ওরা নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কুম্ভমেলার অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেয়নি, অহিন্দু ঘরের বউ বলে। তবে তিনিও কম যান না। মেলা-অনুষ্ঠান সমেত পুরো চক্রটাকে জাতীয় আইনের আওতায় এনে ফেলে ওদের জব্দ করেছেন। এখন তো পুরী, বেনারস, দেওঘর, মথুরা সর্বত্র সরকারি আইনের শৃঙ্খলা, তবু যেহেতু এদেশে আইনের রক্ষকরাও ভক্ষকদের দলে, তাই পাণ্ডা আর তার সাগরেদরা এখনও সুযোগ পেলেই ভালই ঠকাতে থাকে নিরীহ তীর্থযাত্রীদের। পরে জেনেছিলাম ভারত সেবাশ্রম সংঘের মত প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে এলে তেমন সমস্যা হয়না।
গল্পে গল্পে খেয়াল করিনি কখন হনুমানমন্দির ছাড়িয়ে সঙ্গমতীর্থের ঘাটের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের টাঙ্গা।
টাঙ্গা থেকে নেমে যমুনার তীরে এসে দাঁড়াতেই পাণ্ডারা এসে ছেঁকে ধরল। 'আইয়ে বাবুলোগ সঙ্গম কা দর্শন কীজিয়ে...... গঙ্গা মাইয়া কী পূজা চঢ়াইয়ে......পিতৃপুরুষ শ্রাদ্ধ-তর্পণ কীজিয়ে......আইয়ে সাব, নাও রেডি হ্যায়......।
এরই মাঝে ভীড় ঠেলে-ঠুলে জনাচারেক নাপিত এসে জুটেছে। 'বৈঠিয়ে বাবুজি, মুণ্ডন কর দেতে হ্যাঁয়'। আরে মুণ্ডন করব কেন খামখা, পিতৃশ্রাদ্ধই বা কিসের, বাপ-মা বেঁচে আছে আমাদের! তাই শুনে তর্পণ-ওয়ালা পাণ্ডারা পিছিয়ে গেলেও নাপিতরা ছাড়ে না। 'বাবুজি, ফির ভি মুণ্ডন তো করা হি লীজিয়ে। তেল-সিন্দুর-শ্যাম্পু কা খরচা বচেগা, কাংঘি ভি খরিদনা নেহি পড়েগা। কিতনা টেম ভি বচেগা সোচিয়ে!' সমীর আর অশোক দুজনেই লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান ছেলে, ওরা জামার আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে যেতেই সবাই হাওয়া।
নাপিতরা কেটে পড়লেও নৌকো-পার্টি তখনও দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়। একজন এগিয়ে এসে বলল, বাবুজি, আপনারা এখন সঙ্গমের কাছে যমুনার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখুন জলটা গাঢ় নীল, কালো বলা চলে। বাঁদিকে ওই দূরে তাকিয়ে দেখুন, ওই যেখানে লাইন করে খুঁটি পোঁতা আছে, ওখানে যমুনা গিয়ে গঙ্গা-মাইয়াতে মিশছে। গঙ্গাজল সাদা, একটু ঘোলাটে। মাইয়া কী কৃপাসে সঙ্গম এক লাইন সে সাফ পাতা চলতা হ্যায়। চলুন ওখানে নিয়ে যাব, পাটাতন নামিয়ে স্নানের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
এতদূর এসে কিছু না দেখে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। ঈশ্বর দরদস্তুর শুরু করে দিল। 'সির্ফ সাড়ে সাতশো রুপিয়া দীজিয়ে', ওরা বলল। পাগল! আমরা স্টুডেন্ট, অত পয়সা নেই, তিরিশ টাকা দিতে পারি। শেষ পর্যন্ত চল্লিশ টাকায় রফা হল। মনে হয় সেটাও একটু বেশি হয়ে গেল, যাকগে, পাঁচ জনে তো শেয়ার হয়ে যাবে। আমাদের কাছে পয়সা বলতে যেটুকু ধানবাদ থেকে দিল্লির ফার্স্ট-ক্লাসের ভাড়া ধরিয়ে দিয়েছিল ওরা। আমরা তো গেছি সেকেন্ড ক্লাস স্লীপারে, ইন্টারভ্যুতে কী ফলাফল হবে জানিনা, ওই ডিফারেন্সটুকুই আমাদের লাভ। অগত্যা পাঁচজন মিলে নৌকোতে চড়ে বসলাম।
'কি হে, তোমাদের নৌকো এত ভেজা কেন, বসব কোথায়?' আমি বলি।
'বাবুজি, নাও থেকে আমরা সঙ্গমে গঙ্গাস্নান করাই, তাই এগুলো ভেজা। আপনারাও তিন-নদীর জলে স্নান করে নিন। এই পবিত্র সঙ্গমে স্নান করলে জীবনভরের পুণ্য হয়। নৌকো থেকে পাটাতন নামিয়ে দেব, ওই খুঁটিগুলো ধরে ডুব দিয়ে নেবেন। বোলিয়ে ভাইয়া, সির্ফ পচাশ রুপিয়া হর আদমি কে লিয়ে। আচ্ছা আপলোগ চালিশ হি দীজিয়ে।'
পাগল না পেট খারাপ! বিকেল পাঁচটায় ট্রেন ধরতে হবে, একটা বেজে গেছে, এখন জামা-কাপড় ভেজাই আর কী! বলা-বাহুল্য আমরা কেউই রাজি হলাম না। মাঝি আর তার অ্যাসিস্টেন্ট দুজনেই বেশ মনঃক্ষুণ্ন হল, কিন্তু আমরা কেউ দরাদরিতেও গেলাম না। কিন্তু বিপদ এল অন্যদিক থেকে।
গঙ্গা এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণে বইছে, যমুনা পশ্চিম থেকে পূবে। আমরা আছি গঙ্গার পশ্চিম আর যমুনার উত্তরের মাঝের জায়গায়। 'গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল'- বলা হয়ে থাকে, তবে বেনারসে গঙ্গা আবার উত্তরবাহিনী। কাশী বা বারাণসীতে গঙ্গা দেখতেই যায় বটে সবাই, কিন্তু বারাণসী নামটা এসেছে বরুণা আর অসী নদীর থেকে। একসময় অসী হয়ত বেশ চওড়া স্রোতস্বিনী নদীই ছিল, আজ তার অবস্থা একটা নালার মত। বরুণা কাশীর উত্তরে আর অসী দক্ষিণে গঙ্গায় এসে মেশে। গঙ্গামাহাত্ম্যের কাছে ম্লান আজ এদের নাম, হয়ত শুধু বইয়ের পাতাতেই দেখি- 'বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস, স্বচ্ছসলিলা বরুণা'। অসী আর গঙ্গার সঙ্গমের কাছে অসীঘাট আর তুলসী-ঘাট, যেখানে বসে তিনি রামচরিতমানস লেখেন, দেহও রাখেন। 'স'-এর অনুপ্রাসবহুল একটা সুন্দর দোহা আছে তাই নিয়ে-
"সম্বত সোলহশো আসসি, অসী গঙ্গা কে তীর।
সাওন শুক্লা সপ্তমী, তুলসী ত্যজয়ো শরীর।।"
তবে গঙ্গার পশ্চিমকূল বলে নয়, প্রয়াগ-মাহাত্ম্য নিজগুণেই বারানসীর চেয়ে কম কী!
যাক, নৌকো এদিকে পৌঁছে গেছে সঙ্গমস্থলে। এতক্ষণ যমুনা বেশ চওড়া ছিল, কিন্তু গঙ্গা এত শীর্ণ কেন? 'কিঁউ নহি হোগা, গঙ্গাজী নে ইতনি মিট্টি লাঈ, সঙ্গমস্থল পর জলোঢ় দ্বীপ বন গয়া জো!' তাই তো। একটা বিশাল দ্বীপ ঠিক সঙ্গমের মাঝামাঝি। কিন্তু জলোঢ় জিনিষটা কী? জানা গেল তার অর্থ - জল দ্বারা ঢোয়ী মিট্টি। বুঝলাম, এটা alluvial island বা পাললিক দ্বীপ। দ্বীপজুড়ে সাধুসন্তদের অজস্র তাঁবু পড়ে নাকি কুম্ভমেলায়। দেখি যমুনার ঘন নীল জল যেখানে শেষ হয়েছে, গিয়ে মিশেছে গঙ্গায় সাদা ঘোলাটে জলের স্পষ্ট একটা রেখা দেখা যাচ্ছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে দুই নদীর পার্থক্য। তারপর যমুনা আর নেই, আর সরস্বতী? সে নাকি ভূগর্ভ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশছে দুই নদীতে। কিন্তু জলের রঙের এই তারতম্য কেন? ঈশ্বর ঝায়ের অনেক জ্ঞান, বলল, এদেরকে শুধোস না, ব্যাটারা ঈশ্বরের লীলা-টিলা বলে বুঝিয়ে দেবে। আসলে এখানে যমুনা প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর বলে ঘননীল আর গঙ্গা পলিমাটির কারণে আর মাত্র চার-পাঁচফুট গভীর বলে জল এরকম ঘোলাটে। ঠিক সঙ্গমে সবাই স্নান করতে চায় বলে নৌকো বাঁধার সারিসারি খুঁটি পোঁতা ছিল। এখন শুনেছি চেন-টেনের ব্যবস্থা হয়েছে, তবে আমরা তেমন কিছু দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না।
নৌকোর দুই মাঝি আর ছোকরা খালাসি দেখলাম বেশ চৌখস, ভাল হিন্দিও বলে, ভোজপুরি ঘেঁসা নয়। হঠাৎ একজন আমাদের জাত জিজ্ঞেস করল। পাঁচজনই ব্রাহ্মণ শুনে খুব খুশি ওরা, কেন ঠিক বুঝলাম না। তখন আমরা চল্লিশ ফুট গভীরতার যমুনায় ভাসছি। ছেলেটা বলে, 'বাবুজি আপলোগ ব্রাহ্মণ হ্যাঁয়, গঙ্গামাতা কো পূজা তো চঢ়াকে হি জাইয়ে।' মানে? কোথায় মন্দির, কোথায় পূজারি, এই মাঝ-নদীতে কিভাবে পুজো করব? হ্যাঁ, আরেকটা নৌকো চলেছে বটে আমাদের সাথে সাথে প্রায়, কিন্তু তাতে কী?
That was the key! বুঝলাম, আর ভালভাবেই বুঝলাম। সঙ্গম দেখে দিলখুশ, মনের আনন্দে গুনগুন করছি-
"মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে-
গঙ্গাধারা মিশবে নাকি কালো যমুনাতে গো......"
হঠাৎ ঘটাং-ঘট। কেঁপে উঠল আমাদের নৌকো। চমকে পেছন ফিরে তাকালাম সকলে।
একটা অন্য নৌকো এসে ঠেকেছে আমাদের নৌকোর গায়ে। ঝপ-ঝপ করে তার থেকে লাফিয়ে আমাদের নৌকোয় এসে নামল ষণ্ডাগোছের তিনজন মানুষ, গায়ে নামাবলী, মাথায় বিশাল টিকি। 'গঙ্গা-যমনা-সরসতী মাইয়াকো কিরপা করকে পূজা চড়াইয়ে, বিলকুল কম খর্চে মে'- দাবী তাদের। বলছে বটে কৃপা করে, সেই মুন্নাভাইয়ের 'বিনম্রতা সে'র মত করে, কিন্তু গলার টোনে আর ভাবভঙ্গীতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওদের প্রত্যাখ্যান করলে মাঝনদীতে নৌকাডুবি হয়ে পাঁচটি প্রাণ যাওয়াও বিচিত্র নয় তেমন। তবু সমীর বলে- 'উসব নহি হোগা, হামলোগ স্টুডেন্ট হ্যাঁয়, ফালতু প্যায়সা নেহি কিসিকে পাস।'
ওরা যেন অন্তর্যামী। জানে যে একেবারে নিঃস্ব নই আমরা। তাই একটু কায়দা করে বলে, দেখুন, এখানে তো বারবার আসবেন না। তাছাড়া আপনারা পাঁচজনেই ব্রাহ্মণ (কিকরে বুঝল কে জানে, নিশ্চয় আমাদের মাঝি কিছু ইশারা করেছিল), ঘরে ফিরে গেলে মা-বাপকে কী বলবেন? কমসে কম পাও সের লাড্ডু আউর এক-এক নারিয়েল তো চঢ়াকে যাইয়ে!
আমার ইচ্ছে ছিল না, রবিরও। কিন্তু অশোক আর সমীর কী ভেবে রাজি হয়ে গেল, আর তাই দেখে ঈশ্বরও। অগত্যা আমি আর রবিও হ্যাঁ বলে দিলাম, একযাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন! ভাবলাম নারকেল বড়জোর একটাকা আর একপোয়া লাড্ডু পাঁচটাকা, আর কত হবে? গোটা দশেক খরচ করে যদি কিছুটা পুণ্য পাওয়া যায়, ক্ষতি কী?
হ্যাঁ বলতেই মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে বসিয়ে দিল আমাদের পাঁচজনকে, তারপরে হাতে কিছু ফুল-বেলপাতা আর একটা করে ভিজে নারকেল ধরিয়ে দিল। নারকেলগুলো ভিজে কেন? 'উ ছই কে নীচে রখে থে না, ভিঁগ গয়া'- জবাব এল। পাঁচখানা করে বোঁদের লাড্ডু পাতার ঠোঙায় করে রাখা হল। ওদের মধ্যে যে একটু ভদ্রগোছের, মনে হল তিনিই আসল পুরোহিত, বাকি দুজন গুণ্ডা বা পাণ্ডা- বিড়বিড় করে শঙ্করাচার্যের লেখা গঙ্গাস্তোত্র আউড়াতে শুরু করলেন-
"দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে ত্রিভুবনতারিণি তরলতরংগে। শংকরমৌলিবিহারিণি বিমলে মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ‖" এটুকু শুধু বোঝা গেল, তারপরের কথাগুলো যা শুনলাম- "হুঁ হুঁ হুম হুঁ হুঁ হুম হুঁ হুঁ হুম হুম হুম......" ইত্যাদি, মানে আর কিছু ওর মনে নেই, দরকারই বা কিসের! নাম-ধাম-গোত্র বলে পুজো দেওয়া হল। এরপর বলা হল নারকেলগুলো সঙ্গমের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। ও বাবা! যেই না ছুঁড়ে ফেলা, সামনের খুঁটিগুলোতে নোঙর-করা একটা নৌকো থেকে দুটো নুলিয়া-টাইপের বাচ্চা লাফিয়ে পড়ল জলে আর মুহূর্তে সাঁতার কেটে পাঁচখানা নারকেলই তুলে এনে পাণ্ডাদের নৌকোয় রেখে এল। এতক্ষণে ভেজা নারকেলের রহস্য উদ্ধার হল।
সব শেষে টাকা দেওয়ার পালা। হিসেব করে সে ব্যাটা বলে কিনা তিনশো পঁচানব্বই টাকা! কিভাবে? 'পাঁচটা নারকেল চল্লিশ টাকা, পাও সের লাড্ডু পচাস হরকে ঢাই শো, পাঁচ গুণে ইক্বিশ একশো পাঁচ রুপিয়া পূজা কে লিয়ে। পরনামি ভি থোড়া দে দিজিয়ে অলগ সে।'
মহা তর্ক লেগে গেল। বাজারে বিশ টাকা কিলো লাড্ডু, নারকেল এক টাকা, তাও ফেরৎ পেয়ে গেছে। বহু ঝগড়া-ঝাঁটি, ভীতি-প্রদর্শন সবকিছুর পর রফা হল একশো এক টাকায়, নিয়ে বিদায় হল ওরা। হ্যাঁ, একটা করে নাড়ু রেখে চারটে করে প্রসাদ আর কিছু ফুল ফেরত দিয়েছিল। তারপর স্টেশনে ফিরে আসতে কোন ঝামেলা হয় নি। ফেরার সময় সঙ্গমের হনুমান মন্দিরের শায়িত হনুমানজির একনজর দর্শন করে নিয়েছিলাম, তিনি আর কোন বাগড়া দেন নি। তবে টাঙ্গায় ওঠার পর দিলাওর ভাই সব শুনে বলল- 'আপলোগকো সংকটমোচন শ্রীহনুমানজি কা দর্শন পহলে কর লেনা চাহিয়ে থা, ফির সঙ্গম-দরশন মেঁ কোই সংকট নহি আতা।'
'আমাদের সফরের সেরা অভিজ্ঞতা কী হল বলত?' স্টেশনে ফিরে রবিশংকর বলল। 'টাঙ্গাওয়ালা দিলাওর হুসেনের হিন্দু-শাস্ত্রের জ্ঞান।'
বাকি সবাই একযোগে ঘাড় নাড়লাম। অশোক বলল- 'এহি হ্যায় হামারি ইন্ডিয়া!'