সিম্পলি ম্যাড।
এখনও পাগল হইনি বলেই বিশ্বাস করি, কিন্তু প্রায় হতে চলেছিলাম। কিভাবে? তাহলে সেই গল্পই বলি।
অনেক কাল আগের ঘটনা। তখন আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হত ডিসেম্বর মাসে আর তার পরেই দিন পনেরর নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। পড়াশুনো নেই, গরমের দাপট নেই, যতখুশি ছোটাছুটি আর খেলাধূলা। শুধু সন্ধে হতেই বাড়ি ফিরতে হত, তারপর আবার খেলো, মানে ঘরে বসে ক্যারাম, চাইনিজ চেকার আর বড়দাদারা বাগানের লনে যেখানে আলো জ্বালিয়ে আর নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে সেখানে ঘুরঘুর করা, যদি কোন ফাঁকে একটু খেলার মাঝে ঢুকে পড়া যায়!
কিন্তু সব কিছুই একসময় একঘেয়ে হয়ে যায়। পেয়ারাগাছে চাপা, ঢিল ছুঁড়ে কুল পাড়া, দিনভর গোবরডান্ডা আর গুলিডান্ডা খেলা, এমনকি ক্রিকেটও আর ভাল্লাগে না। নতুন কোন উত্তেজনার খোরাক চাই। ভাবতে ভাবতে চারজন অসমবয়সী বন্ধু, মানে আমি নাইনে পড়ি, শিং ভেঙে যাদের দলে ঢুকেছি সেই সুনীল সেভেনে, তোতন সিক্সে আর বালখিল্য হলেও শয়তানিতে আমাদের সবার গুরু আট বছরের খোকনা। সবার হাতে একটা করে সদ্য-বানানো গুলতি, জলার ধারে বেশ কিছু বক বসে আছে, শিকার করা যাবে।
তখন অত পরিযায়ী পাখি-টাখি বুঝতাম না, তাছাড়া ওরা বক না বালিহাঁস ছিল তাও জানতাম না। আমরা তিনজনে যখন কাদায় পা ডুবিয়ে হাঁস-ফাঁস করছি, খোকনা সত্যিকারের দুটো হাঁস না বক জানিনা কী, গুলতি ছুঁড়েই শিকার করে ফেলল। উরিব্বাস, কী আনন্দ! পাখিদুটোকে হাতে ঝুলিয়ে বিজয়ী-বীরের মত ফিরছি, আজ পিকনিক হবে আমাদের বাগানের পেছনে।
ভীড় জমে গেল রীতিমত। আমরা তিন ভাইবোন, তোতন একা, সুনীলরা দুই ভাই আর খোকনারা তিন ভাই আর এক বোন- সবাই জুটে গেল। খোকনার মেয়ে-সদস্য নিতে একটু আপত্তি ছিল, কিন্তু ওর দিদি থাকলে রান্নার সুবিধে হবে বলে আর ঝামেলা করল না। আমিও আমাদের চাকর বিভূতিকে ডেকে নিলাম, তাহলে আর মাংস-কাটাকুটি, উনুন জ্বালানো- এসব করতে সমস্যা হবেনা। ঠিক হল চাল, মশলা, আলু, পেঁয়াজ, লঙ্কা, রসুন, আদা- সবাই শেয়ার করবে, কয়লা আর মশলাপাতি আমাদের বাড়ির। খোকনা বলল ওর পাখি, তাই আর কিছু বাড়িতে চাইতে পারবে না। তবে ওদের বাগানে লুড়কি বেগুন আর টমাটো ফলেছে, তার কয়েকটা তুলে নিয়ে এল, ভাজা আর চাটনি হবে। আমাদের ওপরতলায় রুমু-ঝুমু দুটি বোন থাকে, তারাও লোভে লোভে এসেছিল নীচে। আমাদের আপত্তি ছিল না, তবে তাদের মা, মানে মিষ্টিকাকি কলকাতার কনভেন্টে পড়া সফিস্টিকেটেড মহিলা, তিনি নাক বেঁকিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বললেন- 'রুমু-ঝুমু, তোমরা কি জানো, বকের মাংস খেলে কী হয়?' বলা বাহুল্য, এসব কথা রুমু-ঝুমুদের স্কুলের কোর্সে নেই, তাই ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
- 'না, অন্য কিছু হয় না, সিম্পলি ম্যাড হয়ে যায়। আমাদের ল্যান্সডাউনের পাড়ায় একটা ম্যাডম্যান ছিল, সে নাকি কখন......'
- 'পাগলা ষাঁড় বলুন, কাকিমা, ম্যাড-অক্স।' উনি আবার কাকিমা বললে চটে যেতেন, আন্টি বলতে হতো, আর তাই আমরা আরো বেশি করে কাকিমা বলতাম, 'রুমু বলছিল ওদের মামাবাড়ি নাকি ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছে।' আমি এটুকু বলতেই কথার খেই হারিয়ে সফিস্টি... ইয়ে মানে মিষ্টিকাকি আমার দিকে কটমট করে একবার তাকিয়েই কেন জানিনা দুই মেয়েকে বগলদাবা করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন।
তারপর যা পিকনিক হল না! তখনকার দিনে ছেলেরা শখের রান্না একটু-আধটু করলেও, গেরস্থ বাড়ির একটু বড় মেয়েরা রান্নাবান্না গেরস্থালিতে ওস্তাদ হতো। কাক হোক আর বক, আচ্ছা করে ঝালমশলা দিয়ে খোকনার বেবিদি আর আমার বোন মিলে যা দুর্দান্ত একখানা রান্না নামালো, খোলা জায়গায় গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তার গন্ধে চারপাশের বাড়ির জানলা খুলে সবাই উঁকিঝুকি মারতে লাগল। বিভূতি কলাপাতার অভাবে মানকচুর পাতা কেটে ধুয়ে আনল বেশ কিছু। 'হ্যাঁরে, গলা কুটকুট করবে না তো?' - আমি ভয়ে ভয়ে শুধোলাম। বিভূতি চাকর হলেও আমাদিগকে পাত্তা দিত না একদম, বলে- 'কী আর হবে তাহলে, তোমার খাবারটাও আমিই খেয়ে নেব অল্প কষ্ট করে!'
পরিষ্কার ঘাসের লনে আমরা খেতে বসেছি। ভাত, বাগানের বেগুন-ভাজা, আলুভাতে, চাটনি আর বালিহাঁসের রগরগে ঝাল ঝোল গরম গরম- হ্যাঁ, একফাঁকে খোকনার বাবা এসে দেখে ও দুটোকে বালিহাঁস বলেই সার্টিফাই করে গেছেন। এমন সময় দেখি মিষ্টিকাকি উপর থেকে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে এসে দাঁড়িয়েছে, একাই। বললেন, 'না রে, যা গন্ধ পাচ্ছি ওপর থেকে, ভাবলাম একটু মাংস টেস্ট করেই যাই। রুমু-ঝুমুকে আর আনলাম না। আমার আর কী, এই বয়সে নাহয় ম্যাড হলামই।'
রুমু-ঝুমুর অশেষ সৌভাগ্যই বলতে হবে, ওদের মা-ও সে যাত্রা ম্যাড হতে হতে বেঁচে যায়।
No comments:
Post a Comment