"নন্দিনী ও বিশুপাগলা"
মিহির আচার্য ও বাসন্তী, নববিবাহিত দম্পতি। মিহিরকাকু গ্রামের পোস্ট অফিসে সহকারী পোস্টমাস্টার। মিহিরকাকু স্ত্রীকে বাসন্তী নামেই ডাকেন, আমার দাদু- ঠাকুমাও তাই। খুব রূপসী না হলেও সুশ্রীই বলা যায় কাকীকে। আমাকে কিন্তু উনি প্রথমেই বলেছিলেন, 'এই, আমার নাম কিন্তু নন্দিনী, আর কাকুর নাম রঞ্জন।' আমি বলতাম, 'ধ্যেৎ, তুমি বাসন্তী।' আমার কী দোষ, এক তো আমি রক্তকরবী পড়ি নি, আর কারো এতগুলো নাম হতে পারে সেসব আমি কি করে বুঝব!
কিন্তু দিনে দিনে কাকীর আরো অনেক গুণ প্রকাশ পেতে থাকল। গ্রামের মেয়েরা ওঁর কথাবার্তা চালচলনে, সাজসজ্জার আধুনিকতায় রীতিমত ফ্যান হয়ে পড়ল। একদিন কাকীর বাক্স থেকে বেরোল একটা রংচটা খাতা আর একটা সিংগল রীড হারমোনিয়ম। যেসব গান রেডিও ছাড়া কখনও শোনা যায় না- যেমন 'ওই সুরভরা দূর নীলিমায়', 'এই সুন্দর স্বর্নালি সন্ধ্যায়' এইসব অবলীলাক্রমে গেয়ে যেতেন। আবার দাদুর পায়ের শব্দ শুনতেই 'মহারাজ একি সাজে' ধরে ফেলতেও দ্বিধা করতেন না। মিহিরকাকু দিনভর কাজ করেন আর সন্ধ্যেয় দু-চারজনকে ট্যুশন পড়ান বাড়ির বারান্দায় বসে। অন্দরমহল থাকে আমার ও কাকীর দখলে। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। দুঃখ দুটি, প্রেম বিবাহ, তাও অসবর্ণ (কাকী বিয়ের আগে ছিলেন গুপ্ত, ওঁর গানের খাতায় নাম লেখা দেখেছি) বলে কোন পক্ষই বাড়ি থেকে মানেনি, তার ফলে ওঁদের আত্মীয় স্বজন থেকেও ছিল না। আর বাসন্তী নামটা কাকীর পছন্দ ছিল কিনা জানিনা, কিন্তু জানিনা কেন কেউ ওঁকে নন্দিনী নামে ডাকত না, মিহিরকাকুও নয়। বাসন্তীকাকী আমাকে আবার বিশুপাগলা বলে একটা অদ্ভুত নামে ডাকতেন। আমার এসব ভাল লাগতনা, কিন্তু স্নেহের ডাক ভেবে মেনে নিয়েছিলাম। তখন ছোট ছিলাম বলে অনেক কিছুই বুঝতাম না, আজ ভাবতে বসলে মাথায় ঢোকে যে কাকীর একটা স্বপ্নবিলাসী মন ছিল, যাতে তিনি নিজের মধ্যেই যেন রক্তকরবীর অভিনয় করে যেতেন। মিহিরকাকু ছিলেন নির্বিরোধী ভালমানুষ, সেইসঙ্গে ভীতুর ডিম একটি। একবার একতলার ঘরে আরশুলা ঢুকেছে, ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন- 'মিহির, দেখছ কি, মারো ওটাকে!' আর কাকু তখন খাটের উপর দাঁড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে বোঝাচ্ছেন- 'ভয় পাবেন না জ্যেঠিমা, ওনারা কামড়ান না।' শেষে কাকীই ওটাকে ঝাঁটাপেটা করে শেষ করল।
সহজেই বোঝা যায় যে মিহিরকাকু এই স্বপ্নবিলাসের কিছুই বুঝত না, আর বুঝলেও পাত্তা দিত না। এই নিয়ে বড় দুঃখ ছিল কাকীর। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, 'রঞ্জনটা বেরসিক, তুই আমাকে লাল করবী ফুল এনে দিতে পারবি রে বিশু?' আমি তো করবীই চিনি না তায় লাল! বাড়িতে জবা আর সন্ধ্যামণি ফুটত তাই এনে দিতাম- বাসন্তীকাকী তাতেই খুশী।
সহজেই বোঝা যায় যে মিহিরকাকু এই স্বপ্নবিলাসের কিছুই বুঝত না, আর বুঝলেও পাত্তা দিত না। এই নিয়ে বড় দুঃখ ছিল কাকীর। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, 'রঞ্জনটা বেরসিক, তুই আমাকে লাল করবী ফুল এনে দিতে পারবি রে বিশু?' আমি তো করবীই চিনি না তায় লাল! বাড়িতে জবা আর সন্ধ্যামণি ফুটত তাই এনে দিতাম- বাসন্তীকাকী তাতেই খুশী।
পল্লীগ্রামের ছোট্ট পুকুরে ঢেউ উঠতে যেমন সময় নেয়না, তা মিলিয়ে যেতেও তেমনি দেরী হয়না। কিন্তু এবার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা পাড়ে এসে লাগার আগেই আরেকটা বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল গ্রামের মাটিতে। বন-ভোজন! কাকী গ্রামের ছেলে-মেয়ে সবাইকে নাচিয়েছেন পৌষ-পয়লায় এবার হবে পৌষালু, ডিভিসির পরিত্যক্ত বাগানে। আমার ঠাকুমার ফুল সাপোর্ট। কিন্তু পঞ্চায়েতের মাথা মাথা লোকেদের মহা আপত্তি। ধাড়ি-ধাড়ি ছেলেমেয়েদের একসাথে ফূর্তি-আমোদ! সব এক কথায় নাকচ হয়ে গেল। কাকীও ছাড়ার পাত্রী নন, ছেলেছোকরাদের ভোট তাঁর দিকে। তবু সুবিধে হচ্ছে না। শেষে কী খেয়াল হওয়ায় আমি বললাম, 'কাকী, তুমি দাদুকে ধরো'। দাদু শুনে বললেন, 'এই কথা! তা এতে আপত্তির কি আছে?' দাদু গ্রামের নাম-কে-ওয়াস্তে জমিদার হলেও উকিল আর পণ্ডিত মানুষ বলে একটা আলাদা ওজন ছিল। পঞ্চায়েতের দল তাঁর যুক্তি-তর্কের সাথে পারবে কেন? আমি ছুটতে ছুটতে এসে কাকীকে জড়িয়ে ধরে বললাম, নন্দিনীকাকী, ওরা রাজী হয়েছে।
'সে আমি জানতাম। জ্যেঠামশায় যখন আছেন, ওরা রাজী হবেই। কিন্তু তুই আমাকে কি বললি আরেকবার বল।' আমি বুঝতে পেরে কেন জানিনা আরো লজ্জা পেয়ে গেলাম। 'আমার রঞ্জন আমাকে যে নামেই ডাকুক, তুই আমাকে এবার থেকে নন্দিনীকাকীই বলবি, কেমন,' বাসন্তীকাকী বললেন।
আমি এবার খুশী হয়ে ঘাড় নাড়লাম।
'সে আমি জানতাম। জ্যেঠামশায় যখন আছেন, ওরা রাজী হবেই। কিন্তু তুই আমাকে কি বললি আরেকবার বল।' আমি বুঝতে পেরে কেন জানিনা আরো লজ্জা পেয়ে গেলাম। 'আমার রঞ্জন আমাকে যে নামেই ডাকুক, তুই আমাকে এবার থেকে নন্দিনীকাকীই বলবি, কেমন,' বাসন্তীকাকী বললেন।
আমি এবার খুশী হয়ে ঘাড় নাড়লাম।
No comments:
Post a Comment