Thursday, June 5, 2014

বাংলা ছোটগল্প ।। বিবাহ-বার্ষিকী ।।

।। বিবাহ-বার্ষিকী ।।

বহুকাল পরে বাঁকুড়া এসেছি । না, উপলক্ষ্য কিছু নয়, ভগ্নীপতি এখানে বদলি হয়ে এসেছে এবং একটি মারুতি অল্টো কিনেছে । বোনের খুব ইচ্ছে একবার ওদের আস্তানাটা দেখে যাই । দোলের পরে কলকাতায় একটা কাজে এসে সময়ও হয়ে গেল, দুর্গাপুর ঘুরে টুক করে বাঁকুড়া চলে গেলাম । শহরটা বিশেষ বদলায়নি মনে হল, তবে রাস্তাঘাটে ভীড় অনেক বেড়েছে ।
'হ্যাঁরে, তোদের এখানে মাল্টিপ্লেক্স কালচার এসে পড়েছে না সেই পুরনো সিনেমাঘর গুলোই রয়ে গেছে ? সেই বীণাপাণি, চণ্ডীদাস...' আমি বোনকে শুধোলাম ।
'বাবা, তোর এখনো মনে আছে ? না, মাল্টিপ্লেক্স এখনও আসেনি, তবে এই এল বলে । পুরনো হলগুলোর খুব বাজে অবস্থা,' পাপিয়া বলল ।
'চন্ডীদাস আর কদিন পরে বোধহয় কোল্ড-স্টোরেজ হয়ে যাবে।' ভগ্নীপতির সরস মন্তব্য, 'তা দাদার কি কোনও সেন্টিমেন্টাল এটাচমেন্ট আছে নাকি......?'
'আছে বৈকি', আমি হাসলাম । ছুটিছাঁটাতে মাঝে মাঝেই পিসীর বাড়ি চলে আসতাম আর টো-টো করে ঘুরে বেড়াতাম প্রায় সমবয়সী দিদি শীলার সাথে, অবশ্য জন্মে কখনও ওকে দিদি বলি নি । পিসেমশাই ছিলেন এসিস্ট্যান্ট আর-টি-ও । একদিন দুজনে চন্ডিদাস থেকে সিনেমা দেখে ফিরে খুব বকুনি খেলাম । না বলে সিনেমা যাবার জন্যে নয়, হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম বলে । যত বোঝাই 'হিন্দুস্তান কি কসম' দেশভক্তির ছবি, পিসেমশাই তবু মানেননা, আমার ছেলেমেয়েরা শেষপর্যন্ত হিন্দি সিনেমা দেখছে...ছি, ছি, রুচি কোথায় নেমে গেছে !
'দাদা মনে হচ্ছে পুরনো দিনে হারিয়ে গেছে', অজিত আমার হুঁশ ফিরিয়ে আনল, 'আমি বলি কি, রঙ্গিন মুঘলে-আজম লেগেছে, গিয়ে দেখে এসো, আমার নতুন গাড়িটারও ট্রায়াল হয়ে যাক্‌ ।'
'ক'টা বাজে খেয়াল আছে?' পাপিয়া বলে, 'ইভনিং শো-এর আর টাইম নেই' ।
'নাইট শোই যাই না, তোরাও তৈরি হয়ে নে, একসাথেই বেরোনো যাবে ।' আমি বলি ।
'সে উপায় কি আছে? এখুনি একদল এজেন্ট আসবে, সেলসট্যাক্সের নতুন নিয়মকানুন নিয়ে আলোচনার জন্যে। তারপর ছেলের স্কুল খুলছে, ওকে কাল ভোরে পুরুলিয়ার বাসে তুলে দিতে হবে । তুমি সে জন্যে ভেব না, রাস্তাঘাট যদি মনে আছে তাহলে নাইট শো কোনও সমস্যা নয়, এইত পাটপুর থেকে তিন কিলোমিটারেরও কম', অজিত বলল । ওদের ছেলে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে হস্টেলে থেকে পড়ে ।
সিনেমা তেমন ভাল লাগছে না, বাইরের লাউঞ্জে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি । এখান থেকে দশ বারো কিলোমিটার দূরে ছাতনা গ্রামে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের ভিটে ছিল, মা বাশুলির মন্দির এখনও আছে । তাকিয়ে দেখছি, মনে হচ্ছিল, এখানে তাঁর একটা আবক্ষ মূর্তি ছিল, নীচে লেখা থাকত, 'চন্ডীদাস চিত্র-মন্দির'; শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করকমলে উদ্ঘাটিত, ও শেষে ১৩৩৪ সনের একটা তারিখ । নিজের মনেই ভাবছি কোথায় গেল সেটা, এমন সময় পাশ দিয়ে সাঁ করে একজন ওয়াশ-রুমে ঢুকে গেল । মুখটা খুব চেনা ঠেকল, কিন্তু চিনতে পারলাম না ।
হঠাৎ লোডশেডিং । এ জিনিষটা মফঃস্বল শহরগুলোতে একটা চিরস্থায়ী সমস্যা । তবে এদের জেনারেটার আছে হয়ত, অন্ততঃ একটা এমার্জেন্সি আলো চট করে জ্বলে উঠল । সেই মুহূর্তে এক সুন্দরী মহিলা 'পালন, তুমি কোথায় গেলে, পালন' বলতে বলতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন । আমার মাথায় কি এল, বলে বসলাম, 'আপনি কি পালন মুখার্জিকে খুঁজছেন ?'
'আপনি চেনেন তাকে, দেখেছেন ?'
'আমার স্কুলের বন্ধু । যাকে দেখলাম, যদি সেই হয়, তবে একটু আগে ওয়াশ-রুমের দিকে যেতে দেখলাম । ওই তো এসে পড়েছে ।'
'আরে সলিল না? উঃ, কুড়ি বছরের উপর হয়ে গেল...কোথায় আছিস? বাঃ, দিব্যি তো আমার বৌএর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিস । আগে থেকে চিনতিস নাকি?' নিজের রসিকতায় হা হা করে হেসে উঠল পালন।
'সব কথা পরে হবে ।' আমি বললাম, 'তোরা কি এই পচা বইটা পুরোটা দেখবি, না গল্প করবি এখন? আমার আর সিনেমায় ইন্টারেস্ট নেই । হলটার সাথে একটা নস্টালজিক ফীলিং জড়িয়ে ছিল, সেসব হয়ে গেছে ।'
'আমাদের তো সিনেমা দেখতেই হবে, বছরে একটা দিন । তবে এবার ফেরা যেতে পারে ।'
পালন গাড়ী বা স্কুটার আনেনি, বলল, স্কুটার আর চালায় না, আর গাড়ী কেনার পয়সা নেই । ও আর পলা, হ্যাঁ, ওর স্ত্রী, আমার গাড়ীর পিছনে বসল । পালন একটু আপত্তি করছিল, সেই প্রতাপবাগান নর্থে ওরা থাকে; ভজন জ্যেঠু, মানে লালনদা আর পালনের বাবা ওখানে সস্তায় জমি পেয়ে একখানা বাড়ি করে ফেলেছিলেন- আমি আপত্তিতে কান দিইনি, গাড়ী থাকলে প্রতাপবাগান-পাটপুর সব সমান ।
'আমার তো আর পড়াশোনা হল না, আই-টি-আই করে হলদিয়ায় ঢুকলাম এপ্রেন্টিস হয়ে । সেও প্রায় বাইশ বছর হয়ে গেল ।' নিজের জীবন-বৃত্তান্ত শুরু করল পালন ।
'কিন্তু তোকে দেখে কেউ বলবে না, চল্লিশ পার করেছিস । পলাকেও না । অন্ততঃ দশ বছর কম মনে হয় । ব্যাপারখানা কি?'
'আমাদের বয়স বাড়ার ঘড়িটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি' বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পলা ।
'না রে সত্যি । দ্যাখ, সিগারেট খাই না, জীবনে একবারই খেয়েছিলাম...তাছাড়া আমরা দুজনেই স্পোর্টসম্যান ছিলাম । তবে তোকে একটা কথা বলা হয় নি, আমাদের আজ বারো নম্বর বিবাহ-বার্ষিকী । ছেলেপুলে নেই, এই দিনটা আমরা প্রতি বছর চন্ডীদাসে সেলিব্রেট করি ।'
'তাই নাকি ? তাহলে তো একটা স্পেশ্যাল অভিনন্দন তোদের পাওনা ।' আমি বললাম ।
কিন্তু ব্যাপার কি, পাঠকপাড়া ছাড়িয়ে বাই-পাসে ঢুকেছি অনেকক্ষণ হল । এখনও প্রতাপবাগান আসার নাম নেই । 'এই ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো', আমি পিছনে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম ।
'তুই ঠিক রাস্তায় আছিস, আমরাই রাস্তা ভুলে গেছিলাম', বলেই যুগল হাসি পেছনের সীট থেকে । রহস্যজনক সে হাসি আর থামতেই চায় না । কি সন্দেহ হওয়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমের স্রোত নেমে গেল...পিছনে সীট তো ফাঁকা ! কোথায় কি করে নামল ওরা ! ভয়ে, আতঙ্কে আমি সজোরে ব্রেক কষলাম ।
একটু সম্বিত ফিরতেই দেখি গাড়ীর চারপাশে এত রাতেও একটা ভীড় জমা হয়েছে । এক টাকমাথা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দেখি সামনের বাসা থেকে গাড়ীর দিকে এগিয়ে আসছেন । পালন না? উঁহু, ওর আবার টাক কোথায়! এবার চিনতে পারলাম, লালনদা । তাঁকে এগিয়ে গিয়ে আমার কাহিনী শোনালাম ।
'হুঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছি', লালনদা বললেন, 'তুমি নিশ্চয় বহুদিন পরে পালনকে দেখলে?'
'আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রায় বিশ বছর পরে । লাস্ট দেখেছিলাম ওর তখন কুড়ি-বাইশ হবে ।'
'কিন্তু ওর বয়স যে ত্রিশের বেশী এগোয়নি সেটা লক্ষ্য করোনি । যাক্‌, বড় দুঃখের সে গল্প । শুনতে চাও?'
'অবশ্যই, যদি আপনার কোনও আপত্তি না থাকে । ভজন জ্যেঠু বাড়ি নেই ?'
'না, তিনি গেছেন পাঁচ বছর হল, মা দশ বছর আগে । তার আগে বড় হাসিখুশি ছিল আমাদের পরিবার । পালনটা লেখাপড়া বেশী শেখে নি, কিন্তু ভাল খেলোয়াড় ছিল, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন দুটোই ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে খেলত ।'
'সে তো আমরা জানি, ওই সূত্রেই তো হলদিয়ায় সহজে চাকরিটা পায় ।'
'ঠিক । বার বছর আগে এই দিনে ওদের বিয়ে হয় । বৌমা এখানকারই মেয়ে । বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে পালন একটা সম্পূর্ন কোয়ার্টার পেয়ে ঠিক করে ওকে নিয়ে যাবে হলদিয়া । খুব ভাল কথা । আমি বললাম, এবার তোরা একটু ধুমধাম করে বিবাহবার্ষিকীটা কর, তারপর বৌমাকে সাথে করে নিয়ে যা । খাওয়াদাওয়া গল্পগুজব মিটল প্রায় সাড়ে আটটায় । ইতিমধ্যে এক বন্ধু হাতে গুঁজে দিয়েছে দুটো নাইট শো-এর টিকিট আর একজন একটা দামী সিগারেটের প্যাকেট । পালন কখনও স্মোক করেনা কিন্তু কি ভেবে একটা ধরিয়ে স্কুটার স্টার্ট দিতে গেছে, সাথে বউমা । কেন গাড়ী স্টার্ট নিচ্ছেনা দেখতে পালন পেট্রল ট্যাঙ্কের ঢাকা খুলে দেখতে গেছে তেল আছে কিনা । চরম বোকামি । সিগারেটটা ঠোঁট থেকে খসে সেই মুহূর্তে ট্যাঙ্কের ভিতর ।'
'তারপর?'
'তারপর আর কি ? বিরাট একটা বিস্ফোরণ । পালন তো অন দ্য স্পট শেষ । বৌমা হাসপাতালে চোখ বোজার আগে আমার স্ত্রীকে বলেছিল, দিদি, টিকিট দুটো আমি নষ্ট হতে দেব না, তুমি দেখো ।'
'তাহলে আমি চণ্ডীদাসে যাদের দেখলাম...'
'ওরাই। অনেকেই দেখেছে এখানে, শুধুমাত্র এই দিনটিতে । খবরের কাগজে বেরিয়েছিল ঘটনাটা, অবশ্য তুমি তো বাইরে বাইরেই আছো । যাক্‌গে, অনেক ধকল গেল, গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবে ত? তোমার বোনের বাড়িটি যেন কোথায় ? চা খাবে না কি আরেক কাপ? একদিন এসো এ বাসায় বোন-ভগ্নীপতিকে নিয়ে ...।'
লালনদা অনেক কিছু বলে যাচ্ছেন, বুঝতে পারছি ওনার ঠোঁট নড়া দেখে । আমার কানে কিন্তু আর কিছুই ঢুকছে না ।
মুম্বাই, ২০ মে, ২০১৪ ।

No comments:

Post a Comment