Monday, December 28, 2015

Jachchhetai-3

যাচ্ছেতাই।।
(৩)

আমি, সুজয় আর কানু তিনজনে একত্রে আড্ডায় বসলেই কিভাবে জানি না কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডা অবধারিতভাবে বিশুমামার প্রসঙ্গে মোড় নিত। সেদিন এমনি বসে আছি যাদবের চা-এর দোকানে, কানুর হাতে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও। খবর পেয়েছি একটা বাস দুর্ঘটনায় বিশুমামা গুরুতর আহত হয়েছেন। 'খবরটা কি এইমাত্র রেডিওতে জানান হল- ওটা নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস যে!'- সুজয়ের প্রশ্নে কানু গোমড়া-মুখেই হেসে ফেলল।
-না রে, অত ফেমাসও নয় আমাদের বিশুমামা। তবে বছর দশেক আগে এই রেডিওতেই ওর সাথে আমাদের ভালভাবে পরিচয় হবার কথা ছিল।
- গল্পটা কি রে সলিল, সুজয় জিগ্যেস করল। ও পরে এসেছে পাড়ায়, বিশুমামার গোড়ার দিকের গল্পগুলো তেমন জানে না।
- কি আর, বিশুমামা তখন বিশ্বভারতী সংগীতভবনে শেখে। একদিন একটা পোস্টকার্ড এল মায়ের কাছে-'দিদি, অমুক তারিখে সন্ধ্যে আটটায় আমাদের একটা প্রোগ্রাম দেবে কলকাতা-ক থেকে, শান্তিদেবের পরিচালনায়। গানের দলে আমিও আছি, পারলে শুনিস। তারপর নির্দিষ্ট দিনে আমরা রেডিও খুলে বসে আছি, কোনও অনুষ্ঠানই নেই। গুলবাজ বলে তখন ইতিমধ্যেই একটু খ্যাতি ছড়িয়েছে বিশুমামার, সেটাই কায়েম হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তখন রেডিও সবার বাড়িতে থাকত না, অনেকেই ভীড় করেছেন আমাদের বাসায়। সবাই মিলে মামার পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে, এমন সময় সুশীলকাকুর প্রবেশ। ঢুকেই বলেন, 'উঃ, কি গলা হয়েছে রে আমাদের বিশুর, শান্তিদেবকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, এমন হেঁড়ে। তবে অনুষ্ঠান কিন্তু জমেছিল।' এদিকে আমরা সবাই অবাক। জিগ্যেস করলাম 'কাকু, আমরা তো তাই শুনতেই বসে আছি, কই হল, কখন?' জানা গেল ওটা সকাল আটটায় হয়ে গেছে। তখন রেডিওতে সব প্রোগ্রাম লাইভ হত, আর রিপিট হওয়ার ত প্রশ্নই ছিল না।

সত্যই তখন বিশুমামা বাড়িতে এলে উৎসব লেগে যেত। রবিবার হলে বাবা চলে যেতেন মাংস আনতে। দাদু বারান্দায় বসে আছেন, বিশুমামা তাঁকে গিয়ে প্রণাম করত। সেখানে মামার আবার অন্য রূপ। আমার দাদু ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, কিন্তু খুবই কম কথা বলতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম বিশুমামা এলে দাদুও কেমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। নানারকমের প্রশ্ন করতেন মামা।
- মেসোমশাই, টপ্পা নিয়ে একদিন আমাদের খুব তর্ক হচ্ছিল। টপ্পা নামটা কিভাবে এল একটু বোঝাবেন?
- ঘোড়া যখন ছোটে, তার পায়ের 'টপ-টপ' শব্দ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বা তার উল্টোটা যেমন হয়, মূলতঃ পাঞ্জাবের এই গায়ন-রীতিতে গমক ও বিস্তারগুলো তালের সাথে সংগতি রেখে সেভাবেই ছুটে চলে বলে একে টপ্পা বলে ।
- তাহলে টপ্পায় তাল থাকে? কিন্তু টপ্পা-অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত তো কেউ তালে গান না!
- টপ্পার তাল বেশিরভাগই মধ্যমান বা আড়াঠেকা হয়। কেন, দিনু ঠাকুর, শান্তিদেব, রাজেশ্বরী, কানা কেষ্ট- এঁরা তো তালেই টপ্পা গাইতেন। তবে রবি ঠাকুর শেষ বয়েসে টপ্পা-জাতীয় গান বিনা তবলাসংগতে গাইতে স্বচ্ছন্দ-বোধ করতেন, সেই থেকেই বোধহয় রীতিটা চালু হল। তাছাড়া টপ্পা ও টপ-খেয়াল তালে গাওয়া খুব কঠিনও বটে।
- টপ্পা পঞ্জাবী গান বলছেন, তাকে বাংলায় আমদানী করলেন কি রবীন্দ্রনাথ?
- তোমার কাছে এ প্রশ্ন আশা করিনি বিশু। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তই প্রথম বাংলায় টপ্পা লেখেন ১৭৮০ সাল নাগাদ। তাঁর বানীই ছিল-'নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?'

বলা বাহুল্য, এ সংলাপের অধিকাংশই তখনও বুঝবার বয়স আমার হয়নি। তাই যতশীগ্‌গির সম্ভব মামাকে দাদুর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা দখল করে বসাতাম। শুরু হত গান নিয়ে গান গান খেলা। 'ওরে ওরে আমার মন মেতেছে', 'ভালমানুষ নইরে মোরা', 'বেড়াল কয় মাছ খাবো না', 'আমার হরিনামে রুচি- কারণ পরিনামে লুচি' - মামার এসব গানের সাথে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম।

- কি হল, কোথায় হারিয়ে গেলি আবার? কি হয়েছে বিশুমামার, খুলে বলবি? বেঁচে আছে তো?
- মামার একটা দোষ আছে, যাকে তাকে যা তা কথা দিয়ে বসার। এক ছাত্রীর আকাশবাণীতে অডিশান ছিল। ছাত্রীর বাবাকে জব্বর এক আশ্বাস দিয়ে বসেছে বিশুমামা- 'আরে ভাববেন না, দ্বিজেনদাকে বলা আছে, অডিশানের দিনে সন্তোষ সেনগুপ্তকে একটা চিঠি দিয়ে দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।' গতকাল মেয়েটার বাবা চিঠি আনতে রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুর আসছেন আর মামা তাঁকে দেখতে পেয়েই অন্য একটা চলন্ত বাসে উঠে পালাতে গেছে।
- তারপর?
- তারপর সে এক কাণ্ড, স্লিপ করে পড়ে বাসের পেছনের চাকায় কোমরে ধাক্কা লেগে সাংঘাতিক অবস্থা। আজ সকালে দুর্গাপুর স্টীলের হাসপাতালে একটা অপারেশন হওয়ার কথা।

মামা পরে বেঁচে ওঠেন ঠিকই, তবে প্যানক্রিয়াসে আর ইউরেথ্রাতে একটা স্থায়ী বিকৃতি থেকে যায়। হারিয়ে যায় বিশুমামার সেই নায়কোচিত চেহারা আর গুল দেওয়ার সেই স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষমতা।

Saturday, December 5, 2015

বাংলা ছোটগল্প- হা ঈশ্বর

হা ঈশ্বর ।।
(সব চরিত্র কাল্পনিক)



-‘বাবা, দেখেছ আজকের নবজীবন টাইমসে ডাঃ গোডবোলের লেখাটা? লিখেছেন, ‘হে ঈশ্বর, আমার অপরাধ নিয়ো না। যদি তুমি থেকেই থাক কোথাও, আমার এ বিদ্যে-বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা সব তোমারই দান। সেই বিদ্যে-বুদ্ধি দিয়ে আমি তোমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে পারছি না, সে অক্ষমতার দায় কিন্তু তোমার।‘ একেবারে নতুন ধরণের কথা, তাই না?’

সদ্য জার্নালিজমে দীক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ভাল তর্ক করতে পারেন না বরোদার অবধেশ মন্দিরের পুরোহিত প্রধান কৈলাশপতি ত্রিবেদী। তাই তিনি সোজা কথা বলে দিলেন- ‘পিপীলিকা পক্ষ ধরে মরিবার তরে। এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি ঈশ্বরই তাকে দেবেন।‘
-‘বাবা, কথাটা কিন্তু ওরিজিনালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নাস্তিক নায়কের উক্তি। তবে একটা কথা, ডাঃ গোডবোলে কিন্তু নাস্তিক নন। তিনি ঈশ্বর মানেন। কিন্তু মানেন না দেবতা, স্বর্গ-নরক, পুনর্জন্ম, পাপ-পুণ্য বা এ বিষয়ে বেদ-উপনিষদে যা বলা হয়েছে সে সব। তিনি কলকাতার বিখ্যাত দার্শনিক ডাঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের ছাত্র ছিলেন। তাই মনে করেন যে বেদ-বেদান্তে যে অসংখ্য দেবতার বর্ণনা আর যজ্ঞ-প্রণালীর বর্ণনা আছে তা মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য জাগতিক সমস্যা বা সৃষ্টি রহস্যের একটা কাল্পনিক সমাধান।’
-‘দেখো মা, দর্শন-টর্শন আমিও একটু-আধটু পড়েছি। শঙ্করের অদ্বৈতবাদের আমি বিরোধী নই। তবে ঐ নাস্তিক বাঙ্গালিগুলোর সাথে থেকে একজন মারাঠা ব্রাহ্মণের মতিচ্ছন্ন হবে একথাও মেনে নেওয়া যায় না।‘
-‘কিন্তু বাবা, উনি প্রতিটি কথার যুক্তি দিয়ে...'
- ‘থামো’, এবার গর্জে উঠলেন কৈলাশপতি। ‘ওই বিধর্মীগুলোকে আমার জানতে বাকি নেই। জানো, টেগোর ব্রাহ্ম ছিলেন আর সুকুমারী খৃষ্টান? ওরা তো সনাতন ধর্মের কুৎসা করবেই। তাছাড়া বাঙালি জাতটার তো কোনকালেই বর্ণভেদ, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে কোনও সংস্কার ছিল না। ওরা গোমাংস খায়, ওদের ব্রাহ্মণরা, বিধবারা পর্যন্ত আমিষ খায়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর আর ডিরোজিও সাহেব এদের মাথাটি খেয়েছেন। ওরা আবার সনাতন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কী কথা বলবে! আমি বলছি গোডবোলে শাস্তি পাবে, বিধাতার চরম শাস্তি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।‘
বাবার মেজাজ দেখে আর কথা বাড়াল না শৈলজা। ভয়েই চুপ করে গেল।

ইদানীং কদিন ধরে মন্দিরের গুপ্তকক্ষে মাথায় লাল কাপড় বাঁধা কিছু উগ্র আর গোঁড়া হিন্দুভক্তের আসা-যাওয়া, বাবার সঙ্গে দিনের পর দিন তাদের পরামর্শ কিন্তু শৈলজার নজর এড়ায় না। ইতিমধ্যে গোডবোলে নবজীবন পত্রিকা ও মহারাষ্ট্র টাইমসে লিখে ফেলেছেন আরো গোটাতিনেক বলিষ্ঠ রচনা, সবই ধর্মের ধ্বজাধারী দালালদের উদ্দেশ্যে। তাতে বাদ যায়নি ভণ্ড সাধুদের কাণ্ডকারখানা, ধার্মিক সংগঠনগুলোর কালো টাকার পরিমাণ, গণেশ-মূর্তির দুগ্ধপান থেকে মাহিমে সমুদ্রের জলের মিষ্টতার রহস্য বা মক্কায় হজযাত্রীদের স্ট্যাম্পীডের ঘটনা- কোন কিছুই।

সাপের লেজে পা দিলে সাপ কি ছেড়ে কথা কয়? একদিন সকালে জগিং-এ বেরিয়েছিলেন ডাঃ গোডবোলে, ঘরে ফিরল তাঁর মৃতদেহ পুলিশের গাড়ি চড়ে। দুজন মোটোর-বাইক আরোহী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তাঁর কপালে।

সেদিন বিকেলে নবজীবনের সম্পাদকের ফোন এল শৈলজার কাছে। ‘মিস ত্রিবেদী, এই ঘটনাটার উপর একটা স্পেশ্যাল রিপোর্ট চাই। পরপর তিনজন রেশনালিস্ট খুন হলেন দেশের বিভিন্ন জায়গার, প্রকাশ্য দিবালোকে। ডাঃ দাভোলকার, ডাঃ কালবুর্গি, ডাঃ গোডবোলে তো বটেই, প্রয়োজনে বাংলাদেশের সম্প্রতি-নিহত ব্লগারদের আর শ্রীলঙ্কার যুক্তিবাদী ডাঃ কোভুরের কেসটাও তুলনায় নিয়ে এসো। পারলে কলকাতার যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের সাথেও কথা বলে দেখো।‘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে এডিটার ফোন রাখলেন।

উত্তেজিত শৈলজা নিজেও। অল্প দিনের সাংবাদিক জীবনে এরকম হাই-প্রফাইল কেস সে কখনও হ্যান্ডেল করেনি। সেই সন্ধ্যেতেই সে ছুটল সয়াজীবাগের ধার ঘেঁষে ডাঃ গোডবোলের বাসায়। তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এক সৌম্য সুদর্শন যুবক, নাম জানা গেল মুকুন্দ গোডবোলে। তিনি নিজেই জানালেন যে তিনি মহারাজা সয়াজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বর্গত ডাঃ মধুসূদন গোডবোলের কনিষ্ঠ পুত্র, বছর তিন হল এম-এস-ইউ তে সংখ্যাতত্বের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।

-‘বাবার পরিচয় তো নিশ্চয় আপনার অজানা নয়’, সোজাসুজি মূল প্রশ্নে এসে পড়লেন মুকুন্দ, ‘আর তদন্ত যা করার সে তো পুলিশেই করবে। তাহলে আপনার ভূমিকাটা এখানে কিসের?’
-‘আপনার কথা ঠিক। আমার কাজ খুনের তদন্ত করা নয়, যদিও সেটা জানা বা লোককে জানানোটা আমাদের নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে আমাদের মেন কনসার্ন হল যেভাবে একের পর এক যুক্তিবাদী যিনি ধর্মান্ধতা বা অন্ধবিশ্বাস, তথাকথিত ধর্মগুরুদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজে ব্রতী হয়েছেন তাঁদেরকে এক এক করে খুন করা হচ্ছে- এ আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমরা কি এখনও নিজেদেরকে সভ্য-পরিচয় দেওয়ার যোগ্য আছি, না প্রস্তর-যুগের অসভ্য-বর্বরতার দিকে ফিরে যাচ্ছি?’
-‘না মিস ত্রিবেদী, নিওলিথিক-চ্যাল্কোলিথিক মানুষদের অসভ্য-বর্বর বলার কোনও অধিকার আমাদের নেই। তারা হত্যা করত নিতান্তই জৈব প্রয়োজনে। তাদের ধর্ম বলে কিছু ছিল না, তাই ধর্মান্ধতার কোনও প্রশ্নই আসে না। জানেন, আমার বাবা টেগোর থেকে পড়ে শোনাতেন-
‘ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।.......
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা-
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা!‘ ‘

-‘তবু কারা আপনার বাবাকে মেরেছে বলে আপনার মনে হয়?’
- ‘তা বলতে পারব না, তবে দুজনেরই মাথায় লাল ফেট্টি আর কপালে সিঁদুরের টিপ ছিল।‘
চকিতে চমকে ওঠে শৈলজা। মনে পড়ে মন্দিরে কিছু সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা। মুহূর্তে সবকিছু যেন পরিষ্কার হয়ে যায় চোখের সামনে। কোনমতে একগ্লাস জল চায় সে মুকুন্দের কাছে।
- ‘আমি স্ট্যাটিস্টিক্সের কিছুই বুঝিনা, প্রফেসার গোডবোলে, কিন্তু সামান্য পরিচয়ে আপনাকে যেটুকু দেখলাম তাতে মনে হল আপনি আপনার বাবার একজন যোগ্য উত্তরসূরী, গর্ব করতে পারেন তাঁকে নিয়ে। আমার কিন্তু সে সৌভাগ্য হল না‘- শৈলজা কথাটা বলেই ফেলল।
- ‘ তা কেন, আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, সঙ্গত কারণেই আপনার যুক্তিবাদী হওয়ার, গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ওঠার অধিকার আছে। আর এ ব্যাপারে আমি যদি বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারি, সে আমার সৌভাগ্য বলে মনে করব। আপনি প্লীজ এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা রাখবেন না।‘

বাড়িতে ফিরে ভারাক্রান্ত মনে শুয়ে পড়ল শৈলজা। পরদিন ঘুম ভাঙ্গল রোজকার মত বাবার গলায় সন্ত নরসি মেহেতার রচিত ভজন শুনে-
“বৈষ্ণব জন তো ত্যয়ন কহিয়ে জে
পীড় পরায়ে জানে রে -
পরদুখে উপকার করে তোয়ে
মন অভিমান না আন রে।।“

আজ কিন্তু বাবার গলায় এই গান তার কাছে ভণ্ডামির নামান্তর বলেই মনে হল। প্রবলপ্রতাপ পুরোহিত কৈলাশপতি ত্রিবেদী এখনও জানেন না যে দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের জন্ম হয়েছে তাঁরই অজ্ঞাতসারে, তাঁরই চোখের সামনে। আর ক'দিন পরে বুঝি বা তার জন্যেও কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ ঈশ্বরকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো তাঁরই।

গল্প তবু গল্প নয়- 'মহাপ্রভু'


গল্প তবু গল্প নয়।

মহাপ্রভু।


'রাজা বললেন, যে আমার মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথেই আমার মেয়ের ‘বিয়ে দেব‘- রামাই বলল। পরমুহূর্তেই তার অনুযোগ, ‘দেখুন ঠাকুর কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না!’
- ‘ওরে কেষ্টা, হুঁ বলরে ব্যাটা’, মহাপ্রভু কেষ্টাকে মৃদু ভর্ত্‌সনা করায় কেষ্টা অস্ফুট-স্বরে ‘হুঁ’ বলল। গল্প আবার শুরু হল।
তবে গল্পেরও গল্প থাকে। কে এই মহাপ্রভু? কারাই বা রামাই আর কেষ্টা- জানতে হলে আমাদের একটু কাশীপুর-পঞ্চকোট রাজবাড়ির ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিতে হবে। তবে প্রসঙ্গতঃ জানাই যে এ ইতিহাস কোনও বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ অবস্থায় হয়ত পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন স্থানীয় লোকের স্মৃতিচারণে আর ১৯২৮ সালে পাটনার প্রকাশিত একটি সরকারি গেজেটের সূত্র ধরেই এ কাহিনীর অবতারণা।

মানভূম-পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজাদের কথা বাংলার ইতিহাসে আছে। সেখানে গৌড়বঙ্গের প্রাচীনতম শিখর-বংশীয় রাজত্বের পত্তন হয় ২১০০ বছর আগে পুরুলিয়ার ঝালিদহ বা ঝালদা গ্রামে মধ্যভারতের ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেওয়ের ভ্রমবশতঃ পরিত্যক্ত ও অনার্য সর্দারদের দ্বারা পালিত পুত্র দামোদর শেখর দ্বারা। তারপরের ১৯০০ বছর কাল ধরে রাজধানীই স্থানান্তরিত হয় সাতবার, ৮১ জন রাজপুরুষ সিংহাসনে আসীন হন। মহারাজ কীর্তিনাথ শিখর ৯২৮ খৃষ্টাব্দে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে রাজধানী স্থাপনা করেন ও উনবিংশ শতাব্দীতে বর্গীদের আক্রমণে সে গড় ধ্বংস হলে রাজধানী নিয়ে আসা হয় কাশীপুরে।

আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশীয় ত্রিলোচন আচার্য নামে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তীর্থ-ভ্রমণকালে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলে একটি মন্দিরে কিছুদিন বিশ্রাম করেন। তাঁর শরীর থেকে নির্গত দিব্য-জ্যোতির কথা লোকমুখে শুনে পঞ্চকোটের তখনকার রাজা শত্রুঘ্ন ওরফে গরুড় নারায়ণ সিংহদেও তাঁকে দর্শন করতে আসেন ও তাঁর শিষ্যত্ব নিতে চান। আচার্য রাজী না হলেও তাঁর ভাইকে একাজের জন্যে মনোনীত করেন। এভাবেই ১৬৫১ সালে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশের শ্রী রঙ্গরাজ রাজগুরু হিসেবে পঞ্চকোট আসেন। অচিরেই তিনি পরিবার ও বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন তামিলনাডু থেকে পাঞ্চেত নিয়ে আসেন। নিকটস্থ বেরো পাহাড়ের পাদদেশে বেরো বা গদিবেরো নামক ৫৭ ১/২ খানি মৌজা নিয়ে তৈরি গ্রামটি দেবোত্তর স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদেরকে থাকার জন্যে উৎসর্গ করা হয় ও তাঁরা এখানে অধিষ্ঠিত দেবতা কেশব রায় জিউর সেবাইত নিযুক্ত হন। এই বংশের পুরুষরা মহাপ্রভু নামে বংশানুক্রমে বেরো গ্রামে থেকে আসছেন ও ঠাকুর কেশব রায় জিউর মন্দিরে মোহান্তরূপে কাজ করে আসছেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন মহারাজা নীলমণি সিংদেও পঞ্চকোট থেকে কাশীপুরে রাজধানী নিয়ে আসেন তখন মহাপ্রভু বংশের মহান্ত রাজগোপাল আচারি গোস্বামী ছিলেন গুরুদেব। ইনি পরোপকারি, দয়ালু ও আত্মভোলা মানুষ হিসেবে অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনিই বেরোয় প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনা করেন ও পরবর্তীকালে মেয়েদের শিক্ষারও প্রসার ঘটান। আমাদের এই কাহিনী মহাপ্রভু রাজগোপাল আচারিকে নিয়েই, না উনি গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারির কেউ হতেন না। বরং ততদিনে আয়েঙ্গার গুরুবংশের এই বাহ্মণ পরিবার ও চল্লিশেরও বেশী তাদের আত্মীয়স্বজনের পরিবার তামিল ভাষা ভুলে মানভুমের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। শুধু তাঁদের যাজ্ঞিক ক্রিয়াকর্ম, পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান এখনও কাঞ্চীর বৈদিক নিয়মমতে হয়ে থাকে। এমনকি বিয়ের কনেও আসে তামিলনাডু থেকে যিনি হয়ত একবর্ণও বাংলা বা মানভুমের ভাষা বোঝেন না, চরম নিগ্রহ ভোগ করতে হয় তাঁকে তার ফলে।

আপাততঃ তাহলে ফিরি আমাদের গল্পে। আমাদের এই আপনভোলা মহাপ্রভুটির দুটি নেশা ছিল, এক আফিমের ও দুই গল্প শোনার। প্রতি সন্ধ্যায় ঈশ্বরনাম শেষে শুরু হত তাঁর মৌতাত। কেষ্টা নামে ভৃত্যের দায়িত্ব ছিল আফিম আর অনুপান হিসেবে ঘন করে জ্বাল দেওয়া সর-পূর্ণ দুধের বাটির যোগান দেওয়ার। তেলেঙ্গানা থেকে আমদানি করা ধূর্ত ভৃত্য রামাইএর কাজ ছিল প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্যে প্রতি সন্ধ্যায় গল্প শোনানোর। সে গল্প হয়ত এভাবেই শুরু হত।
- ‘নে রামাই, এবার ধর। খবর্দার, একগাদা দুক্‌খু-টুক্‌খু আনবি নে কিন্তু বলে দিচ্ছি।‘ প্রভু বলতেন।
- ‘না আজ্ঞে, তাই কি করি! তবে কেষ্টাকে বলে দিন যেন প্রতি কথার শেষে হুঁ দেয়। না হলে আমার গল্প-বলার মেজাজ আসবে না কিন্তু, বলে দিচ্ছি।‘
- ‘সে ভাবিস নে। কেষ্টার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে হুঁ দেবে না!’
গল্প শুরু হয়। এক অজানা দেশের রাজার সবরকম সমৃদ্ধির মাঝে থেকেও এক অদ্ভুত বেদনার উপাখ্যান। রাজার একমাত্র মেয়ের অতুল রূপরাশি, শিক্ষা-দীক্ষাতেও অসামান্যা, অথচ কথা বলতে পারেন না। রাজা কী করেননি মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে! ডাক্তার-বদ্যি, সাধু-সন্ন্যিসি, তাগা-তাবিজ, জলপড়া-মন্ত্রপড়া কিছুই বাদ দেন নি । তবু সবই বৃথা।
-‘এইবার তুই মার খাবি রামাই। মানা করলেম না এমন দুঃখের গল্প বলতে।‘ রামাই দেখে প্রভুর দুচোখে জল।
-‘তা যদি বলেন, মহাপ্রভু, অন্য গল্প বলি?’
-‘তা কি হয় রে ব্যাটা! শুরু করেছিস যখন শেষ তো করতেই হবে। তা হ্যাঁরে, রাজা আমাদের কেশব জিউএর থানে মানত করে নাই?’
-‘তা তো জানি না ঠাকুর, কি জানি ওরা হয় তো কেশব জিউএর নামই শোনে নি।‘
- ‘দাঁড়া একটু’, এই বলে প্রভু ঘরের ভেতর থেকে পাঁচটি সিকি এনে দেন রামাইএর হাতে ‘যা তো কাউকে পাঠিয়ে দে, এক্খুনি একটা পুজো দিয়ে মানত করে আসুক বাবার মন্দিরে।‘ ধূর্ত রামাইএরই লাভ, যদিও কেষ্টাটাকে চার আনা বখরা দিতে হবে, সে জানে।
- ‘তারপর কি হল রে, রামাই?’ প্রভুর আদেশে রামাইকে আবার গল্প শুরু করতে হয়।
- ‘তারপর হুজুর, বহু চিকিৎসা, বহু পুজো-আচ্চা করেও যখন কিছু হল না, মহারাজ একটা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। যে রাজকন্যের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথে রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে। দেখুন ঠাকুর, কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না, কিন্তু!’
- ‘হুঁ, হুঁ,’ কেষ্টা চোখ রগড়ে বলে ওঠে, রামাই খুশি।
- ‘বহু লোক এল, গেল, অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু ফল কিছুই হল না। রাজকন্যে অমনি উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে। শেষে একদিন রাজার বাড়িতে একটা চোর ঢুকল।‘
-‘বলিস কি রে, রাজবাড়িতে চোর! পাহারা ছিল না?’
- ‘সে আমি কি জানি। পাহারাদার হয়ত আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছিল’- বলেই জিভ কাটল রামাই। ভাগ্যিস প্রভু কথাটা খেয়াল করেন নি। ‘না না, চোর ব্যাটা ছিল মহা ধূর্ত। সবার চোখ এড়িয়ে সে সিঁধ কেটে ঢুকল রাজকন্যার শোবার ঘরে।‘
- ‘কেন, রাজকন্যের শোবার ঘরে কেন? ওরে রামাই, তোর পেটে পেটে শয়তানি আমি জানি। রাজার মেয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, নীলমণিকে বলে তোকে তাড়াব আমি।‘
- ‘তার আমি কি জানি ঠাকুর। চোর কি আমায় বলে ঢুকেছে!’
- ‘হেই নে বাপ, আমার এই আংটিখান। চোরকে বল এটুকু নিয়ে সরে পড়তে। দেখিস বাবা রাজকন্যের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।‘
রামাইয়ের তো আজ পোয়াবারো, তার লাভের পর লাভ।

- ‘ঠিক আছে ঠাকুর। তা আপনার আশীর্বাদে চোর রাজকন্যাকে কিছু করল না। তার শোবার ঘরের লাগোয়া ছিল ঠাকুর ঘর, ও সেদিকেই এগিয়ে গেল। এদিকে রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। তার সামনে দিয়েই চোর ঢুকে গেল ঠাকুরঘরে। তারপর ধীরে ধীরে - ও ঠাকুর, কেষ্টা চুপ করে আছে, আমি আর বলব না’- রামাই চেঁচিয়ে ওঠে।
- ‘কেষ্টা, তুই এবার মার খাবি হারামজাদা! হুঁ দিস না ক্যানে?’ অনেক হাতে পায়ে ধরে এ যাত্রা উদ্ধার পেল কেষ্টা।
- ‘চোর তারপর গৃহদেবতার সোনার মুকুটখানি খুলে নিয়ে পালাতে গেল রাজকুমারীকে পার করে।‘
-‘তারপর’- রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করেন মহাপ্রভু।
- ‘তারপর হঠাৎ কোত্থেকে কি হয়ে গেল রাজকন্যা চোর চোর বলে চিৎকার করে উঠল।‘
- ‘বলিস কি রে! তারপর?’
- ‘তারপর তো লোকজন ছুটে এল। তারা তো প্রথমেই চোরকে ধরে বাঁধতে গেল। তারপর অবাক হয়ে দেখে রাজকন্যা কথা বলছেন। রাজা-রানী ছুটে এলেন। সবার চোখে আনন্দে জল চলে এল।‘
- ‘ভগবান আছেন, বুঝলি রে রামাই, ভগবান আছেন। বড় জাগ্রত ঠাকুর আমাদের কেশব রায় জিউ।‘ মহাপ্রভু পরম বিশ্বাসে বললেন।
- ‘কিন্তু ঠাকুর, একটা সমিস্যে হল তারপর, সেটা কেউ সমাধান দিতে পারছে না। কথা হল রাজা কি এখন চোরকে শাস্তি দেবেন না তাকে নিজের জামাই করবেন? ওনারা এখনও ভাবছেন গুরুজি! এখন আপনি যদি এর একটা বিহিত করেন।‘
- ‘তাই তো রে, আমি পূজারি পণ্ডিত, আমি এসব সামাজিক সমিস্যের কি জানি। ঠিক আছে, কাল সকালে রাজা নীলমণিকে একবার তলব দিস তো, দেখা যাক কি বলেন।‘
পাঠকরা জেনে রাখুন গুরুদেবের ডাকে রাজার না এসে থাকার ক্ষমতা ছিল না, যতই তিনি শিশুর মত আপনভোলা মানুষ হন না কেন। পরদিন সকালে রাজা এসে মহাপ্রভুকে প্রণাম করলেন। গুরুদেবের প্রশ্নের উত্তরে সমস্যার একটা সমাধানও তিনি দিলেন। তাঁর মতে চোর যখন চুরির উদ্দেশ্যে রাজবাড়িতে ঢুকেছে ও হাতেনাতে ধরা পড়েছে, শাস্তি তার পাওনা। তবে চুরি করতে পারেনি বলে তাকে মোটামুটি দু-বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়াই উচিৎ।
-‘তার পরে?’
- ‘তার পর কথামত সেই চোর হবে রাজার জামাতা। চোর বলে রাজা তো তাঁর কথার খেলাপ করতে পারেন না।

গুরুদেব অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ডাকলেন, ‘মহারাজ’।
- ‘আজ্ঞা করুন গুরুদেব।‘
- ‘আমি যদি বেতাল হতাম, তোমাকে আজ বিক্রমাদিত্যের উপাধি দিতাম। তা যখন হবার নয়, আপাততঃ মন্দিরেই এসো, কেশবজিউএর পূজার প্রসাদ খেয়ে যাও।

আজ আর মহাপ্রভু নেই, নেই পঞ্চকোট বা কাশীপুরের সিংদেও রাজারা। রাজবংশের ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন পরিচয়ে। মহাপ্রভু বংশ ও কুটুম্বের লোকজনদের মধ্যে কেউ হয়েছেন পাটনা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল (ডাঃ গোবিন্দাচারি), বা কেউ বিখ্যাত নিউরো-সার্জন (ডাঃ এন কে আচারি), বা স্বাধীনতা-সংগ্রামী (শ্রী রাঘব আচারি) কিংবা সাংসদ (শ্রী বাসুদেব আচারি) ইত্যাদি। সব ঘটনার সাক্ষী পঞ্চকোট পাহাড় তো সদাই নীরব- শুধু দামোদর নদ কুলুকুলু শব্দে একমনে বয়ে চলেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে।

মুম্বাই, ২৯শে অক্টোবর, ২০১৫।
-

বাংলা বিবিধ- যাচ্ছেতাই (২)

#বিশুমামা_জিন্দাবাদ

(গুল্প)

পরিচয়-পর্ব।

বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী ওরফে আমাদের বিশুমামার একটা প্রাথমিক পরিচয় আগের পর্বে (উলানবাটোরের ওস্তাদ) দিয়েছি। এবার একটু বাস্তব প্রসঙ্গে আসি। আমার বিশুমামা একটি রহস্যময় মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার, এবং পৃথিবীর যাবতীয় অর্থকরী কাজেই অকৃতকার্য। তবে তার জন্যে তাঁর মনে কোনও ক্ষোভ ছিল না। তিনি যখন তখন লোকালয় থেকে উধাও হয়ে যেতেন, কখনও পন্ডিচেরির অরবিন্দ-আশ্রমে, কখনও অযোধ্যা আবার কখনও বা হরিদ্বারের কনখলে মা আনন্দময়ীর আশ্রমে গিয়ে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতেন পাঁচ-ছয় মাস। আবার ফিরে আসতেন অভিজ্ঞতার ঝুলিটি ভরে নিয়ে। সে সব দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে বড় আনন্দের। তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল গানের গলাটি। বিশ্বভারতী সংগীতবিভাগে ডিপ্লোমা নিয়ে এখানে ওখানে বেশ কিছুদিন ক্লাস করে যখন বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন, তখনই হঠাৎ নিরুদ্দেশ যাত্রা করলেন। ফিরে এসে কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলে পলাতকের গান গেয়ে উত্তর দিতেন-
'খেয়াল-পোকা যখন আমার মাথায় নড়ে-চড়ে
আমার তাসের ঘরের বসতি যে অমনি ভেঙে পড়ে।
তখন তালুক ছেড়ে মুলুক ছেড়ে হই যে ঘরের বার, বন্ধু রে......।'

সেদিন বিকেলে কানু-সুজয় আসাতে প্রথম উনি এবার মুখ খুললেন।
- উঃ, এবার পণ্ডিচেরি আশ্রমে কাদের দেখলাম, তোরা বললে বিশ্বাস করবি না!
- বিশ্বাস করেছি কখনও? সুজয়ের উত্তরটা একটু বাঁকা শোনাল।
- একত্রে তিনমূর্তি- দিলীপ রায়, সাহানা দেবী আর নলিনীকান্ত।
- নলিনী গুপ্ত? আমি জানতে চাইলাম।
- না রে বোকা, ইনি সরকার। নজরুল, দিলীপ রায়দের বন্ধু, দাদাঠাকুরের জীবনী লিখেছিলেন। বন্ধু সজনী দাসের আগ্রহে ‘শনিবারের চিঠি’তে রেগুলার লিখতেন।
ভাবি, যে লোকটার এত জ্ঞান, তার গুল দেওয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে।
তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত সেই নমস্য ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ নিয়ে। মুখে জর্দাপান নিয়ে দিলীপবাবু ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ বা ‘আজি এসেছি বঁধু হে’ কিভাবে গাইতেন, হুবহু নকল করে শোনাতেন বিশুমামা। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রী- রবীন্দ্রসংগীতের একজন দিক্‌পাল হয়েও কিভাবে দিলীপ রায়ের বন্ধু ও ভক্ত হয়ে উঠলেন, শোনাতেন সেসব অজানা কথা। জানিনা এর মধ্যে কতটা সত্যি থাকত। আমি মুম্বাইয়ে চাকরি করতে যাবার আগে উনি একজনের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা ব্যালার্ড পিয়ারে থাকেন, হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল গানের শিক্ষিকা। আমি রাজী হতে বললেন, গিয়ে আমার নাম করবি, তবে ফোন করে যাস, লতাজি-আশাজিরাও তাঁর কাছে শেখেন কিনা!
বোঝো ব্যাপারখানা! আমি কিন্তু পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম যে সত্যিই ঐ নামে এক মহিলা থাকেন সেখানে, লতা-আশা অনেকেই তাঁর কাছে ক্লাসিকাল শেখেন। কিন্ত আমি আর ভয়ে সেদিক মাড়াইনি। যদি গিয়ে শুনতাম যে উনি বিশুমামাকে চেনেন, বোধহয় ততটা আশ্চর্য হতাম না, যেভাবে সারপ্রাইজ দিতে দিতে তার ‘প্রাইজ’টাই নষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি।
পরে বিশুমামা বিশ্বভারতী থেকে গানের ডিপ্লোমা নিয়ে ফেরেন ও দুর্গাপুরে একটি স্কুলে গান শেখাতে শুরু করেন। তবে বোহেমিয়ান জীবনযাপনের জন্যে বেশ কয়েকবার বিতাড়িত হয়েছেন, আবার দুটো মিথ্যে কথা বলে ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। বাচ্চাদের গান শেখানোর ওনার একটা সহজাত প্রতিভা ছিল। উনি ‘সাউণ্ড অফ ম্যুজিক’ স্টাইলে সা-রে-গা-মা শেখাতেন যেমন- সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা/ সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা ‘র সুরে গেয়ে শোনাতেন- ‘ন-মো-ন-মো বী-না-পা-ণি/ ন-মো-বা-ণী-না-রা-য়-ণী’। একদিন এসেছেন শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসার ডাঃ ভূপেন হাজারিকার কাছে একটা ওয়ার্কশপ করে। তারপর বলাকওয়া নেই, আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন কলাবতী রাগ নিয়ে। গেয়ে শোনালেন ভূপেনের অপ্রকাশিত গান-
‘দু-দিনের জীবনে কি পাই কে জানে,
তাই সুরে-বেসুরে, তালে-বেতালে
গান গেয়ে আনন্দ পাই-
সা-ণি-ধা-পা, ণি-ধা-পা, ধা-পা-গা রে,
গেয়ে যাই।- এই দ্যাখ, কলাবতী জানিস না! সা-গা-পা-ধা-ণি-ধা-পা-র্সা, র্সা-ণি-ধা-পা, গা-পা-গা-সা-ণি্‌-ধা্‌-সা.....'.বলে শুরু করতেন ধনঞ্জয় স্টাইলে সলিলের গান - 'জানিনা কখন কোথায় তুমি থাক, জানিনা মনে রাখ কি না রাখ...'
-'জানিস, সলিলের সুরে সত্যেন দত্তের ‘পাল্কির গান’ এর আগে বেরিয়ে যায় ভূপেনজির ‘দোলা’ – অসমীয়া ভাষায়, সাড়া জাগায় কাব্যগীতি হিসেবে।' বলেই হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে গেয়ে উঠতেন-
“হে দোলা,
অ্যাঁকাব্যাঁকা বাটে রে, করিআঁহু করিআঁহু
বর বর মানুহর দোলা।
হে আপোন করিলো বনুয়ার জিয়নক
দেহা ভাগোরাই তোলা হে দোলা।
হেই রেইয়া না, রেইয়া না, রেইয়া না।।‘
এই বিশুমামার সেই স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছ্বাসটা একদিন প্রায় হারিয়ে গেল একটা বিশ্রী দুর্ঘটনায়। বারান্তরে সেসব বলা যাবে।