গল্প তবু গল্প নয়।
মহাপ্রভু।
'রাজা বললেন, যে আমার মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথেই আমার মেয়ের ‘বিয়ে দেব‘- রামাই বলল। পরমুহূর্তেই তার অনুযোগ, ‘দেখুন ঠাকুর কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না!’
- ‘ওরে কেষ্টা, হুঁ বলরে ব্যাটা’, মহাপ্রভু কেষ্টাকে মৃদু ভর্ত্সনা করায় কেষ্টা অস্ফুট-স্বরে ‘হুঁ’ বলল। গল্প আবার শুরু হল।তবে গল্পেরও গল্প থাকে। কে এই মহাপ্রভু? কারাই বা রামাই আর কেষ্টা- জানতে হলে আমাদের একটু কাশীপুর-পঞ্চকোট রাজবাড়ির ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিতে হবে। তবে প্রসঙ্গতঃ জানাই যে এ ইতিহাস কোনও বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ অবস্থায় হয়ত পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন স্থানীয় লোকের স্মৃতিচারণে আর ১৯২৮ সালে পাটনার প্রকাশিত একটি সরকারি গেজেটের সূত্র ধরেই এ কাহিনীর অবতারণা।
মানভূম-পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজাদের কথা বাংলার ইতিহাসে আছে। সেখানে গৌড়বঙ্গের প্রাচীনতম শিখর-বংশীয় রাজত্বের পত্তন হয় ২১০০ বছর আগে পুরুলিয়ার ঝালিদহ বা ঝালদা গ্রামে মধ্যভারতের ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেওয়ের ভ্রমবশতঃ পরিত্যক্ত ও অনার্য সর্দারদের দ্বারা পালিত পুত্র দামোদর শেখর দ্বারা। তারপরের ১৯০০ বছর কাল ধরে রাজধানীই স্থানান্তরিত হয় সাতবার, ৮১ জন রাজপুরুষ সিংহাসনে আসীন হন। মহারাজ কীর্তিনাথ শিখর ৯২৮ খৃষ্টাব্দে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে রাজধানী স্থাপনা করেন ও উনবিংশ শতাব্দীতে বর্গীদের আক্রমণে সে গড় ধ্বংস হলে রাজধানী নিয়ে আসা হয় কাশীপুরে।
আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশীয় ত্রিলোচন আচার্য নামে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তীর্থ-ভ্রমণকালে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলে একটি মন্দিরে কিছুদিন বিশ্রাম করেন। তাঁর শরীর থেকে নির্গত দিব্য-জ্যোতির কথা লোকমুখে শুনে পঞ্চকোটের তখনকার রাজা শত্রুঘ্ন ওরফে গরুড় নারায়ণ সিংহদেও তাঁকে দর্শন করতে আসেন ও তাঁর শিষ্যত্ব নিতে চান। আচার্য রাজী না হলেও তাঁর ভাইকে একাজের জন্যে মনোনীত করেন। এভাবেই ১৬৫১ সালে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশের শ্রী রঙ্গরাজ রাজগুরু হিসেবে পঞ্চকোট আসেন। অচিরেই তিনি পরিবার ও বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন তামিলনাডু থেকে পাঞ্চেত নিয়ে আসেন। নিকটস্থ বেরো পাহাড়ের পাদদেশে বেরো বা গদিবেরো নামক ৫৭ ১/২ খানি মৌজা নিয়ে তৈরি গ্রামটি দেবোত্তর স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদেরকে থাকার জন্যে উৎসর্গ করা হয় ও তাঁরা এখানে অধিষ্ঠিত দেবতা কেশব রায় জিউর সেবাইত নিযুক্ত হন। এই বংশের পুরুষরা মহাপ্রভু নামে বংশানুক্রমে বেরো গ্রামে থেকে আসছেন ও ঠাকুর কেশব রায় জিউর মন্দিরে মোহান্তরূপে কাজ করে আসছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন মহারাজা নীলমণি সিংদেও পঞ্চকোট থেকে কাশীপুরে রাজধানী নিয়ে আসেন তখন মহাপ্রভু বংশের মহান্ত রাজগোপাল আচারি গোস্বামী ছিলেন গুরুদেব। ইনি পরোপকারি, দয়ালু ও আত্মভোলা মানুষ হিসেবে অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনিই বেরোয় প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনা করেন ও পরবর্তীকালে মেয়েদের শিক্ষারও প্রসার ঘটান। আমাদের এই কাহিনী মহাপ্রভু রাজগোপাল আচারিকে নিয়েই, না উনি গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারির কেউ হতেন না। বরং ততদিনে আয়েঙ্গার গুরুবংশের এই বাহ্মণ পরিবার ও চল্লিশেরও বেশী তাদের আত্মীয়স্বজনের পরিবার তামিল ভাষা ভুলে মানভুমের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। শুধু তাঁদের যাজ্ঞিক ক্রিয়াকর্ম, পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান এখনও কাঞ্চীর বৈদিক নিয়মমতে হয়ে থাকে। এমনকি বিয়ের কনেও আসে তামিলনাডু থেকে যিনি হয়ত একবর্ণও বাংলা বা মানভুমের ভাষা বোঝেন না, চরম নিগ্রহ ভোগ করতে হয় তাঁকে তার ফলে।
আপাততঃ তাহলে ফিরি আমাদের গল্পে। আমাদের এই আপনভোলা মহাপ্রভুটির দুটি নেশা ছিল, এক আফিমের ও দুই গল্প শোনার। প্রতি সন্ধ্যায় ঈশ্বরনাম শেষে শুরু হত তাঁর মৌতাত। কেষ্টা নামে ভৃত্যের দায়িত্ব ছিল আফিম আর অনুপান হিসেবে ঘন করে জ্বাল দেওয়া সর-পূর্ণ দুধের বাটির যোগান দেওয়ার। তেলেঙ্গানা থেকে আমদানি করা ধূর্ত ভৃত্য রামাইএর কাজ ছিল প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্যে প্রতি সন্ধ্যায় গল্প শোনানোর। সে গল্প হয়ত এভাবেই শুরু হত।
- ‘নে রামাই, এবার ধর। খবর্দার, একগাদা দুক্খু-টুক্খু আনবি নে কিন্তু বলে দিচ্ছি।‘ প্রভু বলতেন।
- ‘না আজ্ঞে, তাই কি করি! তবে কেষ্টাকে বলে দিন যেন প্রতি কথার শেষে হুঁ দেয়। না হলে আমার গল্প-বলার মেজাজ আসবে না কিন্তু, বলে দিচ্ছি।‘
- ‘সে ভাবিস নে। কেষ্টার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে হুঁ দেবে না!’
গল্প শুরু হয়। এক অজানা দেশের রাজার সবরকম সমৃদ্ধির মাঝে থেকেও এক অদ্ভুত বেদনার উপাখ্যান। রাজার একমাত্র মেয়ের অতুল রূপরাশি, শিক্ষা-দীক্ষাতেও অসামান্যা, অথচ কথা বলতে পারেন না। রাজা কী করেননি মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে! ডাক্তার-বদ্যি, সাধু-সন্ন্যিসি, তাগা-তাবিজ, জলপড়া-মন্ত্রপড়া কিছুই বাদ দেন নি । তবু সবই বৃথা।
-‘এইবার তুই মার খাবি রামাই। মানা করলেম না এমন দুঃখের গল্প বলতে।‘ রামাই দেখে প্রভুর দুচোখে জল।
-‘তা যদি বলেন, মহাপ্রভু, অন্য গল্প বলি?’
-‘তা কি হয় রে ব্যাটা! শুরু করেছিস যখন শেষ তো করতেই হবে। তা হ্যাঁরে, রাজা আমাদের কেশব জিউএর থানে মানত করে নাই?’
-‘তা তো জানি না ঠাকুর, কি জানি ওরা হয় তো কেশব জিউএর নামই শোনে নি।‘
- ‘দাঁড়া একটু’, এই বলে প্রভু ঘরের ভেতর থেকে পাঁচটি সিকি এনে দেন রামাইএর হাতে ‘যা তো কাউকে পাঠিয়ে দে, এক্খুনি একটা পুজো দিয়ে মানত করে আসুক বাবার মন্দিরে।‘ ধূর্ত রামাইএরই লাভ, যদিও কেষ্টাটাকে চার আনা বখরা দিতে হবে, সে জানে।
- ‘তারপর কি হল রে, রামাই?’ প্রভুর আদেশে রামাইকে আবার গল্প শুরু করতে হয়।
- ‘তারপর হুজুর, বহু চিকিৎসা, বহু পুজো-আচ্চা করেও যখন কিছু হল না, মহারাজ একটা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। যে রাজকন্যের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথে রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে। দেখুন ঠাকুর, কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না, কিন্তু!’
- ‘হুঁ, হুঁ,’ কেষ্টা চোখ রগড়ে বলে ওঠে, রামাই খুশি।
- ‘বহু লোক এল, গেল, অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু ফল কিছুই হল না। রাজকন্যে অমনি উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে। শেষে একদিন রাজার বাড়িতে একটা চোর ঢুকল।‘
-‘বলিস কি রে, রাজবাড়িতে চোর! পাহারা ছিল না?’
- ‘সে আমি কি জানি। পাহারাদার হয়ত আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছিল’- বলেই জিভ কাটল রামাই। ভাগ্যিস প্রভু কথাটা খেয়াল করেন নি। ‘না না, চোর ব্যাটা ছিল মহা ধূর্ত। সবার চোখ এড়িয়ে সে সিঁধ কেটে ঢুকল রাজকন্যার শোবার ঘরে।‘
- ‘কেন, রাজকন্যের শোবার ঘরে কেন? ওরে রামাই, তোর পেটে পেটে শয়তানি আমি জানি। রাজার মেয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, নীলমণিকে বলে তোকে তাড়াব আমি।‘
- ‘তার আমি কি জানি ঠাকুর। চোর কি আমায় বলে ঢুকেছে!’
- ‘হেই নে বাপ, আমার এই আংটিখান। চোরকে বল এটুকু নিয়ে সরে পড়তে। দেখিস বাবা রাজকন্যের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।‘
রামাইয়ের তো আজ পোয়াবারো, তার লাভের পর লাভ।
- ‘ঠিক আছে ঠাকুর। তা আপনার আশীর্বাদে চোর রাজকন্যাকে কিছু করল না। তার শোবার ঘরের লাগোয়া ছিল ঠাকুর ঘর, ও সেদিকেই এগিয়ে গেল। এদিকে রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। তার সামনে দিয়েই চোর ঢুকে গেল ঠাকুরঘরে। তারপর ধীরে ধীরে - ও ঠাকুর, কেষ্টা চুপ করে আছে, আমি আর বলব না’- রামাই চেঁচিয়ে ওঠে।
- ‘কেষ্টা, তুই এবার মার খাবি হারামজাদা! হুঁ দিস না ক্যানে?’ অনেক হাতে পায়ে ধরে এ যাত্রা উদ্ধার পেল কেষ্টা।
- ‘চোর তারপর গৃহদেবতার সোনার মুকুটখানি খুলে নিয়ে পালাতে গেল রাজকুমারীকে পার করে।‘
-‘তারপর’- রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করেন মহাপ্রভু।
- ‘তারপর হঠাৎ কোত্থেকে কি হয়ে গেল রাজকন্যা চোর চোর বলে চিৎকার করে উঠল।‘
- ‘বলিস কি রে! তারপর?’
- ‘তারপর তো লোকজন ছুটে এল। তারা তো প্রথমেই চোরকে ধরে বাঁধতে গেল। তারপর অবাক হয়ে দেখে রাজকন্যা কথা বলছেন। রাজা-রানী ছুটে এলেন। সবার চোখে আনন্দে জল চলে এল।‘
- ‘ভগবান আছেন, বুঝলি রে রামাই, ভগবান আছেন। বড় জাগ্রত ঠাকুর আমাদের কেশব রায় জিউ।‘ মহাপ্রভু পরম বিশ্বাসে বললেন।
- ‘কিন্তু ঠাকুর, একটা সমিস্যে হল তারপর, সেটা কেউ সমাধান দিতে পারছে না। কথা হল রাজা কি এখন চোরকে শাস্তি দেবেন না তাকে নিজের জামাই করবেন? ওনারা এখনও ভাবছেন গুরুজি! এখন আপনি যদি এর একটা বিহিত করেন।‘
- ‘তাই তো রে, আমি পূজারি পণ্ডিত, আমি এসব সামাজিক সমিস্যের কি জানি। ঠিক আছে, কাল সকালে রাজা নীলমণিকে একবার তলব দিস তো, দেখা যাক কি বলেন।‘
পাঠকরা জেনে রাখুন গুরুদেবের ডাকে রাজার না এসে থাকার ক্ষমতা ছিল না, যতই তিনি শিশুর মত আপনভোলা মানুষ হন না কেন। পরদিন সকালে রাজা এসে মহাপ্রভুকে প্রণাম করলেন। গুরুদেবের প্রশ্নের উত্তরে সমস্যার একটা সমাধানও তিনি দিলেন। তাঁর মতে চোর যখন চুরির উদ্দেশ্যে রাজবাড়িতে ঢুকেছে ও হাতেনাতে ধরা পড়েছে, শাস্তি তার পাওনা। তবে চুরি করতে পারেনি বলে তাকে মোটামুটি দু-বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়াই উচিৎ।
-‘তার পরে?’
- ‘তার পর কথামত সেই চোর হবে রাজার জামাতা। চোর বলে রাজা তো তাঁর কথার খেলাপ করতে পারেন না।
গুরুদেব অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ডাকলেন, ‘মহারাজ’।
- ‘আজ্ঞা করুন গুরুদেব।‘
- ‘আমি যদি বেতাল হতাম, তোমাকে আজ বিক্রমাদিত্যের উপাধি দিতাম। তা যখন হবার নয়, আপাততঃ মন্দিরেই এসো, কেশবজিউএর পূজার প্রসাদ খেয়ে যাও।
আজ আর মহাপ্রভু নেই, নেই পঞ্চকোট বা কাশীপুরের সিংদেও রাজারা। রাজবংশের ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন পরিচয়ে। মহাপ্রভু বংশ ও কুটুম্বের লোকজনদের মধ্যে কেউ হয়েছেন পাটনা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল (ডাঃ গোবিন্দাচারি), বা কেউ বিখ্যাত নিউরো-সার্জন (ডাঃ এন কে আচারি), বা স্বাধীনতা-সংগ্রামী (শ্রী রাঘব আচারি) কিংবা সাংসদ (শ্রী বাসুদেব আচারি) ইত্যাদি। সব ঘটনার সাক্ষী পঞ্চকোট পাহাড় তো সদাই নীরব- শুধু দামোদর নদ কুলুকুলু শব্দে একমনে বয়ে চলেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে।
মুম্বাই, ২৯শে অক্টোবর, ২০১৫।
-
No comments:
Post a Comment