Saturday, December 5, 2015

বাংলা বিবিধ- যাচ্ছেতাই (২)

#বিশুমামা_জিন্দাবাদ

(গুল্প)

পরিচয়-পর্ব।

বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী ওরফে আমাদের বিশুমামার একটা প্রাথমিক পরিচয় আগের পর্বে (উলানবাটোরের ওস্তাদ) দিয়েছি। এবার একটু বাস্তব প্রসঙ্গে আসি। আমার বিশুমামা একটি রহস্যময় মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার, এবং পৃথিবীর যাবতীয় অর্থকরী কাজেই অকৃতকার্য। তবে তার জন্যে তাঁর মনে কোনও ক্ষোভ ছিল না। তিনি যখন তখন লোকালয় থেকে উধাও হয়ে যেতেন, কখনও পন্ডিচেরির অরবিন্দ-আশ্রমে, কখনও অযোধ্যা আবার কখনও বা হরিদ্বারের কনখলে মা আনন্দময়ীর আশ্রমে গিয়ে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতেন পাঁচ-ছয় মাস। আবার ফিরে আসতেন অভিজ্ঞতার ঝুলিটি ভরে নিয়ে। সে সব দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে বড় আনন্দের। তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল গানের গলাটি। বিশ্বভারতী সংগীতবিভাগে ডিপ্লোমা নিয়ে এখানে ওখানে বেশ কিছুদিন ক্লাস করে যখন বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন, তখনই হঠাৎ নিরুদ্দেশ যাত্রা করলেন। ফিরে এসে কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলে পলাতকের গান গেয়ে উত্তর দিতেন-
'খেয়াল-পোকা যখন আমার মাথায় নড়ে-চড়ে
আমার তাসের ঘরের বসতি যে অমনি ভেঙে পড়ে।
তখন তালুক ছেড়ে মুলুক ছেড়ে হই যে ঘরের বার, বন্ধু রে......।'

সেদিন বিকেলে কানু-সুজয় আসাতে প্রথম উনি এবার মুখ খুললেন।
- উঃ, এবার পণ্ডিচেরি আশ্রমে কাদের দেখলাম, তোরা বললে বিশ্বাস করবি না!
- বিশ্বাস করেছি কখনও? সুজয়ের উত্তরটা একটু বাঁকা শোনাল।
- একত্রে তিনমূর্তি- দিলীপ রায়, সাহানা দেবী আর নলিনীকান্ত।
- নলিনী গুপ্ত? আমি জানতে চাইলাম।
- না রে বোকা, ইনি সরকার। নজরুল, দিলীপ রায়দের বন্ধু, দাদাঠাকুরের জীবনী লিখেছিলেন। বন্ধু সজনী দাসের আগ্রহে ‘শনিবারের চিঠি’তে রেগুলার লিখতেন।
ভাবি, যে লোকটার এত জ্ঞান, তার গুল দেওয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে।
তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত সেই নমস্য ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ নিয়ে। মুখে জর্দাপান নিয়ে দিলীপবাবু ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ বা ‘আজি এসেছি বঁধু হে’ কিভাবে গাইতেন, হুবহু নকল করে শোনাতেন বিশুমামা। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রী- রবীন্দ্রসংগীতের একজন দিক্‌পাল হয়েও কিভাবে দিলীপ রায়ের বন্ধু ও ভক্ত হয়ে উঠলেন, শোনাতেন সেসব অজানা কথা। জানিনা এর মধ্যে কতটা সত্যি থাকত। আমি মুম্বাইয়ে চাকরি করতে যাবার আগে উনি একজনের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা ব্যালার্ড পিয়ারে থাকেন, হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল গানের শিক্ষিকা। আমি রাজী হতে বললেন, গিয়ে আমার নাম করবি, তবে ফোন করে যাস, লতাজি-আশাজিরাও তাঁর কাছে শেখেন কিনা!
বোঝো ব্যাপারখানা! আমি কিন্তু পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম যে সত্যিই ঐ নামে এক মহিলা থাকেন সেখানে, লতা-আশা অনেকেই তাঁর কাছে ক্লাসিকাল শেখেন। কিন্ত আমি আর ভয়ে সেদিক মাড়াইনি। যদি গিয়ে শুনতাম যে উনি বিশুমামাকে চেনেন, বোধহয় ততটা আশ্চর্য হতাম না, যেভাবে সারপ্রাইজ দিতে দিতে তার ‘প্রাইজ’টাই নষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি।
পরে বিশুমামা বিশ্বভারতী থেকে গানের ডিপ্লোমা নিয়ে ফেরেন ও দুর্গাপুরে একটি স্কুলে গান শেখাতে শুরু করেন। তবে বোহেমিয়ান জীবনযাপনের জন্যে বেশ কয়েকবার বিতাড়িত হয়েছেন, আবার দুটো মিথ্যে কথা বলে ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। বাচ্চাদের গান শেখানোর ওনার একটা সহজাত প্রতিভা ছিল। উনি ‘সাউণ্ড অফ ম্যুজিক’ স্টাইলে সা-রে-গা-মা শেখাতেন যেমন- সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা/ সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা ‘র সুরে গেয়ে শোনাতেন- ‘ন-মো-ন-মো বী-না-পা-ণি/ ন-মো-বা-ণী-না-রা-য়-ণী’। একদিন এসেছেন শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসার ডাঃ ভূপেন হাজারিকার কাছে একটা ওয়ার্কশপ করে। তারপর বলাকওয়া নেই, আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন কলাবতী রাগ নিয়ে। গেয়ে শোনালেন ভূপেনের অপ্রকাশিত গান-
‘দু-দিনের জীবনে কি পাই কে জানে,
তাই সুরে-বেসুরে, তালে-বেতালে
গান গেয়ে আনন্দ পাই-
সা-ণি-ধা-পা, ণি-ধা-পা, ধা-পা-গা রে,
গেয়ে যাই।- এই দ্যাখ, কলাবতী জানিস না! সা-গা-পা-ধা-ণি-ধা-পা-র্সা, র্সা-ণি-ধা-পা, গা-পা-গা-সা-ণি্‌-ধা্‌-সা.....'.বলে শুরু করতেন ধনঞ্জয় স্টাইলে সলিলের গান - 'জানিনা কখন কোথায় তুমি থাক, জানিনা মনে রাখ কি না রাখ...'
-'জানিস, সলিলের সুরে সত্যেন দত্তের ‘পাল্কির গান’ এর আগে বেরিয়ে যায় ভূপেনজির ‘দোলা’ – অসমীয়া ভাষায়, সাড়া জাগায় কাব্যগীতি হিসেবে।' বলেই হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে গেয়ে উঠতেন-
“হে দোলা,
অ্যাঁকাব্যাঁকা বাটে রে, করিআঁহু করিআঁহু
বর বর মানুহর দোলা।
হে আপোন করিলো বনুয়ার জিয়নক
দেহা ভাগোরাই তোলা হে দোলা।
হেই রেইয়া না, রেইয়া না, রেইয়া না।।‘
এই বিশুমামার সেই স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছ্বাসটা একদিন প্রায় হারিয়ে গেল একটা বিশ্রী দুর্ঘটনায়। বারান্তরে সেসব বলা যাবে।

No comments:

Post a Comment