(১)
আমি ১৯৮৩ সাল থেকেই ছিন্নমূল প্রবাসী। অবশ্য তার আগেও কখনও ঠিক বাংলায় থাকিনি, তবে বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) হলেও তাকে ঠিক প্রবাস বলা যায়না। ধানবাদ, বোকারো, রাঁচী, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, আসানসোল ও কালেভদ্রে কলকাতার পূজো দেখেছি জন্ম থেকে, সেগুলোকে সে অর্থে প্রবাসের পুজো বলতে চাই না। ৮৩ সালে চাকুরিসূত্রে মুম্বাই (তখন বোম্বে) এসে পড়লেও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পুজোয় প্রতিবার বাড়ি ফিরে গেছি, ৮৯এ প্রথম দেখি বোম্বের পূজা।
তখন বোম্বাই শহরে বাঙ্গালিরা অধিকাংশই ছিলেন খানদানী ও উচ্চশিক্ষিত, কারণ পশ্চিমবঙ্গে তখনও শিল্পোদ্যমে ভাঁটা পড়েনি, বঙ্গের সব ক্ষেত্রের সেরা বাঙ্গালিদের টেনে নিয়ে যেত ভারতের অন্য বড় শহরগুলি। অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে ফিল্মের টেকনিসিয়ান লাইনে আর সোনা-চাঁদী-হীরের কারিগরদের বড় কিছু দল ছিল সেখানে। তাদের হাত ধরেই বোম্বাই দুর্গাবাড়ি প্রথম দুর্গোৎসব শুরু করে ১৯৩০ সালে, ঝাবেরি বাজারে, সেখান থেকে ১৯৭১এ তা স্থানান্তরিত হয় কেম্পস কর্ণারের তেজপাল হলে। আমার সেটা বিয়ের বছর, স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি বেঙ্গল ক্লাবের পুজো দেখতে, দাদারের শিবাজী পার্কে। হঠাৎ কানে এল পাশের স্টেজে কেউ যেন মান্না দের নকল করে 'ও আমার মন যমুনার' গানটি গাইছেন। একজনকে শুধোতে তিনি বললেন, মান্না দের মত নয়, দাদা, মান্না দেই গাইছেন। মফঃস্বলে মানুষ, আমি তখনও ভাবতে পারতাম না যে হেমন্ত-কিশোর-লতা-মান্নাদেরও টিকিট না কেটে গাইতে দেখা যায়। আমাদের ছোট শহরেও একবার মান্না দে গেয়ে গেছেন, টিকিটের জন্যে সে কি হুড়োহুড়ি-মারামারি। যাই হোক, সেদিন প্রাণ ভরে মান্না দের সেরা বাংলা গানগুলো শুনেছিলাম।
না, কিশোর-লতা-আশাজীরা বারোয়ারি পুজোয় এভাবে গাইতেন না, তাছাড়া কিশোরজী তখন গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। ১৯৮৪ সালে মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ণ স্টেডিয়ামে কিশোর-লতার শেষ যুগ্ম অনুষ্ঠান হয়েছিল, উচ্চদরের টিকিট থাকা সত্ত্বেও অতবড় স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ভাল গান শুনতে চাও ত শক্তি সামন্তের পুজোয় ঘুরে এস, এক বন্ধু বললেন। শক্তি সামন্ত-প্রমোদ চক্রবর্তী-বাসু চ্যাটার্জি-শচীন ভৌমিক সবাই মিলে পুজো করে আসছেন বহু বছর ধরে, বম্বের সিনেমা জগতের বাঙালীদের সেটা প্রথম বারোয়ারি প্রয়াস। তার আগে প্রবাদপুরুষ শশধর মুখার্জি ও অশোককুমাররা নিজেদের বিশাল পরিবারকে একত্র করে সান্তাক্রুজে শুরু করেন শারদীয়া পূজা, যা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন কাজোল, রানী, দেবশ্রী, অমিতকুমার- বাপি লাহিড়ীরা, এখন শুধু ভেন্যু বদলে হয়েছে বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জুহুর সাহারা টিউলিপ স্টার হোটেলে।
আমি কিন্তু এখনও ৮৯তেই পড়ে আছি। বন্ধুর কথা শুনে ট্যাক্সি নিয়ে যখন বান্দ্রার পটবর্ধন পার্কের কাছে নতুন পল্লী সার্বজনীনে পৌঁছলাম তখন অনুষ্ঠানের শেষ গান ধরেছেন তরুন গায়ক শৈলেন্দ্র সিংহ- 'ম্যয় শায়র ত নেহি'। এই ফাঁকে বলে রাখি, প্রবাসের শহরগুলোতে, এমনকি দিল্লি-বোম্বাইয়েও তখনও কেউ দেবী-মূর্তি বা তার ডেকোরেশন, লাইটিং কেমন হল তা নিয়ে অত মাথা ঘামাত না, থীম নামক বস্তুটির কথা ত ছেড়েই দিলাম। সবাই মিলে আড্ডা-সহ খাওয়া ও খাওয়ানো আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- এই দুটোই ছিল প্রধান বিচার্য। তাছাড়া জানতাম- জুহু স্কীমের জগন্ময়-বিশ্বজিতের পুজোতে ওঁদের দুজন গাইবেন। আন্ধেরি ওয়েস্টের প্রগতি সংঘ মানে মুম্বাইয়ের আরেক পুরনো অথচ বেশ ঘরোয়া পুজো, মহিলারাই সেখানে অগ্রণী ভূমিকায়। সান্তাক্রুজ সেন কলোনীর পুজো মানে মুম্বাইয়ের ওয়েস্টার্ণ রেলে যত বাঙালী কর্মী আছেন তাঁদের পুজো, যদিও প্রভাত কলোনী, ভাকোলা, কালিনা, গোলিবার- এই সমস্ত অঞ্চলের প্রায় সব বঙ্গবাসীই থাকেন এ পুজোর সাথে। আমরা দু-দিন ধরে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। এছাড়া সেবার দেখেছিলাম এয়ারপোর্ট কলোনীর পুজো 'ঐকতান', চেম্বুর, অণুশক্তিনগর, ভাসি, সিবিডি বেলাপুর আর নিউ পানভেলের পুজো। সেই সময় আমি পানভেল ওএনজিসি কলোনিতে থাকতাম বলে আমাদের কোনও পাড়ার পুজোয় ইনভলভমেন্ট ছিল না। তবে প্রায় প্রতি পুজো প্যান্ডালেই পেয়েছি আন্তরিকতা ও আপ্যায়ন।
পরের বছর আমার বদলি হয় কাছাড় জেলার শিলচরে। বাঙ্গালিপ্রধান এলাকা, বাংলার যে কোনও জেলা শহরের সাথেই তুলনীয়, পুজোটাও মনে হয়নি প্রবাসের পুজো বলে। ১৯৯৪ থেকে ৯৯ ছিলাম দক্ষিণের পন্ডিচেরি রাজ্যের কারাইকালে, কাছাকাছি বলতে দুর্গাপূজা হত চেন্নাই-পন্ডিচেরিতে। একবার কলকাতা আসা হয়নি, দুই জায়গার পুজো দেখে এলাম, তবে চেনাশোনা কেউ ছিল না বলে কেউ কোনোরকম অন্তরঙ্গতা বা আন্তরিকতা দেখায়নি সেখানে। তবে থাকতে থাকতে পণ্ডিচেরির বাঙ্গালিসমাজের সাথে কিছুটা চেনা-শোনা হয়ে যায়, তাই ১৯৯৯ সাল থেকে আমাদের কারাকাল অঞ্চলের বাঙ্গালিদের যোগদান বেড়ে যায়। '৯৯তে আমাদের বাচ্চারা মিলে অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর নাটক 'হীরু ডাকাত' মঞ্চস্থ করে অষ্টমীর সন্ধ্যেয়, সবার বেশ পছন্দ হয় নাটকটি। ২০০০এ বদলী হয়ে আমি ফিরে আসি মুম্বাই।
(২)
২০০০ সালে আর মুম্বাইকে চেনা যায় না। পূর্ব আন্ধেরীর যে মহাকালী অঞ্চলে পাহাড়-গুহা-জঙ্গলের মাঝে কেউ থাকতে চাইত না, সে জায়গা এখন জমজমাট। জায়গাটা আমার এত ভাল লেগে গেল যে ২০০১ সালে আমি একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম সেখানে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাঙ্গালীর সাথে আলাপ হয়েছে। একদিন কথাটা পাড়লাম কয়েকজনের মধ্যে। কাছাকাছি পুজো পাঁচ কিলোমিটার দূরের ঐকতান বা ছয় কিলোমিটারে প্রগতি। মহাকালী অঞ্চলে এত বাঙালী, এখানে একটা দুর্গাপুজো নামে না! ব্যাপারটা নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন অঞ্জন চ্যাটার্জী, তপন দাশগুপ্ত, মলয় চক্রবর্তী, হাজরা মাসিমা, ডাঃ মণিদীপা রায় প্রমুখ স্থানীয় বিশিষ্ট বাঙালিরা। সে বছরই পত্তন হল 'মহাকালী সার্বজনীন দুর্গোৎসব সেবা সমিতি' বা MSDSSএর। ইতিমধ্যে ১৯৯৬ সালে শুরু হয়েছে লোখণ্ডওয়ালা বা অভিজিতের পুজো- বিশাল জাঁকজমকের সাথে। গোরেগাঁও ওয়েস্টে কল্লোল কালীবাড়িতে শুরু হয়েছে শুদ্ধাচারে পুজো। এছাড়া কান্দিবলি, মালাড, ভায়েন্দরের বঙ্গসঙ্ঘ, গোরেগাঁওএর গোকুলধামে অল উইমেন্স্ পুজো- দেখি বৃহত্তর মুম্বাই সব মিলিয়ে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। যদি বা কিছু কম ছিল, পরের বছর, মানে ২০০২ তে শুরু হল পাওয়াই হীরানন্দানির 'এলিট' পুজো, আর চার বছর আগে সেটা ভেঙে হল দুটো। অনুরূপ ঘটনা ঘটল থানে, ভাসি, কান্দিবলির ঠাকুর ভিলেজ সর্বত্র- জানি না তা ভাল হয়েছে না মন্দ। তবে আমার আনন্দ বাড়ির কাছেই নিজেদের পুজো শুরু করতে পেরে।
এখন আমাদের শারদোৎসব শুরু হয় মহালয়ার ভোর থেকে শারদপ্রভাতের পুণ্য শঙ্খধ্বনির সাথে পুজো-প্যান্ডালে সভ্য-সভ্যারা একত্রিত হয়ে রেডিওতে 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনে। সাথে আনুষঙ্গিক থাকে চা-সিঙ্গাড়া-জিলিপি গরমাগরম।
চতুর্থীর সকালে হয় সত্যনারায়ণ পূজা, সেদিনই দেবীমূর্তি এনে স্থাপন করা হয় পূজামণ্ডপে। পঞ্চমীতে আনন্দমেলা- সদস্যরা কিছু মুখরোচক রান্না করে নিয়ে আসে, তা বিক্রী করা হয়, লাভ নয়, নিছক আনন্দের জন্যে। মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমী পুজো হয় যথারীতি। বিজয়াদশমীতে সিঁদুর খেলা হয় দেখবার মত, তারপর প্রতিমা বিসর্জিত হয় জুহুর সমুদ্রে। ফিরে আসার পর শান্তিজল, বন্ধুদের মধ্যে কোলাকুলি, তারপর শেষপাতে থাকে সবার জন্যে মিষ্টি।
আমাদের এখনও 'থীম' বস্তুটি ঠিক হৃদয়ঙ্গম না হলেও একটা না একটা বৈশিষ্ট্য জড়িয়ে থাকে প্রায় সব পুজোর সাথে। স্টার দেখতে চাও- চলে যাও অভিজিতের লোখণ্ডওয়ালায় (এবার নাকি হচ্ছে না পুজোটা- প্রায় ৩ কোটি টাকার পুজো, এবার মেজর স্পনসর নেই), নাহয় শশধর মুখার্জিদের, নয় জুহু বিশ্বজিতের পুজোয়। গান শুনতে হলে, বান্দ্রা শক্তি সামন্তের বা অভিজিতের বা সেন কলোনী। এমনি নামকরা স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যাবে পাওয়াই বা চেম্বুরের পুজোয়, শুদ্ধ সাত্বিক মতে পুজো দেখতে হলে কল্লোল কালীবাড়ি বা খার রামকৃষ্ণ মিশন। আরে বাবা রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপূজোতে একটা দিন অন্ততঃ না কাটালে, সেখানে লাইন দিয়ে অমৃতসমান ডোঙ্গাভর্তি খিচুড়ি ভোগ না দেখলে আর মুম্বাইয়ের পুজো দেখলেন কি? আর আমাদের মহাকালী অঞ্চলের পুজোর বৈশিষ্ট্য? 'আনন্দ পাবলিশার্স' আর 'উদ্বোধন প্রকাশন; থেকে বইপত্র এনে একটা স্টল খুলে বসি শুধুমাত্র আড্ডার খাতিরে, হ্যাঁ, পুরোটাই কমিটির খরচায়, লভ্যাংশও পুজোর খাতাতেই যায়। এছাড়া বাঙ্গালি-রসনার তৃপ্তির জন্যে স্পনসর্ড ফুড-স্টল ত থাকবেই, কলকাতা-মুম্বাই থেকে নামী-দামী লোকেরা এসে নেচে-গেয়েও যান। এছাড়া আর কিছু না---কিচ্ছু না, নো পম্প অ্যান্ড শো- শুধু জীবে প্রেম আর জিভে প্রেম। খাও আর গরীব-বড়লোক-ভিখারি-মধ্যবিত্ত-নির্বিশেষে নির্বিচারে তিনদিন ধরে পেট পুরে খাইয়ে যাও। আমরা স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের একটি কুকুরকেও অভুক্ত রাখতে চাইনা পুজোর এই তিনটে দিন!
ঠাট্টা নয়, আলোক-সজ্জা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে খরচ করতে চাইলে কোটি টাকাও কম, অথচ মুম্বাইয়ের মত মহানগরের কেন্দ্রস্থলে আমরা দেখতে পাই প্রতি বছর ২০% থেকে ২৫% ছাত্র বেসরকারি স্কুলগুলি ছেড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে, দরিদ্র বাবা-মা পড়ার খরচ জোগাতে পারছেন না। এদিকে আমরা ত সুখে আছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুল-কলেজে পড়ছে, মেধা কম থাকলেও কোচিং বা ডোনেশনের দৌলতে তারা ভাল ভাল ওপেনিং পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু 'যারে তুমি পিছে রাখ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে'- সবাইকে একসাথে টেনে নিয়ে না চললে সত্যি কি এগোন যায়, তাকে কি চলা বলে? তাই আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্দেশ্যপূরণের জন্যে এই দুর্গোৎসব সমিতির শক্ত ভিতের উপর আমরা একদিন শুরু করলাম 'শিক্ষা কি আশা', আশেপাশের আন-এইডেড স্কুলগুলিতে ড্রপ-আউট যাতে না হয়, মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যেন শেষ পর্যন্ত তাদের যোগ্যতানুযায়ী পড়ার সুযোগ পায় এবং বিশেষ করে, কোনও ছাত্রীকে যেন দারিদ্র্য বা অন্য কারণে পড়া না ছাড়তে হয় মাঝপথে। আমাদের এই কার্যক্রম ২০০৯ থেকে শুরু হয়েছিল দুটি বিদ্যালয়ের দশটি ছাত্রকে অনুদান দিয়ে, এখন তার পরিধি প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সদস্য ও সহৃদয় বন্ধুদের একান্ত সহযোগিতায়। জানি এসবের সাথে আমার প্রবাসে পূজা দেখার অভিজ্ঞতার কোনও সম্বন্ধ নেই, তবে মুম্বাই যে শুধুমাত্র 'বানিয়া' দের শহর নয়, এর একটা হৃদয় আছে জানতে পারি যখন আমাদের সাহায্য পেয়ে পরীক্ষায় সফল কোনও ছাত্রীর বাবা বা সেই স্কুলের হেডমাস্টার এসে ধন্যবাদ জানিয়ে যায়। প্রত্ত্যুত্তরে তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে বলি মা আনন্দময়ীকে, যাঁর আগমনে আনন্দে দেশ ছেয়ে গেছে। তাঁর পুজো ত তখনই সার্থক হবে যখন কোনও কাঙালির মেয়ে শুধুমাত্র মুষ্টিভিক্ষার জন্যে ধনীর দুয়ারে এসে আর দাঁড়াবে না।
আমি ১৯৮৩ সাল থেকেই ছিন্নমূল প্রবাসী। অবশ্য তার আগেও কখনও ঠিক বাংলায় থাকিনি, তবে বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) হলেও তাকে ঠিক প্রবাস বলা যায়না। ধানবাদ, বোকারো, রাঁচী, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, আসানসোল ও কালেভদ্রে কলকাতার পূজো দেখেছি জন্ম থেকে, সেগুলোকে সে অর্থে প্রবাসের পুজো বলতে চাই না। ৮৩ সালে চাকুরিসূত্রে মুম্বাই (তখন বোম্বে) এসে পড়লেও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পুজোয় প্রতিবার বাড়ি ফিরে গেছি, ৮৯এ প্রথম দেখি বোম্বের পূজা।
তখন বোম্বাই শহরে বাঙ্গালিরা অধিকাংশই ছিলেন খানদানী ও উচ্চশিক্ষিত, কারণ পশ্চিমবঙ্গে তখনও শিল্পোদ্যমে ভাঁটা পড়েনি, বঙ্গের সব ক্ষেত্রের সেরা বাঙ্গালিদের টেনে নিয়ে যেত ভারতের অন্য বড় শহরগুলি। অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে ফিল্মের টেকনিসিয়ান লাইনে আর সোনা-চাঁদী-হীরের কারিগরদের বড় কিছু দল ছিল সেখানে। তাদের হাত ধরেই বোম্বাই দুর্গাবাড়ি প্রথম দুর্গোৎসব শুরু করে ১৯৩০ সালে, ঝাবেরি বাজারে, সেখান থেকে ১৯৭১এ তা স্থানান্তরিত হয় কেম্পস কর্ণারের তেজপাল হলে। আমার সেটা বিয়ের বছর, স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি বেঙ্গল ক্লাবের পুজো দেখতে, দাদারের শিবাজী পার্কে। হঠাৎ কানে এল পাশের স্টেজে কেউ যেন মান্না দের নকল করে 'ও আমার মন যমুনার' গানটি গাইছেন। একজনকে শুধোতে তিনি বললেন, মান্না দের মত নয়, দাদা, মান্না দেই গাইছেন। মফঃস্বলে মানুষ, আমি তখনও ভাবতে পারতাম না যে হেমন্ত-কিশোর-লতা-মান্নাদেরও টিকিট না কেটে গাইতে দেখা যায়। আমাদের ছোট শহরেও একবার মান্না দে গেয়ে গেছেন, টিকিটের জন্যে সে কি হুড়োহুড়ি-মারামারি। যাই হোক, সেদিন প্রাণ ভরে মান্না দের সেরা বাংলা গানগুলো শুনেছিলাম।
না, কিশোর-লতা-আশাজীরা বারোয়ারি পুজোয় এভাবে গাইতেন না, তাছাড়া কিশোরজী তখন গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। ১৯৮৪ সালে মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ণ স্টেডিয়ামে কিশোর-লতার শেষ যুগ্ম অনুষ্ঠান হয়েছিল, উচ্চদরের টিকিট থাকা সত্ত্বেও অতবড় স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ভাল গান শুনতে চাও ত শক্তি সামন্তের পুজোয় ঘুরে এস, এক বন্ধু বললেন। শক্তি সামন্ত-প্রমোদ চক্রবর্তী-বাসু চ্যাটার্জি-শচীন ভৌমিক সবাই মিলে পুজো করে আসছেন বহু বছর ধরে, বম্বের সিনেমা জগতের বাঙালীদের সেটা প্রথম বারোয়ারি প্রয়াস। তার আগে প্রবাদপুরুষ শশধর মুখার্জি ও অশোককুমাররা নিজেদের বিশাল পরিবারকে একত্র করে সান্তাক্রুজে শুরু করেন শারদীয়া পূজা, যা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন কাজোল, রানী, দেবশ্রী, অমিতকুমার- বাপি লাহিড়ীরা, এখন শুধু ভেন্যু বদলে হয়েছে বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জুহুর সাহারা টিউলিপ স্টার হোটেলে।
আমি কিন্তু এখনও ৮৯তেই পড়ে আছি। বন্ধুর কথা শুনে ট্যাক্সি নিয়ে যখন বান্দ্রার পটবর্ধন পার্কের কাছে নতুন পল্লী সার্বজনীনে পৌঁছলাম তখন অনুষ্ঠানের শেষ গান ধরেছেন তরুন গায়ক শৈলেন্দ্র সিংহ- 'ম্যয় শায়র ত নেহি'। এই ফাঁকে বলে রাখি, প্রবাসের শহরগুলোতে, এমনকি দিল্লি-বোম্বাইয়েও তখনও কেউ দেবী-মূর্তি বা তার ডেকোরেশন, লাইটিং কেমন হল তা নিয়ে অত মাথা ঘামাত না, থীম নামক বস্তুটির কথা ত ছেড়েই দিলাম। সবাই মিলে আড্ডা-সহ খাওয়া ও খাওয়ানো আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- এই দুটোই ছিল প্রধান বিচার্য। তাছাড়া জানতাম- জুহু স্কীমের জগন্ময়-বিশ্বজিতের পুজোতে ওঁদের দুজন গাইবেন। আন্ধেরি ওয়েস্টের প্রগতি সংঘ মানে মুম্বাইয়ের আরেক পুরনো অথচ বেশ ঘরোয়া পুজো, মহিলারাই সেখানে অগ্রণী ভূমিকায়। সান্তাক্রুজ সেন কলোনীর পুজো মানে মুম্বাইয়ের ওয়েস্টার্ণ রেলে যত বাঙালী কর্মী আছেন তাঁদের পুজো, যদিও প্রভাত কলোনী, ভাকোলা, কালিনা, গোলিবার- এই সমস্ত অঞ্চলের প্রায় সব বঙ্গবাসীই থাকেন এ পুজোর সাথে। আমরা দু-দিন ধরে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। এছাড়া সেবার দেখেছিলাম এয়ারপোর্ট কলোনীর পুজো 'ঐকতান', চেম্বুর, অণুশক্তিনগর, ভাসি, সিবিডি বেলাপুর আর নিউ পানভেলের পুজো। সেই সময় আমি পানভেল ওএনজিসি কলোনিতে থাকতাম বলে আমাদের কোনও পাড়ার পুজোয় ইনভলভমেন্ট ছিল না। তবে প্রায় প্রতি পুজো প্যান্ডালেই পেয়েছি আন্তরিকতা ও আপ্যায়ন।
পরের বছর আমার বদলি হয় কাছাড় জেলার শিলচরে। বাঙ্গালিপ্রধান এলাকা, বাংলার যে কোনও জেলা শহরের সাথেই তুলনীয়, পুজোটাও মনে হয়নি প্রবাসের পুজো বলে। ১৯৯৪ থেকে ৯৯ ছিলাম দক্ষিণের পন্ডিচেরি রাজ্যের কারাইকালে, কাছাকাছি বলতে দুর্গাপূজা হত চেন্নাই-পন্ডিচেরিতে। একবার কলকাতা আসা হয়নি, দুই জায়গার পুজো দেখে এলাম, তবে চেনাশোনা কেউ ছিল না বলে কেউ কোনোরকম অন্তরঙ্গতা বা আন্তরিকতা দেখায়নি সেখানে। তবে থাকতে থাকতে পণ্ডিচেরির বাঙ্গালিসমাজের সাথে কিছুটা চেনা-শোনা হয়ে যায়, তাই ১৯৯৯ সাল থেকে আমাদের কারাকাল অঞ্চলের বাঙ্গালিদের যোগদান বেড়ে যায়। '৯৯তে আমাদের বাচ্চারা মিলে অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর নাটক 'হীরু ডাকাত' মঞ্চস্থ করে অষ্টমীর সন্ধ্যেয়, সবার বেশ পছন্দ হয় নাটকটি। ২০০০এ বদলী হয়ে আমি ফিরে আসি মুম্বাই।
(২)
২০০০ সালে আর মুম্বাইকে চেনা যায় না। পূর্ব আন্ধেরীর যে মহাকালী অঞ্চলে পাহাড়-গুহা-জঙ্গলের মাঝে কেউ থাকতে চাইত না, সে জায়গা এখন জমজমাট। জায়গাটা আমার এত ভাল লেগে গেল যে ২০০১ সালে আমি একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম সেখানে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাঙ্গালীর সাথে আলাপ হয়েছে। একদিন কথাটা পাড়লাম কয়েকজনের মধ্যে। কাছাকাছি পুজো পাঁচ কিলোমিটার দূরের ঐকতান বা ছয় কিলোমিটারে প্রগতি। মহাকালী অঞ্চলে এত বাঙালী, এখানে একটা দুর্গাপুজো নামে না! ব্যাপারটা নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন অঞ্জন চ্যাটার্জী, তপন দাশগুপ্ত, মলয় চক্রবর্তী, হাজরা মাসিমা, ডাঃ মণিদীপা রায় প্রমুখ স্থানীয় বিশিষ্ট বাঙালিরা। সে বছরই পত্তন হল 'মহাকালী সার্বজনীন দুর্গোৎসব সেবা সমিতি' বা MSDSSএর। ইতিমধ্যে ১৯৯৬ সালে শুরু হয়েছে লোখণ্ডওয়ালা বা অভিজিতের পুজো- বিশাল জাঁকজমকের সাথে। গোরেগাঁও ওয়েস্টে কল্লোল কালীবাড়িতে শুরু হয়েছে শুদ্ধাচারে পুজো। এছাড়া কান্দিবলি, মালাড, ভায়েন্দরের বঙ্গসঙ্ঘ, গোরেগাঁওএর গোকুলধামে অল উইমেন্স্ পুজো- দেখি বৃহত্তর মুম্বাই সব মিলিয়ে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। যদি বা কিছু কম ছিল, পরের বছর, মানে ২০০২ তে শুরু হল পাওয়াই হীরানন্দানির 'এলিট' পুজো, আর চার বছর আগে সেটা ভেঙে হল দুটো। অনুরূপ ঘটনা ঘটল থানে, ভাসি, কান্দিবলির ঠাকুর ভিলেজ সর্বত্র- জানি না তা ভাল হয়েছে না মন্দ। তবে আমার আনন্দ বাড়ির কাছেই নিজেদের পুজো শুরু করতে পেরে।
এখন আমাদের শারদোৎসব শুরু হয় মহালয়ার ভোর থেকে শারদপ্রভাতের পুণ্য শঙ্খধ্বনির সাথে পুজো-প্যান্ডালে সভ্য-সভ্যারা একত্রিত হয়ে রেডিওতে 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনে। সাথে আনুষঙ্গিক থাকে চা-সিঙ্গাড়া-জিলিপি গরমাগরম।
চতুর্থীর সকালে হয় সত্যনারায়ণ পূজা, সেদিনই দেবীমূর্তি এনে স্থাপন করা হয় পূজামণ্ডপে। পঞ্চমীতে আনন্দমেলা- সদস্যরা কিছু মুখরোচক রান্না করে নিয়ে আসে, তা বিক্রী করা হয়, লাভ নয়, নিছক আনন্দের জন্যে। মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমী পুজো হয় যথারীতি। বিজয়াদশমীতে সিঁদুর খেলা হয় দেখবার মত, তারপর প্রতিমা বিসর্জিত হয় জুহুর সমুদ্রে। ফিরে আসার পর শান্তিজল, বন্ধুদের মধ্যে কোলাকুলি, তারপর শেষপাতে থাকে সবার জন্যে মিষ্টি।
আমাদের এখনও 'থীম' বস্তুটি ঠিক হৃদয়ঙ্গম না হলেও একটা না একটা বৈশিষ্ট্য জড়িয়ে থাকে প্রায় সব পুজোর সাথে। স্টার দেখতে চাও- চলে যাও অভিজিতের লোখণ্ডওয়ালায় (এবার নাকি হচ্ছে না পুজোটা- প্রায় ৩ কোটি টাকার পুজো, এবার মেজর স্পনসর নেই), নাহয় শশধর মুখার্জিদের, নয় জুহু বিশ্বজিতের পুজোয়। গান শুনতে হলে, বান্দ্রা শক্তি সামন্তের বা অভিজিতের বা সেন কলোনী। এমনি নামকরা স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যাবে পাওয়াই বা চেম্বুরের পুজোয়, শুদ্ধ সাত্বিক মতে পুজো দেখতে হলে কল্লোল কালীবাড়ি বা খার রামকৃষ্ণ মিশন। আরে বাবা রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপূজোতে একটা দিন অন্ততঃ না কাটালে, সেখানে লাইন দিয়ে অমৃতসমান ডোঙ্গাভর্তি খিচুড়ি ভোগ না দেখলে আর মুম্বাইয়ের পুজো দেখলেন কি? আর আমাদের মহাকালী অঞ্চলের পুজোর বৈশিষ্ট্য? 'আনন্দ পাবলিশার্স' আর 'উদ্বোধন প্রকাশন; থেকে বইপত্র এনে একটা স্টল খুলে বসি শুধুমাত্র আড্ডার খাতিরে, হ্যাঁ, পুরোটাই কমিটির খরচায়, লভ্যাংশও পুজোর খাতাতেই যায়। এছাড়া বাঙ্গালি-রসনার তৃপ্তির জন্যে স্পনসর্ড ফুড-স্টল ত থাকবেই, কলকাতা-মুম্বাই থেকে নামী-দামী লোকেরা এসে নেচে-গেয়েও যান। এছাড়া আর কিছু না---কিচ্ছু না, নো পম্প অ্যান্ড শো- শুধু জীবে প্রেম আর জিভে প্রেম। খাও আর গরীব-বড়লোক-ভিখারি-মধ্যবিত্ত-নির্বিশেষে নির্বিচারে তিনদিন ধরে পেট পুরে খাইয়ে যাও। আমরা স্বামীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের একটি কুকুরকেও অভুক্ত রাখতে চাইনা পুজোর এই তিনটে দিন!
ঠাট্টা নয়, আলোক-সজ্জা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে খরচ করতে চাইলে কোটি টাকাও কম, অথচ মুম্বাইয়ের মত মহানগরের কেন্দ্রস্থলে আমরা দেখতে পাই প্রতি বছর ২০% থেকে ২৫% ছাত্র বেসরকারি স্কুলগুলি ছেড়ে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে, দরিদ্র বাবা-মা পড়ার খরচ জোগাতে পারছেন না। এদিকে আমরা ত সুখে আছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাল স্কুল-কলেজে পড়ছে, মেধা কম থাকলেও কোচিং বা ডোনেশনের দৌলতে তারা ভাল ভাল ওপেনিং পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু 'যারে তুমি পিছে রাখ সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে'- সবাইকে একসাথে টেনে নিয়ে না চললে সত্যি কি এগোন যায়, তাকে কি চলা বলে? তাই আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার উদ্দেশ্যপূরণের জন্যে এই দুর্গোৎসব সমিতির শক্ত ভিতের উপর আমরা একদিন শুরু করলাম 'শিক্ষা কি আশা', আশেপাশের আন-এইডেড স্কুলগুলিতে ড্রপ-আউট যাতে না হয়, মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যেন শেষ পর্যন্ত তাদের যোগ্যতানুযায়ী পড়ার সুযোগ পায় এবং বিশেষ করে, কোনও ছাত্রীকে যেন দারিদ্র্য বা অন্য কারণে পড়া না ছাড়তে হয় মাঝপথে। আমাদের এই কার্যক্রম ২০০৯ থেকে শুরু হয়েছিল দুটি বিদ্যালয়ের দশটি ছাত্রকে অনুদান দিয়ে, এখন তার পরিধি প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সদস্য ও সহৃদয় বন্ধুদের একান্ত সহযোগিতায়। জানি এসবের সাথে আমার প্রবাসে পূজা দেখার অভিজ্ঞতার কোনও সম্বন্ধ নেই, তবে মুম্বাই যে শুধুমাত্র 'বানিয়া' দের শহর নয়, এর একটা হৃদয় আছে জানতে পারি যখন আমাদের সাহায্য পেয়ে পরীক্ষায় সফল কোনও ছাত্রীর বাবা বা সেই স্কুলের হেডমাস্টার এসে ধন্যবাদ জানিয়ে যায়। প্রত্ত্যুত্তরে তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে বলি মা আনন্দময়ীকে, যাঁর আগমনে আনন্দে দেশ ছেয়ে গেছে। তাঁর পুজো ত তখনই সার্থক হবে যখন কোনও কাঙালির মেয়ে শুধুমাত্র মুষ্টিভিক্ষার জন্যে ধনীর দুয়ারে এসে আর দাঁড়াবে না।
No comments:
Post a Comment