গীতিময়ের গীতিকথা।।
স্থান- পণ্ডিচেরি রাজ্যের এক অখ্যাত জেলা-শহর।
কাল- ছাব্বিশে জানুয়ারির প্রাতঃকাল।
পাত্র- তিনিই ত নায়ক এই গীতিকাব্যের, ক্রমশ প্রকাশ্য।
পতাকা উত্তোলন হয়ে গেছে। জেনারেল ম্যানেজারের ভাষণও। এরপর সাধারণতঃ মিষ্টির প্যাকেট বিলি করা হয়, সেই সঙ্গে কিছু গানবাজনা, হাল্কা মনোরঞ্জন।
এমন সময় শুনতে পেলাম মাইক হাতে নিয়ে কেউ একজন মর্মান্তিক করুণ সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ভাষা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তবে একটা বুকফাটা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। 'আরে মাইক মে কৌন রো রহা হ্যায়?' বলে আমি আশেপাশে জবাবের জন্যে তাকালাম।
- দাদা, জি-এম গান গাইছে। মাইকটা বোধহয় একমিনিটের জন্যে খালি পড়েছিল, ওটা হাতিয়ে নিয়েছে। এবার তাহলে কেটে পড়ি- ভাস্কর বিশ্বাস খবরটা জানাল।
আমি নতুন এসেছি প্রজেক্টে, কিছুই বুঝলাম না। 'এখানকার জেনারেল ম্যানেজার গান গেয়ে শোকপালন করেন?' অবাক হয়ে জিগ্যেস করি। এতক্ষণে বুঝতে পারছি যৎপরোনাস্তি বেসুরো গলায় 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ' গানটা গাওয়া হচ্ছে।
- না দাদা, ইনি জি-এম মানে গীতিময়। পারচেজ অফিসার জি এম সোম। ফাটাফাটি ওস্তাদ। একাই পুরো টাউনকে মাতিয়ে রেখেছেন।
ঘণ্টাখানেক চরম অস্বস্তিতে কাটিয়ে টাকমাথা সদাহাস্যময় গীতিময়বাবুর সাথে বলতে গেলে নিজের স্বার্থেই গিয়ে আলাপ করলাম। বললাম 'দেখুন, গানবাজনা আমরাও একটু-আধটু করে থাকি। তা, আপনি যে একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, তা তো ওই গলা শুনেই বুঝেছি। গানটা আপনি ভালই করেন। তবে রেয়াজ করবেন নিয়মিত। তাহলে গলায় সুরটা অন্ততঃ আসবে।'
আমার খোঁচাটুকু মাঠে মারা গেল। উনি বরং উৎসাহিত হয়ে বললেন-'আরে আপনি ড্রিলিং অফিসে নতুন এসেছেন না! ওই ত আপনাদের পেছনের ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে আমি থাকি। ফ্যামিলি আনতে পারিনি, বুঝলেন কিনা, ছেলেমেয়ে কলকাতায় পড়াশুনা করে। তাই ওই গানবাজনা করেই সময় কাটাই। তা আপনার ওখানে যাব একদিন, বৌদির সঙ্গে আলাপ করে আসব।'
ব্যস, খাল কেটে কুমীর ডাকার কাজটা আমি সুসম্পন্ন করে ফেললাম। এই কাজটা না করলে আমি গানবাজনা এত শিগ্গির ভুলতাম না বোধহয়।
গীতিময়বাবু রেয়াজ করেন না তাঁর অতিবড় শত্রুও বলবেন না। সকাল থেকে শুরু হয় তাঁর কাক তাড়ানো, অবশ্যই এক অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়ায়। আবার সন্ধ্যের পর বসে আসর, অনেকেই আসেন কানে তুলো লাগিয়ে, ক্যান্টিন থেকে আনানো চা আর চপ-সিঙ্গাড়ার সদ্ব্যবহার করে কেটে পড়েন। ফলে আমার রাত জেগে বইপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভোরবেলায় উঠে পড়তে হয়, আর গুরুদেব যতই বলুন, এই সুর শুনায়ে ভাঙা ঘুমটা আমার মোটেই রমণীয় হয় না।
ইতিমধ্যে আমাদের অফিসার ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের দিন এসে পড়ল। 'আমাকে কুড়িমিনিটের মত সময় দেবেন, ভাই', গীতিময়বাবু আমাকে সলজ্জভাবে অনুরোধ করলেন। 'দেখি, কতটা দেওয়া যায়', আমি কালচারাল সেক্রেটারি হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা মনে করে বললাম, 'অনেক নাচিয়ে-গাইয়েই আছেন কিনা! তাছাড়া মিসেস বিশ্বাস, ট্রান্সপোর্টের ভটচাযদা আছেন, এঁরা একটা গীতিনাট্য টাইপের করছেন। মিসেস তিওয়ারির ঠুমরি-দাদরা, ডাঃ দাসের গজলেও ত বেশ খানিকটা সময় যাবে।'
ভেবেছিলাম ফাংশানের দিন ব্যস্ততার ভান করে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াব, সেখানেও বিধি বাদ সাধলেন। 'আরে ভাই, সোমবাবুকো ভি কোই গানা গানে বোলো, ইতনা বড়া মেহফিল উনকে বগের থোড়ে জমেগা!'- নকল জি-এমের জন্যে দরবার করলেন আসল জি-এম সৈনী স্বয়ং। ভাবখানা এই যে মজাটা দেখাই যাক। গীতিময়বাবুকে আর পায় কে! অর্কেস্ট্রাকে ইশারা করে মাইক টেনে নিলেন তিনি। সৈনীসায়েব একটা চিকেন কাবাবের টুকরো মুখে নিয়ে কানের তুলোটা গুঁজে নিলেন ভাল করে।
'স্যার, একটু তুলোটা খুলে শুনুন, কিশোরের গানটা ভালই গাইছেন দাদা।' একজন পারিষদ পাশ থেকে বললেন।
'ইস গলতফহমি মে না রহিও। লগতা হ্যায় তুমলোগোঁকে কানোঁ কো সোমবাবুকা গানা শুননে কা আদত পড় গয়া হ্যায়। 'জিন্দগী' বোল রহা হ্যায় ইয়া 'গন্দগী'!'
বলছেন। আবার একটা গান শেষ হতেই 'আউর এক, আউর এক' বলে চিৎকারও করে যাচ্ছেন। আমি এই কথাটাই এবার সাহস করে তাঁকে বললাম।
'আরে মুখর্জি, ইধর বইঠো, তুমকো সমঝাতা হুঁ।' আজ স্যার বেশ ভাল মুডে আছেন মনে হচ্ছে।
তারপর ওঁর কাছে যা জ্ঞানলাভ করলাম তাঁর নিজের ভাষাতেই বাংলা করে দিচ্ছি।
' জান ত আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। আমরা মাটি খোঁড়ার যে বরাত কন্ট্রাকটারদের দিই তার রেট হয় ভলিউম হিসেবে। তা এরিয়া তো সহজেই মাপা যায়। তার সঙ্গে ডেপ্থ গুণ করলে এক্সক্যাভেটেড ভল্যুম বেরোয়। খোঁড়ার গভীরতা মাপার জন্যে ওরা কি করে, একটা ছোট্ট অংশকে না খুঁড়ে যেমনকার তেমনি রেখে দেয় ডেটাম বা বেঞ্চ মার্ক হিসেবে, পরে আমরা সেটার উচ্চতা মেপে সেই অনুযায়ী পেমেন্ট করি।'
'তা বুঝলে, এই সোমদাদার গানটাও তাই। আমার কন্যা পাঁচ বছর আগে গান শিখতে শুরু করেছিল, তার আগে ওকে সোমের গান শুনিয়েছিলাম। আজ ওর কলেজের ছুটিতে এসেছে, আবার সোমের গান শুনছে। এখন একটা কম্পারিসন করলে ওর কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা বুঝতে পারবে, কারণ সোম তো সুরোঁ কা বেঞ্চ মার্ক হ্যায়, পেহলে জাহাঁ থা পাঁচ সাল কে বাদ ভি ওহিঁ হ্যায় আউর বিশ সাল বাদ ভি ওয়সা হি রহেগা।'
'স্যার, আপনি জানেন না, সোমবাবুর গান শুনে শুনে আমি চেনা গানগুলোরও সুর ভুলে যাই আজকাল। ইয়ে খতরা ভি হ্যায়', আমি সবিনয়ে বলি।
'অ্যাঁ, তাই নাকি?' এবার চমকানোর পালা সৈনী সাহেবের। 'ওরে, কে আছিস, সোমবাবুকে একটু ধরাধরি করে স্টেজ থেকে নামা বাবা!'
স্থান- পণ্ডিচেরি রাজ্যের এক অখ্যাত জেলা-শহর।
কাল- ছাব্বিশে জানুয়ারির প্রাতঃকাল।
পাত্র- তিনিই ত নায়ক এই গীতিকাব্যের, ক্রমশ প্রকাশ্য।
পতাকা উত্তোলন হয়ে গেছে। জেনারেল ম্যানেজারের ভাষণও। এরপর সাধারণতঃ মিষ্টির প্যাকেট বিলি করা হয়, সেই সঙ্গে কিছু গানবাজনা, হাল্কা মনোরঞ্জন।
এমন সময় শুনতে পেলাম মাইক হাতে নিয়ে কেউ একজন মর্মান্তিক করুণ সুরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ভাষা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তবে একটা বুকফাটা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। 'আরে মাইক মে কৌন রো রহা হ্যায়?' বলে আমি আশেপাশে জবাবের জন্যে তাকালাম।
- দাদা, জি-এম গান গাইছে। মাইকটা বোধহয় একমিনিটের জন্যে খালি পড়েছিল, ওটা হাতিয়ে নিয়েছে। এবার তাহলে কেটে পড়ি- ভাস্কর বিশ্বাস খবরটা জানাল।
আমি নতুন এসেছি প্রজেক্টে, কিছুই বুঝলাম না। 'এখানকার জেনারেল ম্যানেজার গান গেয়ে শোকপালন করেন?' অবাক হয়ে জিগ্যেস করি। এতক্ষণে বুঝতে পারছি যৎপরোনাস্তি বেসুরো গলায় 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ' গানটা গাওয়া হচ্ছে।
- না দাদা, ইনি জি-এম মানে গীতিময়। পারচেজ অফিসার জি এম সোম। ফাটাফাটি ওস্তাদ। একাই পুরো টাউনকে মাতিয়ে রেখেছেন।
ঘণ্টাখানেক চরম অস্বস্তিতে কাটিয়ে টাকমাথা সদাহাস্যময় গীতিময়বাবুর সাথে বলতে গেলে নিজের স্বার্থেই গিয়ে আলাপ করলাম। বললাম 'দেখুন, গানবাজনা আমরাও একটু-আধটু করে থাকি। তা, আপনি যে একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, তা তো ওই গলা শুনেই বুঝেছি। গানটা আপনি ভালই করেন। তবে রেয়াজ করবেন নিয়মিত। তাহলে গলায় সুরটা অন্ততঃ আসবে।'
আমার খোঁচাটুকু মাঠে মারা গেল। উনি বরং উৎসাহিত হয়ে বললেন-'আরে আপনি ড্রিলিং অফিসে নতুন এসেছেন না! ওই ত আপনাদের পেছনের ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে আমি থাকি। ফ্যামিলি আনতে পারিনি, বুঝলেন কিনা, ছেলেমেয়ে কলকাতায় পড়াশুনা করে। তাই ওই গানবাজনা করেই সময় কাটাই। তা আপনার ওখানে যাব একদিন, বৌদির সঙ্গে আলাপ করে আসব।'
ব্যস, খাল কেটে কুমীর ডাকার কাজটা আমি সুসম্পন্ন করে ফেললাম। এই কাজটা না করলে আমি গানবাজনা এত শিগ্গির ভুলতাম না বোধহয়।
গীতিময়বাবু রেয়াজ করেন না তাঁর অতিবড় শত্রুও বলবেন না। সকাল থেকে শুরু হয় তাঁর কাক তাড়ানো, অবশ্যই এক অনৈচ্ছিক প্রক্রিয়ায়। আবার সন্ধ্যের পর বসে আসর, অনেকেই আসেন কানে তুলো লাগিয়ে, ক্যান্টিন থেকে আনানো চা আর চপ-সিঙ্গাড়ার সদ্ব্যবহার করে কেটে পড়েন। ফলে আমার রাত জেগে বইপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভোরবেলায় উঠে পড়তে হয়, আর গুরুদেব যতই বলুন, এই সুর শুনায়ে ভাঙা ঘুমটা আমার মোটেই রমণীয় হয় না।
ইতিমধ্যে আমাদের অফিসার ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের দিন এসে পড়ল। 'আমাকে কুড়িমিনিটের মত সময় দেবেন, ভাই', গীতিময়বাবু আমাকে সলজ্জভাবে অনুরোধ করলেন। 'দেখি, কতটা দেওয়া যায়', আমি কালচারাল সেক্রেটারি হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা মনে করে বললাম, 'অনেক নাচিয়ে-গাইয়েই আছেন কিনা! তাছাড়া মিসেস বিশ্বাস, ট্রান্সপোর্টের ভটচাযদা আছেন, এঁরা একটা গীতিনাট্য টাইপের করছেন। মিসেস তিওয়ারির ঠুমরি-দাদরা, ডাঃ দাসের গজলেও ত বেশ খানিকটা সময় যাবে।'
ভেবেছিলাম ফাংশানের দিন ব্যস্ততার ভান করে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াব, সেখানেও বিধি বাদ সাধলেন। 'আরে ভাই, সোমবাবুকো ভি কোই গানা গানে বোলো, ইতনা বড়া মেহফিল উনকে বগের থোড়ে জমেগা!'- নকল জি-এমের জন্যে দরবার করলেন আসল জি-এম সৈনী স্বয়ং। ভাবখানা এই যে মজাটা দেখাই যাক। গীতিময়বাবুকে আর পায় কে! অর্কেস্ট্রাকে ইশারা করে মাইক টেনে নিলেন তিনি। সৈনীসায়েব একটা চিকেন কাবাবের টুকরো মুখে নিয়ে কানের তুলোটা গুঁজে নিলেন ভাল করে।
'স্যার, একটু তুলোটা খুলে শুনুন, কিশোরের গানটা ভালই গাইছেন দাদা।' একজন পারিষদ পাশ থেকে বললেন।
'ইস গলতফহমি মে না রহিও। লগতা হ্যায় তুমলোগোঁকে কানোঁ কো সোমবাবুকা গানা শুননে কা আদত পড় গয়া হ্যায়। 'জিন্দগী' বোল রহা হ্যায় ইয়া 'গন্দগী'!'
বলছেন। আবার একটা গান শেষ হতেই 'আউর এক, আউর এক' বলে চিৎকারও করে যাচ্ছেন। আমি এই কথাটাই এবার সাহস করে তাঁকে বললাম।
'আরে মুখর্জি, ইধর বইঠো, তুমকো সমঝাতা হুঁ।' আজ স্যার বেশ ভাল মুডে আছেন মনে হচ্ছে।
তারপর ওঁর কাছে যা জ্ঞানলাভ করলাম তাঁর নিজের ভাষাতেই বাংলা করে দিচ্ছি।
' জান ত আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। আমরা মাটি খোঁড়ার যে বরাত কন্ট্রাকটারদের দিই তার রেট হয় ভলিউম হিসেবে। তা এরিয়া তো সহজেই মাপা যায়। তার সঙ্গে ডেপ্থ গুণ করলে এক্সক্যাভেটেড ভল্যুম বেরোয়। খোঁড়ার গভীরতা মাপার জন্যে ওরা কি করে, একটা ছোট্ট অংশকে না খুঁড়ে যেমনকার তেমনি রেখে দেয় ডেটাম বা বেঞ্চ মার্ক হিসেবে, পরে আমরা সেটার উচ্চতা মেপে সেই অনুযায়ী পেমেন্ট করি।'
'তা বুঝলে, এই সোমদাদার গানটাও তাই। আমার কন্যা পাঁচ বছর আগে গান শিখতে শুরু করেছিল, তার আগে ওকে সোমের গান শুনিয়েছিলাম। আজ ওর কলেজের ছুটিতে এসেছে, আবার সোমের গান শুনছে। এখন একটা কম্পারিসন করলে ওর কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা বুঝতে পারবে, কারণ সোম তো সুরোঁ কা বেঞ্চ মার্ক হ্যায়, পেহলে জাহাঁ থা পাঁচ সাল কে বাদ ভি ওহিঁ হ্যায় আউর বিশ সাল বাদ ভি ওয়সা হি রহেগা।'
'স্যার, আপনি জানেন না, সোমবাবুর গান শুনে শুনে আমি চেনা গানগুলোরও সুর ভুলে যাই আজকাল। ইয়ে খতরা ভি হ্যায়', আমি সবিনয়ে বলি।
'অ্যাঁ, তাই নাকি?' এবার চমকানোর পালা সৈনী সাহেবের। 'ওরে, কে আছিস, সোমবাবুকে একটু ধরাধরি করে স্টেজ থেকে নামা বাবা!'
No comments:
Post a Comment