Tuesday, December 31, 2019

প্যারডি কবিতা/ গান।


প্যারডি


১)
ছাড়ব না।।


ছাড়ব না, ছাড়ব না,
আমার আগে তোমায় আমি ছাড়ব না।
তুমি যদি ঢোক তবে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দেবে।
না না না।।

অফিস যেতেই হবে আমায় আজ সকালে
দশটা থেকেই মিটিং আছে দেরি হলে
বস বলেছে করবে ফায়ার শুনবে না কো না না না।।

মিলবে না তো এক কাপ চা আটটার আগে,
ঘুমের ভানে দেখতে থাকো কে প্রথম জাগে।
তোমার আশায় থাকি নি তাই
নিজেই এখন চা বানিয়ে খাই,
সকল প্রয়াস বৃথা যেতে দেব না তো না, না, না।।


২)

ছলনা।।

সেই ভালো, সেই ভালো-
খাবারে যা হয় তা আনো।
খাইয়ে-দাইয়ে পরে খোঁটা দেবে,
এত ছলনাও যে জান।।

মোর থালা ভরে রেখেছ পান্তাভাত,
বুঝেছি তাতেই, কাটবে সারা রাত,
চাইনি তো বাটি-ভরা পরিপাটি
পোলাও কালিয়া সাজানো,
সেই ভালো, সেই ভালো।।
গোপনে দেখেছি তোমার ভায়েরা এলে টাকার খেলা,
ভেটকি ও খাসি আসে রাশি রাশি দেখেছি, দিনের বেলা।
তোমাতে আমাতে বন্ধ যে কথা
না'হলে শুধাতেম, এ টাকা পেলে কোথা,
জানি আছে পড়ে পকেট গভীরে
ফাঁকা মানিব্যাগ সাজানো।।

৩) বর্ষা-অমঙ্গল কাব্য।।
পাপের-শাপের মোচন ঘটুক বাদল গর্জনে।
হৃদয় আমার ফেলে মোটরকার, ওঠ জলযানে।।
অঝোর-ঝরন আগস্ট-মাসে, চাপে কেউ কভু ট্রামে কি বাসে
সাথে ফাউ, বিজলি উধাও, আছে কপালে কী কে জানে?।
কাঁদুক আকাশ, কাঁদুক বাতাস, কাঁদুক নিখিল ধরা,
ডুবুক বিশ্ব দেখে সে দৃশ্য নর্দমা কর্দম-ভরা।
পথ হল নদী জলে জলময়, সাঁতার কাটার ভাল এ সময়
মোটর ভোলাও, নৌকো চালাও, ভাসাও রে উজানে,
হৃদয় আমার এ দেশে বসেই ভেনিসের মজা নে।।

৪)
শেষ ব্রকোলি।
(একটি করুণ-রসসিক্ত #প্যারডি)
আমার সবজি বাগানে
যবে প্রথম ধরে ব্রকোলি ,
তোমার লাগিয়া তখনি বন্ধু
রেখেছিনু কিছু তুলি।।
তখনও আসেনি মালী, সখা,
বেগুন ধরেছে খালি
এখানে-সেখানে দু-চারটে করে
ফুটেছে পেঁয়াজ কলি।।

এখনো পাতার রঙ
শুষেনি সব সি-ওটু এবং
ফুলে এখনও বসেনি অলি।
ও মোর সবুজ ব্রকোলি,
ও তোর গিয়েছে সকলই-
শুধু রঙ খানা রয়ে গেছে
তাও দিতে চাস কি রে বলি!!
(সি-ওটু= কার্বন ডায়োক্সাইড, আমার বিশ্বাস, প্যারডি গানে কেমিক্যাল ফরমুলা ইতিপূর্বে ব্যবহৃত হয়নি)

৫)
নিশিকুটুম্বের গান।।
জাগরণে যায় বিভাবরী।
সিঁদকাঠি নিয়ে হাতে শুধুই ঘুরি।।
হায় কী করি! হায় কী করি!
আগুন লাগলে ঘরে তবু যে ঘুমায়
আজ তার নাকডাকা শুনতে না পাই
কিভাবে সে ঘরে আজ কী ভাবে রে
কিভাবে সে ঘরে আজ করব চুরি?।
হায় কী করি! বাঁচি না মরি!
ওষুধ ছড়িয়ে দিনু জানলা দিয়ে
এবার ঘুমোও। এবার ঘুমোও খুড়ো নাক ডাকিয়ে।
এখনও আওয়াজ? দেখি উঁকিটি মেরে-
ও হরি! টিভি-যে চলে রাত্রি ধরে
সারারাত রাম রাম আরে রে ছিছি-
সারারাত মিছিমিছি চৌকিদারি।।
হায় কী করি! খালি হাতেই ফিরি!

৬) 
একটি প্রেমের গান !
তার হাতে ছিল একটি টিনের ক্যান পেট্রোল তেলে ভরা
পেট্রোলের তেলে ভরা ।
মোর সাথে ছিল পেঁয়াজ ভরা থলে
নাসিক থেকে বাজার করা ।।
সহসা আসিয়া কহিল সে সুন্দরী, এসো না বদল করি ।
রাঁধছি চিকেন বাড়িতে, তেল ভরে নাও গাড়িতে- নাও ত্বরা ।।
তুমি যদি ওল, আমিও তেঁতুল- বললাম, তবে এসো
লিফট দি-নাহয়, আমার পাশেই বসো ।
দুজনেই মোরা হলাম যে জয়ী একে অপরকে পেয়ে
কিছুই হলনা গো হাতছাড়া !!
(ক্ষমা কর রবিঠাকুর, এমনও হয় !)

৭)
পদবী-গীতি
'ধর' হেঁকে কয় ধরো ধরো,
'দে' বলে সব দে,
'কর' বলেছে ট্যাক্সো চাহি,
'বল' কি বলিস রে!
'ঘোষ' বলে ভাই মলেম ঘষে-
'বোসে'র বাড়ির দাওয়ায় বসে,
'ভড়' বলে তোর ভড়ং দেখে
হেসেই বাঁচি নে!!
'পাঁজা' বলে ইঁটের পাঁজায়
আছে বাদামভাজা,
'সাঁতরা' বলে সাঁতরে গিয়ে
যে খায় সেই তো রাজা।
'সাহা' 'রায়' গিয়ে কাঁদে সাহারায়
'ভদ্র' লোকে যায় কি সেথায়?
হয়ে পূজারি 'ঠাকুর' চুরি
করে বেড়ায় কে?? 
('মেঘ বলেছে যাব যাব'-র সুরে গাইতে হবে)
৮) 
ভোট-রঙ্গ


হারজিতের এই ভোটেতে, মিলবে যারা জোটেতে
ও ভাই, ও ভাই, জিতবে যে তারাই ।
ধান্ধাবাজির ফন্দিতে, জুটতে হবে সন্ধিতে
জামাই বোনাই, মিলবে রে যারাই ।।
এখানে যোগ-বিয়োগের ফলে
লক্ষ কোটির খেলা চলে
গোটা দশ লাশ ত কিছুই না,
দুটো ভোট বেশী পেতে হলে-
দু-কান যাদের নাই জিতবে যে তারাই ।।
জিতবে কে গো, হারবে কে গো
খবর রাখে চ্যানেল গুলো, জিতবে কে গো ।
সারারাত জেগে যে ছোঁড়ারা
দেয়ালে ছোটায় গো ফোয়ারা,
গোপনে যারা বাঁধে পেটো
বাইকের মিছিল চালায় যারা -
তাদেরই লাশের উপর জিতবে দাদারাই ।।
(একটি জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবির গানের প্যারডি)

৯)
শুধু তুমি।।

চলনে-বলনে নাচনে-কোঁদনে তুমি যে ফেলেছ সাড়া
রঙেতে-তুলিতে, কবিতা ও গানে একি তব বোঝাপড়া--
তুমি যে আগুন, সবেতে দ্বিগুণ, মেলালে অহি-নকুলে
আনিলে ক্রান্তি শ্মশান-শান্তি এই ভাগীরথী কূলে ৷
বাঘে ও ছাগলে দেখে এক ঘাটে রোমাঞ্চিত এ ভূমি
আজ বাংলার ঘাসের শিকড়ে তুমিই শুধু তুমি ৷৷
সিন্দুরে মেঘে জ্বলে যে গোয়াল, সে দীপের শিখা তুমি
ঢেলে বহুজল নেভালে অনল- গরুও বাঁচালে তুমি ৷
আপনা বিলায়ে ফেলেছ তুমি যে তিনটি ম-এর মাঝে,
লালেতে-নীলেতে বিভেদ ঘটালে, এ তোমায় নাহি সাজে ৷
দূকূল-আঁচলে ভরেছ মুকুলে, হাওয়াই পরশে ভূমি
হুগলী-নদীর জুড়ি দুই তীর তুমিই শুধু তুমি ৷৷
সহসা দেখিনু তোমার দুচোখে কোন্ সে ভয়ের ছায়া
নাকি রজ্জুতে সর্প দেখিলে এ কোন অজানা মায়া ৷
জানে রাজারানী ক্ষমতা তোমার- কারো তা নয় অজানা
তোমারি শিয়রে জনগণ জাগে, তোমারই পুলিশ থানা ৷
কে কোথা কি লেখে, কি গায় কি আঁকে কি তাতে তোমার শুনি
এই বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে তুমিই শুধু তুমি৷৷
(কার্টুন-কাণ্ডের পর দিদির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ, এপ্রিল ১৯, ২০১২)
 (কৃতজ্ঞতাঃ শ্রীমতী মীরা দেববর্মণ)



১০)
(মহাভারতকে রবীন্দ্রসংগীতের মত করে গাওয়া হলে কেমন হত?)

ভীষ্ম যখন যুদ্ধে মগন, নিয়ে কুরু দল ভার
অর্জুন বাদে পাণ্ডব সব ভয়েই পগার পার।।
ধনুক-বাণের এই মেল কি,
কে দেখেছে কবে হেন খেল কি?
বৃদ্ধ-হাড়ের এমন ভেল্কি দেখ চেয়ে সংসার।।
গুণ জুড়িয়া বান ছুঁড়িয়া কে দাঁড়িয়ে রথে
এ যে শিখণ্ডী, পুরুষ-বেশে আস্ত নারীই বটে!
অস্ত্র ছাড়েন পিতামহ,
কৃষ্ণ বলেন এবার লহ
হাতে গাণ্ডীব পার্থ, কর ভীষ্মকে সংহার।।



১১)
কচুরি।।


ও কে কচুরি ভেজে খায়?
লুকিয়ে কড়াইশুঁটি সবুজ আভায়।।
গরম ঘি-এ লেচি ভাজা
ফুলে ফুলে খাস্তা খাজা,
যে খায় এসব সেই তো রাজা
মুকুট ছাড়াই।।

কী যেন বীণার মত, বেজেছে জিভের তারে,
যেন অমৃতের মত আভাস দিয়ে রয় সে দ্বারে।
রসনার কুঞ্জবনে দোলা দেয় অকারণে
এ স্বাদের ভাগ দেব না, করব লড়াই।। 



১২)
কুমড়ো।।
আমার কুমড়ো বাগানে যখন প্রথম ধরেছে কুঁড়ি ৷
তোমারি লাগিয়া তখনই বঁধুয়া তলায় ধরেছি ঝুড়ি ৷৷
তখনও ফোটানো জলে সখা দিইনি চা-পাতা ফেলে,
স্কুটারে স্কুটারে অফিস হইতে ফেরেনিক ছোঁড়াছুঁড়ি ৷
এবার মুড়ির থালায় আচারের তেলটি ঢালার পালা,
মাখা হবে যে এখনই মুড়ি !
ওরে অবাধ্য কুমড়ো কবে রে তোর কুঁড়িগুলো ফুল হবে,
বন্ধু ঘরেতে ফেরার আগেই ফুটে ওঠ তড়িঘড়ি ৷৷



১৩)
মুড়ি
রাগ: মালগুঞ্জি, তাল: কাহারবা


কুঁড়েঘর থেকে তুমি প্রাসাদেতে এস মুড়ি
পায়ে হেঁটে লাগে লাজ? এস দিয়ে হামাগুড়ি।
জলপান কি আহারে ভাজাভুজি সমাহারে
মরিচ পেঁয়াজ সাথে দাও জিভে সুড়সুড়ি!

বাংলা গঞ্জে গ্রামে বিখ্যাত ঝালমুড়ি
কিম্বা মুম্বাইয়া মুর্মুরা ভেলপুরি,
একটু সর্ষে তেল- কালিয়া পোলাও ফেল,
মাখো কলাইয়ের ডাল, মোটেও হবেনা ভুঁড়ি।

(এই গানটা নজরুলের 'গুনজা মালা গলে কুঞ্জে এস হে কালা' র সুরে গাইতে হবে।)




১৪)
ক্ষুধাতুর শিশুর রবীন্দ্রসঙ্গীত ।

মন বলেছে খাব খাব, পেট বলেছে খাই,
মা বলেছে, কোথায় পাব, খাবার তো আর নাই।।
উদর বলে রইনু চেপে, মাঝে মাঝেই উঠছে কেঁপে,
আমি বলি একটুকু ভাত, আর কিছু না চাই।।
কান্না চোখে ঘুমিয়ে পড়ি, নিয়ে ক্ষুধার জ্বালা
স্বপন দেখি আমার তরে লক্ষ রুটির থালা।
হাত বাড়িয়ে যেই পেতে চাই, সকল খাবার উধাও যে ভাই,
পূর্ণিমা চাঁদ তাকিয়ে হাসে, কোথাও কিছুই নাই।।


 ১৫)
ক্য়ালাবেন তিনি।।
ক্য়ালাবেন, তিনি ক্য়ালাবেন।
আছে যত সব পা-চাটার দল,
কোলের বখরা নিয়ে কোলাহল
করে শুধু যাঁরা চলেছেন।
এক এক করে সবাইকে ধরে পেটাবেন।
পাগল-ছাগলে কত কথাই না বলছে,
তেলা মাথাটিতে কত তেলই তারা দলছে
সে মাথায় দেখি তেলাপোকা হেঁটে চলছে-
কত আর তাকে তেলাবেন?
পালাবে কোথায়, সবকটাকেই
ধরে ধরে তিনি ক্য়ালাবেন!
হিসেবের কথা বলি তবে শোনো ,
দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয়্না কখনও
দুয়ে দুয়ে শুধু দুধটি ফুরনো
গাইটিকে কত দোয়াবেন?
দু'য়ে দু'য়ে চার কত তিনি আর মেলাবেন,
এবার সবারে ক্য়ালাবেন!
(কবি অমিয় চক্রবর্তীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।) (১৬) টিকটিকি ও তেলাপোকা।। যদি তারে না চীনেয় নেয় তবে
টিকটিকিতে নেবেই খেয়ে-
ওই যে গো সে দেয়াল বেয়ে
এল ধেয়ে! এল ধেয়ে!

সেকি তাহার এক কামড়ে
ধরবে কষে শক্ত করে-
চিবিয়ে খাবে কুড়মুড়িয়ে,
তাই সে আসে দেয়াল বেয়ে
এল ধেয়ে ! এল ধেয়ে!

সেকি মুখের জোরে দাঁত বসাবে
তারে ধরলে চেপে লেজ খসাবে।
চিমটা তাহার মুখের আকার
হঠাৎ মরণ তেলাপোকার,
তাকিয়ে থাকি অবাক হয়ে,
ওই দেখি সে দেয়াল বেয়ে
এল ধেয়ে! এল ধেয়ে!


(১৭)
লুচি ও লকডাউন।।

মানুষ মারে সে মনের হরষে স্ট্যাটাস পানে না চাহি রে!
লকডাউনের মাঝে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে!
বন্ধ দুয়ার বাজার আপিস
মাছ-তরকারি সকলি হাপিশ,
রাস্তা জুড়িয়া ঘুরিছে পুলিশ কাণ্ডটা কী এলাহি রে!!
ওগো দ্যাখ চেয়ে রান্নাঘরেতে থালা জুড়ে লেচি সাজা রে।
এখনই যে শুরু হবে লুচিগুলো ভাজা রে।
একবার উঁকি মেরে দ্যাখ দিকি
ছ্যাঁক-ছ্যাঁক রব শুরু হয়েছে কি?
করোনাতঙ্কে শুকনো মুখেতে ফুটেছে কি হাসি তাজা রে!
আজ ঘরে থাক, কাজ নেই গিয়ে বাজারে।।
গোল গোল লুচি ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিছে থালাতে থালাতে,
এই শুভক্ষণে চাস কোনখানে পালাতে?
আলুর দমেতে বাটি ভর-ভর
কড়াই-শুঁটিও কাঁপে থর-থর,
হিং-এর সুবাসে প্রবাসী-বন্ধু আনমনা হল বিলাতে।
ময়দা-ময়ানে মাখানো লেচিরা ঘিয়ে এল অবগাহি রে!
ওরে আজ তোরা পাত পেড়ে বোস, যাসনে ঘরের বাহিরে।।



(১৮)
শুক-সারি সংবাদ।

ছাতিম গাছ বিলাসিনী পেঁচি আমাদের।
পেঁচি আমাদের পেঁচি আমাদের-
আমরা পেঁচির, পেঁচি আমাদের!
শুক বলে আমার পেঁচা দিনে নাহি দেখে,
সারি বলে আমার পেঁচি চশমা পরে থাকে,
রোদ যে তাইতে ঢাকে!
শুক বলে আমার পেঁচা পরম রূপবান,
সারি বলে পেঁচি ওকে ভাবে শারুখ খান
নইলে সবাই সমান!
শুক বলে আমার পেঁচা ভুতকে না ডরায়
সারি বলে ভূতেরা যে পেঁচিকে ভয় পায়,
তবে আর ভয় কে দেখায়!
শুক বলে আমার পেঁচা করল এম-এ পাশ,
সারি বলে তুলল পেঁচি দিয়ে লম্বা বাঁশ
না হলে পড়ত ধপাস!
শুক বলে আমার পেঁচা জিতল ভোটে ওরে-
সারি বলে টিকিটটা কে আনল চুরি করে,
নাহলে যে মরত ঘুরে!
শুক বলে আমার পেঁচা পার্লামেন্টে যাবে,
সারি বলে তাও ভাল দিন ঘুমিয়ে কাটাবে।
পেঁচিও সঙ্গে যাবে!
পেঁচি তার সঙ্গে যাবে!!!


১৯) ধর্ম ব্যবসা।
কোরান পড়িতে দিয়োগো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।
বয়েত বলিতে না যদি বা পারি,
ফেলোনা আমারে মরায়ে।।
গলিত পচা এই সমাজের ভার
ধরম বেচিয়া টানি কত আর
নিজ হাতে তুমি কষে দিও মার
দোজখের বেড়া যাই পারায়ে।।
ক্ষমতাপিয়াসী পুরোহিত-মোল্লা
ভাগাও তাদেরে মারিয়ে,
নিজে এসে বোস নিজের দোকানে
খেদাও সবারে তাড়িয়ে।
বিকায়ে তোমারে তারা লাভ পায়
তোমার লাভের গুড় পিঁপড়াতে খায়,
মোর আর্জি তোমার কানেতে না যায়,
দালালের দেয়াল পারায়ে।।



২০)
দুঃসময়।

ছায়া ঘনাইল পথে পথে
কাননে কাননে ডাকে শেয়াল।
কবে মানুষের মাঝে মাঝে
গোপনে উঠিয়া গেল দেয়াল।।
কে জানে কাহার ইশারাতে
একদা খাইতে পান্তাভাতে
সহসা মাথাটি গেল নিয়া
কাটিয়া পুরোটি গেল নিয়া।।
যে বাটি ফ্রিজেতে ছিল ঢাকা
গোমাংস নাকি তাতে ছিল রাখা।
ওরে তোরা মারবি ত মার না
খামখা দিলি কেন এ বদনাম?
কেন মনে এল এই বদ্‌খেয়াল,
মানুষে মানুষে এই দেয়াল।।

২১)



Wednesday, December 25, 2019

চার্লাইনী- ছড়া।

চার্লাইনী


১)
ধর্মের মৃত্যু।।
হিঁদু কহে একদা, হে মোছলমান ভাই,
আছিনু সমাজমধ্যে সমান সবাই।
মানুষ আনিল যবে নিজ নিজ গরু,
ধর্মাধর্ম ঘুচে হল খাওয়াখাওয়ি শুরু!

(গরুর স্থলে 'গুরু' লিখলেও অর্থ বদলায় না।)

২)
ভোটযাত্রা।।

ভোটযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম,
ভোটার বুথেতে গিয়ে করে মতদান।
লোক ভাবে আমি দেব, নেতা ভাবে আমি,
ই-ভি-এম ভাবে আমি, হাসিছে অম্বানী!

৩)
মূল্যবোধ।।

এম-এল-এর লিস্টে এক নির্দলীয় নেতা
জিতিয়াছে কোনমতে সে-ও জানে সেটা
সরকার গড়ার কালে মন্ত্রী বলে ভাই,
তুচ্ছ নহ, আমরা যে তোমাকেই চাই!

৪)
সৌপ্তিক-পর্ব।।

মন্ত্রী কহে যুক্তি করে আজকে সারারাতি
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মিলে চুক্তি নতুন পাতি।
বিরোধিদের পাণ্ডা আমার সুগ্রীব-দোসর,
সৌপ্তিক-পর্বটি সারা যখন হল ভোর!!

৫)
প্রমাণ।।

জনতার নির্বাচনে হয়ে বলীয়ান,
নেতা কহে যা-খুশি করার অধিকার
পেয়েছি হে, অতএব এবার ভোটার-
নাগরিক কিনা তার দেহো রে প্রমাণ!

৬)
সুবিধাবাদী।।

ক-দল থেকে ভোটে দাঁড়াই, তাইত গেলাম জিতে
খ-দল এবার টাকার থলি বাড়ায় আমায় নিতে।
গ-দল দিল দরটি উঁচু তাইতো ছুটে গেলাম
পাবলিক? কার পরোয়া করি? সেলাম টাকা, সেলাম!

৭)
গিরগিটি।।

যখন যেমন তখন তেমন, তাই হতে পাই যদি
আমায় তবে কক্ষনো আর ছাড়তে না হয় গদি!
বাম-জমানায় লাল পতাকা উড়িয়ে দিতাম সুখে,
চেয়ার ঝেড়ে নীল-সাদা রঙ আজ মেখেছি মুখে।

৮)
কেষ্টর কীর্তি।।

কেষ্টা কহিল 'মোর কী সাহস বল!
ভোটারে ডাকিয়া খেতে দিই গুড় জল।'
দিদি বলে, 'আমি আছি, তাই হাঁকডাক-
ভোট নিই আমি, তুই বাজা শুধু ঢাক!'

৯)
উন্নয়ন।।

গুরুজিরে শুধালেম দেশে এত গুণী
তবু মোরা এগোইনা কেন বল শুনি।
গুরু কহে সর্বশক্তি দিয়ে সবে টানে,
একদল সম্মুখেতে অন্যে পিছুপানে!

১০)
রাজদণ্ড।।

রাজা কহে রাজ্যে থাকি আমি যতক্ষণ
প্রজাগণ কোলাহল করে বিলক্ষণ।
পালাই বিদেশে আমি, গৃহমন্ত্রী থাকে
বংশদণ্ড হাতে নিয়ে সুশাসন রাখে। 




Thursday, November 28, 2019

রম্য রচনা- বিয়ের চিঠি।।

বিয়ের চিঠি।।
বাড়িতে খুঁজলে এখনও পুরোনো কিছু বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠিপত্র খুঁজে পাই। তার মধ্যে কয়েকটা বেশ মনে রাখার মত। একবার একটা খুঁজে পেলাম কাকার এক বন্ধুর বিয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো চিঠি। ছাপানো কভারের ভেতরের ভাঁজে তিনি লিখছেন নিজের হাতে-
"জীবনটা নয় কঠিন পাথরে গড়া,
মালার বাঁধনে তাই ত দিতেছি ধরা;
আঠারো বোশেখ হে বন্ধু এসো
প্রীতিতে হৃদয় ভরি,
তব শুভেচ্ছা আজিকে পাথেয় করি।"
উত্তর ভারতীয়দের বিয়েতে একটা শ্লোক নিশ্চয়ই থাকবে হেডিংএ, মন্দ লাগে না পড়তে, শুধুমাত্র 'শ্রীশ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ' থেকে হয়ত ভাল-
"মঙ্গলম্‌ ভগবান বিষ্ণু, মঙ্গলম্‌ গরুড়ধ্বজঃ।
মঙ্গলম্‌ পুণ্ডরীকাক্ষঃ, মঙ্গলায় তনো হরিঃ।।
আমাদের পাড়ার ভার্মা চাচা আরেকটু বৈচিত্র্য দেখিয়েছিলেন তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ের কার্ডে। তার মূল অংশে হিন্দিতে লেখা ছিল-
"ভবসাগর মেঁ উতর রহে হ্যাঁয় দো প্রাণী নাদান খিবৈয়া,
শ্রীমান দো আশিস উনহে, ত্যয়র সকে ওয়ে জীবন নাইয়া।
ভেজ রহে হ্যাঁয় নেহ নিমন্ত্রণ প্রিয়বর তুমহে বুলানে কো,
হে মানস কে হংসরাজ তুম ভুল ন জানা আনে কো।"
প্রসঙ্গ ক্রমে জানা গেল একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা। বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীকে মেজবৌদি তাঁর ছোট দেওরটির জন্যে পছন্দ করে শ্বশুর মহাশয়কে বিস্তারিত জানালে তিনি কূল গোত্র ইত্যাদি দেখে বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। ২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ, রবিবার, ইংরেজি ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য পাত্রীর পিত্রালয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে কন্যাহ্বানের নিয়মানুযায়ী পাত্রীকে পাত্রের বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রীপক্ষ সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন। বেণীমাধব রায়চৌধুরী আত্মীয় স্বজনসহ কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এ জন্য কন্যা পক্ষের পাথেয় খরচ বাবদ ষাট টাকা, বাড়ি ভাড়া বাবদ বাইশ টাকা তিন পাই খরচ বহন করেছিলেন পাত্রের বাবা। ক্যাশ বইয়ের হিসাবে আরো জানা যায়, বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রও ছাপা হয়েছিল এবং ডাকযোগে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল।
পাত্র রসিক মানুষ, তাই দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল হাতে লেখা একটি বিচিত্র রকমের চিঠি দিয়ে। নিমন্ত্রণপত্রটির বয়ানটি হুবহু এরকম:
‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি
অনুগত
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
চিঠিটা বিচিত্র নয়? পাত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং! এই চিঠির উপরের দিকে সচিত্র অ্যাম্বুস করা ছিল, ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’।

Wednesday, November 27, 2019

বরাহ-নন্দন।। গল্প

বরাহ-নন্দন।।

(১)
দীপু মানে সুদীপ্ত সরখেলের মত ভাল আর বন্ধুবৎসল মানুষ এই শহরের বাড়িতে বাড়িতে পাঁচ সেলের টর্চ জ্বেলে খুঁজলেও দুটি পাওয়া যাবে না। সে আবার এত মিষ্টি-স্বভাবের যে অত্যন্ত প্রাণের বন্ধুকে পর্যন্ত গালাগাল দিতে পারে না। তবু কিন্তু বন্ধুমহলের আড্ডায় তার খাতিরটা রয়ে গেছে কেবলমাত্র বাবার মিষ্টির দোকান আছে বলে। মানে দীপু বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়ায় না , বাপের চোখ এড়িয়ে সে কাজটি করার সাধ্যি তার নেই, তবে হাতে কাঁচা টাকা আসে কিনা! তাই চা-সিগারেটের খরচটা কিম্বা মাঝে মাঝে চপ-সিঙাড়া খাওয়ানো- প্রতিষ্ঠা বাঁচাতে এই যথেষ্ট। ইতিহাস-সাইকোলোজি-পল সায়েন্স নিয়ে বি-এ পাশ করলে যে চাকরি পাবে না এ বাজারে তা প্রায় জানাই ছিল, আর তাই সে আর এমনতর চেষ্টাও করেনি। বাপের দোকান সার্কুলার সুইটস্‌এ মাঝে-সাঝে বসতে হয় না তা নয়, তবে সে দিনগুলো হয় দোকানের পক্ষে দুর্দিন, কারণ বন্ধুদের আড্ডা সেদিন সেখানেই বসে কিনা!

সার্কুলার সুইটস নামটা কিন্তু শহরের গোলচত্বর মানে সার্কুলার পার্কের মুখে দোকানটা বলে নয়, সরখেল মশায় এফিডেবিট করে নামের বানানটা করিয়ে নিয়েছিলেন Circle, সেই থেকে সার্কুলার। অবশ্য নামে কিছু যায় আসে না, স্থান-মাহাত্ম্যের গুণে আর মিষ্টির কোয়ালিটির ফলে দোকান এমনিই গড়গড়িয়ে চলত, এক্ষেত্রে দীপু চেষ্টা করেও কিছু ক্ষতি করতে পারত না। কিন্তু তবু কী যেন এক তুচ্ছ কারণে একদিন এক খদ্দেরের সঙ্গে ওর মার-মার ঝগড়া লেগে গেল। খদ্দেরটি বিহারি, একেবারে চ্যাংড়া মাল, 'তেরি মা কী...' বলে এমন গালাগাল শুরু করল, আর থামেই না। এরা আবার নিজের চেয়েও বড়রকমের গালি না শুনলে মুখ বন্ধই করে না আর দীপুর ছোটবেলার থেকে কী যে স্বভাব, 'শালা' কথাটাও বেরোয় না মুখ থেকে। মুখ নিশপিশ করছে বেশ স্মার্টলি একটা জব্বর গালি ঝাড়তে, অগত্যা মনের জোর এনে বলেই ফেলল- 'শালা শুওরের বাচ্চা'! কিন্তু কী অদ্ভুত, নিজের কানকে বিশ্বাস হল না দীপুর, আসলে ওর মুখ থেকে অটোমেটিক ফিল্টার হয়ে যে শব্দটা বেরোল, সেটা 'ব্যাটা বরাহ-নন্দন!'

ঠিক সেই সময় দোকানে ঢুকছিল ন্যাড়া-চৈতন্য, মানে দীপুর দুই বন্ধু নরহরি আর চেতন, একেবারে হরিহর-আত্মা দু'জন। ওরা দীপুর মুখে বরাহনন্দন শুনে হেসে উঠল হো-হো করে। কিন্তু সেই বিহারি চ্যাংড়া লোকটি না জানি কী ভেবে চুপ করে গেল, বাকি পয়সা দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।

- ওরে দীপু আজ গাল দিয়েছে রে, বরাহনন্দন! উটোও আবার গাল- ন্যাড়া তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল।
- বড়া-লন্দনটা কী রে? গালাগাল না তোদের দোকানের নতুন মিঠাইয়ের নাম? - চেতন হাসতে লাগল।
দীপু চুপ করেই আছে। ও তখনও ভেবে চলেছে শুওরের বাচ্চাটা হঠাৎ করে অত সাধু হয়ে গেল কীভাবে! ওটা কি সত্যিই গালি? বরাহ কথাটা ওর মাথায় এল কোত্থেকে? কিছুক্ষণ পরে মোটু, মানে গদাই আর বিশু অর্থাৎ বিশ্বম্ভর এল। দোকানের মিস্লেনিয়াস অ্যাকাউন্টে সবাইকে চা খাওয়ানো হল বটে, তবে সেদিন আর আড্ডাটা তেমন জমল না। আজ নিতাইদাকে দোকান বন্ধ করে দিতে বলে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল দীপু।


(২)
বাসায় ফেরার পথেই ওর মাথায় এল হিন্দুধর্মের ইতিহাসে পড়া দশাবতার-কল্পনা, মৎস্য-কুর্ম-বরাহ। মাছ-কচ্ছপ-শূওর! আরে শূওর তো বিষ্ণুর অবতার রে! অবতারের বাচ্চা তাহলে গালি কেন হবে? বাড়িতে গীতগোবিন্দের অনুবাদ ছিল। বের করে পড়ল-
'দশন-শিখরে তব ধরণীটি লগ্ন-
কলঙ্ক-চাঁদে যেন মগ্ন।
শূকরের রূপ প্রভু ধরিলে,
জয় জগদীশ হরে!'

পরদিন সকাল সকাল মোটু গদাই আর বিশু এসে হাজির। ''কী রে, কাল কী হয়েছিল দোকানে? মোটু শুধোল। 'কোন ব্যাটা বিহারি হুজ্জোত করেছে, চিনিস হারামিটাকে- একবার দেখে নিতাম!'
- ছেড়ে দে মোটু, খদ্দেরের কথায় চটলে বিজনেস করা যায়না। তার চেয়ে বড় কথা আমিও রাগের মাথায় ওকে গালাগাল করেছি।
- দূর শালা, বরাহলন্দন যদি গালি হয় তাহলে ঘোড়ার ডিম মানে সার্কুলার সুইটসের রাজভোগ!- বিশু বলে। 'মাইরি, শুওরের বাচ্চা বলে যা আনন্দ, মেজাজ তর হয়ে যায়, সেখানে কিনা বরাহ-লন্দন!'
- আচ্ছা বিশু, বলতে পারিস, শুওর বলাটা গালি কেন? নোংরা বলে? ব্যাপারটা জানতে হচ্ছে- দীপু বলে।
তবে  এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হল না দীপু, সেইদিন থেকেই ও শুওরের সম্বন্ধে রীতিমত পড়াশুনা শুরু করে দিল। এই ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছিল সাহিত্যিক অনীশ দেবের লেখা একটা রম্যরচনা আর অজস্র পুরাণ-কোরান। বন্ধুরা আড্ডায় দেখা পায়না, দীপুর বাবা সুজিতবাবু চিন্তাগ্রস্ত, ছেলে দোকান যেতে চায় না, আড্ডাও কমিয়ে দিয়েছে, এই কাঁচা বয়সে বই মুখে নিয়ে কী সব আবোলতাবোল লিখে চলেছে!

-কী বলছেন কাকু, আবোলতাবোল মানে? কী লিখছে আমাদের বিশু? সেদিন দোকানে গিয়ে দীপুর খোঁজ নিতেই সরখেলমশাই যে খবর জানালেন তার জবাবে পালটা প্রশ্ন বিশুর।
- আর বোলো না! দেখি 'আবোলতাবোল' নামে একটা বই খোলা টেবিলের উপর, তার উপরে চোখ রেখে দীপু লিখে চলেছে- 'সুকুমার রায় তিনটি শুয়োরকে টুপি পরা অবস্থায় না দেখে অবাক হয়েছিলেন, তাহলে কি শুওরের পক্ষে টুপি পরে থাকাটাই স্বাভাবিক? শুয়োর কেন টুপি পরে, কে তাদেরকে টুপি পরায়?' কী পাগলের কাণ্ড বল দেখি!
- কাকু, দীপুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি তাহলে।
- ওকে এখন পাচ্ছো কোথায়? মূর্তিমান সকাল সকাল হুগলি চলে গেছে ওখানকার শুয়োরদের স্টাডি করতে।

(৩)
সেদিন সন্ধেয় ক্লাবের আড্ডায় আসা মাত্র দীপুকে পাকড়াও করেছে ওর বন্ধুরা। 'কী রে, হুগলিতে কী দেখলি? শুওরগুলো টুপি পরেছিল?'
- না রে, শুওর যে টুপি পরে না সেটুকু বোঝার বুদ্ধি আমারও আছে। আমি গেছিলাম চন্দননগর, ওখানকার অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের লাইব্রেরিতে শুওর সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনো করতে।
এখন আর দীপুর বন্ধুরা ওর কোন কথায় অবাক হয় না। ওরা শুধু শুনে যায় সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী।
- বুঝলি, সুকুমার রায় সম্বন্ধে যদ্দুর জানি, লোকটা বিনা কারণে একটা লাইনও লেখেন নি। সবই নিছক মজা মনে হয়, কিন্তু সবকিছুর আড়ালে হয় আছে শিক্ষামূলক কিছু, নয় ব্যঙ্গ। এখানে তিনটে শুওর কি নিছক মজা? কিন্তু ওখানেই এক বুড়ো সিরিয়াসলি নিল কথাটা। বলল, সে সব অনেক পুরনো ঘটনা, চলে যাও চন্দননগর, বলে এক ফরাসি বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের নাম বলল আমাকে।

- তা, কী পেলি রে চন্দননগরে?
- অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের ওল্ড লাইব্রেরিয়ান দেখলাম সুকুমার রায়ের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন। তবে টুপি পরা শুয়োর বলতে তিনি যে শুয়োরকেই মীন করেননি সে সম্বন্ধে তিনি একপ্রকার নিশ্চিত। মানুষের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, পার্শী প্রায় সবাই টুপি পরত সেকালে। তবে হিন্দুদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত লোকেরা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আর চাষিরা ক্ষেতে-খামারে আর মুসলমানরা জুম্মার নামাজেই সাধারণতঃ টুপি পরতেন। মাথায় চব্বিশ-ঘন্টা টুপি লাগিয়ে রাখতেন ইউরোপীয়রা মানে ইংরেজ আর ফরাসি সায়েবরা। এই টুপিধারিদের ক্লাসটাকে উদ্দেশ্য করেই হয়েছিল ছোটনাগপুরের সাঁওতাল বিদ্রোহ, বিরসা তাঁদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন- 'টোপি টোপি এক হ্যায়, সবাই আমাদের শত্রু'।
'তাহলে কি তিনজন ফরাসি সায়েবকে টুপিহীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে মজা করে সুকুমার ওই ছড়াটা লিখেছেন বলে আপনার মনে হয় মসিঁয়ে?' আমি জিগ্যেস করলাম।
- কী বললেন ভদ্রলোক?
- উনি বললেন সেটা হতেও পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে সুকুমার ফরাসিদের কোন অসম্মান করেননি বা তাঁদেরকে শুয়োর বলে মনে করেননি। জানতো, ইউরোপীয়দের মধ্যে শুয়োরকে টুপি পরানোর চলও আছে। তবে শুয়োরকে পশ্চিমে নাকি দুরকমভাবে দেখে, বাচ্চা শুয়োর বা পিগি হল একটা আদরের জিনিস, ছোটদের খেলার সামগ্রী, আর বয়স্ক শুয়োর বা হগ একটা নোংরা জন্তু, যার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষের পেটে যাওয়া। তাই ইংরেজিতে বলা হয়- 'বাচ্চাগুলোকে খাওয়াও, বুড়োগুলোকে কেটে খাও'- কী অদ্ভুত উলটো-পালটা ভাবনা না?
- উরিব্বাস, তুই তো একদম রিসাচ-পেপার নামিয়ে দিয়েছিস রে বরালন্দনের উপরে, চেতন বলে। তা হুগলিতে শুয়ার দেখলি না একটাও?
- দ্যাখ, ঠাট্টা করবি না একদম। বললে বিশ্বাস করবি না, এন্তার শুয়োর দেখলাম, ওরা বিষ্ণুর অবতার কিনা জানিনা, তবে কাছ থেকে দেখতে কিন্তু একদম মানুষের মতন।
দীপুর বন্ধুরা এ কথার আর জবাব কী দেবে? ওরা চারজনেই হাসতে লাগল, নাঃ ব্যাটার মাথায় শুয়োরই ভর করেছে, যেন সাক্ষাৎ বরাহ-অবতার।

(৪)
কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দোকানে বসেছিল দীপু। এ সময় সরখেল মশাই একটু দিবানিদ্রা দেন, তাই সে সময়টা দীপু দোকান পাহারা দেয়। সাড়ে তিনটের সময় গদাই আসতেই দীপু নিজে হাতে চা এনে দিল ওকে। বলল, 'এই মোটু, ভারত সংঘ আশ্রম যাবি আমার সঙ্গে একবার?'
- 'আশ্রম মানে ভারত সেবাশ্রম সংঘ? হঠাৎ?'
- 'না, একটু স্বামী বৈকুণ্ঠানন্দের সঙ্গে কথা বলতাম হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে। বাবা এলেই বেরিয়ে পড়ব।'
- 'শাস্ত্র মানে আবার শুওর? তুই শালা এবার একটা সত্যিকারের শুয়োর পোষ!'
- 'দূর পুষতে যাব কেন? এইতো কত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশে-পাশে, এখন কথা বলছে আমার সাথে'- বলতেই রেগেমেগে তেড়ে গেল গদাই, কিন্তু পরের মুহূর্তেই থেমে গেল পাশের দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসা নচিকেতার গলায় একটা গান শুনে-
'হাসপাতালের বেডে টিবি রুগির সাথে
খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা-----'

হেসে উঠল দুজনেই।

-  'বুঝলে বৎস, একটা ইঁদুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে তোলা হয়েছে- এই প্রাণীর নাম 'মুষিকবৃদ্ধি' '- পণ্ডিত তাঁর শিষ্যকে বলেন, সে একটা শুয়োর দেখতে পেয়ে ওটা কী জিনিষ তা জানতে চেয়েছিল। সেই সময় আর এক পণ্ডিত যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে। তিনি শুনে থেমে বললেন, 'আরে না না। হাতিটা না খেয়ে শুকিয়ে এই হাল হয়েছে, এর নাম 'গজক্ষয়ঃ'।' এই বলে স্বামীজি হেসে থামলেন।
- 'স্বামীজি, বরাহ অবতারের কথা শুনেছি। আপনার গল্পটাও বেশ মজার। শাস্ত্রে আর কিছু নেই শুয়োর নিয়ে?' দীপুর জানার ইচ্ছে এত সহজে মেটে না।
- 'তাহলে তোমাকে কিছুটা ইতিহাস শোনাই, তার পরে আসি পুরাণে। জান, শূকর পোষা পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীন পশুপালন প্রথা, এর ইতিহাস নয় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো, ছাগল-গরু-ভেড়া-ঘোড়ারও আগের। ইউরেশিয়ার বন্যবরাহদের ডি-এন-এ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে এ তথ্য!'
- 'বলেন কি স্যার?' বলেই গদাইয়ের খেয়াল হয় ও কলেজের ক্লাসে নয়, স্বামীজির সাথে বসে আছে। 'মানে স্বামীজি'- ও শুধরে নেয়।
- 'সংসদীয় গণতন্ত্র শুয়োরের খোঁয়াড়'- এই কথাগুলো কারা বলে জান? এ কথা লেনিন বলেছিলেন, তবে এখনকার ভারতীয় বামপন্থীরা এই উক্তি এখন আর মানে না। শুয়োরের খোঁয়াড় নোংরা নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার মধ্যেও একটা ব্যাপার আছে, কী তা জান?'
- 'স্বামীজি, আমরা অধম, শাস্ত্রজ্ঞান নেই। তাই বলে শুওর-বিশেষজ্ঞও নই। আপনি বরং একটু বুঝিয়ে বলুন।'
- 'হুম! শুয়োর নোংরা প্রাণী, নোংরার মধ্যে থাকতে, আবর্জনা ঘাঁটতে ভালবাসে বটে, যার জন্যে ইসলামে এদের মাংস হারাম, মানে নিষিদ্ধ। শুয়োর কিন্তু নিজেদের বাসস্থানকে নোংরা করে না, পায়খানা-টায়খানা খোঁয়াড়ের বাইরে সারে বেশিরভাগ সময়। এ নিয়ে একটা গল্প আছে হিন্দু পুরাণে। তবে আজ নয়, এখন সন্ধ্যারতির সময়। কাল এসো তোমরা, আরো গল্প করা যাবে, কেমন?'

কী আর করা যায়! বাসায় এসে সব কিছু একটা নোটবইয়ে লিখে রাখল দীপু।     

(৫)
পরদিন সকাল এগারোটায় শহরের সার্কেলের পাশের মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছিল উঠতি নেতা সুভাষ সিকদার। ব্যাটা কয়লার মাফিয়া, কোটিপতি। তবু সকালে ন্যাড়াদের বাসায় এসেছিল, সম্পর্কে নাকি ন্যাড়ার মামা হয়। এসে ন্যাড়ার বাবাকে বলে কিনা, 'জামাইবাবু, পার্টির লোকেরা বলছিল ফর্সা নতুন পাঞ্জাবি পরে নাকি জনসভায় ভাষণ দিতে নেই। আপনার কাছে একটু পুরনো ময়লা পাঞ্জাবি আছে, একটু ছেঁড়া হলে আরো ভাল হয়?'
  
'আমার জামা তোমার গায়ে হবে? তোমার সাইজ কত?'
'বুক ছাব্বিশ, পেট ছাব্বিশ, কোমর ছাব্বিশ'- সাইড থেকে দীপু ফোড়ন কাটল।
সুভাষমামার নির্ঘাৎ হ-য-ব-র-ল পড়া ছিল না। তাই ও একটু অবাক হয়ে তাকাল দীপুর দিকে। তবে ন্যাড়া সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা-টিনেমা দেখে। ও লালমোহন গাঙ্গুলির মত বলে উঠল- 'অ্যাই, আমার মামা কি শুয়োর?'
' শালুক চেনে গোপালঠাকুর, শুয়োর চেনে কচু!' মনে মনেই আপাততঃ একটা গাল দিল দীপু, 'শালা সব শুয়োরের বাচ্চাকে কি চেহারায় চেনা যায়? চিনতে হয় তার আচার-আচরণে!' মুখে কিছু বলল না, কে জানে কবে ব্যাটা এম-এল-এ, মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যায়, ব্যবসা করে খেতে হয়, এগুলোকে চটালে চলবে না।

কিছুক্ষণ বক্তৃতা শোনার পর যখন দেখল গরীবের জন্যে চোখের জলে বাবার ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা ভাসাচ্ছে সুভাষমামা, ন্যাড়া অস্ফুটে বলল- 'হারামি কোথাকার! কুমিরের কান্না দেখাচ্ছে। সন্ধেয় বাড়ি ফিরেই তো মালের বোতল নিয়ে বসবে।'
-'আরেকটা বরাহ-নন্দন!' দীপু বলে। 'হ্যাঁরে, জিগ্যেস করে আসি, মাইকটা ধরে আছে- ও'দুটো ওর হাত না সামনের পা?' শুনে ন্যাড়া-চৈতন্য এমন জোরে হাসল যে আসেপাশের লোকজন চমকে তাকাল ওর দিকে।
কিন্তু এটা তো কোন সমস্যার সমাধান নয়। শুয়োরের আরো কী গল্প শোনাবে বলছিলেন স্বামীজি। আজ মোটকা গদাই নেই, বিশু কোথায় যেন গেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, তাই ন্যাড়া-চৈতন্য যাবে সাথে ঠিক হল।

- 'ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা অযোধ্যার হরিশ্চন্দ্রের নাম শুনেছ তোমরা? রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। একবার একটা গোলমালে ফেঁসে গিয়ে সারা পৃথিবী বিশ্বামিত্র মুনিকে দান করে দিলেন। এখন আর থাকারও জায়গা রইল না, শেষে কাশীধামে গিয়ে থাকতে হয় তাঁকে। সে জায়গাটা নাকি শিবের ত্রিশূলের উপর দাঁড়িয়ে, তাই বিশ্বচরাচরের বাইরে। দানের পর দক্ষিণা চান ঋষি। তখন আর রাজার কাছে কিছুই নেই, বাধ্য হয়ে বউ শৈব্যা আর ছেলে রোহিদাসকে বিক্রি করে কিছুটা চুকান তিনি। বাকিটার জন্যে হরিশ্চন্দ্রকে নিজেকে বেচে দিতে হয় এক হাড়ির কাছে।'
- 'দানের পরে আবার দক্ষিণা! এ আবার কী রে বাবা?'
- 'সেটা সেকালের নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণকে দানের ক্ষেত্রে। মহাভারতে আছে 'বিপ্রেভ্য প্রযচ্ছ কনকং বহু', মানে ব্রাহ্মণকে সোনা দাও দক্ষিণায়। তবে বিশ্বামিত্র কিন্তু জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় ছিলেন, আমি হলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসতাম। যাক্‌গে, রাজা একটু ভালমানুষ ছিলেন। হাড়ির চাকরিতে ওঁর কাজ ছিল ঘাটে মড়া পোড়ানোর টাকা আদায় করা আর হাড়ির শুয়োরদের দেখাশুনা করা। মানুষরা রাজাকে যতই কষ্ট দেক, শুয়োরদের কিন্তু সহানুভূতি ছিল। রাজা মানুষ, মলমূত্র সাফ করতে পারবে না, তাই ওরা কথা দিল রাজার সুবিধার জন্যে ওরা এসব কাজ বাইরে করে খোঁয়াড়ে ফিরবে। শুওরদের কথার দাম দেখ, আজ পর্যন্ত তারা তাই করে থাকে যতক্ষণ পারে।'
- 'তারপর?' ওদের তিনজনেরই মুখ হাঁ এরকম অদ্ভুত উপাখ্যান শুনে।
- 'তারপর জানা গেল ওই হাড়ি স্বয়ং ধর্মরাজ ছিলেন। শেষে বহু পরীক্ষার পরে হরিশ্চন্দ্রের শাপমুক্তি ঘটল, ফিরে পেলেন রাজ্য, বউ, ছেলে- তবে সে অন্য গল্প।
- 'স্বামীজি, এসব আমাদের পুরাণে আছে?'
- 'হ্যাঁ গো, রামায়ণে তো আছেই, মহাভারতের শুরুতে বৈশম্পায়ন রাজা জন্মেজয়কেও এ কাহিনী শুনিয়েছিলেন। আরো দু-একটা পুরাণেও আছে, একটু রকমফের করে। কেন, এ-দেশের প্রথম নির্বাক ফিচার-ফিল্মও তো হয়েছিল ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকের পরিচালনায়, শোননি তোমরা?'
- 'হঁ হঁ, দিশা হছ্যে, এইত সে বছর কত উৎসব হল চলচ্চিত্রের শতবার্ষিকীতে'- চেতনের মনে পড়ল।


(৬)
এই নিয়ে আজ বেশ কয়েকদিন হল দীপু বেশ চুপচাপ আছে, বরাহ-নন্দন নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। ভাবা গেছিল যে ওর পাগলামি বোধহয় চিরকালের জন্যে ঘুচল এতদিনে। মাঝে বরাহ-পুরাণ বলে একটা বই পড়ছিল সে, স্বামীজির রেফারেন্সে আশ্রমের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে। সত্যযুগে বিষ্ণু ভগবান নাকি বিশাল এক শুয়োর-রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যাক্ষ নামের কোন এক দৈত্যকে মেরে তার কব্জা থেকে সাগর-তলে ডুবিয়ে রাখা পৃথিবীটাকে দাঁত দিয়ে উদ্ধার করে তুলে এনেছিলেন, তার চমকপ্রদ কাহিনী শোনাচ্ছিল একদিন ওই বই পড়ে। বন্ধুদের বয়স হয়েছে, আর রূপকথার গল্প শোনবার আগ্রহ বা উৎসাহ কোনটাই নেই। তাই দীপু একটু মনমরা ছিল ক'দিন। কাল রাঁচিতে ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখে এসে একটু ভুলেছে সে দুঃখ।

আজকাল আর সময় কাটছে না দীপুর। বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে কোন ঝামেলা নেই, দোকানেও কিছুটা বেশি সময় থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে ও। কিন্তু একা অলস হয়ে থাকলেই বিপদ, চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ছোট্ট শুঁড় আর আড়াই-প্যাঁচের লেজ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে কোন বরাহনন্দন, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করে চলেছে। তাকিয়ে দেখে, যাঃ ব্বাবা, সামনে টিভিতে ক্রিকেট শেষ হয়ে পুরনো দিনের টেনিস খেলা দেখাচ্ছে, খেলা চলছে দুই লিজেন্ড প্রতিদ্বন্দ্বী স্টেফি গ্রাফ আর মোনিকা সেলেসের মধ্যে, আর প্রতিটা বল মেরে মোনিকা কেমন শুয়োরের মত ঘোঁত-ঘোঁত করে চলেছে। আচ্ছা এই জন্যেই কি কে নাকি ছুরি মেরেছিল মোনিকা সেলেসকে? না না, সে নাকি স্টেফির ভক্ত ছিল, কী জানি, আসল গল্পটা কী। সময় কাটাতে ফেসবুক খুলে দেখে বাঙ্গালোর থেকে সোহমদা ক্রিশ্চিনা রসেটির একটা মজার কবিতা অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন, দীপুকে আবার ট্যাগও করেছেন জানিনা কেন। তবে কি দীপুর এই বরাহ-সাধনার কথা সবাই জেনে গেছে? কবিতাটা আবার পড়ল দীপু, বেশ মজা পেল-

"শুয়োর যদি টুপি পরেই আসে
কী আর বলি, বলো?
ভদ্র মেনেই শুধাই,
'কেমন আছেন, ভালো?' 

ধান্দায় সে খসায় যদি লেজ,
কী বা করার আছে?
নতুন করে লেজ লাগাতে
পাঠাই মুচির কাছে।"

বাঃ, ভারি মজার তো! দীপুর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য, লক্ষ লক্ষ শুয়োর লেজ খসিয়ে, টুপি পরে ভদ্রসমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাদের বরাহনন্দন বলে চিনতে পারছে না, একমাত্র দীপুর চোখেই ওদের ছদ্মবেশ ধরা পড়ছে। যাক, মনটা হাল্কা হওয়ায় সেদিনের মত ঘুমিয়ে পড়ল দীপু।
পরদিন ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ বেলা করে। এমনিতেও সকালটা কিছু করার থাকে না, সকালে বাবাও দোকান যান বেলা দশটার পরে, নিতাইদাই সামলায় ততক্ষণ। ঘুম ভেঙেই শুনছে একটা অপরিচিত গলা- 'সুদীপ্ত আছে?'
- 'সুদীপ্ত?' বাবার অবাক প্রশ্ন কানে আসে। যেন নামটা এই প্রথম শুনছেন।
- 'ও গো, দীপুকে খুঁজছেন ভদ্রলোক', ঘরের ভেতর থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, সুদীপ্ত যে দীপুরই ভাল নাম তা ওর নিজেরই মনে থাকে না প্রায়ই, বাবার কাছে তো আশাই করা যায় না। তাড়াতাড়ি ব্রাশটা সেরে বাইরের ঘরে ছুটল দীপু। দাঁড়িয়ে আছে ওর স্কুলের এককালের ফার্স্ট বয় তাপস। 


(৭)
- 'আয় তাপস, বোস', দীপু বাসায় এনে বসায় তাপসকে, 'আসলে বাবার শুধু কেন, আমার নিজেরই অনেকসময় নিজের ভাল নামটা খেয়াল থাকে না।'
তাপসের মেডিক্যালের ফাইনাল ইয়ার, কলকাতায় পড়ে। ও ছুটিতে এসে অন্য বন্ধুদের কাছে  কানাঘুষোয় শুনেছিল দীপু শুয়োর নিয়ে খুব চিন্তা-ভাবনা করছে। স্কুলে পড়ার সময় দীপুর এধরণের কোন বদখেয়ালের কথা জানত না ও, শুধু জানত তার গালি না দেওয়ার অভ্যেসটা। কিছুটা মজার খেয়ালেই তাই শুয়োরের ব্যাপারটা জানতে এসেছিল সে।

- 'তারপর দীপু, শুয়োরের ব্যাপারখানা কী রে? তুই নাকি হুগলি-চন্দননগর ছুটে বেড়াচ্ছিস গবেষণা করতে!'
- 'আরে ধুর, গবেষণা নয়। আমি আসলে অনেক মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখতে পাচ্ছি আজকাল, এখন তাদেরকে বরাহ-অবতার বলে প্রণাম করি না বরাহনন্দন বলে গালাগাল দিই তা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।'
 - 'আরে তুই তো জেনেটিক্সের পণ্ডিত হয়ে গেছিস রে! খুব পড়াশোনা করছিস, না?' এবার অবশ্য তাপসের গলায় ঠিক ঠাট্টার সুর নয়।
- 'কই না তো! এই তুই কি ইয়ার্কি মারছিস আমার সঙ্গে? দ্যাখ আমি তোদের মত পড়াশুনায় ভাল ছিলাম না তেমন, তাই বলে ঠাট্টা করবি?'
- 'দূর কী যে বলিস! ওসব ভাল-খারাপ স্কুলেই চলে, পরে ওসব কোন কাজে লাগে না, সেখানে কিছুটা ভাগ্য, কিছুটা বুদ্ধি আর বাকিটা উদ্যম আর পুরুষকারের হিসেব চলে। তবে আমি সিরিয়াসলি বলছি, শুয়োরের সঙ্গে মানুষের কিন্তু জেনেটিক্যালি অনেক মিল আছে।'
- 'কিরকম শুনি?'
- 'দ্যাখ খুব সাংঘাতিক রকমের মিল হয়ত নেই, মানে যতটা বাঁদরের সঙ্গে আছে। ইন ফ্যাক্ট, জেনেটিক্যালি শুয়োর থেকে বেশি মিল আমাদের ইঁদুরজাতি বা রোডেন্টের সঙ্গে আছে। শুয়োর বা সোয়াইন জাতি আর মানুষ-বাঁদর মানে প্রাইমেট জাতির এক পূর্বপুরুষ ছিল প্রায় আট কোটি বছর আগে। মানুষ আর শুয়োরের জেনেটিক ম্যাপিং-এ জাঙ্ক ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এই ক্লু পাওয়া গেছে। তারপর এদের দুজনেরই সাইটোপ্লাজমের মধ্যে  কমন 7SL RNA পাওয়া গেছে।'
- 'উরিব্বাবা, কিছুই তো বুঝলাম না। তার মানে কী মানুষ আর শুয়োরের জিন সমান?'
- 'না, তা নয়।  তবে অন্ততঃ ৮০% মিল আছে। যেমন দুজনের DNAতে protein coding sequence একরকম। কিন্তু জিন-গবেষক মোরানের মতে ৮০% হোক বা ৯৮%, মানুষ বা বানরজাতির মধ্যে  gal-transferase নামে একটা জিন কাজ করে যা অন্য কোন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে দেয় না, মানে অ্যান্টিজেনের কাজ করে।- 'তার মানে বলছিস মানুষ কখনও শূয়োরে পরিণত হবে না?'
- 'স্বভাবে আচারে-আচরণে হবে। অনেক মিলই তো আছে। যেমন ধর শরীরে চুল বা মেদের বাড়াবাড়ি, চর্বি জমার আর কীট-বীজানু আকর্ষণের ঝোঁক আর নোংরা ঘাঁটার প্রবৃত্তিতে খুব মিল, বিশেষ করে ওই শেষেরটা। আর কী চাই?' হাসল তাপস।

তাপস চলে যাওয়ার পরে এই ব্যাপারটা নিয়েই খানিকক্ষণ ধরে ভাবল দীপু। তারপর স্নানে যাবার আগে দেখে ওর ভাগ্নি মিনি একটা ছবিওলা ইংরেজি বই পড়ছে, বইটার মলাটের উপর লেখা 'Alice's Adventures In Wonderland'।
     
৮)
স্নান সেরে এসে দীপু দেখে অ্যালিসের বইটা ছিৎরে পড়ে আছে, মিনি ধারেকাছে নেই। বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে একজায়গায় এসে ওর চোখ আটকে গেল। একটা স্কেচ। একটা বাচ্চা মেয়ে একটা শুয়োরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আছে, তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত।
এখানেও শুয়োর! কিছুটা পড়ে দেখল দীপু। এক ডাচেস কোলের বাচ্চাটা মরিচগুঁড়োর চোটে একটানা হাঁচছে দেখে তাকে ছুঁড়ে লুফছে আর গাইছে, বাংলায় ঠিক এরকম হয় গানটা-
'খোকায় আমার বেদম ধাঁতাই, দাবড়ানি দিই বিষম রাগে,
হাঁচলে পরে দমদমিয়ে পেটাই জোরে;
কারণ, জানি এমনিতে তার মরিচগুঁড়ো ভালই লাগে-
ইচ্ছে করেই মিচকে ব্যাটা অমন করে।'
এই বলে বাচ্চাটাকে অ্যালিসের কোলে ছুঁড়ে দিলেন ডাচেস। নিয়ে সাজগোজ করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ শুনে অ্যালিস চমকে তাকিয়া দেখে, ওমা! বাচ্চাটা তো আর মানুষ নেই, কখন শুয়োর হয়ে গেছে। তখন ও তাকে আস্তে আস্তে মাটিতে নামিয়ে দিল, বাচ্চাটা চার পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

এটুকু পড়েই বইটা মুড়ে রাখল দীপু। ননসেন্স গল্প, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন একটা মেসেজ আছে- মনে হল ওর। আরে, সুকুমার রায়ও তো ওই ননসেন্স ধারারই কবি, লুই ক্যারলের মত। তাহলে কি টুপিপরা তিনটে শুয়োরও অর্থবহ? মহা চিন্তায় পড়ে গেল দীপু।

আজকে বন্ধুদের আড্ডাতে অন্যমনস্ক ছিল দীপু। ন্যাড়া ভুবনেশ্বরের নন্দনকাননে সিংহ দেখে এসেছে গত বছর, অথচ মোটু গদাই তার আগের বছর গিরের জঙ্গলে গিয়ে দেখতে পায় নি কেন তাই নিয়ে বিস্তর তর্ক হচ্ছিল। ওরা দীপুকে সালিশ মানল। ও অনায়াসে বলতে পারত গির থেকে কয়েকটা সিংহ এনে নন্দনকাননে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে খোলা চিড়িয়াখানার মত। কিন্তু তা না করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুজনকে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বলল- 'আর তর্ক নয়, কিছুক্ষণ চুপ করে সিগারেট টান।' চার বন্ধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

তাপস বলছিল 'রাইনোসেরাস' বা গণ্ডার নামে এক বিখ্যাত রূপকধর্মী নাটকের কথা। ফেরার পথে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকল দীপু, ইউজিন আয়নেস্কোর লেখা বইয়ের ইংরেজি এডিশনটা পেয়ে গেল সেখানে। আজ রাত্রে পড়ে দেখতে হবে।


৯)
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। দীপু সকালে সার্কুলার সুইটসের দিকে রওনা হয়েছে, কানে এল পাড়ার দুই মহিলার অন্তরঙ্গ কথোপকথনের অংশ।
- 'সুমিত্রাদির জামাইকে দেখেছ মালাদি, কি হ্যান্ডসাম চেহারা না!'
- 'হ্যান্ডসাম হবে না! ওদের তো লাভ-ম্যারেজ। তাও যদি আমার জামাইয়ের ধারেকাছে আসতো।'
- 'ঠিক বলেছ দিদি, তবে তোমার টুকুর বরও তো ডিভোর্সি। আগের বউটাকে যা পেটাতো, আমার বাপের বাড়ির শহরেরই তো মেয়ে!
- 'যাও যাও সুদেষ্ণা, তোমরা হলে বিশ্ব-নিন্দুকে, কারো ভাল দেখতে পার না। আমরা অমন নই। বিশ্বাসের বউটার কাছে ওই পাঞ্জাবি ছোকরাটা লুকিয়ে আসত, আমি ঘরে আলো নিভিয়ে সব দেখেছি, কিন্তু বল, আজ পর্যন্ত কাউকে কি বলেছি?'

দীপু সভয়ে লক্ষ্য করল, মালাদি আর সুদেষ্ণার নাকগুলো কেমন গোল আর লম্বাটে হয়ে উঠেছে আর পেছন দিকে শাড়ির ভেতরটা কেমন যেন সন্দেহজনকভাবে ফুলে আছে। ও সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল। ওদের দোকানে সামনের দিকে কয়েকটা টেবিল আর বেঞ্চ পাতা থাকে, কিছু খদ্দের ওখানে বসেই চা-মিষ্টি-জলখাবার খান। একজন ট্রেড ইউনিয়ানের মাথা, এক উঠতি পলিটিসিয়ান আর তাদেরই কিছু চামচে বসে সিঙাড়া আর চা খাচ্ছিল। কারখানা বন্ধ করতে হবে কয়েকদিন পরে, পার্টি অনেক টাকা খেয়েছে এক নামী শিল্পপতির কাছ থেকে তারই প্ল্যানিং চলছিল বোধ হয়। দীপুর মাথায় বিশেষ কিছু ঢুকছিল না, তবে ওর যেন হঠাৎ মনে হল লোকগুলোর নাক-মুখ কেমন যেন গোল মতন, নাক-সহ ঠোঁট দুখান এগিয়ে এসেছে, আর বুক-পেট-কোমর সব সমান সাইজ হয়ে গেছে। কাপড়ের তলায় কি লেজ গজিয়েছিল একটা করে, ঠিক বোঝা গেল না। নেতাটির তো মুখের দু-পাশে দুখানা দাঁতও দেখা যাচ্ছে- দীপু সভয়ে চোখ সরিয়ে নিল সেদিক থেকে। আর তাদের কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, শুধু ঘোঁত-ঘোঁতানি ছাড়া। বাবা এলেন কিছুক্ষণ পরে। ও ভয়ের চোটে বাবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলই না, কী জানি তাঁর নাকটাও যদি ওরকম বেরিয়ে এসে থাকে। কোনমতে দোকানের বাইরে পালিয়ে এসে বন্ধুদের আড্ডায় ঢুকল দীপু।

আরে! প্রভাত না? হ্যাঁ, ওদের ছোটবেলার বন্ধু প্রভাতই তো, কমরেড প্রভাত। কাঁধে ঝোলা খদ্দরের ব্যাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়ার সময়ই পাক্কা কম্যুনিস্ট বনে গিয়েছিল প্রভাত। দীপুকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে ও ঠাট্টা করে বলল- 'কী রে, ভূত দেখেছিস নাকি? ওভাবে ছুটছিস যে!'
- 'ভূত নয় রে, শুয়োর', দীপু বলে, সব ব্যাটা শুয়োর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার বরাহ-নন্দন!' এই বলে আজ সকাল থেকে যা যা দেখেছে সব বলল দীপু।
- 'হুম! এটা মনে হচ্ছে নতুন রোগ, নাম দেওয়া যেতে পারে সোয়াইনাইটিস! ঠিক আয়নেস্কোর রাইনোসেরাইটিসের মতই একটা রোগ বাসা বাঁধছে সমাজের শরীরে। নাকি মেটামরফোসিস শুরু হল? একটু ভাবতে হবে এ নিয়ে।'

প্রভাত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন ভাষার বামমনস্ক ছবিগুলো প্রায় কোনটাই ছাড়ে না। সুতরাং দীপুর এই পাগলামিতে সায় দেবার অধিকার তার যথেষ্টই আছে। তবে অন্য বন্ধুরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বিশু খুব একটা বিতর্কে যায় না। তবে চৈতন্য মানে চেতন ছাড়ার পাত্র নয়।
- 'লে হালুয়া! একা হনুমানই লঙ্কা জ্বালাতে যথেষ্ট ছিল, এবার সুগ্রীব জুটল একটা।'
- 'কেন বে! একা মার্ক্সে রক্ষা নেই এঙ্গেলস দোসর- কথাটা মাথায় এল না তোদের, আমার ব্যাপারে ওই বুর্জোয়া রামায়ণ-মহাভারতকে টানবিনা বলে দিচ্ছি',- প্রবল আপত্তি জানায় প্রভাত। 'আমি একদম কিছু বানিয়ে বলছিনা। ইন ফ্যাক্ট, আয়নেস্কোর অনেক আগে মানুষ আর জন্তুজানোয়ারের একাত্মীকরণের কথা ভেবেছিলেন কাফকা। পৌরাণিক গাথা, ঠাকুরমার ঝুলির বুদ্ধু-ভুতুম বা অ্যান্ডারসনের ব্যাঙ রাজপুত্র জাতীয় শিশুপাঠ্য রূপকথাগুলো বাদ দিলে মানুষ থেকে পোকামাকড়ে ম্যুটেশন নিয়ে গল্প লেখেন তিনি, ১৯১২ সালে প্রকাশ হয় কাফকার ছোটগল্প Die Verwandlung, ১৯১৫তে  যার ইংরেজি অনুবাদ হয় Metamorphosis নামে। একটা মানুষের এক বিশাল পোকায় রূপান্তরিত হওয়া নিয়ে এই গল্প সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে, নাটক আর সিনেমাতেও খুব সফল হয় গল্পটা। বুঝলি, আজ আমার একদম সময় নেই, একটা পার্টি মিটিংএ যেতেই হবে এক্ষুনি। তবে দীপুর ব্যাপারটা আজকের মিটিং-এ তুলব, আর কাল ঠিক এই সময় এই নিয়ে কিছু আলোচনা করব। এখন একটা সিগারেট দে তো দীপু, বকে বকে গলাটা শুকিয়ে গেল।'
সিগারেট টানতে টানতে বেরিয়ে গেল প্রভাত। ওরাও আড্ডায় ভঙ্গ দিয়ে যে যার বাসায় ফিরে গেল। তবে মেটামরফোসিস নিয়ে একটা নতুন চিন্তা আজ ঢুকে গেল দীপুর মনে। বাম চিন্তাধারায় ওর কোনকালেই বিশ্বাস নেই, তবে কি ওর মনেরও মেটামরফোসিস হচ্ছে ধীরে ধীরে?     


(১০)
বাড়ি ফিরছে দীপু, সঙ্গে ন্যাড়া-চৈতন্য। রাস্তার দু-পাশে বরাহ-নন্দনদের মিছিল, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দে মুখরিত চারদিক- দীপু ছাড়া অবশ্যই আর কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না।
- 'এই ন্যাড়া, ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে দেখেছিস, কতবড় দাঁত? আচ্ছা সবকটা শুয়োর মিলে আরেকটা শুয়োরকে পেটাচ্ছে কেন বল তো? ও, ব্যাটা টুপি পরেছে বলে!'
ওরা গিয়ে দাঁড়াল মারপিটের ভীড়ের মাঝে। কিছুই নয়, টুপিপরা শুওরটাকে এরা চেপে ধরেছে- 'বল ব্যাটা, বরাহ-অবতারের জয়, বল শুয়ারিস্থান জিন্দাবাদ'। আর সেও তেমনই ঢিট, কিছুতেই বলবে না! আরে, তুইও তো শুয়োরিস্থানেই আছিস, বলেই ফেল না বাপ!
- 'এই দীপু, কলকাতায় একটা বরাহনগর আছে, জানিস ওখানকার হাল কী?' চেতন শুধোয় ওকে। স্পষ্ট শয়তানী।
- 'ওরে, এ শুয়োর সে শুয়োর নয়। এ তো প্রভুর বরাহ-লীলা! শুনলি ওরা কী বলাবলি করছে? পুরুলিয়ার বরাভূমে পঞ্চাশ একর জমি নেওয়া হয়েছে, বরাহ-অবতারের মন্দির হবে।'
- 'ওরে উটো তো বলরামপুরের কাছে বটে। আমাদের গাঁয়ের থিকে সাত মাইল। আমাদের জমিন গুলার দাম বাড়বেক মাইরি!' ন্যাড়া বেশ খুশি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কই, ন্যাড়ার মুখটাতো বদলায় নি? না কি নাকটা একটু মোটা আর লম্বাটে লাগছে? নাঃ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

 আপাততঃ সবাই বাসায় ফিরে এল। কিন্তু সেখানে এসেও কি নিস্তার আছে? টিভি চালাতেই একটা নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে গেল দীপুর। তাই তো, বরাভূম নিয়েই আলোচনা হচ্ছে সংসদে। পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়ই বটে! সবকটা লম্বাটে নাক আর দুপাশে দাঁত নিয়ে ঘোঁত-ঘোঁত করে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে যেটুকু বোঝা গেল যে বাংলার সাংসদরা জিদ ধরে বসে আছে যে বরাভূমেই বরাহ দেবতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। একজন নির্দলীয় তার মধ্যে বলে বসেছে 'কেন, বরানগর নয় কেন?' তাকে একজন লাল টুপিওলা শুয়োর থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, 'অ্যাই চুপ করুন তো! আপনি আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন না! জানেন না, আমাদের স্ট্যান্ড মন্দিরেরই বিরুদ্ধে। হলে কোথাও চিন বা ভিয়েৎনামের প্যাগোডা হবে, হ্যাঁ।' শুয়োরটা জানে না, উন্নত প্রযুক্তির মাইক সব কথাই ক্যাচ করছে। এমন সময় এক হোমরা-চোমরা সাংসদ ঘোঁত-ঘোঁত করে তেড়ে এসে বলতে লাগলেন- 
- 'মিত্রোঁ, আমাদের ফাজিল বন্ধু (ফাজিল মানে যে জ্ঞানী সেটা দীপু সদ্য জেনেছে একটা হিন্দি সিনেমা দেখে। ও মনে মনে স্বীকার করল হিন্দি সিনেমা দেখলে ভাষাজ্ঞান বাড়ে, আজকাল বাংলা সিরিয়ালগুলো বুঝতে সুবিধে হয়) ভুলে যাচ্ছেন যে সৎ-যুগে ধরতী সমুন্দর মেঁ ডুবে গেছিল, বরাহ-ভগবান তাকে অপনা দাঁত দিয়ে উদ্ধার করেন। তো মিত্রোঁ, বরাহভূমে সমুন্দর কোথায়, বোলো বোলো!'
- 'আরে সমুন্দর নেই তো কী আছে? তাই বলে বরাহ-মন্দির আমরা গুজরাটে হতে দেব না! বাঙলার প্রতি চিরকালীন এই বঞ্চনার শেষ চাই! দরকার পড়লে মরগুমা কিম্বা খয়রাবেড়া ড্যামের পাশে আমরা মন্দির করব। পুরুলিয়ায় এয়ারপোর্ট হবে।'
উঃ, অসহ্য! টিভি বন্ধ করে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিল দীপু।


(১১)

- 'কিরে, তোদের মিটিং-এ শুয়োরের কথাটা বলেছিলি?' পরদিন সকাল এগারোটায় সার্কুলার পার্কের বেঞ্চে বসে কথাটা শুধোল দীপু। আজ প্রভাত ওর কথা রেখেছে, ঠিক সময়ে এসেছে আড্ডায়। ছুটির দিন নয় বলে বিশু ছাড়া আর কেউ নেই ওদের সাথে। ওর আর কোন চাকরি হচ্ছে না, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে একটার পর একটা।
- 'হ্যাঁরে, বেশ সিরিয়াস আলোচনা হল এ নিয়ে।' প্রভাত মনে হয় এই কথাগুলো বলার জন্যেই আজ ওর মূল্যবান সময় নষ্ট করে এখানে এসেছে। '
- 'কী ব্যাপার বল তো?' বিশু বলে, 'শুয়োর দেখা নিয়ে তোদের পলিটব্যুরো এত সিরিয়াস কেন হঠাৎ? ওরা নিশ্চয় দীপুর মাথার চিকিৎসা করানোর অ্যাডভাইস দিল?'
- 'ঠিক তার উলটো।' 'পলিটব্যুরো' নিয়ে ঠাট্টাটা গায়ে না মেখেই প্রভাত বলে- অন্য দিন হলে খেপে বোম হয়ে যেত, 'ব্যাপারটা হয়ত ইল্যুশন। তবু কেন জানিনা কাফকা আর আয়নেস্কোর সঙ্গে দীপুর অবজারভেশনের মিল খুঁজে পাচ্ছে ওরা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শিল্প-বিপ্লবের অন্তরালে ধীরে ধীরে মানুষের অজ্ঞাতে বেড়ে উঠেছিল যে আত্মকেন্দ্রিকতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে গড়ে ওঠা কর্মজীবনের একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ আর তার থেকে নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণার জন্ম, তারই ফলে একটা মানুষ নিজেকে পোকা ভাবতে শেখে। বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত আধুনিক মানুষেরা জীবনযাপনের দুর্বিষহতায় ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার দেখেও কিছু করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে যে কীটের সাথে তুলনা করে, গল্পে তার বাস্তবায়ন করে দেখানো হয়েছে। এই হতাশা, অবিশ্বাস আর চুড়ান্ত আত্মগ্লানির আবহাওয়া থেকেই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তা হয়ত কাফকাও বোঝেননি, তবু হয়ত এটাই ফ্যাক্ট।'
- 'বাপরে! আর গন্ডারের সঙ্গে শুয়োরের মিলটা?' দীপু শুধোয়। ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখা নিয়ে লোকে এত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
- 'রাইনোসেরাসের পটভূমি জানতে গেলে তোদের একটু আয়োনেস্কোর সম্বন্ধে আগে জানতে হবে। রোমানিয়ান বাবা আর ফরাসি মায়ের সন্তান তিনি। সেই মা আবার সেফার্দি অর্থাৎ স্পেন-পর্তুগালের আদি ইহুদি। নাৎসি রাজত্বের উন্মেষের সময় রোমানিয়াতে ইউজিনদের টিকে থাকাটা একপ্রকার সমস্যা হয়ে দেখা যায়, চোখের সামনে চেনা বন্ধুদের ইহুদি-বিদ্বেষী নাৎসি হয়ে যেতে দেখতে থাকেন। ১৯২৮ থেকে শুরু হয়ে ১৯৩৬ এ তা চরম রূপ নেয়, সেই সময়কার স্মৃতির ফসল 'রাইনোসেরাস'- চেনা মানুষের অচেনা রূপে পরিবর্তন। এই সময় উদ্ভব হয় চুড়ান্ত ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর, হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন আর রুজভেল্ট-চার্চিলের মত কূটনীতিজ্ঞের অভ্যুত্থান- তার থেকে জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।'  
- 'কিন্তু রাইনোসেরাসের রচনাকাল তো ১৯৫৯'- দীপু বলে।
- '১৯৩৬-৩৭এর রোমানিয়ায় বসে একজন হাফ-ইহুদির এই নাটক লিখে কোন লাভ হত না, মাঝখান থেকে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হত। তবে তাতে পরিণতি কিছু বদলাত না। কিন্তু ছয়ের দশকে উনি এমন এক পরিবর্তনের কথা লিখে গেছেন যার চুড়ান্ত পরিণামে  হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হয়ত সেই সময়ও তিনি এমনই আরেকটা কিছুর সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে একটা অ্যালার্ম কল করেছেন নাটকটার মধ্য দিয়ে।'
- 'তাহলে বলতে চাস, বরাহ-নন্দনের ব্যাপারটাও এমনই একটা বিপর্যয়ের পূর্বাভাস?' এতক্ষণে বিশুর মাথাটা খোলে।
- 'দেখা যাক। তুই একটু সাবধানে থাকিস দীপু। কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটিতে আবার জড়িয়ে না পড়িস।'
কেটে পড়ল কমরেড প্রভাত চক্রবর্তী।



(১২)
আর সাবধানে থাকা! চতুর্দিকে শুয়োরের দল, নোংরা আবর্জনা, আর ঘোঁতঘোঁতানি। বরাহ-নন্দনেরা ক্রমে দলে ভারি হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি লাগছে, এমনকি অন্য শুওরদেরও তারা ছেড়ে কথা কইছেনা।  সাদা-গোলাপি শুয়োর আর কালো শুয়োরের মধ্যে তো চিরকালের দাঁতাদাঁতি (হাতাহাতির বদলে এই শব্দটা মনে মনে ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করল দীপু) লড়াই। ইদানীং আরো কিছু অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। আগে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে যৌনতা খোলাখুলি ছিল, ধর্ষণ জাতীয় অপরাধের কথা কেউ শোনে নি। আজকাল কিন্তু প্রায়ই কিছু শুয়োরের বাচ্চা মিলে মানব-কন্যাদের রেপ করে পরে দাঁত দিয়ে ফালাফালা করে চিরে ফেলছে বলে শোনা যাচ্ছে। মানুষ অপরাধ করলে শাস্তি হয়, তবে শুয়োরে করলে পুলিশ নাকি কেস নিচ্ছে না। নেবে কেন? ওরাও তো দ্রুত বদলে যাচ্ছে।   
আজকের খবরে প্রকাশ, বরাহ-মন্দিরের কেস মানুষরা হেরে গেছে, এখন বরাহভূমের পাশে অযোধ্যাপাহাড়ের শিখরে বরাহ অবতারের মন্দিরের শিলান্যাস হতে চলেছে। নীচের মরগুমা ড্যাম থেকে জল নিয়ে এসে ভগবানের পায়ে ঢালবেন ভক্তেরা তার জন্যে হাইওয়ে আর রোপওয়ে দুটোই তৈরি হবে। পুরুলিয়া শহর থেকে বলরামপুর, বেগুনকোদর, বাঘমুন্ডি সর্বত্র শুয়োরের রাজত্ব এখন। মানুষদের মধ্যে বেশ কিছু শুয়োরে পরিবর্তিত হয়েছে, আরো হচ্ছে। কি করে হচ্ছে, তার মেকানিজ্‌ম্‌ এখনও ঠিক পরিষ্কার নয় সবার কাছে, কিন্তু শুয়োর হতে পারলে আর চিন্তা নেই। যে অবহেলিত জাতির লোকজন এখনও কষ্ট করে মানবজীবনে পড়ে আছে, তারা একমনে বরাহমন্ত্র জপ করে চলেছে দু'বেলা, যদি তাতে মুক্তি হয়, বরাহজীবনে উত্তরণ ঘটে। দীপুর চোখের সামনে ওর বন্ধুরা অনেকে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এইত তাপস এসেছিল, সিলিন্ড্রিক্যাল নাক নিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কত অহংকার করে গেল। বাবা নিজের দোকান থেকে মিষ্টি এনে ওকে খাওয়াল, জানিনা তার ফলেই কিনা, বাবার নাকটাও সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। বিশু ব্যাটার শুয়োর হয়ে যা গুমোর বেড়েছে, পাত্তাই দিতে চায় না একেবারে!

আজ সকালে ঘুম ভেঙে দীপুর কিরকম গায়ে ব্যথা ব্যথা লাগছে। এ কোথায় শুয়ে আছে সে! সবুজ পর্দা, সবুজ চাদর, গায়ে ডোরাকাটা কয়েদিদের মত পোষাক- একি জেলখানা নাকি? বাইরে কিছু চেনা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মনে হচ্ছে, মানুষের গলাই, কই ঘোঁত-ঘোঁতানি নয় তো! এমন সময় মোটা আর বিশু ঘরে ঢোকে।
- 'জ্ঞান ফিরেছে, দীপুর জ্ঞান ফিরেছে!' বিশু খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। আরে, বিশুটা আবার মানুষ হয়ে গেল কখন?
- 'হ্যাঁরে, আমি কোথায়? আর বিশু তুই শুয়োর হয়ে গেছিলি না! আবার কি করে মানুষ হলি?'
- 'কী পাগলের মত বকছিস! শুয়োর আবার কোথায়? তুই হাসপাতালে। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি। তবে চিন্তা নেই, সবকটা শুয়োরের বাচ্চা এখন হাজতে। এখন কাকাবাবুকে একটা খবর দিতে হবে দীপুর জ্ঞান ফিরেছে বলে।'
- 'তাহলে শুয়োরদের সঙ্গে আমার মারপিট হয়েছিল? তবে যে বলছিস আমি পাগলের মত বকছি!'
- 'আরে তোর মনে নেই, ওই বিহারি গুণ্ডাটা যাকে তুই শুয়োরের বাচ্চা, মানে ওই বরাহ-নন্দন না কী যেন বলেছিলি? শালা জীবনে প্রথম গাল দিয়েই উদোম ক্যালানি খেয়ে গেলি'- বলে হাসতে লাগল মোটা গদাই। 'তবে আমরাও ছাড়িনি, খুব উত্তমমধ্যম দিয়েছি হারামিদের। আরে আমরা কি জানি ব্যাটা কারো কাছ থেকে বরাহ-নন্দনের মানে জেনে এসে দলবল নিয়ে পেটাতে আসবে। তুই তখন সন্ধের পর বাড়ি ফিরছিলি, নিতাইদা এসে খবর দিল দীপুবাবুকে  চারটে গুন্ডা মিলে পেটাচ্ছে। আমরা ঠিক সময়ে এসে না পড়লে তোকে বাঁচানো যেত না।'     
- 'তাহলে ওই যারা শুয়োর হয়ে গেল, তাপস আর প্রভাতের সঙ্গে এত কথা হল!'
- 'কী বলছিস রে!' বিশু বলে, 'তাপস তো ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে ডাক্তারির, ও আসবে কি করে এখন কলকাতা থেকে? আর প্রভাত......' বলে চুপ করে গেল বিশু।
- 'কী হয়েছে প্রভাতের? ও কি শুয়োর হয়ে গেছে নাকি?'
- 'না রে', ইতিমধ্যে ন্যাড়া ঢুকেছে রুমে, ও বলল, 'ওকে আর আমরা দেখতে পাব না। মাওবাদী নক্সালদের দলে ভিড়েছিল, পরশু জঙ্গলমহলে পুলিশের সঙ্গে একটা এনকাউন্টারে মারা গেছে।'

যাক, কুয়াসা কাটল। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে পড়ে দীপু তাহলে একটা লম্বা স্বপ্ন দেখে গেল। কিন্তু জেনেটিক্স, বরাহ-পুরাণ, কাফকা, আয়োনেস্কো- এতসব সে জানল কি করে? না কি স্বর্গের দোরগোড়া থেকে ফিরে এল বেশ কিছু দিব্যজ্ঞান নিয়ে। সত্যিটা কী তা কে বলবে, ভবিষ্যৎ? 

   

শেষ।।




 

Wednesday, November 6, 2019

দাদুরি-কাব্য।। ছড়া (লিমেরিক)

দাদুরি-কাব্য।।
(ছড়া- লিমেরিক)

(১)
দাদুরি-কাব্য

ঝমঝমে বৃষ্টিতে কত আর ভাববো,
ভেবে ভেবে লিখে ফেলি দাদুরির কাব্য।
অচল আধুলি-সিকে
চলে যায় লিমেরিকে,
ব্যাঙ বলে বৃষ্টিতে জলে কি গো নাবব?

(২)
ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙেদের সাতপাকে মিশেছিল জল তাই
বিয়েটা হলনা পুরো ভ্যাস্তাল সবটাই।
সিঁদুরে বর্ষা ধারা
ব্যাঙানী ত কেঁদে সারা,
ভেকেদের কলরবে শুনল না কেউ ভাই।

(৩)
ব্যাঙের আধুলি

একটি আধুলি-সিকিতে ব্যাঙের যত বিলাস-ব্যসন
তাই দিয়ে তাঁর চলে পরিবার, কেনেন আটা-বেসন
ব্যাঙেদের নেই ব্যাঙ্ক,
আছে শুধু জল-ট্যাঙ্ক,
ব্যাঙ ম'লো অনাহারে যবে হ'ল ডিমনিটাইজেশন!

(৪)
বিগ-ব্যাং

ব্যাঙেদের রাজা চলছিল তার বাড়িয়ে ঠ্যাং
এমন সময় পণ্ডিত এসে মারল ল্যাং।
রেগে মেগে বলে ব্যাঙ
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ,
থাকতিস কোথা না হলে সেদিন বিগ-ব্যাং?


(৫)
ব্যাঙের রাজা

রাজা চাই, চাই রাজা, কাঁদুনি জুড়ল যত ব্যাঙ,
বিধাতা পাঠান বক, চেয়ে থাকে তুলে এক ঠ্যাং
সারাদিন চেঁচিয়ে কাবার
ব্যাঙ হয় রাজার খাবার,
চাইনে এমন রাজা, কেঁদে বলে ঘ্যাংগোর-ঘ্যাং। (সুকুমারীয় প্রেরণায়)



(৬)
ব্যাঙের সর্দি

বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে ব্যাঙের হল সর্দি
ব্যাঙানি তাই ছাতা মাথায় ডাকতে গেল বদ্যি।
বদ্যি বলে আচ্ছা বোকা-
তুমি তো নও কচি খোকা,
উঠবে নাকো 
পুকুর থেকে যাও ফিরে যাও জলদি! 


(৭)
ব্যাঙের ছাতা

সর্বনেশে জন্তু সেটা মানুষ নাকি নাম
 কিনতে এল 
ব্যাঙের ছাতা দিয়ে দেদার দাম
বলল তোরা ভীষণ যা তা
খাসনে কেন ব্যাঙের ছাতা,
জানিস এতে প্রোটিন আছে, তাই নিয়ে চললাম!


(৮)
ঝিং-ঝ্যাং

ব্যাঙ ওরে ব্যাঙ, ছড়িয়ে চারটে ঠ্যাঙ
ডাকিস শুধুই গ্যাঙোর গ্যাঙোর গ্যাঙ
থাকতিস যদি চীনে
ঠিক তারা নিত কিনে
কেটেকুটে তোরে বানাত কোর্মা, নাম দিত ঝিং-ঝ্যাং!


(৯)
মুনলাইট সোনাটা

কোলা ব্যাঙ গান গায় সোনা ব্যাঙ কিছুই পারে না
তাই দেখে ওস্তাদ বলে শোন ওরে কোলা সোনা,
সোনাটা নেহাৎই অবলা,
ও বরং বাজাক তবলা,
কোলা তুই পিয়ানোতে 'মুনলাইট সোনাটা' শোনা! 



(১০)
ফ্রগ বনাম দাদুরি

ফ্রগ মানে ব্যাঙ, দাদুরি মানেও ব্যাঙ
বর্ষা এলেই দাদুরি গাইত, ফ্রগটা ওনলি স্যাং,
দাদুরি জানত রাগ ও রাগিনী
ফ্রগের চয়েস ছিল পলিফোনি,
বাখ-বিঠোফেন শুনতে গেলেই, মোবাইল হত হ্যাং!


(১১)
ব্যাঙা আর ব্যাঙাচি

অন্নদা-স্যার শুনতে পেলেন, ব্যাঙ রেগে কয় 'ব্যাঙাচ্চি-
বড্ড তোদের বাড় বেড়েছে, দাঁড়া তোদের ঠ্যাঙাচ্ছি!'
ব্যাঙাচ্চিরা অমনি ভয়ে কাঁটা,
পাণ্ডা যে তার মস্ত বুকের পাটা!
সে তবে কয় লেজটা নেড়ে, 'আমরা কি স্যার ভ্যাঙাচ্ছি?'

(উৎস - অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া- "ব্যাঙ রেগে কয় ব্যাঙাচ্ছি")


(১২)
পকেটমার ব্যাঙ
 
কোলা ব্যাঙের আধুলিখানা সাপটা নিল কেড়ে
পয়সা পেয়ে মস্ত খুশি, ব্যাঙকে দিল ছেড়ে।
সাপটা এসে অফিস থেকে
খোলসটাকে টাঙিয়ে রাখে-
ব্যাঙটা ক'রে পকেটমারি আধুলি দেয় ঝেড়ে!


(১৩)
ব্যাঙ বনাম হাঁস

জলের উপর দুইটি প্রাণী, দাদুরি আর হাঁস
হাঁসটা থাকে স্থলে, ব্যাঙের জলের মাঝে বাস।
ব্যাঙ বললে, হাঁস, এটা মান-
মোরা দু'জনাই অ্যাম্ফিবিয়ান,
হাঁস বলে আমি একটু বেশি, ছুঁতে পারি আকাশ! 


(১৪)
দাদু ও দাদুরি

দাদু বলে 'আমি দাদু, তুই হলি দাদুরি
আয় করি কোলাকুলি ক্যায়সি হ্যায় এ দূরী',
ব্যাঙ বলে ছুঁড়ে লেগ
'চড়িয়েছ কত পেগ?
ছুটে যাবে সব নেশা খেলে হিং-কচুরি!'


(১৫)
বরসাত

বহুকাল আগে সিনেমা হলেতে চলছিল 'বরসাত'
রাজ কাপুরের ছাতা উড়ে যায়, নার্গিস হাতে হাত,
হঠাৎ শব্দ গ্যাঙর-গ্যাঙর-গ্যাঙ,
হলে ফুটো মেঝে উঠে আসে যত ব্যাঙ,
বলে- এ ছবিটা ছ-বার দেখেছি, চালা 'য়াদোঁ কী বারাত'!

(১৬)
কূপমণ্ডূক

কুয়োতে ছিল যে ব্যাঙ জাতে কূপমণ্ডূক
বাঘ ভেবে শিকারিটা নিয়ে আসে বন্দুক,
অবাক, তাকিয়ে দেখে- একি!
বাইশটা ব্যাঙ খেলে হকি,
বলে, এটা হকি নয়, যষ্টি ও কন্দুক।

(১৭)
খাই খাই

ব্যাঙ খায় পতঙ্গ, সাপ খায় ব্যাঙকে,
ময়ূর সাপকে খায়, বাঘেতে ময়ূরকে
মানুষই এমন প্রাণী
শুধু টাকা খায় জানি,
সুদ খায়, ঘুস খায়, রাখে টাকা ব্যাংকে!

(১৮)
পারম্পর্য

ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়, না বৃষ্টি হলে ব্যাঙ ডাকে?
এ প্রশ্নটা সিধুজ্যাঠার সামনে ফেলুদাই রাখে।
সিধুজ্যাঠার প্রশ্ন আদিম,
মুরগি আগে, না আগে ডিম?
জানতে এসব ব্যাঙের কাছেই যাও, গিয়ে শুধাও তাকে!

(১৯)
গ্যাঙর গ্যাং ছড়িয়ে ঠ্যাং ডাকছে ব্যাঙ, বিশাল গ্যাং
ফক্কা ট্যাঁক, নাচছে দ্যাখ  চিনের চ্যাং, ড্যাড্যাং ড্যাং