Monday, January 14, 2019

ভ্রমণ- আত্মকথা। দক্ষিণের শহর- কারাইকাল

দক্ষিণের শহর- কারাইকাল 

 (১)

১৯৯৩ সালে শিলচর থেকে বদলির আবেদন করেছিলাম। না, শহর হিসেবে শিলচর খারাপ মোটেও নয়, পুরোপুরি বাংলা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আছে সেখানে। কারণ ছিল চিকিৎসা আর যাতায়াতের অভাব। বছর-বছর বন্যা আর বন্যা এলেই এয়ারপোর্টের রাস্তা বন্ধ বা প্লেন ক্যানসেল, রেল বন্ধ তো বটেই। তবু সেখানকার লোকেদের সাথে ভাল মিলে মিশে গেছিলাম। পশ্চিম বাংলার লোক বলে আমাদের প্রতি স্থানীয় শিলেটিদের একটু সন্দেহমিশ্রিত সম্ভ্রম থাকত, জানিনা কেন। তাছাড়া বাংলার মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা বলে কিছুটা দেরীতে হলেও কিছু মহৎজনের সান্নিধ্যে আসায় একটা ভাল পরিবেশ পেয়ে গেছিলাম, তাই বেরিয়ে আসার ইচ্ছেটা খুব একটা বলবতী ছিল না।

বদলির খাতায় লেখা ছিল কাবেরী প্রজেক্ট, মাদ্রাজ অফিস, তাই একটু আশান্বিত হয়ে CSI Building এ গিয়ে হানা দিলাম। ওটাই কাবেরী বেস অফিস। তবে সব আশায় জল ঢেলে দিলেন প্রজেক্ট ম্যানেজার নিমাইচাঁদ বোস। বললেন সবাই মাদ্রাজে থাকায় ফরোয়ার্ড বেসে কোনও কাজ হচ্ছে না, তাই শিগ্‌গিরি এই অফিস বন্ধ হয়ে সমস্ত কারাইকাল চলে যাবে। ওনারা সবাই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছেন। আমি ফ্যামিলি নিয়ে আসব শুনে সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনীয়ার মিঃ ম্যাথু আমাকে টুলস্‌ ইয়ার্ডের দায়িত্ব দিলেন নিজের আন্ডারে। ভাবলাম যাক, তবু ফীল্ডে কম যেতে হবে। তবে কারাইকাল বস্তুটি কি বা কেমন, কিছুই জানিনা, একবর্ণ তামিল বুঝিনা- বেশ টেনশন ছিল। শুনেছিলাম পণ্ডিচেরী, কারাইকাল, ইয়ানাম আর মাহে- চারটি জেলা নিয়ে পণ্ডিচেরী বা পুদুওয়াই রাজ্য, আগে পুরোটা ফ্রেঞ্চ কলোনী ছিল, শুনে একটু ভাল লাগল। পন্ডিচেরী মানেই ঋষি অরবিন্দ, প্রচুর বাঙালী, ফরাসি কালচার- এই ধারণা ছিল মনে। তাছাড়া এও শুনেছিলাম যে সাউথের লোকেরা হিন্দী না বুঝলেও ইংরেজিটা ভাল বোঝে বা বলে। এই ধারণা অবশ্য আমার চেন্নাই এয়ারপোর্ট থেকে এগমোর অটো-রিক্সায় আসতেই ভাঙল, ভাষার সুযোগ নিয়ে সেই বাজারে অটোওলা লোকটা প্রায় শ'খানেক টাকা হাতিয়ে নিলে!

'৯৪ সালের জানুয়ারী মাস সেটা। তখনও তেমন উন্নতির ছোঁয়া লাগেনি দক্ষিণের শহরগুলিতে। মাদ্রাজ তখনও চেন্নাই হয়ে ওঠেনি, যদিও খবরের কাগজে বা বইপত্রে চিরকালই চেন্নাই লেখা হত, চেন্নাপট্টনমের অপভ্রংশ হিসেবে। কলকাতা থেকে স্যুট পরে রওনা হয়েছিলাম, গিয়ে ঠাণ্ডা পাব বলে। তিরুভাল্লুভার ট্রান্সপোর্টের রাত্রের বাসে চেপে ২৮৫ কিলোমিটার দূরত্বের ছোট জেলা-শহর কারাইকালে ভোর ছটায় পৌঁছেও ঘেমে নেয়ে একাকার। দক্ষিণ ভারতে সেই আমার শেষ স্যুট পরা।


বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে দেখি উল্টোদিকে সিটি লজ, তার নীচে 'নালা রেস্টুরেন্ট', পাশ দিয়ে নালা বয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য, ভাবলাম, নালা নামেও খাবারের হোটেল হয়! সিটি লজে উঠে ব্যাপারটা খোলসা হল। ম্যানেজার ভদ্রলোক শিক্ষিত, তাঁর কথায় কারাইকালের অদূরে তিরুনাল্লার তীর্থক্ষেত্রের সাথে জড়িত একটা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পটভূমির কথা জানা গেল।

পাণ্ড্য-ভূমি তাঞ্জোরে শৈবদের একসময় খুব প্রকোপ ছিল। তবু কেন জানিনা নেডুমারণ নামে পাণ্ড্যবংশের এক রাজা রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের সাথে নিয়ে জৈনধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু রানী মাঙ্গাইয়ারকারাসি ও মন্ত্রী নয়নার শৈবধর্ম শুধু আঁকড়েই থাকলেন না, বেদারণ্যম্‌ থেকে মহাত্মা তিরুজ্ঞানসম্বন্ধমকে ডেকে পাঠান ধর্ম উদ্ধারের জন্যে। জৈনরা প্রতিহিংসার বসে তাঁর বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয়, কিন্তু অলৌকিক শক্তিবলে সাধু সেই আগুন দিয়ে উলটে মহারাজের দু-বাহু জ্বালিয়ে দেন। জৈনরা বহু মন্ত্র পড়েও রাজাকে সারাতে পারে না। তখন রানীর একান্ত অনুরোধে সাধু তিরুজ্ঞান 'মন্দিরমাবাডু নীরু' মন্ত্র গেয়ে রাজাকে সারিয়ে তোলেন। এইরকম ৪৯টি মন্ত্রগীত বা 'পাডিগম্‌' তিরুনাল্লারের বিখ্যাত শিব মন্দির দর্ভারণ্যেশ্বরম্‌ শিবের মন্দিরের বৈশিষ্ট্য। পরে জৈনরা এই মন্ত্রের প্রভাবে পরাজিত হয়ে চলে যায়, পাণ্ড্য-রাজ্যে শৈবধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই ঘটনার ফলে লোকের নজর পড়ে তিরুনাল্লারের এই শিবমন্দিরের দিকে, যার মধ্যে নবগ্রহের অন্যতম শনিদেব বা শনিশ্বরমের বিশেষ অধিষ্ঠান। দক্ষিণ ভারতের পুরাণ অনুযায়ী নিষাদরাজ নলের সাথে কলি নয়, শনির প্রকোপ পড়েছিল, অক্ষ(পাশা) খেলায় রাজত্ব হারাবার পর। পরে তিনি শনিতীর্থ তিরুনাল্লারে নূলার, বাঞ্চিয়ার ও আরসুলার নদীর ত্রিবেণীসঙ্গমে স্নান আর কর্মের দেবতা শনিদেবের পূজা করে হারানো রাজ্য আর পত্নী দময়ন্তীকে ফিরে পান। তিরু অর্থে শ্রী, নাল্লার মানে নলরাজার নামের সাথে জড়িত তীর্থস্থান, এভাবে কারাইকাল জেলার তিরুনাল্লার খ্যাতি পায়।

সে না হয় হল। কিন্তু তার সাথে নালা হোটেলের সম্পর্ক কি? ও হরি! জানা গেল নলরাজা ছিলেন খুব বড় রাঁধুনী। তিনিই নাকি বিশ্বে প্রথম সৌর চুল্লীর ব্যবহার করেন। অবাক হচ্ছেন এ তথ্যটা পেয়ে? পুরাণ কিন্তু তাই বলে। তিনি বিনা আগুনে রান্না করার দৈবশক্তির অধিকারী ছিলেন- সেটা সোলার হিটার ছাড়া আর আর কি হতে পারে!

আর নালা মানে নলরাজা, ইংরাজি লেখায় আমি অন্ততঃ তাই পড়েছিলাম।




কারাইকাল।২।

ম্যাথু সাহেবের কাছেই জেনেছিলাম যে আমাদের অফিস বাস স্ট্যাণ্ড থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে নিরভি গ্রামের মোড়ে। নিরভি, নাগোর বা নাগাপট্টনমের বাসে যাওয়া যায়, বা কুড়ি টাকা খরচা করে অটোতেও। প্রথম দিন বলে সেদিন অটো করে নিলাম।

অফিস দেখে খুব একটা ভক্তিশ্রদ্ধা এল না। ভারত সরকারের সর্ববৃহৎ খনিজ তেলের কোম্পানী, তাছাড়া সবচেয়ে লাভজনক সরকারি উদ্যোগও বটে, তার জন্যে শুধু কয়েকসারি এজবেস্টাস ছাতের ঘর! এখন কাকে রিপোর্ট করতে হবে? সবাই এককথায় পাঠিয়ে দিল ট্রান্সপোর্টের চীফ ম্যানেজার রাজামণির কাছে- উনিই তখন কাবেরী ফরোয়ার্ড বেস অফিসের রাজা। আমি সপরিবারে কারাইকালে থাকব শুনে উনি খুব খুশী। বললেন, এখানে তো এখন শুধু ফীল্ড সার্ভিসের অফিস, অফিস না বলে ইয়ার্ড বলাই ভাল। সিমেন্টিং, লগিং, ওয়েল স্টিমুলেশান, স্টোর, ট্রান্সপোর্ট, ড্রিলিং সার্ভিসেস আর সিভিল। ড্রিলিং-এর ডিজিএম মিঃ ভাসিন সপ্তাহে দুদিন ম্যাড্রাস অফিস থেকে এসে বসেন, আপাততঃ সেখানেই আপনার পোস্টিং।
-তা এখন কি মিঃ ভাসিন আছেন? আমার প্রশ্ন।
-ওনার জন্যে আটকাবে না। ড্রিলিং ইঞ্জিনীয়ার ইলাঙ্গোভন আছে। ওই এখানকার সব দেখে। বড় অফিসারদের তো এখানে সবার গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স!- রাজামণির গলায় কি শ্লেষের ছোঁয়া?
ইলাঙ্গোভন দেখলাম ড্রিলিঙ্ সেকশানটাকে পিলারের মত ধরে রেখেছে। আমার থেকে এক বছরের সিনিয়ার, বয়সও কাছাকাছি, কিন্তু মাথার টাকে আর কথাবার্তার গাম্ভীর্যে একটা বস্‌সুলভ মহিমা এসেছে চরিত্রে। আমাকে বলল, এখানে উত্তর ভারতীয়েরা কেউ পরিবার নিয়ে আসতে চায় না, তবু তোমাকে আমি ডিসকারেজ করব না, এখানে এনজয় করার জিনিষ চাইলেই খুঁজে পাবে।
- আমার কাজ কি হবে এখানে? আমি শুধোই। আমি এখানে ঠিক কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
- এখানে আমাদের একটা ড্রিলিং সার্ভিসেস আর ফিল্ড প্রভিসনিং গ্রুপ আছে। স্পেশ্যাল সার্ভিস, যেমন ফিশিং, ড্রিল-স্টেম টেস্টিং, লাইনার হ্যাঙ্গারের যাবতীয় যন্ত্রপাতি, তাছাড়া যে টুলগুলো সচরাচর ব্যবহার হয় না, তাদের প্রপার স্টোরিং আর মেন্টেনান্স তো আছেই। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে পোলাগাম গ্রামে জমি নেওয়া আছে, সেখানে তৈরী হবে নতুন ড্রিলিং টুল ইয়ার্ড, তোমার তত্বাবধানে। ত্রিপুরার তিচ্‌না আর আঙ্কলেশ্বরের গান্ধারে পরপর দুখানা ব্লো-আউট হয়ে যাওয়ায় একটা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ খোলা হয়েছে অন্ধ্রের নরসাপুরে, তার একটা ব্যাক-আপ এখানে তোমাকে চালু করতে হবে। তার আগে চেয়ারম্যানের ডিরেক্টিভ অনুযায়ী সবকটা ব্লো-আউট প্রিভেন্টারে ব্লাইণ্ডের বনেট বদলে শিয়ারিং র‍্যাম লাগাতে হবে, ফ্রেডরিক সে দায়িত্ব নিয়েছে।

আমার তখন মাথা ঘুরছে। চিরকাল ফীল্ড ইঞ্জিনীয়ারের কাজ করেছি দশ-এগার বছর ধরে, এসব কাজ কারা করত তার কোনও ধারণাই ছিল না। আজ জানতে পারলাম, পাদপ্রদীপের আলোর আড়ালেও কিছু লোক নীরবে এ ধরণের কাজ করে চলে বলেই আমাদের ফীল্ডের কাজ নির্ঝঞ্ঝাটে চলত। ভাল কাজের কৃতিত্ব আমরা পেতাম, ওরা থেকে যেত অবহেলার আড়ালে।



কারাইকাল।৩।

সেদিন আলাপ হল ট্রান্সপোর্টের রায়দা আর সিক্যুরিটি অফিসার রাবারির সাথে। এঁরাও নতুন বদলি হয়ে এসেছেন, রাবারি গুজরাট আর আর রায়দা ত্রিপুরা থেকে।
ওরা আমাকে বললেন গেস্ট হাউসে চলে আসতে। তাতে কি হবে? না, একত্রে থাকা, খাওয়া-দাওয়া আর অফিস যাওয়া আসা। সত্যি বলতে আমার এই গাড়ি বা স্কুটার ছাড়া ৬ কিলোমিটার অফিস যাত্রাটা ভাল লাগছিল না। বাসে ইংরেজিতে লেখা না থাকার কারণে নিরাভি বা নাগোর বুঝতে পারছি না। পরদিন তো তিন অক্ষর দেখে নাগোর ভেবে কোয়েম্বাটুরের বাসে চেপে বসেছিলাম- ওরা লেখে 'কোওয়াই' বা Kowai, তামিলে সেটা তিন অক্ষরের। শেষে কি ভেবে একটা তামিল ভাষাশিক্ষার বই-ই কিনে ফেললাম।

'তামিল তেরিমা?' প্রশ্ন শুনে রাবারির দিকে তাকালাম ভ্রূ কুঁচকে। কি আশ্চর্য, তামিল আমার মা হতে যাবে কেন? আমি রেগেমেগে বললাম- 'বাঙালী তেরা বাপ!' রায়দা আর রাবারি দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল। রাবারি বোঝাল 'তামিল তেরিমা'র অর্থ -তামিল জান কি? এভাবেই ওরা কথাবার্তা শুরু করে। তাইত! কালই তো বইটাতে কত কিছু পড়লাম। না=আমি, নী=তুমি, ভনক্কম=নমস্কার, নান্‌রি=ধন্যবাদ, ওয়া=এসো, পো=যাও, নী এঙ্গে পোরা= তুমি কোথায় যাচ্ছ ইত্যাদি। মনে পড়ল শিলচরের একটা মজার ঘটনা। শ্রীকোনা অফিসের ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে এসেছে ফ্রেশ ইঞ্জিনীয়ার শ্রীনিবাসন। মাতৃভাষা তামিল এবং হিন্দীতে প্রায় nil। ক্যান্টিনে একে একে সবার খাবার চলে এল আর তার টেবিলে এখনও আগের লোকটির এঁটো বাসন পড়ে আছে, বাচ্চা ছেলেটা অন্য সব পরিষ্কার করলেও তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। এবার শ্রীনিবাসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ধমক দিয়ে ছেলেটিকে ডেকে টেবিলটি দেখিয়ে বলল- 'তাম্বি (ভাইটি বা বাচ্চা), ইধার পিসাব করো!' বাচ্চাটি ঘাবড়ে গেল। 'ক্যা বোলতা সাব?' 'আরে বোলতা না, ইধার পিসাব করো!!'
পরে ব্যাপারটা খোলসা হল। তামিলভাষায় একটা বর্গের চারটি অক্ষরেরই এক উচ্চারণ, অর্থাৎ ক=খ=গ=ঘ। তেমনি প=ফ=ব=ভ, একটিই অক্ষর, একই উচ্চারণ। তাই 'ইধার ভি সাফ করো' আর 'ইধার পিসাব করো'র মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই এই ভাষায়। কিছু করার নেই। We were in Rome, তাই রোমান সাজতেই হবে! রাত্রে একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি আমি আর রায়দা। ওখানে আটার প্রচলন খুব একটা নেই। তবু ওরা একটা রুটি আর পরোটার মাঝামাঝি জিনিষ খায় রাত্রের দিকে, বলে 'চাপাতি'। কোরমা দিয়ে তিনটে চাপাতি খেয়েও রায়দার পেট ভরে নি, হাঁক দিয়েছে- 'ওয়ান মোর'। দু-মিনিট পরে একটা ছেলে এসে একগ্লাস ঘোল (butter milk) ঠক করে রেখে গেল। হায় মুরুগান! 'মোর মানে এখানে ঘোল নাকি!'- রায়দার কাতরোক্তি।
'তাও ভাল, দাদা, উত্তর ভারত হলে হয়ত একটা আস্ত ময়ূর রেখে যেত টেবিলে- তখন কি করতেন?' আমি বলি। 'যস্মিন দেশে যদাচারঃ, কাছা ছাড়াই ধুতি পর!'



কারাইকাল।৪।

হোটেলে আর থাকা যাচ্ছিল না, যদিও দু-সপ্তাহের হোটেল ভাড়া কোম্পানীর দেওয়ার কথা। যাক, সিটি লজের ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে চার্চ স্ট্রীটের এই গেস্ট হাউসে এসে উঠলাম। রুমগুলি সিঙ্গল উইথ অ্যাটাচ্‌ড্‌ বাথ হলেও বেশ ছোট। চব্বিশটা রুমে বাইশজন বোর্ডার, একটায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটার ও অন্যটি স্টোর, সবেধন কর্মচারি আনবুর দখলে। এতে অন্ততঃ অফিস যাওয়ার ঝামেলাটা মিটল, সকাল ন'টায় অফিসের গাড়ি আসতে শুরু করে অফিসারদের নিয়ে, তার কোনও একটাতে উঠে পড়লেই হল।
নিরভি অফিস এখান থেকে চার কিলোমিটার, একেবারে সোজা রাস্তা। কারাইকাল আদর্শ ফ্রেঞ্চ কলোনীর আদলে গড়া প্ল্যান্‌ড্‌ শহর, যাঁরা পণ্ডিচেরি গেছেন, তাঁরা বুঝবেন, এখানকার রাস্তাগুলো সবই প্রায় পূর্ব থেকে পশ্চিম, বা উত্তর থেকে দক্ষিণে দাবার বোর্ডের মত করে ছক-কাটা। উত্তরে থিট্টাচ্চেরিতে কারাইকাল জেলায় ঢুকে যে রাস্তা নাগোরে জেলা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার নাম মেন রোড বা ভারতীয়ার রোড- বিখ্যাত তামিল কবি সুব্রহ্মণ্যম ভারতীর নামের স্মৃতিতে। আবার পূর্বের বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে তিরুনাল্লার হয়ে আমবাগারাত্তুর পর্যন্ত রাস্তাটি জেলার পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত, নাম- তিরুনাল্লার রোড। ভারতীয়ার রোড, চার্চ স্ট্রীট, কামরাজ সালাই ও বাইপাস রোড উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল, অন্যদিকে ক্রশ-রোড নেহেরু স্ট্রীট, পি-কে সালাই, তিরুনাল্লার রোড, থমাস আরুল স্ট্রীট ইত্যাদি মিলে একটা রেক্টাঙ্গুলার প্যাটার্ন তৈরি করেছে। শহরের মধ্যিখানে গভর্নমেন্ট প্লেস- বাগান, বক্তৃতাদি অনুষ্ঠানের জন্যে মঞ্চ, মাঠ, আর বিভিন্ন সরকারী অফিসের সমাহার। শহরের দক্ষিণ দিয়ে বয়ে চলেছে কাবেরীরই এক শাখানদী আরসালার, যার সাদা মানে Royal Water, তার রাজকীয় ভঙ্গিমায়। শহরতলিতে যাবার সেতুটি মেন রোডের উপরেই, সেখান থেকে শুরু হয়েছে শহরের সেরা রাস্তাটি- বীচ রোড। বীচ রোডের শেষে বঙ্গোপসাগরের তটে কারাইকাল বীচ, পাশেই আরাসালারের মোহানা। বীচের মুখেই সুন্দর বাগান, লাইট-হাউস ও সুন্দর পরিবেশে বার-রেস্তোরাঁ 'সী-গ্যল'। এই বীচ ছিল আমাদের এই প্রবাস জীবনের একটি সেরা হ্যাং-আউট, একঘেয়ে জীবনের মধ্যে একটা মস্ত রিলীফ।

পুরানো কারাইকাল শহরের বৈশিষ্ট্য এখানকার প্রাচীন বাড়ি-ঘরে ফরাসি নগর-স্থাপত্যের ছাপ, এখানকার বাজার, স্কুল ও গীর্জাগুলি। সেন্ট মেরি চার্চ অর্থোডক্স ক্যাথলিক, তবে এখানকার লোকেরা বলে মারিয়াম্মান কোইল (মেরীমাতার মন্দির) বা যেশু-কোইল, সবেতেই হিন্দু-মুসলিম-খৃস্টানের প্রবেশাধিকার অবাধ। তবু তার সাথে প্রাচীন দক্ষিণী স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হিন্দু মন্দির কারাইকাল আম্মান বা কৈলাশনাথর কোইল। বেশ কয়েকটি ছোট-বড় মসজিদও আছে। দীর্ঘ ছয় বছর সেখানে কাটিয়ে দেখেছি, প্রায় ১১% খৃস্টান ও ৭% মুসলমান অধ্যুষিত এই জেলায় সব ধর্মের লোকেরা সুন্দর মিলেমিশে আছে, হিন্দু উৎসবের প্রসাদ পেতে অন্য সম্প্রদায়ের লোকের অনীহা নেই, আবার দেখিনি ঈদ-উল-ফিত্‌রের হালুয়া বা ইদ-উজ-জোহার বিরিয়ানীতে কোনও হিন্দু প্রতিবেশির আপত্তিও। আমরা সচরাচর ইসলামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনে করে থাকি, ভাবি তারা অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সাথে মিলে মিশে থাকতে চায় না, বা পারে না। কিন্তু দেখেছি কারাইকাল ও তৎসংলগ্ন নাগাপট্টনম জেলার এই সুন্দর পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে আমাদের একাধিক উত্তর ভারতীয় মুসলমান বন্ধু সেখানে বাড়ি কিনে বসবাস করছে। সম্ভবতঃ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের এখনও এদিকে নজর পড়েনি, দেখা যাক, কদিন টেঁকে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ বাতাবরণ।


ক'টা দিন নতুন জায়গার আনন্দে কেটে গেল। ১৪ই জানুয়ারি বা মকর সংক্রান্তিতে শুরু হল তামিল অঞ্চলের প্রধান উৎসব 'পোঙ্গল'। বোঝা গেল, তার আগের কদিন বাজারে এত ভীড় ছিল সেই কারণেই, নতুন জামাকাপড়, মিষ্টি, পটকা ও অতি অবশ্যই সোনা-রূপার দোকানে। হাতে কিছু অতিরিক্ত পয়সা এলেই বাঙালী ওড়ায় খেয়ে আর বেড়িয়ে, গুজরাতি লাগায় ব্যবসায়ে বা শেয়ারে, পাঞ্জাবী ডোবায় মদে, বিহারী জমায় ব্যাঙ্কে, কেরালার লোক জমি কেনে আর তামিল কেনে সোনা-রূপোর গয়না। কেন তা জানার জন্যে বোধহয় কম্যুনিটি সাইকোলজি পড়ার প্রয়োজন নেই। এই পোঙ্গল উৎসব সম্বন্ধে এই ফাঁকে কিছুটা জ্ঞানদান করা যাক, কেমন?

পৌষ বা মকর সংক্রান্তির মতই পোঙ্গল একপ্রকার নবান্ন উৎসব বা harvest festival, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তা ভিন্ন-ভিন্ন রূপে পালিত হয়। তামিলনাডু বা তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে এটি শুরু হয় পৌষ সংক্রান্তি (১৩/১৪ জানুয়ারি) থেকে ও চলে মাঘের ৩রা পর্যন্ত, যার একেকটি দিনের ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য। সংক্রান্তির আগে থেকেই শুরু হয় কোলাম বা নানা রঙে রাঙানো চালগুঁড়ো দিয়ে আলপনায় গৃহসজ্জা, ঘর-দুয়োর পরিষ্কার করে চুন বা রঙ করা, প্রতি আসবাব, বাসন-পত্র যথাসম্ভব সাফাই ও পালিশ করা ইত্যাদি। পোঙ্গলের প্রথম দিন পালিত হয় 'ভোগী' উৎসব যা প্রকারান্তরে পঞ্জাবের লোঢ়ীর মত অর্থাৎ 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো'। সেই আগুনে পোড়ে পুরনো ভাঙাচোরা আসবাব, জঞ্জাল, কাগজ-পত্র, আগাছার স্তুপ। সবাই আগুনের চারধারে ঘিরে বসে 'bonfire' উপভোগ করে। দ্বিতীয় দিন আসল উৎসব। মানুষের ও সব প্রাণের আধার সূর্যই এই দিনের আরাধ্য। দক্ষিণায়নের ছয়মাস সূর্যদেব তাঁর জীবনীশক্তি দিয়ে ফসল ফলাতে সাহায্য করে সবার জীবনধারণের রসদ যুগিয়ে উত্তরায়ণে প্রবেশ করেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এই thanksgiving পর্যায়ে ঘরের উঠোনে সূর্যের আলোয় কাঠের জ্বালে দুধে নতুন চালের গুঁড়ো ফুটিয়ে বানানো হয় 'মিষ্টি পোঙ্গল'- চাল ফোটার সময় তার প্রথম উপচে পড়া দুধ নৈবেদ্য করা হয় দেবতার প্রতি। সাথে সাথে বেজে ওঠে ঢোল-কাঁসি-তূর্য, ছেলেরা বাজি ফাটিয়ে স্বাগত জানায় সূর্যের মকররাশিতে প্রবেশের মুহূর্তটিকে। এই হল 'তাই পোঙ্গল', যার সাথে শুরু হয় তামিল বর্ষপঞ্জীতে 'তাই' বা মাঘমাস।

কৃষিভিত্তিক ভারতের গ্রামে গ্রামে গবাদি পশুর বিশাল অবদানের কথা স্মরণে রেখে পালিত হয় পোঙ্গলের তৃতীয় দিনের উৎসব 'মাডু পোঙ্গল'। এদিন গৃহপালিত গরু-মোষ-ছাগলদের ভাল করে শিকাকাই ও হলুদ-জলে নাইয়ে ধুইয়ে ফুল-চন্দন-কুঙ্কুমাদি দিয়ে সাজানো হয়, নানা রঙে চিত্রিত করা হয় তাদের শিং-জোড়া। নতুন চালের ঘন ফেন ও পোঙ্গল সহ কলাপাতা খাওয়ানো হয় তাদের। মেয়েরা কাক ও অন্যান্য পাখিদের শষ্যদানা খাওয়ায় ভাইদের কল্যাণ-কামনায়। চতুর্থ ও শেষ দিন- 'কাণু পোঙ্গল' যার উদ্দেশ্য পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের মিলন, অনেকটা আমাদের বিজয়াদশমীর মত। অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে খাওয়া ও খাওয়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো আর নানা রকমের খেলাধুলোর আয়োজন। মহামিলনের দিনটিকে আরেকটু তাৎপর্যময় করে তুলতে জায়গায় জায়গায় মেলার আয়োজন হয়, এদিন বাবা-মা - যাদের বিবাহযোগ্য সন্তানাদি আছে, একটু মেলামেশার সুযোগ করে দেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে, অনেকটা আমাদের সরস্বতীপূজো, গুজরাটের দাণ্ডিয়া বা আন্তর্জাতিক ভ্যালেন্টাইন-ডে'র মত। তারপর দিন থেকে আবার সেই চিরাচরিত তামিল রক্ষণশীলতা!




কারাইকাল।৫।

আজ এতকাল পরে নিরাপদে নিরুপদ্রবে বসে পোঙ্গল-মঙ্গলকাব্য লিখলাম বলে পাঠক মোটেও ভাববেন না যে তামিল অধ্যুষিত অজানা-অচেনা নির্বান্ধব-পুরী কারাইকালে বসে আমার প্রথম পোঙ্গল উৎসব খুব আনন্দে কেটেছিল। হয়েছিল ঠিক তার উলটো। পোঙ্গলের প্রথম দিন অফিস খোলা ছিল, তাই লাঞ্চ করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যে আটটায় আমি আর রায়দা যখন চেত্তিয়ার হোটেলে খেতে যাই, পথে সমস্ত দোকান-বাজার বন্ধ দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়, কি দাদা, হোটেল খোলা পাব তো? ঠিক তাই। খোলা আছে শুধু বার আর মদের দোকান, বাকি সব বন্ধ। এই ফাঁকে বলে দিই, ইউনিয়ন টেরিটরি হওয়ার ফলে কারাইকালে কয়েকটা জিনিষে সরকারি আবগারি শুল্ক লাগতনা, যেমন মোটর ভেহিকল, পেট্রল ও মদ। জেলায় ঢোকার মুখে তাই দুইপ্রান্তে থাকত পেট্রোল পাম্প ও বার, যাতে প্রতিটি গাড়ি আর তার যাত্রী ও ড্রাইভার নিজেদের ট্যাঙ্ক আকণ্ঠ ভরে নিতে পারে। ঠিক টি-টোটলার না হলেও আমার তাতে বিশেষ লাভ হয়নি এযাবৎ। আজ কিন্তু বাধ্য হয়ে আমরা সেখানকার বিখ্যাত সেন্থিল বারে গিয়ে বসলাম। দুজনে মিলে একটা করে বীয়ার আর পাঁউরুটি-ওমলেটের অর্ডার দিলাম। এই প্রথম প্রাণরক্ষার্থে মদ্যপান করলাম। কোনমতে ক্ষুন্নিবৃত্তি হল। পরের দু-তিন দিনও বাজার বন্ধ, তবে আমি আবিষ্কার করলাম যে বাসষ্ট্যান্ডের রেস্তোঁরাটি এই দুর্দিনেও খোলা থাকে, তাই আর অসুবিধা হয়নি। তবে চোখধাঁধানো আলোর তলায় খানিকটা অন্ধকার অবশ্যই থেকে যায়, সে উপলব্ধি সেবার আমার হয়েছিল।

গভর্ণমেন্ট প্লেসের পাশে দুপ্লে স্ট্রীট আর নেহেরু রোডের মুখে যে বড় বাড়িটি, তাতে থাকতেন মিঃ স্টিফেন, এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেটার। তার পাশের বাড়িটি অ্যালিয়-দ্য-ফ্রাঁসের ফরাসি ভাষার রিটায়ার্ড প্রফেসর অ্যালবার্ট জ্ঞানাধিকমের, যাঁকে তোয়াজ করা আমার আর রায়দার দৈনিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ত তখন। কারণ আর কিছুই নয়, বীচ রোডের ধারে গড়ে উঠছে নতুন পল্লী 'ভারতী নগর', সেখানে উনি একটি দোতলা বাড়ি বানাচ্ছেন ও আমরা তার সম্ভাব্য ভাড়াটিয়া। অগ্রিম দেওয়া হয়ে গেছে, এবার কাজ শেষ হলেই আমরা পরিবার নিয়ে এসে সেখানে উঠব, এমনটাই ঠিক হয়ে আছে। আমার ইচ্ছে ২৬ জানুয়ারী কলকাতা গিয়ে ১লা ফেব্রুয়ারি ফিরব। সে হিসেবে টিকিট কাটাও হয়ে গেছে। ভারতী নগর জায়গাটিও খুব সুন্দর। সুন্দর সমুদ্রের হাওয়া, ছাতে উঠলে সমুদ্র দেখাও যায়। বীচ দুই কিলোমিটার, অফিস সাড়ে তিন, বাস স্ট্যান্ড তিন, বাজার দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে। জিনিষপত্রের সাথে আমার স্কুটার এসে পড়লে আর ভাবনা থাকবে না।

তবে মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। আমার ট্রাক আসতে কিছুটা দেরী হওয়ায় আমাকে স্ত্রী আর চারমাসের মেয়েকে নিয়ে ঐ গেস্ট হাউসেই উঠতে হল।


গেস্ট হাউসে চার মাসের মেয়েকে নিয়ে থাকাটা আমার স্ত্রীর পক্ষে কষ্টকর হতনা, যদি সেখানে আরও একটি অন্ততঃ পরিবার থাকত। আমার অফিস চলে যাওয়ার পর ঐ নির্বান্ধব পুরীতে চারপাশের বিজাতীয় মানুষের ভীড়ে সময় কাটানো কি কষ্টকর তা আমি বুঝি। কিন্তু সেখানে বহু অফিস কলিগ থাকলেও নিজে থেকে তো সে ব্যাপারে কথা বলতে পারিনা। সিভিলের ব্যানার্জি সেদিন আলাপ করিয়ে দিল ইন্ডিয়ান ওভারসীজ ব্যাঙ্কের অফিসার অদ্বৈত সরকারের সাথে। সদালাপী রুচিবান ব্যাচেলার মানুষ, একনিমেষেই আমার ছোট ভাই হয়ে গেল। ওর অনুরোধে পরদিন আম্মাইয়ার কোইল স্ট্রীটে ওর টু-বেডরুমের বাসায় আমি সপরিবারে চলে এলাম। 'বৌদি, এটাকে নিজের বাড়ি মনে করে যতদিন খুশি থাকুন, চাইলে নিজে রান্না করে খান', অদ্বৈত বলল, 'নেভার মাইন্ড, এতে আমারও কিঞ্চিৎ স্বার্থ আছে। এক, পরিবারের সাথে থাকা আর দুই, কিছুদিনের জন্যে হলেও বাড়ির রান্না খাওয়া। আর তিন নম্বরটা- থাক এখনই বলছি না।'

পরের দু-তিন দিন ধরে আলাপ-পর্ব চলতে লাগল বিভিন্ন বাঙালী ও উত্তর ভারতীয় পরিবারের সাথে যারা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমার সমব্যথী- অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা, রুচি, আদব-কায়দা, সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে হয়েছে। ওদের মধ্যে একটা প্রাথমিক ধারণা ছিল যে উত্তর ভারতীয় (ওরা বলত- ‘ইন্দি’ বা হিন্দি) মাত্রেই অসৎ, নাস্তিক বা ঈশ্বরভীতিহীন, ভোগ-বিলাসী, অখাদ্য-কুখাদ্য খায় আর সবচেয়ে বড় কথা, খরচের হাত খুব বড়, পয়সাকড়ি না জমিয়ে বা গয়না না কিনে অসভ্যের মত খেয়ে আর বেড়িয়ে ওড়ায়। এই শেষ ধারণাটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ের, খরচ করাতা যে মস্ত ছোঁয়াচে রোগ, যদিও স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল তাতে খুব উল্লসিত ছিল। ওদের দোষ দিই না, দক্ষিণ ভারতীয় সম্বন্ধে আমরা বাঙ্গালিরা কি একই কথা ভাবি না? দক্ষিণী মানেই ম্যাড্রাসি (ওদের মধ্যেও যে নানা ভাষা নানা মত থাকতে পারে তা নিয়ে কে ভাবত), গায়ের রঙ কালো, সব খাবারেই তেঁতুল আর প্রচণ্ড ঝাল, ধুতিকে লুঙ্গির মত পরে ঘুরিয়ে তুলে পরে, কঞ্জুষ দি গ্রেট, হিন্দি ভাষার ভয়ংকর বিরোধী (অবশ্য এ জিনিষটা ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পর্যন্ত আমাদের মধ্যেও ছিল), কাউকে বিশ্বাস করে না ইত্যাদি। অদ্বৈত সন্ধ্যেয় নিয়ে গেল নবীন রিজার্ভয়ের ইঞ্জিনীয়ার সঞ্জীব সিনহার বাড়ি, মা আর পিঠোপিঠি বয়সের দিদি রিঙ্কুকে নিয়ে ওদের সংসার। আলাপ হল সিপিডাব্লুডির ইঞ্জিনীয়ার চৌধুরীর সাথে। তাঁর স্ত্রী শুনলাম পাহাড়ি সান্যালের নিজের ভাগনি। সেখানে বেড়াতে এসেছে সিভিলের ব্যানার্জী, ভারতী নগরের বাসায় উনি আমার প্রতিবেশী হবেন, আর সিমেন্টিং-এর ভাস্কর বিশ্বাস সপরিবারে। মুষ্টিমেয় বাঙালী নিয়ে সদ্য সরস্বতীপূজা কিভাবে করা হল তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। চৌধুরি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, পরিধানে ন’খেইয়ের পৈতে, তাই এককথায় তাঁকে পুরোহিতের দায়িত্ব নিতে হল। কার বাড়িতে যেন ছিল মা সরস্বতীর ক্যালেণ্ডার, সেটা বাঁধানো হল। এবার ফুল-বেলপাতা যোগাড় করতে হবে। বেলপাতাকে তামিলে কি বলে? কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না। শেখর ভট্‌চায্যির মাথায় বুদ্ধি এল, ওই যে, কথায় বলে না ‘বেল পাকলে কাকের কি?’ উনি বোঝালেন ‘এ রাউণ্ড ফ্রুট, ক্রোস ডোন্ট কেয়ার হোয়েন ইট ইস রাইপ’!

কি কাণ্ড! যাক্‌, আর এ জীবনে ভুলছি না যে বেলগাছকে তামিলে বলে ‘বিলবর-মরম’ আর বেলপাতা হল ‘বিলবর ইলাই’।

তার দু’দিন পরে খবর এল আমার ট্রাক, চেন্নাই (তখনও ম্যাড্রাস) পৌঁছে গেছে। আমি আর রায়দা প্রঃ জ্ঞানাধিকমের কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাড়ির উপর-নীচের দখল নিলাম। সিমেণ্টিং সেকশানের ত্রিবেদী সপরিবারে এল দেখা করতে। ও আমাদের অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারিও বটে, খবর পেয়ে গেছে আমরা একটু আধটু সংগীতচর্চা করি। বেচারা সিধাসাদা গুজরাটি মানুষ, কিন্তু স্ত্রী ছিলেন এককালে স্টেট লেভেলের জেভেলিন ও শটপুট থ্রোয়ার। তাদের চার বছরের পুত্র সার্থকনামা শার্দুল একাই শহরটাকে মাতিয়ে রেখেছিল। মায়ে পোয়ে মিলে বাবাকে নিয়ে না ছোঁড়াছুড়ি খেলে কোনোদিন সেই ভয়ে ত্রিবেদীভাই নিজের ওজন বাড়িয়ে চলেছিল। যাকগে আমার বাসস্থান সমস্যার সমাধান তো হল, এবার সময় করে কারাইকাল ও তার আশেপাশের অঞ্চলের দিকে একটু তাকিয়ে দেখতে হবে, স্কুটারটা সার্ভিস সেন্টার থেকে সারিয়ে আনলাম।



কারাইকাল।৬।

কারাইকাল শহরে আমি ভ্রমণ করতে আসিনি, চাকরিসূত্রে ছ'বছর কাটাতে হয়েছে। তাই তাড়াহুড়ো না করে এই অঞ্চলের ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতি-ডেমোগ্রাফি জানতে ও বুঝতে সময় নিয়েছি যথেষ্ট। ২০০৩এর সুনামিতে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের উপকূলের সমস্ত অঞ্চল ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যদিও আমি ততদিনে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। এই উপকূল জুড়ে ঝড়-ঝাপটা লেগেই আছে, আর তার নিদর্শন হিসেবে সাক্ষী দিত কারাইকাল রেলওয়ে স্টেশনের ভগ্নস্তুপ আর মিটার গেজের কিছুটা রেলপথ। SIR (South Indian Railway), পরে Southern Railwayর ত্রিচি ডিভিশনের চেন্নাই-তিরুভারুর-নাগোর রূটের পেরালাম থেকে রেলপথের একটা টুকরো দিয়ে জোড়া হয়েছিল কারাইকালকে, সেই ১৯০২ সালে। তারপর ১৯৮০র দশকে একটি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে ও অর্থনৈতিক কারণের ক্ষতির খতিয়ান দেখে রূটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০০ সালের পরে চেন্নাই-পণ্ডি-তাঞ্জোর থেকে পুরো রূটটির গেজ কনভার্সন করে ব্রড গেজ করা হয় ও ১৪ কিমি দূরবর্তী নাগোরের সাথে মেলানো হয় নবনির্মিত কারাইকাল স্টেশনকে। এখন এখান থেকে সোজাসুজি যাওয়া যায় নাগোর হয়ে ভেলাঙ্কানি, ত্রিচি, তাঞ্জোর, পণ্ডিচেরি, চেন্নাই, বাঙ্গালুরু, তিরুপতি ও কোচিন। কারাইকালে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় শিল্পাঞ্চলের প্রকল্পটি এইবারে ত্বরান্বিত হয় ও মোটামুটি সফলতা লাভ করে।

চেন্নাই থেকে পূর্ব উপকূল বরাবর ইস্ট কোস্ট রোড (ECR) ধরে দক্ষিণে এগিয়ে গেলে একে একে আসবে মামাল্লাপূরম বা মহাবলীপুরম, কল্পক্কম, পণ্ডিচেরি, কাডালুর, পেরাঙ্গাপেট্টাই বা পোর্টো-নোভো, চিদাম্বরম, সিরকালি, পুম্পুহার, তরঙ্গমবাড়ি বা ট্র্যাঙ্কোভার, কারাইকাল, নাগোর, নাগাপট্টিনাম ও ভেলাঙ্কানি। ECR সেখান থেকে ঘুরে মুত্তুপেট্টাম, তোন্ডি হয়ে চলে যাচ্ছে রামনাদ হয়ে রামেশ্বরম। সাবেক কোস্টাল রোডটি কিন্তু নাগাপট্টিনাম থেকে দক্ষিণে ভেলাঙ্কানি, বেদারণ্যম হয়ে চলে আসছে কোডিক্কারাই-পয়েন্ট ক্যালিমার অন্তরীপ পর্যন্ত। এ সব স্থানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য যেমন আছে, তেমনই ঐতিহাসিক ও ধার্মিক মহত্ব। মহাবলীপুরম বিখ্যাত তার পুরাকালীন পাণ্ডব-রথ আদি মন্দির স্থাপত্যের জন্যে, কলপক্কমে আছে অতি আধুনিক পরমাণু-বিদ্যুৎ প্রকল্প, পন্ডিচেরি অন্যতম ফরাসী উপনিবেশ ও ঋষি অরবিন্দের স্মৃতি-বিজড়িত স্থান, কাডালুর প্রাচীন বন্দর শহর। নায়কন রাজত্বের প্রসিদ্ধ বন্দর শহর মুথুকৃষ্ণপুরী পর্তুগীজ শাসনকালে পরিচিত হয় পোর্টো নোভো (New Port) বা পারাঙ্গিপেটাই (অর্থাৎ ফিরিঙ্গি উপনিবেশ) নামে। ১৮৩০ সালে ভারতে প্রথম ইস্পাত তৈরির কারখানা স্থাপিত হয় সেখানে, তার সাক্ষী চেন্নাই এগ্মোর স্টেশনের লৌহস্তম্ভগুলিতে এখনো দেখা যায় খোদাই করা 'Made in Porto Novo'। ১৯২৪ সালে মহাত্মা গান্ধী এখানে অ্যান মারী পিটারসন নির্মিত সেবামন্দির নামে একটি স্কুলের ভিত্তি স্থাপন করেন। এছাড়া চিদাম্বরমে আছে বিশ্ববিখ্যাত নটরাজ শিবের মন্দির ও আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়। আরো খানিকটা দক্ষিণে পড়বে চোল সাম্রাজ্যের একসময়ের রাজধানী কাবেরী মোহানার ঐতিহাসিক নগর পুম্পুহার। যার কারুশিল্পকলায় খৃষ্টপূর্ব যুগের বিশ্ব মোহিত হয়েছিল, মোগল স্থাপত্য পর্যন্ত ছিল তার ছাপ, তা এখন সমুদ্রের তলায়- তবু সেখানে পর্যটক আজও হানা দেয় কোনও কিছু পাওয়ার আশায়। আরও দক্ষিণে এলে দেখা যাবে ড্যানিশ উপনিবেশ ট্র্যাঙ্কেবার যা আজ হয়েছে তরঙ্গমবাড়ি, সাতশ বছরের পুরানো মসিলামনি শিবের মন্দিরের জন্যে ছিল তার খ্যাতি, আর ছিল তাঞ্জোর-নৃপতি রঘুনাথ নায়কের নির্মিত একটি দুর্গ। ১৬২০ সালে নায়ক-রাজের কাছ থেকে দুর্গ সমেত শহরটি বাণিজ্যের জন্যে ইজারা নিয়ে ড্যানিশ জেনারেল ডান্সবর্গ সেখানে বন্দর স্থাপন করেন। ভারতের প্রাচীনতম প্রটেস্টান্ট চার্চ তৈরি হয় ট্র্যাঙ্কেবারে ১৭০২ সালে, ১৭১৮ সালে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে তার নাম হয় 'ওল্ড জেরুজালেম চার্চ'। দক্ষিণ ভারতে খৃষ্টধর্ম প্রচারে এই গির্জার মিশনের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ২০০৪ সালে সুনামির তরঙ্গ আছড়ে পড়ে প্রায় ভেঙে দিয়ে যায় তরঙ্গমবাড়ির এই স্থাপত্যটিকে, যা প্রায় ৭ কোটি টাকা খরচ করে সম্প্রতি সারানো হয়েছে। এই তরঙ্গমবাড়ির পরেই আমরা ঢুকছি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ফরাসি উপনিবেশ পণ্ডিচেরি রাজ্যের জেলা কারাইকালে।




কারাইকাল।৭।

তরঙ্গমবাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে কোট্টুচেরি গ্রাম থেকে শুরু হচ্ছে কারাইকাল জেলা। শেষ হচ্ছে ইস্ট কোস্ট রোড ধরে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে পোলাগাম গ্রামের প্রান্তে। কারাইকাল ও তৎসংলগ্ন নাগাপট্টনম কুয়েদ-এ-মিলাধ (তামিলনাডুর এই জেলা কারাইকালকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে আছে, অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর), তিরুভারুর ও পুদুকোট্টাই জেলার কিছু অংশ সমস্তটাই এককালে তাঞ্জোর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তাঞ্জোর সম্বন্ধে অনেক কিছু আলোচনা করার আছে, কারণ দাক্ষিণাত্য ছাড়া ভারতের অন্য অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় তাঞ্জোরবাসীরা বহুকাল আগেই পায়। তাছাড়া এই জেলাকে যদি তামিলনাডুর কলা ও সাংস্কৃৃতিক কেন্দ্র বলি, খুব একটা ভুল হবে না। আপাততঃ তাই কারাইকালকে বাদ দিয়ে সমুদ্রোপকূল ধরে কিছুটা দক্ষিণে ঘুরে নিই।

কারাইকাল থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে নাগাপট্টনম জেলায় অন্যতম ধর্মীয় আকর্ষণকেন্দ্র হল নাগোর। সপ্তদশ শতাব্দীর সুফি ফকির মস্তান হজরত সৈয়দ সাহুল হামিদের পুণ্য সমাধিস্থলে স্থাপিত মকবরাটিকেই বলা হয় নাগোর দরগাহ। ইনি একসময় তাঞ্জোরের রাজা অচুতাপ্পা নায়ককে এক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সারিয়ে তোলেন। এই দরগায় পাঁচটি মিনার আছে যার মধ্যে সর্বোচ্চটি তাঞ্জোরের মরাঠা সম্রাট প্রতাপ সিংহ নির্মাণ করেন। পয়গম্বর সাহুল হামিদের পুণ্যতিথি থেকে শুরু করে এখানে প্রতি বছর ১৪ দিন ধরে চলে বিশাল ধর্মীয় উৎসব 'কান্ডুরি'। শিরডির সাঁইবাবা বা পীর হজরত নিজামুদ্দীনের মত এই অঞ্চলের পথে ঘাটে ছড়িয়ে পীর মস্তান সাহুলের অনেক অলৌকিক কীর্তিকাহিনী, লোকে তাঁর নামও রাখে 'নাগোরের রাজা'। হিন্দু-মুসলমান-ক্রীস্টান নির্বিশেষে দলে দলে পুণ্যার্থী যোগ দেয় এই উৎসবে, সাথে নিয়ে আসে তাদের রোগ-জ্বালা-দুঃখ-বেদনার বিবরণ, পীরবাবার আশীর্বাদে সব দুঃখ দূর হবে এই আশা নিয়ে।

সপ্তদশ শতাব্দীরই কোনও এক সময় এই নাগোর থেকে ষোল কিলোমিটার দক্ষিণে ভেলাঙ্কানি গ্রামে ঘটে কিছু অলৌকিক ঘটনাবলী। শিশুসন্তান কোলে এক দিব্য জ্যোতির্ময়ী নারী মূর্তিকে মাঝে মাঝে দেখতে পায় কোনও এক গোয়ালা বালক। তিনি শিশুর জন্যে কিছুটা দুধ চাইলে বালক তাঁকে বেশ কিছুটা দুধ দেয়। পরে গ্রাহকের বাসায় গিয়ে সে অবাক হয়ে দেখে যে পাত্রটি পূর্ণ, যেন কোনও কিছুই নেওয়া হয়নি। আর একদিন একটি পঙ্গু গোপবালক তাঁর শিশুর জন্যে কিছুটা ঘোল দেয়। নারী তাকে অনুরোধ করেন নাগাপট্টনম গিয়ে সেখানকার ক্যাথলিক বিশপকে বলে ভেলাঙ্কানির সমুদ্রতীরে একটি গীর্জা বানিয়ে দিতে। ছেলেটি চলতে শুরু করে আর অবাক হয়ে দেখে তার পা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। বিশপকে ছেলেটি সব কথা খুলে বলতেই তিনি বুঝতে পারেন ঐ রমণীটি আর কেউ নয় শিশু-যিশু কোলে স্বয়ং মেরীমাতা। তিনি গ্রামবাসীর সাহায্যে সেখানে একটি গীর্জা গড়ে তোলেন।

কয়েকবছর পরে সেখান থেকে কিছুদূরে সমুদ্রের মাঝে একটি পর্তুগীজ জাহাজ ঝড়ে ভেঙে পড়ে। নাবিক ও যাত্রীরা প্রাণভয়ে মাতামেরীর প্রার্থনা শুরু করেন। হঠাৎ আশাতীতভাবেই কিছু মৎস্যজীবি তাঁদের রক্ষা করে ভেলাঙ্কানি উপকূলে নিয়ে আসে ও তাঁরা মাতামেরীর ভগ্ন গীর্জাটি সেখানে দেখতে পান। তাঁদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় যে মাতাই তাঁদের রক্ষা করেছেন । পরে তাঁরা প্রচুর খরচ করে গীর্জাটি নতুন করে গড়ে তোলেন। তার নাম হয় 'Basilica of Our Lady of Health' (মহামান্য পোপ জন ২৩- ১৯৬২ সালে একে ব্যাসিলিকার মর্যাদা দেন) বা আরোগ্য মাতার মন্দির। চার্চ হিসেবে এটি এখন ভারতে দেশি-বিদেশী মিলিয়ে সবথেকে বেশী তীর্থযাত্রী আকর্ষণ করে। খোঁড়া ছেলেটি মাতাকে প্রথম দেখে একটি জলাশয়ের ধারে, সেই পবিত্র জলাশয়ের নাম এখন মাতা কুলাম। সর্বধর্মনির্বিশেষে ভক্তদের ধারণা যে সেই পবিত্র জলে স্নান করে গণ্ডি কেটে মাতার মন্দিরে এসে তাঁকে দর্শন করলে সেরে যাবে যে কোনও অঙ্গের ব্যাধি। তাঁরা মানত করেন শরীরের অশক্ত অঙ্গটি সেরে উঠলে তার একটি সোনা-রূপা বা অন্ততঃ পিতলের গড়া একটি অঙ্গের প্রতিমূর্তি দেবীকে দান করবেন। ভক্তদের দানে তাই সমৃদ্ধ হয়েছে এখানকার সংগ্রহশালাটি- সোনার পা, রূপার কিডনী, পিতলের ফুসফুস- সব সাজানো থরে থরে। এখানে ঢুঁ মারলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে মাতার অলৌকিক শক্তির সম্বন্ধে। চার্চের প্রতিষ্ঠা দিবস ৮ই সেপ্টেম্বর, সেদিন অত্যধিক ভীড় হয় সেখানে। ভেলাঙ্কানি এখন জমজমাট তীর্থস্থান, প্রচুর হোটেল-ধর্মশালা, রেল-বাসের মাধ্যমে এটি যুক্ত সমস্ত ভারতের সাথে।



কারাইকাল।৮।

সাবেক ইস্ট কোস্ট রোড ভেলাঙ্কানি ছাড়িয়ে কিছুটা এসে শেষ হলেও একই ন্যাশানাল হাইওয়ে সমুদ্র থেকে দূরে রওনা হয়েছে রামেশ্বরমের উদ্দেশে। আমরা কিন্তু ঠিক করেছিলাম কারাইকাল সংলগ্ন করোমন্ডল কোস্টের চারপাশটা একবার ঘুরে দেখার। ভেলাঙ্কানি থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর কূল ঘেঁসে রাস্তা গেছে কোডিক্কারাই পর্যন্ত। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র কি এ পথেই লঙ্কায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন? এই রাস্তার পাশেই রামপাদ নামে এক জায়গায় ক্লে-স্টোনের উপর একজোড়া পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তা নাকি শ্রীরামচন্দ্রের পদচিহ্ন। রামায়ণের গল্পে যদি সত্যতা কিছু থাকে, তবে আমার মনে হয় হনুমান এই পথে পয়েন্ট ক্যালিমার পর্যন্ত এসে ভেবেছিলেন সেটাই ভারতের শেষ সীমানা। তিনি হয়ত এখান থেকেই ২৮ কিলোমিটার সমুদ্র লাফ দিয়ে হোক বা সাঁতরে পার হয়েছিলেন। পরে রামচন্দ্র এসে পনের ফুট উঁচু কাদামাটির (তখন বর্ষাকাল চলছিল) উপরে দাঁড়িয়ে লঙ্কার সীমানা দেখার চেষ্টা করেছিলেন হয়ত, সেটাই পরে শুকিয়ে কর্দম-শিলা (Clay-stone) হয়ে তাঁর পদচিহ্ন চিরকালের জন্যে ধারণ করে রাখে। রামভক্ত হিন্দুদের এটি এখন এক তীর্থ, এপ্রিলে রামনবমীতে ভালই পুণ্যার্থীর সমাগম হয় এখানে। রাম হয়ত এই পয়েন্ট ক্যালিমার বা বেদারণ্যম থেকেই সমুদ্রশোষণ করে সেতু বাঁধার উপক্রম করেন। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে রামেশ্বরম বা ধনুষ্কোটির সন্ধান দেয় যেখানে ভৌগোলিক বিস্ময় হিসেবে একটি শিলাময় সেতুজাতীয় বস্তু সমুদ্রের উপর মোটামুটি অবস্থান করছিল, ইঞ্জিনীয়ার নল আর বানর সেনানী দিয়ে তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে একটি পূর্ণাবয়ব সেতুর রূপ দেন। আমার এ ধারণা হয়ত ভিত্তিহীন নয়, কারণ সি-১৪ পরীক্ষায় পাথরগুলিতে পাওয়া জৈব উপাদানের বয়স নির্ধারিত হয়েছে ১২৫০০০ থেকে ৩৫০০ বছর। মনে হয় অ্যাডাম সেতু প্রাকৃতিক নিয়মে (ভূকম্প বা সুনামীতে) গঠিত হয় ১২৫০০০ বছর আগে, এবং সেটিকে ৩৫০০-৪০০০ বছর আগে রামচন্দ্র একটি পূর্ণাঙ্গ সেতুর রূপ দেন। পরে রামসেতু ১৪০০ সাল নাগাদ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়লেও এর প্রাচীন অংশটি থেকে যায়।

অনেক গবেষণা হল, এবার বেদারণ্যমে ফিরে আসি। এখানে আছে চিরহরিৎ বেদারণ্যম, একটি অভয়ারণ্য যেখানে সালমান খানদের অগোচরে নির্ভয়ে খেলে বেড়ায় লুপ্তপ্রায় প্রজাতির কৃষ্ণসার হরিণের দল (Black buck)। এছাড়া আছে তিনটি আলোক-স্তম্ভ (তার মধ্যে প্রাচীনতম হাজার বছরের পুরনো চোলা লাইট-হাউসটি গত সুনামিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়), বিশাল একটি লেগুন আর বিস্তীর্ণ জলাভূমি জুড়ে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। শীতকালে এখানে দেখা যাবে কিছু দুর্লভ স্পেসির অতিথি পাখি যেমন spoon-billed sandpiper আর greater flamingo। পয়েন্ট ক্যালিমারের শেষপ্রান্তে অবস্থিত বন-বিভাগের অফিসে পরিচয়-পত্র দেখিয়ে টিকিট কেটে ঘুরে নেওয়া যায় সমস্ত সংরক্ষিত অঞ্চল, সাথে সরকারী গাইডও পাওয়া যায়।

বেশীরভাগ বাঙালী ট্যুরিস্টই দক্ষিণ ভারতে একসাথে একটা প্যাকেজ করে নেয় যার মধ্যে থাকে- চেন্নাই, তিরুপতি, মামাল্লাপুরম, পণ্ডিচেরি, কাঞ্চী-পক্ষীতীর্থম, কোদাইকানাল, উটি, মাদুরাই, রামেশ্বরম, কন্যাকুমারী, কোভালাম ও তিরুভনন্তপুরম। বা অন্যদিকে ভাইজাগ-বিজয়ওয়াড়া-হায়দরাবাদ-বাঙ্গালুরু-মাইসোর-কুর্গ-কোচিন-মুন্নার-থেক্কাডি-অ্যালেপ্পি-কালিকট-উদুপি। করোমণ্ডল তটভূমির মৎস্যোপজীবিদের কথা জানতে চাইলে পড়ে নেয় সরোজিনী নাইডুর কবিতা। আমি কারাইকালের আরাইঞার আন্না কলেজের একজন ইতিহাসের অধ্যাপক আর সেখানকার টাউন অ্যাডমিনিস্ট্রেটারের সাহায্যে শুরু করেছিলাম একটি প্রজেক্টের কাজ- 'কারাইকালকে ভারতের পর্যটন-মানচিত্রে নিয়ে আসা' সম্ভব কিনা তা নিয়ে। আমি জানিনা সেটি তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন কিনা, তবে আজ এই শহরকে ঘিরে সত্যিই একটি জনপ্রিয় পর্যটন অঞ্চল গড়ে উঠেছে, যদিও ভাবতে খারাপ লাগে যে তার মূল ভিত্তি জনসাধারণের ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস। তবু তো- 'বিশ্বাসে মিলায়ে কৃষ্ণ'! পরের অংশে এই প্রসঙ্গে আসছি।



কারাইকাল।৯।

এবার ফিরি কারাইকালে আমাদের সেই ছোট নতুন বাসায়। ওয়ান বেডরুম-হল-কিচেন-বাথ-ব্যালকনি হলেও আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অফিস থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পোলাগাম গ্রামে নতুন টুলস ইয়ার্ড চালু করার দায়িত্ব। আট-দশ একর জমির উপর তৈরী হবে ব্যবহৃত পাইপের র‍্যাক, ফিশিং, ড্রিল-স্টেম টেস্টিং, ডেভিয়েশন ড্রিলিংয়ের যন্ত্রপাতি, লাইনার হ্যাঙ্গার ইত্যাদি যন্ত্রের স্টোরিংসহ রক্ষণাবেক্ষণ-ব্যবস্থা। ফ্রেডরিক দায়িত্ব নিল ব্লো-আউট প্রিভেন্টার মেরামতির আর রমেশ ও নন্দিত ভার নিল হ্যান্ডলিং টুল রক্ষণাবেক্ষণের। একজন স্টোর কীপার পাওয়া গেল স্পেয়ার পার্টের হসেব রাখার জন্যে। এছাড়া আরো দু-চারজন অফিসার, ওয়েল্ডার আর অস্থায়ী শ্রমিক নিয়ে শুরু হল আমাদের কাজ। এ কাজে মনিটারিং বা খবরদারির বিশেষ কিছু নেই, আটটা ড্রিলিং রিগ বিভিন্ন ফিল্ডে কাজ করছে- তাদের যখন যা প্রয়োজন, প্ল্যান্‌ড্‌ বা আনপ্ল্যান্‌ড্‌, প্রভিসন দিয়ে যেতে হবে। আমাকে সকাল নটায় মেন অফিসে যেতে হয়। মুথুরাম আম্বেদকার সেখানে আমার প্রতিনিধি, সবার প্রয়োজনের লিস্ট তৈরি করে রাখে, একটা প্রাত্যহিক মিটিংএর মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইনভেন্ট্রি অ্যানালিসিস করে পারচেজ রিকুইজেশান পাঠানোর দায়িত্বও আমাদের। প্রায় সাড়ে-দশটা এগারোটায় আমার পৌঁছনো হয় নিজের অফিসে। ফেরার কোনও ঠিক নেই, ছটা-সাতটা প্রায়ই বাজে। মেয়ে আমার ততক্ষণ বাড়ির জানলার ধারের ডিভানে বসে কুকুর-শুয়োর যা দেখতে পায়, আঃ-আঃ করে ডেকে চলে। তবু খুশি ছিলাম যে বাসায় ফিরে পরিবারের মুখ দেখতে পেতাম, বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানো যেত।

মোবাইল সার্ভিস তো দূর-অস্ত, ৯৪ সালে ল্যাণ্ডলাইন টেলিফোন পাওয়ারও লম্বা লাইন ছিল। পরের সাত-আট মাসের মধ্যেও ফোন পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে মিঃ সুব্রহ্মন্যম নামে একজনের সাথে আলাপ হল। ভারতী নগরেই থাকেন, সেলস-ট্যাক্স কনসালট্যান্ট, স্ত্রী সরকারী হাসপাতালে স্টাফ নার্স। উনি দোতলা তুলেছেন, 2BHK, দুখানা ব্যালকনি, কভারড কার পার্ক, আমার তো দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। তাছাড়া বীচ রোড, মাছের বাজার, অফিস, সবই বেশী না হলেও ৩-৪ শো মিটার কাছে হবে, মন্দ কি? দেওয়ালির পরেই সে বাড়িতে শিফট করলাম।

এতদিনে একটা কালচারাল বোঝাপড়া করে ফেলেছি নিজের সাথে। এখন শুধু অফিসের উত্তর ভারতীয় গ্রুপই নয়, পাড়া-বেপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপ জমে উঠেছে। প্রথম প্রথম ভাষার সমস্যা ছিল। আমরা যতই ভাবি যে দক্ষিণ ভারতীয়রা হিন্দী পছন্দ না করলেও ইংরেজিটা বোঝে ভাল- সেটা সীমিত শিক্ষিতদের মধ্যেই। ইতিমধ্যে একজন খবর দিল যে সিটি মালিগাইএর (মালিগাই=মুদীর দোকান) কর্মচারিরা হিন্দি-ইংরেজি বোঝে। খুব আশা নিয়ে গেলাম সেখানে। মালিক আমাকে দেখেই জিগ্যেস করলেন-ইন্দি? আমি ঘাড় নাড়তেই একটা ল্যামিনেট করা বোর্ড ধরিয়ে দিলেন। দেখি সেখানে তিন ভাষায় জিনিষপত্রের নাম লেখা আছে- তামিল, হিন্দী ও ইংরেজি। আমি বলে যেতে লাগলাম- কোলাম চাল- ৫ কিলো, ভদ্রলোক হাঁকলেন কোলাম আরিসি - আঞ্জি কিলো। অরহর ডাল- আধো কিলো, তওয়রম পুরপ্প আরেই কিলো। জিরে-ধনে-হলুদ-লবন, উনি আদেশ দিলেন- জিরাগম-মল্লি-মঞ্জল-উপ্প। এসব দেখে আমার একমাসে বাজারের জিনিষপত্রের তামিল নাম-দাম সব মুখস্থ হয়ে গেল, তখন অন্য যে কোনও দোকানে বা সব্জিবাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে পারি।



কারাইকাল।১০।

বলতে ভুলে গেছিলাম এর মধ্যে আমার মেয়ের প্রথম জন্মদিন এল সেপ্টেম্বরের শেষে। ভাবলাম নতুন জায়গায় একটু বড় করে অনুষ্ঠান করা যাক, সবার সাথে পরিচিতি বাড়বে। অফিসার্স ক্লাবের হলে ব্যবস্থা করা হল। বাঙ্গালি-উত্তর ভারতীয়-তামিল মিলিয়ে ৬০-৭০ জন হল। ক্লাবের কেয়ারটেকার পেরুমল সব দায়িত্ব নিল। ওরই সুত্রে ক্লাবের নিয়মিত ক্যাটারার আনবেলাগানের সাথে কথা বললাম। রান্নার ব্যাপারে বললাম, ভাই চিকেনটা নর্থ ইণ্ডিয়ান স্টাইলে করুন, গুচ্ছেক নারকেল দেবেন না। আনবু রাজী হল।
এই ঘটনাটার উল্লেখ করলাম এখানকার লোকের রুচি ও বিচারধারা দেখানোর জন্যে। কারণ অনুষ্ঠানের রাত্রে দেখি সেই চিরাচরিত নারকেল দিয়ে রাঁধা চিকেন কারি! আনবুকে বলতেই ও অম্লানবদনে জানাল- 'স্যার আপনি তো ঝোলে নারকেল দিতে মানা করলেন। কিন্তু আমারও এখানে একটা সুনাম আছে। ইনফেরিয়ার কোয়ালিটির রান্না করে আমি আমার সুনাম খারাপ করতে চাই নি'।

দুর্গাপূজা বা দশেরা উৎসব এসে যে পড়ল, তার কিছুই বোঝা গেল না। কারাইকালে কিছু হয় না, একফাঁকে পরিবার নিয়ে মাদ্রাজ চলে এলাম, অ্যাপোলো হাসপাতালে কাজ ছিল, তাছাড়া ওখানকার বাঙ্গালিদের দুর্গাপূজো দেখার ইচ্ছে কিছুটা ছিল। তবে টি-নগর বা অ্যাডেয়ারে পূজো দেখে আনন্দ পেলাম না। ওখানকার বাঙ্গালিরা আলাপ করতেই চায় না, আর কারাইকাল নামটার সাথে, বিশ্বাস করুন, দেখা গেল কেউই পরিচিত নয়। বরং মহাষ্টমীর দিনে দেখলাম তামিলরা 'আয়ূধ পূজা' করে, সরস্বতীর প্রতিমাকে আয়ূধ বা যন্ত্রপাতির দেবীরূপে পুজো করা হয় বিশ্বকর্মার জায়গায়। কি ভেবে পণ্ডি বাজার থেকে ৪'x৩' সাইজের একটা আয়ূধ, মানে মা সরস্বতীর পোস্টার কিনে ফেললাম।

দেওয়ালি তামিলনাডুর নিজস্ব উৎসব না হলেও জাঁক-জমকখানা কম হয় না সেখানে। এদিকের সাথে কোনও তফাৎ নেই এ বিষয়ে, তাই আর বিশেষ বর্ণনা দেওয়া দরকার মনে করছি না। তবে খৃস্টমাস বেশ ধুমধাম করে পালিত হল সেখানে। নিউ ইয়ার্স ঈভের অনুষ্ঠানে অফিসার্স ক্লাবে ভালই খানাপিনা হল। রাত্রি একটায় মেয়ে-বউ নিয়ে স্কুটারে আসছি চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে, লিকার এখানে সস্তা, ভয় হচ্ছিল রাস্তায় মাতালের উৎপাত না সহ্য করতে হয়। অবাক হয়ে দেখলাম, এখানকার মানুষ মাতাল হলে বেশী ভদ্র হয়ে যায়। তাদের চুড়ান্ত ভদ্রতাকে কোনমতে পাশ কাটিয়ে বাড়ি পৌঁছলাম।
এরপর জানুয়ারি আসতেই ভাস্কর, ভট্টাচার্জিদা, সঞ্জীব সবাই এসে ধরল সরস্বতী পূজোর জন্যে। ঠিক আছে, সবার সাথে আছি, আর কি চাই? না, না, চৌধুরিদা বদলি হয়ে গেছে, সুতরাং পৌরোহিত্য করতে হবে। আরে, দুই ভট্টচাজ, ব্যানার্জি, মুখার্জিদা, তপাদারদা, গোস্বামী- পৈতেধারীর তো অভাব নেই। আমারই বরং পৈতে মাঝে মাঝেই ধোপাবাড়ি গিয়ে আর ফেরত আসেনা। আসলে আর কিছু না, মাদ্রাজ থেকে কেনা সরস্বতীর ছবিটা এনেই হয়েছে যত বিপত্তি। অফিসের স্টাফদের অনুরোধে ওটা বাঁধিয়ে আমার ইয়ার্ডের অফিসে সাজিয়ে রেখেছি, ওদের ইচ্ছে বেশ বড় করে আয়ূধ পুজো করবে এবার। ওখানে মূর্তি পাওয়া যায় না, অগত্যা ওই বাঁধানো ছবির পুজো হবে ঠিক হল। আমি পাকে-চক্রে পুরোহিত হয়ে গিয়ে এবার খুঁজতে লাগলাম বাবার হাতে লেখা মন্ত্রের খাতাটা আর একটা যজ্ঞোপবীত!

সে বছর যা সরস্বতী পুজো হয়েছিল, ভাবলে এখনও হাসি পায়। ভাস্কররা তিরুনাল্লার রোডের একটা বিল্ডিঙে থাকত। তার তামিল মালিক সহ সেখানে ছটি পরিবার ভাড়ায় ছিল। বাড়ি একদিকে, আর সামনের দিকে টানা গাড়ি রাখার জায়গা। গাড়িগুলো বের করে দিয়ে সেই বাঁধানো উঠোনে ছোট্ট প্যান্ডেল খাটানো হল, আলপনা ইত্যাদির মধ্যে ঘটস্থাপন আর মা সরস্বতীর ছবি রাখা হল। এই সূত্রে জানতে পারলাম যে 'প্যান্ডেল' কথাটাকে ইংরেজি শব্দ ভেবে আমরা পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম, সেটা মূলতঃ তামিল। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা মাঝে মাঝে কাউকে ঠাট্টা করে বলি না 'মস্ত তালেবর হয়েছ', আসলে তালাইবর কথাটাও তামিল, যার মানে হয় 'শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি' (তালাই = মাথা)।
সে যাক, বাবার সংগৃহীত মন্ত্রের খাতার কল্যাণেই হোক বা 'আয়ুধ' দেবীর বাঁধানো ছবির আশীর্বাদে, সরস্বতী পুজো চমৎকার ভাবে মিটল। অবশ্য আমরা বাঙ্গালিরা মনে করি সব ভাল যার শেষ ভাল, আর শেষে ছিল বিশুদ্ধ বাঙালী গৃহিনীদের হাতে রাঁধা খিচুড়ি-ছ্যাঁচড়া-চাটনি-পায়েস, সুতরাং ভাল না হয়ে উপায় ছিল? আমাকে আবার কয়েকটি শিশুকে হাতেখড়িও দিতে হল। ঝামেলা বাধালেন এক বয়স্কা বৌদি, নাম করবনা, পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রের উপর খুব চটে উঠলেন- 'কই, ভয়েবচটা ত বললেন না!' যত বোঝাই এরকম কোনও মন্ত্র নেই, বলেন, 'আপনি কি তরুন মজুমদারের থেকে বেশী জানেন?' 'কে তরুন মজুমদার।' 'ঐ যে, অনুপকুমার সাধু সেজে বলছে না, বিদ্যাস্থানে ভয়েবচ, দাদার কীর্তি দেখেন নি, চ্যাটার্জীদা', অনন্যা ফোড়ন কাটাতে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বৌদিটিও আসল ব্যাপারটা হয়ত বুঝে লজ্জা পেয়ে গেলেন। পরদিন মহাসমারোহে সমুদ্রে ঘট বিসর্জন দেওয়া হল।

সরস্বতীপূজায় অসমীয়া-উড়িয়ারা বাঙ্গালিদের সাথে ঢুকে পড়লেও, আমাদের উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়রা থাকত একটু দূরে-দূরেই। তবে আমাদের হোলিখেলাটা ছিল একেবারেই অনন্য। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়া সবাই অংশ নিত। তবে হোলি ত আর ইনডোর গেম নয়, এর ন্যাড়াপোড়া, উদোম রঙবাজি ত কোনও ঘরে বসে হয় না। তাই আমাদের উৎসব হোলিকাদহন দিয়ে শুরু হত ওএনজিসি অফিসার্স ক্লাবের প্রশস্ত বাগানে। আমার তত্বাবধানে টুল ইয়ার্ড থাকাতে প্যাকিং বাক্সের কাঠের অভাব ছিল না। কোম্পানীর পিক-আপ ভ্যানে প্রচুর ভাঙ্গাচোরা কাঠের বাক্স সকালে ক্লাবে পাঠিয়ে দিতাম, ত্রিবেদী, এস পি সিং, রাও মিলে পেরুমলের সাহায্য নিয়ে ন্যাড়া গড়ে তুলত। রাত্রে সেটা সবাই মিলে পুড়িয়ে পটকা ফাটানো, আবীর খেলা আর মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। আসল খেলা হত পরদিন সকাল নটা থেকে বীচের ধারে। রঙ মেখে ভূত সেজে সমুদ্র স্নান। রসিকজনেরা দল বেঁধে ঢুকে পড়ত 'সী-গ্যল'এ বীয়ারের আনন্দ নিতে। বীচ রোডের গার্ডেনের ধারের শেডে ফিরে আসতে আসতেই দেখতে পেতাম পেরুমল ভ্যান থেকে লুচি, তরকারি, লাড্ডু নামাচ্ছে সবার জন্যে। আগেই বলেছি, তামিলে প-ফ-ব-ভ'এর উচ্চারণ একরকম। তাই স্থানীয় উচ্চারণে সেটাকে আমরা মজা করে ভুরিভোজই বলতাম। আমাদের আনন্দ বাড়ত বাচ্চাদের উৎসাহ আর স্ফুর্তি দেখে।

আর স্থানীয় বাসিন্দারা? তারা অবাক হয়ে ভাবত এই 'ইন্দি' লোকেরা মন্দিরে না গিয়েই কত উৎসবই না করতে পারে!




কারাইকাল।১১।

আমাদের কোম্পানী থেকে অফিসারদের তেলের জন্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রতিমাসে দেওয়া হত, অবশ্য যদি গাড়ি থাকে। কিন্তু গাড়ি কিনব, টাকা কই? তখন সবচেয়ে সস্তা গাড়ি মারুতি, তবু লোন ছাড়া কেনার ক্ষমতা ছিল না। আর লোনের দরখাস্ত করে বসে আছি সেই কত দিন থেকে, বছরে ১৪-১৫টার বেশী ক্লিয়ারই হয় না। শেষে একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড ফিয়াট কিনে নিলাম একদিন।
তারপর আর আমার ফুর্তি দেখে কে? উইকএন্ডে বা অন্য কোনও ছুটি পেলেই ছোটাছুটি পণ্ডিচেরি, ভেলাঙ্কানি, তাঞ্জোর, কুম্ভকোনাম, চিদাম্বরম। পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে বসে থাকতে বা বীচ রোডে ঘুরে বেড়াতে এত ভাল লাগত তখন! আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী ছিল, ডাঃ সুশান্ত দাস, তন্ময়, ভাস্কর, হালদার, দেশাই বা সুলিপি। সায়ন বিশ্বাস একটা মারুতি ভ্যান কিনেছিল, অথচ নিজের চালাবার সাহস ছিল না, ওটা ওর গিন্নি সুলিপির হেফাজতেই থাকত। ব্যাপারটা এমন গা সওয়া হয়ে গেছিল যে এ নিয়ে কেউ কিছুই বলত না।

কিন্তু অকারণে কাঁহাতক আর ঘোরা যায়! ইতিমধ্যে IGNOUর MBA Correspondence Courseএ অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিলাম, তাতে সিলেক্ট হলাম। জানা গেল পণ্ডিচেরির বি-এড কলেজে উইক-এন্ডে ক্লাস হবে। ভাবলাম, যাক, মাঝে মাঝে এখানে আসার একটা ছুতো পাওয়া গেল।
আমাদের মধ্যে ডাঃ দাস ছিলেন প্রকৃত বন্ধুবৎসল এবং হুজুগে মানুষ। আমরা দলবল নিয়ে কোনও কোনও চন্দ্রালোকিত রাত্রে বীচের পার্কে গিয়ে বনজ্যোৎস্না বা moonlit picnic করতাম। ব্যস্ত জায়গা বলে রান্নাবান্না করার অনুমতি ছিল না, তাই বাড়ি থেকে লুচি, ফ্রায়েড রাইস, মাংস, মিষ্টি তৈরি করে নিয়ে গিয়ে আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া হত। তারপরে কিছুদিন যেতে দেখি স্থানীয় লোকেদেরও ব্যাপারটা খুব পছন্দ হয়েছে। ফলে সন্ধের পর ভীড় বাড়তে লাগল সেখানে। মেরিনার মত না হলেও যথেষ্ট প্রশস্ত বেলাভূমি দিয়ে চাঁদের আলোয় হাঁটার অনুভূতিই ছিল আলাদা, দিনগুলি এখনও মিস করি। জানুয়ারিতে শীত ঠিক না পড়লেও একটা শিরশিরে হাওয়া দিত দিনভর, অন্ততঃ গরমটা টের পেতাম না। কিন্ত জমিয়ে একটা পৌষালু না করতে পারলে শীতকালই বৃথা।

অবশেষে একদিন সুলিপির ভ্যান এক রবিবারের ভোরবেলায় থামল আমার দুয়ারে। সাথে সায়ন আর একগাদা বাচ্চাকাচ্চা। কি ব্যাপার, না আরসালার মোহানায় নদীর ওপারে ডাঃ দাস একটা নির্জন বীচ আবিষ্কার করেছেন, পিকনিকের একেবারে আদর্শ জায়গা। দাস আর হালদার সস্ত্রীক গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেছেন, তন্ময়, ব্যানার্জী, গোস্বামীদের খবর দেওয়া হয়েছে, এবার আমাদের বেরোতে হবে। কয়েকটি অবাঙ্গালী বন্ধুও সপরিবারে চললেন সাথে। গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন পৌঁছলাম সেখানে, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঝাউ আর দেবদারু গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাগরের ঊর্মিমালা বালিয়াড়ির উপর ভেঙে পড়ার সশব্দ দৃশ্য- বাকি চারিদিক নির্জন, শান্ত, মহিলামহল একমুহূর্তেই ডাঃ দাসের নামে ওর নামকরণ করে ফেলল- 'সুশান্ত বীচ'।

সেদিন 'সুশান্ত' বীচের ঝাউবনে আমাদের পিকনিক একটা অন্য মাত্রা পেয়েছিল। নাচে-গানে-আবৃত্তিতে-জোক বলায় কার কি 'লুক্কায়িত প্রতিভা' আছে তা একদিনেই প্রকাশ হয়ে গেল। তবে বীচটা এত নির্জন কেন সেটা পরে জেনেছিলাম একটা ভয়ানক শোকাবহ ঘটনা থেকে। পরে এই বীচ আমাদের মত অন্য বহিরাগতদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০১ সালে আমাদেরই কোনও সহকর্মীর তিন ছেলেমেয়ে একসাথে ডুবে মারা যায় সেখানে সমুদ্রস্নান করতে গিয়ে- আরাসালার মোহানার ঠিক তলায় নাকি ভয়ংকর ঘুর্ণি আছে কয়েকটা, তার চক্রে পড়ে গেলে আর রক্ষা নাই। এখনও ভাবি, সেদিন কি ভেবে আমরা কোনও বাচ্চাকে সমুদ্রে নামতে দিইনি, দিলে কি ফল হতে পারত ভেবে এখনও গা শিউরে ওঠে।


কারাইকাল।১২।

১৯৯৮ সালে আমি ম্যানেজমেন্টের পিজি ডিপ্লোমা পেয়ে গেলাম, কিন্তু প্রোজেক্ট তখনও বাকি। ইতিমধ্যে এই শহরের রিজিওন্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটার মিঃ স্টিফেনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোক আই-এ-এস হয়েও কেন জানি না আমাদের সাথেই এম-বি-এতে ভর্তি হয়েছিলেন। ফরাসি আমল থেকেই এই অঞ্চলের শাসকীয় প্রধানকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটার বলা হত, ২০০৬ সাল নাগাদ এই পদের নাম বদলে কালেক্টার করা হয়। সেবার উনি ওঁর গাড়িতে পণ্ডিচেরি থেকে কারাইকাল লিফট দিয়েছিলেন, আমাকে আর সহকর্মী কুরূপকে। তখনই উনি আমাকে একটা প্রজেক্টের আইডিয়া দিলেন- বিষয়, 'কারাইকালকে ভারতীয় পর্যটন মানচিত্রে আনা- A feasibility study.' পর্যটনের সঙ্গে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সম্বন্ধটা ঠিক মাথায় এল না। তবু বললাম, এত স্থানীয় জ্ঞানী-গুণী থাকতে আমি এ কাজে! তাছাড়া তামিলটাও তো ঠিক বলতে বা বুঝতে পারি না। উনি আমাকে সরকারি লাইব্রেরিতে যেতে বললেন। আলাপ হল চীফ লাইব্রেরিয়ান ও ক্যুরেটার মিঃ দণ্ডপাণির সাথে, একগাদা পোকায় খাওয়া বইয়ের মাঝে ঠিক গ্রন্থকীটের মতই বসেছিলেন ভদ্রলোক। উনি আমার প্রজেক্টের কথায় উল্লসিত। বললেন, এখানকার মানুষ 'প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং' হলেও ধর্মম্‌ আর তঙ্গম্‌ (সোনা ) ছাড়া আর কিছু ভাবতে চায় না। তবে এরা হোস্টাইল নয়, সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে জানে। তামিলনাডুর অন্য অঞ্চলের মত সরকারি লালফিতের বাঁধনও তেমন শক্ত নয়। কিন্তু দিনকাল পাল্টাচ্ছে, একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে হওয়ার দরকার আছে।

'কিন্তু এ ব্যাপারে আমাকে কে গাইড করতে পারেন? তাঁর আবার ইউনিভার্সিটির মনোনয়ন চাই', আমি বললাম।

'দেখুন, যদি এম-বি-এ না থাকলেও চলে, তাহলে আমি আপনার জন্যে আরিঞার আন্না আর্টস কলেজের প্রফেসার ডাঃ চোলনের নাম সাজেস্ট করতে পারি। যদি ইগনু অ্যাপ্রুভ করে তাহলে এই বিষয়ে ওঁর থেকে যোগ্য মানুষ আর পাওয়া যাবে না।
'আরিঞার আন্না' কথাটার মানে বোধহয় 'জ্ঞানী বড় ভাই'। অন্ততঃ ইতিহাসের অধ্যাপক ডাঃ চোলানকে দেখে আমার তাই মনে হল। আমার সংকল্প দেখে উনিও সমান উত্তেজিত। তাঁর কাছেই জানা গেল, প্রাচীন তাঞ্জোর জেলার কুম্ভকোনাম থেকে শনীশ্বরম পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে 'নবগ্রহ সন্নিধি'। কথিত আছে পুরাকালে অমৃত মন্থনের পর তা বন্টনের সময় যখন রাহু-কেতু নামের অসুরেরা বিষ্ণুর চক্রান্ত বুঝতে পেরে দেবতা সেজে অমৃতের স্বাদ নিচ্ছে, চন্দ্র-সূর্য তাদের চিনতে পেরে বিষ্ণুকে জানান। বিষ্ণু সাথে সাথে রাহু-কেতুর মাথা সুদর্শনে কেটে ফেললেও অমৃতকুম্ভ নিয়ে দেব-দানবে যুদ্ধ লেগে যায়। হাতাহাতিতে কুম্ভটি ছিটকে ভেঙে যায় আর তার একটি টুকরো পড়ে একটি সরোবরে, সাথে সাথে সরোবরের জলে অমৃতের গুণ দেখা যায়। কুম্ভের কোনা ভেঙে পড়ে বলে জায়গাটির নাম হয় কুম্ভকোনাম। গলা কাটা গেলেও অমৃতের স্বাদ পেয়েছে বলে রাহু-কেতুর মৃত্যু নেই, তবু আরো অমৃতের লোভে তাঁরা কাছাকাছিই ঘাঁটি পাতেন, তাঁদের নামে মন্দির স্থাপনা হয়। কিন্তু তাঁরা আর বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না, কারণ স্বয়ং শিব আর সূর্যদেবতার অধিষ্ঠান হয় সেই সরোবরের তীরে। সূর্যের থেকে দূরে থাকতে না পেরে এইভাবেই কাছাকাছির মধ্যে বাসা বাঁধেন চন্দ্র-বুধ-মঙ্গল-বৃহস্পতি আর শুক্র। তিরুনাল্লারের শনিদেবের কথা তো আগেই বলেছি। এই নবগ্রহের তীর্থযাত্রা দক্ষিণ ভারতীয়দের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গ্রহ শান্ত হলে কোনও দুঃখ-রোগ-অমঙ্গল কাছে ঘেঁষতে পারেনা যে! তবে সাধারণতঃ নিম্ন মধ্যবিত্তরাই তীর্থভ্রমণ বেশী করে থাকেন, তাই গুটিকয় ধর্মশালা আর কিছু নিম্নমানের হোটেল ছাড়া তেমন কিছুই গড়ে ওঠেনি এই অঞ্চলে। কিম্বা হয়ত ইনফাস্ট্রাক্‌চারের অভাবেই এখানে পর্যটনটা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। কোনটা ঠিক তা জানতে গেলেও একটা বিষয়নিষ্ঠ গবেষণাভিত্তিক কাজের প্রয়োজন আছে।

 প্রফেসার চোলানের বায়োডাটা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিলাম, দু সপ্তাহের মধ্যে মঞ্জুরী এসে পড়ল, আমিও কাজে নেমে পড়লাম।



কারাইকাল।১৩।

প্রজেক্টে হাত দিয়ে নতুন উৎসাহে মাঠে নেমে পড়লাম। ঘোরাঘুরির ব্যাপারে আমাদের দলটা একপায়ে খাড়া হলেও জমিয়ে আর মাতিয়ে রাখার ব্যাপারে ডাঃ দাস আর তন্ময় বসু ছিল শীর্ষে। তন্ময়ের আবার ছিল পরোপকারের নেশা। সবসময় খবর রাখত ছুটির দিনে কোথায় কোন পুকুরে মাছ ধরা হচ্ছে আর কোথায় আড়াই সেরি রুই-কাতলা-মিরগেল-শোল ধরে এনে বিক্রি করা হচ্ছে। তখনও সেল ফোন আসেনি বাজারে, তবে তন্ময় সব খোঁজ-খবর নিয়ে বাড়ি ফিরেই বাড়ি-বাড়ি ফোন করে সবাইকে জানাত। সিভিলের সাইট তৈরির কাজে ওকে খুব ঘুরতে হত, আমার জন্যে প্রতিদিনই কোন না কোন নতুন খবর থাকত ওর ঝুলিতে। আমরাও ছিলাম হুজুগে, খবর পেলেই জয় মুরুগান বলে বেরিয়ে পড়তাম গাড়ি নিয়ে।

একদিন খবর পেলাম আমাদের বাসা থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরেই আছে ভারতের একমাত্র জটায়ূ মন্দির। রাবণের সঙ্গে জটায়ূর যুদ্ধটা নাকি ওখানেই হয়েছিল। রামায়ণ-অনুসারে ওটা হয়েছিল দণ্ডকারণ্যের পূর্বপ্রান্তে, এখনকার ছত্তিসগড়ের কাছাকাছি। তবে ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি যে মহাভারতের আগের ঘটনাবলীর প্রায় প্রতিটার উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে একটা করে ঠিকানা আছে, কেউ কারো থেকে কম যায় না। শুধু অযোধ্যা, দণ্ডকবন, কিষ্কিন্ধ্যা, রামেশ্বরম আর লঙ্কা নিয়েই কোন মতদ্বৈধ নেই। যাক, তিরুমালাইরায়নপট্টনম গ্রামে সমুদ্রতীরে মন্দিরটা দেখে এলাম। মন্দিরগাত্রে পাথর কুটে আঁকা রাবণের সঙ্গে জটায়ুর যুদ্ধের দৃশ্যাবলি বেশ অভিনব, রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবি দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখেও কিন্তু বেখাপ্পা ঠেকল না।

এভাবেই একদিন দেখে এলাম কারাইকাল থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কালিয়াপ্পালানুর গ্রামের তিন চক্ষু ও দশহস্ত অঞ্জনেয়ার (অঞ্জনাপুত্র) হনুমানের মন্দির। দেখে এলাম থালায়ুর গ্রামের ভদ্রকালী মন্দির। এরপর একদিন প্ল্যান করলাম গাড়ি নিয়ে তাঞ্জোর ঘুরে আসার।

কাঞ্চীপুরম যদি শুধু মন্দিরের বৈচিত্র্য আর সংখ্যা দিয়ে অগ্রগণ্য হয়, তাঞ্জোরকে তাহলে তামিলনাডুর সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা যেতে পারে, শহর হিসেবে মাদুরাইকে এগিয়ে রেখেও। মারাঠা রাজা সর্ফোজি এ রাজ্য দখল করার ফলে এখানে দ্রাবিড়ের সঙ্গে মিলিত হয় মারাঠা সংস্কৃতি। এক হাজার বছর পুরনো চোলনৃপতি রাজারাজের তৈরি বৃহদীশ্বরর বা রাজরাজেশ্বরম শিবের মন্দিরকে ঘিরে প্রাচীন শহরটি গড়ে উঠেছিল। এই বৃহদীশ্বরের বিশেষত্ব এর অতুলনীয় দ্রাবিড় স্থাপত্য, আর নায়ক-রাজা নির্মিত এখানকার বিখ্যাত নন্দী- সম্ভবতঃ বিশ্বের বৃহত্তম মনোলিথিক নন্দী। পাণ্ড্য আর বিজয়নগর রাজত্বেরও বেশ কিছু নিদর্শন আছে এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

ওহো, আসল কথাটাই তো বলা হয় নি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কর্ণাটকি সংগীতকে উচ্চতম মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে ঋষিতুল্য মানুষটি, যাঁকে দাক্ষিণাত্যের তানসেন বা ভারতের বীঠোফেন বলা হয়, সেই ত্যাগরাজ স্বামীর জন্মভূমি কারাইকাল থেকে তাঞ্জোরের পথে তিরুভারুর (কারাইকাল ৪০, তাঞ্জোর ৬০ কিমি)। এই শহর দাক্ষিণাত্যের শৈব সম্প্রদায়ের বেদতুল্য 'তেবরম' অর্থাৎ শৈবগীতি সংকলন তিরুমুরাইয়ের প্রথম সাতটির রচয়িতা (এঁদের তামিলনাডুতে নয়নার বলা হয়) সন্ত তিরুজ্ঞানসম্বন্দম, তিরুনাভুক্কারাসু ও সুন্দরমূর্তির স্মৃতিবিজড়িত শিবের মন্দির যেখানে শিবলিঙ্গ ত্যাগরাজ স্বামী নামে প্রতিষ্ঠিত। তিরুজ্ঞানসম্বন্দমের জন্মস্থান কারাইকালের উত্তরে সিরকালি (Sirkazhi), তিরুনাভুক্কারাসু বা আপ্পারের জন্ম হয় ভিল্লুপুরম জেলার তিরুভামুর গ্রামে আর সুন্দরের জন্ম একই জেলার তিরুনাভালুরে। যখন আর্যাবর্ত মুখরিত বেদগানে তার কয়েকশ বছর পরে ত্যাগরাজ ও নটরাজ মন্দিরের আকাশ-বাতাস ভরে উঠত তিরুমুরাইয়ের তেবরমে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মরাঠারাজ সর্ফোজি এই স্তিমিত আবেগকে জিইয়ে তোলেন সন্ত ত্যাগরাজার গানের সুরে, সঙ্গে থাকেন মুথুস্বামি ও শ্যামশাস্ত্রী। তিরুভারুরের অদূরে নীডামঙ্গলমে জন্ম নেন কর্ণাটকি সঙ্গীতশাস্ত্রীত্রয়ী মীনাক্ষীসুন্দরম, সন্মুখভাডিভেল ও নীলকণ্ঠশাস্ত্রী। এই নীডামঙ্গলম থেকে একসময় ৪০ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গপথ যেত মরাঠা রাজমহল পর্যন্ত, এখন বিপজ্জনক বলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শৈবগীতি ও নয়নার সম্প্রদায় সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু অকারণে জ্ঞানদান এই রচনার উদ্দেশ্য নয় বলে আর এগোচ্ছি না। তবে তিরুভারুরের রথযাত্রার কথা না বললে রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ৯৬ ফুট উচ্চতার আর ৩০০ টন ওজনের এই রথ বোধহয় ভারতের অন্যতম প্রাচীন রথ। ফাল্গুন মাসে ২৫ দিন ধরে চলে রথযাত্রা আর অন্যান্য উৎসব, চলে আসছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। তামিলনাড়ুর শহরগুলোর মধ্যে কাঞ্চী আর তিরুভারুরে ধুলো-ময়লা একটু বেশি, তবু কারাইকালকে ঘিরে যে অঞ্চলগুলো দর্শন করা যায় তাদের মধ্যে তিরুভারুর বাদ দেওয়া চলে না।


কারাইকাল।১৪।

আবার ফিরে আসি কারাইকালে, একটু নজর দিই কারাইকালের পর্যটন-পরিকাঠামোর দিকে। বাংলায় কি শব্দগুলো কঠিন ঠেকছে, আচ্ছা, সহজ করে বলছি- tourism infrastructure। ভাল হোটেল বলতে দুটি- ভারদিয়ার রোডে প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল আর চার্চ স্ট্রীটে অবিরামি। তিরুনাল্লারে একটা ভাল হোটেল গড়ে উঠছে খবর পাচ্ছি। আর বাকিগুলোর- কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। সবচেয়ে বড় কথা, কারাইকালের রেলওয়ে স্টেশন সমেত লাইন সব আশি-একাশি সালের তুমুল ঝড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, ইস্ট কোস্ট রোডের অবস্থাও তথৈবচ। আগে সেগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। দোকানী, ট্র্যাফিক পুলিশ, মন্দিরের পুরোহিত, সবাইকে হিন্দি আর ইংরেজি শিখতে হবে। রাস্তার কাজ অবশ্য শুরু হয়ে গেছিল, তবে রেলওয়ে তখনও দূর-অস্ত। একটাই ভরসা, লোকজন ধর্মভীরু আর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় যথেষ্ট সৎ। শুধু নেই তাদের ব্যবসা-বুদ্ধি। টাকা থাকলেও, কৃপণ, জমায় শুধু মেয়ের বিয়ের পণের জন্যে, খরচ করে সোনা আর তীর্থযাত্রায়। বাইরের লোকজন আসুক তাতে প্রবল আপত্তি, সংস্কৃতি-দূষণের ভয়। তবে অতিথিবৎসলতা আছে। এতদিন কারাইকালের চারপাশটাই ঘুরে বেড়িয়েছি, এবার একটু শহরের দিকে নজর দেবার কথা ভাবলাম।

শহরের আকর্ষণ বলতে আলোকস্তম্ভ শোভিত এখানকার অদ্ভুত সুন্দর সমুদ্রবেলা, যার বর্ণনা আগেই দিয়েছি, আর আরসালার (বাংলায় যার অর্থ রাজকীয়) নদীর ধারে বীচ রোড। এছাড়া আর তেমন কিছু নেই, কয়েকটা মন্দির আর গীর্জা ছাড়া। এখানকার বিখ্যাত মন্দিরগুলো হল কারাইকাল আম্মাইয়ার কোইল আর কৈলাশনাথার কোইল। আম্মাইয়ার মন্দির বিখ্যাত এর সঙ্গে জড়িত মাঙ্গানি উৎসবের জন্যে, যার ইতিহাসও বেশ সুন্দর। কৈলাশনাথের মন্দির প্রায় হাজার দুই বছরের পুরনো শিবের মন্দির, অষ্টম শতাব্দীতে পহ্লব-রাজত্বে এটি পুণর্নির্মিত হয়। এখানকার চারটি গোপুরম দর্শনীয়, সেই সঙ্গে রথের মেলা।
 
চোল সাম্রাজ্যের কালে কারাইকাল বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। এই অঞ্চলের এক বৈশ্য পরিবারে জন্ম হয় পুনীতাবতীর, যাঁর বিয়ে হয় বণিক পরমদত্তের সঙ্গে। পুনীতাবতী বড় শিবের ভক্ত ছিলেন, কৈলাশনাথের নিত্য পুজারিনী ছিলেন। একদিন পরমদত্ত এক শৈবের দেওয়া দুটি আম বাড়ি পাঠান। সেইসময় এক ক্ষুধার্ত শৈব সন্ন্যাসী এসে পড়ায় বাড়িতে অন্য আহার্য না থাকায় পুনীতাবতী একটি আম তাঁকে খেতে দেন। পরে তাঁর স্বামী এসে আম দুটি খেতে চাওয়ায় তিনি শিবের কাছে প্রার্থনা করে আরেকটি আম পান। এই আমটা ছিল খুবই মিষ্টি। কেন তা জানতে চাইলে তিনি বণিককে সব খুলে বলেন ও সেভাবেই আরেকটি আম এনে দেখান। পরমদত্ত চমৎকৃত হয়ে বুঝলেন যে এই পুনীতাবতী নারী নন দেবী। তিনি অনুতাপে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। পুনীতাবতী শিবের কাছে বর চান অসৌন্দর্যের, দেহ তাঁর কালিরূপ ধারণ করে। আমাকে প্রো: চোলান বলেন তামিল শৈব পুরাণ-মতে শিবের বরে আম্মার পা দুটি কালো হয়ে যাওয়াতে তাঁর নাম হয় কারাইকাল আম্মা (তামিল কারিয়= কালো, কাল= পা), অবশ্য আমি অন্যত্র কোথাও এই ব্যাখ্যা পাই নি। তাঁর মৃত্যুর পরে অঞ্চলের লোকেরা কৈলাশনাথ শিবের মন্দিরের উল্টোদিকে কারাইকাল আম্মাইয়ার নামে পুনীতাবতীর মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করে ও শৈব ভক্তের আম-ভিক্ষার ঘটনার স্মরণে জৈষ্ঠ মাসে মাঙ্গানি বা আম-উৎসব পালন করে (কোইল=মন্দির, মাঙ্গায়= আম)। এই কারাইকাল আম্মা ছিলেন দক্ষিণ ভারতের শৈব-স্তোত্রাবলী রচয়িতা বিখ্যাত ৬৩জন নয়নমারের মধ্যে একজন।

এখনও পর্যন্ত যাঁরা ভাবছেন আমি এত পুরাণ, ঈশ্বর-ইত্যাদির গল্প ফাঁদছি কেন। না ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিতে নয়, মানুষের যে দেবতায় উত্তরণ ঘটে, বিশেষত: দক্ষিণ ভারতে, তারই একটা উদাহরণ দিলাম।

   

No comments:

Post a Comment