Thursday, January 17, 2019

Long Story-চাঁদ উঠেছিল সিন্ধুপারে।

#চাঁদ_উঠেছিল_সিন্ধুপারে।
(বড় গল্প)


(১)
কাল- খৃষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৪৫০০র মধ্যে কোনও এক সময়।
স্থান- সিন্ধুপারের মেহ্‌রগড়, পূর্ব বালুচিস্তান।
নিয়েন্ডারথাল পার হয়ে মেসোলিথিকের পর নিওলিথিক যুগেরও অবসান ঘটতে চলেছে।মানুষ এখন দু-পায়ে চলে, আগের মত লোমশ নেই, গুহা ছেড়ে সমতল জমিতে কোনও নদী বা জলাশয়ের তীরাঞ্চলে পাতার, বাঁশের বা মাটির কুটির বেঁধে থাকতে শিখেছে। ক্রমে দুর্লভ হতে থাকা বন্যজন্তু শিকারের উপর নির্ভর না করে তারা এখন জমি চাষ করে, ফসল ফলায়, পশুপালন করে, রান্না খাবার খায়, এমন কি গুহা, পর্বতগাত্রে বা ঘরের দেয়ালে রঙিন ছবিও আঁকে। এই কয়েকশ’ বছর আগে পর্যন্ত তারা নিম্নাঙ্গে একটুকরো চামড়া বা বাকল ঝুলিয়ে রাখত, এখন পশুলোম আর পাটের সুতো দিয়ে বোনা কাপড় পরছে অনেকে, মেয়েরা ঘরের বাইরে গেলে ঊর্ধাঙ্গও ঢেকে রাখে। গরু, ভেড়া, উট আর মহিষ নামে একপ্রকার হিংস্র প্রাণীও আজ পোষ মেনেছে এই মেহেরগড়বাসী মানুষের কাছে। মহিষ আর জলহস্তী ঠিক জলচর না হলেও তারা সারাদিন জলে শুয়ে থাকতেই ভালবাসত। যেদিন জানা গেল যে মহিষের দুধ স্বাদিষ্ট ও বেশ খাওয়া চলে, মানুষ তাদেরকে ছলে-বলে-কৌশলে পোষ মানাল। ইদানীং আবার মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য ও তাইগ্রিস উপকূলের যাযাবরেরা একধরণের দাড়িওলা জন্তু নিয়ে আসছে, এরাও বেশ দুধ দেয় আর প্রয়োজনে কেটে ঝলসে খাওয়াও চলে- ওরা এদের বলে বকর্‌-বকরী। যাই হোক, এই মেহ্‌রগড়ের নব-প্রস্তরযুগের মানুষরা কি পারত আর কি পারত না তার বিবরণ এখন বরং থাক, কারণ, সভ্যতার এই ক্রম উত্তর সিরিয়ার তেল কারামেল অঞ্চলের মানুষ প্রায় হাজার দু’এক বছর আগেই পেরিয়ে এসেছে, যদিও আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে তাদের কারো নামই নেই।
এই সময়েই সিন্ধুনদের এক অববাহিকা বোলান নদীর তীরে উফ্‌রা নামক একটি গ্রামে আমাদের এই গল্পের সূচনা হয়। গ্রামের মোড়ল, সেই সঙ্গে মৃৎশিল্পী ও কুম্ভকার মটকু চাকে বসিয়ে নিখুঁত নৈপুণ্যের সাথে গড়ে চলেছে একের পর এক কলসী, আর সেগুলো শুকোনোর পর তার স্ত্রী গুন্ঠা পাথর আর খড়ের আস্তরণ সাজিয়ে জ্বাল দেবার জন্যে তৈরী করছে। সব হয়ে গেলে তাদের মেয়ে হীর সেগুলোকে ভাল করে বেঁধে সাজিয়ে তুলে দেবে উটের পিঠ থেকে দুপাশে ঝোলা থলিগুলোতে আর তারপর হীরের ভাই তন্দু ওগুলো গঞ্জের হাটে বিক্রি করে তার বদলে নিয়ে আসবে বাজরা, যব, নুন আর জ্বালানী কাঠ। সব কাজ সুষ্ঠুভাবে এগোচ্ছে, এমন সময় ঘরের বাইরের প্রশস্ত উঠোনে এসে দাঁড়াল একটি পরিচিত চেহারা, সুগঠিত চেহারার স্বাস্থ্যবান যুবক, নাম হুম্‌ড়া। আজ তার মুখে কেমন একটা অজানা ভয়ের ছাপ। এসেই তন্দুকে ধরল- ‘তন্দু রে, তোর ধনুক আর তামার তীরগুলো নিয়ে এখনি চল আমার সাথে। কি একটা অদ্ভুত জন্তু এসেছে রে, মুখ দিয়ে লা(আগুন) বেরোচ্ছে।‘
এই তামা জিনিষটা সদ্য এসেছে এখানে। রেকো ডিক বা যাদুপাহাড়ের পথে লালডুংরির ধার দিয়ে যেতে কালচে লালপাথর ছড়িয়ে আছে পথের দু-ধারে। একদিন এরকম কিছু পাথর দিয়ে গুণ্ঠা ভাটি সাজিয়েছে, আগুন লাগাবার ঘণ্টাখানেক পরে দেখে সব কিছু ভেঙ্গেচুরে একাকার, মেটে লালচে রঙের কি যেন গলে গলে পড়ছে। মটকু দেখেই কি একটা সন্দেহ করে ওগুলো নিয়ে পড়ল। দেখা গেল পাথরের কিছুটা অংশ গলে পড়ার পর আবার জমাট বেঁধে যাচ্ছে বটে, কিন্তু গরম অবস্থায় তাকে পিটিয়ে ছুঁচলো বা ধারালো করে অস্ত্র-শস্ত্র, রান্নার বাসন, এমনকি মেয়েদের গয়নাও বানান যাচ্ছে আর তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাথর বা হাড়ের তৈরী জিনিষের থেকেও শক্ত। এখনও বর্ণাশ্রম বা জাতিভেদ শুরু হয়নি, তাই হাঁড়ি-কলসির সাথে সাথে মটকু তামার কাজেও লেগে পড়ল আর ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে উঠল। ফলে তন্দুর ব্যবহার করা তামার ফলাওয়ালা অস্ত্রশস্ত্র গ্রামের সবার কাছে ঈর্ষণীয় হয়ে উঠল। তবে মটকু পোড় খাওয়া মানুষ। সে বলল- ‘কি হয়েছে খুলে বলনারে ব্যাটা, জন্তুটা কামড়েছে কাউকে? খামখা মারবি ক্যানো?’
-আজ্ঞে না, তবে ছুটে বেড়াচ্ছিল এধার থেকে ওধার। আর সত্যি বলছি কত্তা, চিতা ছাড়া এত জোরে ছুটতে কোনও জন্তুকে দেখিনি কখনও- হুমড়া বলে। তারপর তন্দু আর তার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনায়। হীর উদবেগের মধ্যে ছিল, নিঃশব্দে পিছু নেয় তাদের।
গ্রামের একপ্রান্তে জঙ্গল একটু ঘন হতেই দেখা গেল জন্তুটাকে দূর থেকে। নাচের ছন্দে টপাটপ আওয়াজ করে ছুটে আসছে, মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে তার ছোটার তালে তালে। মুখ দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে, যদিও এত দূর থেকে তার শিখা দেখা যাচ্ছে না, তবে ধোঁয়ার মত লাগছে। তন্দু মারার জন্যে ধনুকে তীর জুড়ল। হঠাৎ কোথা থেকে হীর ছুটে এসে তন্দুকে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ায় তার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তন্দু আর হুমড়া দুজনেই হীরের এই ব্যবহারে রেগে উঠল। তখন হীর তাদেরকে জন্তুটির দিকে ইশারা করে দেখাল।
দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে জন্তুটার পিঠে বসে আছে এক সুদর্শন যুবক। গায়ের রঙ তাদের থেকে অনেকটা ফর্সা, কিন্তু রোদে পুড়ে তাম্রবর্ণ ধারণ করেছে। মাথায় একটা তামার শিরস্ত্রাণ, কোমরের পেটিকায় গোঁজা একটি পাথরের তৈরী ছুরিকা। তিনজন স্থানীয় মানুষকে দেখে যুবকটি তার বাহন থেকে নেমে এল, যদিও তার মুখে-চোখে কোনও ভয়ের চিহ্ন ছিল না। যুবকের বেশভূষা, ভাষা ও আচার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে যে সে বিদেশী।

‘কে তুমি, আগন্তুক?’ প্রশ্ন করল তন্দু। উত্তরে বিদেশী জানাল যে সে এসেছে সুদূর ক্রিমিয়া অঞ্চল থেকে, নাম তার কার্লোভ। কৃষ্ণ সাগর উপকূল থেকে ককেশাস পর্বতমালা হয়ে এস্তোনিয়া পর্যন্ত সুবৃহত জনপদ একসময় এসিয়া মাইনর, আর্মেনিয়া ও মেসোপটেমিয়ার উন্নত সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড শীতে মানুষজন ককেশাস থেকে পালাতে শুরু করে ও গ্রীস, মিশর ও পারস্যে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুতগামী এই জন্তুটির নাম অশ্ব বা ঘোড়া, সম্প্রতি তারা একে পোষ মানাতে পেরেছে, এখন ইচ্ছেমত চালনা করতে পারে।

‘তোমার এত দূর ভ্রমণ করার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই কোনও শখ চরিতার্থ করতে নয়, তাছাড়া এই অদ্ভুত জন্তুতে চড়ে তুমি একা দুর্গম পার্বত্য পথ পার হয়ে এলেই বা কি করে?’ হীর প্রশ্ন করে, ‘তোমার দেখে তো যাযাবর শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হয় না।‘

'না, আমি একা নই, সাথে দিমিত্রি নামে আমার এক বন্ধু আছে। আমরা আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলি, কিন্তু কিছুদিন এখানে থেকে তোমাদের ভাষা শিখে নিয়েছি। কি নাম এই ভাষার?'
'ভাষার আবার নাম কি? এ তো প্রাকৃতিক ভাষা যা দিয়ে আমরা মনের ভাব আদান-প্রদান করি। এ ছাড়া অন্য কোনও ভাষার কথা আমাদের জানা নেই- হুমড়া জানায়।'
'বেশ, তাহলে আমরা একে প্রাকৃত ভাষা বলব। তোমাদের এই দেশ আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। রোদের তেজ বেশী নয়, আবার দিনরাত্রি তুষারপাতও হয়না। নদী দিয়ে মিষ্টি জল প্রবাহিত হয়। তোমরা দেখছি বন্য গাছপালার উপর নির্ভর না করে শষ্য উৎপাদন করতেও শিখেছ। আমরা ক্রিমিয়া, মালদোভিয়া, গ্রুশিয়া সর্বত্র চেষ্টা করেও বছরে মাত্র তিনমাসের উপযোগী বাজরা ফলাতে পেরেছি, অবশ্য অত্যধিক ঠাণ্ডাই তার কারণ।'
'তা তোমরা কি আমাদের দেশ দখল করতে এসেছ? সেটা এত সহজে হবে না!' হুমড়ার গলার স্বর রীতিমত আক্রমণাত্মক।
'এতটা দুঃসাহসী নই আমরা'- কার্লোভ হাসল। 'আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিছক বন্ধুত্ব স্থাপন।'

'আসল উদ্দেশ্যটা বল নি বুঝি?' অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে কার্লোভ বাদে তিনজনই চমকে ঘাড় ফেরাল, তখনই দেখতে পেল অন্য এক যুবককে। অনুমানে বোঝা গেল এই সেই দিমিত্রি, কার্লোভের বন্ধু ও সহচর।
'ধীরে, বন্ধু ধীরে। আজই সব শোনাতে হবে? আমাদের যে সকাল থেকে আজ কিছু খাওয়া হয়নি। শিকার পেয়েছ কি কিছু?'

হীর এতক্ষণ অবাক হয়ে সবার কথা শুনছিল। সে একেই অল্পভাষিণী, তায় দুজন বিদেশী- যা সচরাচর এখানে দেখা যায় না, দেখে ও তাদের কথা শুনে হতচকিত। তবু সে সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল, ‘আগন্তুক বন্ধুরা আর হুমড়া যদি আজ আমাদের বাসায় দিনের খাওয়া সারেন তো আমার মা-বাবা দুজনেই খুব খুশী হবেন।‘ এর পরে আর কথা চলে না, সবাই একত্রে রওনা হল মটকুর বাসার উদ্দেশে।



(২)
মটকু কিন্তু পোড় খাওয়া মানুষ, মহাসমাদরে অতিথিদের ঘরে ডেকে খাতির করে বসালেও তাদের এই দেশভ্রমণের কাহিনীকে এত সহজেও নিল না। সে গল্প শুনেছে কিভাবে তাদের পূর্বপুরুষেরা পাহাড়-জঙ্গল ছেড়ে সমতলের দিকে এসে বসত করতে শুরু করে একসময়, সিন্ধু আর বোলান নদীর উর্বর পলিমাটি দিয়ে গড়া এই মেহ্‌রগড়ে এসে তাদের খোঁজ সম্পন্ন হয়, এখানে দু-তিন হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতার বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকে এই আদি মানবেরা। তারা এখানে এসে শিকার ছেড়ে পশুপালন শুরু করেছে, গুহা ছেড়ে কাঁচা মাটির ইঁট দিয়ে তৈরী বাড়িতে থাকা শুরু করেছে, আজ প্রায় পাঁচশো বছর হল সে ইঁট তারা চুল্লী তৈরি করে পুড়িয়ে নেয় আর সেই পোড়ামাটি দিয়ে ইঁট ছাড়াও কলসী, থালা, বাসন, খেলনা আর নানা ধরণের অলঙ্কার বানাতে শিখেছে। বোলানের তীরে এই বাড়িতেই মটকুদের কত পুরুষ থাকা হয়ে গেল, তার উঠোনের এক প্রান্তে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা সারি সারি কবরের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। তাই আগন্তুকদের পরিচয় সম্যকভাবে পাওয়ার পরেই সে আশ্বস্ত হল।
মটকু আর গুন্ঠা একটা দুই টুকরো কাঠের তৈরী বিশালকায় যন্ত্র নিয়ে তাদের উঠোনে ঢুকেছিল। আগন্তুক দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল যন্ত্রটিকে। দিমিত্রি শেষে থাকতে না পেরে জিগ্যেস করে বসল যন্ত্রটির সম্বন্ধে। তন্দু হেসে বলল, ‘ভালই হল, আমরা যেমন ঘোড়া দেখিনি, তোমরাও তেমনি হল দেখনি।‘

'হল? অবাক হল কার্লোভ। তার মানে চাষের যন্ত্র? কি অদ্ভুত! এর অগ্রভাগ দিয়ে নিশ্চয়ই মাটি খোঁড়া হয়। আমরা কাঠের লাঠির অগ্রভাগে শানিত পাথর জুড়ে এই কাজ করি। তবে সে তো অনেক ছোট, একটা মানুষ তা দিয়ে আঘাত করে মাটি খুঁড়তে পারে।'
'সেটা আমরাও করে থাকি', মটকু বলে, তাকে আমরা কোদাল বলি, গাঁইতিও আছে। পাথরে থাকে তীক্ষ্ণতা, আর কাঠ হাল্কা বলে একসাথে অনেকটা ক্ষেত কর্ষণ করতে পারে। তবে হল চালানোর কাজটা একা করা খুব কঠিন তাই আমি একদিক ধরে টেনে নিয়ে যাই আর গুণ্ঠা বা তন্দু অন্য প্রান্তে ধাক্কা কিংবা প্রয়োজনে চাপ দিয়ে আমাকে সাহায্য করে। মাটি ভেজা থাকলে যন্ত্র কিছুটা গভীরে যায়।'
'আমার কি মনে হয় খুড়ো, হুমড়া বলে, হলের আগার দিকটা যদি পাথর বসানো যায়, সেটা আরো গভীরে যেত।'
'উঁহু, সে চেষ্টা কি করিনি। পাথর দিয়ে আঘাত করা যায়, তবে কর্ষণ হয় না। আমি বরং তামা দিয়ে হলাগ্র মুড়ে দেখেছি কিন্তু তামা খুব সহজে বেঁকে যায় বলে সেটাও সফল হয় নি। আহা, যদি এর চেয়ে কঠিন কোনও ধাতু পেতাম!'

এই সময় একজন প্রতিবেশী সেখানে এলেন। তাঁর নাম ভিষম, চুলের স্বল্পতা দেখেই বোঝা যায় যে বয়সে তিনি বেশ প্রবীণ, কথায় বোঝা যায় তিনি জ্ঞানবৃদ্ধও বটে। তাঁর হাতে একটি পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি গোলাকার বস্তু যার নলাকৃতি উপরিভাগে কিছু আধপোড়া পাতা। বস্তুটি আর কিছু নয় তামাক-পাতা পুড়িয়ে ধূমপান করার হুঁকা বিশেষ, জিনিষটি মটকুরই উদ্ভাবন। তাঁর বাসায় আগুন নেই, আগুনের খোঁজে এসে দেখেন বেশ জ্ঞান-গম্ভীর কথাবার্তা চলছে, সাথে আবার দুই ভিনদেশী আগন্তুক। ভিষম পণ্ডিত মানুষ, আলকেম-শাস্ত্রে তাঁর পারদর্শিতা এলাকার লোক জানে। তিনি সম্প্রতি তামা আর দস্তাকে একসাথে গলিয়ে এক মিশ্র-ধাতু তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা দিয়ে অভঙ্গুর বাসন-পত্র তৈরী করা যায়। তবে তিনি চতুর লোক, তাই বিদেশীদের কাছে আর এ নিয়ে আলোচনা করলেন না। এঁর পরিচয় দিয়ে রাখলাম, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আগুন নিয়ে ভিষম বেরিয়ে গেলেন। গুণ্ঠা আর হীর ইতিমধ্যে মাটি আর তামার পাত্রে বেশ কিছু খাবার দাবার এনে রেখেছে। যবকে মাটির খোলায় ভেজে গুঁড়ো করা ছাতু, সেদ্ধ বাজরা, জ্বাল দেওয়া মোষের দুধ আর কচি ষাঁড়ের ঝলসানো সূল্বপক্ক মাংস- এই ছিল সেদিনের খাবার, প্রত্যেকে বেশ তৃপ্তি করে খেল। ষাঁড় খুব দুর্বিনীত প্রাণী, আর একটু বয়স হয়ে গেলে তার মাংস আহারের উপযোগী থাকে না। তাই কিছু ষাঁড়কে প্রজননের জন্যে রেখে দিয়ে বাকীদের কম বয়েসেই জবাই করার রীতি ছিল তাদের সমাজে। এই নিয়ে সমাজের শীর্ষস্থানীয় মানুষদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ছিল প্রচুর। গোমাংস সুস্বাদু, অথচ গাভী দুধ দেয় আর বংশবৃদ্ধি করে- তাই স্ত্রী-গোজাতি নিধন আর খাবার ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। আর ষণ্ডমাংস একসময়ের পর খাবার উপযোগী স্বাদিষ্ট থাকে না। এ ব্যাপারে কিছু আদিম শ্রেণীর যাযাবরদের উটের উপর করা সাধারণ অস্ত্রোপচার থেকে তারা শিক্ষা নিয়ে ঋষভজাতি কে পুরুষত্বহীন করতে সমর্থ হয়েছিল  চমৎকৃত হয়ে মানুষ দেখল এতে তিনটে ফল হচ্ছে। পুরুষ গো-জাতির অল্পবয়সে হত্যা বন্ধ হল, দেখা গেল নপুংসক বলদের মাংস অধিকতর সুস্বাদু আর এই অস্ত্রের পর বলীবর্দ অল্পেই পোষ মানে আর তাই গাড়ি টানার মত কাজে তাদের লাগান সহজ হল। তবে এই গো-যানের চাকা নিয়েও তাদের চিন্তা কম ছিল না। কাঠের তৈরি চাকা বড় ভঙ্গুর, বোঝা নেয় না, সহজেই ভেঙে যায়, গ্রামের সর্দার মটকু মাঝে মাঝে ভাবতে বসে এ নিয়ে।




(৩)
এভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ছয় মাস। কার্লোভ আর দিমিত্রি এই গ্রামেই আছে। হয়ত থাকত না, হয়ত অন্য কারণ ছিল। তাদের বন্ধুত্ব হুমড়া বা তন্দুর সাথে ততটা গভীর হয়নি। ওরা ঘোড়ার রহস্য বুঝতে এসেছিল, ওদের কয়েকটা ভুল ভেঙেছে এ বিষয়ে। প্রথমতঃ ঘোড়ার মুখ দিয়ে আগুন বেরোয় না, ছোটার সময় খুব জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ায় নাক-মুখ থেকে জলকণা বাষ্পের আকারে বেরোতে থাকে, যাকে ওরা দূর থেকে আগুনের ধোঁয়া ভেবেছিল। এছাড়া ঘোড়া খুব শান্ত প্রাণী, তবে শুরুতে তাকে পোষ মানানো বা কবজা করা সত্যিই শক্ত। তবে হীর ছাড়ে নি। সে কার্লোভের পেছনে লেগে থেকে ঘোড়ায় চড়া বা তাকে ইচ্ছেমত ছোটানো, দুইই শিখে নিয়েছে। এখন বোলান নদীর তীরে বা লালডুংরি পাহাড়ের পথে মাঝে মাঝে ওদের দুজনকে দেখতে পায় গ্রামের লোকে, ঘোড়ায় চেপে ঢিমে-চালে এগিয়ে চলেছে, সেদিনের সেই স্বল্পভাষী হীরের মুখে তখন কথার ফুলঝুরি। সেই সময় দিমিত্রি হয়ত গুহার বাইরে গড়িয়ে নেয় বা কালকের শিকার করা বুনো খরগোশ ঝলসানোয় ব্যস্ত থাকে। আর ওদের দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছেটা ক্রমেই কমতে থাকে।
এত কথার ও ব্যস্ততার মাঝেও কিন্তু মটকু এই দুই বিদেশীদের আসার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে তাদের উপর নজর রাখতে ভোলে নি। তবে যেদিন দিমিত্রি বলল যে খুড়ো, তুমিই পারবে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে, সে বড়ই আশ্চর্য হল। জানা গেল যে তাদের দেশের লোকেরা ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছে, দ্রুতগামী যান হিসেবে তাদেরকে ব্যবহার করতে শিখেছে। কিন্তু তাদের দেশের ভেজা আবহাওয়ায় ঘোড়ারা মাঝে মাঝেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে, আর তার পরে বেশিদিন বাঁচে না। এই রহস্যের সমাধান সেখানে কেউ এখনও করতে পারেনি, তাই তাদের একটা দল ককেশাস আর আর্মেনিয়া ছেড়ে আনাতোলিয়ার দক্ষিণে মেসোপটেমিয়ার প্রায় প্রান্তে আসিরিয়া ছাড়িয়ে নেমে এসেছে, দিয়াবাকির আর গাজিয়ানটেপের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। শুকনো আবহাওয়ায় কিছুটা উন্নতি হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তাদের আশা, এই মেহরগড়ের উন্নত সভ্য মানুষেরা এর হয়ত একটা কিনারা করতে পারবে। কিন্তু এখানে এসে তারা আর একটিও ঘোড়া না দেখে হতাশ হয় ও ঘটনাটা খুলে কাউকে বলবে কিনা বুঝতে পারে না।

মটকু ব্যস্ত মানুষ হলেও ইদানীং সে যেন বড় ভাবুক হয়ে পড়েছিল। সেই একঘেয়ে জীবন, সকাল থেকে একটানা বাঁধা গতে জীবনের সাথে সঙ্গত করে চলা, যেন বেঁচে থাকার আর রসদ খুঁজে পাচ্ছিল না সে। মানুষটা সাদা-সিধে পরিশ্রমী সৎ কর্মনিষ্ঠ শ্রেণীর হলেও তার একটা আলাদা জীবনদর্শন ছিল। জানি সে যুগের নিরিখে এটা একটু অস্বাভাবিক লাগবে শুনতে, কারণ তখনও বনমানুষ থেকে হোমো-ইরেকটাসে পদার্পণের স্মৃতি খুব বেশী পুরনো হয় নি মানুষের মনে- দৈহিক প্রয়োজন অর্থে ক্ষুধা আর কামের অতিরিক্ত আর কোনও কিছু ভাবার সময় তেমন আসেনি। অপত্য-স্নেহ, মায়া-মমতা, কর্তব্যবোধ আর ষড়-রিপু এগুলি প্রবৃত্তি বা ইন্স্টিঙ্কট রূপে চিরকালই প্রচ্ছন্ন ছিল, সম্প্রতি কিছু নতুন চেতনা তার সাথে মনে হয় সদ্য জন্ম নিয়েছে। তার একটা হচ্ছে বিশ্বের যাবতীয় রহস্যের সম্বন্ধে জানার, সেগুলো সমাধানের ইচ্ছা, দ্বিতীয়টি চিত্রাঙ্কন বা সুর-তাল- সব মিলিয়ে একটা সৌন্দর্যের বোধ। আর একটা- না, এখন থাক, সম্যকভাবে না জেনে কিছু বলা উচিৎ নয়। তাই রাত্রে শুয়ে ঘোড়াদের সমস্যার কথা ভাবতে ভাবতে তার হঠাৎ ভিষমের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক করল সে কালই এ ব্যাপারে ভিষমের সাথে কথা বলবে।
পরদিন কিছু মৃৎপাত্র গড়ে তাদের ভাটিতে সাজিয়ে একটা হুঁকো ধরিয়ে মটকু ভিষমের বাসায় এল। ভিষমের স্ত্রী গত হয়েছে বেশ কয়েকবছর হল। যদিও সে দেশে তখন সঙ্গিনী পাওয়া কোনও সমস্যা ছিল না, বিবাহ নামক সামাজিক রীতিটিও গড়ে ওঠেনি, তবু কেন জানিনা, ভিষম তার গবেষণার অতিরিক্ত আর কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় নি। মটকু যখন আসে সে তখন একটা চুল্লীতে কয়েকটি ছোট পাথরের ঢেলা গরম করে গলাতে ব্যস্ত। মটকুকে ইশারায় বসতে বলে ঢেলাগুলো গলে যাবার মুখে তাদেরকে একটা পাথরের পাত্রে মেশাল ভাল করে। তারপর মেঝেতে তৈরি করা বালির ছাঁচে তাদের ঢালল। ছোট কাঠের নল দিয়ে কিছুক্ষণ বাষ্প বেরোনোর পর ছাঁচটি ভেঙে কালো রঙের গোলাকৃতি বস্তুটি বের করে আনল। কিছুক্ষণ ঘষামাজার পর একটি ঈষৎ পীতাভ লাল বস্তু চকচক করতে লাগল ও একটি গোল বাটির আকার নিল। মটকু সমঝদার লোক, সে বুঝতে পেরে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

- সম্ভবতঃ এই হল বিশ্বের প্রথম পিতলের বাটি, বেশ তৃপ্তির সুরে ভিষম বলল।
- হ্যাঁ হে, তামার মতই লাগছে বটে, তা আর কি মিশিয়েছ?
- কিছুটা সাদা ধাতু, আমি নাম দিয়েছি দস্তা। এখন এ নিয়ে আরো মাস ছয়েকের কাজ বাকি, তারপর আর তোমাদের বাসনের সমস্যা থাকবে না, বুঝলে?
এই সব কথা হচ্ছে, এমন সময় কার্লোভ আর হীর হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল। ‘খুড়ো, যা ভয় করছিলাম, দিমিত্রির ঘোড়া খুব ছটফট করছে সকাল থেকে, এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। ঘোড়া মরে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে খুড়ো, ওর আর দেশে ফেরাই হবে না হয়ত।‘



(৪)
এখানে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যের আলোচনা করে নেওয়া যাক, যা জানা থাকলে পাঠকের গল্পের পরিসর আর পৃষ্ঠভূমি বুঝতে সুবিধা হবে আর আমারও এগিয়ে গিয়ে প্রতিপদে পেছোতে হবে না। পৃথিবীতে দুই থেকে আড়াই গজ লম্বা ইয়োহিপ্পাস নামে ঘোড়ার পূর্বপুরুষের আবির্ভাব হয় ইয়সিন যুগে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে। আমাদের গল্পের সময়ে উরাল পর্বতমালার পশ্চিম থেকে ইউরেশিয়ার স্তেপ অঞ্চল (পশ্চিম কাজাখস্তান) থেকে অধুনা ডাগেস্তান ছাড়িয়ে ককেশাস পর্বতশ্রেণীর মধ্যবর্তী ক্যাস্পিয়ান সাগরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল আর উত্তর গ্রুশিয়ার (জর্জিয়া) মূল বাসিন্দারা প্রায় পাঁচশ' বছর আগেই ঘোড়া নামক জন্তুটাকে পোষ মানিয়ে ফেলেছে। তারা ঘোড়ায় চড়া, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে সঠিকভাবে চালানো, তার পরিচর্যা, অঙ্গসজ্জা, চিকিৎসা এই সবই মোটামুটি আয়ত্ত করেছে।
ঘোড়াকে পোষ মানানোর আগে পর্যন্ত যেকোনো জাতির বিচরণের ক্ষেত্র খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষিকাজে যতই উন্নতি হোক না কেন, আর তার মাধ্যমে সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটুক না কেন, মানুষ কোনো লম্বা পথ অতিক্রমের সাহস দেখানো তো দূরে থাক, এমনকি স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেত। কেননা মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে কতদূরেই বা যাওয়া সম্ভব! কিন্তু যখন মানুষ ঘোড়ার সাথে সখ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো, তখন থেকেই মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সীমা ছাড়িয়ে গেল। ঘোড়ার গতি আর শক্তির উপর ভর করে মানুষ দূরকে জয়ের পথে পা বাড়াল, বদলে গেল মানুষের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও। দূরত্ব জয় তো ছিলই, এর পাশাপাশি কৃষিকাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ব্যবসা, ক্রীড়াক্ষেত্র সবখানেই ঘোড়া হয়ে উঠল মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু ও সহচর।
তবু কয়েকটা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ইউরেশিয়ায় থাকার সময় বরফের উপর ঘোড়ার চলার যে অসুবিধা তা বোঝা যায়। পিচ্ছিল বরফ থেকে রক্ষা পেতে ওরা ঘোড়ার খুর মুড়ে দেয় চামড়ার মোজায়, কিন্তু তা হয় ক্ষণস্থায়ী। তামার প্রচলন হতে তামার তৈরি আবরণ দিয়ে চেষ্টা করে, কিন্তু তাও অত্যধিক নমনীয় হওয়ায় চ্যাপ্টা হয়ে ফুটোর সৃষ্টি করত বা খুলে বেরিয়ে যেত। নগ্ন ক্ষুরের উপর চলা নরম মাটিতে অসুবিধা না ঘটালেও পাথুরে জমিতে বেশি ছোটাছুটি করলে ক্ষুরগুলি ক্ষয়ে যেত, পায়ে ঘা হত প্রায়ই। তবে সেধরণের কোন ঘা না হলেও হঠাৎ করে ঘোড়া কেমন নেতিয়ে পড়ত, প্রায়ই মারা যেত সেই রোগে। জলা জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার পর এই সমস্যা খানিকটা কমলেও এই রোগের মূল কারণ আর তার চিকিৎসার কোন উপায় খুঁজে পায়নি আর্মেনিয়রা। তাই কিছুটা উন্নততর ওষুধ, খাদ্যশষ্য আর জীবনযাত্রার সুষ্ঠু পরিবেশ খুঁজতে বিভিন্ন প্রান্তে বেরিয়ে পড়েছিল একদল নব্য প্রস্তরযুগের মানুষ- এই খুঁজে বেড়ানোর দলটাকে প্রাণীতত্বের ভাষায় forager বলা হয়। ঘটনাক্রমে আমাদের গল্পের দুজন অশ্বারোহী তৎকালীন ইউফ্রেটাস আর টাইগ্রিস নদী পার হয়ে মেসোপটেমিয়া, সুমের, পারস্য-গান্ধার ছাড়িয়ে হিন্দুকুশ পর্বতমালার দক্ষিণ প্রান্তে উপস্থিত হয়। তাদের মনে হয়েছিল এই বুঝি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত, তখনই একদল যাযাবরকে পাহাড়ি পথে এগোতে দেখে দূর থেকে তাদের অনুসরণ করে পাহাড়ের শীর্ষ মালভূমি যার আধুনিক নাম কুয়েটাতে (Quetta) এসে পৌঁছোয়। তখনই ওদের চোখে পড়ে বোলান নদীর ধার ঘেঁসে গিরিপথ চলে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। কয়েকঘণ্টা সেই পথ ধরে এসে পৌঁছয় সমতলভূমি যার এখনকার নাম শিবি (Sibi)। সেখান থেকে ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে উফরা গ্রামে, এখন যেখানে বালুচিস্তানের ধাদাড় আর মেহরগড় অঞ্চল। তারপরের ঘটনা আমাদের জানা। এবার তাহলে গল্পে ফেরা যাক।
বিঃ দ্রঃ- মেহ্‌রগড় (বালুচভাষায় অর্থ প্রেমের স্বর্গ) পাকিস্তানের পূর্ব বালুচিস্তান রাজ্যে একটি অঞ্চল যেখানে ফ্রেঞ্চ প্রত্নতাত্বিক জাঁ-ফ্রাঁসোয়া জারিজ (Jean-François Jarrige) ১৯৭৪ সালে আবিষ্কার করেন নব্যাশ্ম/ তাম্রাশ্ম (neolithic/ chalcolithic) যুগের প্রথম নগর-ভিত্তিক সভ্যতা যার বয়স প্রায় ১১০০০ থেকে ৪৫০০ বছর, মানে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো থেকেও প্রাচীন। নিচের ছবি - খননের পরে মেহ্‌রগড়ের বাড়ি-ঘর ও শষ্যাধার (ঋণ- আজিজুল শাহজির ব্লগ) 

Image may contain: outdoor and nature


(৫)

'সে কী? কী হয়েছে দিমিত্রির ঘোড়ার?' প্রশ্ন মটকুর। তারও উদ্বেগ লুকোনো থাকে না। এই কয়েকমাসে কেমন কে জানে তার ভাল লাগতে লেগেছে এই ভদ্রস্বভাবের বিদেশীদের। মন কে জানে তার ভাল লাগতে লেগেছে এই ভদ্রস্বভাবের বিদেশীদের।
'কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছু খেতে চাইছে না, মাঝে মাঝে ছটফট করছে।'
'দেখ বাপু, আমরা তো ঘোড়ার ব্যাপারে কিছুই জানি না', মটকু বলেন। 'কি ভিষম, তুমি কিছু জান?'
'ঘোড়া না হলেও গরু-মোষ-শুয়োর তো আমরা পুষি। যাযাবরদের কাছে ছাগল-ভেড়া-উট কিনি মাঝে মাঝে, কিছু চিকিৎসাও শিখেছি। ঘোড়ার অসুখ তার থেকে আর আলাদা কী হবে। চল গিয়ে দেখা যাক একবার।' ওরা চারজনে গেল কার্লোভদের গুহার দিকে। যাবার আগে ভিষম একটা ঢাকা দেওয়া খেজুর-পাতার ঝুড়ি নিল সঙ্গে, কে জানে কী আছে তাতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা গুহামুখে হাজির হল। দিমিত্রির ঘোড়া নির্জীব হয়ে আধশোয়া হয়ে ছড়িয়ে আছে, একটা পা একটু উঁচু করে- মাঝে মাঝে সেটা ছুঁড়ছে। সকলে এগিয়ে আসছিল, ভিষম তাদের মানা করল। তারপর মুখে একটা কাপড়ের টুকরো ঘুরিয়ে বেঁধে ঘোড়ার পায়ের দিকটা দেখতে এগিয়ে গেল। ওটা ছিল সামনের বাঁ-পা। ক্ষুরের গায়ে একটা সাদা গোল দাগ ছিল, যেটা গোড়ালির দিকে একটু বেশি চওড়া মনে হল। পরীক্ষা করতেই দেখেন ক্ষুরের সামনের অংশ যেন কিছুটা আলগা আর ঢিলে হয়ে গেছে, আর একটু চাপ দিলেই ঘোড়া ছটফট করছে।

'হ্যাঁগো ভিষমখুড়ো, ক্ষুরের সমস্যাটা তো দেখছি', দিমিত্রি বলে, 'কিন্তু তার সঙ্গে খাবারে অরুচি আর দুর্বলতা কিসের তা তো বুঝছি না!'
কিছুটা দূরে ঘোড়ার খানিকটা বিষ্ঠা পড়ে ছিল। ভিষম গিয়ে সেটাও কিছুক্ষণ ধরে দেখে এলেন। তারপর দিমিত্রি আর কার্লোভকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, ঘোড়া কী খেয়েছে, কী করেছে এ ক'দিন ধরে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে এ সমস্ত। উত্তরে জানা গেল নদীর কিনারায় বর্ষার পরে বেশ সবুজ ঘাস হয়েছিল, পেট পুরে খেয়েছে ক'দিন। তাছাড়া গ্রামের শষ্যাধারের উদ্বৃত্ত গম গ্রামের লোকেরা এই দুটি ঘোড়াকে খাইয়ে অতিথি সৎকার করেছে। আর বোলানের ধার ঘেঁসে পাথুরে রাস্তায় ছোটাছুটি তো ওরা করেই থাকে। বরং দিমিত্রির ঘোড়া ক'দিন একটু ছুটেছে কম আর খেয়েছে বেশি।

'হুঁ, বুঝেছি। কৃমি নেই। তাহলে নিশ্চয় শর্করার মাত্রা বেশি হয়েছে ব্যাটার, তার থেকেই হজমের  গোলমাল, শরীরে জ্বালা। এখানকার গরুদের মধ্যে বেশি যব-গম খেলে এমনটা হয় মাঝে মাঝে। তোমার মনে নেই মটকু, হুলার বলদটা মরল সেবার বমি করতে করতে, তারও তো ক্ষুরে এমনি যন্ত্রণা হচ্ছিল!'
'কিন্তু খুড়ো, পেটের গোলমালের সাথে পায়ের কী সম্পর্ক?' দিমিত্রির ধাঁধা কাটে না।
'তার আর কী বুঝি আমি? ভাই হুমড়া, মিল্লাকে গ্রাম থেকে একটু ডেকে আনতে পারবি, ও ব্যাটা গরু-ছাগলের অসুখ-বিসুখ অনেক সারিয়েছে মাঝে মাঝে। আমি ততক্ষণ দেখি কী করা যায়।'

হুমড়াকে যেতে হল না, হীর ততক্ষণে এসে পড়েছিল, তার আগেই ও বলল, 'কার্লোভ, তোমার ঘোড়াটা নিয়ে আমিই যাচ্ছি, মিল্লার বাসা এখান থেকে অনেকটা।' ও বেরিয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে।
ভিষম তার পেটি থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে জলে ভিজিয়ে ঘোড়ার খুরে বাঁধল আর মাঝে মাঝেই ওই পট্টিতে জল ছেটাতে থাকল। ঘোড়া মনে হয় আরাম পেল, তার ছটফটানি কমল। গুহার পাশে একটা বড় নিমগাছ ছিল। হুমড়াকে দিয়ে তার কয়েকটা ডাল পাড়ান হল। ঝুড়ি থেকে হামানদিস্তা বেরোল, কিছুটা নিমপাতা বেঁটে জোর করে গেলানো হল ঘোড়াকে। ইতিমধ্যে দেখা গেল হীর মিল্লাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে আসছে দ্রুতবেগে।   

'কী হে, এটা কেমন ধরণের জন্তু? কী নাম এর?' নামতে নামতেই মিল্লার জিজ্ঞাসা।
'আজ্ঞে, এদের আমরা বলি অসুয়ো, তবে ম্যাসিডোনিয়ার বলে হিপোস আর আল্পসের ওপারে ইকুয়াস।' দিমিত্রি জানাল।
'তাহলে আমরা বরং অশ্বই বলি', মিল্লা বলে। 'তাহলে ভিষম ওস্তাদ, কী দেখলে এতক্ষণ?'
ভিষম ওকে নিজের পর্যবেক্ষণ সম্বন্ধে সব জানাল। শুনে মিল্লা বলে-
'ওঃ, দারুণ কাজ করেছ হে। তবে কৃমি যখন নেই, নিমপাতা আর খাইয়ো না। বরং ডুমুরের পাতা আর ফল দিও, আমার উঠানে আছে কয়েকটা গাছ, নিয়ে যেয়ো। বয়স কত হে জন্তুটার?' শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিমিত্রি দিল।
'আমারটার আঠার, কার্লোভের তের।'
'কদ্দিন বাঁচে এরা?'
'তা ধরুন কর্তা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর।'
'হুঃ, তাই বোধহয় বয়স্ক অশ্বটিকেই রোগে ধরেছে', গম্ভীরভাবে মাথা নাড়েন মিল্
'আচ্ছা তুমি তো গরু-ছাগলের অনেক চিকিৎসা করেছ', ভিষম শুধোন, 'শর্করের রোগে পায়ের ব্যথা কেন হচ্ছে বলতে পার?'
'রক্তে মিঠা আনাজ মিশে হাওয়ার মাত্রাটা কম হয়ে যায় হে, হাত-পায়ের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ভাল-তাজা রক্ত পৌঁছে না। এই ক্ষুরটা দেখছ, এটার ভিতরে আছে একটা শক্ত হাড়। ক্ষুর আর হাড়ের মাঝের অংশে যে শিরা আর তন্তুগুলো আছে, তারা ভাল রক্তের অভাবে শুকিয়ে গেছে, তাই মাংসের উপর পুরো শরীরের চাপ পড়ছে। অবস্থা খুব খারাপ। যব-গম বন্ধ করে শুধু কচি পাতা, কম পরিমাণে ঘাস আর সেদ্ধ ছোলা অল্প করে খাওয়াও হপ্তা দুই। আর ওকে রোজ একটু-আধটু চলতে দাও- কিন্তু বালি বা ঘাসের উপর, শক্ত পাথরে একদম নয়। সামনের দু'খানা পা-কে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ডুমুর পাতার পাঁচনটা রোজ চলুক দু'বেলা। তারপর দেখা যাক, কী হয়।'
'পা ঠাণ্ডা রাখার দায়িত্ব আমার। আমি একটা ব্যবস্থা করব, কার্লোভ কাল সকালে একবার এসো তো আমার বাসাৎ', ভিষম বললেন।
পরদিন কার্লোভ গিয়ে দেখে দুটো তামার কাপ তৈরি করে রেখেছেন ভিষম, বললেন- 'এগুলো পরিয়ে দিও সামনের পায়ে আর মাঝে মাঝে উপর থেকে এর মধ্যে জল ঢালবে। তার আগে ক্ষুরদুটো ভিজে কাপড়ে মুড়ে দিও। তিন-চারদিনের ভেতর জ্বালা ঠিক কমে যাবে।'
'আপনি আর মিল্লা যা সাহায্য করলেন, আমরা এ উপকার জীবনে শোধ করতে পারব না।'
'খুব পারবে। এই নাও, এই দুটো ধর তো। আর এই থলি'- এই বলে দুটো পাথরের টুকরো আর একটা থলি কার্লোভের হাতে দিয়ে ভিষম বললেন- 'এরকম পাথর হয়ত বোলানের তীরে ধারে কাছে কুড়িয়ে পাবে। পেলে কিছু নিয়ে এস তো। এখন তো দিমিত্রি নেই, তাই তোমাকেই বলছি। তোমাদের ঘোড়া, মানে অশ্বদের ক্ষুরে পরাবার জন্যে কিছু শক্ত নাল তৈরি করার চেষ্টা করছি।'
ঈশ্বরের কৃপা হোক বা উফ্‌রার গ্রামবাসীদের সাহায্যের ফলেই, মাস দুইয়ের মধ্যেই দিমিত্রির অশ্ব চাঙ্গা হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এখন গ্রামের সবাই ওদের বন্ধু হয়ে গেছে। এখন দিমিত্রি গ্রামের ভেতর গেলেই মিল্লার নাতনি আর তার বন্ধুদের জন্যে আমলকি আর টোপাকুল এনে দেয়, কাঠের খেলনা বানিয়ে দেয় ওদের জন্যে। তার সেই সময় কার্লোভ আর হীর হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ায় বোলান নদীর ধারে ঘাসের উপর, পাহাড়ে-জঙ্গলে। শুধু গ্রামের মোড়ল মটকুর মনে শান্তি নেই, এ বছর ভাল ফসল হয় নি একদম। কী অভিশাপ বয়ে আনল দুই বিদেশী, তিনি পরামর্শ করতে চললেন ভিষমের কুটিরে।

(৬)
ফসল কাটার সময় এসে গেল। এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় উফ্‌রা আর তার আসেপাশের গ্রামগুলোতে ফসল অনেকটাই কম হয়েছে। ফসল বলতে গম, যব, বাজরা, ছোলা আর কন্দমূল। বেশ কয়েক বছর আগে, যখন মটকুর জোয়ান বয়েস, ওদের গ্রামে ইরানী যাযাবরেরা আসে। ওরাই বীজ ছড়িয়েছিল কিনা কে জানে, চলে যাবার পর মাটি খুঁড়ে একরকমের গোল শেকড় জাতীয় জিনিষ পাওয়া যায়, তার একটা বেশ ঝাঁঝালো গন্ধ, খেতেও বেশ। এরা এখন শেকড় পুঁতে চাষ শুরু করেছে, ভালই ফলন হয় এই ফসলের, তাকে ওরা পেঁয়াজ বলে। এবার কিন্তু জল কম হলেও পেঁয়াজের ফলন ভালই হয়েছে।
তবে শীত পড়তেই কার্লোভ আর দিমিত্রি বাড়ি ফেরার জন্যে আকুল হয়ে উঠল। ওদের একবছর এখানে থাকা হয়ে গেছে। এই একবছরে ওরা দিয়েছে কিছু, পেয়েছে অনেক বেশি এই মেহ্‌রগড়ের কাছ থেকে। পাথর কেটে মাটি লেপে ঘরবাড়ি বানানো, শষ্যাধারে উদ্বৃত্ত শষ্য সঞ্চিত রাখা, বাসন গড়তে মাটির আর তামার ব্যবহার, গরু-মোষ পালন আর চাষবাসের উন্নত পদ্ধতি। ওরা দুই বন্ধুতে এসব কথাই আলোচনা করছিল, এমন সময় হীর আর তন্দু এসে হাজির হল।
ওদের ফিরে যাবার কথা শুনে তন্দুর মন খারাপ হয়ে গেল। ও মাসখানেক ধরে ঘোড়ায় চড়ার নানা কসরত শিখছিল দিমিত্রির কাছে। বদলে গরুর চামড়া দিয়ে নতুন ধরণের জিন বানিয়ে দিয়েছে ও অশ্বদের জন্যে, সে জিন ঘোড়ার পিঠে পরালে যে অংশটা নীচে ঝোলে তার সামনে-পেছনে উঁচু, মাঝে গর্ত- তাতে বসার অনেক সুবিধে হয়। ভিষমও একটা কিছু তৈরি করছেন, কী সেটা গিয়ে দেখে আসতে হবে। 'তোদের সঙ্গে আমিও যাব তাহলে তোদের দেশে'- তন্দু বলে।
'সে চল না কেন, কিন্তু যাবি কিভাবে?' দিমিত্রি শুধোয়, 'ঘোড়ায় দুজনে যেতে পারবে না এতটা পথ।'
মনখারাপ হয়ে যায় সবার। 'আচ্ছা, আমরা এরকম ঘোড়া আরো পেতে পারি না তোমাদের দেশ থেকে?'- হীর জিজ্ঞেস করে, 'কার্ল, চল না আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে আর কয়েকটা নিয়ে আসি।'
'তুমি আমার সঙ্গে গেলে আর তোমাকে ছেড়ে দেব ভাবছ! এরকম সুন্দরী আমাদের দেশে আর একটাও নেই'- হাসে কার্লোভ।
'যাঃ মিথ্যুক কোথাকার! আমার বয়ে গেছে তোমাদের দেশে গিয়ে থাকতে'- কার্লোভের পিঠে একটা কিল মারে হীর।
পরদিন ওদের কথা হচ্ছে ভিষমের বাসায়। তিনি কিছু সাদা আর কিছু লাল পাথরকে একসাথে গলাচ্ছিলেন চুল্লিতে, পাথরগুলো কার্লোভ খুঁজে এনে দিয়েছে তাঁকে বোলানের খাত আর লালডুংরির তরাই থেকে। কিছুক্ষণ পরে পাথরের পাত্রখানা চুল্লি থেকে বের করে গলিত ধাতুটাকে ঢাললেন মাটি খুঁড়ে তৈরি করা ছাঁচের ভেতরে। আধঘন্টা পরে ছাঁচ ভেঙে গলিত মোমটা ফেলে বের করা হল চারখানা অর্ধগোলাকার চ্যাপ্টা ধাতব বস্তু। কিছুক্ষণ ঘষামাজার পর যে বস্তুটা ফুটে উঠল তা দেখেই চমকে উঠল কার্লোভ- 'ঘোড়ার নাল! কী দিয়ে বানালেন?'
'ব্রোঞ্জ- নাম দিয়েছি এর। তামা আর টিনের পাথর মিশিয়ে বানানো প্রথম ব্রোঞ্জের জিনিষ।'
'বোধহয় পৃথিবীর প্রথম ব্রোঞ্জ!' উচ্ছ্বাস চাপা থাকেনা দিমিত্রির। আমরা আগে কোথাও দেখিনি।
পরদিন দিমিত্রির ঘোড়া ক্ষুরে পরল নতুন অলংকার- ব্রোঞ্জের নাল। কার্লোভকে এখন দেওয়া হলনা, আগে দেখা যাক এটা টেঁকে কিনা আর ফলটাই বা কেমন হয়!

(৭)
আর্মেনীয় যুবকদের দেশে ফেরা নিয়ে কথা হচ্ছিল ভিষম আর মটকুর মধ্যে। মটকুর বক্তব্য- সত্যিই তো, আর কদিন ওরা বিদেশে থাকবে! তবে ভিষমের অন্য কথা। আরে ওদের সেদেশে আছে কে? এখানে থাকলেই বা কী ক্ষতি? একটা করে সঙ্গিনী যোগাড় করে নিক, তারপর- বলে কী যেন ভেবে থেমে যান ভিষম।
'কী হল, চুপ করে গেলে যে?'
'ভাবছি অন্য কথা। তোমার মেয়েটিকে তো মনে হয় কার্লোভের মনে ধরেছে। ওরা যদি একসঙ্গে থাকে তোমার কোন আপত্তি আছে?'
'বল কী? ওদের ভাষা, দেশ, রুচি, কায়দাকানুন সব আলাদা- আমার মেয়ে সেসব মানিয়ে নিতে পারবে কেন?'
'কেন হে! সবই তো শিখে গেছে তোমার হীর। দেখি তো ওদের সেমিটিক ভাষা্তেও দিব্যি কথা বলছে। ঘোড়ায় চড়ছে, কার্লোভকে আমাদের ভাষা শিখিয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা বড় ভাব হয়েছে হে দুটিতে। আর একটা কথা কই। আমরা তো এ দেশ ছেড়ে নড়িনি কখনও। তবে আসিরিয়া আর মিশরের জিপ্সি যাযাবরদের থেকে শুনেছি মিশরে নাকি খুব কাছের আত্মীয়দের মধ্যে মেলামেশা হয় আর তার ফলে তাদের বাচ্চারা প্রায়ই নানা অসুখে ভোগে। আমার মনে হয় কী, যত দূরের আর অন্য জাতের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হবে বাচ্চারা তত উন্নত বুদ্ধি আর ভাল স্বাস্থ্য নিয়ে জন্মাবে। মানুষ জাতটারও এভাবে ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। তুমি কী বল?'
'আমি আর কী বলি ভিষম! তোমার জ্ঞানবুদ্ধির উপর আমার বরাবরই ভরসা আছে। তবে একটিই মেয়ে আমার, দূরদেশে পাঠাতে মন চায় না। অবশ্য ওরা চাইলে আমি বাধা দেব না।'
এদিকে তখন বোলানের ধারে দুটো ঘোড়ায় পাশাপাশি চলতে চলতে কথা হচ্ছে হীর আর কার্লোভের মধ্যে। হীর কিছুতেই কার্লোভের সঙ্গে তার দেশে যেতে রাজি নয়। তার ইচ্ছে কার্লোভ মেহ্‌রগড়েই থেকে যাক বরাবরের জন্যে।
'তোমার কে আছে ওখানে কার্ল? কোন মেয়ে বন্ধু, বাচ্চা, বাবা-মা? কাদের জন্যে ফিরবে সেখানে?' শুধোয় হীর।
'আমার নেই, তবে দিমিত্রির সবাই আছে, বাপ, মা, ভাই, বোন।'
'তাহলে ও ফিরুক না। তুমি থেকে যাও।'
'তা হয় না হীর। এত দুর্গম পথে একা যাওয়া যায় না। পথে কিছু বিপদ-আপদ হতে পারে। ঘোড়ার কিছু হলে তো আরো খারাপ। তাছাড়া আমরা এসেছি আমাদের গোষ্ঠী বা সমাজের থেকে একটা কাজ নিয়ে। ওরা আমাদের পথ চেয়ে আছে এক বছর ধরে।'
'সে কাজটা কী? ঘোড়ার রোগের চিকিৎসা? সে তো দেখলে আমরা ঘোড়াই এই প্রথম দেখলাম।' 'তাহলে খুলেই বলি তোমাকে। আমরা আদতে ছিলাম ককেশিয়ান। তবে অত্যধিক শীতে বছরের বেশিরভাগ বরফ জমে থাকায় চাষবাস খুব একটা হত না, শিকার আর কত করব। তাই শ'পাঁচেক বছর আগে আমাদের একটা বড় দল সেখান থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাগে ছড়িয়ে পড়ি। কেউ যায় মিশর, কেউ মেসোপটেমিয়া বা তুর্কমেন হয়ে কিতানের* দিকে। আমরা আর্মেনিয়া আসিরিয়াতে আছি প্রায় তিনশো বছর। ওখানে থাকার কোন অসুবিধা নেই। দুদিকে সমুদ্র, ঠাণ্ডা তেমন নেই। তবে জমি ভাল নয়, বড্ড শক্ত, পাথুরে। তাই মেসোপটেমিয়া ছাড়িয়ে আরো আগে কিছু আছে কিনা দেখতে আমাদের একটা দলকে পাঠানো হয়। ইউফ্রেটিস নদী পার করে আরো পূব-দক্ষিণে টাইগ্রিস নদী চোখে পড়ে। ওখানে সুমেরিয়রা দেখি ভাল ফসল ফলিয়েছে, প্রচুর ছাগল, ভেড়া, উট চরছে। বড় বড় গ্রাম, প্রচুর লোকজন, কিন্তু অনেক কিছু নেইও সেখানে।'
'যেমন?'
'চাষবাস আমাদের মতই করে ওরা, পাথরের কোদাল-গাঁইতি দিয়ে। নেহাৎ দুই নদীর পলি জমে জমি নরম, তাই ফসল ভাল হয়। তাছাড়া সুমের অঞ্চলে খুব কম বরফ পড়ে, চমৎকার জল-হাওয়া। তবে তোমরা এখানে যেমন মাটির ইঁট দিয়ে বাড়ি করতে শিখেছ, সেটা ওরা জানেনা। ঘোড়া ওরাও তেমন দেখেনি আর তামা ছাড়া আর কোন ধাতুও চেনেনা। আমাদের দলের আর সবাই সেখানে রয়ে গেল খোঁজখবর করতে। আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম গান্ধার ছাড়িয়ে নতুন দেশের খোঁজে। তারপর কুয়েটা থেকে কিভাবে এখানে পৌঁছোলাম সে তো তোমাকে কতবার বলেছি।'
'আর এখানে এসে কী পেলে? ঘোড়ার চিকিৎসা?'
'এখানে পেলাম অনেক কিছু। কিন্তু দুটি জিনিষ দুনিয়ার আর কোথাও নেই এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।'
'সেগুলো কী জিনিষ শুনি!'
'দুটি মানুষ। একজন হলেন ভিষম, এক আশ্চর্য প্রতিভা। আর একটি হলে তুমি। তুমি না থাকলে হয়ত সেদিনই তন্দুর তিরে আমি শেষ হয়ে যেতাম।'
'শুধু এইটুকু?'
'বাকিটুকু বলছি। নেমে এস তাহলে।' দুজনে ঘোড়া থেকে নেমে হাতে হাত ধরে নদী আর পাহাড়ের মাঝের তরাইএর ঘন বনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
* কিতান- ইউরেশিয়া অঞ্চলে চীনদেশকে বলা হত।

(৮)
কিছুদিন আগে ভিষম এক যুগান্তকারী কাণ্ড করেছেন। কিছু পাথরের খণ্ডকে একসাথে গলিয়ে ব্রোঞ্জধাতু বেশ খানিকটা তৈরি করেছিলেন তিনি, উদ্দেশ্য ছিল তা দিয়ে হল বা লাঙলের ফলা গড়ে তোলা। তবে এ নিয়ে গ্রামের চাষীদের সঙ্গে কথা বলে উনি বুঝেছিলেন যে একখানা লাঙলের ফলাতে যে পরিমাণ ধাতু লাগবে তা উৎপাদন করার জন্যে কাঁচামাল জোগাড় করা খুবই কষ্টসাধ্য। তাই তিনি গলিত ব্রোঞ্জ বেশ খানিকটা নিয়ে তাকে গরম করে পিটিয়ে পাত তৈরি করলেন। দেখা গেল তামার মত এ জিনিষটা বেঁকে ভেঙে যাচ্ছে না। তারপর সেই পাতকে কাঠের লাঙলের আগায় মুড়ে ফেলে মটকুকে দেখালেন। তারই আজ সফল পরীক্ষণ করে দেখল মটকু আর তন্দু তাদের যবের ক্ষেতে। ফল আশাব্যঞ্জক লাঙলের ফলা জমির গভীরে যাচ্ছে, তবে তাতে তন্দুর পক্ষে লাঙল টানা আরো কষ্টকর হয়ে উঠছে, দেখা যাক, বৃষ্টি হলে হয়ত কিছু সুবিধে হবে। হুমড়ার অবশ্য ধারণা যে মানুষের জায়গায় মহিষ বা বলদ দিয়ে হলকর্ষণ করলে আরো ভাল হত। সে ভবিষ্যতের ব্যাপার, তখন দেখা যাবে।
কার্লোভ আর দিমিত্রি আর থাকতে চাইল না। শীত পেরোবার আগেই ওরা রওনা দিল দেশের পথে। যাবার আগে দুজনে মিলে ভিষমের উঠোন ভরে দিল তামা, দস্তা, টিন সমেত নানা আকরিক পাথরে। তার পরিবর্তে ওরা পেলও অনেক কিছু। গ্রামবাসীদের তৈরি যব ও চণকের পিঠে, মিল্লার বানানো নানাধরণের রোগ নিরাময়ের জন্যে বিভিন্ন চূর্ণ আর নির্যাস, হীরের হাতে বোনা পশুলোমের চাদর, আর ভিষমের তৈরি বেশ কয়েকটা ব্রোঞ্জের নাল আর হলের ফলায় মুড়ে লাগানোর জন্যে বেশ খানিকটা ব্রোঞ্জের পাত। আর্মেনিয়রা লাঙল বা হলের ব্যবহার জানত না, এরা শিখে যাচ্ছে এখান থেকে।
'তুমি তো আমাকে শুধু দিয়েই গেলে', কার্লোভ শুধোল হীরকে, 'কিছু চাইলে না আমার কাছ থেকে?'
'তুমি কী দিয়েছ তার হিসেব তোমার ওই মোটা মাথায় ঢুকবে না। আপাততঃ তোমার ঐ তামার শিরস্ত্রাণটা রেখে যেয়ো আমার কাছে, পরেরবার এলে ফেরৎ পাবে। আসার সময় গ্রামের জন্যে কিছু ঘোড়া আনবে।' এমন সময় দিমিত্রি ঢুকছিল গুহামুখ দিয়ে, দুজনকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখে মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে এল।
যাবার সময় দিমিত্রি এল মটকুর বাসায়। গুন্ঠা আর মটকু ওকে জড়িয়ে ধরল। তন্দুর কাছ থেকে ওরা দু'জন কিছুটা ধনুর্বিদ্যা শিখেছিল, এখন তন্দু ওর হাতে ধরিয়ে দিল একটা চামড়ার ছিলার ধনুক আর আগায় পিতল মোড়া বেশ কিছু তির। দিমিত্রি এরপর গেল ভিষমের কাছে বিদায় নিতে, কার্লোভ ইতিমধ্যে এসেছে সেখানে। ওরা কেউ কিন্তু যাবার সময় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হীরকে দেখতে পেল না, কার্লোভের কাছে একটা অতিরিক্ত শিরস্ত্রাণ ছিল, ওটা মটকুর হাতে দিয়ে এল হীরকে দেবার জন্যে। দিনের আলো থাকতেই বোলান গিরিবর্ত্ম পার হয়ে কুয়েটা পৌঁছনো জরুরি, তাই ওরা আর অপেক্ষা করতে পারল না। মিল্লা, তার মেয়ে, নাতনি আর গ্রামের কিছু যুবক এসেছিল নদীতীর পর্যন্ত তাদেরকে বিদায় দিতে।
সংকীর্ণ গিরিপথ ধরে ঘোড়াদুটো পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত হীর চেয়ে থাকল বনের প্রান্তে একটা টিলার ওপর থেকে। তারপর নেমে এসে এসে ধীর পায়ে বাসার দিকে রওনা হল।


(৯)

মাঘের শেষে কিছুটা বৃষ্টি হল। বোলানের তীরে এই কাচ্চি সমতলভূমির প্রায় তিনদিক পাহাড়ঘেরা বলে দক্ষিণসাগর আর পূবদিক থেকে আসা মেঘের দল পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঝরে পড়ে মেহরগড় অঞ্চল থেকে সিন্ধু নদের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। হিন্দুকুশের পশ্চিমপ্রান্ত আর সিন্ধুর পূর্বভাগ বর্ষার অভাবে রুক্ষ মরুভূমিতে পরিণত হয়, যদিও ঘগ্‌গর, হাকরা, সরস্বতী, লুনী, বানস বয়ে চলত এই অঞ্চল জুড়ে কিন্তু চাষ-আবাদ আর ছাগ-মেষ-গোচারণের বাড়াবাড়িতে ঘাস শেষ হয়ে বালুকাময় হয়ে উঠতে থাকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অবশ্য সে বছর বৃষ্টি ভালই হল। দুটো বলদ, জোয়াল আর ব্রোঞ্জের ফলা লাগানো কাঠের লাঙ্গল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল পিতাপুত্রে, মানে মটকু আর তন্দুতে। বেশ ভাল করে গোবর আর শুকনো খড়-পাতার তৈরি সার দিয়ে মাটি ওলট-পালট করে দিল দুজনে। এই দুই বলদে টানা হল-জোয়ালের কল্পনাটা ছিল হুমড়ার। ছেলেটা কর্মঠ বলে ভিষমেরও বড় প্রিয়পাত্র, তবে যতটা খাটে, মাথা ততটা খেলে না।
এদিকে এবছর ভাল চাষের সম্ভাবনা থাকা সত্বেও হীরের মন বসে না কোন কাজে। সে কার্লকে ভুলতে পারছে না, তাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ওর সঙ্গে কাটানো গত এক বছরের বেশ কিছু সুখস্মৃতি।ওদের ছোট্ট আদিম সমাজে এ রোগ তো ছিল না! অশ্ব, পিতল, ব্রোঞ্জ, বলদের হালচাষ- এই আদিম সভ্যতার বিকাশের পথে কি আরেকটা নতুন অধ্যায় যোগ করল এই অনুভূতি? মনের এই ভাবের কী নাম, কী বলবে যদি কেউ তাকে শুধোয় তার কী হয়েছে!
অবশ্য হীরের মনের কী অবস্থা তা কেউ না বুঝলেও শরীরের অবস্থা মাসখানেকের মধ্যেই ধরে ফেলল ওর মা গুন্ঠা। তার শরীরে যে পালিত হচ্ছে আরেকটি শরীর, সে খবর অবশ্য কোন লজ্জার বা ভয়ের ছিল না সে যুগে। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা তখনও ছিল, তবে পুরুষভোগ্যা নারী যে বর্বরতার সংস্কৃতি তা থেকে মেহ্‌রাগড় অনেকটা এগিয়ে এসেছিল। পারস্পরিক স্বীকৃতি ছাড়া পুরুষ আর নারীর মধ্যে ধর্ষণ-সংস্কৃতির যুগকে ছাড়িয়ে এসেছে ওরা, যদিও এই সম্পর্কের কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চালু হয় নি তখনও। সবাই জানে কার সন্তান পালিত হচ্ছে তার গর্ভে, তবু খুশি সকলেই। সুখ নেই শুধু হীরের মনে। কার্ল কি জানবে কোনদিন, কী দিয়ে গেল সে একটা বিদেশিনীকে? সে কি ফিরবে কোনদিন?
গম আর যবের বীজ ফেলা হয়ে গেছে। সারি সারি পোঁতা চারাগাছগুলো হাওয়ায় দুলতে থাকে। আলের ধারে একা বসে হীর দেখে গ্রামের দিক থেকে তন্দু আসছে, সঙ্গে মিল্লার মেয়ে দুলিয়া আর তার শিশুকন্যা মিষ্টি মেয়ে কিয়া। মাসখানেক আগে কিয়ার বাপ জালান দলবল সমেত বোলানের উত্তরে গেছিল শিকারে, জার্ঘন-ঘর পাহাড় থেকে যে তুষার-চিতা এসে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, এটা তার মাথায় আসেনি। হিন্দুকুশের উত্তরাঞ্চলে খাইবার গিরিপথের বরফে ঢাকা উপত্যকায় দেখা যায় এই হিংস্র জন্তুদের, তবে দক্ষিণ হিন্দুকুশ শীতকাল হলেও অপেক্ষাকৃত কম ঠাণ্ডা বলে এদিকে ওদের দেখা যাবে বলে ভাবেনি ওরা। সঙ্গের পোষা শিকারি কুকুরগুলোও কিছু করতে পারেনি। গ্রামের লোক পরদিন তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটা নিয়ে আসে গরুর গাড়ি করে। খুব কেঁদেছিল দুলিয়া সেদিন, কেঁদেছিল বাচ্চাটাও। প্রথা অনুযায়ী পুব-পশ্চিম দিক বরাবর মাটি খুঁড়ে কবরে মৃতদেহ বসিয়ে রাখাও যাচ্ছিল না, জালানের শরীরটা এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।...... কিন্তু আজ হঠাৎ দুলিয়া তন্দুর সাথে? ভাবতে ভাবতে ওরা এসে পড়ল হীরের কাছে।
'দুলিয়াকে নিয়ে এলাম রে, এই সময়টাতে তোর দেখাশুনা করবে। বদ্যির মেয়ে, অনেক টোটকা-টুটকি জানা আছে ওর।'
'তাই বুঝি? তা কী টোটকা দিয়ে আমার দাদা তোকে বশ করল শুনি! দেখে তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বেশি তন্দুরই দরকার তোকে।'
'না রে হীর। আমার ঘোড়াও চাই না, তির-ধনুকও নয়।' কষ্টের হাসি হাসল দুলিয়া। 'এই দুঃখের সময়ে ও যেভাবে আমার সাথ দিয়েছে, এই মানুষটাকে পেলেই আমার সব পাওয়া হবে। কিয়াও ওর বাপ পাবে।'
'আর তোর বাবাকে কে দেখবে?'
'আমি তো এখানেই আছি, যাব মাঝে মাঝে। তোর কাজটা ভালয় ভালয় মিটে যাক, তারপর তো আমরা ওখানেই থাকব গিয়ে।'
তা বটে। ওদের সমাজটা যে স্ত্রী-প্রধান, মেয়েরা বাপ-মায়ের জমি-বাড়ির উত্তরাধিকার পায় সেটা কার্লোভের চিন্তায় প্রায় ভুলতেই বসেছিল হীর। ওরা চারজনে ঘরের দিকে পা বাড়াল এবার।


(১০)

গ্রীষ্মকালের শেষে ফসল উঠল গোলায়। যব, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ আর ছোলা। এরপর এল একটা সংক্ষিপ্ত বর্ষাকাল। দিন পনের বৃষ্টি হল, মাটি ভিজে থাকল কিছুদিন। তার মধ্যেই গমের বীজ ফেলা হল। কয়েকবছর হল ভুট্টার চাষও শুরু হয়েছে এই অঞ্চলে। লাঙলে ব্রোঞ্জের পাত ব্যবহার করায় কর্ষণ ভাল হচ্ছে, বিশেষতঃ বলদ বা মহিষকে কাজে লাগালে। তবে এতে একটা অসুবিধা হয়েছে। টিনের আকর এ অঞ্চলে কম, দস্তার সাদা পাথর তবু পাওয়া যায়। আরেকটা প্রসঙ্গ এল। এদের সমাজে নিয়ম করে স্ত্রী-জাতীয় গবাদি পশু খাওয়ার জন্যে বধ করা প্রায় বন্ধ করা হয়েছিল, কারণ তারা দুধ দেয় আর সন্তানের জন্ম দেয়। পুরুষ জাতির ছাগল, ভেড়া, গরু, মহিষ এন্তার খাওয়া চলত। সেবার গ্রামসভায় মোড়ল মটকু প্রস্তাব আনল পুরুষ গো-মহিষাদি হত্যা কম করার জন্যে, অন্ততঃ চাষের আর গাড়ি টানার কাজের জন্যে প্রয়োজনীয়-সংখ্য়ায় যেন থাকে তারা, প্রজননের জন্যে আলাদা কিছু তো থাকছেই। বলা বাহুল্য এতে আপত্তি করার তেমন কিছু ছিল না। মাংসের জন্যে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, ইয়াক যথেষ্ট আছে, হরিণ, বরা, ময়ূর এসব শিকার করাই যায়।
শরতের শেষে এল সেই প্রত্যাশিত শুভদিন। মটকু আর গুণ্ঠার বাড়ি আলো করে এল নতুন অতিথি, হীরের কোলে জন্ম নিল কার্লোভের পুত্রসন্তান। দুলিয়া যেভাবে যত্ন নিয়েছিল, তাতে প্রায় কোন কষ্টই পেতে হয় নি হীরকে, কষ্টটা  আর অন্যত্র। ছেলে পেয়েছে মায়ের রূপ আর বাবার গায়ের রঙ, যদিও গুণ্ঠা বলছে পুরুষ মানুষের রঙ পুড়ে যাবে একটু বড় হলেই মাঠে-বাটে ঘুরে বেড়িয়ে। পুরুষ মানুষ! ঐটুকু বাচ্চাকে ভবিষ্যতের কার্লোভ কল্পনা করে হেসে গড়িয়ে পড়ল হীর আর দুলিয়া। ইস্‌, কার্ল তো জানতেই পারল না যে সে কখন নিজের অজান্তেই বাবা হয়ে গেল, আবার মন খারাপ হয়ে গেল হীরের।
প্রসবের রাত্রে ধাইকে রেখে বাড়ি ফিরে গেছিলেন মিল্লা, পরদিন সকালেই দেখতে এলেন শিশু আর তার মাকে। ভিষম আর গ্রামের অন্য লোক, মেয়েরা অনেকেই এল। ঠিক হল একমাস পরে হবে নামকরণের উৎসব। মোড়লের নাতি বলে কথা, জামাই না থাকলেই বা! তন্দু আর হুমড়া এখন থেকেই লেগে পড়ল আয়োজনে।
মাসখানেক পার হল। হীর আর তার শিশুপুত্র ততদিনে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে। সেদিন অনেক লোক জমা হয়েছে মটকুর উঠোনে। বাড়ির পেছনের মাঠে বেশ কয়েকটা বলদ আর হরিণ কাটা হয়েছে। ঝলসানো মাংসের সঙ্গে যব আর চণকের আটা মিশিয়ে সেঁকা হচ্ছে মোটা মোটা রোট আর মোষের দুধের ঘি মাখানো পুরোডাশ (পরোটা)। মাটির ভাঁড়ে করে পরিবেশিত হচ্ছে ভুট্টা আর গমকে সেদ্ধ করে গেঁজানো হাঁড়িয়া, সঙ্গে অনুপান হিসেবে জারণ করা পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। এছাড়া ছিল ফুলের মধু থেকে তৈরি মাধ্বী আর অন্য এক বিশেষধরণের দামি মদ যাকে পরবর্তীকালে বেদে সোমরস নামে বর্ণনা করা হয়েছে। কী সেই মদ? সেযুগে বালুচিস্তানের উত্তরে হিন্দুকুশ অঞ্চলে সম্ভবতঃ ‘এফিড্রা সিনিকা’ নামের এক লতা পাওয়া যেত। চাঁদনি রাতে এই লতাগুলোকে মূলসুদ্ধু উপড়ে, পাহাড়ি ছাগলে-টানা গাড়িতে নিয়ে আসা হল উৎসবের প্রাঙ্গনে। আগে থেকেই ঘাস আর কাঠকুটো দিয়ে একটা জায়গা করা ছিল। সেখানে ওই সোমলতাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পাথরে পেষা হল। তার পর ওই পিষে-যাওয়া লতাগুল্মকে পশমের ছাঁকনিতে রেখে দশ আঙুলে চটকানো হল। পাথরে ছেঁচা, ঈষৎ হলুদরঙা ওই রস এ বার দুধে মিশিয়ে টানা ৯ দিন ধরে গ্যাঁজানো হল। ব্যস, তৈরি দেবভোগ্য সোমরস। এই মদকে সযত্নে রাখা হল 'গ্রহ' নামে কাঠের পাত্রে আর কিছু মাটির পাত্রে যার নাম ‘স্থালী’।* গ্রামের মাথাগোছের কর্তাব্যক্তিদের জন্যে এভাবেই তৈরি হয়েছিল সোমরস।
দু'দিন ধরে উদ্দাম খানাপিনার পর এল নামকরণের সময়। এবার মোড়লমশাইয়ের হল বিপত্তি। তাইতো, নাম কী হবে? ছেলের মা তো কিছুই বলে নি তাকে! কোথায় হীর, ডাকো ওকে।
'আরমান।' গ্রামের মাতব্বররা চমকে তাকিয়ে দেখে হীর এসে দাঁড়িয়েছে উৎসবের মঞ্চে। 'ওর নাম হবে আরমান'- ঘোষণা করে সে।
'আরমান! তার মানে? এটা কোন জাতীয় নাম?' জিজ্ঞাসা সমস্বরে।
'আরমান ওর বাপের দেশের নাম, আর্মেনিয়ার ভাষায় এর মানে সাহসী, সৎ পুরুষ। কার্লোভ বলত ওদের দেশে এই নামটা খুব পছন্দের।'
আর কেউ কিছু বলতে পারে না। তাছাড়া সোমরসের একটা যাদুও তো আছে! সবার সম্মতিক্রমে শেষে ওই নামই সাব্যস্ত হল হীরের ছেলের।
* - তথ্যঋণ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ঋগ্বেদ, ষষ্ঠ মণ্ডল


(১১)

এবার তাহলে একটু আর্মেনিয়ার দিকে চোখ ফেরানো যাক, কী ঘটে চলেছে সেখানে। আমাদের ককেশীয় বন্ধুরা দীর্ঘ তিনমাসের চেষ্টায় দেশে পৌঁছল। সেখানে তখন গ্রীষ্মের শুরু, মনোরম আবহাওয়া। প্রথম কয়েকমাস বেশ আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে কাটল কার্লোভ আর দিমিত্রির। ব্রোঞ্জের পাত আর ঘোড়ার পায়ের নাল দেখে তো মহা খুশী তাদের বন্ধুরা। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন ভাবে চাষ-বাস শুরু হল। তবে এবার ফসল কাটা হতেই একটা নতুন উপদ্রব শুরু হল। ফসল কেটে জমা করার কয়েক দিনের মধ্যে ইউরেশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে নেমে এল দস্যু বানজারার দল, অর্ধেকের উপর ফসল লুটপাট করে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, কেউ আর তাদের হদিস করতে পারল না। তাদের কাছে ছিল উন্নত-জাতের প্রশিক্ষণ দেওয়া ঘোড়া, যাদেরকে ওরা বলত কাভালো, এই আর্মেনীয় ঘোড়াদের সাধ্য কি তাদের নাগাল পায়।

ইতিমধ্যে মেসোপটেমিয়ার সুমের অঞ্চল থেকে কিছু লোক ফিরে এসেছে। ওরা জানাল যে মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস (দজলা) আর টাইগ্রিস (ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল বেশ উর্বর আর জনবহুল। টাইগ্রিসের তীরে আসিরিয়দের জনপদ অসুর, যেখানে যথেষ্ট খালি জমি আর বেশ কিছু উন্নতজাতের মানুষ আছে। তাই শুনে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে উঠল। আর্মেনিয়া ছেড়ে যেতে কেউ চায় না, কিন্তু উন্নত, সহজ জীবনযাত্রা কে না চায়। তাও বেশীরভাগ লোকেই আর্মেনিয়াতেই রয়ে গেল, কিছু লোক তুরস্কের আনাতোলিয়ায় আর কিছু ব্যাবিলনে গিয়ে নতুন সভ্যতা গড়ে তুলল। আমাদের গল্পের নায়করা একটা বড় দল আর বিস্তর ঘোড়া-ছাগল-উট নিয়ে রওনা হল অসুরের উদ্দেশ্যে। তবে অসুররা বন্ধুত্বের হাত বাড়াল না, তাদের লড়াকু মনোভাব দেখে তারা নেমে এল ইউফ্রেটিসের তীরে উরুক গ্রামে, সেখানেই গড়ে তুলল নতুন সুমেরীয় জনপদ। অবশ্য অসুরদের সঙ্গে দক্ষিণ সুমেরীয়দের একটা বরাবরের বৈরীভাব গড়ে উঠল এর ফলে।

এভাবে নতুন বসতি গড়ে তুলতে কেটে গেল দুটো বছর। কার্লোভ হিসেব করে দেখল প্রায় তিন বসন্ত পেরিয়ে গেছে তার মেহ্‌রগড় থেকে ফেরার পর। এতদিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে জীবন চাইল একটু স্থিরতা আর ঠিক তখনই মনে পড়ল হীরের কথা। দিনরাত ছটফট করে বেড়ায় কার্লোভ, সুখস্মৃতিগুলো বড্ড বেশী পিছু টানে। আচ্ছা এই অনুভূতির নাম কী? এখন হীরের কিভাবে সময় কাটছে? আচ্ছা শেষ দু'মাস তো বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিল তারা......হীর কি তবে তার সন্তান ধারণ করেছে? জানার তো কোন উপায় নেই। প্রায় ছুটে কার্লোভ গেল প্রাণের বন্ধু দিমিত্রির কাছে।

দিমিত্রি এখন আর একা নয়। সুমের অঞ্চলের লোকেরা এমে-ঙির ভাষায় কথা বলত সে যুগে, যার সঙ্গে এ যুগের প্রায় কোন ভাষারই মিল পাওয়া যায় না। তাদেরই মধ্যে একটি পরিবার ছিল যারা এমে-ঙির ভাষা বললেও বাড়িতে স্তেপ বলত ওরা। মনে হয় ওদের পূর্বপুরুষ কাজাখস্তান থেকে ঘোড়া বিক্রি করতে এসেছিল কোনোকালে, পাকেচক্রে সুমেরে রয়ে গেছে। তাদের বাড়ির মেয়ে ইয়াম্নায়া ছিপছিপে সুন্দরী, কেমন করে যেন দিমিত্রিকে পছন্দ করে ফেলল। কাজাখদের মত নাক সামান্য চ্যাপ্টা হলেও দিমিত্রির মন জয় করেছিল ওর ঘোড়ার পিঠে চড়ে ইকোয়েস্ট্রিয়ান খেলাগুলো। ওর বাবা নুরিক যখন ভিষম আর মিল্লার ঘোড়ার মধুমেহের চিকিৎসার গল্প শুনত দিমিত্রির কাছে, মেয়ে কথা শোনার চেয়ে বেশি দিমিত্রিকেই দেখে যেত। নুরিকেরও যেন মনে হত ওরা একে অপরের জন্যেই তৈরি তাই ওদের মেলামেশায় কোন বাধা দেয় নি। ওরা নুরিকের জমিরই এক কোণে বাসা বেঁধে আছে, এমন সময় কার্লোভ হাজির।

'কী খবর রে, এত অস্থির লাগছে কেন তোকে'- উদ্বিগ্ন প্রশ্ন দিমিত্রির।
'খুব মন খারাপ করছে রে হীরের জন্যে। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই শুনি......।'
'কী? হীর ডাকাডাকি করছে?' হেসে ওঠে দিমিত্রি। হাসি ফোটে ইয়াম্নায়ার মুখেও।
'না রে, শুনি একটা বাচ্চার কান্না।' এবার আর হাসতে পারে না দিমিত্রি। বলে, 'তাহলে তোর একবার যাওয়া উচিত। তবে এবার আর একা নয়, পুরো দলবল নিয়ে যাওয়া যাবে।'

ব্যস, এটুকুই শোনার ছিল। দলবল জোগাড় শুরু হয়ে গেল। কার্লোভের মনে পড়ল হীর বলেছিল কিছু ঘোড়া নিয়ে যেতে ওদের দেশের যুবকদের জন্যে। ঘোড়া বিনা দামে কেউ দেবে না, তবে ধার করে নিয়ে যাওয়া যায়, প্রতিদানে কিছু নিয়ে আসতে হবে সেখান থেকে। এছাড়া অন্য বেশ কিছু ব্যবসার লোভ দেখাতে হবে সঙ্গীসাথীদের, নয়ত তারা কী লোভে যাবে এরকম একটা দূরদেশে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। কী নিয়ে যেতে পারা যায় সেখানে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিল ওরা বন্ধুরা মিলে।
'ঘোড়া তো বটেই, উট মেহরগড়ে নেই বললেই চলে। শিবিতেই যা দু-চারখানা উট দেখেছি। আর শষ্য? ছোলা, যব আর গম তো ওদেরও আছে। শুকনো খেজুর, মটর, অরহর আর সর্ষে নিয়ে যাওয়া যায়।'
'কিছু মুরগি নিয়ে গেলে হয় না?' ইয়াম্নায়া শুধোয়।
'তাইতো! আমরা ওখানে পোষা মুরগি দেখিনি। সর্ষের তেলও দেখিনি। তার বদলে বরং গরু-বলদ, গাধা, ভুট্টা আর রসুন-পেঁয়াজ নিয়ে আসা যাবে'- দিমিত্রি বলে। কিন্তু মোরগ কি তিনমাস বেঁচে থাকবে?'
'তুই ভুলে যাচ্ছিস যে আমরা আর্মানি থেকে নয় সুমের থেকে যাচ্ছি, তারপর রাস্তা এখন চেনা। তাই তিনমাস নয় এক থেকে দেড়মাস লাগবে এবার;- কার্লোভ বলে।
এর মধ্যে দুই বন্ধু আর ইয়াম্নায়া মিলে ঘুরে বেড়িয়েছে সুমেরের পথে পথে। দেখেছে সেখানে কী আছে যা মেহরগড়ে নেই আর কী আনা যায় সেখান থেকে। এরা চাষবাসে সত্যিই খুব উন্নতি করেছে।  সেচ ব্যবস্থাটা প্রথম এখানেই দেখে ওরা, দেখেছে কিভাবে ইউফ্রেটিসের থেকে খাল কেটে জল দেওয়া হচ্ছে ক্ষেতে ক্ষেতে, যব-গম-মটর-অরহর শষ্য ছাড়াও কেমন শিম, লেটুস, পালং, সর্ষের চাষ হচ্ছে, আপেল, খেজুর, তরমুজ আর ডুমুর ফলছে রাশি রাশি। গত বছর কাঠের লাঙ্গল তৈরি করে পাথরের ফলা বসিয়ে কর্ষণের পদ্ধতি শিখিয়েছিল ওরা স্থানীয় বাসিন্দাদের। কর্মঠ সুমেরীয়রা এক বছরের মধ্যেই প্রায় শ'দুই লাঙ্গল তৈরি করে ফেলেছে, ইদানীং এক কারিগর তার কয়েকটাতে একজোড়া করে কাঠের চাকাও লাগিয়ে ফেলেছে। তবে গরুর অভাবে বড় ছাগল আর ঘোড়া দিয়েও কাজ চালাতে হয় মাঝে-মধ্যে , অবশ্য নরম মাটিতে দু'জন মানুষই যথেষ্ট। শ্লাভ যাযাবরেরা একবার নিয়ে এসেছিল আখের বীজ, এরা আখের চাষেও সফল হয়েছে, তার রস বের করে গুড় তৈরিও শিখেছে।

     (ইউফ্রেটিস নদীর তীরে চাষ-বাস)

শেষ মুহূর্তে ইয়াম্নায়া বেঁকে বসল, বাপকে ছেড়ে সে নড়বে না। অগত্যা দিমিত্রিও যাবে না। তবে ঠিক হল যাবে তার ভাই মিখাইল আর বোন হানোভা। পঁচিশ জন স্ত্রী-পুরুষ, নানাধরণের শষ্য আর শিল্পকলার সম্ভার, চল্লিশটা ঘোড়া আর দশটা উট নিয়ে ওরা রওনা হল ফসল কাটার পর পাতা ঝরার ঋতু শুরু হতেই যাতে শীতের মাঝামাঝি পৌঁছে যেতে পারে মেহরগড়ে।



(১২)

শীতের মাঝামাঝি বোলানের তীরে একটা টিলার উপর দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল হুমড়া। নজরে পড়ল গিরিবর্ত্মের ওপারে দূরে তোবা কাকাড় পর্বতশ্রেণীর লো-নেকান পাহাড়ের মাথায় বরফ জমেছে। জার্ঘন-ঘর পাহাড়ে তেমন বরফ জমে না, সেখান থেকেই তুষার-চিতা নেমে এসে মেরে ফেলেছিল জালানকে। অবশ্য ওরা নদী হয়ত পেরোতে পারবে না। এইসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল উফ্‌রা গ্রামের একটি রাখাল ছেলে টিলার ওপাশের ঘাসে ছাওয়া মাঠ থেকে একটা মোষের পিঠে চেপে দ্রুত আসছে। হুমড়া ততক্ষণে নেমে এসেছে টিলা থেকে। ওকে দেখেই রাখাল ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে যা বলল তার মর্মার্থ হচ্ছে যে সাবধান হুমড়া ভাই, বোলান পাস দিয়ে দ্রুত নেমে আসছে একদল অশ্বারোহী সেনা, কয়েকটা উটও আসছে পিছু পিছু।
হুমড়ার বিশ্বাস হয় না, কী দেখতে কী দেখেছে ছোঁড়া। 'অ্যাই সত্যি করে বল তো কাদেরকে দেখলি? বানজারার দল নয় তো?'
'না গো। বানজারারা মাথায় এত সুন্দর টুপি পরে না। বাকি পোষাক তো দেখতে পাইনি দূর থেকে, তবে টুপিগুলো তোদের সেই পরদেশী বন্ধুদুটার মতই।'
এবার সত্যি চিন্তায় পড়ে গেল হুমড়া। সেও ছুটল তন্দুকে খবর দিতে।

ঘণ্টাদুই পরে জনাপঞ্চাশেক যুবক সঙ্গে তির-ধনুক নিয়ে ছুটল নদীর ধার ঘেঁসে। পাহাড়ের ধার দিয়ে চলেছে সংকীর্ণ গিরিপথ। ওরা পাহাড়ের উপর এক এক করে চড়ে গেল, অশ্বারোহী দলটাকে এই পাহাড়ের নীচ দিয়ে যেতেই হবে, তখনই তির ছুঁড়বে ওরা। তবে একটা বাঁক পেরিয়ে পাহাড়ের একদম নীচে আসার আগেই আক্রমণ করতে হবে, নইলে সব তিরই শিরস্ত্রাণে গিয়ে আঘাত করবে। এদের ঘোড়া না থাকতে পারে, তা বলে দুর্বল নয় কেউই।
টগবগ, টগবগ...এগিয়ে আসছে পুরো দলটা। তন্দুরাও ধনুক বাগিয়ে তৈরি। হঠাৎ এ কী! কে ছুটে আসছে উলটো পথ ধরে! হীর না? হ্যাঁ, হীরই তো। ইশারায় সবাইকে ধনুক নামাতে বলল। ওই তো ঘোড়সওয়ারের দলটা এসে পড়েছে। ওদের দলের সবচেয়ে সামনে যে ছিল সে নেমে পড়েছে ঘোড়া থেকে। তারপর এগিয়ে গেল হীরের দিকে। একি কাণ্ড! হীর কি একাই লড়বে এতগুলোর সঙ্গে, তাও খালি হাতে? দেখা যাক কী হয়, রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকল সবাই।
কিন্তু না, সে রকম কিছুই ঘটল না। বরং দেখা গেল বিদেশী যুবকটি এগিয়ে এল হীরের দিকে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরল গভীর উচ্ছ্বাসে, কার্লোভকে চিনতে পেরে আনন্দে চিৎকার করে উঠল তন্দু আর তার দলবল। এই ঐতিহাসিক পুনর্মিলনের সাক্ষী থাকল গ্রামের পঞ্চাশটি যুবক। ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এল সবাই।

ঘন্টা দুই পরে গ্রামের লোক সবিস্ময়ে দেখল অশ্বারোহী দলটাকে...না, বন্দী করে নয়, বন্দী হয়েও নয়, মহাসমারোহে হই-হুল্লোড় করে নিয়ে আসছে উফরা গ্রামের জোয়ানরা। আজ এখানে আনন্দ-উৎসব। কার্লোভ এসেছিল হীরের টানে, হীর ফিরে পেল তার কার্লকে আর ওরা সংযোজন করল মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন শব্দ- ভালবাসা, প্রেম।
আরো চমক অপেক্ষা করছিল যখন দুলিয়া একটি শিশুকে কার্লোভের কোলে তুলে দিল। এ কি! এই তো সেই শিশু যাকে ও এতদিন ধরে স্বপ্নে দেখে এসেছে! পরিচয় দিতে হল না, শিরায় শিরায় যে আছে পরিচিতির ধারা, আরও দুটো শব্দ যোগ হল প্রাকৃত-ভাষার অভিধানে- পিতৃস্নেহ আর আনন্দাশ্রু।


উপসংহার।

মিখাইল আর হানোভার বেশ ভাল লেগে গেছে এই অঞ্চলটা। এখানে পাহাড়, নদী, ঘাসে ছাওয়া মাঠ, জঙ্গল, সবই আছে। মানুষজন সরল, সুমেরীয়দের মত বুদ্ধিমান না হলেও, পরিশ্রমী আর সুগঠিত দেহের অধিকারী প্রায় সকলে। উট আর ঘোড়াগুলোর জন্যে দরদস্তুর হল, ঠিক হল যতজন উরুক ফিরবে সেই হিসেবমত ঘোড়া ফেরত যাবে, বাকি রয়ে যাবে মেহরগড়ে। উট সবকটাই রেখে যাবে তারা। এরা কেউ সুমের এমে-ঙির ভাষা বোঝে না, তাই কার্লোভই গ্রামের মাতব্বরদের ডেকে শিক্ষা দিতে লাগল খাল আর নালা-ভিত্তিক সেচ প্রণালীর, সর্ষের চাষ আর তেল নিষ্কাশনের পদ্ধতি, সর্ষে আর তিসির তেলের ব্যবহার, মরা জন্তুর হাড়ের অলঙ্কার আর অস্ত্র ছাড়াও সেই হাড়ে দাগ কেটে সুমেরীয় সংখ্যা-গণন পদ্ধতি আর মুর্গি-পালন। এত কিছু করার পরেও যে তারা একখানা সাঙ্ঘাতিক ভুল করে ফেলেছে সেটা জানতে পারল এতদিন।

একদিন আর্মানকে আদর করছে কার্লোভ, এমন সময় দুলিয়া বাচ্চাটাকে ওর কোল থেকে টেনে নিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠল- 'ওহে ঠাকুরজামাই, কিভাবে ছেলের বাপ হলে তুমি বল তো? এই নাকি তোমরা বুদ্ধির বড়াই কর!'
কার্লোভ অবাক। কী করল তারা আবার?
'তোমাদের দেশে বুঝি পুরুষ ঘোড়াতেও বাচ্চা দেয়? খেয়াল করে দেখেছ যে উনচল্লিশটা ঘোড়ার সবকটাই ছেলে, মাদী একটাও নেই?'
'তাইত! চল্লিশটা ঘোড়ার মধ্যে একটা পথে অসুখে মারা যায়। বাকি সবকটা পুরুষ! তাহলে তো আর বংশরক্ষা হবেনা তাদের! কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, ভবিষ্যতে দেখা যাবে।'

হাওয়ার দিক পাল্টেছে। পাহাড়ে একটা ভূমিকম্প হয়ে বোলান নদী তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, জল আর থাকে না সেরকম। কয়েকজন গ্রামবাসী ভাবছে সিন্ধুনদ ধরে উত্তরে চলে যাবে। ওদিকে হরপ্পা বলে একটা বিশাল সমতলভূমি আছে, পলিস্তরে তৈরি জমি খুবই উর্বর। তবে মটকুর এতে সায় নেই। ওরা খায় তো গম আর যব, কতটুকু জল লাগে তাতে। আবার এদিকে ভিষম বেশ অসুস্থ। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। খুব ইচ্ছে ছিল হুমড়াকে শিখিয়ে যান তাঁর অধীত বিদ্যা। তামা বা তামার গয়না, বাসন, মূর্তি, অস্ত্র গ্রামের আরো কয়েকজন শিখে ফেললেও পেতল, কাঁসা, ব্রোঞ্জ আর কেউ পারে না। কিন্তু হুমড়ার এদিকে মন নেই, সে মজেছে আরেক বিদেশিনীতে- মেয়েটি দিমিত্রির বোন হানোভা। এদিকে হানোভা বাপ-মা ছেড়ে এখানে বরাবরের জন্যে থাকতে রাজি নয়, ফলে হয়ত হুমড়াও ছুটবে ওর পেছনে। কার্লোভ মটকুর জন্যে নিয়ে এসেছে উন্নতধরণের কুমোরের চাক, হাঁড়ি-কলসি-বাটি-প্রদীপ এত সুন্দর গোলাকার হচ্ছে, বাজারে তাদের চাহিদা খুব বেড়ে গেছে। কিন্তু তাঁর এই বিভিন্ন বিষয়ে অসীম জ্ঞানভাণ্ডার কাকে দিয়ে যাবেন ভিষম, এই অমূল্য সম্পদের যোগ্য উত্তরাধিকারের কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মাথা ঘুরে ওঠে, একটা আর্তনাদ করে পড়ে যান তিনি।

বেশ ভিড় জমেছে আজ ভিষমের উঠোনে। মিল্লা বারবার নাড়ি দেখছেন। শেষে হাল আর হাত দুটোই ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। সিন্ধুপারের মেহেরগড়ে সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, হঠাৎ তাকে একটা গোলাকার ছায়া এসে ঢেকে দিল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সভ্যতার গ্রহণের দিন বুঝি শুরু হল। 


 
(উত্তর সুমেরের অসুর অঞ্চলে প্রথম গ্রামভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠলেও এশিয়ার প্রথম সভ্য শহর সম্ভবতঃ দক্ষিণ সুমেরের ইউফ্রেটিসের তীরে উরুক। সিরিয়ার দামাস্কাস, টাইগ্রিসের তীরে বোগদাদ আর গঙ্গাতীরের কাশী শহরের পত্তন অন্ততঃ আরো পাঁচশো বছর পরে হয়।)

সমাপ্ত।।

   

No comments:

Post a Comment