Saturday, August 22, 2020

ঈশ্বর-দর্শন। (বিশেষ রচনা)

ঈশ্বর-দর্শন।
(বিশেষ রচনা)

খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক সন্তোষ সেনগুপ্ত তাঁর ‘আমার সঙ্গীত ও আনুষঙ্গিক জীবন’ বইয়ে গ্রামোফোন কোম্পানির একজন বড়কর্তা হিসেবে লিখেছেন, "কমবয়সে দেবব্রত বিশ্বাসের গলা এমন একটা দরাজ, বিশাল আর সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল যে গ্রামোফোন কোম্পানির বাপের সাধ্যি নেই তা রেকর্ডে ধরে রাখে।”

তাহলে তো লাইভ শুনতে হয়। আমাদের অল্পবয়সে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। কিন্তু ঈশ্বরকে পাই কোথা? ভাবতাম কলকাতার বাসিন্দারা ভাগ্যবান, চাইলেই তাঁকে দেখতে পান। আমি থাকি অনেক দূরে, জানিনা ভগবানের ঠিকানা। তাছাড়া খবর পেয়েছি যে তিনি তখন ব্রাত্য, তাঁকে গান গাইতে দেওয়া হয় না, ১৯৭১ সাল থেকে তিনি আর রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন না, জলসায়-অনুষ্ঠানে যান না। ভাবতাম এটা কি ইংরেজ শাসনের প্রলম্বন, যে সম্ভাবনার কথা নজরুল লিখে গেছিলেন তাই কি সত্যি হল!
'হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি, সর্বনাশী শেখায় এ হীন তথ্য কে রে?'
তাহলে? ১৯৭৮এ হঠাৎই সুযোগ হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখতে যাওয়ার, আমাদের এক বন্ধুর হোস্টেলের অতিথি হয়ে। অজয়-ময়ূরাক্ষী-দামোদরের বন্যার বছর সেটা, বাসে ইলামবাজার পেরোবার সময় গাছের ডালে গরুর কংকাল ঝুলতে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। সেদিন ৭ই পৌষ সন্ধ্যেয় মেলা তখনও জমে নি তেমন। ফেরার পথে স্টেট ব্যাঙ্কের দরজার মুখে সিঁড়িতে এক মাতালকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। বন্ধু বলল, প্রণাম কর, ইনি রামকিংকর বেইজ। সত্যি, কি নেশা আছে এখানকার জলে-হাওয়ায়-মাটিতে দুনিয়ার যত পাগল-মাতাল-নেশাখোর বলরামের চেলারা ভীড় করেছেন এখানে। আমাদের এই ভগবানও তো পাগল, বুঁদ হয়ে আছেন এক অনন্য নেশার বন্ধনে, তার নাম রবি ঠাকুরের গান।
সকালে পৌষালু শীতের কবল থেকে বেরোতে একটু সময় লেগে গেল। মেলার মুখে দেখি আরে, রবি ঠাকুর বেহালা নিয়ে বসে বাজাচ্ছেন- 'তোমার খোলা হাওয়া'। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, ইনি রবি ঠাকুর হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। ইনি হয়ত দাদাঠাকুর বা ধনঞ্জয় বৈরাগী বা 'অচলায়তন' ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই গুরু। বিশ্বভারতীর স্টলে দূর থেকে দেখছি খুব ভীড়। একজন গেরুয়া পরা ভদ্রলোক খোলা গলায় গাইছেন-
"কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সংকেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।"
মনে হল এই শীতের সকালে যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। না, কাছে গিয়ে দেখি সুচিত্রা মিত্র আর অশোকতরু বসে আছেন। জানা গেল, দেবব্রত বিশ্বাস এইমাত্র স্টল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, ঈশ্বরকে পেতে যে সাধনার প্রয়োজন তা হয়ত আমার ছিল না।

No comments:

Post a Comment