Monday, August 14, 2017

জিলিপি-রসকাব্য।।

জিলিপি-রসকাব্য।।

বহুদিন ধরে ফেসবুক পরে ছিনু আমি তব ভরসায়,
দিল টিম সুকুমার রায়।
যে রাজা বাদামভাজা খেতো শুধু
প্রখর তপনে বুক করে ধূ-ধূ,
সে পায় যখন প্যাঁচে প্যাঁচে মধু
আর থাকে সে অপেক্ষায়?
আজ শুধু সে জিলিপি খায়।

লিখতে যখন হবেই তখন কেন আর মিছে ভাবব,
জিভে জল নিয়ে তাই লিখে চলি জিলিপির মহাকাব্য।
নাকপুর থেকে কানপুর
রসে রসে টইটম্বুর,
শিশি আঁটি ছিপি ভরি মিসিসিপি লিখি জিলিপির লিপি তাই
এ জিনিষ খাঁটি দিশি ভাই।

ময়রা-পাচক নিতাই-গৌর বলেছেন কবি নজরুল
Knows rule, তাই জানেন তো তিনি সব রুল।
ঠাকুর পরমহংস
নরদেহে দেব-অংশ,
অতি সাদা মন, নেই কোনও প্যাঁচ, তবু এ প্যাঁচালো রসধর
'লাটসাহেবের গাড়ি' বলে তারে দিয়েছেন নব সমাদর। 



Sunday, August 13, 2017

ছড়া- অদ্ভুতুড়ে বিয়ে।

"অদ্ভুতুড়ে বিয়ে"
শ্যাওড়াফুলির ক্যাওড়াতলায় থাকত সে এক পেত্নি,
সম্পর্কে বেতাল ভাটের হত সে যে নাতনী।
পড়শি ছিল কারিয়া পিরেত
মাথাটি তার নয়কো নিরেট
স্বপ্ন দেখে একদিন সে করবে তাকে পত্নী।
সংকল্পখানা সে যে রেখেছিল প্রায় গুপ্ত,
ক্রমে ক্রমে ইচ্ছেটা তার রইল না আর সুপ্ত।
ভাবতে থাকে কিভাবে সে তার
কার্যখানা করে উদ্ধার,
পেত্নিরে সে পত্নী করে হবেই অবলুপ্ত!
ছিরামপুরের গাঙ্গের ধারে মস্ত ছিল খামার
সেইখানে তার বন্ধু ছিল রমাকান্ত কামার
উল্টোলে তার নামের আদল
একই থাকে, হয়না বদল,
ভূত হয়ে তাই রইল মানুষ মতন তোমার-আমার।
এক সন্ধ্যেয় পেত্নিটা যার নামটি ছিল ন্যাকা
কারশেডের ওই নোংরা ডোবায় ধুচ্ছিল গা একা।
এমন সময় রমাকান্ত
ভূত হয়ে যে ছিল জ্যান্ত,
চাপল ঘাড়ে, বুঝল না কেউ, যায় না তাকে দেখা।
কি হল ছাই কেউ বোঝেনা, রমাকান্ত কামার
ন্যাকার ঘাড়ে চড়ে কেবল গাইতে থাকে ধামার,
সবাই বলে কাণ্ডটা কি?
ন্যাকার হল বিকার নাকি!
ভূতের দেশে আমদানি কে করল সারেগামার?
কি যে হল ন্যাকারানীর কেউ পারেনা বুঝতে
গেছো-মেছো-মামদো-নিশি ব্যস্ত সবাই খুঁজতে।
হাফ-ভূতকে যায়না দেখা,
পিঠের ব্যথায় মরছে ন্যাকা,
কাণ্ডটা কি জানলে তবেই পারবে কি না যুঝতে!
এমন সময় কারিয়া পিরেত হাজির চেপে প্যাঁচায়,
বললে, ওহে মেয়েভূত কি এমনি করে চেঁচায়?
মানুষ কাঁধে ভর করেছে,
ন্যাকা বুঝি প্রায় মরেছে,
আমি ছাড়া আর কে আছে পেত্নিকে আজ বাঁচায়!
সবাই মিলে ধরল তাকে, ‘কারিয়া প্রেত ওরে,
জানিনা এই পেত্নিটাকে কে রয়েছে ধরে।
তুই যদি তোর বিদ্যে দিয়ে
ন্যাকাকে আজ দিস বাঁচিয়ে
তোর সাথে ওর দেবই বিয়ে, দেখি কে কি করে!’
কারিয়া শুনে বুক ফুলিয়ে বললে ‘ওরে কামার,
শোনরে ব্যাটা, আদেশ দিলাম ঘাড় থেকে ওর নামার।‘
মুচকি হেসে আসলো নেমে
দেখল সবাই শ্বাসটি থেমে,
রমাকান্ত বলল ‘ওরে, ন্যাকা এখন আমার’।
কাণ্ড দেখো, ন্যাকা এখন হেসেই কুটিকুটি
রমাকান্তের সাথে কেমন করছে সে খুনসুটি।
বললে, ‘ওগো কারিয়া প্রেত,
বন্ধু তোমার মানুষটা গ্রেট,
মোদের হল মালা বদল, তোমার এবার ছুটি’।

Thursday, August 10, 2017

বাংলা অণুগল্প- শিশুতীর্থ।

শিশুতীর্থ।।
((অণুগল্প)
'আবার সেই পাগলিটা এসেছে স্যার', গগৈ চিৎকার করে, 'ভাত চাইছে'।
'বেশ্যা মাগী!' ঘেন্নার সাথে নাক কুঁচকোন ফীল্ড ইনচার্য অনুপ কর্মকার। 'যা ভাগ, এখান থেকে।'
পাগলি নড়ে না। হয়ত নড়তে পারে না।
'যাবে কি করে', ডেটোনেটার-ম্যান মুন্সী বলে, 'ওর ত এখন দুটো খাবার লোক', বলে পাগলির পেটের দিকে ইশারা করে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করে সে।
'কোন হারামির কাজ এটা?' এবার সত্যিই রেগে ওঠে্ন অনুপ। যদিও তিনি জানেন যে পাগলিটার অসহায়তার সুযোগ নিয়েছে অনেকেই দু'মুঠো ভাত আর দু-এক বোতল হাঁড়িয়ার বিনিময়ে। কিন্তু এখন সে কথা কে আর স্বীকার করবে। রাগে ঘেন্নায় ক্যাম্প ছেড়ে জীপ নিয়ে ফিল্ড অফিসের দিকে বেরিয়ে পড়েন অনুপ।
আসামের কাছাড় অঞ্চলের সোনাই নদীর তীরের জঙ্গলে ঘেরা দুর্গম অঞ্চলে তাঁবু পেতেছে সরকারি সিস্মিক সার্ভের দলটি। দীর্ঘকাল ধরে স্ত্রী-সংসর্গ বহির্ভূত লোকগুলি মাঝে মাঝে একটু উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ে, সমর্থন না করলেও কিছু করার থাকে না অনুপের। তবে এবার একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে ওরা। একটা মানসিক সন্তুলনহীন মেয়েকে, তায় আবার জাত-পাঁতের ঠিক নেই, ছি ছি।
মাসদুই পরে কিন্তু অবস্থা সঙ্গীনের দিকে মোড় নিল। 'স্যার পাগলিটা মরতে বসেছে'- ক্যাম্প-বস গগৈ খবর দিল। 'গ্রামে ধাই আছে কেউ? চলতো আমার সাথে', জীপে গগৈকে বসিয়ে রওনা দিলেন অনুপ।

*    *     *     *
'বাবা, একটা পাগলি এসেছে বাইরের রাস্তায়। হি হি, কেমন নাচছে ধেই ধেই করে।' ছেলে তীর্থ বাইরে থেকে এসে বলে। ভারি আমোদ তার।
'তীর্থ!' ধমকে ওঠে অনুপ। নিষ্পাপ শিশু, কাকে কি বলতে হয় জানেনা। তাঁর মনে পড়ে যায় দশ বছর আগেকার আর এক মৃত্যুপথযাত্রী পাগলির আকুল মিনতি, 'ছাহেব, আমার পোলাডারে দ্যাহেন'।তখন তার কথায় পাগলামির আর কোনও লক্ষণ নেই। নরকের জীব বলে ঘৃণা করলেও অসহায় মেয়েটির কথা ফেলতে পারেননা তিনি!

বিয়ে আর করা হয়ে ওঠেনি। বিশ্বের বিষ কণ্ঠে নিয়ে নীলকণ্ঠ হয়েছেন অনুপ কর্মকার, শিশুতীর্থে অবগাহন করে তবু তিনি তৃপ্ত

Pallab Kumar Chatterjee
8th October, 2017

হাল্কা রঙ্গরস।

রবি ঠাকুরের দুঃখ।।
হাঁদা।। বুঝলি ভোঁদা, রবি ঠাকুরের কিছু গানের না কোন মানেই হয় না।
ভোঁদা।। সেকি রে, কোন গানের কথা বলছিস?
হাঁদা।। এই দেখ না, 'ও কেন চুরি করে চায়?' যদি চাইবেই তবে চুরি করবে কেন? না চেয়ে নিলে তবেই না চুরি করা হয়!
ভোঁদা।। দূর বোকা, এ চাওয়া সে চাওয়া নয়। চাওয়া মানে তাকানো। একটা গান আছে না-'আমার পানে চেয়ে চেয়ে সুখী থাকো'।
হাঁদা।। বলছিস! তাহলে এটা কি? 'ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন!' এ্রর দিকে তাকিয়ে বেদুইন হতাম?
ভোঁদা।। না রে বোকা, ওটা তুলনা বোঝায়, বা comparison।
হাঁদা।। তাই কি? আবার চীন দেশ যাবার সময় লিখেছিলেন- 'যেতে যেতে চায়না যেতে, ফিরে ফিরে চায়'। যাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না বোধহয়।
ভোঁদা।। না রে হাঁদা। আমার মনে এসব গান তিনি চায়ের তেষ্টায় লিখেছিলেন। মস্ত চা-খোর ছিলেন কিনা! ভেবে দেখ, বেলা ফুরোয়- চা আসে না। উনি লিখলেন- 'ফুরাতে চায় না বেলা, তাই সুর গেঁথে খেলা'। কিম্বা 'প্রাণ চায়, চক্ষু না চায়'- প্রাণ চা খাবে, চোখে দেখা নেই চায়ের।
সেই দুঃখ মেটাতেই তো বিষ্ণুর চায়-ওয়ালা অবতার ধারণ!!!

সত্য ঘটনা অবলম্বনে। জয়সীয়ারাম স্কুল।।

জয়সীয়ারাম স্কুল।।
হরিদ্বার বা প্রয়াগের কুম্ভমেলায় যখন দলে দলে সম্পূর্ণ নগ্ন বা সামান্য কৌপীনধারী সাধু-সন্ন্যাসিদের মিছিল চলে, দেখে মন নিমেষের জন্যে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি আবেগে ভরে ওঠে। পরক্ষণেই খেয়াল হয়, মনুষ্যশক্তির কি অপব্যবহার! এঁরা সংসারহীন সর্বত্যাগী, চাইলে নিরর্থক ঈশ্বরসেবার ফল মোক্ষলাভের বদলে সবাই মিলে দেশের হালটাই বদলে দিতে পারতেন। এঁদের মধ্যে আবার গা-ঢাকা দিয়ে অনেক ফেরারি অপরাধীও লুকিয়ে থাকে, কারণ এ দেশে সন্ন্যাসী সেজে অনায়াসে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া যায়।
আজ আমি যে কথা ভাবছি, আজ থেকে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগেই সেরকম কিছু একটা ভেবেছিলেন এক দলছুট সন্ন্যাসী শ্রী রাঘবানন্দ বা রামসাধু। উনি একদা উপলব্ধি করেন যে নিজের মুক্তিতে প্রকৃত আনন্দ নেই, যদি না অন্যকেও সে ফলের ভাগ দেওয়া যায়। কিন্তু কিভাবে? উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি একদিন এসে উপস্থিত হন পুরুলিয়া জেলার ঝালদা থানার তুলিন গ্রামে। এই তুলিন পুরুলিয়া-রাঁচী রোডের উপর এখন একটি ছোটখাটো শহরের মতো মনে হলেও ১৯৫২-৫৩ সালে এটি ছিল একটি দারিদ্র্য-নিষ্পীড়িত অজ পাড়াগাঁ। তবু সন্ন্যাসী গ্রামের এক কোনে ধুনী জ্বেলে বসলেন। মুখে তাঁর রামনাম, উদ্দেশ্য সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের গ্রামে গ্রামে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করার। সবার মধ্যে তিনি দেখতে পান ঈশ্বরকে, সবাই ভগবান। সন্ন্যাসী এসেছেন খবর পেয়ে গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝেই এসে ফল-মূল, টাকাটা-সিকেটা দিয়ে যান। নিজে নাকি নিমপাতা ছাড়া আর কিছুই খেতেন না, কিন্তু সাধুবাবা সবাইকে আহ্বান জানাতেন, 'আও আও, গাঁওবালে ভগবান, জয় সীয়ারাম'। কুশল শুধোতেন- 'ভোজন কিয়া না ভগবান? ইয়াদ রাখো, পহলে অপনা শরীর, ফির সাধু-মহাত্মা কি সেবা।' তারপর শোনাতেন রহিমের দোহা-
'সাঁই, ইতনা দীজিয়ে, জামাই কুটুম সমায়,
ম্যয় ভী ভুখা না রহুঁ, সাধু না ভুখা যায়।'
অশিক্ষিত গ্রামবাসী কি বোঝে তুলসী আর কি রহিম! তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। 'কিছু বুঝলে ভগবান?'- তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চায়- 'মুরখ বটি ঠাকুর'।
তাইত! রামসাধু ভাবেন, এরা তো লেখাপড়া কিছুই শেখে নি। বয়স্কদের নাহয় জীবনের শেখার সময় অনেকটা পার হয়ে এসেছে, তাই বলে শিশুরা পড়াশোনা করবে না, তা কি করে হয়। গ্রামে তো একটা পাঠশালাও নেই। তিনি সময় করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ডেকে অ-আ-ক-খ পড়ান, যেটুকু বাংলা জানেন। 'বাচ্চা ভগবান, পঢ়াই করো, তবে তো অসলি ভগবান কো জানবে।' সন্ধ্যার পর বয়স্ক ভক্তেরা এলে তাদের শোনাতেন তুলসী রামায়ণ, সুরদাসের পদ আর কবীরের দোহা, গিরিধরের কুণ্ডলী। ধীরে ধীরে রাঘবানন্দ বা রামসাধু ঐ অঞ্চলের একটি চলমান কিংবদন্তীতে পরিণত হলেন।
সাধুবাবার মনে তবু সুখ নেই। এই অঞ্চলে যদি একটা স্কুল খোলা যেত! কিন্তু কপর্দকশূন্য সন্ন্যাসীর কাছে এ স্বপ্ন বোধহয় অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। তিনি অবশ্য হাল ছাড়েন না, বিডিও, কালেকটার, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ছুটে ছুটে যান। তাঁরা মুখে আশার কথা শোনালেও বাস্তবে কেউ কিছু করেন না। তখন মানভূম জেলা পুরোটাই বিহারে, তবু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এসেছেন মানভূমের অধিবাসী বাঙ্গালিপ্রধান অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করতে, সাধুবাবা খবর পেয়ে ঝালদায় ছুটে গেছেন তাঁর কাছে। 'মন্ত্রী ভগবান, বাচ্চোঁ কে লিয়ে কুছ করো।' মুখ্যমন্ত্রী বললেন, 'সাধুবাবা, বাংলায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে, আমি নিজেই ত্রাণের জন্যে টাকা সংগ্রহ করছি। তাছাড়া, আমি তো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী, বিহারে স্কুল খুলব কিভাবে?' তখন রামসাধু নিজস্ব ভিক্ষালব্ধ সঞ্চয় উজাড় করে দিলেন ডাঃ রায়ের হাতে- 'তব ইয়ে ভি লে যাও ভগবান! জনতা ভগবান কা ত্রাণ করো।' ঐ সামান্য টাকায় কি আর বিদ্যালয় স্থাপনা হবে!
১৯৫৬তে পুরুলিয়া বাংলায় আসার পর আবার তুলিন সফরে এসেছেন ডাঃ রায়। জনতা তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে রাঘবানন্দের কুটিরে। মন্ত্রী এসেছেন, বাবার তো খুশী আর ধরে না। 'মন্ত্রী ভগবান, অবতো স্কুলঠো কর দো' আর্জি জানালেন এবার। আর না করতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষাসচিব ডিএম সেনকে যথাবিধি নির্দেশ দেওয়ায় তুলিনে বছরখানেকের মধ্যেই চালু হল- 'জয়সীয়ারাম উচ্চ বিদ্যালয়।'
কে এই সন্ন্যাসী, কোথায় তাঁর বাসা, কি তাঁর আসল পরিচয় কিছুই আমরা জানিনা- শুধু জানি যে একটি স্ফুলিঙ্গ যদি যথাস্থানে গিয়ে পড়ে তবে তার থেকে দাবানল ঘটানোও সম্ভব। তাই তিনি এই দরিদ্র জেলার পশ্চাৎপদ একটি গ্রামের শিক্ষার বিকাশের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে তাঁকে, তাঁর অবদানকে একবার স্মরণ করতেই পারি।
(তথ্যসূত্রঃ শ্রী দিলীপকুমার গোস্বামী)