জয়সীয়ারাম স্কুল।।
হরিদ্বার বা প্রয়াগের কুম্ভমেলায় যখন দলে দলে সম্পূর্ণ নগ্ন বা সামান্য কৌপীনধারী সাধু-সন্ন্যাসিদের মিছিল চলে, দেখে মন নিমেষের জন্যে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতি আবেগে ভরে ওঠে। পরক্ষণেই খেয়াল হয়, মনুষ্যশক্তির কি অপব্যবহার! এঁরা সংসারহীন সর্বত্যাগী, চাইলে নিরর্থক ঈশ্বরসেবার ফল মোক্ষলাভের বদলে সবাই মিলে দেশের হালটাই বদলে দিতে পারতেন। এঁদের মধ্যে আবার গা-ঢাকা দিয়ে অনেক ফেরারি অপরাধীও লুকিয়ে থাকে, কারণ এ দেশে সন্ন্যাসী সেজে অনায়াসে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া যায়।
আজ আমি যে কথা ভাবছি, আজ থেকে প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগেই সেরকম কিছু একটা ভেবেছিলেন এক দলছুট সন্ন্যাসী শ্রী রাঘবানন্দ বা রামসাধু। উনি একদা উপলব্ধি করেন যে নিজের মুক্তিতে প্রকৃত আনন্দ নেই, যদি না অন্যকেও সে ফলের ভাগ দেওয়া যায়। কিন্তু কিভাবে? উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি একদিন এসে উপস্থিত হন পুরুলিয়া জেলার ঝালদা থানার তুলিন গ্রামে। এই তুলিন পুরুলিয়া-রাঁচী রোডের উপর এখন একটি ছোটখাটো শহরের মতো মনে হলেও ১৯৫২-৫৩ সালে এটি ছিল একটি দারিদ্র্য-নিষ্পীড়িত অজ পাড়াগাঁ। তবু সন্ন্যাসী গ্রামের এক কোনে ধুনী জ্বেলে বসলেন। মুখে তাঁর রামনাম, উদ্দেশ্য সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের গ্রামে গ্রামে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করার। সবার মধ্যে তিনি দেখতে পান ঈশ্বরকে, সবাই ভগবান। সন্ন্যাসী এসেছেন খবর পেয়ে গ্রামের লোকেরা মাঝে মাঝেই এসে ফল-মূল, টাকাটা-সিকেটা দিয়ে যান। নিজে নাকি নিমপাতা ছাড়া আর কিছুই খেতেন না, কিন্তু সাধুবাবা সবাইকে আহ্বান জানাতেন, 'আও আও, গাঁওবালে ভগবান, জয় সীয়ারাম'। কুশল শুধোতেন- 'ভোজন কিয়া না ভগবান? ইয়াদ রাখো, পহলে অপনা শরীর, ফির সাধু-মহাত্মা কি সেবা।' তারপর শোনাতেন রহিমের দোহা-
'সাঁই, ইতনা দীজিয়ে, জামাই কুটুম সমায়,
ম্যয় ভী ভুখা না রহুঁ, সাধু না ভুখা যায়।'
অশিক্ষিত গ্রামবাসী কি বোঝে তুলসী আর কি রহিম! তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। 'কিছু বুঝলে ভগবান?'- তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চায়- 'মুরখ বটি ঠাকুর'।
তাইত! রামসাধু ভাবেন, এরা তো লেখাপড়া কিছুই শেখে নি। বয়স্কদের নাহয় জীবনের শেখার সময় অনেকটা পার হয়ে এসেছে, তাই বলে শিশুরা পড়াশোনা করবে না, তা কি করে হয়। গ্রামে তো একটা পাঠশালাও নেই। তিনি সময় করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ডেকে অ-আ-ক-খ পড়ান, যেটুকু বাংলা জানেন। 'বাচ্চা ভগবান, পঢ়াই করো, তবে তো অসলি ভগবান কো জানবে।' সন্ধ্যার পর বয়স্ক ভক্তেরা এলে তাদের শোনাতেন তুলসী রামায়ণ, সুরদাসের পদ আর কবীরের দোহা, গিরিধরের কুণ্ডলী। ধীরে ধীরে রাঘবানন্দ বা রামসাধু ঐ অঞ্চলের একটি চলমান কিংবদন্তীতে পরিণত হলেন।
সাধুবাবার মনে তবু সুখ নেই। এই অঞ্চলে যদি একটা স্কুল খোলা যেত! কিন্তু কপর্দকশূন্য সন্ন্যাসীর কাছে এ স্বপ্ন বোধহয় অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। তিনি অবশ্য হাল ছাড়েন না, বিডিও, কালেকটার, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ছুটে ছুটে যান। তাঁরা মুখে আশার কথা শোনালেও বাস্তবে কেউ কিছু করেন না। তখন মানভূম জেলা পুরোটাই বিহারে, তবু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এসেছেন মানভূমের অধিবাসী বাঙ্গালিপ্রধান অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করতে, সাধুবাবা খবর পেয়ে ঝালদায় ছুটে গেছেন তাঁর কাছে। 'মন্ত্রী ভগবান, বাচ্চোঁ কে লিয়ে কুছ করো।' মুখ্যমন্ত্রী বললেন, 'সাধুবাবা, বাংলায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে, আমি নিজেই ত্রাণের জন্যে টাকা সংগ্রহ করছি। তাছাড়া, আমি তো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী, বিহারে স্কুল খুলব কিভাবে?' তখন রামসাধু নিজস্ব ভিক্ষালব্ধ সঞ্চয় উজাড় করে দিলেন ডাঃ রায়ের হাতে- 'তব ইয়ে ভি লে যাও ভগবান! জনতা ভগবান কা ত্রাণ করো।' ঐ সামান্য টাকায় কি আর বিদ্যালয় স্থাপনা হবে!
১৯৫৬তে পুরুলিয়া বাংলায় আসার পর আবার তুলিন সফরে এসেছেন ডাঃ রায়। জনতা তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে রাঘবানন্দের কুটিরে। মন্ত্রী এসেছেন, বাবার তো খুশী আর ধরে না। 'মন্ত্রী ভগবান, অবতো স্কুলঠো কর দো' আর্জি জানালেন এবার। আর না করতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষাসচিব ডিএম সেনকে যথাবিধি নির্দেশ দেওয়ায় তুলিনে বছরখানেকের মধ্যেই চালু হল- 'জয়সীয়ারাম উচ্চ বিদ্যালয়।'
কে এই সন্ন্যাসী, কোথায় তাঁর বাসা, কি তাঁর আসল পরিচয় কিছুই আমরা জানিনা- শুধু জানি যে একটি স্ফুলিঙ্গ যদি যথাস্থানে গিয়ে পড়ে তবে তার থেকে দাবানল ঘটানোও সম্ভব। তাই তিনি এই দরিদ্র জেলার পশ্চাৎপদ একটি গ্রামের শিক্ষার বিকাশের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে তাঁকে, তাঁর অবদানকে একবার স্মরণ করতেই পারি।
(তথ্যসূত্রঃ শ্রী দিলীপকুমার গোস্বামী)