Sunday, September 8, 2019

বাংলা গল্প- উৎকোচ-রহস্য।

উৎকোচ-রহস্য।।
(গল্প)
না, এটা কোনও গল্প নয়। একেবারে সত্যি ঘটনা, শুধু নামধামগুলো বদলে ফেলেছি। তখনো সাইবার যুগ আসেনি। ফলে ই-মেল, ইন্টারনেট, মোবাইল, ডাটাব্যাঙ্ক, ক্রেডিট কার্ড কিছুই ছিলনা। সব কাজের যোগাযোগ ছিল ডাক মারফৎ, আর লেনাদেন নগদে।
এরকম এক সময়ে আমার বদলি হয়েছে মুম্বাই থেকে আসামের শিলচরে। কিন্তু আমার স্কুটারের নো অবজেকশন একমাসের জায়গায় ছ'মাসেও এল না দেখে আমি পড়লাম মুস্কিলে। আইন অনুসারে তিনমাসের মধ্যে কনফার্মেশন না এলে ধরে নিতে হয় যে কাগজপত্র ঠিক আছে, আর-সি বই ট্রান্সফারে কোনও বাধা থাকে না। কিন্তু আইন থাকে আইনের জায়গায়। আমাদের দেশে বে-আইনি কাজকে আইনসম্মত করা সহজ, যত ঝামেলা আইন মেনে কাজ করতে গেলে। তবু আর-টি-ও অফিসে গিয়ে আবেদন জমা দিলাম। তিন-চার দিন পরে ডাক এল। মোটর ভেহিকেলের ইন্সপেক্টার সাহেব বললেন, চিঠি তো আসে নি, কি করে বুঝব আপনার কেসটা জেনুইন?
- স্যার, তিন মাসের মধ্যে না এলে তাই ত ধরে নিতে হবে।
- দেখুন, আইন শেখাবেন না। আমাদের কাছে এ রকম কোনও সার্কুলার নেই।
আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওনার সহকারীর আমার উপর একটু দয়া হল। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, দেখুন, কিছু মনে করবেন না, স্যারের আজ মেজাজটা ভাল নেই, সকাল সকাল চন্দনের ক্যান্টিনের চা না পেলেই এই অবস্থা হয়। আপনি প্লীজ চন্দনকে বলে এক কাপ স্পেশাল চা পাঠিয়ে দিন না ওনার জন্যে। আর হ্যাঁ, পয়সাটাও দিয়ে দেবেন। যাক্‌, এত সহজে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে ভেবে আমি আর কথা না বাড়িয়ে পেছন ফিরলাম।
- ও হ্যাঁ, ভদ্রলোক আবার ডাকলেন, দু' চামচ চিনি দিতে বলবেন চায়ে।
আর-টি-ও অফিসে ঢোকার মুখেই ডানদিকে চন্দন থাপার চায়ের দোকান। প্রচুর ভিড়। আমি গিয়ে বললাম, ভাই দত্তচৌধুরী সায়েবের জন্যে এককাপ স্পেশ্যাল চা পাঠিয়ে দেবেন, আর্জেন্ট।
- চিনি ক চামচ? চন্দন শুধোল।
-অ্যাঁ? ও হ্যাঁ, দু চামচ।
- নিন, দু'শো টাকা বার করুন। চা পাঠিয়ে চন্দনের তলব।
- সে কি! এক কাপ চায়ের দাম দু'শ? লেখা আছে যে স্পেশ্যাল চা পাঁচ টাকা?
- কেন, দু-চামচ চিনি বললেন যে! স্যার, যে পুজোর যা মন্তর। আপনি-আমি কি করতে পারি বলুন। চিন্তা করবেন না, টাকাটা পে করে দিন- বিকেল চারটেয় এসে দেবনাথ বাবুর কাছ থেকে আপনার আর-সি বুকটা নিয়ে যাবেন। দেবনাথকে চেনেন তো? দত্তচৌধুরী সায়েবের অ্যাসিস্ট্যান্ট.........
আমাকে থ' হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথাটা আর শেষ করে না চন্দন থাপা।

Tuesday, September 3, 2019

গল্প- ঘোষাল-গিন্নি

ঘোষাল-গিন্নি।।
(গল্প)

গড়ফার বাসিন্দা ঘোষালবাবু প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি করে সদ্য রিটায়ার করেছেন। এতদিন তবু চাকরি ছিল বলে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, এখন তিনটি অবিবাহিতা মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে পেনশনের টাকায় চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সারাদিন হিমশিম খাচ্ছেন, অথচ পেট ভরছে না। এর মধ্যে আবার ঘোষাল-গিন্নি, মানে ফুল্লরা দেবী আন্ত্রিক বাধিয়ে বসলেন। বড়মেয়ে একটা দোকানের রিসেপশনে কাজ পেয়েছে, তার সময় নেই। মেজটা চাকরি-বাকরি পায়নি, গোটা-দুই ট্যুশন করে, ছোটটি বারো ক্লাসে পড়ে। মোটামুটি হাসপাতালে নিয়ে যাবার কারো সময় বা উদ্যম নেই।
দু'দিন ভোগার পর নেতিয়ে পড়েছেন ফুল্লরা। বার্লি আর গুড়জলে আর কত রি-হাইড্রেশন হবে। শেষে প্রতিবেশিদের পরামর্শে রামলাল বাজারের কাছে একটা দরগায় কোন এক ফকিরবাবার কাছে নিয়ে গেলেন তাঁকে ঘোষাল বাবু, সঙ্গে গেল মেজ কন্যাটি। সেখানে মন্ত্রপূত জলপড়া খাওয়ান হল, বাবা বললেন- এ একেবারে অব্যর্থ!

ফিরে আসার পর আবার শুরু হল ভেদবমি আর পেটব্যথা। সন্ধে নাগাদ কান্নার রোল উঠল ঘোষাল-বাড়ির থেকে। সেই সময় যাদবপুর অঞ্চলের যুক্তিবাদী মঞ্চের নেতা চঞ্চল বোস ফিরছিল অফিস থেকে। সে থাকে একই বিল্ডিঙের তিনতলায়, ঘোষালরা দোতলায়। কান্নার রোল শুনে উঁকি দিয়ে দেখল ব্যাপারটা। ভদ্রমহিলা খাবি খাচ্ছেন বটে, তবে বেঁচে আছেন। ঘোষালবাবুর কাছে ব্যাপারটা জেনে ওর রক্ত মাথায় চড়ে গেল রাগে। তবু কোনমতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে জিগ্যেস করল- 'আপনি কি মাসিমাকে সত্যি বাঁচাতে চান, না মারতে - সত্যি করে বলুন। বলছি কারণ আমার কথা শুনলে এখনও আশা আছে।'
'কী করব বাবা, হাসপাতালে এখন নেবে বলে তো মনে হয় না, আর নার্সিং হোমে ভীষণ খরচ।' উনি কোনমতে বললেন।
'আপনি ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কি ঘাস কাটতেন? লোকে ডিপার্টমেন্টের নাম শুনলে এমনিতেই তো আপনার মেয়েদের জন্যে পণের দর বেড়ে যাবে!'
'না না বাবা, আমি তো চিরকালের গান্ধীবাদী। তাছাড়া ছিলাম তো পার্সোন্যাল সেক্‌শনে। যাকগে সে সব কথা। এখন তুমি কী করতে বল?'
'আম্বুলেন্স ডাকুন। গোলপার্কের একটা নার্সিং হোমে আমার কিছুটা চেনাশোনা আছে। এছাড়া অন্য কেউ এই মুমূর্ষু রোগীকে নেবে বলে মনে হয় না।'

আম্বুলেন্স ডাকা হল। চঞ্চল, তার ছোট ভাই প্রাঞ্জল আর ঘোষালবাবু তিনজনে মিলে ধরাধরি করে ঘোষালগিন্নিকে নিয়ে গেল গোলপার্কের নার্সিং হোমে। চঞ্চলের তৎপরতায় আর ডাক্তারদের আন্তরিক চেষ্টায় দিন-তিনেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন ফুল্লরা দেবী। উৎসবের পরিবেশ ফিরে এল ঘোষাল-বাড়িতে। চঞ্চলের কথা কারো আর মনে থাকল না।

তারপর এক শুভদিন দেখে রামলাল বাজারের দরগায় গিয়ে পীরবাবার সমাধিতে চাদর চড়িয়ে এলেন ঘোষাল-গিন্নি। বাবার অসীম মহিমা, গিন্নি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবু কেন জানিনা রিক্স করে বাড়ি ফেরার সময় পাড়ার মোড়ে চঞ্চলকে দেখে কোনমতে গিন্নির আঁচলে মুখ লুকোলেন ঘোষালবাবু।

Monday, September 2, 2019

গীতিনাট্য- সুরের মায়ায়

সুরের মায়ায়।।

(গীতিনাট্য)


রচনাঃ পল্লব চট্টোপাধ্যায়

পাত্র-পাত্রীঃ
চরণদাস- ব্যাধ
শারঙ্গদেব- সন্ন্যাসী, গানের গুরু
চিত্রক- চিতল হরিণ
চরণের স্ত্রী, পথিক-১, পথিক-২
বনের অন্য জন্তুরা (ঐচ্ছিক)।

প্রথম দৃশ্য।

(স্টেজে অরণ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড। চিত্রক নামের হরিণ স্টেজের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে যাচ্ছে, তারপর উইংসের আড়ালে যেতেই ব্যাধ চরণদাস ধনুর্বাণ নিয়ে ছুটে স্টেজ পারাপার করছে; বোঝাই যাচ্ছে যে ব্যাধ শিকারকে তাড়া করে চলেছে। এই রকম কয়েকবার হবার পর চরণ চোখের উপরে দু-হাতে রোদ আড়াল করে দূরে হরিণটাকে দেখার চেষ্টা করল। না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে স্টেজের মাঝে বসে পড়ল।)
চরণ।। গান-
আজকে আমার কপাল বেজায় মন্দ।
শুধু ছুটে বেড়াই এ-দিক ও-দিক,
নেই শিকারের নামগন্ধ।।
হরিণগুলো চালাক বেজায়
শান্তভাবে চরে বেড়ায়,
যেই ধনুকে জুড়েছি তির, অমনি মনে সন্দ!
পালায় ছেড়ে বন-জঙ্গল, পেরিয়ে খানা-খন্দ।।
শুয়োর-বরা মারব কি রে!
তারা ঘোঁত-ঘোঁতিয়ে আসে তেড়ে
তাই ভাবছি বর্শা ফুঁড়ে
করি ফোঁস-ফোঁসানি বন্ধ।। (উঠে প্রস্থান)
(অন্য দিক থেকে চিত্রকের প্রবেশ, নাচ ও গান)
চিত্রক।।
কেমন ব্যাটায় দিইচি ফাঁকি!
ওরে- মারবি যদি আয়না দেখি।।
আল্লা মোদের দেননিকো দাঁত-নখ,
বাহারি শিং ঠুনকো বেজায়
আর কাজল-কালো চোখ।
তাই বলে তুই ফ্যালনা ভাবিস না,
আছে দুই-জোড়া এই পা
বাঘ-চিতাদের মহড়া নিই,
যদি তেমনধারা ঠেকি।। (প্রস্থান)
(ঘরের পথে চরণ। চরণের বউ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুখঝামটা দেয়।)
(গান)
বউ।। একি রঙ্গ দেখি মুখপোড়া মিন্‌সে!
খালি হাতে ফিরছ ঘরে মুখ কেন ঝুলে পানসে?
চরণ।। এই নিয়ে তিনদিন হল গিন্নি-
হরিণগুলো খালি ছুটিয়ে মারে।
ওদের সাথে ছুটে পাল্লা দিতে
চেহারাখানা হল রোগা চিম্‌সে।।
বউ।। থাক থাক আর নিজ রূপের বাখান
না করে উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে
দেখে এস খালি হাঁড়ি-কড়া কয়খান,
 ঘাসপাতা খাব শেষে ফেলে মাংসে!!
চরণ।। ওগো ভগবান, দাও দেখা
যেদিকে দু’চোখ চায়, পালাই একা-
বউ।। তাই যাওনা গো কে তোমায় করছে বারণ!
বলি, বউকে উপোষী রাখে কোন মান্‌ষে?? (ঘরের দিকে প্রস্থান)
চরণ।। (গান)
ওগো ঠাকুর সগ্‌গো থেকে শুনছ তুমি কী?
এমন কথা কয় কি কোন ভালমানুষের ঝি!
আমিও তাই নিলেম বিদায়,
চলব যেথা দুই আঁখি ধায়,
যদ্দিন না শিকার মেলে
ফিরব না এই পণ করেছি।।
(যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য।

(সন্ধ্যাকাল। চরণদাস বনের প্রান্তে বসে আছে।)
চরণ।। (গান)
আর যে শরীর চলেনা।
পরশু খেয়েছিলাম একজোড়া শশা।
...আরে না না নয়কো শশক,
হরিণ-বরা সে তো ছলনা।।
ওগো যমরাজ, কোথা তুমি আজ,
তুলে নিয়ে আমায় চলনা।
ওগো প্রাণের শবরি, যদি অনাহারে মরি
দোষ দিওনা আমায় ললনা।।
(দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর, পুরবী রাগে)
চরণ।। ওগো প্রাণের ঠাকুর, বাঁশির সুরে ডাক দিলে কী?
অধম আমি পাপী শবর, খুঁজি তোমায় হয়ে কাতর
শুনে করুণ-স্বর, মূরলীধর, স্বর্গ থেকে নামলে নাকি??
(দুই পথিকের প্রবেশ)
পথিক ১।। ও হে নিষাদ, কী বকছ যা তা!
তোমার খারাপ নাকি মাথা?
সগ্‌গ লয় গো, মত্তোবাসী
সারংঠাকুর বাজায় বাঁশি
তবে ইটো সইত্য বটে, লয়কো মানুষ তিনি।
সুরেই তিনি পাথর গলায়, সুরেই ভুলায় ব্যতা।।
পথিক ২।। ঠিক বলেছ। সারঙ্গদেব, ওই হোথা তাঁর বাসা।
সুরের গুরু, গানের ঠাকুর- হাওয়ায় ভেসে আসা
শুনছ তুমি তাঁর বাজনা
ঝেড়ে ফেল সব ভাবনা,
বাঁশির সুরে এগিয়ে চল, মিটবে গো পিপাসা।। (দুই পথিকের প্রস্থান)
চরণ।। তবে যাই চলে যাই নিয়ে আমার বুকভরা হতাশা।
তাঁর চরণেই সঁপি জীবন, সব ভরসা আশা।।
(প্রস্থান)


তৃতীয় দৃশ্য।

(বনের প্রান্তে নদীর ধারে সাধক সারঙ্গদেবের কুটির। তিনি গাইছেন, পশুপাখিরা দল বেঁধে সে গান শুনছে।)
শারঙ্গ।। (গান) ইমনকল্যাণ/ ত্রিতাল
মন তুমি কেন নাহি ধীরজ ধর? @
ধীরজ ধরিয়া সব কারজ পূর্ণ কর।।
পুনঃ পুনঃ অভ্যাসে জড়তা দূর হয়,
রশির ঘরষণ শিলাকে করে ক্ষয়।
পঙ্গু লঙ্ঘে গিরি, মূকও বচন কয়।।
(ব্যাধের প্রবেশ, শারঙ্গদেবকে প্রণাম)
চরণ।। ওগো সুরের ঠাকুর, নাও আমার প্রণাম।
হতভাগ্য নিষাদ, খিদের জ্বালায়
ছেড়েছি ঘর, দুয়ার-আলয়,
এখন তোমার শরণে হেথা এলাম।।
শারঙ্গ।। আশিস জানাই, কী চাও বাছা?
সাধক আমি, রাজা-বাদশা
নই ত, তোমায় কী ধন দেব
বৎস, তোমার কী নাম?
চরণ।। আমি চরণদাস, প্রভু ওই চরণের দাস।
যে গানে বাঘ-হরিণে হিংসা ভুলে
জোটে এক কুটির তলে,
শোনে গান সবাই মিলে-
তারি এক কণা পেয়ে ধন্য হতে
তোমার চরণ-তলে করতে চাই গো বাস।।
শারঙ্গ।। চরণ রে তোর স্কন্ধে ধনুঃশর।
ধনুক, নাকি ধরবি বীণা
তাই আগে ঠিক কর,
ওরে, তুই আগে ঠিক কর।।
চরণ।। এই ফেললাম ধনুক-শর
দাও গো বীণা হাতে।
বনের পশুপাখির সাথে উঠব গানে মেতে।।
সারঙ্গ।। তাই হোক তবে।
বাণীকে প্রণাম করে নাড়া বাঁধ হাতে,
এস, গাও মোর সাথে-
নমো নমো বীণাপাণি, নমো বাণী নারায়ণী।*
হৃদয়ের শতদলে রাখো রাঙা পদতলে।
সমাহিত কর চিত সংগীতে হে জননি!
(সময়ান্তর। প্রাতঃকাল। চরণ গাইছে, গুরু শেখাচ্ছেন।)
সা।। হে
সারেসা।। ভগবান
সারেগারেসা।। নমি ভগবান
সারেগামাগারেসা।। তব করুণার দান
সারেগামাপামাগারেসা।। সুরে সুরে ভরে দাও প্রাণ
সারেগামাপাধাপামাগারেসা।। তোমারি চরণে ঢেলে মনপ্রাণ
সারেগামাপাধানিধাপামাগারেসা।। মন দিয়ে শিখি তুমি যা শেখাও গান
সারেগামাপাধানিসানিধাপামাগারেসা।। দাও প্রাণ দাও গান দাও সুর দাও তান।
সারঙ্গ।। গলাটি তোর নয়তো তেমন মন্দ!
হওয়া চাই সুরে সাধা।
শোন রে নিষাদ, সব সঙ্গীত
সুর বাণী আর তালে বাঁধা।।
সাতটি শুদ্ধ স্বর পাঁচটি কোমল-কড়ি,
সংগীত জগতের আধার।।
এছাড়া রয়েছে শ্রুতি, ঠাট-রাগ-রাগিনী
এ হিসেব আজ নয় থাক।
চাইনা অযথা ব্যাকরণ
শেখার পথে হোক বাধা।।
রাগরাগিনীর জগতে আমরা প্রবেশি এস তবে,
ভোরের সূর্য উদয়াচলে, বন্দ আহির-ভৈরবে।।
ধীরে ধীরে প্রভাত হল। **
সাতটি অশ্বে টানা রথটি নিয়ে
সাতরঙা রশ্মিতে রশি বানিয়ে
দিবাকর লঙ্ঘেন উদয়াচল।
সাতসুরে গড়া ভৈরব-রাগে
জগতবাসী তাঁরে প্রণমিল।।
টিকাঃ @ রফির গাওয়া 'মন রে তু কাহে না'- গানের সুরের কাছাকাছি।
* সরগম- আরোহন ও অবরোহনের সুরে।
** যেসুদাসের গাওয়া 'ধীরে ধীরে সুবহ হুঈ'-র কাছাকাছি সুরে।

চতুর্থ দৃশ্য।।

(চরণের শিক্ষা চলছে। গুরু বোঝাচ্ছেন।)
সারঙ্গ।। রহস্যময় মানবমনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি আর চিত্রময় প্রকৃতির লীলাবৈচিত্র্যে আমাদের দেশের বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর প্রকাশ। রাগরূপ শুনলে তার ভাব বুঝতে সমস্যা হবে না। শোন মন দিয়ে-
(যন্ত্রে বাজবে)
০ ৩ + ২
জ্ঞ জ্ঞ ঋ স ণ্‌ স দ্‌ া ণ্‌ স া জ্ঞ ম দ ম প
জ্ঞ ম জ্ঞ ঋ স ণ্ দ্ া ম্ দ্ ণ্ জ্ঞ া ম দ া
ণ র্স া র্ঋ র্স ণ দ ম প ণ দ প ম জ্ঞ ঋ স
কী বুঝলে বল?
চরণ।। পথ চেয়ে বসে আছি, এখনও তো এলে না। *
আঁধার রাতি উজল হ’ল, একী প্রভু তব ছলনা।।
শারঙ্গ।। বাঃ! এই হল ভৈরবী। এবার শোন ভীমপলশ্রী। (যন্ত্রে বাজান)
মা পা ।।
র্সা ণি া । ধা পা া ।। মা জ্ঞা া । রে সা রে ।।
নি্‌ সা া । নি্‌সা নি্‌সা নি্‌গা ।। রে া া ।া গা মা ।।
গা া মা । গা মা া ।। গামা পা মা ।। গা মা া ।।
জ্ঞা জ্ঞা রে। জ্ঞা া রে ।। ণি া া । া া া ।।
চরণ।। গাও গাও রে পরাণ আজ এ করুণ সুর। **
আকাশে বাতাসে ধ্বনি ছড়াক মধুর।।
কী পেয়েছি, কী পেলাম না,
মনে রয়ে গেল কত বাসনা-
হতাশা-কালিমা যত হয়ে যাক দূর।।
সারঙ্গ।। ওই দেখ আকাশে মেঘের রাশি। ঝড়-বৃষ্টি-বিদ্যুতের অগ্রদূত। কী গাইবে চরণ?
চরণ।। প্রবলদল মেঘ ঘন, উড়িয়া চলে ঘেরি গগন। #
সপ্তমেঘ ধরণীতলে ইন্দ্র আনো আনো হে।।
বরষত মুষলধার, সঙ্গী পবন চার,
কৃষ্ণ করে গিরি-ধারণ, বজ্র হানো হানো হে।।
(মেঘ রাগ বাজতে থাকবে। শ্রীরাগের মধ্যে ভোরের আলো ফুটবে।)
******
সারঙ্গ।। আজ তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ নিষাদ, এবার তুমি ঘরে ফিরে যাও। সরস্বতীর চরণাশ্রিত এই বীণা আজ তোমার হল, দেখো যেন এর অমর্যাদা না হয়। (বীণা দান)
চরণ।। (বীণা নামিয়ে রেখে নাচ ও গান)
ধন্য আমি যে, ধন্য আমি যে। @
আজ জীবন-বীণার তারে তারে
উঠছে ধ্বনি বারে বারে,
সরস্বতীর উপহারে পূর্ণ আমি হে।।
বন্য জীবন ধন্য আজি
পুণ্য বীণায় উঠছে বাজি
হংসাসনার অর্ঘ্য সাজি পূর্ণ আমি হে।।
* - 'আয়ে না বালম' বড়ে গোলাম আলি খানের সুরে
** - 'যা যা রে অপনে মন্দরবা' খেয়াল আর 'আমার সাধ না মিটিল' শ্যামাসংগীত মিশ্রিত।
# - 'প্রবলদল সাঁজি ঝুক' - মিঞা তানসেন বা 'তিমিরময় নিবিড় নিশা' রবীন্দ্রসংগীতের সুরে
@ - 'রুখবে মোদের কে?'- জনপ্রিয় দেশবন্দনার সুরে।

পঞ্চম দৃশ্য।

(চরণের বাসা। চরণ আর তার স্ত্রী বসে, মনে দুঃখ। একপাশে পড়ে বীণা, অন্যদিকে তির-ধনুক।)
চরণ।। বাসায় তো এসে পড়লাম। এবার খাব কী?
(গান)
ঘরে বসে আছি দুজনায়, এবার খাবটা কী?
গুরু ঘরে বসে ভিক্ষা পান, আমি সেটা পাব কী?
হাতে বীণা, কাঁধে ধনুর্বাণ, বনের পথ ধরি,
দেখি কে খাবার জুটিয়ে দেয়, তারে সেলাম করি।
(জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চরণ ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরের উপর বসে পড়ে)
চরণ।। আজকে দেখি খাবার-দাবার জোটে কিনা।
পেয়েছি সাধনা-ধন এবার তবে বাজাই বীণা।
বীণার স্বরটি শুনে কলাটা-মুলোটা গুনে
যদি কেউ ইনাম ধরে, হয়ে তার থাকব কেনা।।
(বীণা বাদন। বীণার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে হরিণ চিত্রক প্রবেশ করে, এদিকওদিক তাকিয়ে একটু দূরে ঘেঁসে বসে, বীণা শুনতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলে চরণ হরিণকে দেখতে পায়, দ্রুত উঠে ধনুক-বাণ হাতে নিয়ে চিত্রককে বধ করে। হতচকিত চিত্রক কিছুক্ষণ ছটফট করে গেয়ে ওঠে-)
চিত্রক।। ওগো শবর, তোমায় সেলাম।
তোমার হাতে মরেও আমি ধন্য হলাম।
যবে একটি পাতা থরথরিয়ে হাওয়ায় কাঁপে, *
ভীরু আমি- একছুটে ধাই বন থেকে বনান্তরে,
শুনে তোমার বীণা মুগ্ধ আমি
জীবন দিলাম দান করে।
হল তোমারই জয়, আর করিনে ভয়
শেষ প্রণাম জানাই সেই সুরে।।
শির কেটে মোর সাজাও ঘরে
মাংস আমার খাও,
আমার মৃগচর্মে বসে
সদাই বীণা বাজাও।
আমার একটি কথাই রাখ নিষাদ,
আমায় বীণা শোনাও
তুমি আমায় বীণা শোনাও। (মৃত্যু)
চরণ।। হায় কী হল, এ কী করলাম আমি!
আর কী বাজাই বীণা,
ছিন্ন হল সব তার
এমন শ্রোতাই রইল না আর,
বীণা কি বাজবে আর,
হায়, বীণা কি বাজে গো আর!!

(শেষ)



মূল আখ্যানটি হিন্দিতে, অনেকটা এরকম-
হরিণ।। এক পত্র যব খড়খড়াওয়ে
ব্যয়ঠুঁ সিংহল দ্বীপ,
তেরে বীণা কে স্বর সে মেরা
শির দিয়া বক্‌শিস।
শির মেরা কাটো, বাটারা বানাও,
মাংস ভি মেরা খাও,
মেরা মৃগচর্ম পর বইঠ তুম
হরদম বীণা বজাও।
ব্যাধ।। ক্যা বজাউঙ্গা বীণা,
টুট গ্যয়ে সব তার
জো এয়সা শুননেওয়ালা না রহা,
ক্যা বীণা বজেগা আউর!!

Sunday, September 1, 2019

আংটি।। (অণু-গল্প)

আংটি
(অণু-গল্প)



'দেখ, এখন আর আমাদের মধ্যে অতীত নিয়ে কোন আলোচনা না হওয়াই ভাল। তোমার যদি অতীত থাকে, আমারও আছে। এস আমরা কথা দিই কেউ কাউকে পুরনো কথা জিগ্যেস করব না।' একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল জিতেন।

ধীরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। একটু নিশ্চিন্তও যেন। যাক কী হবে আর পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে। বিয়েটা ভালয় ভালয় মিটে গেছে, কেউ বাগড়া দেয়নি। আজ ফুলশয্যায় একটু চাপ আছে, দেখা যাক, কী হয়। এমন সময় ডানহাতের অনামিকায় কিসের একটা চাপ অনুভব করল ধীরা। একটা আংটি, জিতেন পরিয়ে দিল, বলল, বাঃ, পারফেক্ট ফিট করে গেছে তো। সাইজ জানতাম না, খুব চিন্তা ছিল!

কিন্তু এবার ধীরার কী হল? সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আংটিটার দিকে। ভোলার কথা নয়, তবু আরেকবার মনে পড়ে গেল দু'বছর আগের সেই বিভীষিকার রাত্রি। ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার ছিল কফি হাউসে। শেয়ালদা ফিরতে রাত্রি সাড়ে ন'টা। ধীরাকে বনগাঁ লোকালে গুমা ফিরতে হবে। ভীড় ছিল বলে লেডিস কামরায় উঠেছিল। হঠাৎ দেখে বারাসতে কামরাটা খালি হয়ে গেল, রইল শুধু ও আর দু'জন বোরকা পরা মহিলা। সেই সময় কেউ যেন কামরার আলো নিভিয়ে দিল। সিঙ্গল লাইনে ট্রেন চলছে ঢিমে গতিতে। ভয়ে আতঙ্কে ধীরা দেখল ওদের মুখ থেকে বোরকা সরে গেছে আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুটো পুরুষের মুখ। কিছু বোঝার আগেই গাড়ির সীটের উপর শুইয়ে দিয়ে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নরপশু দু'টো। জ্ঞান হারাবার আগে ধীরা বুঝতে পারল ওর আঙুল থেকে একজন আংটিটা টেনে খুলে নিল, এই সেই আংটি।

এই সেই আংটি! এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা মাথায় ঢুকতেই আতঙ্কে একটা চিৎকার করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধীরা। তারপর দরজা খুলেই দিগ্বিদিক ভুলে দৌড়। পেছন পেছন ছুটে আসছে জিতেন। বড় রাস্তায় আসতেই সামনে একটা ভ্যান সজোরে ব্রেক কষল। পড়েই জ্ঞান হারাল ধীরা। না, ধাক্কা লাগেনি। পাঁজাকোলা করে তাকে তুলে নিয়ে এসে ঘরে শুইয়ে দিল জিতেন। কিছুক্ষণ পরেই ওর জ্ঞান ফিরল।

'কী ব্যাপার বল তো? মাথায় ছিট আছে নাকি, ছুটলে কেন খামখা? যদি কিছু একটা হয়ে যেত!'
'তার আগে বল এ আংটি তুমি কোথায় পেলে? জানো, এ আংটি আমার ভীষণ চেনা?'
'কেন, গয়নার দোকানে। রসিদ দিয়েছে, তবে কাঁচা রসিদ- অন্যের বিক্রি করা জিনিষ, সেটা অবশ্য ওরা জানিয়ে দিয়ে ছিল।'
'আগে বলনি কেন?'
'তুমি তো জিগ্যেস করনি!'

আবার চোখ বন্ধ করল ধীরা। তবে এবার পরম নিশ্চিন্তের নিদ্রা। ধীরে ধীরে ওর মাথাটা নিজের বুক থেকে বালিশে নামিয়ে দিল জিতেন।