Tuesday, September 3, 2019

গল্প- ঘোষাল-গিন্নি

ঘোষাল-গিন্নি।।
(গল্প)

গড়ফার বাসিন্দা ঘোষালবাবু প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি করে সদ্য রিটায়ার করেছেন। এতদিন তবু চাকরি ছিল বলে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল, এখন তিনটি অবিবাহিতা মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে পেনশনের টাকায় চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সারাদিন হিমশিম খাচ্ছেন, অথচ পেট ভরছে না। এর মধ্যে আবার ঘোষাল-গিন্নি, মানে ফুল্লরা দেবী আন্ত্রিক বাধিয়ে বসলেন। বড়মেয়ে একটা দোকানের রিসেপশনে কাজ পেয়েছে, তার সময় নেই। মেজটা চাকরি-বাকরি পায়নি, গোটা-দুই ট্যুশন করে, ছোটটি বারো ক্লাসে পড়ে। মোটামুটি হাসপাতালে নিয়ে যাবার কারো সময় বা উদ্যম নেই।
দু'দিন ভোগার পর নেতিয়ে পড়েছেন ফুল্লরা। বার্লি আর গুড়জলে আর কত রি-হাইড্রেশন হবে। শেষে প্রতিবেশিদের পরামর্শে রামলাল বাজারের কাছে একটা দরগায় কোন এক ফকিরবাবার কাছে নিয়ে গেলেন তাঁকে ঘোষাল বাবু, সঙ্গে গেল মেজ কন্যাটি। সেখানে মন্ত্রপূত জলপড়া খাওয়ান হল, বাবা বললেন- এ একেবারে অব্যর্থ!

ফিরে আসার পর আবার শুরু হল ভেদবমি আর পেটব্যথা। সন্ধে নাগাদ কান্নার রোল উঠল ঘোষাল-বাড়ির থেকে। সেই সময় যাদবপুর অঞ্চলের যুক্তিবাদী মঞ্চের নেতা চঞ্চল বোস ফিরছিল অফিস থেকে। সে থাকে একই বিল্ডিঙের তিনতলায়, ঘোষালরা দোতলায়। কান্নার রোল শুনে উঁকি দিয়ে দেখল ব্যাপারটা। ভদ্রমহিলা খাবি খাচ্ছেন বটে, তবে বেঁচে আছেন। ঘোষালবাবুর কাছে ব্যাপারটা জেনে ওর রক্ত মাথায় চড়ে গেল রাগে। তবু কোনমতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে জিগ্যেস করল- 'আপনি কি মাসিমাকে সত্যি বাঁচাতে চান, না মারতে - সত্যি করে বলুন। বলছি কারণ আমার কথা শুনলে এখনও আশা আছে।'
'কী করব বাবা, হাসপাতালে এখন নেবে বলে তো মনে হয় না, আর নার্সিং হোমে ভীষণ খরচ।' উনি কোনমতে বললেন।
'আপনি ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে কি ঘাস কাটতেন? লোকে ডিপার্টমেন্টের নাম শুনলে এমনিতেই তো আপনার মেয়েদের জন্যে পণের দর বেড়ে যাবে!'
'না না বাবা, আমি তো চিরকালের গান্ধীবাদী। তাছাড়া ছিলাম তো পার্সোন্যাল সেক্‌শনে। যাকগে সে সব কথা। এখন তুমি কী করতে বল?'
'আম্বুলেন্স ডাকুন। গোলপার্কের একটা নার্সিং হোমে আমার কিছুটা চেনাশোনা আছে। এছাড়া অন্য কেউ এই মুমূর্ষু রোগীকে নেবে বলে মনে হয় না।'

আম্বুলেন্স ডাকা হল। চঞ্চল, তার ছোট ভাই প্রাঞ্জল আর ঘোষালবাবু তিনজনে মিলে ধরাধরি করে ঘোষালগিন্নিকে নিয়ে গেল গোলপার্কের নার্সিং হোমে। চঞ্চলের তৎপরতায় আর ডাক্তারদের আন্তরিক চেষ্টায় দিন-তিনেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন ফুল্লরা দেবী। উৎসবের পরিবেশ ফিরে এল ঘোষাল-বাড়িতে। চঞ্চলের কথা কারো আর মনে থাকল না।

তারপর এক শুভদিন দেখে রামলাল বাজারের দরগায় গিয়ে পীরবাবার সমাধিতে চাদর চড়িয়ে এলেন ঘোষাল-গিন্নি। বাবার অসীম মহিমা, গিন্নি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তবু কেন জানিনা রিক্স করে বাড়ি ফেরার সময় পাড়ার মোড়ে চঞ্চলকে দেখে কোনমতে গিন্নির আঁচলে মুখ লুকোলেন ঘোষালবাবু।

No comments:

Post a Comment