জঙ্গল-মহাল ও ছোটনাগপুরের আদিবাসী বিদ্রোহ।
"সিদু কানু চাঁদ ভৈরব চারি ভাই ছিল।
ভাগলা দিহি গ্রামে উদের জনম হঞে ছিল ।।
মহেশ দারোগা আসে জঙ্গল মহালে।
নানা অত্যাচার তারা করে সাঁওতালে ।।
এক দিন সিদু কানু ঘরে শুঞে ছিল।
সাদা রঙা ভগবান আইসে দেখা দিল ।।
দশখানা আঙুল ছিল তাঁর প্রতি হাতে।
বিশটি কাগজ টুকরা ধরা ছিল তাতে ।।
তাহাতে রয়েছে লিখা দেবতার বাণী।
গ্রামে গ্রামে ইহা ক্রমে হ’ল জানাজানি ।।
সিদু বলে শুন সবে ছাড়িও না হাল।
স্বাধীন করিতে হবে জঙ্গল মহাল ।।"(স্বপ্নময় চক্রবর্তী)
ভাগলা দিহি গ্রামে উদের জনম হঞে ছিল ।।
মহেশ দারোগা আসে জঙ্গল মহালে।
নানা অত্যাচার তারা করে সাঁওতালে ।।
এক দিন সিদু কানু ঘরে শুঞে ছিল।
সাদা রঙা ভগবান আইসে দেখা দিল ।।
দশখানা আঙুল ছিল তাঁর প্রতি হাতে।
বিশটি কাগজ টুকরা ধরা ছিল তাতে ।।
তাহাতে রয়েছে লিখা দেবতার বাণী।
গ্রামে গ্রামে ইহা ক্রমে হ’ল জানাজানি ।।
সিদু বলে শুন সবে ছাড়িও না হাল।
স্বাধীন করিতে হবে জঙ্গল মহাল ।।"(স্বপ্নময় চক্রবর্তী)
মানভূম সহ সমস্ত জঙ্গলমহলের (মতান্তরে 'মহাল') আদিবাসী সম্প্রদায়ের বন্য-সরল-অশিক্ষিত মানুষরা যে প্রয়োজনে প্রাণকে তুচ্ছ করে স্বাধীনতা বা কোন আদর্শের জন্যে কিভাবে লড়াই করতে পারে তার উদাহরণ জঙ্গলমহাল-মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-মানভূমের চুয়াড় বিদ্রোহ, মানভূম-ছোটনাগপুরের কোল বিদ্রোহ ও বীরভূম-সাঁওতাল পরগণার সাঁওতাল বিদ্রোহ।
১৭৯৮-৯৯ । মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও মানভূমের জঙ্গলমহলের অধিবাসী আদিম ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের স্থানীয় জমিদারশ্রেণী অবজ্ঞাভরে চুয়াড় নাম দিয়েছিল। তাদের জমি কেড়ে নেয়ায় বা সাধ্যাতীত মাত্রায় নতুন কর ধার্য করায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। ওয়ারেন হেস্টিংস ব্যর্থ হন এ বিদ্রোহ দমনে। ১৭৯৯ সালে বড়লাট ওয়েলেসলি চুয়াড় বিদ্রোহের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনেন।
সুপ্রচীনকালেই ‘কোল’নামে এক আদিম উপজাতি বর্তমান বিহারের সিংভূম, মানভূম সমেত সারা ছোটোনাগপুর অঞ্চলে বসবাস শুরু করে । কোলরা হো, মুন্ডা, ওরাওঁ ইত্যাদি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল । অন্যান্য আদিম জাতিগুলির মতো কোলরাও ছিল কৃষিজীবী । নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে ইংরেজ সরকার বহিরাগত লোকদের কোল সম্প্রদায়ের জমিদার হিসাবে নিযুক্ত করেন। তাঁরা চড়া হারে রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ও আইন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোল সমাজের ওপর আঘাত হানে, এইসব শোষণ ও বঞ্চনা থেকেই ১৮৩১ সালে কোল বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়।
রাঁচি, হাজারিবাগ, সিংভূম, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সিংরাই, বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ প্রভৃতি নেতাগণ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । কোল বিদ্রোহের পাশাপাশি মানভূমের ভূমিহীন জনসাধারণ বিদ্রোহী হয়ে সরকারি কাছারি ও পুলিশ ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করে এই বিদ্রোহ দমন করতে হয়। কোল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে কোলদের ঐক্যবদ্ধ রূপ। তাছাড়া বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ ও বহিরাগত জমিদারবর্গ। চার্লস মেটকাফের মতে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো।
রাঁচি, হাজারিবাগ, সিংভূম, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলে কোল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সিংরাই, বুদ্ধ ভগৎ, জোয়া ভগৎ প্রভৃতি নেতাগণ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । কোল বিদ্রোহের পাশাপাশি মানভূমের ভূমিহীন জনসাধারণ বিদ্রোহী হয়ে সরকারি কাছারি ও পুলিশ ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করে এই বিদ্রোহ দমন করতে হয়। কোল বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে কোলদের ঐক্যবদ্ধ রূপ। তাছাড়া বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ ও বহিরাগত জমিদারবর্গ। চার্লস মেটকাফের মতে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানো।
উপরের যে কবিতাটি দেওয়া হয়েছে তা সাঁওতাল বিদ্রোহের অসমসাহসী নেতা দুই ভাই সিদ্হ ও কান্হর পাঁচালির অংশবিশেষ। ১৮৫৫ সালে হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। সিদ্হ, কান্হ, ভৈরব প্রমুখের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীন সাঁওতাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সংকল্পে কলকাতা মার্চ করে। সংঘর্ষে ২৩ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে ইংরেজরা ও সিদ্হ-কান্হর ফাঁসি হয়।
পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুরসহ ছোটনাগপুরের পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলের মানুষ, তাদের জীবন-সংগ্রাম আর সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক পরিকাঠামো আর শাসন-ব্যবস্থার সাথে। এই অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলা দামোদর, বরাকর, কোয়েল, সুবর্ণরেখা ও কাঁসাইএর মত বেশ কিছু পাহাড়ি নদী থাকলেও বর্ষাকাল বাদে তাদের জল কম, আর বর্ষায় তীব্র স্রোত থাকায় উর্বরা পলি-মাটি জমে কম, তাই মাটির উর্বরাশক্তিও নিম্নমানের।
এসব থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে কৃপণা বসুধরা এখানে মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে শস্যকণা দিতে চান না। তবু কৃষিনির্ভর আদিবাসি সম্প্রদায় প্রাক্-ঔপনিবেশিক সময় (precolonial era) পর্যন্ত নিজেদের স্থানীয় পরিবেশ জ্ঞান, সমাজ-সংস্কৃতি আর ধর্মীয় বিশ্বাস-এর ওপরে ভিত্তি করে সচেতনভাবে তাদের গ্রাম-ভূচিত্র বজায় রেখেছিল। একইভাবে, বন্য আদিবাসি তাদের স্বাভাবিক দক্ষতা দিয়ে জৈব-প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ আর পুনরুৎপাদন করেছে। কিন্তু, ঔপনিবেশিক সময়ে পরিস্থিতির বদল ঘটেছে। ব্রিটিশ শাসক বানিজ্যিক কারণে অস্বাভাবিকভাবে পণ্য উৎপাদন-এর সম্প্রসারণ-এর জন্যে জমি অধ্যুষিত করেছে কৃষিজমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে। গ্রা্মের ঔপনিবেশিকীকরণ আদিবাসীদের সামাজিক সংহতি চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। রেলওয়েতে স্লীপার পাততে শালবন ধ্বংস হয়েছে। রেলপথের বিস্তারের জন্যে পরিকল্পনাহীনভাবে জঙ্গল কাটা হতে থাকায় ভূমিক্ষয় (soil erosion) বেড়ে গেছে - বর্ষায় সেই মাটি বাহিত হয়ে কাঁসাই, সুবর্ণরেখা ও দামোদরে এসে পড়াতে নদীতে চড়া পড়ে তাদের জলধারণক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। গাছ ধ্বংস হওয়ায় সারা অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রাঁচী ও সংলগ্ন অঞ্চল, যার ফলে ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে এক নতুন বিপ্লব-চেতনার জন্ম দিয়েছিল যে ঘটনা সমস্ত আদিবাসী আর ভূমিপুত্র বাঙ্গালিদের জীবনসংগ্রামের ইতিহাস থেকে আলাদা নয়।
‘আমার অরণ্য মাকে কেউ যদি কেড়ে নিতে চায়, আমার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে কেউ যদি অন্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়, আমার ধর্মকে কেউ যদি খারাপ বা অসভ্য ধর্ম বলে, আমাকে কেউ যদি শুধু শোষণ করে নিতে চায় তবে আমি বিদ্রোহ করবই।’ ১৮৯৫-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক বিরসা মুন্ডার এমন চিন্তাচেতনা থেকেই সে সময় উলগুলানের (বিদ্রোহের) জন্ম হয়। উলগুলান আদিবাসীদের দেখিয়েছিল জমিদার, মিশনারি, ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে মুক্তির স্বপ্ন।
মুন্ডা জনগণের কাছে বিরসা আজ কিংবদন্তি। বর্তমানের রাঁচি জেলার উলিহাটুতে ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। বিরসার জন্ম নিয়ে আজো মুন্ডারা গান গায়—
‘হে ধরতি আবা! জন্ম তোমার চালকাদেতে ভাদ্র মাসে,অন্ধজনের চোখ মিলল ভাদ্র মাসে।চলো যাই ধরতি আবাকে দেখি;এ বড়ো আনন্দ হে, তাঁকে প্রণাম করি-
আমাদের শত্রুদের তিনি হারিয়ে দিবেন ভাদ্র মাসে।‘
বিরসার নেতৃত্বে মুন্ডাদের উলগুলান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পৃথিবী যখন তথাকথিতভাবে সভ্য হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশের আদি জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের অসভ্য বলে, নীচ বলে ঘৃণা করা হয়েছে। আদিবাসীরা বহুদিন চুপ করে এসব সহ্য করেছে। যখন অন্যায়-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়েছে, তখন তারা করেছে বিদ্রোহ। এই উলগুলান সেই সময় ইংরেজ শাসকদের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন ছোটনাগপুরের জেলাগুলোয় মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীদের ঘনবসতি ছিল। ১৮৩১-৩২ সালের কোল বিদ্রোহ, ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পরও ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গাগুলোয় আদিবাসীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার চলতে থাকে। আদিবাসীদের শুধু ঠকিয়ে, তাদের ওপর অত্যাচার করে, তাদের বেগার খাটিয়ে ইংরেজরা-জমিদাররা ক্ষান্ত হয়নি। আদিবাসী মুন্ডাদের মধ্যে তারা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে তাদের ধর্মচ্যুত করে। এতে মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি বিপন্ন হতে শুরু করে। অনেক মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসীরা নিজেদের ধর্ম-সংস্কৃতি বিলিয়ে দিয়েও ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তারাও রক্ষা পায়নি। বিরসা মুন্ডার বাবা সুগানা মুন্ডা খ্রিস্টান হয়েছিলেন। কিন্তু যখনই মুন্ডারা তাদের অধিকারের কথা বলেছে, তখনই কী ইংরেজ সাহেব, কী জমিদার, আর কী মিশনারি, কেউ তাদের অধিকারের বিন্দুমাত্র দেয়নি। তাইতো বিরসা বলেছিলেন, ‘মিশনের সাহেব আর অফিসার সাহেব সবাই এক জাতের। সাহেব সাহেব এক টোপি হ্যায়।’
* * * *
১৮৯৫ সালের দিকে ২০ বছরের যুবক বিরসা বুঝতে পারেন আর চুপ করে থাকা চলবে না। মুন্ডাদের আদি ধর্ম থেকে কুসংস্কার বাদ দিয়ে তাদের নতুন ধর্ম শেখাতে হবে। মিশন, সরকারি কর্মচারী, জমিদার, মহাজন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ধর্ম শেখাতে হবে। বিরসা বলেছিলেন, ‘আমি বিরসা নই, আমি ধরতি আবা। এই পৃথিবী আমার সন্তান। আমি মুন্ডাদের নতুন ধর্ম শেখাব। আমি তোদের কোলে নিয়ে ভোলাব না, দোলাব না। আমি মুন্ডাদের মরতে আর মারতে শেখাব।’ বিরসা তার এই নতুন ধর্মে মুন্ডাদের দীক্ষিত করতে শুরু করেছিলেন। কানে কানে খবর পেয়ে রাঁচির ডেপুটি কমিশনার বিরসাকে ধরতে হুকুম দিলেন। এদিকে মুন্ডারি ভাষার পণ্ডিত পাদ্রি হফম্যান ইংরেজ সরকারকে জানান যে, বিরসা স্থির করেছে মিশনারিদের হত্যা করবে। রাতের আঁধারে অভিযান চালিয়ে ধরা হয় বিরসাকে। ইংরেজদের একতরফা সাজানো বিচারে বিরসার দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
দু বছর হাজারিবাগ জেলে থেকে বিরসা মুক্তি পান। বিরসার মুক্তিতে মুন্ডাসহ আদিবাসী সমাজে উৎসবের আমেজ বসে। গ্রামে গ্রামে নাচ-গান ও নাকাড়া বেজে ওঠে। বিরসা আবার তার নতুন ধর্মে সবাইকে দীক্ষিত করতে শুরু করেন। বিরসার নতুন ধর্মে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদেরকে বিরসাইত বলা হত। বিরসাইতরা নানা রকম কাজের ভার পেল। শুরু হলো বিদ্রোহের প্রস্তুতি। সভা হতে লাগল মুন্ডা এলাকার গ্রামে গ্রামে। তামাড় ও খুঁটির পর্বতমালা থেকে কিছু দূরে ডোম্বা বা সাইকোর বনে ঢাকা উপত্যকা ডোম্বারি এলাকায় বিরসা তাঁর প্রধান ঘাঁটি বানিয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৮৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি, তার পর ১৮৯৯ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরে ডোম্বারি পাহাড়ে বিরসাইতরা সভা করে। এ সভায় বিরসা ব্রিটিশ রাজের লাল নিশান দেখিয়ে মুন্ডাদের বলে, ‘দিকু (যারা আদিবাসি নয়) দের সঙ্গে যুদ্ধ হবে। এই নিশানের মত লাল রক্ত বইবে মাটিতে।’
১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে সাহেবদের বড়দিন উৎসবের ওপর বিরসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সিংভূম ও রাঁচির ছ'টি থানায় ২৪ ডিসেম্বর বিরসাইতরা মিশনগুলোয় আক্রমণ করে। বহু মিশন, গির্জায় আগুন জ্বলতে থাকে। বেশকিছু ইংরেজ সাহেব, মিশনারি, চৌকিদার আহত-নিহত হয়। ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে। রাঁচির ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিটফিল্ড বিরসাকে ধরার জন্য পুলিশ নিয়ে আসে। কিন্তু বিরসাকে ধরা যায় না। ১৯০০ সালের ৬ জানুয়ারি ৫০-৬০ জন বিরসাইত বিদ্রোহীরা গয়া মুন্ডা নামক এক বিরসাইতের বাড়িতে মিলিত হয়। খবর পেয়ে সেখানে রাঁচির খুঁটি থানার হেড কনস্টেবল তার দুজন কনস্টেবল ও তিন চৌকিদারকে নিয়ে গয়া মুন্ডার বাড়িতে পৌঁছলে বিদ্রোহীরা দুই কনস্টেবল জয়রাম ও বুদুকে হত্যা করে, অন্যরা পালিয়ে যায়। ঘটনার পর দুমকা ও রাঁচি থেকে পুলিশ বাহিনী, ডোরানডা থেকে সেনাবাহিনী এনে সিংভূম ও রাঁচির কমিশনার বিরসাকে ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সৈলরাকাব পাহাড়ে অভিযান চালায় ইংরেজ বাহিনী। চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় পাহাড়টি। স্ট্রিটফিল্ড বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান করেন, কিন্তু বিদ্রোহীরা তার জবাবে শুরু করে এক অসম যুদ্ধ। একদিকে চলে ঝাঁকে ঝাঁকে বন্দুকের গুলি, অন্যদিকে মুন্ডাদের তীর। অবশেষে বাস্তবতা, আধুনিক অস্ত্র বন্দুকের কাছে তীর পেরে ওঠে না। বিরসা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এই অসম যুদ্ধে অনেক মুন্ডা নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। বিরসাকে ধরার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এদিকে বিরসা গোপনে গ্রামে গ্রামে সভা করতে থাকেন। ১৯০০ সালের ফেরুয়ারির ১৩ তারিখে সেনত্রা জঙ্গলে মনমারু ও জারকাইল গ্রামের কিছু মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করে বিরসাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। তাঁকে এবং ৫৮১ জন বিরসাইতকে বন্দি করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার শুরু হয়। এর মধ্যে তিনজনের ফাঁসি হয় এবং ৭৭ জনের দ্বীপান্তরসহ নানা মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। বিদ্রোহীদের রাঁচি জেলখানায় রাখা হয়েছিল শেকল দিয়ে বেঁধে। ১৯০০ সালের ৮ জুন বিরসা অসুস্থ হয়ে পড়েন ও ৯ জুন রক্ত বমি করতে করতে বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়। বিরসার মৃত্যুতে হাহাকার করে ওঠে মুন্ডারা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কলেরা বলা হলেও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও তার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণের সঙ্গে কলেরা রোগের মিল পাওয়া যায়নি। অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার মনে করেন বিরসাকে অর্সেনিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।
বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের কাছে আজো বিরসা ভগবান হয়ে বেঁচে আছেন। বিরসার উলগুলান আধুনিক অস্ত্রের কাছে পরাজিত হলেও আদিবাসী সমাজ তাঁর এ পরাজয়ে লজ্জিত নয় বরং গর্বিত। তিনি দেখিয়ে গেছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এমনকি আজও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিরসার মতো লড়ে প্রয়োজনে জীবন দিতে হয়। আজো অনেকে সেবার নামে, ধর্ম প্রচারের নামে জনসংখ্যায় কম আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে না দিয়ে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে। সময় হয়েছে প্রত্যেক আদিবাসী এক একজন বিরসা ভগবান হয়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি আর অরণ্যের অধিকার রক্ষার যুদ্ধে শামিল হবে।
No comments:
Post a Comment