

আমার যে দিন...।
বন্ধুরা অনেকে নিজের বাগানের ফুল-ফল-গাছের ছবি পোস্ট করে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, মুগ্ধ হয়ে দেখে যাই শুধু। এখানে মুম্বাইয়ের একচিলতে ফ্ল্যাটবাড়িতে টবে কিছু শৌখিন গাছপালা পুঁতে ফুল-টুল ফোটান বটে আমার গিন্নি, ভাল লাগে, কিন্তু নস্টালজিক মন ছেলেবেলার কথা মনে করে তেমন নাড়া খায় না তা দেখে।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বিহারের (এখন ঝাড়খণ্ড) দামোদর-তীরের ছোট্ট এক আধা-শহরে। এ এক এমন জায়গা যে গুগল ম্যাপে চেষ্টা করেও বাড়ি-ঘর খুঁজে পাবে না সেখানে, মনে হবে যেন গভীর জঙ্গল। হবে না কেন? বেশির ভাগ বাড়িই একতলা নয় দোতলা, অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কয়েকটা তিনতলা হোস্টেল বাদে। ছিল গোটা দুই মস্ত কারখানা- সার আর সিমেন্টের, দ্বিতীয়টা আজও আছে, সারের কারখানা সরকার, শিল্পপতি আর ইউনিয়নের মিলিত চক্রান্তে বন্ধ হয়ে গেছে সতের বছর আগে। কিন্তু কলোনি ছিল চোখ জুড়োন, চৌকো রাস্তা, প্ল্যানমাফিক সাজানো কোয়ার্টার্স আর বাংলোগুলো, আর ছিল সবুজের সমারোহ রাস্তার দুপাশ, বাড়ির বাগান জুড়ে। অজস্র মহীরূহের মাঝে চোখে আর নাকে পড়ার মত ছিল পলাশ-কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া-ছাতিম আর কদম। বসন্তে চারপাশ রঙিন হয়ে উঠত আর বর্ষার মুখে কদমের ডালে মেলা লাগত হলুদ-গোলাপি ফুলের। বর্ষা শেষ হতে না হতেই পুজো আসার অগ্রিম সংবাদ জানা যেত থোকায় থোকায় ফুটে থাকা সপ্তপর্ণী (ছাতিম) ফুলের তীব্র গন্ধে। আমাদের স্কুল ছিল বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। বাস ছিল, কিন্তু এই ফুলগুলোর লোভে প্রায়ই বাস ছেড়ে দিয়ে সবান্ধবে হাঁটা দিতাম, বৃষ্টির প্রথম ধারায় স্নান করাটা ছিল উপরি পাওনা। কদমের ফুল গাছে চেপে পাড়ার ক্ষমতা হত না, তবে যে পরিমাণ পড়ে থাকত গাছের তলায় তলায়, সেগুলোই কুড়িয়ে জমাতাম, অকারণেই। তখন আমাদের প্রথম কদম ফুল দান করার কেউ ছিল না, হয়ত সে বয়সও হয়নি, তাই নিজের ফুল নিজেকেই কুড়োতে হত। অবশ্য দু-চারটে মেয়েও যে থাকত না সে দলে তা নয়, তারই কোন একটিকে দেখে হয়ত জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন-
"কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"
একেবারে নিখুঁত ছবি, যদিও উনি এ শহরে কোনদিন এসেছেন বলে শুনিনি।
তবে আসল মজাটা পেলাম হাইস্কুলে যাবার পর। সেখানে দুটো বিল্ডিংএর মাঝে ছিল একটা বিশাল মহুয়া গাছ। আমাদিগকে তখন একটা পেপার হিন্দি আর একটা বাংলা পড়তে হত। হিন্দিভাষী ছেলেদের পড়তে হত দুটো হিন্দির পেপার। তা ওদের হিন্দি-২ এর সময় আমাদের বাংলা থাকত। কিন্তু ক্লাসরুম অত না থাকায় হরিদাস স্যার বা দাস স্যার আমাদের কয়েকজন বঙ্গসন্তানদের নিয়ে পড়াতে বসতেন বাইরে গাছতলায়, একেবারে শান্তিনিকেতনী স্টাইলে। কিন্তু পড়ব কী? 'সেদিন চৈত্রমাস'। সর্বনাশ হওয়ার বা ঘটানোর বয়স আমাদের না হলেও একটা জিনিষ দস্তুরমত টের পাচ্ছি সেটা সবজে কমলা রঙের মহুয়ার ফুল- প্রচুর পড়ে আছে গাছের তলায়। কী মিষ্টি গন্ধ- ঠিক যেন গোবিন্দভোগ চালের পায়েস, ভুর ভুর করছে চারপাশ। বাংলা পড়তে পড়তে অন্যমনস্কভাবে একটা মুখে তুলে নিতাম, এ হে হে- কিছুটা টক, আর বেশ তিতকুটে। এর চেয়ে বরং পাকা নিমফল ভাল! তখনও কি জানতাম এর মাদকতার কথা যেটা না চেখেই হয়ত কবিগুরু এন্তার কথা লিখে গেছেন-
"চৈত্রদিনে তপ্ত বেলা তৃণ-আচঁল পেতে
শূণ্যতলে গন্ধভেলা ভাসায় বাতাসেতে-
কপোত ডাকে মধুকশাখে বিজন বেদনায়।।"
(মধুক মানে যে মহুয়া সেটা তখন জানতাম না)
শূণ্যতলে গন্ধভেলা ভাসায় বাতাসেতে-
কপোত ডাকে মধুকশাখে বিজন বেদনায়।।"
(মধুক মানে যে মহুয়া সেটা তখন জানতাম না)
ঠিক এই গন্ধে ভরা দুপুরগুলোকে আজও মিস করি। ইতিহাস রাখি নি, 'তবু উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস'। বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপে কারখানা আবার চালু হতে চলেছে- সেই ছেলেবেলার বন্ধ স্কুলে আজ সেই কন্সট্রাকশন শ্রমিকদের ডেরা, সেই স্কুল, সেই শহর আর আমার নয়। তবু সুযোগ পেলেই এখনকার খাঁচার পাখি তখনকার বনে-জঙ্গলে ছুটে যাই।
আজ করোনাভাইরাসের আতঙ্কে গৃহবন্দী হয়ে এইসব কথাই চিন্তা করছিলাম। তবে না, কদমফুলের সঙ্গে নভেল ভাইরাসের চেহারার মিলটা সেই মুহূর্তে মাথায় আসে নি, এটা নিছক একটা সমাপতন!
মুম্বাই, ১৪২৭।
সঙ্গে ফটো- বুড়োবয়সে আবার দেখতে গেছি বাল্যের শহরকে, সবান্ধবে
No comments:
Post a Comment