এবার একটু সুর ও রাগ প্রসঙ্গে আসি । 'সঙ্গীত ও ভাব' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন যে 'আমাদের দেশের সঙ্গীতে রোদনের সুরের অভাব নাই, সকল রাগিনীতেই প্রায় কাঁদা যায় ।...যাহা কিছু সুখের রাগিনী আছে, তাহা বিলাসময় সুখের রাগিনী, গদগদ সুখের রাগিনী ।...উল্লাসের গান রচনা করিতে হইলে রাগিনী যে ভাবেরই হউক তাহাকে দ্রুত তালে বসাইয়া লই...।' অর্থাৎ সুরের সাথে সাথে তাল-লয়ও ভাব প্রকাশের একটা অঙ্গ । কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রতিটি রাগের এক বিশেষ সময় ও ভাব আছে, যেমন ইমনের নি্-রে-গা-হ্ম-গা-রে-নি্-রে-সা'র পকড়টুকু বা পুরবীর মধ্যম থেকে মীড় দিয়ে ঋ ছুঁয়ে ষড়জে আসতেই মনে হয় সন্ধ্যা হল...'আর নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে ।' অথচ আশ্চর্য, তাঁর গানে রাগ-রাগিনীর শুদ্ধতা রক্ষার প্রয়াস তাঁর মোটেও ছিল না । 'সঙ্গীতের মুক্তি' প্রবন্ধে তিনি সময় ও ভাবের বেড়াজাল থেকে রাগ-রাগিনীর মুক্তি আর কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দ থেকে গীতিকাব্য বা lyrics কে মুক্তি দিয়েছেন । তাই ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫-এ জাহাজযাত্রীর ডায়েরিতে তিনি লিখলেন-
"তাল আর সা-রে-গ-ম যখন কেবলমাত্র বাহিরের তথ্যরূপে কানের উপর, মনের উপর পড়তে থাকে, তখন তার থেকে মুক্তি পাবার জন্যে চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে; কিন্তু যখন সেই তাল আর সা-রে-গ-ম'র ভিতর থেকেই সঙ্গীতকে দেখতে পাই তখন মাত্রায় অমাত্রকে, সীমায় অসীমকে, পাওয়ায় অ-পাওয়াকে জানি- তখন্ই আনন্দে মনে হয় সব দিতে পারি । কার জন্যে? ঐ সা-রে-গ-ম'র জন্যে? ঐ ঝাঁপতাল-চৌতালের জন্যে? দুন-চৌদুনের কসরতের জন্যে? না- এমন কিছুর জন্যে যা অনির্বচনীয়, যা পাওয়া-না-পাওয়ায় এক হয়ে মেশা; যা সুর নয়, তাল নয়, সুর তালে ব্যাপ্ত হয়ে থেকে সুর-তালের অতীত যা, সেই সঙ্গীত ।"
আমাদের পাড়ার বিলুকাকুদের বাড়ি শ্রদ্ধেয় প্রসাদ সেনের পারিবারিক সূত্রে যাতায়াত ছিল । উনি এলেই পাড়ার রসিকজনেরা ভীড় করতেন, গান-বাজনার আসর বসত । সেবার এসেছেন পুত্র সত্যকামকে নিয়ে । তাকে আমরা ধরলাম, কমবয়সিদের নিয়ে তার বাবা যেন একটা workshop জাতীয় করেন । প্রসাদ সেন এককথায় রাজী । প্রায় জনা ৭-৮ ছেলেমেয়েকে নিয়ে উনি 'দীপ নিভে গেছে মম' গানটি নিয়ে লেগে পড়লেন ।
এই গানটি বিহগ বা বেহাগ রাগের উপর, ঝাঁপতালে নিবদ্ধ । বেহাগ রাত্রি দ্বিপ্রহরে গেয় রাগ, সকলে ঘুমিয়ে পড়লে গাওয়া
জীবনের চলার পথে মাঝে মাঝেই এরকম মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছি আর সবার অলক্ষ্যে কুড়িয়ে ঝুলিতে ভরেছি তাঁদের অজান্তে পথের দুধারে ছড়িয়ে পড়া মণিমুক্তো । শ্রী হরিনারায়ন চক্রবর্তী শেখাচ্ছেন নজরুলের 'হে পার্থসারথি' গানটি । শিবরঞ্জনী, তিনতাল । এটি আবার কাফি ঠাটে, উড়ব জাতির রাগ । ভূপালির গ-নি কোমল করে নিলেই মোটামুটি শিবরঞ্জনি । তা দ্বিতীয় লাইনেই খটকা- 'চিত্তের অবসাদে' শুদ্ধ গান্ধার কেন? উত্তর সেই একইরকম পেলাম, 'অবসাদ' বোঝাতে বিবাদী সুরের প্রয়োগ । কি বলব? Great men think alike?
।।৪।।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি বলতে পারি, যদিও প্রতিটি রবীন্দ্রসঙ্গীতই আমার প্রিয়, তবু তারই মধ্যে বাছাই করতে বললে উঠে আসবে প্রকৃতি পর্যায় এবং অবশ্যই বর্ষার গান । কিন্তু বর্ষার গান মানে কি তা বর্ষারই গান? সযত্নকল্পিত পর্যায়ের পরিধি ছাড়িয়ে তাঁর গানে কি প্রকৃতি-পূজা-প্রেম-স্বদেশ-বিচিত্র সব একাকার হয়ে যায়নি । 'গীতাঞ্জলি' তো তাঁর জীবন দেবতার চরণে শ্রদ্ধার্ঘ । সেখানে তো বর্ষার গানের ছড়াছড়ি, অবশ্যই যে ৫৬টি গানে সুর দেওয়া হয়েছে আমি তাদের কথাই বলছি । 'এই বর্ষাসঙ্গীতের সুরে ক
...েবল বর্ষার ঝংকার নাই, বর্ষণের অন্তরালে যিনি আছেন তাঁহারই নূপুরনিক্কন শোনা যায়, সৌন্দর্যের অন্তরালে সুন্দরকে যেন দেখা যায়...এই গীতধারায় দেবতা ও প্রকৃতি এবং তাহার সঙ্গে মানব অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা পড়িয়াছে- সৌন্দর্য্ ও সুন্দর একাঙ্গীভূত অদ্বৈত হইয়াছে ।...তাই গীতাঞ্জলি প্রমুখ কাব্যে ঈশ্বর ও প্রকৃতি এমন ওতপ্রোতভাবে মিলিত, প্রিয়তমের বিরহ-বেদনা ছন্দে ও সুরে মুখর;...কিন্তু কবির জীবন যতই গভীরে প্রবেশ করিল, প্রকাশের ভাষা ততই রূপকের সুরে ছন্দে-রহস্যে ভরিয়া উঠিল; পরে ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে মুখ্য-গৌণ ভেদ ঘুচিয়া গিয়া অখণ্ড রস-বোধে সমস্ত চিত্ত প্লাবিয়া একাকার হইয়াছিল ।' (প্রভাত মুখো-২)
এই প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির একটি গানের উল্লেখ করছি-
'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরাণসখা বন্ধু হে আমার ।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার ।।'
গানটি হয়ত আষাঢ় ১৩১৬ তে লেখা, কিন্তু পাণ্ডুলিপিতে বোট, শ্রাবন ১৩১৬ দেখা যায় । কবি তখন শিলাইদহে বোটে অবস্থান করছিলেন । প্রবল বেগে পূবে বাতাস বইছে, পদ্মা একূল থেকে ওকূল পর্যন্ত তরঙ্গিত- মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি গানটি লেখেন ও সম্ভবতঃ দেশরাগে সুরারোপিত করেন । গানটি যখন 'কেতকী'র অন্তর্ভুক্ত হয়ে গীত হয়, তখন এটি শুধু বর্ষারই গান, কিন্তু যেমনি বলা হল এটি গীতাঞ্জলির গান, এর আরেক আধ্যাত্মিক রূপ চোখের উপর ফুটে উঠল ।
প্রেম-পূজার একাকারের প্রসঙ্গে অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন । আবার 'কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস' গানটিতে এই সাধক-প্রেমিক-পাগলটিকে কি আমরা ঠিক চিনতে পারি? কে জানে তিনি হয়ত দেশ-মাতৃকার কোনও বরপুত্র । আমরা একবার নেতাজী জয়ন্তীতে কোরাসে গানটি গেয়েছিলাম, তখন সবাই একবাক্যে বলেছিল, হ্যাঁ কবি সুভাষকে ভেবেই এটা লিখেছিলেন । বস্তুতঃ গানটির রচনার সময় সুভাষের বয়স তের পূর্ণ হয় নি !
কবিগুরুর এক একটি গান যেন একেকটি পৃথক রত্নখনি, নানা রূপে তাদেরকে আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার করা যায় । তবে আমার একটি বিষয়ে ছোটবেলায় বেশ খানিকটা খটকা ছিল- সেটা হল রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষ গায়কি । আর একটা জিনিষ, তাঁর গান নাকি ভাব-প্রধান, সুতরাং অর্থ না বুঝলে গায়কী আসবে না, গানের পরিপূর্ণ ভাবটি ফুটে উঠবে না । আমি সেজন্য কোনও গান শেখার আগে তার মূল অর্থটা যথাসম্ভব হৃদয়ঙ্গম করে নিতাম । গানটা শুদ্ধরূপে গাইলেও আমার গলা সেরকম appealing ছিল না, তাই যে কোনও প্রতিযোগিতায় যাদের গলা ভাল অথচ গানের মানে একবর্ণ বোঝে নি, তারাই প্রথম হত । এটা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনার পর আমার গুরুস্থানীয় ডাঃ প্রদীপ ঘোষের কাছে ছুটেছি কারণ অনুসন্ধানে ।
।।৫।।
না, হিন্দুস্থানী বা কর্নাটকী কোনও সঙ্গীতশৈলীর সাথেই রবীন্দ্রনাথের কোনও বিরোধ ছিল না । শ্রী দিলীপকুমার রায়ের সাথে আলাপ-আলোচনা পর্বেই তার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় । তিনি তাঁর গানে শিল্পীকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেননি বলে শ্রী রায় অভিযোগ তোলেন । কবিবর বললেন, ' না, এ কথা আমি অস্বীকার করিনা বটে । কিন্তু তাই বলে তুমি কি বলতে চাও যে, আমার গান যার যেরকম ইচ্ছা সে তেমনিভাবে গাইবে ? আমি তো নিজের রচনাকে সেরকমভাবে খন্ডবিখন্ড করতে অনুমতি দিইনি । যে রূপসৃষ্টিতে বাহিরের লোকের হাত চালাবার পথ আছে তার এক নিয়ম, আর যার পথ নেই, তার অন্য । হিন্দুস্থানী সংগীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাঁক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন । তাই কোনও দরবারী-কানাড়ার খেয়াল সাদামাটা ভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া-নেড়া না শুনিয়েই পারে না, কারণ দরবারী কানাড়া তানালাপের সঙ্গেই গেয় । কিন্তু আমার গানে তো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে অন্য সেটা ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব ।' (সংগীতচিন্তা)
সুতরাং দেখতে পাচ্ছি, রাগ-সংগীতে কথার দৌর্বল্য বা রাগ-রূপ অনুযায়ী কথার বিন্যাস ইত্যাদি নয়, সুরের মধ্যেকার ফাঁক নিয়েই ছিল তাঁর বিষম চিন্তা । একটা উদাহরণ দিচ্ছি । মেঘ-ঝাঁপতালে নিবদ্ধ তানসেন রচিত খেয়ালটি মনে করুন-
'প্রবলদল সাঁজি ঝুক ধূমায়ত ভূমাপর
উমড়ঘন মেঘ দল ইন্দ্র লে আও রে ।।'
সেই সুরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-'তিমিরময় নিবিড়-নিশা, নাহিরে নাহি দিশা
একেলা ঘন-ঘোর পথে পান্থ কোথা যাও ?'
বলা বাহুল্য এ গান রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ওঠার কোনও কারণ ছিল না । তফাতের মধ্যে তিনি গানটিকে ধ্রুপদাঙ্গে বেঁধে একটা করে সঞ্চারী আর আভোগ জুড়ে দিলেন । তান জুড়বার আর কোনও প্রয়োজনই থাকল না । তাছাড়া তাঁর টপ্পা-অঙ্গের গানগুলির সুর তিনি বা দিনু ঠাকুর এমনভাবে করে গেছেন যে শিল্পীর গলা খেলানো তাঁর গলার দখলের উপর সীমিত থাকে । 'শুধু তোমার বানী' তে শান্তিদেব যে স্বাধীনতা নিয়েছেন, হেমন্ত গলার পরিমিতি বুঝে সাদামাটা গেয়েছেন । 'বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী' স্বাগতালক্ষ্মী পুরো কর্ণাটকী করে ছেড়েছেন । পূরবী মুখোপাধ্যায় কি তা পারেননি, না স্বাভাবিক সংযম দেখিয়েছেন, কে জানে !
এহ বাহ্য । একসময় সাহানা দেবী ছিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্রী । রবি ঠাকুর নিজেই একস্থানে লিখেছেন, 'আমার গান ঝুমু-র মত করে গাইতে আর কেউ পারেনা'। কিন্তু পরবর্তীকালে পঙ্কজকুমার যখন তাঁর স্বভাব-সিদ্ধ টানে (একটি ছায়াছবির জন্য চাইতে এসে) ' কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে' গানটি শোনান, মুগ্ধ হয়ে যান গুরুদেব । পঙ্কজকে তিনি খোদার উপর খোদকারির কিছুটা স্বাধীনতা দেন । তার ফলস্বরূপ আমরা পাই 'দিনের শেষে ঘুমের দেশে' র মতো সুর । শান্তিদেব ঘোষ বা কণিকাকেও তিনি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন তাঁরা কেউ তাঁর গানের অমর্যাদা করবেন না ।
এতক্ষণ কথা হচ্ছিল শ্রদ্ধেয় ডাঃ প্রদীপ ঘোষের সাথে । তিনি ছিলেন প্রজেক্টস্ এণ্ড ডেভেলপমেন্ট ইণ্ডিয়ার Physical Research Wing-এর প্রধান, অথচ সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী । আমি বললাম, কাকু, বুঝলাম যে কবিগুরুর গানের কাঠামোটাই এমন যে শুদ্ধ সুর-তাল-লয়-উচ্চারণ বজায় রেখে গাইলেই তার ভিতরের ভাবটি বাইরে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে, গায়ক ভাবার্থটি না বুঝলেও চলে । ঠিক, তিনি বললেন । তবে হ্যাঁ, অধিকন্তু ন দোষায় । গানের মানে বুঝলে তোর গাইতে আরো ভাল লাগবে, গানের মধ্যে প্রাণসঞ্চার হবে ।
আমার চোখ তখন টিভির পর্দায় । সব ভাষায় একে একে গাওয়া হচ্ছে- 'বাজে সরগম হর তরফ সে, মিলে বনকে দেশ রাগ' । আমি বললাম, কাকু এই দেশাত্মবোধক গানে সাথে দেশরাগ মেলানোর পরিকল্পনাটা দারুণ না !'
'সেটাও কে প্রথম করেছিল, জানিস? বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম্'এ দেশরাগে সুর দেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেটা ছিল ১৮৮৬ সাল, পরে ১৮৯৬ এর একটি প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস অধিবেশনে গানটি প্রথম গাওয়া হয় ।'
।।৬।।
আমার ঠাকুর্দা উকিলের পেশার বাইরে একজন সাহিত্যপ্রেমী ও সংগীতজ্ঞও ছিলেন । ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলাম উনি পাখোয়াজের পণ্ডিত ছিলেন ও বেনারস সংগীত-সমাজ থেকে বাদ্য-বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন । আর আমার সেজমামা ছিলেন বিশ্বভারতী সংগীতভবনের স্নাতক ও দুর্গাপুরের 'স্কুল অফ ম্যুজিকের' শিক্ষক, আমাদের বাড়ি মাঝে মাঝে আসতেন । তিনি এলে আমরা ভাই-বোনরা সমেত বাবা-মার মধ্যেও উৎসব লেগে যেত, এমনকি গম্ভীর ঠাকুর্দাও উচছ্ল হয়ে পড়তেন । সেজমামা কিন্তু এসে প্রথমেই ঠাকুর্দার সাথে আড্ডা জুড়ে দিতেন । আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু খুব মনযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতাম, বুঝি বা না বুঝি । একদিনকার একটি নমুনা দিচ্ছি-
মামা- মেসোমশাই, টপ্পা নাম কিভাবে এসেছে?
ঠাকু- ঘোড়া যখন ছোটে, তার পায়ের 'টপ-টপ' শব্দ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বা তার উল্টোটা যেমন হয়, মূলতঃ পঞ্জাবের এই গায়ন-রীতিতে গমক ও বিস্তারগুলো তালের সাথে সংগতি রেখে সেভাবেই ছুটে চলে বলে একে টপ্পা বলে ।
মামা- তাহলে টপ্পায় তাল থাকে? কিন্তু টপ্পা-অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত তো কেউ তালে গান না ।
ঠাকু- টপ্পার তাল অধিকাংশই মধ্যমান বা আড়াঠেকা হয় । কেন, দিনু ঠাকুর, শান্তিদেব, রাজেশ্বরী, কানা কেষ্ট- এঁরা তো তালেই টপ্পা গাইতেন । তবে রবি ঠাকুর শেষ বয়েসে টপ্পা-জাতীয় গান বিনা তবলাসংগতে গাইতে স্বচ্ছন্দ-বোধ করতেন, সেই থেকেই বোধহয় রীতিটা চালু হল । তাছাড়া টপ্পা ও টপ-খেয়াল তালে গাওয়া খুব কঠিনও বটে ।
মামা- টপ্পা পঞ্জাবী গান বলছেন, তাকে বাংলায় আমদানী করলেন কি রবীন্দ্রনাথ ?
ঠাকু- তোমার কাছে এ প্রশ্ন আশা করিনি বিজয় । নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তই প্রথম বাংলায় টপ্পা লেখেন ১৭৮০ সাল নাগাদ । তাঁর বানীই ছিল-'নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?'
বলা বাহুল্য, এ সংলাপের অধিকাংশই তখনও বুঝবার বয়স আমার হয়নি । তাই যতশীঘ্র সম্ভব মামাকে দাদুর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা দখল করে বসাতাম । শুরু হত কবিগুরুর গান নিয়ে গান গান খেলা । 'আমার মনের কোনের বাইরে', 'ওরে ওরে আমার মন মেতেছে', 'ভালমানুষ নইরে মোরা', 'হ্যাদে গো নন্দরানী'্মামার এসব গানের সাথে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম ।
কথাগুলো সেদিন না বুঝলেও, পরবর্তীকালে শ্রী সুবিনয় রায়ের লেখা পড়ে ধারণা কিছুটা স্বচ্ছ হয়েছে । উনি আবার রবীন্দ্র-রচিত টপ্পাগুলিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন- হিন্দী টপ্পা-ভাঙ্গা, টপ-খেয়াল ভাঙা ও ঢালা-গান বা রবীন্দ্র-টপ্পা । হিন্দী (বা পঞ্জাবী) ভাঙা টপ্পাগুলি গাওয়া হবে মধ্যমান তালে, যেমন- 'কে বসিলে আজি', 'হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল' বা 'এ পরবাসে রবে কে' ইত্যাদি । টপ-খেয়াল ভাঙা গানগুলি গাওয়া হয় আড়াঠেকা বা বিলম্বিত একতালে । উদাহরণ- 'চিরসখা হে ছেড় না', 'একি করুণা হে', 'এ মোহ আবরণ' ইত্যাদি । ঢালাগান হচ্ছে কবিগুরু রচিত টপ্পা অঙ্গের কাব্যসংগীত যা তাল বিনা বা ঢালালয়ে গীত হয় । শ্রী রায় এই ধরণের গানগুলি যেমন- 'আমি রূপে তোমায়', 'সার্থক জনম আমার', 'তবু মনে রেখ', 'তোমায় নতুন করে পাব' ইত্যাদিকে তাল ছাড়াই গাইতে বলছেন, কারণ এগুলিতে তাল রাখা এবং স্বরলিপির নির্দেশ পালন করা এমনকি নিখুঁত স্বরলিপি তৈরি করাও বেশ কঠিন ।
এই প্রসঙ্গে জানাই যে রবি ঠাকুর, যিনি চিরকাল সংগীত ও কাব্যের মুক্তি, হৃদয় ও মনোবিকাশের মুক্তির কথা সোচ্চারে বলে এসেছেন, তিনি হঠাত নিজের গানের বেলায় এত রক্ষণশীল হয়ে পড়লেন কেন? ধ্রুপদ বা খেয়ালাঙ্গের গানে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, রশিদ খান বা পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর পারঙ্গমতা প্রশ্নাতীত । তাঁরা যদি তান-বিস্তার করেন, পরিমিতি বোধটুকু রেখেই করবেন, এবং করেছেনও । তবু তা শ্রোতাদের মনে দাগ কাটতে পারেনি । তাতে একটা জিনিষই প্রমাণিত হচ্ছে যে পরিমার্জন যতই সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক, রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতা তাদের প্রিয় গানের উপর কোনও কালোয়াতি অত্যাচার সহ্য করতে রাজী নন, এমনকি গলার সূক্ষ্ম কারুকাজের বিন্যাসও নয় । হয়ত এ জিনিষটা কবিগুরুও আন্দাজ করেছিলেন । কি জানি !
যাই হোক্, সেজমামা চলে যাবার পর আমি ঠাকুর্দাকে নিয়ে পড়লাম, দাদু আমাকে একটা রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়ে দাও । উনি সেদিন পাত্তা দেন নি । পরে আমার এক পিসতুত দিদি কিন্তু ঠিক একটা গান আদায় করে নেয় । আমার এখনও মনে আছে দিদির গানের খাতায় 'সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে' গানটির উপরে ঠাকুর্দা বড় বড় করে লিখেছেন- 'ইমনকল্যাণ- তেওড়া' । আমি কিছুই বুঝিনি, দিনের পর দিন শুধু ভেবেছি এগুলো কি ধরণের জীবজন্তুদের নাম ।
।।৭।।
কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল যে ইমনকল্যাণের রহস্য হয়ত ঐ হারমোনিয়ামটাতে লুকোনো আছে, তাই একদিন ওটা টেনে বের করলাম । পরপর রীডগুলো বাজিয়ে এক অদ্ভুত সুর বেরোচ্ছে, সিনেমায় ভয়ের বাজনার মতো । আবার মাঝের এক-আধটা রীড ছেড়ে ছেড়ে বাজালে ভালই লাগছে । এমন সময় সেই দিদি এসে পড়ে এক ধমক দিল । তারপর কি মনে করে সা-রে-গা-মা'র রহস্য হারমোনিয়ম ধরে বোঝাল আমাকে, এমনকি কড়ি-কোমল ভেদও । বারোটা সুর আর দশটা ঠাটের কথা সেই প্রথম শুনলাম, যদিও দিদি ছটার বেশী নাম বলতে পারেনি সেদিন । তবে এটুকু সেদিন জেনে গেলাম যে সবকটা শুদ্ধসুর পরপর গেয়ে বা বাজিয়ে গেলে আর সেভাবেই নেমে এলে হয় বিলাওল ঠাট ও রাগ ।
একদিন শুনছি ঠাকুর্দা সেজমামাকে ধমক দিচ্ছেন, এই যে তোমরা ছাত্র-ছাত্রীদের হারমোনিয়ম ধরিয়ে দিয়ে তাদের মাথাটি খাচ্ছ, এটা কি ভাল হচ্ছে? জান, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে হারমোনিয়মের ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন । মামা আর কি করেন, মাথা চুলকে বললেন, কি করি মেসোমশাই? তানপুরাই সব জায়গায় পাই না, এস্রাজের ছড়ি ধরবে কে । কিন্তু রবি ঠাকুর হারমোনিয়ম মানা করতেন কেন? মামা বললেন, তুই বুঝবি না এখন । আমি বললাম, বুঝেছি, হারমনিয়মে এক সুর থেকে আরেক সুরে গড়িয়ে যাওয়া যায় না । মামা আমার গালটা টিপে দিয়ে বললেন, বাঃ, ঠিক ধরেছিস তো! তবে এছাড়াও ২২টা শ্রুতির মধ্যে মাত্র বারোটা ধরা যায় রীডে, অতিকোমল, অনুকোমল, অতিতীব্র- এরা আসে না । আমি একে শ্রুতি শুনেই ঘাবড়ে গেছি, তারপর দ্বারাবতী, কুমুদ্বতী...কি সব নাম আউড়ে গেলেন সেজোমামা যে আমি একেবারে নির্বাক ।
যাক্গে, এসব ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে । আমার একসময় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বোনের গানের শিক্ষিকা গৌরীকাকীর সাথে । বোনকে ছাড়তে-আনতে যাওয়ার ফাঁকে প্রচুর প্রশ্ন থাকত আমার, আর তার জন্যে কাকীকে কখনও বিরক্ত হতে দেখিনি । উনি আমায় বুঝিয়েছিলেন যে গানের আগে রাগ আর তাল জানিয়ে রাখলে প্রয়োজনে তানপুরায় রাগ অনুযায়ী বাঁধা যায়, রাগের আলাপ সেরে গান ধরা যায়, তবলচিও তালের ঠেকা দিয়ে ধরাতে সাহায্য করতে পারেন । দেখতাম, 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে' গাইবার আগে উনি দ্বিতীয় তারটাকে পঞ্চম (মালকোষে বর্জিত) থেকে বদলে মধ্যমে বেঁধে নিতেন, বাগেশ্রীর আগেও তাই করতেন । কল্যাণ ঠাটের রাগ গাইলে ওটা তীব্র মধ্যম করে নিতেন । সংগীতজ্ঞ পাঠক হয়ত এই প্রাথমিক পাঠে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু সেই সময়ই ঐ ছোট শহরের সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে আমি রাগ ভূপালির কল্যাণ ঠাটে অন্তর্ভুক্তির কারণ জিজ্ঞাসা করে সন্তোষজনক উত্তর পাই নি, জেনেছি তার অনেক পরে ।
আবার ফিরে আসি রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে, ১৮৭৮ সালে যাকে বলা হত 'রবিবাবুর গান'। ভারতীয় ঘরানাভিত্তিক (মূলতঃ বিষ্ণুপুরী) রাগসংগীতের সাথে পাশ্চাত্য সুর মিলিয়ে যার সৃষ্টি, তার সযত্ন-লালিত পরিণতি হল এই রবীন্দ্রসংগীত- বাঙালির আনন্দ-বেদনার এক গুপ্ত আশ্রম যেন তাঁর এই কথা ও সুর । সাথে একটু পরিণত বয়সে মিলিত হল কবির কুষ্টিয়া-শিলাইদহ-গড়াইবিধৌত জীবন বাংলা লোক এবং লালনের বাউলসংগীতের প্রভাব । যে কারণে সূচনাপর্বের যেমন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশ্রণে সমৃদ্ধ, তেমনি মানবজীবনের বৈচিত্র্যময় ভাবনা ও সৃষ্টি-স্রষ্টা রহস্যের ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের মধ্যে যে জীবন দেবতার সন্ধান করেছেন তিনি, তা বাউল ঘরানার 'মনের মানুষ' প্রভাবিত অথবা একই উৎসজাত । কিসের অনুপস্থিতি বা কী লুকিয়ে আছে কবির মাঝে- 'আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়...'। তাই মনের মাঝে অন্য কার যেন উপস্থিতি মাঝে মাঝেই জানান দেয়-
'মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা-
সে আমায় জানি পাঠায় বানী গানের সুরে লুকিয়ে তারে'...।
তাকে শোনার জন্যেই যেন তিনি বারে বারে কান পেতে থাকেন 'আপন হৃদয় গহন-দ্বারে' । তাই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে তিনি লেখেন- 'বাদলের বায়ে প্রদীপ নিভায়ে জেগে বসে আছি আঁধারে' ।
যে লুকিয়ে ছিল সে নিশ্চয়ই কবির প্রেমিকা নয়। শান্তিদেব ঘোষ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল' গ্রন্থে তাই বলেছেন, 'আমরা জানি বাউলদের মতোই গুরুদেব তাঁর প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের অনেক গানে বারবার এক গভীর বেদনা অনুভব করেছেন কোনো এক প্রিয়ার অনুপস্থিতির জন্য'। এই প্রিয়াই কি তাঁর জীবনদেবতা অথবা মনের মানুষ ?
।।৮।।
রবি ঠাকুরের গান সম্বন্ধে যে কোনও আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি কীর্তন, বাউল ও লোকগীতির প্রসঙ্গ না আসে । ১৯২৪-এ বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ তার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি- "বাংলাদেশের নতুন একটা ভাব গ্রহণ করবার সাহস ও শক্তি আছে এবং আমরা তা বুঝিও সহজে। কেননা অভ্যাসের জড়তার বাধা আমরা পাই না। এটা আমাদের গর্বের বিষয় । ....একটা খুব বিস্ময়কর জিনিস দেখানো যায়-- হিন্দুস্থানী গান বাংলায় আমল পায় নি। এটা আমাদের দৈন্য হতে পারে। অনেক ওস্তাদ আসেন বটে গোয়ালিয়র হতে, পশ্চিমদেশ দক্ষিণদেশ হতে, যাঁরা আমাদের গান বাদ্য শেখাতে পারেন, কিন্তু আমরা সে-সব গ্রহণ করি নি। কেননা আমাদের জীবনের স্রোতের সঙ্গে তা মেলে না । ...বাংলা কি গান গায় নি? বাংলা এমন গান গাইলে যাকে আমরা বলি কীর্তন। বাংলার সংগীত সমস্ত প্রথা-- সংগীতসম্বন্ধীয় চিরাগত প্রথার নিগড় ছিন্ন করেছিল। দশকুশী বিশকুশী কত তালই বেরোল, হিন্দুস্থানী তালের সঙ্গে তার কোনোই যোগ নেই। খোল একটা বেরোল, যার সঙ্গে পাখোয়াজের কোনো মিল নেই। কিন্তু, কেউ বললে না এটা গ্রাম্য বা অসাধু। একেবারে মেতে গেল সব-- নেচে কুঁদে হেসে ভাসিয়ে দিলে। কত বড়ো কথা- "আমার গান আমি গাইব।'! ছন্দ ও ভাব সম্বন্ধে আমাদের গীতিকাব্য যে-একটা স্বাতন্ত্র্য ও সাহসিকতা দেখিয়েছে অন্য দেশে তা নেই । ...আমার বিশ্বাস আমাদের বৈষ্ণব কবিরা ছন্দ ও ভাব সম্বন্ধে খুব দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন। প্রচলিত শব্দ ভেঙে চুরে বা একেবারে অগ্রাহ্য করে- যাতে তাঁদের সংগীত ধ্বনিত হয়, ভাবের স্রোত উদ্বেল হয়ে ওঠে, তেমনি শব্দ তাঁরা তৈরি করেছেন। আমি তুলনা করে কিছু বলব না, কিন্তু, গান সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ আপনার গান আপনি গেয়েছে। ভারতবর্ষের অন্যত্র যা সম্পদ আছে তা আমরা নিশ্চয়ই গ্রহণ করব, কিন্তু তুলনা-দ্বারা তার যথার্থ মূল্য যাচাই করে নেব। সুতরাং হিন্দুস্থানী সংগীত শিক্ষা দেবার আমি পক্ষপাতী, কিন্তু এ কথা আমি বলব না যে-- "যা হয়ে গেছে তা আর হবে না।'। .... আমাদের দেশের শৌখিন ধনী লোকেরা হিন্দুস্থানী গায়কদের আহ্বান করে আনতেন, কিন্তু বাংলার হৃদয়ের অন্তঃপুরে সে গান প্রবেশ করে নি-- যেমন বাউল আর কীর্তন এ দেশকে প্লাবিত করে দিয়েছিল ।
এখানে রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছেন এমন জিনিষের উপর, যা বাংলার নিজস্ব, তার প্রাণের গান, সহজিয়া কবির দরদিয়া ও মরমিয়া গান । বস্তুতঃ বৈষ্ণব সাহিত্য ও পদাবলী কীর্তনের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে সর্বপ্রথম, কবির ১৩-১৪ বছর বয়সে, তিনি পড়ে ফেলেন গীতগোবিন্দম, বিদ্যাপতি ও বড়ু চণ্ডীদাস । আপন সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৮৭৮-৭৯ তে বিদ্যাপতির মৈথিলী পদের অনুসরণে -
"গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুলমধুর বংশী বাজে,
বিসরি ত্রাস লোক লাজে,
সজনী আও আও লো ।"
অবশ্য গানের ভাষা নিয়ে একটু মতদ্বৈধ আছে । রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ছদ্মনামে ভা লেখেন, তাঁর কথায় তা ব্রজবুলি, আসলে তা বিদ্যাপতির মৈথিলীর সাথে বৃন্দাবনের ব্রজভাষার মিশ্রণজাত শুধুমাত্র কাব্যে প্রচলিত ব্রজবুলি । উনি এ ধরণের অনুকরণ বা অনুসরণকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি, তাই 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র গানগুলি প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে 'সন্ধ্যাসংগীতে'রও পরে । পরবর্তীকালে তিনি বেশ কিছু কীর্তনাঙ্গের গান লেখেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'ওহে জীবন-বল্লভ, ওহে সাধন-দুর্লভ', 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' (এটি আখর সহযোগেও গাওয়া হয়), 'ভালবেসে সখি, নিভৃত যতনে','আমি নিশিনিশি কত রচিব শয়ন', 'আমার মন মানে না, দিনরজনী', 'সুখে আছি, সুখে আছি' ইত্যাদি ।
প্রথম জীবনে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ দেশীসঙ্গীতের মধ্যে প্রচলিত কীর্তন ছাড়া রামপ্রসাদী গানই বেশী শুনেছেন । প্রথম যুগের সঙ্গীতরচনায় তাই ঐ সুরে প্রভাবিত মাত্র কয়েকটি গানই স্থান পেয়েছিল । এই প্রসঙ্গে তাঁর গানের প্রধান উত্তরসাধক শ্রী শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন যে, 'প্রথম সাতাশ বছর তিনি যে সব দেশী সুরের গান লিখেছেন তার সবই কলকাতা অঞ্চলের প্রচলিত কীর্তন ও রামপ্রসাদী সুরে রচিত'। 'রামপ্রসাদী' বাংলার একটি নিজস্ব সুর। এমন সরল অথচ ভাবঘন গান আর কোনও দেশে নেই। এই দেশী সুরে তিনি কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। গানগুলি হল - 'আমিই শুধু রইনু বাকি', 'মিলেছি আজ মায়ের ডাকে', 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক', 'শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা ।'
||৯||
রবি ঠাকুরের গানে বৈষ্ণব পদাবলী ও কীর্তন গানের প্রভাব নিয়ে যা কিছু লিখি যথেষ্ট হয় না । তবু একটা গানের উল্লেখ এখানে করতেই হচ্ছে । পৌষ ১৮৮৬ তে মাঘোৎসব উপলক্ষ্যে কবি ২৬টি গীত লেখেন যার অন্যতম ছিল যোগিয়া-বিভাস রাগে কীর্তনাঙ্গের গান 'নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে' । অন্যান্য গানগুলির সাথে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই গানটিও শোনেন ও বলেন 'দেশের রাজা যদি দেশের ভাষা বুঝিত তবে আজ কবিকে পুরস্কৃত করিত । সে আশা যখন নাই তখন এ কার্য আমাকেই করিতে হইবে', এই বলে কিশোর রবিকে ৫০০ টাকা পুরস্কার দেন । ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য অসমবয়সী হয়েও কবির বিশেষ গুণমুগ্ধ ছিলেন । তিনি একবার কার্সিয়াঙএ থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথকে বৈষ্ণব পদাবলী সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেন । কবি কাজ শুরুও করেন কিন্তু ইতিমধ্যে রাজার মৃত্যু হওয়ায় কাজটি অসমাপ্ত থেকে যায় । উল্লেখযোগ্য, ২৪শে আগস্ট, ১৮৯৫ শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়ার পথে বোটে যেতে যেতে লিখছেন- ‘প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণবকবির ছন্দোঝংকার এনে দেয়- তার প্রধান কারণ, এই সমস্ত সৌন্দর্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য নয় – এর মধ্যে মানব ইতিহাসের যেন সমস্ত পুরাকালীন প্রীতিসম্মিলনগাথা পূর্ণ হয়ে রয়েছে ও এর মধ্যে যেন একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে । বৈষ্ণবকবিতার যথার্থ মর্মের ভিতরে যে প্রবেশ করেছে সে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সেই বৈষ্ণবকবিতার ধ্বনি শুনতে পায় ।‘
রবীন্দ্রনাথের বাউল সঙ্গীত চর্চা ও তাঁর গানে বাউলের প্রভাব আলোচনা করার আগে তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে দু-চারটি কথা বলে নিই । তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম, যদিও উনি ব্রাহ্মধর্মের আচার অনুষ্ঠান ও তাত্ত্বিক দিকটি সযত্নে এড়িয়ে ঈশ্বরকে 'সত্যমঙ্গল প্রেমময়' রূপেই দেখতে বেশি ভালবাসতেন । দ্বৈত-অদ্বৈত, পৌত্তলিকতা, শাক্ত-বৈষ্ণব কোনো কিছুর সাথেই তাঁর বিরোধ ছিল না, এমনকি নাস্তিক হয়েও যাঁরা সত্যনিষ্ঠ তাঁদেরকে তিনি হেয় না করে যথার্থ আসন দিয়েছেন, উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে 'চতুরঙ্গ' উপন্যাস ও রবিবার ছোটগল্পে । আচারনিষ্ঠ বাতিকগ্রস্ত বিধবা জয়কালি কর্তৃক একটি ঘৃণ্য অথচ শরণাগত শুকরছানাকে দেবতার মন্দিরে আশ্রয় দেওয়ার (অনধিকার প্রবেশ) সাহস দেখাতেও তিনি পশ্চাৎপদ হন নি ।
পরবর্তীকালে এই ঈশ্বর-চেতনা, জীবনের মূল্যবোধ, প্রকৃতিপ্রেম সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । অথচ এই মহা-চেতনা বা অনুভূতির কথা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে অসমর্থ । ৭ই আগষ্ট, ১৮৯৪ তিনি শিলাইদহ থেকে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখেন-‘ আমাদের দুটো জীবন আছে, একটা মনুষ্যলোক, অন্যটা ভাবলোক । সেই ভাবলোকের জীবনবৃত্তান্তের অনেকগুলো পৃষ্ঠা আমি এই পদ্মার উপরকার আকাশে লিখে গেছি । এখানে যখন আসি তখন বেশ বুঝতে পারি – আমার কবিতায় আমি কিছুই লিখতে পারি নি । যা অনুভব করি, তা ব্যক্ত করতে পারি নে ।‘ সম্ভবতঃ এই অনুভূতিই রূপ নিল দুদিন পরে লেখা ‘অন্তর্যামী’ কবিতায় -
‘একী কৌতূক নিত্যনূতন, ওগো কৌতুকময়ী,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে বলিতে দিতেছ কই ?
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে ।‘
তাঁর যেন সদাই মনে হত কোনও এক অদৃশ্য জীবনদেবতা অন্তরে-বাহিরে সততই তাঁকে চালনা করছে । ‘নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে ।‘ ‘এই অন্তরযামী কি অন্তরেই জেগে আছেন ? তিনিই কি আত্মা ? তবে তাঁর কথা কেন আমার বানীতে প্রকাশ পায়?’
‘মাঝে মাঝে তার বারতা, আমার ভাষায় পায় কি কথা ।
সে আমায় জানি পাঠায় বানী গানের সুরে লুকিয়ে তারে, বারে বারে ।।‘
একদিন তিনি ইন্দিরাকে পত্রে লিখলেন (১০ই অক্টোবর, ১৮৯৫), ‘ ঠিক যাকে ধর্ম বলে সেটা আমি যে নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়ভাবে লাভ করতে পারিনি, তবে মনের ভিতর ক্রমে ক্রমে যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে উঠছে তা অনেকসময় অনুভব করতে পারি... একটা নিগূঢ় চেতনা, একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়... তখন নিজের এই সৃজনশক্তির সাথে সৃজ্যমান অনন্ত বিশ্বচরাচরের একতা যোগ উপলব্ধি করি ।‘ এই কথাই তিনি ‘জীবনদেবতা’ নামে কবিতায় (চিত্রা) লেখেন-
‘ওহে অন্তরতম
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম ?’
রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে কিন্তু বাউল-সুফি-সহজিয়া ও মুর্শিদা সম্প্রদায়ের মধ্যে গিয়ে পড়েছেন । ১৮৯০ সালে সপরিবারে শিলাইদহে থাকাকালীন বলেন্দ্রনাথ লিখেছেন -‘আমরা যখন শিলাইদহে ছিলুম তখন রোজ রোজ আমাদের বোটে সেখানকার গ্রাম্য গাইয়েদের আমদানি হত । একজন বোষ্ণম- সে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গান গাইত, আর একজন নেড়ে এবং বাচ্চা- তার গান নানারকম । তাদের নাম সুনা-উল্লা ।‘ বলু ঠাকুর সুনা-উল্লার দশ-বারটি গানের নকল করে রেখেছিলেন, তার মধ্যে একটির রচয়িতা শিলাইদহের ডাক-হরকরা গগন মণ্ডল । গানটি রবীন্দ্রনাথের বিশেষভাবে প্রিয় ছিল ও পরে তিনি এটি ভেঙে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান লেখেন যা পরে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতরূপে গৃহীত হয় ।গগন হরকরার এই বহুল-প্রচারিত এই বাউল-গানটি আজ আর কারো অজানা নয়-
‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে ।
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে, দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে ।‘
পরে গগনের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ও আলাপ হয় । সে সূত্রে তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের আউলিয়া ফকির লালনের গান শোনেন, যদিও ইতিহাস বলে তাঁদের মধ্যে সেবার কোনও চাক্ষুষ সাক্ষাৎ হয় নি ও পরেরবার কবি যখন শিলাইদহে আসেন, লালন তার আগেই গত হয়েছেন । তবে কবিগুরু লালন ফকিরের প্রচুর গান একটি খাতায় সংগ্রহ করে কলকাতা নিয়ে আসেন ।
||১০||
আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি যে রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার বর্ণিত মনের মানুষের কথা প্রথম শোনেন ১৮৮৯-৯০ খৃষ্টাব্দে এবং সেটি ভেঙে ‘সোনার বাংলা’ লেখেন ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রাক্কালে । অথচ তাঁর ‘জীবনদেবতা’র যখন আবির্ভাব হয় ১৮৯৫ সালে, তাঁর কোনও বাউল গানের কথা মনে পড়ে নি । বাউলের সুরে ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ লেখেন ‘গীতাঞ্জলী’তে ১৯১০-এ । বাউলের সুর তিনি শুনতে থাকেন ১৮৮৯ বা তারও আগে থেকে অথচ সে সুর ভেঙে গান লেখা শুরু করেন ১৯০৫-এ, তাও স্বদেশ-সংগীত দিয়ে । নিজস্ব বাউল গান এলো আরো পাঁচ বছর পরে । এরকম কেন হল ?
মুহম্মদ মন্সুর উদ্দিনের হারামণি গ্রন্থের ভূমিকা প্রসঙ্গে কবি লিখেছেন- ‘আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে । এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন্-এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে । তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল–
কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে ।।
কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে : তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ । যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণবেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম তার গেঁয়ো সুরে সহজ ভাষায়–যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা–অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর–তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল । এর অনেক কাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না–তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে । লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি নে ।‘
উপরের উক্তিগুলিতে 'আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুর মিশেছে' এই অংশ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞাতসারে যেসব গানে হুবহু কোন বাউল গানের রূপরেখায় গান লিখেছেন, সে গান আমাদের সকলের মন মাতিয়েছে। যেমন,
মূলগান: হরিনাম দিয়ে জগত; ভাঙাগান: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
মূলগান: আমি কোথায় পাব তারে; ভাঙা গান: আমার সোনার বাঙলা
মূলগান: মন-মাঝি সামাল সামাল; ভাঙাগান: এবার তোর মরা গাঙে
রবীন্দ্রনাথের বাউল গানের অবদান খুবই মূল্যবান এবং বিশাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কালে যে গানগুলি তিনি পুব বাংলার বাউল সুরে রচনা করেছেন, সেই গানগুলির মূল্যবোধ এখনও কমে নি । কয়েকটি গান উল্লেখ করা যেতে পারে - 'ও আমার দেশের মাটি', 'ওরে তোরা নেই বা কথা বলছি', 'ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে', 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক', 'তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে' ইত্যাদি । প্রতিটি গান আপন মাধুর্য ও স্বকীয়তায় অনন্যসাধারণ। আরও কয়েকটি গানের কথা এখানে উল্লেখ করতে ইচ্ছা হয় -
(১) এই যে ভালো লেগেছিল
(২) যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
(৩) কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
(৪) বসন্তে কি শুধু কেবল, ফোটা ফুলের মালা
(৫) মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি
(৬) বাদল-বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে
(৭) পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়
(৮) পাগলা হাওয়ার বদল দিনে
কিন্তু অজ্ঞাতসারে বাউল অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত ‘ভুবনে ভুবনে কাজ করে যায় গোপনে গোপনে ‘। ১৯৯১ সালে শিলচরে থাকাকালীন ‘রাবীন্দ্রিকী’ সংস্থার সৌজন্যে সুযোগ পাই তিনদিনের জন্য ঢাকার স্বনামধন্যা গায়িকা-অধ্যাপিকা সান্জিদা খাতুনের কাছে একটি কর্মশালায় যোগদান করার । তিনি কথাপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানে লোকগীতের এই দুই-ধরণের প্রভাবের কথাই সোদাহরণ আলোচনা করেন । পরে শ্রী শান্তিদেব ঘোষের লেখাতেও প্রায় একই কথার উল্লেখ দেখি । বাউল যেখানে রবীন্দ্রনাথের মনে প্রবেশ করে সুরের মধ্য দিয়ে আবার বেরিয়ে এসেছে, সেই রকম রচনাগুলি আমাদের কাছে অপূর্ব বিস্ময় । এই রকম দুটি গানের উল্লেখ করি এ প্রসঙ্গে । চিরন্তন বাউলের যে মনের মানুষ, তাকে উপলব্ধি করতে কবির জীবনে কেটে গেছে বিশ বছর । ১৯১০এ তিনি উপলব্ধি করলেন-
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে ।
আছে সে নয়ন তারায়, আলোকধারায় তাই না হারায় ।
আমি তাই হেরি তায় যেথায় সেথায়, তাকাই আমি যেদিক পানে ।‘ বা ১৯১২ সালে লেখা গান-
‘ও আমার মন যখন জাগলি নারে,
ওরে তোর মনের মানুষ এল দ্বারে ।
তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে (ও তোর) ভাঙ্গল রে ঘুম অন্ধকারে ।।‘
আবার দেখুন, 'আমি তখন ছিলেম মগন গহন' গানটিতে 'আমার দেহের সীমা গেল পারায়ে'- এই সঞ্চারী অংশটির সুরের সাথে অন্তরা এবং আভোগের সমন্বয় অত্যন্ত বিস্ময়কর ও মাধুর্যপূর্ণ । আর একটি গান - 'বকুল গন্ধে বন্যা এল দখিন হাওয়ার স্রোতে ।' এই গানটিতে সঞ্চারী 'আকাশ পারে পেতে আছে একলা আসনখানি' অংশের সুর হঠাৎ কীর্তনের আমেজ নিয়ে এসে একটা নতুন সুরের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে । প্রসঙ্গতঃ বলা যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহু কীর্তনাঙ্গ গানের সাথে বাউলের সুর একাত্ম হয়ে মিশে গেছে । আবার বহু রাগভিত্তিক সুরের গানে হঠাৎ অজ্ঞাতসারেই যেন বাউলের আমেজ ফুটে উঠেছে । 'তুমি কোন পথে যে এলে পথিক', 'ওগো সাঁওতালী ছেলে', 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি' ইত্যাদি গান চর্চা করলেই এই বিষয়টি যথার্থ অনুভব করা যায় ।
বাউল ছাড়াও ভাটিয়ালি, সারিগান, ভাওয়াইয়া সুরের বহু গান জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন, এবং তারাও হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রসংগীত । সারি গানের সুর নৌকা চালানোর সময় মাঝিদের মুখেই প্রথম উদ্ভব হয়। এই সুরের একটি গান 'এবার তোর মরা গাঙে' গানটির কথা আগেই বলা হয়েছে । এই সুরের দ্বিতীয় গানটির সুর পল্লীবাসীদের খুবই চেনা, কিন্তু তার সাথে যে ভাব ও কথার রস মিশেছে তা অসাধারণ । গানটি - 'তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে' । আরেকটি গানও রচনাসৌকর্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত রচনা - 'বজ্রে তোমার বাঁশি বাজে সে কি সহজ গান'। অবারিত মাঠে রাখালের ভাটিয়ালি গান এক কালে পল্লীর একটি বিশেষ সম্পদ ছিল । সেই ভাটিয়ালি সুরে অন্তত একটি গানের সুর ও অসাধারণ রূপ-কল্পনার সমন্বয়ে চিরকালের গান হয়ে আছে । সে গানটি - 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ' (যদিও আমি মনে করি ভাওয়াইয়ার সাথে এর মিল বেশী) । এর প্রায় সমতুল্য বা তুলনাহীন পর্যায়ের গান - 'ঐ আসন তলে মাটির পরে' এবং 'আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র-ছায়ায় লুকোচুরির খেলা ।'
আমার এই প্রবন্ধটি এখানেই শেষ করতে চাই, কারণ রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শেষ হবার নয় । ধন্যবাদ জানাই তাঁদেরকে যাঁরা বিভিন্ন তথ্য-প্রমাদ দেখিয়ে ও বই-website-এর সন্ধান দিয়ে উৎসাহিত ও উপকৃত করেছেন । এর পরেও যদি কেউ মনে করেন, ও সেটাই স্বাভাবিক যে এ বিষয়ে আরো লেখার ও বিতর্কের অবকাশ আছে তাঁদের স্বাগত জানাই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে ।
সমাপ্ত ।।