Friday, August 22, 2014

কবিতা (সংকলিত) ।। কৃষ্ণের ফল খাওয়া ।।

কৃষ্ণের ফল খাওয়া ।।
দ্বিজহরি দাস

অবগতি শুন কিছু নিবেদন করি,
গোকুলে আনিল ফল এক মাগী বুড়ি
একটা ঝুড়ি হাতে ।
একটা ঝুড়ি হাতে, বসল পথে ফল গুচ্ছেক ঢেলে
ফল খাওসে, ফল খাওসে, ডাকে যত গোপের ছেলে

বাপু তোরা দৌড়ে আয়, বুড়ি তায় ডাকছে ঘনে ঘন-
শ্রীদাম বলে সুদাম ভায়া, বুড়ি ডাকছে কেন
কিছু তার বৃত্তান্ত -
কিছু তার বৃত্তান্ত বলে আনত, শোনরে গুণের ভাই,
বুড়ি কেন ডাকছে চল গুটি গুটি যাই,
চলিলেন সবে মিলে ।
চলিলেন সবে মিলে, গোপের ছেলে, মণ্ডা মুখের হাসি
পথের মাঝে ঝুড়ি হাতে যেথায় বুড়ি বসি
ধর গো ধর মুখে ।
ধর গো ধর মুখে, খাও সুখে, খেয়ে পাবে তার
মায়ের কাছে বুঝে আনবে ধার ।

চল মা আমার সাথে, ব্রজের পথে কিনে দিবি সে ফল,
দিবি কি না দিবি রানী তুই সত্যি করে বল
নতুবা তার উপায় করি -
নতুবা তার উপায় করি, ভাঙব হাঁড়ি, ভাঙব দুধের হালা
দুধ গড়িয়ে যাবে যখন তখন পাবি জ্বালা
এই বলে কাঁদেন হরি ।
এই বলে কাঁদেন হরি, দাও মা কড়ি, কাঁদেন যাদব রায়,
লোকের ছেলে মাকে বলে কত কিনে খায় ।

বাবা তুমি কেমন কথা বললে হেথা আমায় দিয়ে দোষ-
পাকা পাকা ফল আনিবেন ঘরকে আসুন ঘোষ,

আসুন নন্দ, কৃষ্ণচন্দ্র, ফল আনিবেন পাড়ি-
কেন বাবা গোপের ঘরের মজাইবে কড়ি ?
খাওসে ক্ষীরননী ।
খাও সে ক্ষীরননী, যাদুমণি, খেলি ডাক, সবে কর খেলা,
ঘর রইল, দুয়ার রইল, ধান রইল মেলা ।
আমি তো যাব জলে-
আমি তো যাব জলে, রানী বলে, কুম্ভ হাতে, যমুনাতে আনতে যাব জল-
দ্বিজহরি দাসে গাহে, ঠাকুর খাবেন ফল ।
* * *
লয়ে দুটি ধান্যকণা চলেন হরি যেথায় বুড়ির থান,
সন্তুষ্ট হল বুড়ি দেখে ভগবান ।
বাবা তুমি কাদের ছেলে, কাছে এলে এমন চাঁদের কণা,
যতগুলি ধান্য দিলে, সকলি হল সোনা ।
তুমি মানুষ নও, দেবতা হও, সকল দেবের সার,
পূর্ণব্রহ্ম গোপের ঘরে হলেন অবতার ।।

বাংলা কবিতা ।। গদি-কাহিনী ।।

গদি-কাহিনী ||


খিলখিল্লির মুল্লুকে আজ থাকত দু'খানা রাজগদি,
একখানা নিত কেজরিওয়ালা, আরেকখানায় ওই মোদী ।
তারপর এমন লাগত দুটোয়, তুই রাজা, না কি মুই রাজা !
দেশটা আমিই করব শাসন, তুই হোথা বসে ঢোল বাজা ।
সব ব্যাটাকেই হাড়ে হাড়ে চিনি, সবগুলো সেম, করাপ্টেড,
সব থানাতেই ঝুলছে তোদের নাম, নিচে লেখা 'ওয়ান্টেড' ।

আরে যা যা, আর তুই কিরে ব্যাটা, সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকিস,
কে কবে কোথায় চড় মেরে বসে, তাই মাফলারে মুখ ঢাকিস -
আমি পালোয়ান, গায়ে আলোয়ান, স্বামীজি শিষ্য, চায়-ওলা,
ঝোল ধরে তুই রাহুলের কাছা, তখতে বসবে এই পোলা ।
তারপরে জোর ধাঁই-ধপাধপ, আঁচড়কামড়, গালি-গালাজ-
শেষে দেখি দুটো গদি আছে পড়ে, নেই একটাও রাজাধিরাজ !
১৪ই মে, ২০১৪ ।

বাংলা ছোট গল্প ।। ছাগল বাবা ।।

ছাগল-বাবা ।।
(ছোট গল্প)
মাটির নীচ থেকে ড্রিল করে কোল-বেড মিথেন উৎপাদন প্রজেক্টের কাজে এসেছি ঝাড়খন্ডের ধানবাদ জেলার নিরসাতে । ২নং ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে যে রাস্তা শালুকচাপরা গ্রামের ভিতর দিয়ে বালিয়াপুর গেছে তার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রিগ-রোড বানানো হয়েছে । মোরাম ঢালা কাঁচা রাস্তা, ফাঁকাই পড়ে থাকার কথা । অথচ রুট সার্ভে করতে এসে আমার তো মাথায় হাত । দলে দলে গ্রাম্য লোকেরা চলেছে ওই পথ ধরে, অন্ততঃ শ-দেড়েক তো হবেই । এদের পাশ দিয়ে জীপ নিয়ে যেতে হলেই তো দিন কাবার ! একটু নেমে খোঁজ নিলাম । ওরা যাচ্ছে ছাগল-বাবার কাছে আশীর্বাদ নিতে । অদ্ভুত নাম তো! তিনি আবার নাকি সাক্ষাৎ অশ্বিনীকুমারের অবতার- একেবারে ধন্বন্তরী । সর্দি-জ্বর-ম্যালেরিয়া-টাইফয়েড হেন রোগ নেই যা তাঁর বশ মানে নি । বোঝ ব্যাপারখানা ! নিরীহ গ্রাম্য লোকগুলোকে ঠকিয়ে ভালই জোচ্চুরির ব্যবসা ফেঁদেছে দেখছি লোকটা।
যাক্‌গে আমাদের কাজ তো শুরু হল । কিন্তু শুরুতেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা কাজ করতে হল আমাকে । একদিন রাত্রে আমাদের একটি লেবারকে কামড়াল পাহাড়ী বিছায় । মেডিকটি নতুন, তার আছে শুধু ফার্স্ট-এড সার্টিফিকেট, আর রিগের সামান্য স্টকে তেমন ওষুধ-বিষুদও নেই । নিকটস্থ হাসপাতাল অন্ততঃ ৫০ কিমি দূরে । এই অবস্থায় লোকজনেরা বলল, নেই মামা থেকে কানা মামা ভাল; আপনি ওকে একটু ছাগল-বাবার কাছে নিয়ে যান না- এই তো জীপে মিনিট পনের ।
অগত্যা তাই সই । বাবার ছোট্ট কুঁড়েয় গিয়ে দেখি বাইরে দুজন শিষ্য হামান-দিস্তা নিয়ে ওষুধ তৈরী করছে, বাবা ভিতরে । একজন গিয়ে ডেকে আনতে একটি অদ্ভুত-দর্শন মানুষ বেরিয়ে এল, যার মুখখানা ছাগলের মত, অর্থাৎ ছাগ-মুখোশধারী । কোন কথা না বলে উনি রোগীকে নিয়ে পড়লেন । কিছুক্ষণ ধোওয়াধুয়ি আর ঘষাঘষির পর আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি দুটো ইঞ্জেকশন দিয়ে বললেন- টিটেনাস আর এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিলাম । বিষটাও এনেস্থেটিক ব্লীচ দিয়ে ধুয়ে দিয়েছি । তবে মনে হচ্ছে বার্ক স্কর্পিওন, তাই ২৪ ঘন্টা কিছু বলা যাবে না । এখন ও ঘুমোক, সকালে একটা আইবুপ্রুফেন দিতে হবে । আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি আমাকে কুঁড়ের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন । তারপর মুখোশটা সরিয়ে নিতেই আমি 'অজামিল' বলে চেঁচিয়ে উঠলাম । আমাদের বন্ধু ডাঃ অজামিল দত্ত । শুনে গেলাম তার বিস্তারিত উপাখ্যান, সব শেষে ও মন্তব্য করল-
-ভুল চিকিৎসা করে নেতার মেয়েকে মারার অপরাধে আমার মেডিক্যাল লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হল । অথচ ভুল যে আমি করিনি তা আর কাউকে বোঝাতে পারলাম না । তাই 'হিপোক্রিটিক ওথের' মান রাখতে এই পথ বেছে নিয়েছি । এদেশে বুক ফুলিয়ে বেআইনি কাজ করতে গেলে হয় সাধু নয় নেতা সাজতেই হবে ।
-আর 'অজামিল'এর সাথে মিল রাখতে 'অজ' অর্থাৎ ছাগলের মুখোশ, তাই তো ? আমি হাসলাম ।
- তা তো বটেই, আসলে identity হারাতে তো আমি চাইনি ।
সে এক যুগ ছিল, যখন মহাপাপী অজামিল বুদ্ধি করে ছেলের নাম রাখে নারায়ণ । মৃত্যুকালে ছেলেকে ডাকার ছলে সেই নারায়ণের নাম করেই সে বৈকুণ্ঠলাভ করেছিল । জানিনা আমাদের এযুগের অজামিল পাপ করছে না পুণ্য, সে কি নিজের কর্মবলে স্বর্গলাভ করবে, না ঈশ্বরও শেষে নামগানের ঘুষ চেয়ে বসবেন !
মুম্বাই, ৭ই জুন, ২০১৪ ।

মনের মণিকোঠা থেকে ।।৭।।


জানুয়ারী মাস। নতুন বছরের নতুন সেশন শুরু হয়েছে। স্কুলের টিফিনের পরের প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা বাজলো। অনেকে যারা ক্লাসরুমে বসেই টিফিন খাই, বা চ্যাঁচামেচি, গান-বাজনা, টেবিলঠোকা, হই-চৈ, গল্পগুজব করি, চালিয়ে যাচ্ছি যথারীতি। এমন সময় পান মুখে বাংলা শিক্ষক হরিদাস স্যারের আবির্ভাব। জোরালো চুম্বকের উপস্থিতিতে লোহার চূর্ণগুলো যেমন ছোটাছুটি করে মুহূর্তের মধ্যে একভাবে একদিকে মুখ করে সেজে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেছি ফিজিক্স ল্যাবে, ঠিক সেইভাবে আমরা যে যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েকজন বাইরে রোদ খাচ্ছিল, তারাও ছুটে এসে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। স্যার একবার খুশি হয়ে সবদিকটা দেখে নিলেন, তারপর নিজে বসে সবাইকে বসতে বললেন।
'তারপর, বাইরের রোদটা বেশ আরামের তাইনা?' উনি শুরু করলেন, 'ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয় তো! আমারও হয়'। বলতে বলতে 'আসব স্যার?', শংকর, জিতু, তপেনের দলটা দরজায় এসে দাঁড়ালো।
'আসুন স্যার, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?' স্যারের তির্যক খোঁচাটুকু গায়ে না মেখেই ওরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ক্লাসরুমে।
'হাঁ, তা কি যেন বলছিলাম? রোদ্দুরের আরামের কথা। বুঝলে, টিফিন শেষ করে একটা পান মুখে নিয়ে আর কি টিচার্স রুমে ঢুকতে ভালো লাগে। হলের বাইরে বাঁধানো গাছ্তলাটিতে কিছুক্ষণ গিয়ে বসতেই হয়। শিক্ষকদের আড্ডাটা আজকাল সেখানেই জমে কিনা! আহা নরম রোদ্দুরে বসে কি আরাম। তা করতে করতেই টিফিন শেষ হবার ঘন্টা বাজে।' এটুকু বলে আমাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেন হরিদাস স্যার। আমরা আজ ওনার কথার কোনো খেই পাচ্ছি না।
'তারপর ঘন্টা বাজানেওলা দারোয়ানটাকে হাঁক দিই, ক্যা রে হরিয়া, ঘন্টি মারনে কা বহুত জলদি হ্যায় তুঝে!'
সর্বনাশ, এ কথাগুলো তো কাল জিতু বলছিল দারোয়ানকে। তাকিয়ে দেখি, জিতুর মুখ ভয়ে চুন হয়ে গেছে। স্যার কিন্তু নিজের গল্প বলেই চলেছেন। 'তারপর ভাবলাম, দূর, এত তাড়াতাড়ি ক্লাসে গিয়ে কি হবে, ছেলেগুলো খামোখা আমাকে দেখে বিরক্ত হবে। ভেবে একটা সিগারেট ধরাই। খবরদার, মাস্টারমশায়দের নকল করতে হয় কর, তা বলে এই অভ্যাসটুকু তোমরা ধরো না দয়া করে। তা তার খানিক পরেই দেখি প্রিন্সিপাল বেরোচ্ছেন রাউন্ড দিতে। অগত্যা সিগারেটটিতে একটা সুখটান দিয়ে ওটা ফেলে আসি ক্লাসরুমে। ততক্ষণে দশ মিনিট দেরী হয়ে গেছে।'
'কিন্তু স্যার, আপনি তো ঠিক সময়েই আসেন ক্লাসে, কখনো তো দেরী হয় না!' শ্রীমান শংকরের উক্তি। ও কেন জানিনা স্যরের কথাগুলোর মধ্যে একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।
'কিন্তু শ্রীমদশঙ্করাচার্য, সেকথা তোমার তো জানার কথা নয়!' এবার তিনি নিজের রূপে এলেন। 'তোমাদের তো তখন গুলিডান্ডা নয় পিট্টুখেলা চলছে। সময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্যে দারোয়ানকে ধমকানো, বা পানদোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা, সে যেই করে থাকুক, আজ না হোক কাল প্রিন্সিপালের নজরে পড়বেই। এ শহরে, এই স্কুলে বাঙালিদের যেটুকু সুনাম আছে তাও কি থাকতে দিবিনা তোরা!'
উফ, এতক্ষণে স্যর 'তুমি' থেকে 'তুই' তে ফিরে এসেছেন। কি ভালই যে লাগলো শুনতে!

২৭শে জুন, ২০১৪