Friday, August 22, 2014

মনের মণিকোঠা থেকে ।।৭।।


জানুয়ারী মাস। নতুন বছরের নতুন সেশন শুরু হয়েছে। স্কুলের টিফিনের পরের প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা বাজলো। অনেকে যারা ক্লাসরুমে বসেই টিফিন খাই, বা চ্যাঁচামেচি, গান-বাজনা, টেবিলঠোকা, হই-চৈ, গল্পগুজব করি, চালিয়ে যাচ্ছি যথারীতি। এমন সময় পান মুখে বাংলা শিক্ষক হরিদাস স্যারের আবির্ভাব। জোরালো চুম্বকের উপস্থিতিতে লোহার চূর্ণগুলো যেমন ছোটাছুটি করে মুহূর্তের মধ্যে একভাবে একদিকে মুখ করে সেজে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখেছি ফিজিক্স ল্যাবে, ঠিক সেইভাবে আমরা যে যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েকজন বাইরে রোদ খাচ্ছিল, তারাও ছুটে এসে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। স্যার একবার খুশি হয়ে সবদিকটা দেখে নিলেন, তারপর নিজে বসে সবাইকে বসতে বললেন।
'তারপর, বাইরের রোদটা বেশ আরামের তাইনা?' উনি শুরু করলেন, 'ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয় তো! আমারও হয়'। বলতে বলতে 'আসব স্যার?', শংকর, জিতু, তপেনের দলটা দরজায় এসে দাঁড়ালো।
'আসুন স্যার, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?' স্যারের তির্যক খোঁচাটুকু গায়ে না মেখেই ওরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ক্লাসরুমে।
'হাঁ, তা কি যেন বলছিলাম? রোদ্দুরের আরামের কথা। বুঝলে, টিফিন শেষ করে একটা পান মুখে নিয়ে আর কি টিচার্স রুমে ঢুকতে ভালো লাগে। হলের বাইরে বাঁধানো গাছ্তলাটিতে কিছুক্ষণ গিয়ে বসতেই হয়। শিক্ষকদের আড্ডাটা আজকাল সেখানেই জমে কিনা! আহা নরম রোদ্দুরে বসে কি আরাম। তা করতে করতেই টিফিন শেষ হবার ঘন্টা বাজে।' এটুকু বলে আমাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেন হরিদাস স্যার। আমরা আজ ওনার কথার কোনো খেই পাচ্ছি না।
'তারপর ঘন্টা বাজানেওলা দারোয়ানটাকে হাঁক দিই, ক্যা রে হরিয়া, ঘন্টি মারনে কা বহুত জলদি হ্যায় তুঝে!'
সর্বনাশ, এ কথাগুলো তো কাল জিতু বলছিল দারোয়ানকে। তাকিয়ে দেখি, জিতুর মুখ ভয়ে চুন হয়ে গেছে। স্যার কিন্তু নিজের গল্প বলেই চলেছেন। 'তারপর ভাবলাম, দূর, এত তাড়াতাড়ি ক্লাসে গিয়ে কি হবে, ছেলেগুলো খামোখা আমাকে দেখে বিরক্ত হবে। ভেবে একটা সিগারেট ধরাই। খবরদার, মাস্টারমশায়দের নকল করতে হয় কর, তা বলে এই অভ্যাসটুকু তোমরা ধরো না দয়া করে। তা তার খানিক পরেই দেখি প্রিন্সিপাল বেরোচ্ছেন রাউন্ড দিতে। অগত্যা সিগারেটটিতে একটা সুখটান দিয়ে ওটা ফেলে আসি ক্লাসরুমে। ততক্ষণে দশ মিনিট দেরী হয়ে গেছে।'
'কিন্তু স্যার, আপনি তো ঠিক সময়েই আসেন ক্লাসে, কখনো তো দেরী হয় না!' শ্রীমান শংকরের উক্তি। ও কেন জানিনা স্যরের কথাগুলোর মধ্যে একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।
'কিন্তু শ্রীমদশঙ্করাচার্য, সেকথা তোমার তো জানার কথা নয়!' এবার তিনি নিজের রূপে এলেন। 'তোমাদের তো তখন গুলিডান্ডা নয় পিট্টুখেলা চলছে। সময়ে ঘন্টা বাজানোর জন্যে দারোয়ানকে ধমকানো, বা পানদোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা, সে যেই করে থাকুক, আজ না হোক কাল প্রিন্সিপালের নজরে পড়বেই। এ শহরে, এই স্কুলে বাঙালিদের যেটুকু সুনাম আছে তাও কি থাকতে দিবিনা তোরা!'
উফ, এতক্ষণে স্যর 'তুমি' থেকে 'তুই' তে ফিরে এসেছেন। কি ভালই যে লাগলো শুনতে!

২৭শে জুন, ২০১৪

No comments:

Post a Comment