Thursday, November 28, 2019

রম্য রচনা- বিয়ের চিঠি।।

বিয়ের চিঠি।।
বাড়িতে খুঁজলে এখনও পুরোনো কিছু বিয়ের নিমন্ত্রণের চিঠিপত্র খুঁজে পাই। তার মধ্যে কয়েকটা বেশ মনে রাখার মত। একবার একটা খুঁজে পেলাম কাকার এক বন্ধুর বিয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো চিঠি। ছাপানো কভারের ভেতরের ভাঁজে তিনি লিখছেন নিজের হাতে-
"জীবনটা নয় কঠিন পাথরে গড়া,
মালার বাঁধনে তাই ত দিতেছি ধরা;
আঠারো বোশেখ হে বন্ধু এসো
প্রীতিতে হৃদয় ভরি,
তব শুভেচ্ছা আজিকে পাথেয় করি।"
উত্তর ভারতীয়দের বিয়েতে একটা শ্লোক নিশ্চয়ই থাকবে হেডিংএ, মন্দ লাগে না পড়তে, শুধুমাত্র 'শ্রীশ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ' থেকে হয়ত ভাল-
"মঙ্গলম্‌ ভগবান বিষ্ণু, মঙ্গলম্‌ গরুড়ধ্বজঃ।
মঙ্গলম্‌ পুণ্ডরীকাক্ষঃ, মঙ্গলায় তনো হরিঃ।।
আমাদের পাড়ার ভার্মা চাচা আরেকটু বৈচিত্র্য দেখিয়েছিলেন তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ের কার্ডে। তার মূল অংশে হিন্দিতে লেখা ছিল-
"ভবসাগর মেঁ উতর রহে হ্যাঁয় দো প্রাণী নাদান খিবৈয়া,
শ্রীমান দো আশিস উনহে, ত্যয়র সকে ওয়ে জীবন নাইয়া।
ভেজ রহে হ্যাঁয় নেহ নিমন্ত্রণ প্রিয়বর তুমহে বুলানে কো,
হে মানস কে হংসরাজ তুম ভুল ন জানা আনে কো।"
প্রসঙ্গ ক্রমে জানা গেল একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা। বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীকে মেজবৌদি তাঁর ছোট দেওরটির জন্যে পছন্দ করে শ্বশুর মহাশয়কে বিস্তারিত জানালে তিনি কূল গোত্র ইত্যাদি দেখে বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। ২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ, রবিবার, ইংরেজি ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। পাত্রপক্ষ বিয়ের জন্য পাত্রীর পিত্রালয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে কন্যাহ্বানের নিয়মানুযায়ী পাত্রীকে পাত্রের বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করা হয়। পাত্রীপক্ষ সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন। বেণীমাধব রায়চৌধুরী আত্মীয় স্বজনসহ কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এ জন্য কন্যা পক্ষের পাথেয় খরচ বাবদ ষাট টাকা, বাড়ি ভাড়া বাবদ বাইশ টাকা তিন পাই খরচ বহন করেছিলেন পাত্রের বাবা। ক্যাশ বইয়ের হিসাবে আরো জানা যায়, বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রও ছাপা হয়েছিল এবং ডাকযোগে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল।
পাত্র রসিক মানুষ, তাই দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল হাতে লেখা একটি বিচিত্র রকমের চিঠি দিয়ে। নিমন্ত্রণপত্রটির বয়ানটি হুবহু এরকম:
‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি
অনুগত
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
চিঠিটা বিচিত্র নয়? পাত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং! এই চিঠির উপরের দিকে সচিত্র অ্যাম্বুস করা ছিল, ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’।

Wednesday, November 27, 2019

বরাহ-নন্দন।। গল্প

বরাহ-নন্দন।।

(১)
দীপু মানে সুদীপ্ত সরখেলের মত ভাল আর বন্ধুবৎসল মানুষ এই শহরের বাড়িতে বাড়িতে পাঁচ সেলের টর্চ জ্বেলে খুঁজলেও দুটি পাওয়া যাবে না। সে আবার এত মিষ্টি-স্বভাবের যে অত্যন্ত প্রাণের বন্ধুকে পর্যন্ত গালাগাল দিতে পারে না। তবু কিন্তু বন্ধুমহলের আড্ডায় তার খাতিরটা রয়ে গেছে কেবলমাত্র বাবার মিষ্টির দোকান আছে বলে। মানে দীপু বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়ায় না , বাপের চোখ এড়িয়ে সে কাজটি করার সাধ্যি তার নেই, তবে হাতে কাঁচা টাকা আসে কিনা! তাই চা-সিগারেটের খরচটা কিম্বা মাঝে মাঝে চপ-সিঙাড়া খাওয়ানো- প্রতিষ্ঠা বাঁচাতে এই যথেষ্ট। ইতিহাস-সাইকোলোজি-পল সায়েন্স নিয়ে বি-এ পাশ করলে যে চাকরি পাবে না এ বাজারে তা প্রায় জানাই ছিল, আর তাই সে আর এমনতর চেষ্টাও করেনি। বাপের দোকান সার্কুলার সুইটস্‌এ মাঝে-সাঝে বসতে হয় না তা নয়, তবে সে দিনগুলো হয় দোকানের পক্ষে দুর্দিন, কারণ বন্ধুদের আড্ডা সেদিন সেখানেই বসে কিনা!

সার্কুলার সুইটস নামটা কিন্তু শহরের গোলচত্বর মানে সার্কুলার পার্কের মুখে দোকানটা বলে নয়, সরখেল মশায় এফিডেবিট করে নামের বানানটা করিয়ে নিয়েছিলেন Circle, সেই থেকে সার্কুলার। অবশ্য নামে কিছু যায় আসে না, স্থান-মাহাত্ম্যের গুণে আর মিষ্টির কোয়ালিটির ফলে দোকান এমনিই গড়গড়িয়ে চলত, এক্ষেত্রে দীপু চেষ্টা করেও কিছু ক্ষতি করতে পারত না। কিন্তু তবু কী যেন এক তুচ্ছ কারণে একদিন এক খদ্দেরের সঙ্গে ওর মার-মার ঝগড়া লেগে গেল। খদ্দেরটি বিহারি, একেবারে চ্যাংড়া মাল, 'তেরি মা কী...' বলে এমন গালাগাল শুরু করল, আর থামেই না। এরা আবার নিজের চেয়েও বড়রকমের গালি না শুনলে মুখ বন্ধই করে না আর দীপুর ছোটবেলার থেকে কী যে স্বভাব, 'শালা' কথাটাও বেরোয় না মুখ থেকে। মুখ নিশপিশ করছে বেশ স্মার্টলি একটা জব্বর গালি ঝাড়তে, অগত্যা মনের জোর এনে বলেই ফেলল- 'শালা শুওরের বাচ্চা'! কিন্তু কী অদ্ভুত, নিজের কানকে বিশ্বাস হল না দীপুর, আসলে ওর মুখ থেকে অটোমেটিক ফিল্টার হয়ে যে শব্দটা বেরোল, সেটা 'ব্যাটা বরাহ-নন্দন!'

ঠিক সেই সময় দোকানে ঢুকছিল ন্যাড়া-চৈতন্য, মানে দীপুর দুই বন্ধু নরহরি আর চেতন, একেবারে হরিহর-আত্মা দু'জন। ওরা দীপুর মুখে বরাহনন্দন শুনে হেসে উঠল হো-হো করে। কিন্তু সেই বিহারি চ্যাংড়া লোকটি না জানি কী ভেবে চুপ করে গেল, বাকি পয়সা দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।

- ওরে দীপু আজ গাল দিয়েছে রে, বরাহনন্দন! উটোও আবার গাল- ন্যাড়া তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল।
- বড়া-লন্দনটা কী রে? গালাগাল না তোদের দোকানের নতুন মিঠাইয়ের নাম? - চেতন হাসতে লাগল।
দীপু চুপ করেই আছে। ও তখনও ভেবে চলেছে শুওরের বাচ্চাটা হঠাৎ করে অত সাধু হয়ে গেল কীভাবে! ওটা কি সত্যিই গালি? বরাহ কথাটা ওর মাথায় এল কোত্থেকে? কিছুক্ষণ পরে মোটু, মানে গদাই আর বিশু অর্থাৎ বিশ্বম্ভর এল। দোকানের মিস্লেনিয়াস অ্যাকাউন্টে সবাইকে চা খাওয়ানো হল বটে, তবে সেদিন আর আড্ডাটা তেমন জমল না। আজ নিতাইদাকে দোকান বন্ধ করে দিতে বলে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল দীপু।


(২)
বাসায় ফেরার পথেই ওর মাথায় এল হিন্দুধর্মের ইতিহাসে পড়া দশাবতার-কল্পনা, মৎস্য-কুর্ম-বরাহ। মাছ-কচ্ছপ-শূওর! আরে শূওর তো বিষ্ণুর অবতার রে! অবতারের বাচ্চা তাহলে গালি কেন হবে? বাড়িতে গীতগোবিন্দের অনুবাদ ছিল। বের করে পড়ল-
'দশন-শিখরে তব ধরণীটি লগ্ন-
কলঙ্ক-চাঁদে যেন মগ্ন।
শূকরের রূপ প্রভু ধরিলে,
জয় জগদীশ হরে!'

পরদিন সকাল সকাল মোটু গদাই আর বিশু এসে হাজির। ''কী রে, কাল কী হয়েছিল দোকানে? মোটু শুধোল। 'কোন ব্যাটা বিহারি হুজ্জোত করেছে, চিনিস হারামিটাকে- একবার দেখে নিতাম!'
- ছেড়ে দে মোটু, খদ্দেরের কথায় চটলে বিজনেস করা যায়না। তার চেয়ে বড় কথা আমিও রাগের মাথায় ওকে গালাগাল করেছি।
- দূর শালা, বরাহলন্দন যদি গালি হয় তাহলে ঘোড়ার ডিম মানে সার্কুলার সুইটসের রাজভোগ!- বিশু বলে। 'মাইরি, শুওরের বাচ্চা বলে যা আনন্দ, মেজাজ তর হয়ে যায়, সেখানে কিনা বরাহ-লন্দন!'
- আচ্ছা বিশু, বলতে পারিস, শুওর বলাটা গালি কেন? নোংরা বলে? ব্যাপারটা জানতে হচ্ছে- দীপু বলে।
তবে  এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হল না দীপু, সেইদিন থেকেই ও শুওরের সম্বন্ধে রীতিমত পড়াশুনা শুরু করে দিল। এই ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছিল সাহিত্যিক অনীশ দেবের লেখা একটা রম্যরচনা আর অজস্র পুরাণ-কোরান। বন্ধুরা আড্ডায় দেখা পায়না, দীপুর বাবা সুজিতবাবু চিন্তাগ্রস্ত, ছেলে দোকান যেতে চায় না, আড্ডাও কমিয়ে দিয়েছে, এই কাঁচা বয়সে বই মুখে নিয়ে কী সব আবোলতাবোল লিখে চলেছে!

-কী বলছেন কাকু, আবোলতাবোল মানে? কী লিখছে আমাদের বিশু? সেদিন দোকানে গিয়ে দীপুর খোঁজ নিতেই সরখেলমশাই যে খবর জানালেন তার জবাবে পালটা প্রশ্ন বিশুর।
- আর বোলো না! দেখি 'আবোলতাবোল' নামে একটা বই খোলা টেবিলের উপর, তার উপরে চোখ রেখে দীপু লিখে চলেছে- 'সুকুমার রায় তিনটি শুয়োরকে টুপি পরা অবস্থায় না দেখে অবাক হয়েছিলেন, তাহলে কি শুওরের পক্ষে টুপি পরে থাকাটাই স্বাভাবিক? শুয়োর কেন টুপি পরে, কে তাদেরকে টুপি পরায়?' কী পাগলের কাণ্ড বল দেখি!
- কাকু, দীপুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি তাহলে।
- ওকে এখন পাচ্ছো কোথায়? মূর্তিমান সকাল সকাল হুগলি চলে গেছে ওখানকার শুয়োরদের স্টাডি করতে।

(৩)
সেদিন সন্ধেয় ক্লাবের আড্ডায় আসা মাত্র দীপুকে পাকড়াও করেছে ওর বন্ধুরা। 'কী রে, হুগলিতে কী দেখলি? শুওরগুলো টুপি পরেছিল?'
- না রে, শুওর যে টুপি পরে না সেটুকু বোঝার বুদ্ধি আমারও আছে। আমি গেছিলাম চন্দননগর, ওখানকার অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের লাইব্রেরিতে শুওর সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনো করতে।
এখন আর দীপুর বন্ধুরা ওর কোন কথায় অবাক হয় না। ওরা শুধু শুনে যায় সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী।
- বুঝলি, সুকুমার রায় সম্বন্ধে যদ্দুর জানি, লোকটা বিনা কারণে একটা লাইনও লেখেন নি। সবই নিছক মজা মনে হয়, কিন্তু সবকিছুর আড়ালে হয় আছে শিক্ষামূলক কিছু, নয় ব্যঙ্গ। এখানে তিনটে শুওর কি নিছক মজা? কিন্তু ওখানেই এক বুড়ো সিরিয়াসলি নিল কথাটা। বলল, সে সব অনেক পুরনো ঘটনা, চলে যাও চন্দননগর, বলে এক ফরাসি বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের নাম বলল আমাকে।

- তা, কী পেলি রে চন্দননগরে?
- অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের ওল্ড লাইব্রেরিয়ান দেখলাম সুকুমার রায়ের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন। তবে টুপি পরা শুয়োর বলতে তিনি যে শুয়োরকেই মীন করেননি সে সম্বন্ধে তিনি একপ্রকার নিশ্চিত। মানুষের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, পার্শী প্রায় সবাই টুপি পরত সেকালে। তবে হিন্দুদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত লোকেরা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আর চাষিরা ক্ষেতে-খামারে আর মুসলমানরা জুম্মার নামাজেই সাধারণতঃ টুপি পরতেন। মাথায় চব্বিশ-ঘন্টা টুপি লাগিয়ে রাখতেন ইউরোপীয়রা মানে ইংরেজ আর ফরাসি সায়েবরা। এই টুপিধারিদের ক্লাসটাকে উদ্দেশ্য করেই হয়েছিল ছোটনাগপুরের সাঁওতাল বিদ্রোহ, বিরসা তাঁদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন- 'টোপি টোপি এক হ্যায়, সবাই আমাদের শত্রু'।
'তাহলে কি তিনজন ফরাসি সায়েবকে টুপিহীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে মজা করে সুকুমার ওই ছড়াটা লিখেছেন বলে আপনার মনে হয় মসিঁয়ে?' আমি জিগ্যেস করলাম।
- কী বললেন ভদ্রলোক?
- উনি বললেন সেটা হতেও পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে সুকুমার ফরাসিদের কোন অসম্মান করেননি বা তাঁদেরকে শুয়োর বলে মনে করেননি। জানতো, ইউরোপীয়দের মধ্যে শুয়োরকে টুপি পরানোর চলও আছে। তবে শুয়োরকে পশ্চিমে নাকি দুরকমভাবে দেখে, বাচ্চা শুয়োর বা পিগি হল একটা আদরের জিনিস, ছোটদের খেলার সামগ্রী, আর বয়স্ক শুয়োর বা হগ একটা নোংরা জন্তু, যার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষের পেটে যাওয়া। তাই ইংরেজিতে বলা হয়- 'বাচ্চাগুলোকে খাওয়াও, বুড়োগুলোকে কেটে খাও'- কী অদ্ভুত উলটো-পালটা ভাবনা না?
- উরিব্বাস, তুই তো একদম রিসাচ-পেপার নামিয়ে দিয়েছিস রে বরালন্দনের উপরে, চেতন বলে। তা হুগলিতে শুয়ার দেখলি না একটাও?
- দ্যাখ, ঠাট্টা করবি না একদম। বললে বিশ্বাস করবি না, এন্তার শুয়োর দেখলাম, ওরা বিষ্ণুর অবতার কিনা জানিনা, তবে কাছ থেকে দেখতে কিন্তু একদম মানুষের মতন।
দীপুর বন্ধুরা এ কথার আর জবাব কী দেবে? ওরা চারজনেই হাসতে লাগল, নাঃ ব্যাটার মাথায় শুয়োরই ভর করেছে, যেন সাক্ষাৎ বরাহ-অবতার।

(৪)
কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দোকানে বসেছিল দীপু। এ সময় সরখেল মশাই একটু দিবানিদ্রা দেন, তাই সে সময়টা দীপু দোকান পাহারা দেয়। সাড়ে তিনটের সময় গদাই আসতেই দীপু নিজে হাতে চা এনে দিল ওকে। বলল, 'এই মোটু, ভারত সংঘ আশ্রম যাবি আমার সঙ্গে একবার?'
- 'আশ্রম মানে ভারত সেবাশ্রম সংঘ? হঠাৎ?'
- 'না, একটু স্বামী বৈকুণ্ঠানন্দের সঙ্গে কথা বলতাম হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে। বাবা এলেই বেরিয়ে পড়ব।'
- 'শাস্ত্র মানে আবার শুওর? তুই শালা এবার একটা সত্যিকারের শুয়োর পোষ!'
- 'দূর পুষতে যাব কেন? এইতো কত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশে-পাশে, এখন কথা বলছে আমার সাথে'- বলতেই রেগেমেগে তেড়ে গেল গদাই, কিন্তু পরের মুহূর্তেই থেমে গেল পাশের দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসা নচিকেতার গলায় একটা গান শুনে-
'হাসপাতালের বেডে টিবি রুগির সাথে
খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা-----'

হেসে উঠল দুজনেই।

-  'বুঝলে বৎস, একটা ইঁদুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে তোলা হয়েছে- এই প্রাণীর নাম 'মুষিকবৃদ্ধি' '- পণ্ডিত তাঁর শিষ্যকে বলেন, সে একটা শুয়োর দেখতে পেয়ে ওটা কী জিনিষ তা জানতে চেয়েছিল। সেই সময় আর এক পণ্ডিত যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে। তিনি শুনে থেমে বললেন, 'আরে না না। হাতিটা না খেয়ে শুকিয়ে এই হাল হয়েছে, এর নাম 'গজক্ষয়ঃ'।' এই বলে স্বামীজি হেসে থামলেন।
- 'স্বামীজি, বরাহ অবতারের কথা শুনেছি। আপনার গল্পটাও বেশ মজার। শাস্ত্রে আর কিছু নেই শুয়োর নিয়ে?' দীপুর জানার ইচ্ছে এত সহজে মেটে না।
- 'তাহলে তোমাকে কিছুটা ইতিহাস শোনাই, তার পরে আসি পুরাণে। জান, শূকর পোষা পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীন পশুপালন প্রথা, এর ইতিহাস নয় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো, ছাগল-গরু-ভেড়া-ঘোড়ারও আগের। ইউরেশিয়ার বন্যবরাহদের ডি-এন-এ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে এ তথ্য!'
- 'বলেন কি স্যার?' বলেই গদাইয়ের খেয়াল হয় ও কলেজের ক্লাসে নয়, স্বামীজির সাথে বসে আছে। 'মানে স্বামীজি'- ও শুধরে নেয়।
- 'সংসদীয় গণতন্ত্র শুয়োরের খোঁয়াড়'- এই কথাগুলো কারা বলে জান? এ কথা লেনিন বলেছিলেন, তবে এখনকার ভারতীয় বামপন্থীরা এই উক্তি এখন আর মানে না। শুয়োরের খোঁয়াড় নোংরা নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার মধ্যেও একটা ব্যাপার আছে, কী তা জান?'
- 'স্বামীজি, আমরা অধম, শাস্ত্রজ্ঞান নেই। তাই বলে শুওর-বিশেষজ্ঞও নই। আপনি বরং একটু বুঝিয়ে বলুন।'
- 'হুম! শুয়োর নোংরা প্রাণী, নোংরার মধ্যে থাকতে, আবর্জনা ঘাঁটতে ভালবাসে বটে, যার জন্যে ইসলামে এদের মাংস হারাম, মানে নিষিদ্ধ। শুয়োর কিন্তু নিজেদের বাসস্থানকে নোংরা করে না, পায়খানা-টায়খানা খোঁয়াড়ের বাইরে সারে বেশিরভাগ সময়। এ নিয়ে একটা গল্প আছে হিন্দু পুরাণে। তবে আজ নয়, এখন সন্ধ্যারতির সময়। কাল এসো তোমরা, আরো গল্প করা যাবে, কেমন?'

কী আর করা যায়! বাসায় এসে সব কিছু একটা নোটবইয়ে লিখে রাখল দীপু।     

(৫)
পরদিন সকাল এগারোটায় শহরের সার্কেলের পাশের মাঠে বক্তৃতা দিচ্ছিল উঠতি নেতা সুভাষ সিকদার। ব্যাটা কয়লার মাফিয়া, কোটিপতি। তবু সকালে ন্যাড়াদের বাসায় এসেছিল, সম্পর্কে নাকি ন্যাড়ার মামা হয়। এসে ন্যাড়ার বাবাকে বলে কিনা, 'জামাইবাবু, পার্টির লোকেরা বলছিল ফর্সা নতুন পাঞ্জাবি পরে নাকি জনসভায় ভাষণ দিতে নেই। আপনার কাছে একটু পুরনো ময়লা পাঞ্জাবি আছে, একটু ছেঁড়া হলে আরো ভাল হয়?'
  
'আমার জামা তোমার গায়ে হবে? তোমার সাইজ কত?'
'বুক ছাব্বিশ, পেট ছাব্বিশ, কোমর ছাব্বিশ'- সাইড থেকে দীপু ফোড়ন কাটল।
সুভাষমামার নির্ঘাৎ হ-য-ব-র-ল পড়া ছিল না। তাই ও একটু অবাক হয়ে তাকাল দীপুর দিকে। তবে ন্যাড়া সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা-টিনেমা দেখে। ও লালমোহন গাঙ্গুলির মত বলে উঠল- 'অ্যাই, আমার মামা কি শুয়োর?'
' শালুক চেনে গোপালঠাকুর, শুয়োর চেনে কচু!' মনে মনেই আপাততঃ একটা গাল দিল দীপু, 'শালা সব শুয়োরের বাচ্চাকে কি চেহারায় চেনা যায়? চিনতে হয় তার আচার-আচরণে!' মুখে কিছু বলল না, কে জানে কবে ব্যাটা এম-এল-এ, মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যায়, ব্যবসা করে খেতে হয়, এগুলোকে চটালে চলবে না।

কিছুক্ষণ বক্তৃতা শোনার পর যখন দেখল গরীবের জন্যে চোখের জলে বাবার ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা ভাসাচ্ছে সুভাষমামা, ন্যাড়া অস্ফুটে বলল- 'হারামি কোথাকার! কুমিরের কান্না দেখাচ্ছে। সন্ধেয় বাড়ি ফিরেই তো মালের বোতল নিয়ে বসবে।'
-'আরেকটা বরাহ-নন্দন!' দীপু বলে। 'হ্যাঁরে, জিগ্যেস করে আসি, মাইকটা ধরে আছে- ও'দুটো ওর হাত না সামনের পা?' শুনে ন্যাড়া-চৈতন্য এমন জোরে হাসল যে আসেপাশের লোকজন চমকে তাকাল ওর দিকে।
কিন্তু এটা তো কোন সমস্যার সমাধান নয়। শুয়োরের আরো কী গল্প শোনাবে বলছিলেন স্বামীজি। আজ মোটকা গদাই নেই, বিশু কোথায় যেন গেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, তাই ন্যাড়া-চৈতন্য যাবে সাথে ঠিক হল।

- 'ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা অযোধ্যার হরিশ্চন্দ্রের নাম শুনেছ তোমরা? রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। একবার একটা গোলমালে ফেঁসে গিয়ে সারা পৃথিবী বিশ্বামিত্র মুনিকে দান করে দিলেন। এখন আর থাকারও জায়গা রইল না, শেষে কাশীধামে গিয়ে থাকতে হয় তাঁকে। সে জায়গাটা নাকি শিবের ত্রিশূলের উপর দাঁড়িয়ে, তাই বিশ্বচরাচরের বাইরে। দানের পর দক্ষিণা চান ঋষি। তখন আর রাজার কাছে কিছুই নেই, বাধ্য হয়ে বউ শৈব্যা আর ছেলে রোহিদাসকে বিক্রি করে কিছুটা চুকান তিনি। বাকিটার জন্যে হরিশ্চন্দ্রকে নিজেকে বেচে দিতে হয় এক হাড়ির কাছে।'
- 'দানের পরে আবার দক্ষিণা! এ আবার কী রে বাবা?'
- 'সেটা সেকালের নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণকে দানের ক্ষেত্রে। মহাভারতে আছে 'বিপ্রেভ্য প্রযচ্ছ কনকং বহু', মানে ব্রাহ্মণকে সোনা দাও দক্ষিণায়। তবে বিশ্বামিত্র কিন্তু জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় ছিলেন, আমি হলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসতাম। যাক্‌গে, রাজা একটু ভালমানুষ ছিলেন। হাড়ির চাকরিতে ওঁর কাজ ছিল ঘাটে মড়া পোড়ানোর টাকা আদায় করা আর হাড়ির শুয়োরদের দেখাশুনা করা। মানুষরা রাজাকে যতই কষ্ট দেক, শুয়োরদের কিন্তু সহানুভূতি ছিল। রাজা মানুষ, মলমূত্র সাফ করতে পারবে না, তাই ওরা কথা দিল রাজার সুবিধার জন্যে ওরা এসব কাজ বাইরে করে খোঁয়াড়ে ফিরবে। শুওরদের কথার দাম দেখ, আজ পর্যন্ত তারা তাই করে থাকে যতক্ষণ পারে।'
- 'তারপর?' ওদের তিনজনেরই মুখ হাঁ এরকম অদ্ভুত উপাখ্যান শুনে।
- 'তারপর জানা গেল ওই হাড়ি স্বয়ং ধর্মরাজ ছিলেন। শেষে বহু পরীক্ষার পরে হরিশ্চন্দ্রের শাপমুক্তি ঘটল, ফিরে পেলেন রাজ্য, বউ, ছেলে- তবে সে অন্য গল্প।
- 'স্বামীজি, এসব আমাদের পুরাণে আছে?'
- 'হ্যাঁ গো, রামায়ণে তো আছেই, মহাভারতের শুরুতে বৈশম্পায়ন রাজা জন্মেজয়কেও এ কাহিনী শুনিয়েছিলেন। আরো দু-একটা পুরাণেও আছে, একটু রকমফের করে। কেন, এ-দেশের প্রথম নির্বাক ফিচার-ফিল্মও তো হয়েছিল ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকের পরিচালনায়, শোননি তোমরা?'
- 'হঁ হঁ, দিশা হছ্যে, এইত সে বছর কত উৎসব হল চলচ্চিত্রের শতবার্ষিকীতে'- চেতনের মনে পড়ল।


(৬)
এই নিয়ে আজ বেশ কয়েকদিন হল দীপু বেশ চুপচাপ আছে, বরাহ-নন্দন নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। ভাবা গেছিল যে ওর পাগলামি বোধহয় চিরকালের জন্যে ঘুচল এতদিনে। মাঝে বরাহ-পুরাণ বলে একটা বই পড়ছিল সে, স্বামীজির রেফারেন্সে আশ্রমের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে। সত্যযুগে বিষ্ণু ভগবান নাকি বিশাল এক শুয়োর-রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যাক্ষ নামের কোন এক দৈত্যকে মেরে তার কব্জা থেকে সাগর-তলে ডুবিয়ে রাখা পৃথিবীটাকে দাঁত দিয়ে উদ্ধার করে তুলে এনেছিলেন, তার চমকপ্রদ কাহিনী শোনাচ্ছিল একদিন ওই বই পড়ে। বন্ধুদের বয়স হয়েছে, আর রূপকথার গল্প শোনবার আগ্রহ বা উৎসাহ কোনটাই নেই। তাই দীপু একটু মনমরা ছিল ক'দিন। কাল রাঁচিতে ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখে এসে একটু ভুলেছে সে দুঃখ।

আজকাল আর সময় কাটছে না দীপুর। বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে কোন ঝামেলা নেই, দোকানেও কিছুটা বেশি সময় থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে ও। কিন্তু একা অলস হয়ে থাকলেই বিপদ, চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ছোট্ট শুঁড় আর আড়াই-প্যাঁচের লেজ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে কোন বরাহনন্দন, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করে চলেছে। তাকিয়ে দেখে, যাঃ ব্বাবা, সামনে টিভিতে ক্রিকেট শেষ হয়ে পুরনো দিনের টেনিস খেলা দেখাচ্ছে, খেলা চলছে দুই লিজেন্ড প্রতিদ্বন্দ্বী স্টেফি গ্রাফ আর মোনিকা সেলেসের মধ্যে, আর প্রতিটা বল মেরে মোনিকা কেমন শুয়োরের মত ঘোঁত-ঘোঁত করে চলেছে। আচ্ছা এই জন্যেই কি কে নাকি ছুরি মেরেছিল মোনিকা সেলেসকে? না না, সে নাকি স্টেফির ভক্ত ছিল, কী জানি, আসল গল্পটা কী। সময় কাটাতে ফেসবুক খুলে দেখে বাঙ্গালোর থেকে সোহমদা ক্রিশ্চিনা রসেটির একটা মজার কবিতা অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন, দীপুকে আবার ট্যাগও করেছেন জানিনা কেন। তবে কি দীপুর এই বরাহ-সাধনার কথা সবাই জেনে গেছে? কবিতাটা আবার পড়ল দীপু, বেশ মজা পেল-

"শুয়োর যদি টুপি পরেই আসে
কী আর বলি, বলো?
ভদ্র মেনেই শুধাই,
'কেমন আছেন, ভালো?' 

ধান্দায় সে খসায় যদি লেজ,
কী বা করার আছে?
নতুন করে লেজ লাগাতে
পাঠাই মুচির কাছে।"

বাঃ, ভারি মজার তো! দীপুর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য, লক্ষ লক্ষ শুয়োর লেজ খসিয়ে, টুপি পরে ভদ্রসমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাদের বরাহনন্দন বলে চিনতে পারছে না, একমাত্র দীপুর চোখেই ওদের ছদ্মবেশ ধরা পড়ছে। যাক, মনটা হাল্কা হওয়ায় সেদিনের মত ঘুমিয়ে পড়ল দীপু।
পরদিন ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ বেলা করে। এমনিতেও সকালটা কিছু করার থাকে না, সকালে বাবাও দোকান যান বেলা দশটার পরে, নিতাইদাই সামলায় ততক্ষণ। ঘুম ভেঙেই শুনছে একটা অপরিচিত গলা- 'সুদীপ্ত আছে?'
- 'সুদীপ্ত?' বাবার অবাক প্রশ্ন কানে আসে। যেন নামটা এই প্রথম শুনছেন।
- 'ও গো, দীপুকে খুঁজছেন ভদ্রলোক', ঘরের ভেতর থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, সুদীপ্ত যে দীপুরই ভাল নাম তা ওর নিজেরই মনে থাকে না প্রায়ই, বাবার কাছে তো আশাই করা যায় না। তাড়াতাড়ি ব্রাশটা সেরে বাইরের ঘরে ছুটল দীপু। দাঁড়িয়ে আছে ওর স্কুলের এককালের ফার্স্ট বয় তাপস। 


(৭)
- 'আয় তাপস, বোস', দীপু বাসায় এনে বসায় তাপসকে, 'আসলে বাবার শুধু কেন, আমার নিজেরই অনেকসময় নিজের ভাল নামটা খেয়াল থাকে না।'
তাপসের মেডিক্যালের ফাইনাল ইয়ার, কলকাতায় পড়ে। ও ছুটিতে এসে অন্য বন্ধুদের কাছে  কানাঘুষোয় শুনেছিল দীপু শুয়োর নিয়ে খুব চিন্তা-ভাবনা করছে। স্কুলে পড়ার সময় দীপুর এধরণের কোন বদখেয়ালের কথা জানত না ও, শুধু জানত তার গালি না দেওয়ার অভ্যেসটা। কিছুটা মজার খেয়ালেই তাই শুয়োরের ব্যাপারটা জানতে এসেছিল সে।

- 'তারপর দীপু, শুয়োরের ব্যাপারখানা কী রে? তুই নাকি হুগলি-চন্দননগর ছুটে বেড়াচ্ছিস গবেষণা করতে!'
- 'আরে ধুর, গবেষণা নয়। আমি আসলে অনেক মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখতে পাচ্ছি আজকাল, এখন তাদেরকে বরাহ-অবতার বলে প্রণাম করি না বরাহনন্দন বলে গালাগাল দিই তা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।'
 - 'আরে তুই তো জেনেটিক্সের পণ্ডিত হয়ে গেছিস রে! খুব পড়াশোনা করছিস, না?' এবার অবশ্য তাপসের গলায় ঠিক ঠাট্টার সুর নয়।
- 'কই না তো! এই তুই কি ইয়ার্কি মারছিস আমার সঙ্গে? দ্যাখ আমি তোদের মত পড়াশুনায় ভাল ছিলাম না তেমন, তাই বলে ঠাট্টা করবি?'
- 'দূর কী যে বলিস! ওসব ভাল-খারাপ স্কুলেই চলে, পরে ওসব কোন কাজে লাগে না, সেখানে কিছুটা ভাগ্য, কিছুটা বুদ্ধি আর বাকিটা উদ্যম আর পুরুষকারের হিসেব চলে। তবে আমি সিরিয়াসলি বলছি, শুয়োরের সঙ্গে মানুষের কিন্তু জেনেটিক্যালি অনেক মিল আছে।'
- 'কিরকম শুনি?'
- 'দ্যাখ খুব সাংঘাতিক রকমের মিল হয়ত নেই, মানে যতটা বাঁদরের সঙ্গে আছে। ইন ফ্যাক্ট, জেনেটিক্যালি শুয়োর থেকে বেশি মিল আমাদের ইঁদুরজাতি বা রোডেন্টের সঙ্গে আছে। শুয়োর বা সোয়াইন জাতি আর মানুষ-বাঁদর মানে প্রাইমেট জাতির এক পূর্বপুরুষ ছিল প্রায় আট কোটি বছর আগে। মানুষ আর শুয়োরের জেনেটিক ম্যাপিং-এ জাঙ্ক ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এই ক্লু পাওয়া গেছে। তারপর এদের দুজনেরই সাইটোপ্লাজমের মধ্যে  কমন 7SL RNA পাওয়া গেছে।'
- 'উরিব্বাবা, কিছুই তো বুঝলাম না। তার মানে কী মানুষ আর শুয়োরের জিন সমান?'
- 'না, তা নয়।  তবে অন্ততঃ ৮০% মিল আছে। যেমন দুজনের DNAতে protein coding sequence একরকম। কিন্তু জিন-গবেষক মোরানের মতে ৮০% হোক বা ৯৮%, মানুষ বা বানরজাতির মধ্যে  gal-transferase নামে একটা জিন কাজ করে যা অন্য কোন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে দেয় না, মানে অ্যান্টিজেনের কাজ করে।- 'তার মানে বলছিস মানুষ কখনও শূয়োরে পরিণত হবে না?'
- 'স্বভাবে আচারে-আচরণে হবে। অনেক মিলই তো আছে। যেমন ধর শরীরে চুল বা মেদের বাড়াবাড়ি, চর্বি জমার আর কীট-বীজানু আকর্ষণের ঝোঁক আর নোংরা ঘাঁটার প্রবৃত্তিতে খুব মিল, বিশেষ করে ওই শেষেরটা। আর কী চাই?' হাসল তাপস।

তাপস চলে যাওয়ার পরে এই ব্যাপারটা নিয়েই খানিকক্ষণ ধরে ভাবল দীপু। তারপর স্নানে যাবার আগে দেখে ওর ভাগ্নি মিনি একটা ছবিওলা ইংরেজি বই পড়ছে, বইটার মলাটের উপর লেখা 'Alice's Adventures In Wonderland'।
     
৮)
স্নান সেরে এসে দীপু দেখে অ্যালিসের বইটা ছিৎরে পড়ে আছে, মিনি ধারেকাছে নেই। বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে একজায়গায় এসে ওর চোখ আটকে গেল। একটা স্কেচ। একটা বাচ্চা মেয়ে একটা শুয়োরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আছে, তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত।
এখানেও শুয়োর! কিছুটা পড়ে দেখল দীপু। এক ডাচেস কোলের বাচ্চাটা মরিচগুঁড়োর চোটে একটানা হাঁচছে দেখে তাকে ছুঁড়ে লুফছে আর গাইছে, বাংলায় ঠিক এরকম হয় গানটা-
'খোকায় আমার বেদম ধাঁতাই, দাবড়ানি দিই বিষম রাগে,
হাঁচলে পরে দমদমিয়ে পেটাই জোরে;
কারণ, জানি এমনিতে তার মরিচগুঁড়ো ভালই লাগে-
ইচ্ছে করেই মিচকে ব্যাটা অমন করে।'
এই বলে বাচ্চাটাকে অ্যালিসের কোলে ছুঁড়ে দিলেন ডাচেস। নিয়ে সাজগোজ করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ শুনে অ্যালিস চমকে তাকিয়া দেখে, ওমা! বাচ্চাটা তো আর মানুষ নেই, কখন শুয়োর হয়ে গেছে। তখন ও তাকে আস্তে আস্তে মাটিতে নামিয়ে দিল, বাচ্চাটা চার পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

এটুকু পড়েই বইটা মুড়ে রাখল দীপু। ননসেন্স গল্প, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন একটা মেসেজ আছে- মনে হল ওর। আরে, সুকুমার রায়ও তো ওই ননসেন্স ধারারই কবি, লুই ক্যারলের মত। তাহলে কি টুপিপরা তিনটে শুয়োরও অর্থবহ? মহা চিন্তায় পড়ে গেল দীপু।

আজকে বন্ধুদের আড্ডাতে অন্যমনস্ক ছিল দীপু। ন্যাড়া ভুবনেশ্বরের নন্দনকাননে সিংহ দেখে এসেছে গত বছর, অথচ মোটু গদাই তার আগের বছর গিরের জঙ্গলে গিয়ে দেখতে পায় নি কেন তাই নিয়ে বিস্তর তর্ক হচ্ছিল। ওরা দীপুকে সালিশ মানল। ও অনায়াসে বলতে পারত গির থেকে কয়েকটা সিংহ এনে নন্দনকাননে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে খোলা চিড়িয়াখানার মত। কিন্তু তা না করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুজনকে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বলল- 'আর তর্ক নয়, কিছুক্ষণ চুপ করে সিগারেট টান।' চার বন্ধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

তাপস বলছিল 'রাইনোসেরাস' বা গণ্ডার নামে এক বিখ্যাত রূপকধর্মী নাটকের কথা। ফেরার পথে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকল দীপু, ইউজিন আয়নেস্কোর লেখা বইয়ের ইংরেজি এডিশনটা পেয়ে গেল সেখানে। আজ রাত্রে পড়ে দেখতে হবে।


৯)
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। দীপু সকালে সার্কুলার সুইটসের দিকে রওনা হয়েছে, কানে এল পাড়ার দুই মহিলার অন্তরঙ্গ কথোপকথনের অংশ।
- 'সুমিত্রাদির জামাইকে দেখেছ মালাদি, কি হ্যান্ডসাম চেহারা না!'
- 'হ্যান্ডসাম হবে না! ওদের তো লাভ-ম্যারেজ। তাও যদি আমার জামাইয়ের ধারেকাছে আসতো।'
- 'ঠিক বলেছ দিদি, তবে তোমার টুকুর বরও তো ডিভোর্সি। আগের বউটাকে যা পেটাতো, আমার বাপের বাড়ির শহরেরই তো মেয়ে!
- 'যাও যাও সুদেষ্ণা, তোমরা হলে বিশ্ব-নিন্দুকে, কারো ভাল দেখতে পার না। আমরা অমন নই। বিশ্বাসের বউটার কাছে ওই পাঞ্জাবি ছোকরাটা লুকিয়ে আসত, আমি ঘরে আলো নিভিয়ে সব দেখেছি, কিন্তু বল, আজ পর্যন্ত কাউকে কি বলেছি?'

দীপু সভয়ে লক্ষ্য করল, মালাদি আর সুদেষ্ণার নাকগুলো কেমন গোল আর লম্বাটে হয়ে উঠেছে আর পেছন দিকে শাড়ির ভেতরটা কেমন যেন সন্দেহজনকভাবে ফুলে আছে। ও সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল। ওদের দোকানে সামনের দিকে কয়েকটা টেবিল আর বেঞ্চ পাতা থাকে, কিছু খদ্দের ওখানে বসেই চা-মিষ্টি-জলখাবার খান। একজন ট্রেড ইউনিয়ানের মাথা, এক উঠতি পলিটিসিয়ান আর তাদেরই কিছু চামচে বসে সিঙাড়া আর চা খাচ্ছিল। কারখানা বন্ধ করতে হবে কয়েকদিন পরে, পার্টি অনেক টাকা খেয়েছে এক নামী শিল্পপতির কাছ থেকে তারই প্ল্যানিং চলছিল বোধ হয়। দীপুর মাথায় বিশেষ কিছু ঢুকছিল না, তবে ওর যেন হঠাৎ মনে হল লোকগুলোর নাক-মুখ কেমন যেন গোল মতন, নাক-সহ ঠোঁট দুখান এগিয়ে এসেছে, আর বুক-পেট-কোমর সব সমান সাইজ হয়ে গেছে। কাপড়ের তলায় কি লেজ গজিয়েছিল একটা করে, ঠিক বোঝা গেল না। নেতাটির তো মুখের দু-পাশে দুখানা দাঁতও দেখা যাচ্ছে- দীপু সভয়ে চোখ সরিয়ে নিল সেদিক থেকে। আর তাদের কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, শুধু ঘোঁত-ঘোঁতানি ছাড়া। বাবা এলেন কিছুক্ষণ পরে। ও ভয়ের চোটে বাবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলই না, কী জানি তাঁর নাকটাও যদি ওরকম বেরিয়ে এসে থাকে। কোনমতে দোকানের বাইরে পালিয়ে এসে বন্ধুদের আড্ডায় ঢুকল দীপু।

আরে! প্রভাত না? হ্যাঁ, ওদের ছোটবেলার বন্ধু প্রভাতই তো, কমরেড প্রভাত। কাঁধে ঝোলা খদ্দরের ব্যাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়ার সময়ই পাক্কা কম্যুনিস্ট বনে গিয়েছিল প্রভাত। দীপুকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে ও ঠাট্টা করে বলল- 'কী রে, ভূত দেখেছিস নাকি? ওভাবে ছুটছিস যে!'
- 'ভূত নয় রে, শুয়োর', দীপু বলে, সব ব্যাটা শুয়োর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার বরাহ-নন্দন!' এই বলে আজ সকাল থেকে যা যা দেখেছে সব বলল দীপু।
- 'হুম! এটা মনে হচ্ছে নতুন রোগ, নাম দেওয়া যেতে পারে সোয়াইনাইটিস! ঠিক আয়নেস্কোর রাইনোসেরাইটিসের মতই একটা রোগ বাসা বাঁধছে সমাজের শরীরে। নাকি মেটামরফোসিস শুরু হল? একটু ভাবতে হবে এ নিয়ে।'

প্রভাত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন ভাষার বামমনস্ক ছবিগুলো প্রায় কোনটাই ছাড়ে না। সুতরাং দীপুর এই পাগলামিতে সায় দেবার অধিকার তার যথেষ্টই আছে। তবে অন্য বন্ধুরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বিশু খুব একটা বিতর্কে যায় না। তবে চৈতন্য মানে চেতন ছাড়ার পাত্র নয়।
- 'লে হালুয়া! একা হনুমানই লঙ্কা জ্বালাতে যথেষ্ট ছিল, এবার সুগ্রীব জুটল একটা।'
- 'কেন বে! একা মার্ক্সে রক্ষা নেই এঙ্গেলস দোসর- কথাটা মাথায় এল না তোদের, আমার ব্যাপারে ওই বুর্জোয়া রামায়ণ-মহাভারতকে টানবিনা বলে দিচ্ছি',- প্রবল আপত্তি জানায় প্রভাত। 'আমি একদম কিছু বানিয়ে বলছিনা। ইন ফ্যাক্ট, আয়নেস্কোর অনেক আগে মানুষ আর জন্তুজানোয়ারের একাত্মীকরণের কথা ভেবেছিলেন কাফকা। পৌরাণিক গাথা, ঠাকুরমার ঝুলির বুদ্ধু-ভুতুম বা অ্যান্ডারসনের ব্যাঙ রাজপুত্র জাতীয় শিশুপাঠ্য রূপকথাগুলো বাদ দিলে মানুষ থেকে পোকামাকড়ে ম্যুটেশন নিয়ে গল্প লেখেন তিনি, ১৯১২ সালে প্রকাশ হয় কাফকার ছোটগল্প Die Verwandlung, ১৯১৫তে  যার ইংরেজি অনুবাদ হয় Metamorphosis নামে। একটা মানুষের এক বিশাল পোকায় রূপান্তরিত হওয়া নিয়ে এই গল্প সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে, নাটক আর সিনেমাতেও খুব সফল হয় গল্পটা। বুঝলি, আজ আমার একদম সময় নেই, একটা পার্টি মিটিংএ যেতেই হবে এক্ষুনি। তবে দীপুর ব্যাপারটা আজকের মিটিং-এ তুলব, আর কাল ঠিক এই সময় এই নিয়ে কিছু আলোচনা করব। এখন একটা সিগারেট দে তো দীপু, বকে বকে গলাটা শুকিয়ে গেল।'
সিগারেট টানতে টানতে বেরিয়ে গেল প্রভাত। ওরাও আড্ডায় ভঙ্গ দিয়ে যে যার বাসায় ফিরে গেল। তবে মেটামরফোসিস নিয়ে একটা নতুন চিন্তা আজ ঢুকে গেল দীপুর মনে। বাম চিন্তাধারায় ওর কোনকালেই বিশ্বাস নেই, তবে কি ওর মনেরও মেটামরফোসিস হচ্ছে ধীরে ধীরে?     


(১০)
বাড়ি ফিরছে দীপু, সঙ্গে ন্যাড়া-চৈতন্য। রাস্তার দু-পাশে বরাহ-নন্দনদের মিছিল, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দে মুখরিত চারদিক- দীপু ছাড়া অবশ্যই আর কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না।
- 'এই ন্যাড়া, ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে দেখেছিস, কতবড় দাঁত? আচ্ছা সবকটা শুয়োর মিলে আরেকটা শুয়োরকে পেটাচ্ছে কেন বল তো? ও, ব্যাটা টুপি পরেছে বলে!'
ওরা গিয়ে দাঁড়াল মারপিটের ভীড়ের মাঝে। কিছুই নয়, টুপিপরা শুওরটাকে এরা চেপে ধরেছে- 'বল ব্যাটা, বরাহ-অবতারের জয়, বল শুয়ারিস্থান জিন্দাবাদ'। আর সেও তেমনই ঢিট, কিছুতেই বলবে না! আরে, তুইও তো শুয়োরিস্থানেই আছিস, বলেই ফেল না বাপ!
- 'এই দীপু, কলকাতায় একটা বরাহনগর আছে, জানিস ওখানকার হাল কী?' চেতন শুধোয় ওকে। স্পষ্ট শয়তানী।
- 'ওরে, এ শুয়োর সে শুয়োর নয়। এ তো প্রভুর বরাহ-লীলা! শুনলি ওরা কী বলাবলি করছে? পুরুলিয়ার বরাভূমে পঞ্চাশ একর জমি নেওয়া হয়েছে, বরাহ-অবতারের মন্দির হবে।'
- 'ওরে উটো তো বলরামপুরের কাছে বটে। আমাদের গাঁয়ের থিকে সাত মাইল। আমাদের জমিন গুলার দাম বাড়বেক মাইরি!' ন্যাড়া বেশ খুশি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কই, ন্যাড়ার মুখটাতো বদলায় নি? না কি নাকটা একটু মোটা আর লম্বাটে লাগছে? নাঃ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

 আপাততঃ সবাই বাসায় ফিরে এল। কিন্তু সেখানে এসেও কি নিস্তার আছে? টিভি চালাতেই একটা নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে গেল দীপুর। তাই তো, বরাভূম নিয়েই আলোচনা হচ্ছে সংসদে। পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়ই বটে! সবকটা লম্বাটে নাক আর দুপাশে দাঁত নিয়ে ঘোঁত-ঘোঁত করে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে যেটুকু বোঝা গেল যে বাংলার সাংসদরা জিদ ধরে বসে আছে যে বরাভূমেই বরাহ দেবতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। একজন নির্দলীয় তার মধ্যে বলে বসেছে 'কেন, বরানগর নয় কেন?' তাকে একজন লাল টুপিওলা শুয়োর থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, 'অ্যাই চুপ করুন তো! আপনি আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন না! জানেন না, আমাদের স্ট্যান্ড মন্দিরেরই বিরুদ্ধে। হলে কোথাও চিন বা ভিয়েৎনামের প্যাগোডা হবে, হ্যাঁ।' শুয়োরটা জানে না, উন্নত প্রযুক্তির মাইক সব কথাই ক্যাচ করছে। এমন সময় এক হোমরা-চোমরা সাংসদ ঘোঁত-ঘোঁত করে তেড়ে এসে বলতে লাগলেন- 
- 'মিত্রোঁ, আমাদের ফাজিল বন্ধু (ফাজিল মানে যে জ্ঞানী সেটা দীপু সদ্য জেনেছে একটা হিন্দি সিনেমা দেখে। ও মনে মনে স্বীকার করল হিন্দি সিনেমা দেখলে ভাষাজ্ঞান বাড়ে, আজকাল বাংলা সিরিয়ালগুলো বুঝতে সুবিধে হয়) ভুলে যাচ্ছেন যে সৎ-যুগে ধরতী সমুন্দর মেঁ ডুবে গেছিল, বরাহ-ভগবান তাকে অপনা দাঁত দিয়ে উদ্ধার করেন। তো মিত্রোঁ, বরাহভূমে সমুন্দর কোথায়, বোলো বোলো!'
- 'আরে সমুন্দর নেই তো কী আছে? তাই বলে বরাহ-মন্দির আমরা গুজরাটে হতে দেব না! বাঙলার প্রতি চিরকালীন এই বঞ্চনার শেষ চাই! দরকার পড়লে মরগুমা কিম্বা খয়রাবেড়া ড্যামের পাশে আমরা মন্দির করব। পুরুলিয়ায় এয়ারপোর্ট হবে।'
উঃ, অসহ্য! টিভি বন্ধ করে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিল দীপু।


(১১)

- 'কিরে, তোদের মিটিং-এ শুয়োরের কথাটা বলেছিলি?' পরদিন সকাল এগারোটায় সার্কুলার পার্কের বেঞ্চে বসে কথাটা শুধোল দীপু। আজ প্রভাত ওর কথা রেখেছে, ঠিক সময়ে এসেছে আড্ডায়। ছুটির দিন নয় বলে বিশু ছাড়া আর কেউ নেই ওদের সাথে। ওর আর কোন চাকরি হচ্ছে না, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে একটার পর একটা।
- 'হ্যাঁরে, বেশ সিরিয়াস আলোচনা হল এ নিয়ে।' প্রভাত মনে হয় এই কথাগুলো বলার জন্যেই আজ ওর মূল্যবান সময় নষ্ট করে এখানে এসেছে। '
- 'কী ব্যাপার বল তো?' বিশু বলে, 'শুয়োর দেখা নিয়ে তোদের পলিটব্যুরো এত সিরিয়াস কেন হঠাৎ? ওরা নিশ্চয় দীপুর মাথার চিকিৎসা করানোর অ্যাডভাইস দিল?'
- 'ঠিক তার উলটো।' 'পলিটব্যুরো' নিয়ে ঠাট্টাটা গায়ে না মেখেই প্রভাত বলে- অন্য দিন হলে খেপে বোম হয়ে যেত, 'ব্যাপারটা হয়ত ইল্যুশন। তবু কেন জানিনা কাফকা আর আয়নেস্কোর সঙ্গে দীপুর অবজারভেশনের মিল খুঁজে পাচ্ছে ওরা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শিল্প-বিপ্লবের অন্তরালে ধীরে ধীরে মানুষের অজ্ঞাতে বেড়ে উঠেছিল যে আত্মকেন্দ্রিকতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে গড়ে ওঠা কর্মজীবনের একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ আর তার থেকে নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণার জন্ম, তারই ফলে একটা মানুষ নিজেকে পোকা ভাবতে শেখে। বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত আধুনিক মানুষেরা জীবনযাপনের দুর্বিষহতায় ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার দেখেও কিছু করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে যে কীটের সাথে তুলনা করে, গল্পে তার বাস্তবায়ন করে দেখানো হয়েছে। এই হতাশা, অবিশ্বাস আর চুড়ান্ত আত্মগ্লানির আবহাওয়া থেকেই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তা হয়ত কাফকাও বোঝেননি, তবু হয়ত এটাই ফ্যাক্ট।'
- 'বাপরে! আর গন্ডারের সঙ্গে শুয়োরের মিলটা?' দীপু শুধোয়। ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখা নিয়ে লোকে এত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
- 'রাইনোসেরাসের পটভূমি জানতে গেলে তোদের একটু আয়োনেস্কোর সম্বন্ধে আগে জানতে হবে। রোমানিয়ান বাবা আর ফরাসি মায়ের সন্তান তিনি। সেই মা আবার সেফার্দি অর্থাৎ স্পেন-পর্তুগালের আদি ইহুদি। নাৎসি রাজত্বের উন্মেষের সময় রোমানিয়াতে ইউজিনদের টিকে থাকাটা একপ্রকার সমস্যা হয়ে দেখা যায়, চোখের সামনে চেনা বন্ধুদের ইহুদি-বিদ্বেষী নাৎসি হয়ে যেতে দেখতে থাকেন। ১৯২৮ থেকে শুরু হয়ে ১৯৩৬ এ তা চরম রূপ নেয়, সেই সময়কার স্মৃতির ফসল 'রাইনোসেরাস'- চেনা মানুষের অচেনা রূপে পরিবর্তন। এই সময় উদ্ভব হয় চুড়ান্ত ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর, হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন আর রুজভেল্ট-চার্চিলের মত কূটনীতিজ্ঞের অভ্যুত্থান- তার থেকে জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।'  
- 'কিন্তু রাইনোসেরাসের রচনাকাল তো ১৯৫৯'- দীপু বলে।
- '১৯৩৬-৩৭এর রোমানিয়ায় বসে একজন হাফ-ইহুদির এই নাটক লিখে কোন লাভ হত না, মাঝখান থেকে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হত। তবে তাতে পরিণতি কিছু বদলাত না। কিন্তু ছয়ের দশকে উনি এমন এক পরিবর্তনের কথা লিখে গেছেন যার চুড়ান্ত পরিণামে  হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হয়ত সেই সময়ও তিনি এমনই আরেকটা কিছুর সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে একটা অ্যালার্ম কল করেছেন নাটকটার মধ্য দিয়ে।'
- 'তাহলে বলতে চাস, বরাহ-নন্দনের ব্যাপারটাও এমনই একটা বিপর্যয়ের পূর্বাভাস?' এতক্ষণে বিশুর মাথাটা খোলে।
- 'দেখা যাক। তুই একটু সাবধানে থাকিস দীপু। কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটিতে আবার জড়িয়ে না পড়িস।'
কেটে পড়ল কমরেড প্রভাত চক্রবর্তী।



(১২)
আর সাবধানে থাকা! চতুর্দিকে শুয়োরের দল, নোংরা আবর্জনা, আর ঘোঁতঘোঁতানি। বরাহ-নন্দনেরা ক্রমে দলে ভারি হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি লাগছে, এমনকি অন্য শুওরদেরও তারা ছেড়ে কথা কইছেনা।  সাদা-গোলাপি শুয়োর আর কালো শুয়োরের মধ্যে তো চিরকালের দাঁতাদাঁতি (হাতাহাতির বদলে এই শব্দটা মনে মনে ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করল দীপু) লড়াই। ইদানীং আরো কিছু অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। আগে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে যৌনতা খোলাখুলি ছিল, ধর্ষণ জাতীয় অপরাধের কথা কেউ শোনে নি। আজকাল কিন্তু প্রায়ই কিছু শুয়োরের বাচ্চা মিলে মানব-কন্যাদের রেপ করে পরে দাঁত দিয়ে ফালাফালা করে চিরে ফেলছে বলে শোনা যাচ্ছে। মানুষ অপরাধ করলে শাস্তি হয়, তবে শুয়োরে করলে পুলিশ নাকি কেস নিচ্ছে না। নেবে কেন? ওরাও তো দ্রুত বদলে যাচ্ছে।   
আজকের খবরে প্রকাশ, বরাহ-মন্দিরের কেস মানুষরা হেরে গেছে, এখন বরাহভূমের পাশে অযোধ্যাপাহাড়ের শিখরে বরাহ অবতারের মন্দিরের শিলান্যাস হতে চলেছে। নীচের মরগুমা ড্যাম থেকে জল নিয়ে এসে ভগবানের পায়ে ঢালবেন ভক্তেরা তার জন্যে হাইওয়ে আর রোপওয়ে দুটোই তৈরি হবে। পুরুলিয়া শহর থেকে বলরামপুর, বেগুনকোদর, বাঘমুন্ডি সর্বত্র শুয়োরের রাজত্ব এখন। মানুষদের মধ্যে বেশ কিছু শুয়োরে পরিবর্তিত হয়েছে, আরো হচ্ছে। কি করে হচ্ছে, তার মেকানিজ্‌ম্‌ এখনও ঠিক পরিষ্কার নয় সবার কাছে, কিন্তু শুয়োর হতে পারলে আর চিন্তা নেই। যে অবহেলিত জাতির লোকজন এখনও কষ্ট করে মানবজীবনে পড়ে আছে, তারা একমনে বরাহমন্ত্র জপ করে চলেছে দু'বেলা, যদি তাতে মুক্তি হয়, বরাহজীবনে উত্তরণ ঘটে। দীপুর চোখের সামনে ওর বন্ধুরা অনেকে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এইত তাপস এসেছিল, সিলিন্ড্রিক্যাল নাক নিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কত অহংকার করে গেল। বাবা নিজের দোকান থেকে মিষ্টি এনে ওকে খাওয়াল, জানিনা তার ফলেই কিনা, বাবার নাকটাও সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। বিশু ব্যাটার শুয়োর হয়ে যা গুমোর বেড়েছে, পাত্তাই দিতে চায় না একেবারে!

আজ সকালে ঘুম ভেঙে দীপুর কিরকম গায়ে ব্যথা ব্যথা লাগছে। এ কোথায় শুয়ে আছে সে! সবুজ পর্দা, সবুজ চাদর, গায়ে ডোরাকাটা কয়েদিদের মত পোষাক- একি জেলখানা নাকি? বাইরে কিছু চেনা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মনে হচ্ছে, মানুষের গলাই, কই ঘোঁত-ঘোঁতানি নয় তো! এমন সময় মোটা আর বিশু ঘরে ঢোকে।
- 'জ্ঞান ফিরেছে, দীপুর জ্ঞান ফিরেছে!' বিশু খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। আরে, বিশুটা আবার মানুষ হয়ে গেল কখন?
- 'হ্যাঁরে, আমি কোথায়? আর বিশু তুই শুয়োর হয়ে গেছিলি না! আবার কি করে মানুষ হলি?'
- 'কী পাগলের মত বকছিস! শুয়োর আবার কোথায়? তুই হাসপাতালে। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি। তবে চিন্তা নেই, সবকটা শুয়োরের বাচ্চা এখন হাজতে। এখন কাকাবাবুকে একটা খবর দিতে হবে দীপুর জ্ঞান ফিরেছে বলে।'
- 'তাহলে শুয়োরদের সঙ্গে আমার মারপিট হয়েছিল? তবে যে বলছিস আমি পাগলের মত বকছি!'
- 'আরে তোর মনে নেই, ওই বিহারি গুণ্ডাটা যাকে তুই শুয়োরের বাচ্চা, মানে ওই বরাহ-নন্দন না কী যেন বলেছিলি? শালা জীবনে প্রথম গাল দিয়েই উদোম ক্যালানি খেয়ে গেলি'- বলে হাসতে লাগল মোটা গদাই। 'তবে আমরাও ছাড়িনি, খুব উত্তমমধ্যম দিয়েছি হারামিদের। আরে আমরা কি জানি ব্যাটা কারো কাছ থেকে বরাহ-নন্দনের মানে জেনে এসে দলবল নিয়ে পেটাতে আসবে। তুই তখন সন্ধের পর বাড়ি ফিরছিলি, নিতাইদা এসে খবর দিল দীপুবাবুকে  চারটে গুন্ডা মিলে পেটাচ্ছে। আমরা ঠিক সময়ে এসে না পড়লে তোকে বাঁচানো যেত না।'     
- 'তাহলে ওই যারা শুয়োর হয়ে গেল, তাপস আর প্রভাতের সঙ্গে এত কথা হল!'
- 'কী বলছিস রে!' বিশু বলে, 'তাপস তো ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে ডাক্তারির, ও আসবে কি করে এখন কলকাতা থেকে? আর প্রভাত......' বলে চুপ করে গেল বিশু।
- 'কী হয়েছে প্রভাতের? ও কি শুয়োর হয়ে গেছে নাকি?'
- 'না রে', ইতিমধ্যে ন্যাড়া ঢুকেছে রুমে, ও বলল, 'ওকে আর আমরা দেখতে পাব না। মাওবাদী নক্সালদের দলে ভিড়েছিল, পরশু জঙ্গলমহলে পুলিশের সঙ্গে একটা এনকাউন্টারে মারা গেছে।'

যাক, কুয়াসা কাটল। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে পড়ে দীপু তাহলে একটা লম্বা স্বপ্ন দেখে গেল। কিন্তু জেনেটিক্স, বরাহ-পুরাণ, কাফকা, আয়োনেস্কো- এতসব সে জানল কি করে? না কি স্বর্গের দোরগোড়া থেকে ফিরে এল বেশ কিছু দিব্যজ্ঞান নিয়ে। সত্যিটা কী তা কে বলবে, ভবিষ্যৎ? 

   

শেষ।।




 

Wednesday, November 6, 2019

দাদুরি-কাব্য।। ছড়া (লিমেরিক)

দাদুরি-কাব্য।।
(ছড়া- লিমেরিক)

(১)
দাদুরি-কাব্য

ঝমঝমে বৃষ্টিতে কত আর ভাববো,
ভেবে ভেবে লিখে ফেলি দাদুরির কাব্য।
অচল আধুলি-সিকে
চলে যায় লিমেরিকে,
ব্যাঙ বলে বৃষ্টিতে জলে কি গো নাবব?

(২)
ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙেদের সাতপাকে মিশেছিল জল তাই
বিয়েটা হলনা পুরো ভ্যাস্তাল সবটাই।
সিঁদুরে বর্ষা ধারা
ব্যাঙানী ত কেঁদে সারা,
ভেকেদের কলরবে শুনল না কেউ ভাই।

(৩)
ব্যাঙের আধুলি

একটি আধুলি-সিকিতে ব্যাঙের যত বিলাস-ব্যসন
তাই দিয়ে তাঁর চলে পরিবার, কেনেন আটা-বেসন
ব্যাঙেদের নেই ব্যাঙ্ক,
আছে শুধু জল-ট্যাঙ্ক,
ব্যাঙ ম'লো অনাহারে যবে হ'ল ডিমনিটাইজেশন!

(৪)
বিগ-ব্যাং

ব্যাঙেদের রাজা চলছিল তার বাড়িয়ে ঠ্যাং
এমন সময় পণ্ডিত এসে মারল ল্যাং।
রেগে মেগে বলে ব্যাঙ
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ,
থাকতিস কোথা না হলে সেদিন বিগ-ব্যাং?


(৫)
ব্যাঙের রাজা

রাজা চাই, চাই রাজা, কাঁদুনি জুড়ল যত ব্যাঙ,
বিধাতা পাঠান বক, চেয়ে থাকে তুলে এক ঠ্যাং
সারাদিন চেঁচিয়ে কাবার
ব্যাঙ হয় রাজার খাবার,
চাইনে এমন রাজা, কেঁদে বলে ঘ্যাংগোর-ঘ্যাং। (সুকুমারীয় প্রেরণায়)



(৬)
ব্যাঙের সর্দি

বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে ব্যাঙের হল সর্দি
ব্যাঙানি তাই ছাতা মাথায় ডাকতে গেল বদ্যি।
বদ্যি বলে আচ্ছা বোকা-
তুমি তো নও কচি খোকা,
উঠবে নাকো 
পুকুর থেকে যাও ফিরে যাও জলদি! 


(৭)
ব্যাঙের ছাতা

সর্বনেশে জন্তু সেটা মানুষ নাকি নাম
 কিনতে এল 
ব্যাঙের ছাতা দিয়ে দেদার দাম
বলল তোরা ভীষণ যা তা
খাসনে কেন ব্যাঙের ছাতা,
জানিস এতে প্রোটিন আছে, তাই নিয়ে চললাম!


(৮)
ঝিং-ঝ্যাং

ব্যাঙ ওরে ব্যাঙ, ছড়িয়ে চারটে ঠ্যাঙ
ডাকিস শুধুই গ্যাঙোর গ্যাঙোর গ্যাঙ
থাকতিস যদি চীনে
ঠিক তারা নিত কিনে
কেটেকুটে তোরে বানাত কোর্মা, নাম দিত ঝিং-ঝ্যাং!


(৯)
মুনলাইট সোনাটা

কোলা ব্যাঙ গান গায় সোনা ব্যাঙ কিছুই পারে না
তাই দেখে ওস্তাদ বলে শোন ওরে কোলা সোনা,
সোনাটা নেহাৎই অবলা,
ও বরং বাজাক তবলা,
কোলা তুই পিয়ানোতে 'মুনলাইট সোনাটা' শোনা! 



(১০)
ফ্রগ বনাম দাদুরি

ফ্রগ মানে ব্যাঙ, দাদুরি মানেও ব্যাঙ
বর্ষা এলেই দাদুরি গাইত, ফ্রগটা ওনলি স্যাং,
দাদুরি জানত রাগ ও রাগিনী
ফ্রগের চয়েস ছিল পলিফোনি,
বাখ-বিঠোফেন শুনতে গেলেই, মোবাইল হত হ্যাং!


(১১)
ব্যাঙা আর ব্যাঙাচি

অন্নদা-স্যার শুনতে পেলেন, ব্যাঙ রেগে কয় 'ব্যাঙাচ্চি-
বড্ড তোদের বাড় বেড়েছে, দাঁড়া তোদের ঠ্যাঙাচ্ছি!'
ব্যাঙাচ্চিরা অমনি ভয়ে কাঁটা,
পাণ্ডা যে তার মস্ত বুকের পাটা!
সে তবে কয় লেজটা নেড়ে, 'আমরা কি স্যার ভ্যাঙাচ্ছি?'

(উৎস - অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া- "ব্যাঙ রেগে কয় ব্যাঙাচ্ছি")


(১২)
পকেটমার ব্যাঙ
 
কোলা ব্যাঙের আধুলিখানা সাপটা নিল কেড়ে
পয়সা পেয়ে মস্ত খুশি, ব্যাঙকে দিল ছেড়ে।
সাপটা এসে অফিস থেকে
খোলসটাকে টাঙিয়ে রাখে-
ব্যাঙটা ক'রে পকেটমারি আধুলি দেয় ঝেড়ে!


(১৩)
ব্যাঙ বনাম হাঁস

জলের উপর দুইটি প্রাণী, দাদুরি আর হাঁস
হাঁসটা থাকে স্থলে, ব্যাঙের জলের মাঝে বাস।
ব্যাঙ বললে, হাঁস, এটা মান-
মোরা দু'জনাই অ্যাম্ফিবিয়ান,
হাঁস বলে আমি একটু বেশি, ছুঁতে পারি আকাশ! 


(১৪)
দাদু ও দাদুরি

দাদু বলে 'আমি দাদু, তুই হলি দাদুরি
আয় করি কোলাকুলি ক্যায়সি হ্যায় এ দূরী',
ব্যাঙ বলে ছুঁড়ে লেগ
'চড়িয়েছ কত পেগ?
ছুটে যাবে সব নেশা খেলে হিং-কচুরি!'


(১৫)
বরসাত

বহুকাল আগে সিনেমা হলেতে চলছিল 'বরসাত'
রাজ কাপুরের ছাতা উড়ে যায়, নার্গিস হাতে হাত,
হঠাৎ শব্দ গ্যাঙর-গ্যাঙর-গ্যাঙ,
হলে ফুটো মেঝে উঠে আসে যত ব্যাঙ,
বলে- এ ছবিটা ছ-বার দেখেছি, চালা 'য়াদোঁ কী বারাত'!

(১৬)
কূপমণ্ডূক

কুয়োতে ছিল যে ব্যাঙ জাতে কূপমণ্ডূক
বাঘ ভেবে শিকারিটা নিয়ে আসে বন্দুক,
অবাক, তাকিয়ে দেখে- একি!
বাইশটা ব্যাঙ খেলে হকি,
বলে, এটা হকি নয়, যষ্টি ও কন্দুক।

(১৭)
খাই খাই

ব্যাঙ খায় পতঙ্গ, সাপ খায় ব্যাঙকে,
ময়ূর সাপকে খায়, বাঘেতে ময়ূরকে
মানুষই এমন প্রাণী
শুধু টাকা খায় জানি,
সুদ খায়, ঘুস খায়, রাখে টাকা ব্যাংকে!

(১৮)
পারম্পর্য

ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়, না বৃষ্টি হলে ব্যাঙ ডাকে?
এ প্রশ্নটা সিধুজ্যাঠার সামনে ফেলুদাই রাখে।
সিধুজ্যাঠার প্রশ্ন আদিম,
মুরগি আগে, না আগে ডিম?
জানতে এসব ব্যাঙের কাছেই যাও, গিয়ে শুধাও তাকে!

(১৯)
গ্যাঙর গ্যাং ছড়িয়ে ঠ্যাং ডাকছে ব্যাঙ, বিশাল গ্যাং
ফক্কা ট্যাঁক, নাচছে দ্যাখ  চিনের চ্যাং, ড্যাড্যাং ড্যাং 
 



 

গণেশপুরী ও সিদ্ধপীঠ আশ্রম। ভ্রমণ/ প্রবন্ধ

গণেশপুরী ও সিদ্ধপীঠ আশ্রম।


(১)
তখন আমি ভারতের একটি বিখ্যাত খনিজ তেল কোম্পানীর মুম্বাই শাখায় কর্মরত। হঠাৎ একদিন একটা ট্রেনিংএর অফিস অর্ডার হাতে পেলাম, আমাকে আর আমার অফিসের এক বয়স্ক সহকর্মী যাদবজিকে যেতে হবে তিনদিনের এক যোগা ও মেডিটেশনের কোর্সের জন্যে মুম্বাই থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের গণেশপুরীর গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমে। ব্যাপারটাকে কিভাবে নেব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, এটা শিখে বা অভ্যাস করে কোম্পানীর কী কাজে লাগাতে পারব, নাকি এটা ব্যক্তিগত বিকাশের জন্যে কর্মচারীদের প্রতি কোন সেবামূলক কার্যক্রম। যাকগে, কৌতূহল আর না বাড়িয়ে বিরার লোকাল ট্রেনে ভাসাই স্টেশনে নেমে দেখি যাদবজি আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। গণেশপুরী বা বজ্রেশ্বরী মন্দিরের কিম্বা তনসা হট স্প্রিং-এর বাস নিতে বলা হয়েছিল, ভাগ্যক্রমে গণেশপুরী আশ্রমেরই বাস পেয়ে উঠে পড়লাম দুজনে।
মুম্বাই শহরের উত্তরে থানে জেলায় তনসা নদীর উপত্যকায় গণেশপুরী জল-জঙ্গল-পাহাড় অধ্যুষিত এক মনোরম স্থান, অন্ততঃ একসময় তাই ছিল। তনসার তীরে আছে বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণ বা গরম জলের কুণ্ড। এরই পাশে রাস্তার ধারে ভডভালি গ্রামে একটি টিলার মাথায় আছে দেবী বজ্রেশ্বরী যোগিনী মন্দির, খুব সম্ভবতঃ ওই অঞ্চলের ঘনঘন বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে এই দেবীর কল্পনা, অবশ্য এ অঞ্চলের অন্যান্য যোগিনী (যেমন মহাকালী, যোগেশ্বরী বা কানহেরি গুহা) মন্দিরগুলোর মত এর বৌদ্ধ উৎসের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মূল মন্দিরটি নাকি আট কিলোমিটার দূরে গুঁজ গ্রামে ছিল, যেটা পর্তুগিজরা একসময় ধ্বংস করে দেওয়ায় এই বর্তমান মন্দিরটির স্থাপনা হয়।
এখান থেকে বিরারের পথে তিন-চার কিলোমিটার দূরে শুরু হচ্ছে পুণ্যভূমি গণেশপুরী। এসেই পড়েছি যখন এর ইতিহাসও খানিক জেনে নেওয়া যাক। কথিত আছে পুরাকালে এখানে একটি প্রাচীন গণেশমন্দির ছিল যেখানে ঋষি বশিষ্ঠ একসময় এক মহাযজ্ঞ করেছিলেন। ১৯২৩ সালে কালিকট থেকে স্বামী নিত্যানন্দ নামে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এখানে এসে একটি কুটির গড়ে সাধনা শুরু করেন। তাঁর তপোপ্রভাবে আশেপাশের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি থেকে দর্শনার্থী ভক্তরা তাঁর কাছে আসতে থাকেন। ধীরে ধীরে শিষ্যসংখ্যা বাড়তে থাকে আর তনসা তীরবর্তী তাঁর কুটিরটি আর সংলগ্ন উষ্ণ প্রস্রবণগুলিতে মানুষজনের ভীড় বাড়তে থাকে। বাবা নিত্যানন্দ সব ব্যাপারেই উদাসীন ছিলেন। কিন্তু শিষ্যদের মধ্যে স্বামী মুক্তানন্দ বাবার বাণী প্রচার করার উদ্দেশ্যে গ্রাম-সংলগ্ন হাইওয়ের ধারে প্রচুর জমি যোগাড় করে এক বিশাল আশ্রম খুলে বসেন, যার নাম এখন বিদেশী ভক্তশিষ্যদের কল্যাণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রম নামে। নামেমাত্র একটি লেংটিধারী ভোলা সন্ন্যাসী নিত্যানন্দকে অবশ্য ভুলে যায়নি লোকে, তিনি দেহ রেখেছেন ১৯৬১ সালে। তাঁর কুটির এখন একটি বিখ্যাত মন্দির, যেখানে ট্রাস্টের আয়োজিত স্বল্পমূল্যে বাবার প্রসাদ বড়া-সম্ভর থেকে পূর্ণ ভোজন সবই পাওয়া যায়, যদিও ভীড় বেশি হয় গরম জলের কুণ্ডে পুণ্যস্নানার্থীদের জন্যে।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বাসযাত্রার পরে আমরা গণেশপুরীর সিদ্ধপীঠ আশ্রমে এসে নামলাম।

(২)
গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের অবস্থান গণেশপুরী গ্রামের পথে মোড় ঘুরতেই। মূল আশ্রম আর গাঁওদেবী মন্দির পড়ে বাঁপাশে আর তার উল্টোদিকে ডানপাশে জনসংযোগ ও রেজিস্ট্রেশন অফিস আর অতিথিশালা ও কর্মচারীদের জন্যে কলোনী। গাঁওদেবী মন্দির কী জানেন তো? ইনি কোন গ্রাম বা জনপদের রক্ষাকর্ত্রী ও ইষ্টদেবী, গ্রামে ঢোকার মুখে এঁর মন্দির থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তা গ্রামের মধ্যে বা কোন পাহাড় বা টিলাতেও থাকে। এই গ্রামদেবীর অধিষ্ঠান আর কল্পন একসময় এ দেশের সর্বত্র ছিল, আজ দাক্ষিণাত্য আর উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে এখনও রয়ে গেছে। বস্তুতঃ ধার্মিক কারণ ছাড়াও এই গাঁওদেবীর মন্দিরগুলি তৎকালীন হিন্দু রাজ্যসমূহের গ্রামগুলোতে একপ্রকারের সুরক্ষা বা পুলিশ আউট-পোস্টের কাজও করত।
এই গণেশপুরী গ্রামের গাঁওদেবীর মন্দির সেখানে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিল, স্বামী মুক্তানন্দ সংলগ্ন প্রায় বিশ-ত্রিশ একর জমি নিয়ে আশ্রম তৈরি শুরু করার সময় ওই মন্দিরটির আমূল সংস্কার করে তার উপরেই আশ্রম, যজ্ঞশালা, গুরুদেবের মন্দির, উপাসনা-গৃহ, বিশ্রামালয় ইত্যাদি তৈরি হয়, সংলগ্ন ছবি দেখলেই তা বোঝা যাবে।

আমরা দুজন বাস থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে আশ্রমের মুখোমুখি অফিসে গেলাম। সেখানে আমাদের পরিচয়, কাগজপত্র সব দেখে সাথে-সাথেই ছবি তুলে পরিচয়-পত্র বা আই-কার্ড তৈরি করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তারপর একজন আমাদের সঙ্গে এসে গেস্ট-হাউসে আমাদের একটা দুই-কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিল, না তার কোন চাবি নেই, তার দরকারও হয় না।
সাড়ে পাঁচটা বাজছিল। ছ'টায় নৈশাহারের সময়, আমাদিগকে মেন গেট দিয়ে আশ্রমে যেতে বলা হল। আই-কার্ড গলায় ছিল, সুরক্ষা কর্মী কিছু বলল না। ভেতরে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা ভোজনালয়। সেলফ-সার্ভিস, যাঁদের পণ্ডিচেরি আশ্রম বা ইস্কনের মায়াপুর আশ্রমের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা কিছুটা বুঝবেন। কাউন্টার থেকে খাবার নিয়ে এসে বসলাম, রুটি, ভাত, ডাল, দুটো তরকারি, পাপড়ভাজা, মিষ্টি আর একবাটি দুধ। কোন ঝাল-মশলা নেই, খাঁটি ঘিয়ের একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম শুধু। খুব খিদে পেয়েছিল, তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পর বাসন ধোওয়ার জায়গায় নিজেকেই নামিয়ে দিতে হচ্ছিল, খুব চমৎকার আর সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমাদের সঙ্গে খাচ্ছিলেন বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। পন্ডি আর মুম্বাইয়ের ইস্কন মন্দিরে এঁদেরকে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে চোখ, তাই কিছু অস্বাভাবিক ঠেকল না তেমন। দুজন শ্বেতাঙ্গ সন্ন্যাসী বা যোগীকেও দেখলাম, পরে জেনেছিলাম ওঁরা মঠের 'যোগা অ্যাণ্ড রিট্রিট' শিক্ষক ও অধীক্ষক স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী মহেশানন্দ। আজ বলে নয়, সেই কোন কালে রবীন্দ্রনাথও এরকমই কাউকে দেখে মজা করে লিখেছিলেন-
"টেরিটিবাজারে তাঁর সন্ধান পেনু
গোরা বোষ্টম-বাবা নাম দিল বিনু।"
পরে এই স্বামীজীদের সঙ্গে বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল।

খাওয়া-দাওয়া শেষে দেখি উপাসনালয়ে সমবেতকণ্ঠে নামগান আর ভজন হচ্ছে। আমরাও গলা মেলালাম-
"সদ্‌গুরু জ্যোত সে জ্যোত জাগাও,
মেরা অন্তর তিমির মিটাও।
হে যোগেশ্বর, হে পরমেশ্বর,
হে জ্ঞানেশ্বর, হে সর্বেশ্বর,
নিজ কিরপা বরসাও।।"
মেন দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। স্বামী মুক্তানন্দের সমাধি-মন্দিরের পাশ দিয়ে গাঁওদেবী মন্দিরের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তা পেরিয়ে গেস্ট-হাউসে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি আর যাদবজি। এভাবেই একটা দিন, আশ্রমের প্রথম দিন শেষ হল।

(৩)
 পরদিন ঘুম থেকে উঠতে হল ভোর সাড়ে তিনটেয়।
প্রাতঃকৃত্য আর স্নান সেরে সোয়া চারটে নাগাদ এলাম প্রার্থনা সভায়। খোল-করতাল-করতালি-হারমোনিয়ম যোগে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুরু-গীতা, বিভিন্ন স্তোত্র আর নামগান হল। সাড়ে-পাঁচটায় ইনডোর কাফেটারিয়ামে গিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমবেত প্রাতঃভ্রমণে।

সিদ্ধপীঠ আশ্রমের ছবি দেখলে তার লে-আউট কিছুটা বুঝতে পারবেন। মেন-গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে প্রথমেই পড়বে ক্যাফে যেখানে আমরা চা খেলাম। সেটা পেরিয়েই ডানদিকে রান্নাঘর ও ভোজনালয়। তারপর রাস্তা ডানদিকে ঘুরে মুক্তানন্দ স্বামীর সমাধি-মন্দির আর গুরুমাঈয়ের বিশ্রামালয়ের দিকে, তাদেরকে ডানদিকে রেখে বাঁয়ে ঘুরলেই পড়বে যোগাশ্রম, গুরুকুল, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি ইত্যাদি, আরো এগিয়ে গেলে হোমকুণ্ড, হঠযোগাভ্যাস কেন্দ্র, প্রচুর গাছপালা, বাগান ইত্যাদি। ভোজনালয় থেকে সোজা এগিয়ে বাঁদিকে এক বিশাল মাঠ যার চারদিকে আমরা তখন হাঁটছি।
আমরা যেটাকে ভাবছিলাম প্রাতঃভ্রমণ বা মর্নিং-ওয়াক পরে বুঝলাম ঠিক তা নয়। গুরুকুলের এক ছাত্র ছিল আমাদের গাইড। সে বলল এর নাম মন্দির প্রদক্ষিণ। মন্দির? এ তো একটা ফাঁকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ! না, জানা গেল আশ্রম তৈরির খননকার্যের সময় এই মাঠেরই নীচে পাওয়া যায় প্রাচীন এক গণেশ মন্দির, যার নামে ঐ এলাকা ও গ্রামের নাম 'গণেশপুরী'। ভেতরে ক্যামেরা বা ক্যামেরা-যুক্ত মোবাইল আনা নিয়মবিরুদ্ধ, তাই কোন ছবি তোলা যায়নি ওই 'মন্দিরের'। তবে মন্দির-মাঠের চারপাশে দেখলাম প্রচুর ছোট বড় যত্ন করে পালন করা গাছ, প্রতি গাছের তলে একটা প্লেটে লেখা আছে সেই ভক্ত বা ছাত্রের নাম যাঁরা গাছটি দান করেছেন। অনেকে যাঁরা ওখানে এখনও আছেন তাঁরা গাছগুলির নিয়মিত পরিচর্যাও করেন, যদিও সব কিছুই করা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় আর নিয়ম মেনে। পরিক্রমার পর আমরা আনীত হলাম চারদিক খোলা শেডের ক্লাসহলে, শুরু হল পরিচয়পর্ব। গুরু শিবানন্দ আশ্রমের রীতিনীতি-পদ্ধতি, যোগা ও ধ্যানের কোর্স, সময়-সারণী, গুরুকুলের আদর্শ, হিন্দুধর্মের আদর্শ ও ঐতিহ্য, প্রাচীন ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস- সব বিষয়ে একটা ইন্টারেক্টিভ বক্তৃতা দিলেন, তারপর আটটায় ব্রেকফাস্ট, আবার আমরা উপস্থিত হলাম খাবার ঘরে, দুধ-পাঁউরুটি-কলা-মিষ্টি দিয়ে সারা হল প্রাতঃরাশ।

এবার আশ্রমের প্রশাসন আর কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা কর যাক। আগেই বলেছি, গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ভগবান নিত্যানন্দের শিষ্য স্বামী মুক্তানন্দ। ১৯০৮ সালে মাঙ্গালোরের কাছে ধর্মস্থল গ্রামে তাঁর জন্ম। পনের বছর বয়সে গৃহত্যাগ করার পর সাধনার শেষভাগে তিনি বাবা নিত্যানন্দের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁরই শিষ্যত্ব নিয়ে ১৯৫৬তে গণেশপুরীতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ১৯৬১তে নিত্যানন্দের মহাসমাধির পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুসারে তিনি গণেশপুরীর গাঁওদেব মন্দির সংলগ্ন জলা-জঙ্গলের উপর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। দেশবিদেশ থেকে বহু ভক্তসমাগম হতে থাকে, ক্রমে এই যোগাশ্রমের শাখা-প্রশাখা সিদ্ধযোগ ফাউন্ডেশনের নামে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মুক্তানন্দের এক কন্নড় গৃহী ভক্ত পরিবার বোম্বাইয়ে থাকতেন, তাঁরা মাঝে মাঝেই গুরুসন্দর্শনে আসতেন শিশুকন্যাকে নিয়ে। পঞ্চবর্ষীয়া মালতী শেট্টি তখন কী বুঝত কে জানে, চুপ করে মুক্তানন্দের পায়ের কাছে বসে থাকত, তাঁর বাণী-প্রবচন বোঝার চেষ্টা করত। ইনি চৌদ্দ বছর বয়সে আধ্যাত্মিক শিক্ষামন্ত্র 'শক্তিপট'এ দীক্ষিত হন স্বামীজির দ্বারা, পরে কুড়ি বছর বয়স থেকে পাকাপাকিভাবে আশ্রমে এসে বিদেশী শিষ্যদের জন্যে স্বামীজির দোভাষীর কাজে লেগে পড়েন, ইতিমধ্যে যোগ-সাধনায় সিদ্ধিলাভও করেন। স্বামী মুক্তানন্দের ইনি শ্রেষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। ১৯৮২তে মহানির্বানের কয়েকমাস আগে স্বামীজি তাঁকে গুরুমাঈ চিদ্‌বিলাসানন্দ নাম দিয়ে তাঁকে আর তাঁর ছোট ভাই নিত্যানন্দকে যুগ্মভাবে আশ্রম চালানোর দায়িত্ব দিয়ে যান। অবশ্য কিছু বিতর্কিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে ১৯৮৫তে নিত্যানন্দকে আশ্রম ছেড়ে যেতে হয়, আর তখন থেকেই গুরুমাঈ সিদ্ধপীঠ সমেত সমগ্র সিদ্ধযোগা ফাউন্ডেশনের সর্বেসর্বা।

(৪)
আমার সিদ্ধপীঠ আশ্রমে যে কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার কথা তার নাম 'Retreat to Pilgrimage of Heart', বাংলায় বললে 'হৃদয়তীর্থে একান্তবাস'। রিট্রীট কথাটার অনেক অর্থ হয়, স্বামী শিবানন্দ, ইনি জন্মসূত্রে আমেরিকান, বোঝালেন। আমরা যেমন যেমন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি, বুদ্ধি, দৈহিক শক্তি, জ্ঞান, অর্থ এসব এসে হৃদয়বৃত্তিকে দূরে এককোনে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বে অনেক তীর্থস্থান আছে, অনেক দেবতা, অনেক দুর্গম যাত্রা, কিন্তু সেরা তীর্থ আপন হৃদয়। সে যা দেখায় তাই স্বচ্ছ, নির্মল, যা করায় তাই পুণ্যকর্ম, যা ভাবায় তাই অধ্যাত্মচেতনা। আগামী তিনদিন ধরে আমরা বর্তমান জীবন ভুলে ফিরে যাব হৃদয়ের তীর্থে, উপলব্ধি করার চেষ্টা করব শাশ্বত শুদ্ধাত্মাকে যাঁর বাস প্রতি মানুষের হৃদয়ে বা অন্তঃকরণে। কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করা অনেক বড় যোগসাধনার ব্যাপার। আমরা কর্মব্যস্ত মানুষ, সে সব বুঝি না, পারার প্রশ্নই নেই। কিন্তু দেহের এই ষড়চক্রের মাঝে যে অসীম মানসিক শক্তি লুকিয়ে আছে তার একটুকরো অনুভব- এটুকুও যদি পাওয়া যায়! আরো অনেক বিশাল বড় বড় জ্ঞানের কথা শুনেছিলাম সেদিন, অত বুঝি নি, আর কিছু মনেও নেই। এবার একটু আশ্রমবাসীদের প্রসঙ্গে আসি।

এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ছোট-বড় কাজে রত যাদেরকে দেখছি চারপাশে, তারা কিন্তু একটু অন্যরকম, মানে ঠিক কাজের লোক বা মাইনে করা কর্মচারী বলে মনে হচ্ছিল না। কথিত আছে প্রাচীন ভারতে মণ্ডনমিশ্র নামে এক মহাপণ্ডিত ছিলেন যাঁর বাড়িত দাস-দাসীরাও শাস্ত্র আলোচনা করত, খাঁচার পাখিরাও উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করত। প্রথমে তাই ভেবেছিলাম এঁরাও হয়ত পরিবেশ-সাহচর্যে যোগ ও অধ্যাত্ম-শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠেছে, মানসিক ভাবেও অনেক উন্নতিলাভ করেছে। তবে একজন ভদ্রলোক কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশন করছিলেন, জানালেন তাঁর নাম সমীর পারিখ, মুম্বাইয়ের একজন শিল্পপতি। রিসেপশনে যে ভদ্রমহিলা ছবি তুলে আর ফর্ম ভরিয়ে আমাদের রেজিস্ট্রেশন করালেন তিনি নাকি বাঙ্গালোরের একটি সফটোয়্যার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। বক্তৃতা-হলে যিনি চেয়ার সাজাচ্ছিলেন তিনি আই-আই-টি বোম্বের একজন অধ্যাপক! এঁরা সবাই আশ্রমে সেবাদান করছেন নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে। নিউ জার্সি থেকে আগত এক শ্বেতাঙ্গিনী নিত্যপূজার মালা গাঁথছিলেন, আর আমি তাঁকে দেখে অবাক হলাম না। তবে যা জেনে আশ্চর্য লাগল যে অন্ততঃ বেশ কয়েকমাস আশ্রমে যোগশিক্ষার ছাত্র হিসেবে না থাকলে আর দু-একটা রিট্রীটের কার্যক্রমে যোগদান না করলে সেবারও অধিকার নাকি পাওয়া যায় না। বোঝা গেল এঁরা প্রত্যেকেই হয় গুরুকুলের ছাত্র-ছাত্রী আছেন বা ছিলেন কিংবা স্বামী মুক্তানন্দ ও গুরুমাঈয়ের একান্ত ভক্ত।

পরিচয়পর্বের শেষে শুরু হল আশ্রম পরিক্রমণ। গণেশ মন্দিরের মাঠ আগেই ঘোরা হয়ে গেছে। এবার বাকিটুকু ঘুরে দেখলাম। পরিপাটি করে সাজানো ফুল-ফলের বাগান, মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন সন্ত-তপস্বীর মর্মর মূর্তি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মাধবাচার্য, তুলসী, জ্ঞানেশ্বর, নরসি মেহতা তুকারাম, জলারাম, রামকৃষ্ণ পরমহংস, তৈলঙ্গস্বামী, সুরদাস, মীরাবাঈ, শ্রীচৈতন্য, সাঁইবাবা- কে নেই সেই সভায়। সেখানে ধর্ম-জাতের ভেদ নেই, মুসলমান তাঁতী কবীর বা শুদ্র চর্মকার সন্ত রুইদাসও সসম্মানে বিরাজিত- একেবারে সশিষ্য। পুরাকালের ব্যাস-বাল্মীকি-বিশ্বামিত্র-গৌতম-যাজ্ঞবল্ক-মনুও বাদ যাননি, সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিরাও আছেন। হিন্দুধর্মের দিকপালরা ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুরুরা যেমন নানক, খ্রীস্ট, বুদ্ধ, মহাবীরদের মূর্তিও ছিল, কেবল ইসলাম নবী হজরত নেই, থাকার কথাও নয়- তাঁরা মূর্তিপূজার বিরোধী। সবার সুবিধার জন্য মর্মর ফলকে সকলের নাম-পরিচয়-সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনীও লিপিবদ্ধ করা ছিল প্রতি মূর্তির সাথে। সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে হোমকুণ্ড, হঠযোগের অভ্যাস-স্থল, লাইব্রেরি, ধ্যান বা মেডিটেশন সেন্টার, সব ঘুরে দেখে রীতিমত অভিভূত হলাম।
এই করতে করতে সাড়ে এগারটা। লাঞ্চ-ব্রেক। একই নিয়মে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম সবাই মিলে। এরপর শুরু হবে যোগাভ্যাসের ক্লাস।   

(৫)
আমাদের গ্রুপে আমি আর যাদবজীই আশ্রমজীবনে নতুন। বাকি সবাই বহুদিন ধরেই গুরুকুলছাত্র বা স্বামী মুক্তানন্দের বা গুরুমাঈয়ের ভক্ত, বহুদিন ধরে গণেশপুরী বা বিশ্বজুড়ে থাকা বিভিন্ন সিদ্ধযোগের শাখা আশ্রম বা কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ত্রিশজনের গ্রুপে অন্ততঃ অর্ধেকই তো শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। আমরা কর্পোরেট-সূত্রে প্রবেশাধিকার পেয়েছি, সুতরাং যোগাভ্যাস প্রণালী, এর রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। তবু স্বামী মহেশানন্দ যোগের ক্লাস গোড়া থেকেই শুরু করলেন।

যোগ কথার সোজা অর্থ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মাকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া। প্রাণত্যাগ করলে জীবাত্মা আপনি তা পায়, কিন্তু জীবদ্দশায় তার অনুভব পেতে সাধনার প্রয়োজন, এই সাধনার অভ্যাসই যোগ। যোগের চারটি পদ্ধতি, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ আর রাজযোগ। প্রথম তিনটি পদ্ধতি মূলতঃ মানসিক। জ্ঞানযোগ শিক্ষার পথ। সাংখ্য, দর্শন, বেদান্ত ইত্যাদি শাস্ত্রপাঠ করে শ্রবণ, মনন আর নিদিধ্যাসনের মধ্য দিয়ে এই পথে এগিয়ে সিদ্ধিলাভ করা যায়। ভক্তিযোগের মূল হল দাস, সেবক, সখা বা প্রেমীরূপে ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মনিবেদন। পূজা, প্রার্থনা, নামগান ও সংকীর্তন জাতীয় ক্রিয়াই ভক্তিযোগের পদ্ধতি বা প্রকরণ। কর্মযোগের কথা গীতাতে বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে। ঈশ্বর, মানুষ, জীবজন্তু, প্রকৃতির প্রতি নিষ্কাম সেবা আর কর্মই এই সাধনার পদ্ধতি, 'মা ফলেষু কদাচন্‌'- ফলাফল ভগবানকে সমর্পণ করতে হবে।

এছাড়া ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিকশিত করে আত্মোন্নতির মাধ্যমে পরামার্থপ্রাপ্তির যে সাধনা, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার সময় বিশ্বকে জানান, তার নাম 'রাজযোগ'। অন্য পদ্ধতিগুলিতে মন আর হৃদয় ছিল মুখ্য, দেহের ভূমিকা ছিল গৌণ। রাজযোগে মনের সাথে সাথে দেহকেও যুক্ত করে হয় সাষ্টাঙ্গ-সাধনা, এর ফল হয় অনেক বেশি কার্যকর। এই রিট্রীটে রাজযোগের উপর আমাদের আকর্ষণকে কেন্দ্রিত করার কথা বললেন শ্বেতাঙ্গ স্বামী মহেশানন্দ। তিনি বোঝালেন রাজযোগের আটটি অঙ্গ- ১) যম (অহিংসা, সত্য, আস্তেয়, ব্রহ্মচর্য আর অপরিগ্রহ)- জৈনদর্শনে সম্যকচরিত্রের পাঁচটি মহাব্রতের নাম, বৌদ্ধধর্মে যা পঞ্চশীল ২) নিয়ম বা অনুশীলন- শৌচ (পরিচ্ছন্নতা), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় আর ঈশ্বর প্রণিধান ৩) আসন বা দেহের ভঙ্গিমার দ্বারা বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া আর ৪) প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাস্থ্যকর বিধি- এই দুইয়ে মিলে বলা হয় হঠযোগ ৫) প্রত্যাহার বা বিধিসঙ্গত বিরাম, বিশ্রাম ৬) ধারণ বা মনঃসংযোগ ৭) ধ্যান বা একাগ্রচিত্তে পরমাত্মার প্রতি চিত্ত-নিয়োজন ও ৮) সমাধি অর্থাৎ বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আত্মাকে বহিরঙ্গে পরমাত্মার মধ্যে প্রতিস্থাপন। এটি সাধনার উচ্চতম স্তর।

ধীরে ধীরে ঘরের আলো কমে এল। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের মধ্যে। একটা মৃদু ওঙ্কারধ্বনি সুরে বেজে চলেছে। আমরা সকলে মাটিতে আসন পেতে বসেছিলাম। স্বামীজি বললেন মনঃসংযোগ করে চোখ বন্ধ করতে। এরপরে আদেশ হল ওঙ্কারধ্বনির প্রতি কান রেখে পারিপার্শ্বিক ভুলে একমনে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কোন শক্তির কথা ভাবতে। আমরা আজ্ঞা পালন করলাম। এভাবেই অন্ততঃ মিনিট পনের কেটে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ওঙ্কাররব থেমে আলো আগের মত জ্বলে উঠল। স্বামী মহেশানন্দ বললেন, তোমরা কে কী দেখলে একে একে শেয়ার কর, আমরা শুনি।

(৬)
'আমি দেখলাম অন্ধকারে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। কিছুই বুঝতে পারছিনা। এমন সময় আমার পাশে গুরুমাঈ এসে দাঁড়ালেন। আমি প্রণাম করতেই হাত ধরে টেনে তুলে আমাকে নিয়ে শূন্যে উড়ে চলতে লাগলেন। তারপর আর মনে নেই।'
একজনের বর্ণনা শেষ হতেই আরেকজন। 'আমি এক জ্যোতিঃসমুদ্রের মাঝে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি। উল্টোদিক থেকে একে একে আসছেন সেই সব মহাপুরুষেরা যাঁদের মূর্তি আশ্রমের বাগানে সাজানো আছে।'
'আমি এই ঘর থেকে নড়িনি। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে স্বামী নিত্যানন্দ ধ্যানস্থ হয়ে আছেন আর স্বামী মুক্তানন্দ তাঁর পদসেবা করছেন।'

এবার আমার পালা। 'আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঘরের পরিবেশটা এত মায়াময় হয়ে উঠেছিল, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।' আমার কথায় সবাই হেসে উঠলেন। মহেশানন্দ কিন্তু হাসলেন না। তিনি বললেন-'সেটাই স্বাভাবিক। প্রথম প্রথম ধ্যানে বসে ঘুম আসাটাই নর্ম্যাল। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইয়োর অনেস্টি, মাই ফ্রেন্ড!' আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
'যাক, ধ্যানের একটা ফীল তোমরা পেলে', স্বামীজি বললেন। 'টী ব্রেকের পর লাইব্রেরিতে কিছুক্ষণ বসতে পার। তারপর আমরা যাব স্বামী নিত্যানন্দের সমাধি-মন্দির দর্শনে। ফিরে এসে ডিনার করে আজকের প্রোগ্রামের সমাপ্তি। কালকের দিনটির সম্বন্ধে একটি বিশেষ সূচনা। আগামীকাল এই রিট্রীটের সব ছাত্রের জন্য আছে মৌনব্রত। ক্লাসরুমের মধ্যে প্রয়োজনে কো-অর্ডিনেটার বা লেকচারারের সঙ্গে ছাড়া পারতপক্ষে কেউ কথা বলবে না সারা দিন।'
'আশ্রমের পথে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে?'
'চা খেয়ে লাইব্রেরিতে এস। প্রত্যেককে একটা করে ব্যাজ দেওয়া হবে যেটা কাল সারাদিন তোমরা গলায় ঝুলিয়ে রাখবে। ব্যাজের একদিকে হিন্দিতে লেখা 'মৌন', অন্যপিঠে ইংরেজিতে 'Silent'. Do you know that listen and silent use the same letters, they are anagrams? To listen, to truly listen to someone, even to your inner core of the heart, where you are on a pilgrimage to, you must be silent—not only outwardly silent, but also inwardly. Silent লেখা ব্যাজ দেখলে এখানে কেউ তোমাদের প্রশ্ন করবে না, আশ্রমের সবাই এটা জানে।'

নিত্যানন্দের সমাধি আশ্রম থেকে মাইলখানেকের পথ। তনসা নদীর তীরে যেখানে মাটি খুঁড়লেই একটা স্তর থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে আসে উষ্ণস্রোত, সেখানে এক শান্ত মনোরম পরিবেশে ভগবান নিত্যানন্দের সমাধি মন্দির। নিত্যানন্দ নির্জনে সাধনা করতেন, প্রচারের আলোয় কোনদিনই আসতে চাননি। তবে ১৯৬১তে তাঁর মহানির্বানের পরে শিষ্য মুক্তানন্দ আর এখন স্বামী চিদবিলাসানন্দ বা গুরুমাঈ দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর শিক্ষা জনমানসে প্রচার ও প্রসারে। সেখান থেকে ফিরে এসে ডিনার সেরে সান্ধ্য প্রার্থনায় যোগ দিলাম। তারপর প্রায় সাতটায় আমরা আবাসনে ফিরে এলাম। 'মৌন' লেখা ব্যাজ পেয়ে গেছি, কাল সারাদিন কথা বন্ধ। ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠতে হবে, তাই সাড়ে আটটার মধ্যেই শুয়ে পড়লাম।  


(৭)
পরদিন আমরা 'মৌন' লেখা ব্যাজ বুকে ঝুলিয়ে আশ্রমে এলাম। প্রার্থনাসভায় বসে আধঘণ্টা নামগান আর ভজন শুনলাম, তবে গলা মেলাই নি। তারপর চা-বিস্কুট খেয়ে মন্দির পরিক্রমার নামে মর্নিং ওয়াক, ফিরে এসে শুরু হল যোগা-কেন্দ্রের হলে হঠযোগের অভ্যাস।
হঠযোগ রাজযোগের একটি অঙ্গ যাতে শরীরের সাধনায় মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এর শুরু হয় প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক পদ্ধতি আর অভ্যাস দিয়ে, যেটা বাবা রামদেবের টেলিভিশন আর সিডির কল্যাণে এখন সবার জানা। এর পরের স্টেজ আসন। পদ্মাসন থেকে শুরু, উষ্ট্রাসন, গোমুখাসন, হলাসন, শলভাসন, ময়ূরাসন, সর্বাঙ্গাসন আর সবার মাঝে মাঝে একবার করে শবাসনে কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম। শবাসন জিনিসটা আমার মন্দ লাগে নি, এটা আমি রোজ ৬-৭ ঘন্টা করে থাকি, এখনও! তবে ভয় ছিল শীর্ষাসন নিয়ে, সঙ্গত কারণেই দু-দিনের অতিথিদের জন্যে সেটার শিক্ষাটা বাদ দেওয়া হয়েছিল, বাঁচলাম।

Related image
ক্ষিদে পেয়ে গেছিল। প্রাতঃরাশে দুধ দিয়ে আটার মোটা পাঁউরুটি হাফ-পাউন্ড মেরে দিলাম। তারপর অধ্যাত্ম-বিদ্যার শিক্ষা, ক্লাস নিলেন আই-আই-এম বাঙ্গালোরের একজন প্রফেসার, তিনি কন্নড় কিন্তু পদবীতে বাঙালি। তন্ত্রবিদ্যা দিয়ে শুরু করলেন দেহের ষট-চক্র সম্বন্ধে বক্তৃতা। আমি ঠিক বুঝলাম না, এটা আধ্যাত্মিক, না সত্যিকারের অ্যানাটমি না দুয়ের যোগ। মানুষের মস্তিষ্কের গঠনের একটা বিজ্ঞানসম্মত রূপ, কার্যকারিতা থাকলেও এর শক্তির সীমারেখা মনে হয় কোন অ্যানাটমির নিয়মের ধার ধারে না, আর তাই দেখেই আদিম-কাল থেকেই মানুষের যত কল্পনার উদ্ভব। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে বা তৃতীয় নয়নের উন্মোচন হলে যে কী অঘটন ঘটতে পারে, কী আশ্চর্যজনক অনুভূতি জেগে ওঠে তা বলে বোঝানো যায় না, এদিকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কে দেয়! অগত্যা এমত পরিস্থিতিতে বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ পথ। সঙ্গের ছবিটি দেহের আনুমানিক ছ'টি চক্রের অধিষ্ঠান আর তাদের পরস্পরের সংযোগ-বিবরণ বোঝায়। এই ছয় চক্রের একটু বিশদ পরিচয় দিই, বিশ্বাস করা না করা ব্যক্তিগত বিবেচনা।

   


এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে মানুষের শরীরের সুষুম্না নাড়ির মধ্যে পদ্মের আকৃতির ৬টি চক্র আছে।ষট্‌চক্র গুপ্ত ও রহস্যজনক, বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, অলৌকিক এবং অতীন্দ্রিয়, যদিও বর্ণনায় শরীরভিত্তিক হিসাবে বর্ণিত। সংক্ষেপে এগুলো হল-
১। 'মূলাধার চক্র', প্রথম চক্র, মানুষের মূলশক্তি বা 'কুণ্ডলিনী শক্তি'-র আধার ! এর অবস্থান সুষুম্নার অধোমুখে, গুহ্যের অধোদেশে! মূলাধার চক্র দেখতে নাকি রক্তবর্ণ। ওখানকার পদ্ম চতুর্দল অর্থাৎ চারটি পাপড়িবিশিষ্ট! 
২। 'স্বাধিস্থান চক্র',   দ্বিতীয় চক্র। লিঙ্গমূলে অবস্থিত। সিঁদুরে লাল রং, যাকে বলে অরুণ ঊষা বর্ণ। যড়্‌দল অর্থাৎ পদ্মের পাপড়ি ছয়টি।
৩। 'মণিপূরক চক্র' অবস্থিত। সুনীল বা গাঢ় নীল বর্ণ। এর পদ্মের পাপড়ি দশটি।
৪। 'অনাহত চক্র'। এটি অবস্থিত ! পদ্মের কলি অর্থাৎ পদ্মের কুঁড়ির মতো লাল রং। পাপড়ি বারোটি মানে দ্বাদশ দল যুক্ত।
৫। 'বিশুদ্ধ চক্র' কৃষ্ণলোহিত বা কালচে লাল বর্ণ। পদ্মের ষোড়শ দলের সজ্জা অর্থাৎ পাপড়ি ষোলটি।৬। 'আজ্ঞা চক্র'। ষষ্ঠ ও শেষ চক্র। দুই ভ্রু-র মধ্যে অবস্থিত। চন্দ্রসদৃশ শুভ্র বর্ণের। পদ্ম দ্বিদল, পাপড়ি মাত্র দুটি।
তান্ত্রিক যোগী সাধনার মাধ্যমে ঐ যট্‌চক্রের ছয়টি চক্রকে ভেদ করে নিজের মূলাধারের কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগিয়ে তুলে  মস্তিষ্কের শীর্ষের সহস্রারপদ্মে শক্তিরূপে গমন করেন। সহস্রার শিরোমধ্যে আছে সহস্রদল পদ্ম। ওখানে পরম শিবের পবিত্র অধিস্থান! তান্ত্রিক যোগী সেখানে শিবের সাথে মিলিত হয়ে সহস্রার-ক্ষরিত অমৃতধারা পান করে অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন। সেটাই নাকি সাধনার সিদ্ধিলাভ। প্রয়োজনে তান্ত্রিক যোগী আবার ষট্‌চক্র ভেদ করেন ! আবার করেন। আবার করেন.....
তান্ত্রিক যোগী অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! যোগী অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! পরমানন্দ উপভোগ করেন!



(৮)
এতদূর পর্যন্ত ঠিক ছিল। ভাবছিলাম এর পরের পর্ব আর লিখব কিনা, কারণ তারপরেই শুরু হল এক পরস্পরবিরোধী সংলাপ আর কিছু রহস্যমোচন।

সেদিন মধ্যাহ্নভোজনের পরের পর্বে ভারতের আধ্যাত্মিক, যোগসাধনা আর ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে খানিক চর্চা হচ্ছিল। স্বামীজির উদ্দেশ্য ছিল উপস্থিত সবাইকে গুরুমাঈয়ের কৃপালাভের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে অনুপ্রেরিত করা। এখানে আমি একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে ফেললাম- গুরুর কৃপায় আমার কী লাভ হবে? উত্তর পেলাম- ঈশ্বরকে পাবার পথ প্রশস্ত হবে। এইবার একটু হোঁচট খেলাম। আমি নাহয় চল্লিশের কোঠায় আছি, যাদবজি ষাটের কাছাকাছি হবেন। আমরা তবু ভগবদ্‌প্রাপ্তির সাধনা শুরু করতে পারি। কিন্তু এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষের বয়সই ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, নিউজিল্যান্ড থেকে আগত এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি আর দু-একজন তরুণ ছাত্রও আছেন তাদের মধ্যে। তারা হঠাৎ এই কাঁচা বয়সে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সাধনায় মত্ত হয়ে উঠলেন কেন? আমি সেকথা শ্রীমহেশানন্দকে জানালাম। বললাম, আমি তো ঈশ্বরকে পাবার আশায় এখানে আসিনি।
- তাহলে কী জন্যে এসেছেন?
- কেন, সে তো প্রোগ্রামের নামেই রয়েছে- 'হৃদয়-তীর্থে ফিরে তাকানো', আমার ধারণা ছিল ধ্যান আর যোগের মাধ্যমে আত্মিক আর আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটানো ছিল এর উদ্দেশ্য।
- তা তো বটেই। তবে প্রকৃত উদ্দেশ্য তো নির্বাণ আর মোক্ষেরই সাধনার হাতেখড়ি! 

বুঝলাম, এঁদের ভাষণ আমাদের অর্থাৎ ভারতীয় হিন্দুদের তেমন কোন কাজেই আসবে না। পাশ্চাত্য উন্নত দেশগুলোতে কর্মব্যস্ত মানুষের কিছুটা শান্তি চাই, কাজ থেকে চাই সাময়িক মুক্তি আর তার চেয়েও বড় কথা অজস্র ডলারের আর ইউরোর বোঝা থেকেও খানিকটা মুক্তি, যে কাজটা আমাদের স্বামীজিরা ভালই বোঝেন। স্বামী বিবেকানন্দও বুঝেছিলেন, তবে তিনি সেটা স্বীকারও করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন রচনাতেই পরিস্ফুট হয়েছে যে পরাধীন দরিদ্র ভারতবর্ষের দুঃখমোচন করতে দরকার সুসংবদ্ধ আর সংহতিপূর্ণ, সুনিয়ন্ত্রিত, নিঃস্বার্থ সেবামূলক কাজের, আর তার জন্যে প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। আমেরিকা-ইউরোপ দেশের মানুষের অর্থ আছে, তারা ভারতের আত্মার সন্ধান পেতে চায়, সেবার ভাবনা তাদের মধ্যেও সংক্রমিত করা যায়, বিভিন্ন বক্তৃতা আর রচনার মাধ্যমে তিনি তাই করেছেন, মূলতঃ তারই ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম সংঘ। তখন হিন্দুত্ব নামক বস্তুটির ধারণা ছিল না বিশ্বের দরবারে, ভারতের ছবি দারিদ্র, সাপুড়ে, কুসংস্কার আর কালা-জাদুর দেশ হিসেবে দেখানো হত পাশ্চাত্য দুনিয়ায়। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ তুলে ধরলেন সনাতন ধর্মের উচ্চ আদর্শকে যা সর্বংসহা মনোভাবের বশবর্তী হয়ে হারতে হারতে আত্মবিশ্বাস খুইয়ে বসেছিল, তিনি তাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন এক অনন্য সম্মানের আসনে, পশ্চিম দুনিয়ার মনোযোগ আর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করল অবহেলিত ভারতবর্ষ আর মানহারা, বিশ্বে প্রায় অপরিচিত সনাতন হিন্দুধর্ম। বিবেকানন্দের সাফল্য উৎসাহিত করল, কিছু ক্ষেত্রে লোভও দেখাল অনেক আধ্যাত্মিক সাধু, যোগী আর সেই সঙ্গে বেশ কিছু ভণ্ডকেও। তারপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একে একে গড়ে উঠল স্বামী প্রণবানন্দের ভারত সেবাশ্রম সংঘ, চিন্ময় মিশন, স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর দিব্যজীবন সমাজ, শ্রীভক্তিবেদান্তের কৃষ্ণ-চেতনা সমাজ বা ইস্‌কন ও হাল-আমলের শ্রীশ্রীরবিশংকরের আর্ট-অফ-লিভিং ফাউন্ডেশন। এঁরা মানুষের উপকার করেননি তা নয়, তবে সংঘমূলক দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এঁদের কর্ণধাররা হয়েছেন অগাধ সম্পত্তির অধিকারি, গা ভাসিয়েছেন চরম বিলাসিতায়, অনেকে রীতিমতো বদনামও কুড়িয়েছেন দেশে বিদেশে। যাক, যে পর্যন্ত মানুষ স্বেচ্ছার অর্থ, সম্পত্তি বা শ্রমদান করেন কার কী বলার থাকতে পারে? তবে কিছু ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ভারতের প্রাচীন নির্লোভ আর অনাড়ম্বর জীবনযাপনের ঐতিহ্যের অবনমন হচ্ছে বই কি, তথাকথিত ধার্মিক নেতারা নানা বিতর্ক আর দুর্নামে জড়িয়ে পড়ে এ দেশের কষ্টার্জিত সম্মানহানিরও কারণ হয়েছেন মাঝে মধ্যেই- সে বিতর্ক নাহয় এখন থাক। আমি সামান্য মানুষ, বেশি কিছু বলার ক্ষমতা, বুদ্ধি বা সাহস কোনটাই আমার নেই, যুক্তি দিয়ে ঘটনাপ্রবাহ বোঝার চেষ্টা করি, আর কেউ ভয় দেখালে বা জোরাল গলায় (হোক সে অন্যায়) ধমক দিলে বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকি।

যাকগে সে সব কথা, আমরা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজের কী দরকার? তিনদিনের অনুষ্ঠান কিন্তু সত্যি খুবই উপভোগ করেছিলাম। আশ্রমের পরিবেশ, সাধারণ মানের জীবনযাত্রা আর অসাধারণ উচ্চমানের আধ্যাত্মিক আলোচনা- তুলনাহীন এই দুইয়ের সন্তুলন। আমার কাজে লাগুক বা না লাগুক, প্রাচীন ভারতের গুরুকুল-সংস্কৃতির কিছুটা হলেও আভাস পেলাম এই ক'দিনে, তার স্মৃতি নিয়েই চতুর্থ দিনে বাড়ি ফিরলাম।

(শেষ)

Friday, November 1, 2019

বিহার-বেঙ্গল সন্তরণ চ্যালেঞ্জ!! গল্প

বিহার-বেঙ্গল সন্তরণ চ্যালেঞ্জ!!গল্প

হাইস্কুলে পড়ার সময় সাঁতারটা মোটামুটি শেখার পর জল দেখলেই হাত-পা গুলো কেমন যেন উসখুস করত। ভাবতাম, যারা সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যায় বা ভয়ে মরে তারা নিতান্তই বোকা। আমার পাড়ার বন্ধুরাও এ ব্যাপারে কেউ কম যেত না কিন্তু আমার মত আত্মবিশ্বাস বোধহয় কারো ছিল না।
একবার মার্চ মাসে আমরা দামোদরের ধারে পিকনিকে গেছি। এপারে আমাদের দিকটা বিহারে, ওপারটা বেঙ্গল। জল তখন অতটা ঠাণ্ডা নেই। অগত্যা আমাদের বন্ধুদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে সাঁতার কাটার জন্যে। তার মধ্যে তোতা বলে উঠল, বিহার থেকে বেঙ্গল গিয়ে ফিরে আসতে হবে, যে পারবে সে আজকের হিরো! এতটা কারো সাহস ছিল না, যদিও এটা সেই বিদ্যাসাগরের আমলের মেদিনীপুরের দামোদর নয়। তবু আমি কি ভেবে হাত তুলে দিলাম। অরে এই তো এতটুকু! লেকের জলে তো আমরা প্রতিদিন এর চেয়ে বেশি দূরত্বে দু-তিনবার এপার ওপর করি। তখন মরা নদী, স্রোতও তেমন ছিল না। 'তোদের সাহস হোক না হোক, আমি ঠিক পারব, দেখে নে।' সবাই হই হই করতেই আমি জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
এদিকে আমি সাঁতার শুরু করতেই হয়েছে কি, ডিভিসির তেনুঘাট না কোথাকার যেন কোন ড্যামের জল ছেড়ে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি নদীর মাঝখানে স্রোত বেড়ে গেছে, আমি কিন্তু অবলীলায় দু মিনিটের মধ্যেই মাঝনদীতে এসে পড়েছি। তারপর আর এগোতে পারি না, দম ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু মান-সম্মানের প্রশ্ন, হেরে গেলে চলবে না। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ দেখি তীরের কাছে এসে পড়েছি। 'এই তো একটু, আরেকটু হলেই -', কারা যেন উৎসাহ দিচ্ছে। আমি উত্তেজনার বশে খেয়াল করিনি কখন হাঁটু জলে এসে পড়েছি। ঠাহর হতেই হাসতে হাসতে তীরে। এবার একটু দম নিয়ে ওপারে ফিরতে হবে।
হঠাৎ কারা যেন সাবাস সাবাস বলে উঠল। গলাগুলো খুব চেনা ঠেকল। ও মা, দেখি বন্ধুরা আমার আগেই সবাই এ পারে এসে গেছে। কি করে এল? ও হরি! আমি তো যে বিহারে ছিলাম সেই বিহারেই আছি! এতক্ষন তবে কি করলাম?
'এটা কেমন করে হলো?' আমি হতাশ হয় জিজ্ঞেস করলাম। 'এই জন্যেই বলি, বিজ্ঞানের বইগুলো শুধু মুখস্থ না করে তার মানেগুলো বোঝার চেষ্টা কর,' সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ করা বাবলুদা হেসে বলল। আমি তবুও বুঝি না। 'ওরে গাধা, বার্নৌলির থিওরেম মনে কর। যখন ড্যামে জল ছাড়ে মাঝনদীতে জলের গতিবেগ বেড়ে যায় আর তার ফলে চাপ যায় কমে। ফলে তুই খুব সহজেই মাঝ নদীতে চলে গেলি, কিন্তু সেই একই কারণে পার হতে পারলি না।'
'তাহলে আমি ফিরে এলাম কি করে, বাবলুদা?'
'বুঝতে পারিস নি কখন ঘুরে গেছিস। আর খেয়াল করেছিস বোধহয় যে এ পাড়ে একটা ভেতরের দিকে বেন্ড আছে। তার ফলে এ প্রান্তে জলের বেগ বেশি, চাপ কম। যাক, এর বেশি বুঝতে চাস না, তাহলে আমার জ্ঞানে কুলোবে না।'
কি জানি বাবলুদা কতটা ঠিক বলেছিল, কোন ফিজিক্সের বইয়ে এরকম উদাহরণ জন্মে দেখিনি। তবে এ ও সত্যি যে, এরপর আর কোনোদিন আমি সাঁতরে নদী পারাপার করার সাহস দেখাই নি।