দীপু মানে সুদীপ্ত সরখেলের মত ভাল আর বন্ধুবৎসল মানুষ এই শহরের বাড়িতে বাড়িতে পাঁচ সেলের টর্চ জ্বেলে খুঁজলেও দুটি পাওয়া যাবে না। সে আবার এত মিষ্টি-স্বভাবের যে অত্যন্ত প্রাণের বন্ধুকে পর্যন্ত গালাগাল দিতে পারে না। তবু কিন্তু বন্ধুমহলের আড্ডায় তার খাতিরটা রয়ে গেছে কেবলমাত্র বাবার মিষ্টির দোকান আছে বলে। মানে দীপু বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়ায় না , বাপের চোখ এড়িয়ে সে কাজটি করার সাধ্যি তার নেই, তবে হাতে কাঁচা টাকা আসে কিনা! তাই চা-সিগারেটের খরচটা কিম্বা মাঝে মাঝে চপ-সিঙাড়া খাওয়ানো- প্রতিষ্ঠা বাঁচাতে এই যথেষ্ট। ইতিহাস-সাইকোলোজি-পল সায়েন্স নিয়ে বি-এ পাশ করলে যে চাকরি পাবে না এ বাজারে তা প্রায় জানাই ছিল, আর তাই সে আর এমনতর চেষ্টাও করেনি। বাপের দোকান সার্কুলার সুইটস্এ মাঝে-সাঝে বসতে হয় না তা নয়, তবে সে দিনগুলো হয় দোকানের পক্ষে দুর্দিন, কারণ বন্ধুদের আড্ডা সেদিন সেখানেই বসে কিনা!
সার্কুলার সুইটস নামটা কিন্তু শহরের গোলচত্বর মানে সার্কুলার পার্কের মুখে দোকানটা বলে নয়, সরখেল মশায় এফিডেবিট করে নামের বানানটা করিয়ে নিয়েছিলেন Circle, সেই থেকে সার্কুলার। অবশ্য নামে কিছু যায় আসে না, স্থান-মাহাত্ম্যের গুণে আর মিষ্টির কোয়ালিটির ফলে দোকান এমনিই গড়গড়িয়ে চলত, এক্ষেত্রে দীপু চেষ্টা করেও কিছু ক্ষতি করতে পারত না। কিন্তু তবু কী যেন এক তুচ্ছ কারণে একদিন এক খদ্দেরের সঙ্গে ওর মার-মার ঝগড়া লেগে গেল। খদ্দেরটি বিহারি, একেবারে চ্যাংড়া মাল, 'তেরি মা কী...' বলে এমন গালাগাল শুরু করল, আর থামেই না। এরা আবার নিজের চেয়েও বড়রকমের গালি না শুনলে মুখ বন্ধই করে না আর দীপুর ছোটবেলার থেকে কী যে স্বভাব, 'শালা' কথাটাও বেরোয় না মুখ থেকে। মুখ নিশপিশ করছে বেশ স্মার্টলি একটা জব্বর গালি ঝাড়তে, অগত্যা মনের জোর এনে বলেই ফেলল- 'শালা শুওরের বাচ্চা'! কিন্তু কী অদ্ভুত, নিজের কানকে বিশ্বাস হল না দীপুর, আসলে ওর মুখ থেকে অটোমেটিক ফিল্টার হয়ে যে শব্দটা বেরোল, সেটা 'ব্যাটা বরাহ-নন্দন!'
ঠিক সেই সময় দোকানে ঢুকছিল ন্যাড়া-চৈতন্য, মানে দীপুর দুই বন্ধু নরহরি আর চেতন, একেবারে হরিহর-আত্মা দু'জন। ওরা দীপুর মুখে বরাহনন্দন শুনে হেসে উঠল হো-হো করে। কিন্তু সেই বিহারি চ্যাংড়া লোকটি না জানি কী ভেবে চুপ করে গেল, বাকি পয়সা দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।
- ওরে দীপু আজ গাল দিয়েছে রে, বরাহনন্দন! উটোও আবার গাল- ন্যাড়া তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল।
- বড়া-লন্দনটা কী রে? গালাগাল না তোদের দোকানের নতুন মিঠাইয়ের নাম? - চেতন হাসতে লাগল।
দীপু চুপ করেই আছে। ও তখনও ভেবে চলেছে শুওরের বাচ্চাটা হঠাৎ করে অত সাধু হয়ে গেল কীভাবে! ওটা কি সত্যিই গালি? বরাহ কথাটা ওর মাথায় এল কোত্থেকে? কিছুক্ষণ পরে মোটু, মানে গদাই আর বিশু অর্থাৎ বিশ্বম্ভর এল। দোকানের মিস্লেনিয়াস অ্যাকাউন্টে সবাইকে চা খাওয়ানো হল বটে, তবে সেদিন আর আড্ডাটা তেমন জমল না। আজ নিতাইদাকে দোকান বন্ধ করে দিতে বলে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল দীপু।
বাসায় ফেরার পথেই ওর মাথায় এল হিন্দুধর্মের ইতিহাসে পড়া দশাবতার-কল্পনা, মৎস্য-কুর্ম-বরাহ। মাছ-কচ্ছপ-শূওর! আরে শূওর তো বিষ্ণুর অবতার রে! অবতারের বাচ্চা তাহলে গালি কেন হবে? বাড়িতে গীতগোবিন্দের অনুবাদ ছিল। বের করে পড়ল-
পরদিন সকাল সকাল মোটু গদাই আর বিশু এসে হাজির। ''কী রে, কাল কী হয়েছিল দোকানে? মোটু শুধোল। 'কোন ব্যাটা বিহারি হুজ্জোত করেছে, চিনিস হারামিটাকে- একবার দেখে নিতাম!'
- ছেড়ে দে মোটু, খদ্দেরের কথায় চটলে বিজনেস করা যায়না। তার চেয়ে বড় কথা আমিও রাগের মাথায় ওকে গালাগাল করেছি।
- দূর শালা, বরাহলন্দন যদি গালি হয় তাহলে ঘোড়ার ডিম মানে সার্কুলার সুইটসের রাজভোগ!- বিশু বলে। 'মাইরি, শুওরের বাচ্চা বলে যা আনন্দ, মেজাজ তর হয়ে যায়, সেখানে কিনা বরাহ-লন্দন!'
- আচ্ছা বিশু, বলতে পারিস, শুওর বলাটা গালি কেন? নোংরা বলে? ব্যাপারটা জানতে হচ্ছে- দীপু বলে।
তবে এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হল না দীপু, সেইদিন থেকেই ও শুওরের সম্বন্ধে রীতিমত পড়াশুনা শুরু করে দিল। এই ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছিল সাহিত্যিক অনীশ দেবের লেখা একটা রম্যরচনা আর অজস্র পুরাণ-কোরান। বন্ধুরা আড্ডায় দেখা পায়না, দীপুর বাবা সুজিতবাবু চিন্তাগ্রস্ত, ছেলে দোকান যেতে চায় না, আড্ডাও কমিয়ে দিয়েছে, এই কাঁচা বয়সে বই মুখে নিয়ে কী সব আবোলতাবোল লিখে চলেছে!
-কী বলছেন কাকু, আবোলতাবোল মানে? কী লিখছে আমাদের বিশু? সেদিন দোকানে গিয়ে দীপুর খোঁজ নিতেই সরখেলমশাই যে খবর জানালেন তার জবাবে পালটা প্রশ্ন বিশুর।
- আর বোলো না! দেখি 'আবোলতাবোল' নামে একটা বই খোলা টেবিলের উপর, তার উপরে চোখ রেখে দীপু লিখে চলেছে- 'সুকুমার রায় তিনটি শুয়োরকে টুপি পরা অবস্থায় না দেখে অবাক হয়েছিলেন, তাহলে কি শুওরের পক্ষে টুপি পরে থাকাটাই স্বাভাবিক? শুয়োর কেন টুপি পরে, কে তাদেরকে টুপি পরায়?' কী পাগলের কাণ্ড বল দেখি!
- ওকে এখন পাচ্ছো কোথায়? মূর্তিমান সকাল সকাল হুগলি চলে গেছে ওখানকার শুয়োরদের স্টাডি করতে।
(৩)
সেদিন সন্ধেয় ক্লাবের আড্ডায় আসা মাত্র দীপুকে পাকড়াও করেছে ওর বন্ধুরা। 'কী রে, হুগলিতে কী দেখলি? শুওরগুলো টুপি পরেছিল?'
- না রে, শুওর যে টুপি পরে না সেটুকু বোঝার বুদ্ধি আমারও আছে। আমি গেছিলাম চন্দননগর, ওখানকার অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের লাইব্রেরিতে শুওর সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনো করতে।
এখন আর দীপুর বন্ধুরা ওর কোন কথায় অবাক হয় না। ওরা শুধু শুনে যায় সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী।
- বুঝলি, সুকুমার রায় সম্বন্ধে যদ্দুর জানি, লোকটা বিনা কারণে একটা লাইনও লেখেন নি। সবই নিছক মজা মনে হয়, কিন্তু সবকিছুর আড়ালে হয় আছে শিক্ষামূলক কিছু, নয় ব্যঙ্গ। এখানে তিনটে শুওর কি নিছক মজা? কিন্তু ওখানেই এক বুড়ো সিরিয়াসলি নিল কথাটা। বলল, সে সব অনেক পুরনো ঘটনা, চলে যাও চন্দননগর, বলে এক ফরাসি বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের নাম বলল আমাকে।
- অ্যালিয়াস ডি-ফ্রাঁসের ওল্ড লাইব্রেরিয়ান দেখলাম সুকুমার রায়ের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন। তবে টুপি পরা শুয়োর বলতে তিনি যে শুয়োরকেই মীন করেননি সে সম্বন্ধে তিনি একপ্রকার নিশ্চিত। মানুষের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, পার্শী প্রায় সবাই টুপি পরত সেকালে। তবে হিন্দুদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত লোকেরা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আর চাষিরা ক্ষেতে-খামারে আর মুসলমানরা জুম্মার নামাজেই সাধারণতঃ টুপি পরতেন। মাথায় চব্বিশ-ঘন্টা টুপি লাগিয়ে রাখতেন ইউরোপীয়রা মানে ইংরেজ আর ফরাসি সায়েবরা। এই টুপিধারিদের ক্লাসটাকে উদ্দেশ্য করেই হয়েছিল ছোটনাগপুরের সাঁওতাল বিদ্রোহ, বিরসা তাঁদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছিলেন- 'টোপি টোপি এক হ্যায়, সবাই আমাদের শত্রু'।
'তাহলে কি তিনজন ফরাসি সায়েবকে টুপিহীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে মজা করে সুকুমার ওই ছড়াটা লিখেছেন বলে আপনার মনে হয় মসিঁয়ে?' আমি জিগ্যেস করলাম।
- উনি বললেন সেটা হতেও পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে সুকুমার ফরাসিদের কোন অসম্মান করেননি বা তাঁদেরকে শুয়োর বলে মনে করেননি। জানতো, ইউরোপীয়দের মধ্যে শুয়োরকে টুপি পরানোর চলও আছে। তবে শুয়োরকে পশ্চিমে নাকি দুরকমভাবে দেখে, বাচ্চা শুয়োর বা পিগি হল একটা আদরের জিনিস, ছোটদের খেলার সামগ্রী, আর বয়স্ক শুয়োর বা হগ একটা নোংরা জন্তু, যার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানুষের পেটে যাওয়া। তাই ইংরেজিতে বলা হয়- 'বাচ্চাগুলোকে খাওয়াও, বুড়োগুলোকে কেটে খাও'- কী অদ্ভুত উলটো-পালটা ভাবনা না?
- উরিব্বাস, তুই তো একদম রিসাচ-পেপার নামিয়ে দিয়েছিস রে বরালন্দনের উপরে, চেতন বলে। তা হুগলিতে শুয়ার দেখলি না একটাও?
- দ্যাখ, ঠাট্টা করবি না একদম। বললে বিশ্বাস করবি না, এন্তার শুয়োর দেখলাম, ওরা বিষ্ণুর অবতার কিনা জানিনা, তবে কাছ থেকে দেখতে কিন্তু একদম মানুষের মতন।
দীপুর বন্ধুরা এ কথার আর জবাব কী দেবে? ওরা চারজনেই হাসতে লাগল, নাঃ ব্যাটার মাথায় শুয়োরই ভর করেছে, যেন সাক্ষাৎ বরাহ-অবতার।
'আমার জামা তোমার গায়ে হবে? তোমার সাইজ কত?'
'বুক ছাব্বিশ, পেট ছাব্বিশ, কোমর ছাব্বিশ'- সাইড থেকে দীপু ফোড়ন কাটল।
সুভাষমামার নির্ঘাৎ হ-য-ব-র-ল পড়া ছিল না। তাই ও একটু অবাক হয়ে তাকাল দীপুর দিকে। তবে ন্যাড়া সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা-টিনেমা দেখে। ও লালমোহন গাঙ্গুলির মত বলে উঠল- 'অ্যাই, আমার মামা কি শুয়োর?'
' শালুক চেনে গোপালঠাকুর, শুয়োর চেনে কচু!' মনে মনেই আপাততঃ একটা গাল দিল দীপু, 'শালা সব শুয়োরের বাচ্চাকে কি চেহারায় চেনা যায়? চিনতে হয় তার আচার-আচরণে!' মুখে কিছু বলল না, কে জানে কবে ব্যাটা এম-এল-এ, মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে যায়, ব্যবসা করে খেতে হয়, এগুলোকে চটালে চলবে না।
কিছুক্ষণ বক্তৃতা শোনার পর যখন দেখল গরীবের জন্যে চোখের জলে বাবার ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা ভাসাচ্ছে সুভাষমামা, ন্যাড়া অস্ফুটে বলল- 'হারামি কোথাকার! কুমিরের কান্না দেখাচ্ছে। সন্ধেয় বাড়ি ফিরেই তো মালের বোতল নিয়ে বসবে।'
-'আরেকটা বরাহ-নন্দন!' দীপু বলে। 'হ্যাঁরে, জিগ্যেস করে আসি, মাইকটা ধরে আছে- ও'দুটো ওর হাত না সামনের পা?' শুনে ন্যাড়া-চৈতন্য এমন জোরে হাসল যে আসেপাশের লোকজন চমকে তাকাল ওর দিকে।
কিন্তু এটা তো কোন সমস্যার সমাধান নয়। শুয়োরের আরো কী গল্প শোনাবে বলছিলেন স্বামীজি। আজ মোটকা গদাই নেই, বিশু কোথায় যেন গেছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, তাই ন্যাড়া-চৈতন্য যাবে সাথে ঠিক হল।
- 'ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা অযোধ্যার হরিশ্চন্দ্রের নাম শুনেছ তোমরা? রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। একবার একটা গোলমালে ফেঁসে গিয়ে সারা পৃথিবী বিশ্বামিত্র মুনিকে দান করে দিলেন। এখন আর থাকারও জায়গা রইল না, শেষে কাশীধামে গিয়ে থাকতে হয় তাঁকে। সে জায়গাটা নাকি শিবের ত্রিশূলের উপর দাঁড়িয়ে, তাই বিশ্বচরাচরের বাইরে। দানের পর দক্ষিণা চান ঋষি। তখন আর রাজার কাছে কিছুই নেই, বাধ্য হয়ে বউ শৈব্যা আর ছেলে রোহিদাসকে বিক্রি করে কিছুটা চুকান তিনি। বাকিটার জন্যে হরিশ্চন্দ্রকে নিজেকে বেচে দিতে হয় এক হাড়ির কাছে।'
- 'দানের পরে আবার দক্ষিণা! এ আবার কী রে বাবা?'
- 'সেটা সেকালের নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণকে দানের ক্ষেত্রে। মহাভারতে আছে 'বিপ্রেভ্য প্রযচ্ছ কনকং বহু', মানে ব্রাহ্মণকে সোনা দাও দক্ষিণায়। তবে বিশ্বামিত্র কিন্তু জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় ছিলেন, আমি হলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসতাম। যাক্গে, রাজা একটু ভালমানুষ ছিলেন। হাড়ির চাকরিতে ওঁর কাজ ছিল ঘাটে মড়া পোড়ানোর টাকা আদায় করা আর হাড়ির শুয়োরদের দেখাশুনা করা। মানুষরা রাজাকে যতই কষ্ট দেক, শুয়োরদের কিন্তু সহানুভূতি ছিল। রাজা মানুষ, মলমূত্র সাফ করতে পারবে না, তাই ওরা কথা দিল রাজার সুবিধার জন্যে ওরা এসব কাজ বাইরে করে খোঁয়াড়ে ফিরবে। শুওরদের কথার দাম দেখ, আজ পর্যন্ত তারা তাই করে থাকে যতক্ষণ পারে।'
- 'তারপর?' ওদের তিনজনেরই মুখ হাঁ এরকম অদ্ভুত উপাখ্যান শুনে।
- 'তারপর জানা গেল ওই হাড়ি স্বয়ং ধর্মরাজ ছিলেন। শেষে বহু পরীক্ষার পরে হরিশ্চন্দ্রের শাপমুক্তি ঘটল, ফিরে পেলেন রাজ্য, বউ, ছেলে- তবে সে অন্য গল্প।
- 'স্বামীজি, এসব আমাদের পুরাণে আছে?'
- 'হ্যাঁ গো, রামায়ণে তো আছেই, মহাভারতের শুরুতে বৈশম্পায়ন রাজা জন্মেজয়কেও এ কাহিনী শুনিয়েছিলেন। আরো দু-একটা পুরাণেও আছে, একটু রকমফের করে। কেন, এ-দেশের প্রথম নির্বাক ফিচার-ফিল্মও তো হয়েছিল ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকের পরিচালনায়, শোননি তোমরা?'
- 'হঁ হঁ, দিশা হছ্যে, এইত সে বছর কত উৎসব হল চলচ্চিত্রের শতবার্ষিকীতে'- চেতনের মনে পড়ল।
(৬)
এই নিয়ে আজ বেশ কয়েকদিন হল দীপু বেশ চুপচাপ আছে, বরাহ-নন্দন নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। ভাবা গেছিল যে ওর পাগলামি বোধহয় চিরকালের জন্যে ঘুচল এতদিনে। মাঝে বরাহ-পুরাণ বলে একটা বই পড়ছিল সে, স্বামীজির রেফারেন্সে আশ্রমের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে। সত্যযুগে বিষ্ণু ভগবান নাকি বিশাল এক শুয়োর-রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যাক্ষ নামের কোন এক দৈত্যকে মেরে তার কব্জা থেকে সাগর-তলে ডুবিয়ে রাখা পৃথিবীটাকে দাঁত দিয়ে উদ্ধার করে তুলে এনেছিলেন, তার চমকপ্রদ কাহিনী শোনাচ্ছিল একদিন ওই বই পড়ে। বন্ধুদের বয়স হয়েছে, আর রূপকথার গল্প শোনবার আগ্রহ বা উৎসাহ কোনটাই নেই। তাই দীপু একটু মনমরা ছিল ক'দিন। কাল রাঁচিতে ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখে এসে একটু ভুলেছে সে দুঃখ।
আজকাল আর সময় কাটছে না দীপুর। বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে কোন ঝামেলা নেই, দোকানেও কিছুটা বেশি সময় থেকে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে ও। কিন্তু একা অলস হয়ে থাকলেই বিপদ, চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ছোট্ট শুঁড় আর আড়াই-প্যাঁচের লেজ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে কোন বরাহনন্দন, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করে চলেছে। তাকিয়ে দেখে, যাঃ ব্বাবা, সামনে টিভিতে ক্রিকেট শেষ হয়ে পুরনো দিনের টেনিস খেলা দেখাচ্ছে, খেলা চলছে দুই লিজেন্ড প্রতিদ্বন্দ্বী স্টেফি গ্রাফ আর মোনিকা সেলেসের মধ্যে, আর প্রতিটা বল মেরে মোনিকা কেমন শুয়োরের মত ঘোঁত-ঘোঁত করে চলেছে। আচ্ছা এই জন্যেই কি কে নাকি ছুরি মেরেছিল মোনিকা সেলেসকে? না না, সে নাকি স্টেফির ভক্ত ছিল, কী জানি, আসল গল্পটা কী। সময় কাটাতে ফেসবুক খুলে দেখে বাঙ্গালোর থেকে সোহমদা ক্রিশ্চিনা রসেটির একটা মজার কবিতা অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন, দীপুকে আবার ট্যাগও করেছেন জানিনা কেন। তবে কি দীপুর এই বরাহ-সাধনার কথা সবাই জেনে গেছে? কবিতাটা আবার পড়ল দীপু, বেশ মজা পেল-
"শুয়োর যদি টুপি পরেই আসে
কী আর বলি, বলো?
ভদ্র মেনেই শুধাই,
'কেমন আছেন, ভালো?'
ধান্দায় সে খসায় যদি লেজ,
কী বা করার আছে?
নতুন করে লেজ লাগাতে
পাঠাই মুচির কাছে।"
বাঃ, ভারি মজার তো! দীপুর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য, লক্ষ লক্ষ শুয়োর লেজ খসিয়ে, টুপি পরে ভদ্রসমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তাদের বরাহনন্দন বলে চিনতে পারছে না, একমাত্র দীপুর চোখেই ওদের ছদ্মবেশ ধরা পড়ছে। যাক, মনটা হাল্কা হওয়ায় সেদিনের মত ঘুমিয়ে পড়ল দীপু।
পরদিন ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ বেলা করে। এমনিতেও সকালটা কিছু করার থাকে না, সকালে বাবাও দোকান যান বেলা দশটার পরে, নিতাইদাই সামলায় ততক্ষণ। ঘুম ভেঙেই শুনছে একটা অপরিচিত গলা- 'সুদীপ্ত আছে?'
- 'সুদীপ্ত?' বাবার অবাক প্রশ্ন কানে আসে। যেন নামটা এই প্রথম শুনছেন।
- 'ও গো, দীপুকে খুঁজছেন ভদ্রলোক', ঘরের ভেতর থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, সুদীপ্ত যে দীপুরই ভাল নাম তা ওর নিজেরই মনে থাকে না প্রায়ই, বাবার কাছে তো আশাই করা যায় না। তাড়াতাড়ি ব্রাশটা সেরে বাইরের ঘরে ছুটল দীপু। দাঁড়িয়ে আছে ওর স্কুলের এককালের ফার্স্ট বয় তাপস।
(৭)
- 'আয় তাপস, বোস', দীপু বাসায় এনে বসায় তাপসকে, 'আসলে বাবার শুধু কেন, আমার নিজেরই অনেকসময় নিজের ভাল নামটা খেয়াল থাকে না।'
তাপসের মেডিক্যালের ফাইনাল ইয়ার, কলকাতায় পড়ে। ও ছুটিতে এসে অন্য বন্ধুদের কাছে কানাঘুষোয় শুনেছিল দীপু শুয়োর নিয়ে খুব চিন্তা-ভাবনা করছে। স্কুলে পড়ার সময় দীপুর এধরণের কোন বদখেয়ালের কথা জানত না ও, শুধু জানত তার গালি না দেওয়ার অভ্যেসটা। কিছুটা মজার খেয়ালেই তাই শুয়োরের ব্যাপারটা জানতে এসেছিল সে।
- 'তারপর দীপু, শুয়োরের ব্যাপারখানা কী রে? তুই নাকি হুগলি-চন্দননগর ছুটে বেড়াচ্ছিস গবেষণা করতে!'
- 'আরে ধুর, গবেষণা নয়। আমি আসলে অনেক মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখতে পাচ্ছি আজকাল, এখন তাদেরকে বরাহ-অবতার বলে প্রণাম করি না বরাহনন্দন বলে গালাগাল দিই তা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।'
- 'আরে তুই তো জেনেটিক্সের পণ্ডিত হয়ে গেছিস রে! খুব পড়াশোনা করছিস, না?' এবার অবশ্য তাপসের গলায় ঠিক ঠাট্টার সুর নয়।
- 'কই না তো! এই তুই কি ইয়ার্কি মারছিস আমার সঙ্গে? দ্যাখ আমি তোদের মত পড়াশুনায় ভাল ছিলাম না তেমন, তাই বলে ঠাট্টা করবি?'
- 'দূর কী যে বলিস! ওসব ভাল-খারাপ স্কুলেই চলে, পরে ওসব কোন কাজে লাগে না, সেখানে কিছুটা ভাগ্য, কিছুটা বুদ্ধি আর বাকিটা উদ্যম আর পুরুষকারের হিসেব চলে। তবে আমি সিরিয়াসলি বলছি, শুয়োরের সঙ্গে মানুষের কিন্তু জেনেটিক্যালি অনেক মিল আছে।'
- 'কিরকম শুনি?'
- 'দ্যাখ খুব সাংঘাতিক রকমের মিল হয়ত নেই, মানে যতটা বাঁদরের সঙ্গে আছে। ইন ফ্যাক্ট, জেনেটিক্যালি শুয়োর থেকে বেশি মিল আমাদের ইঁদুরজাতি বা রোডেন্টের সঙ্গে আছে। শুয়োর বা সোয়াইন জাতি আর মানুষ-বাঁদর মানে প্রাইমেট জাতির এক পূর্বপুরুষ ছিল প্রায় আট কোটি বছর আগে। মানুষ আর শুয়োরের জেনেটিক ম্যাপিং-এ জাঙ্ক ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এই ক্লু পাওয়া গেছে। তারপর এদের দুজনেরই সাইটোপ্লাজমের মধ্যে কমন 7SL RNA পাওয়া গেছে।'
- 'উরিব্বাবা, কিছুই তো বুঝলাম না। তার মানে কী মানুষ আর শুয়োরের জিন সমান?'
- 'না, তা নয়। তবে অন্ততঃ ৮০% মিল আছে। যেমন দুজনের DNAতে protein coding sequence একরকম। কিন্তু জিন-গবেষক মোরানের মতে ৮০% হোক বা ৯৮%, মানুষ বা বানরজাতির মধ্যে gal-transferase নামে একটা জিন কাজ করে যা অন্য কোন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে দেয় না, মানে অ্যান্টিজেনের কাজ করে।- 'তার মানে বলছিস মানুষ কখনও শূয়োরে পরিণত হবে না?'
- 'স্বভাবে আচারে-আচরণে হবে। অনেক মিলই তো আছে। যেমন ধর শরীরে চুল বা মেদের বাড়াবাড়ি, চর্বি জমার আর কীট-বীজানু আকর্ষণের ঝোঁক আর নোংরা ঘাঁটার প্রবৃত্তিতে খুব মিল, বিশেষ করে ওই শেষেরটা। আর কী চাই?' হাসল তাপস।
তাপস চলে যাওয়ার পরে এই ব্যাপারটা নিয়েই খানিকক্ষণ ধরে ভাবল দীপু। তারপর স্নানে যাবার আগে দেখে ওর ভাগ্নি মিনি একটা ছবিওলা ইংরেজি বই পড়ছে, বইটার মলাটের উপর লেখা 'Alice's Adventures In Wonderland'।
৮)
স্নান সেরে এসে দীপু দেখে অ্যালিসের বইটা ছিৎরে পড়ে আছে, মিনি ধারেকাছে নেই। বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে একজায়গায় এসে ওর চোখ আটকে গেল। একটা স্কেচ। একটা বাচ্চা মেয়ে একটা শুয়োরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আছে, তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত।
এখানেও শুয়োর! কিছুটা পড়ে দেখল দীপু। এক ডাচেস কোলের বাচ্চাটা মরিচগুঁড়োর চোটে একটানা হাঁচছে দেখে তাকে ছুঁড়ে লুফছে আর গাইছে, বাংলায় ঠিক এরকম হয় গানটা-
'খোকায় আমার বেদম ধাঁতাই, দাবড়ানি দিই বিষম রাগে,
হাঁচলে পরে দমদমিয়ে পেটাই জোরে;
কারণ, জানি এমনিতে তার মরিচগুঁড়ো ভালই লাগে-
ইচ্ছে করেই মিচকে ব্যাটা অমন করে।'
এই বলে বাচ্চাটাকে অ্যালিসের কোলে ছুঁড়ে দিলেন ডাচেস। নিয়ে সাজগোজ করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হঠাৎ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ শুনে অ্যালিস চমকে তাকিয়া দেখে, ওমা! বাচ্চাটা তো আর মানুষ নেই, কখন শুয়োর হয়ে গেছে। তখন ও তাকে আস্তে আস্তে মাটিতে নামিয়ে দিল, বাচ্চাটা চার পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
এটুকু পড়েই বইটা মুড়ে রাখল দীপু। ননসেন্স গল্প, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন একটা মেসেজ আছে- মনে হল ওর। আরে, সুকুমার রায়ও তো ওই ননসেন্স ধারারই কবি, লুই ক্যারলের মত। তাহলে কি টুপিপরা তিনটে শুয়োরও অর্থবহ? মহা চিন্তায় পড়ে গেল দীপু।
আজকে বন্ধুদের আড্ডাতে অন্যমনস্ক ছিল দীপু। ন্যাড়া ভুবনেশ্বরের নন্দনকাননে সিংহ দেখে এসেছে গত বছর, অথচ মোটু গদাই তার আগের বছর গিরের জঙ্গলে গিয়ে দেখতে পায় নি কেন তাই নিয়ে বিস্তর তর্ক হচ্ছিল। ওরা দীপুকে সালিশ মানল। ও অনায়াসে বলতে পারত গির থেকে কয়েকটা সিংহ এনে নন্দনকাননে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে খোলা চিড়িয়াখানার মত। কিন্তু তা না করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুজনকে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বলল- 'আর তর্ক নয়, কিছুক্ষণ চুপ করে সিগারেট টান।' চার বন্ধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
তাপস বলছিল 'রাইনোসেরাস' বা গণ্ডার নামে এক বিখ্যাত রূপকধর্মী নাটকের কথা। ফেরার পথে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকল দীপু, ইউজিন আয়নেস্কোর লেখা বইয়ের ইংরেজি এডিশনটা পেয়ে গেল সেখানে। আজ রাত্রে পড়ে দেখতে হবে।
৯)
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। দীপু সকালে সার্কুলার সুইটসের দিকে রওনা হয়েছে, কানে এল পাড়ার দুই মহিলার অন্তরঙ্গ কথোপকথনের অংশ।
- 'সুমিত্রাদির জামাইকে দেখেছ মালাদি, কি হ্যান্ডসাম চেহারা না!'
- 'হ্যান্ডসাম হবে না! ওদের তো লাভ-ম্যারেজ। তাও যদি আমার জামাইয়ের ধারেকাছে আসতো।'
- 'ঠিক বলেছ দিদি, তবে তোমার টুকুর বরও তো ডিভোর্সি। আগের বউটাকে যা পেটাতো, আমার বাপের বাড়ির শহরেরই তো মেয়ে!
- 'যাও যাও সুদেষ্ণা, তোমরা হলে বিশ্ব-নিন্দুকে, কারো ভাল দেখতে পার না। আমরা অমন নই। বিশ্বাসের বউটার কাছে ওই পাঞ্জাবি ছোকরাটা লুকিয়ে আসত, আমি ঘরে আলো নিভিয়ে সব দেখেছি, কিন্তু বল, আজ পর্যন্ত কাউকে কি বলেছি?'
দীপু সভয়ে লক্ষ্য করল, মালাদি আর সুদেষ্ণার নাকগুলো কেমন গোল আর লম্বাটে হয়ে উঠেছে আর পেছন দিকে শাড়ির ভেতরটা কেমন যেন সন্দেহজনকভাবে ফুলে আছে। ও সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল। ওদের দোকানে সামনের দিকে কয়েকটা টেবিল আর বেঞ্চ পাতা থাকে, কিছু খদ্দের ওখানে বসেই চা-মিষ্টি-জলখাবার খান। একজন ট্রেড ইউনিয়ানের মাথা, এক উঠতি পলিটিসিয়ান আর তাদেরই কিছু চামচে বসে সিঙাড়া আর চা খাচ্ছিল। কারখানা বন্ধ করতে হবে কয়েকদিন পরে, পার্টি অনেক টাকা খেয়েছে এক নামী শিল্পপতির কাছ থেকে তারই প্ল্যানিং চলছিল বোধ হয়। দীপুর মাথায় বিশেষ কিছু ঢুকছিল না, তবে ওর যেন হঠাৎ মনে হল লোকগুলোর নাক-মুখ কেমন যেন গোল মতন, নাক-সহ ঠোঁট দুখান এগিয়ে এসেছে, আর বুক-পেট-কোমর সব সমান সাইজ হয়ে গেছে। কাপড়ের তলায় কি লেজ গজিয়েছিল একটা করে, ঠিক বোঝা গেল না। নেতাটির তো মুখের দু-পাশে দুখানা দাঁতও দেখা যাচ্ছে- দীপু সভয়ে চোখ সরিয়ে নিল সেদিক থেকে। আর তাদের কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, শুধু ঘোঁত-ঘোঁতানি ছাড়া। বাবা এলেন কিছুক্ষণ পরে। ও ভয়ের চোটে বাবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলই না, কী জানি তাঁর নাকটাও যদি ওরকম বেরিয়ে এসে থাকে। কোনমতে দোকানের বাইরে পালিয়ে এসে বন্ধুদের আড্ডায় ঢুকল দীপু।
আরে! প্রভাত না? হ্যাঁ, ওদের ছোটবেলার বন্ধু প্রভাতই তো, কমরেড প্রভাত। কাঁধে ঝোলা খদ্দরের ব্যাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়ার সময়ই পাক্কা কম্যুনিস্ট বনে গিয়েছিল প্রভাত। দীপুকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে ও ঠাট্টা করে বলল- 'কী রে, ভূত দেখেছিস নাকি? ওভাবে ছুটছিস যে!'
- 'ভূত নয় রে, শুয়োর', দীপু বলে, সব ব্যাটা শুয়োর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার বরাহ-নন্দন!' এই বলে আজ সকাল থেকে যা যা দেখেছে সব বলল দীপু।
- 'হুম! এটা মনে হচ্ছে নতুন রোগ, নাম দেওয়া যেতে পারে সোয়াইনাইটিস! ঠিক আয়নেস্কোর রাইনোসেরাইটিসের মতই একটা রোগ বাসা বাঁধছে সমাজের শরীরে। নাকি মেটামরফোসিস শুরু হল? একটু ভাবতে হবে এ নিয়ে।'
প্রভাত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিভিন্ন ভাষার বামমনস্ক ছবিগুলো প্রায় কোনটাই ছাড়ে না। সুতরাং দীপুর এই পাগলামিতে সায় দেবার অধিকার তার যথেষ্টই আছে। তবে অন্য বন্ধুরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বিশু খুব একটা বিতর্কে যায় না। তবে চৈতন্য মানে চেতন ছাড়ার পাত্র নয়।
- 'লে হালুয়া! একা হনুমানই লঙ্কা জ্বালাতে যথেষ্ট ছিল, এবার সুগ্রীব জুটল একটা।'
- 'কেন বে! একা মার্ক্সে রক্ষা নেই এঙ্গেলস দোসর- কথাটা মাথায় এল না তোদের, আমার ব্যাপারে ওই বুর্জোয়া রামায়ণ-মহাভারতকে টানবিনা বলে দিচ্ছি',- প্রবল আপত্তি জানায় প্রভাত। 'আমি একদম কিছু বানিয়ে বলছিনা। ইন ফ্যাক্ট, আয়নেস্কোর অনেক আগে মানুষ আর জন্তুজানোয়ারের একাত্মীকরণের কথা ভেবেছিলেন কাফকা। পৌরাণিক গাথা, ঠাকুরমার ঝুলির বুদ্ধু-ভুতুম বা অ্যান্ডারসনের ব্যাঙ রাজপুত্র জাতীয় শিশুপাঠ্য রূপকথাগুলো বাদ দিলে মানুষ থেকে পোকামাকড়ে ম্যুটেশন নিয়ে গল্প লেখেন তিনি, ১৯১২ সালে প্রকাশ হয় কাফকার ছোটগল্প
Die Verwandlung, ১৯১৫তে যার ইংরেজি অনুবাদ হয় Metamorphosis নামে। একটা মানুষের এক বিশাল পোকায় রূপান্তরিত হওয়া নিয়ে এই গল্প সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে, নাটক আর সিনেমাতেও খুব সফল হয় গল্পটা। বুঝলি, আজ আমার একদম সময় নেই, একটা পার্টি মিটিংএ যেতেই হবে এক্ষুনি। তবে দীপুর ব্যাপারটা আজকের মিটিং-এ তুলব, আর কাল ঠিক এই সময় এই নিয়ে কিছু আলোচনা করব। এখন একটা সিগারেট দে তো দীপু, বকে বকে গলাটা শুকিয়ে গেল।'
সিগারেট টানতে টানতে বেরিয়ে গেল প্রভাত। ওরাও আড্ডায় ভঙ্গ দিয়ে যে যার বাসায় ফিরে গেল। তবে মেটামরফোসিস নিয়ে একটা নতুন চিন্তা আজ ঢুকে গেল দীপুর মনে। বাম চিন্তাধারায় ওর কোনকালেই বিশ্বাস নেই, তবে কি ওর মনেরও মেটামরফোসিস হচ্ছে ধীরে ধীরে?
(১০)
বাড়ি ফিরছে দীপু, সঙ্গে ন্যাড়া-চৈতন্য। রাস্তার দু-পাশে বরাহ-নন্দনদের মিছিল, ঘোঁত-ঘোঁত শব্দে মুখরিত চারদিক- দীপু ছাড়া অবশ্যই আর কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না।
- 'এই ন্যাড়া, ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে দেখেছিস, কতবড় দাঁত? আচ্ছা সবকটা শুয়োর মিলে আরেকটা শুয়োরকে পেটাচ্ছে কেন বল তো? ও, ব্যাটা টুপি পরেছে বলে!'
ওরা গিয়ে দাঁড়াল মারপিটের ভীড়ের মাঝে। কিছুই নয়, টুপিপরা শুওরটাকে এরা চেপে ধরেছে- 'বল ব্যাটা, বরাহ-অবতারের জয়, বল শুয়ারিস্থান জিন্দাবাদ'। আর সেও তেমনই ঢিট, কিছুতেই বলবে না! আরে, তুইও তো শুয়োরিস্থানেই আছিস, বলেই ফেল না বাপ!
- 'এই দীপু, কলকাতায় একটা বরাহনগর আছে, জানিস ওখানকার হাল কী?' চেতন শুধোয় ওকে। স্পষ্ট শয়তানী।
- 'ওরে, এ শুয়োর সে শুয়োর নয়। এ তো প্রভুর বরাহ-লীলা! শুনলি ওরা কী বলাবলি করছে? পুরুলিয়ার বরাভূমে পঞ্চাশ একর জমি নেওয়া হয়েছে, বরাহ-অবতারের মন্দির হবে।'
- 'ওরে উটো তো বলরামপুরের কাছে বটে। আমাদের গাঁয়ের থিকে সাত মাইল। আমাদের জমিন গুলার দাম বাড়বেক মাইরি!' ন্যাড়া বেশ খুশি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কই, ন্যাড়ার মুখটাতো বদলায় নি? না কি নাকটা একটু মোটা আর লম্বাটে লাগছে? নাঃ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
আপাততঃ সবাই বাসায় ফিরে এল। কিন্তু সেখানে এসেও কি নিস্তার আছে? টিভি চালাতেই একটা নিউজ চ্যানেলে চোখ আটকে গেল দীপুর। তাই তো, বরাভূম নিয়েই আলোচনা হচ্ছে সংসদে। পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়ই বটে! সবকটা লম্বাটে নাক আর দুপাশে দাঁত নিয়ে ঘোঁত-ঘোঁত করে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে যেটুকু বোঝা গেল যে বাংলার সাংসদরা জিদ ধরে বসে আছে যে বরাভূমেই বরাহ দেবতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। একজন নির্দলীয় তার মধ্যে বলে বসেছে 'কেন, বরানগর নয় কেন?' তাকে একজন লাল টুপিওলা শুয়োর থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, 'অ্যাই চুপ করুন তো! আপনি আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন না! জানেন না, আমাদের স্ট্যান্ড মন্দিরেরই বিরুদ্ধে। হলে কোথাও চিন বা ভিয়েৎনামের প্যাগোডা হবে, হ্যাঁ।' শুয়োরটা জানে না, উন্নত প্রযুক্তির মাইক সব কথাই ক্যাচ করছে। এমন সময় এক হোমরা-চোমরা সাংসদ ঘোঁত-ঘোঁত করে তেড়ে এসে বলতে লাগলেন-
- 'মিত্রোঁ, আমাদের ফাজিল বন্ধু (ফাজিল মানে যে জ্ঞানী সেটা দীপু সদ্য জেনেছে একটা হিন্দি সিনেমা দেখে। ও মনে মনে স্বীকার করল হিন্দি সিনেমা দেখলে ভাষাজ্ঞান বাড়ে, আজকাল বাংলা সিরিয়ালগুলো বুঝতে সুবিধে হয়) ভুলে যাচ্ছেন যে সৎ-যুগে ধরতী সমুন্দর মেঁ ডুবে গেছিল, বরাহ-ভগবান তাকে অপনা দাঁত দিয়ে উদ্ধার করেন। তো মিত্রোঁ, বরাহভূমে সমুন্দর কোথায়, বোলো বোলো!'
- 'আরে সমুন্দর নেই তো কী আছে? তাই বলে বরাহ-মন্দির আমরা গুজরাটে হতে দেব না! বাঙলার প্রতি চিরকালীন এই বঞ্চনার শেষ চাই! দরকার পড়লে মরগুমা কিম্বা খয়রাবেড়া ড্যামের পাশে আমরা মন্দির করব। পুরুলিয়ায় এয়ারপোর্ট হবে।'
উঃ, অসহ্য! টিভি বন্ধ করে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে নিল দীপু।
(১১)
- 'কিরে, তোদের মিটিং-এ শুয়োরের কথাটা বলেছিলি?' পরদিন সকাল এগারোটায় সার্কুলার পার্কের বেঞ্চে বসে কথাটা শুধোল দীপু। আজ প্রভাত ওর কথা রেখেছে, ঠিক সময়ে এসেছে আড্ডায়। ছুটির দিন নয় বলে বিশু ছাড়া আর কেউ নেই ওদের সাথে। ওর আর কোন চাকরি হচ্ছে না, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে একটার পর একটা।
- 'হ্যাঁরে, বেশ সিরিয়াস আলোচনা হল এ নিয়ে।' প্রভাত মনে হয় এই কথাগুলো বলার জন্যেই আজ ওর মূল্যবান সময় নষ্ট করে এখানে এসেছে। '
- 'কী ব্যাপার বল তো?' বিশু বলে, 'শুয়োর দেখা নিয়ে তোদের পলিটব্যুরো এত সিরিয়াস কেন হঠাৎ? ওরা নিশ্চয় দীপুর মাথার চিকিৎসা করানোর অ্যাডভাইস দিল?'
- 'ঠিক তার উলটো।' 'পলিটব্যুরো' নিয়ে ঠাট্টাটা গায়ে না মেখেই প্রভাত বলে- অন্য দিন হলে খেপে বোম হয়ে যেত, 'ব্যাপারটা হয়ত ইল্যুশন। তবু কেন জানিনা কাফকা আর আয়নেস্কোর সঙ্গে দীপুর অবজারভেশনের মিল খুঁজে পাচ্ছে ওরা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শিল্প-বিপ্লবের অন্তরালে ধীরে ধীরে মানুষের অজ্ঞাতে বেড়ে উঠেছিল যে আত্মকেন্দ্রিকতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে গড়ে ওঠা কর্মজীবনের একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ আর তার থেকে নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণার জন্ম, তারই ফলে একটা মানুষ নিজেকে পোকা ভাবতে শেখে। বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত আধুনিক মানুষেরা জীবনযাপনের দুর্বিষহতায় ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার দেখেও কিছু করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে যে কীটের সাথে তুলনা করে, গল্পে তার বাস্তবায়ন করে দেখানো হয়েছে। এই হতাশা, অবিশ্বাস আর চুড়ান্ত আত্মগ্লানির আবহাওয়া থেকেই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তা হয়ত কাফকাও বোঝেননি, তবু হয়ত এটাই ফ্যাক্ট।'
- 'বাপরে! আর গন্ডারের সঙ্গে শুয়োরের মিলটা?' দীপু শুধোয়। ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ওর মানুষের মধ্যে শুয়োর দেখা নিয়ে লোকে এত চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
- 'রাইনোসেরাসের পটভূমি জানতে গেলে তোদের একটু আয়োনেস্কোর সম্বন্ধে আগে জানতে হবে। রোমানিয়ান বাবা আর ফরাসি মায়ের সন্তান তিনি। সেই মা আবার সেফার্দি অর্থাৎ স্পেন-পর্তুগালের আদি ইহুদি। নাৎসি রাজত্বের উন্মেষের সময় রোমানিয়াতে ইউজিনদের টিকে থাকাটা একপ্রকার সমস্যা হয়ে দেখা যায়, চোখের সামনে চেনা বন্ধুদের ইহুদি-বিদ্বেষী নাৎসি হয়ে যেতে দেখতে থাকেন। ১৯২৮ থেকে শুরু হয়ে ১৯৩৬ এ তা চরম রূপ নেয়, সেই সময়কার স্মৃতির ফসল 'রাইনোসেরাস'- চেনা মানুষের অচেনা রূপে পরিবর্তন। এই সময় উদ্ভব হয় চুড়ান্ত ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর, হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন আর রুজভেল্ট-চার্চিলের মত কূটনীতিজ্ঞের অভ্যুত্থান- তার থেকে জন্ম নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।'
- 'কিন্তু রাইনোসেরাসের রচনাকাল তো ১৯৫৯'- দীপু বলে।
- '১৯৩৬-৩৭এর রোমানিয়ায় বসে একজন হাফ-ইহুদির এই নাটক লিখে কোন লাভ হত না, মাঝখান থেকে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হত। তবে তাতে পরিণতি কিছু বদলাত না। কিন্তু ছয়ের দশকে উনি এমন এক পরিবর্তনের কথা লিখে গেছেন যার চুড়ান্ত পরিণামে হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হয়ত সেই সময়ও তিনি এমনই আরেকটা কিছুর সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে একটা অ্যালার্ম কল করেছেন নাটকটার মধ্য দিয়ে।'
- 'তাহলে বলতে চাস, বরাহ-নন্দনের ব্যাপারটাও এমনই একটা বিপর্যয়ের পূর্বাভাস?' এতক্ষণে বিশুর মাথাটা খোলে।
- 'দেখা যাক। তুই একটু সাবধানে থাকিস দীপু। কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটিতে আবার জড়িয়ে না পড়িস।'
কেটে পড়ল কমরেড প্রভাত চক্রবর্তী।
(১২)
আর সাবধানে থাকা! চতুর্দিকে শুয়োরের দল, নোংরা আবর্জনা, আর ঘোঁতঘোঁতানি। বরাহ-নন্দনেরা ক্রমে দলে ভারি হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি লাগছে, এমনকি অন্য শুওরদেরও তারা ছেড়ে কথা কইছেনা। সাদা-গোলাপি শুয়োর আর কালো শুয়োরের মধ্যে তো চিরকালের দাঁতাদাঁতি (হাতাহাতির বদলে এই শব্দটা মনে মনে ভেবে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করল দীপু) লড়াই। ইদানীং আরো কিছু অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। আগে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে যৌনতা খোলাখুলি ছিল, ধর্ষণ জাতীয় অপরাধের কথা কেউ শোনে নি। আজকাল কিন্তু প্রায়ই কিছু শুয়োরের বাচ্চা মিলে মানব-কন্যাদের রেপ করে পরে দাঁত দিয়ে ফালাফালা করে চিরে ফেলছে বলে শোনা যাচ্ছে। মানুষ অপরাধ করলে শাস্তি হয়, তবে শুয়োরে করলে পুলিশ নাকি কেস নিচ্ছে না। নেবে কেন? ওরাও তো দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
আজকের খবরে প্রকাশ, বরাহ-মন্দিরের কেস মানুষরা হেরে গেছে, এখন বরাহভূমের পাশে অযোধ্যাপাহাড়ের শিখরে বরাহ অবতারের মন্দিরের শিলান্যাস হতে চলেছে। নীচের মরগুমা ড্যাম থেকে জল নিয়ে এসে ভগবানের পায়ে ঢালবেন ভক্তেরা তার জন্যে হাইওয়ে আর রোপওয়ে দুটোই তৈরি হবে। পুরুলিয়া শহর থেকে বলরামপুর, বেগুনকোদর, বাঘমুন্ডি সর্বত্র শুয়োরের রাজত্ব এখন। মানুষদের মধ্যে বেশ কিছু শুয়োরে পরিবর্তিত হয়েছে, আরো হচ্ছে। কি করে হচ্ছে, তার মেকানিজ্ম্ এখনও ঠিক পরিষ্কার নয় সবার কাছে, কিন্তু শুয়োর হতে পারলে আর চিন্তা নেই। যে অবহেলিত জাতির লোকজন এখনও কষ্ট করে মানবজীবনে পড়ে আছে, তারা একমনে বরাহমন্ত্র জপ করে চলেছে দু'বেলা, যদি তাতে মুক্তি হয়, বরাহজীবনে উত্তরণ ঘটে। দীপুর চোখের সামনে ওর বন্ধুরা অনেকে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এইত তাপস এসেছিল, সিলিন্ড্রিক্যাল নাক নিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কত অহংকার করে গেল। বাবা নিজের দোকান থেকে মিষ্টি এনে ওকে খাওয়াল, জানিনা তার ফলেই কিনা, বাবার নাকটাও সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। বিশু ব্যাটার শুয়োর হয়ে যা গুমোর বেড়েছে, পাত্তাই দিতে চায় না একেবারে!
আজ সকালে ঘুম ভেঙে দীপুর কিরকম গায়ে ব্যথা ব্যথা লাগছে। এ কোথায় শুয়ে আছে সে! সবুজ পর্দা, সবুজ চাদর, গায়ে ডোরাকাটা কয়েদিদের মত পোষাক- একি জেলখানা নাকি? বাইরে কিছু চেনা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মনে হচ্ছে, মানুষের গলাই, কই ঘোঁত-ঘোঁতানি নয় তো! এমন সময় মোটা আর বিশু ঘরে ঢোকে।
- 'জ্ঞান ফিরেছে, দীপুর জ্ঞান ফিরেছে!' বিশু খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। আরে, বিশুটা আবার মানুষ হয়ে গেল কখন?
- 'হ্যাঁরে, আমি কোথায়? আর বিশু তুই শুয়োর হয়ে গেছিলি না! আবার কি করে মানুষ হলি?'
- 'কী পাগলের মত বকছিস! শুয়োর আবার কোথায়? তুই হাসপাতালে। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি। তবে চিন্তা নেই, সবকটা শুয়োরের বাচ্চা এখন হাজতে। এখন কাকাবাবুকে একটা খবর দিতে হবে দীপুর জ্ঞান ফিরেছে বলে।'
- 'তাহলে শুয়োরদের সঙ্গে আমার মারপিট হয়েছিল? তবে যে বলছিস আমি পাগলের মত বকছি!'
- 'আরে তোর মনে নেই, ওই বিহারি গুণ্ডাটা যাকে তুই শুয়োরের বাচ্চা, মানে ওই বরাহ-নন্দন না কী যেন বলেছিলি? শালা জীবনে প্রথম গাল দিয়েই উদোম ক্যালানি খেয়ে গেলি'- বলে হাসতে লাগল মোটা গদাই। 'তবে আমরাও ছাড়িনি, খুব উত্তমমধ্যম দিয়েছি হারামিদের। আরে আমরা কি জানি ব্যাটা কারো কাছ থেকে বরাহ-নন্দনের মানে জেনে এসে দলবল নিয়ে পেটাতে আসবে। তুই তখন সন্ধের পর বাড়ি ফিরছিলি, নিতাইদা এসে খবর দিল দীপুবাবুকে চারটে গুন্ডা মিলে পেটাচ্ছে। আমরা ঠিক সময়ে এসে না পড়লে তোকে বাঁচানো যেত না।'
- 'তাহলে ওই যারা শুয়োর হয়ে গেল, তাপস আর প্রভাতের সঙ্গে এত কথা হল!'
- 'কী বলছিস রে!' বিশু বলে, 'তাপস তো ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে ডাক্তারির, ও আসবে কি করে এখন কলকাতা থেকে? আর প্রভাত......' বলে চুপ করে গেল বিশু।
- 'কী হয়েছে প্রভাতের? ও কি শুয়োর হয়ে গেছে নাকি?'
- 'না রে', ইতিমধ্যে ন্যাড়া ঢুকেছে রুমে, ও বলল, 'ওকে আর আমরা দেখতে পাব না। মাওবাদী নক্সালদের দলে ভিড়েছিল, পরশু জঙ্গলমহলে পুলিশের সঙ্গে একটা এনকাউন্টারে মারা গেছে।'
যাক, কুয়াসা কাটল। তিনদিন ধরে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে পড়ে দীপু তাহলে একটা লম্বা স্বপ্ন দেখে গেল। কিন্তু জেনেটিক্স, বরাহ-পুরাণ, কাফকা, আয়োনেস্কো- এতসব সে জানল কি করে? না কি স্বর্গের দোরগোড়া থেকে ফিরে এল বেশ কিছু দিব্যজ্ঞান নিয়ে। সত্যিটা কী তা কে বলবে, ভবিষ্যৎ?
শেষ।।