গণেশপুরী ও সিদ্ধপীঠ আশ্রম।
(১)
তখন আমি ভারতের একটি বিখ্যাত খনিজ তেল কোম্পানীর মুম্বাই শাখায় কর্মরত। হঠাৎ একদিন একটা ট্রেনিংএর অফিস অর্ডার হাতে পেলাম, আমাকে আর আমার অফিসের এক বয়স্ক সহকর্মী যাদবজিকে যেতে হবে তিনদিনের এক যোগা ও মেডিটেশনের কোর্সের জন্যে মুম্বাই থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের গণেশপুরীর গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমে। ব্যাপারটাকে কিভাবে নেব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, এটা শিখে বা অভ্যাস করে কোম্পানীর কী কাজে লাগাতে পারব, নাকি এটা ব্যক্তিগত বিকাশের জন্যে কর্মচারীদের প্রতি কোন সেবামূলক কার্যক্রম। যাকগে, কৌতূহল আর না বাড়িয়ে বিরার লোকাল ট্রেনে ভাসাই স্টেশনে নেমে দেখি যাদবজি আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। গণেশপুরী বা বজ্রেশ্বরী মন্দিরের কিম্বা তনসা হট স্প্রিং-এর বাস নিতে বলা হয়েছিল, ভাগ্যক্রমে গণেশপুরী আশ্রমেরই বাস পেয়ে উঠে পড়লাম দুজনে।
মুম্বাই শহরের উত্তরে থানে জেলায় তনসা নদীর উপত্যকায় গণেশপুরী জল-জঙ্গল-পাহাড় অধ্যুষিত এক মনোরম স্থান, অন্ততঃ একসময় তাই ছিল। তনসার তীরে আছে বেশ কয়েকটি উষ্ণ প্রস্রবণ বা গরম জলের কুণ্ড। এরই পাশে রাস্তার ধারে ভডভালি গ্রামে একটি টিলার মাথায় আছে দেবী বজ্রেশ্বরী যোগিনী মন্দির, খুব সম্ভবতঃ ওই অঞ্চলের ঘনঘন বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে এই দেবীর কল্পনা, অবশ্য এ অঞ্চলের অন্যান্য যোগিনী (যেমন মহাকালী, যোগেশ্বরী বা কানহেরি গুহা) মন্দিরগুলোর মত এর বৌদ্ধ উৎসের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মূল মন্দিরটি নাকি আট কিলোমিটার দূরে গুঁজ গ্রামে ছিল, যেটা পর্তুগিজরা একসময় ধ্বংস করে দেওয়ায় এই বর্তমান মন্দিরটির স্থাপনা হয়।
এখান থেকে বিরারের পথে তিন-চার কিলোমিটার দূরে শুরু হচ্ছে পুণ্যভূমি গণেশপুরী। এসেই পড়েছি যখন এর ইতিহাসও খানিক জেনে নেওয়া যাক। কথিত আছে পুরাকালে এখানে একটি প্রাচীন গণেশমন্দির ছিল যেখানে ঋষি বশিষ্ঠ একসময় এক মহাযজ্ঞ করেছিলেন। ১৯২৩ সালে কালিকট থেকে স্বামী নিত্যানন্দ নামে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এখানে এসে একটি কুটির গড়ে সাধনা শুরু করেন। তাঁর তপোপ্রভাবে আশেপাশের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলি থেকে দর্শনার্থী ভক্তরা তাঁর কাছে আসতে থাকেন। ধীরে ধীরে শিষ্যসংখ্যা বাড়তে থাকে আর তনসা তীরবর্তী তাঁর কুটিরটি আর সংলগ্ন উষ্ণ প্রস্রবণগুলিতে মানুষজনের ভীড় বাড়তে থাকে। বাবা নিত্যানন্দ সব ব্যাপারেই উদাসীন ছিলেন। কিন্তু শিষ্যদের মধ্যে স্বামী মুক্তানন্দ বাবার বাণী প্রচার করার উদ্দেশ্যে গ্রাম-সংলগ্ন হাইওয়ের ধারে প্রচুর জমি যোগাড় করে এক বিশাল আশ্রম খুলে বসেন, যার নাম এখন বিদেশী ভক্তশিষ্যদের কল্যাণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রম নামে। নামেমাত্র একটি লেংটিধারী ভোলা সন্ন্যাসী নিত্যানন্দকে অবশ্য ভুলে যায়নি লোকে, তিনি দেহ রেখেছেন ১৯৬১ সালে। তাঁর কুটির এখন একটি বিখ্যাত মন্দির, যেখানে ট্রাস্টের আয়োজিত স্বল্পমূল্যে বাবার প্রসাদ বড়া-সম্ভর থেকে পূর্ণ ভোজন সবই পাওয়া যায়, যদিও ভীড় বেশি হয় গরম জলের কুণ্ডে পুণ্যস্নানার্থীদের জন্যে।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বাসযাত্রার পরে আমরা গণেশপুরীর সিদ্ধপীঠ আশ্রমে এসে নামলাম।
(২)
গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের অবস্থান গণেশপুরী গ্রামের পথে মোড় ঘুরতেই। মূল আশ্রম আর গাঁওদেবী মন্দির পড়ে বাঁপাশে আর তার উল্টোদিকে ডানপাশে জনসংযোগ ও রেজিস্ট্রেশন অফিস আর অতিথিশালা ও কর্মচারীদের জন্যে কলোনী। গাঁওদেবী মন্দির কী জানেন তো? ইনি কোন গ্রাম বা জনপদের রক্ষাকর্ত্রী ও ইষ্টদেবী, গ্রামে ঢোকার মুখে এঁর মন্দির থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তা গ্রামের মধ্যে বা কোন পাহাড় বা টিলাতেও থাকে। এই গ্রামদেবীর অধিষ্ঠান আর কল্পন একসময় এ দেশের সর্বত্র ছিল, আজ দাক্ষিণাত্য আর উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে এখনও রয়ে গেছে। বস্তুতঃ ধার্মিক কারণ ছাড়াও এই গাঁওদেবীর মন্দিরগুলি তৎকালীন হিন্দু রাজ্যসমূহের গ্রামগুলোতে একপ্রকারের সুরক্ষা বা পুলিশ আউট-পোস্টের কাজও করত।
এই গণেশপুরী গ্রামের গাঁওদেবীর মন্দির সেখানে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিল, স্বামী মুক্তানন্দ সংলগ্ন প্রায় বিশ-ত্রিশ একর জমি নিয়ে আশ্রম তৈরি শুরু করার সময় ওই মন্দিরটির আমূল সংস্কার করে তার উপরেই আশ্রম, যজ্ঞশালা, গুরুদেবের মন্দির, উপাসনা-গৃহ, বিশ্রামালয় ইত্যাদি তৈরি হয়, সংলগ্ন ছবি দেখলেই তা বোঝা যাবে।
আমরা দুজন বাস থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে আশ্রমের মুখোমুখি অফিসে গেলাম। সেখানে আমাদের পরিচয়, কাগজপত্র সব দেখে সাথে-সাথেই ছবি তুলে পরিচয়-পত্র বা আই-কার্ড তৈরি করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তারপর একজন আমাদের সঙ্গে এসে গেস্ট-হাউসে আমাদের একটা দুই-কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিল, না তার কোন চাবি নেই, তার দরকারও হয় না।
সাড়ে পাঁচটা বাজছিল। ছ'টায় নৈশাহারের সময়, আমাদিগকে মেন গেট দিয়ে আশ্রমে যেতে বলা হল। আই-কার্ড গলায় ছিল, সুরক্ষা কর্মী কিছু বলল না। ভেতরে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা ভোজনালয়। সেলফ-সার্ভিস, যাঁদের পণ্ডিচেরি আশ্রম বা ইস্কনের মায়াপুর আশ্রমের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা কিছুটা বুঝবেন। কাউন্টার থেকে খাবার নিয়ে এসে বসলাম, রুটি, ভাত, ডাল, দুটো তরকারি, পাপড়ভাজা, মিষ্টি আর একবাটি দুধ। কোন ঝাল-মশলা নেই, খাঁটি ঘিয়ের একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম শুধু। খুব খিদে পেয়েছিল, তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পর বাসন ধোওয়ার জায়গায় নিজেকেই নামিয়ে দিতে হচ্ছিল, খুব চমৎকার আর সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমাদের সঙ্গে খাচ্ছিলেন বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। পন্ডি আর মুম্বাইয়ের ইস্কন মন্দিরে এঁদেরকে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে চোখ, তাই কিছু অস্বাভাবিক ঠেকল না তেমন। দুজন শ্বেতাঙ্গ সন্ন্যাসী বা যোগীকেও দেখলাম, পরে জেনেছিলাম ওঁরা মঠের 'যোগা অ্যাণ্ড রিট্রিট' শিক্ষক ও অধীক্ষক স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী মহেশানন্দ। আজ বলে নয়, সেই কোন কালে রবীন্দ্রনাথও এরকমই কাউকে দেখে মজা করে লিখেছিলেন-
"টেরিটিবাজারে তাঁর সন্ধান পেনু
গোরা বোষ্টম-বাবা নাম দিল বিনু।"
পরে এই স্বামীজীদের সঙ্গে বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে দেখি উপাসনালয়ে সমবেতকণ্ঠে নামগান আর ভজন হচ্ছে। আমরাও গলা মেলালাম-
"সদ্গুরু জ্যোত সে জ্যোত জাগাও,
মেরা অন্তর তিমির মিটাও।
হে যোগেশ্বর, হে পরমেশ্বর,
হে জ্ঞানেশ্বর, হে সর্বেশ্বর,
নিজ কিরপা বরসাও।।"
মেন দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। স্বামী মুক্তানন্দের সমাধি-মন্দিরের পাশ দিয়ে গাঁওদেবী মন্দিরের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তা পেরিয়ে গেস্ট-হাউসে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি আর যাদবজি। এভাবেই একটা দিন, আশ্রমের প্রথম দিন শেষ হল।
(৩)
পরদিন ঘুম থেকে উঠতে হল ভোর সাড়ে তিনটেয়।
প্রাতঃকৃত্য আর স্নান সেরে সোয়া চারটে নাগাদ এলাম প্রার্থনা সভায়। খোল-করতাল-করতালি-হারমোনিয়ম যোগে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুরু-গীতা, বিভিন্ন স্তোত্র আর নামগান হল। সাড়ে-পাঁচটায় ইনডোর কাফেটারিয়ামে গিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমবেত প্রাতঃভ্রমণে।
সিদ্ধপীঠ আশ্রমের ছবি দেখলে তার লে-আউট কিছুটা বুঝতে পারবেন। মেন-গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে প্রথমেই পড়বে ক্যাফে যেখানে আমরা চা খেলাম। সেটা পেরিয়েই ডানদিকে রান্নাঘর ও ভোজনালয়। তারপর রাস্তা ডানদিকে ঘুরে মুক্তানন্দ স্বামীর সমাধি-মন্দির আর গুরুমাঈয়ের বিশ্রামালয়ের দিকে, তাদেরকে ডানদিকে রেখে বাঁয়ে ঘুরলেই পড়বে যোগাশ্রম, গুরুকুল, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি ইত্যাদি, আরো এগিয়ে গেলে হোমকুণ্ড, হঠযোগাভ্যাস কেন্দ্র, প্রচুর গাছপালা, বাগান ইত্যাদি। ভোজনালয় থেকে সোজা এগিয়ে বাঁদিকে এক বিশাল মাঠ যার চারদিকে আমরা তখন হাঁটছি।
আমরা যেটাকে ভাবছিলাম প্রাতঃভ্রমণ বা মর্নিং-ওয়াক পরে বুঝলাম ঠিক তা নয়। গুরুকুলের এক ছাত্র ছিল আমাদের গাইড। সে বলল এর নাম মন্দির প্রদক্ষিণ। মন্দির? এ তো একটা ফাঁকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ! না, জানা গেল আশ্রম তৈরির খননকার্যের সময় এই মাঠেরই নীচে পাওয়া যায় প্রাচীন এক গণেশ মন্দির, যার নামে ঐ এলাকা ও গ্রামের নাম 'গণেশপুরী'। ভেতরে ক্যামেরা বা ক্যামেরা-যুক্ত মোবাইল আনা নিয়মবিরুদ্ধ, তাই কোন ছবি তোলা যায়নি ওই 'মন্দিরের'। তবে মন্দির-মাঠের চারপাশে দেখলাম প্রচুর ছোট বড় যত্ন করে পালন করা গাছ, প্রতি গাছের তলে একটা প্লেটে লেখা আছে সেই ভক্ত বা ছাত্রের নাম যাঁরা গাছটি দান করেছেন। অনেকে যাঁরা ওখানে এখনও আছেন তাঁরা গাছগুলির নিয়মিত পরিচর্যাও করেন, যদিও সব কিছুই করা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় আর নিয়ম মেনে। পরিক্রমার পর আমরা আনীত হলাম চারদিক খোলা শেডের ক্লাসহলে, শুরু হল পরিচয়পর্ব। গুরু শিবানন্দ আশ্রমের রীতিনীতি-পদ্ধতি, যোগা ও ধ্যানের কোর্স, সময়-সারণী, গুরুকুলের আদর্শ, হিন্দুধর্মের আদর্শ ও ঐতিহ্য, প্রাচীন ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস- সব বিষয়ে একটা ইন্টারেক্টিভ বক্তৃতা দিলেন, তারপর আটটায় ব্রেকফাস্ট, আবার আমরা উপস্থিত হলাম খাবার ঘরে, দুধ-পাঁউরুটি-কলা-মিষ্টি দিয়ে সারা হল প্রাতঃরাশ।
এবার আশ্রমের প্রশাসন আর কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা কর যাক। আগেই বলেছি, গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ভগবান নিত্যানন্দের শিষ্য স্বামী মুক্তানন্দ। ১৯০৮ সালে মাঙ্গালোরের কাছে ধর্মস্থল গ্রামে তাঁর জন্ম। পনের বছর বয়সে গৃহত্যাগ করার পর সাধনার শেষভাগে তিনি বাবা নিত্যানন্দের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁরই শিষ্যত্ব নিয়ে ১৯৫৬তে গণেশপুরীতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ১৯৬১তে নিত্যানন্দের মহাসমাধির পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুসারে তিনি গণেশপুরীর গাঁওদেব মন্দির সংলগ্ন জলা-জঙ্গলের উপর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। দেশবিদেশ থেকে বহু ভক্তসমাগম হতে থাকে, ক্রমে এই যোগাশ্রমের শাখা-প্রশাখা সিদ্ধযোগ ফাউন্ডেশনের নামে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মুক্তানন্দের এক কন্নড় গৃহী ভক্ত পরিবার বোম্বাইয়ে থাকতেন, তাঁরা মাঝে মাঝেই গুরুসন্দর্শনে আসতেন শিশুকন্যাকে নিয়ে। পঞ্চবর্ষীয়া মালতী শেট্টি তখন কী বুঝত কে জানে, চুপ করে মুক্তানন্দের পায়ের কাছে বসে থাকত, তাঁর বাণী-প্রবচন বোঝার চেষ্টা করত। ইনি চৌদ্দ বছর বয়সে আধ্যাত্মিক শিক্ষামন্ত্র 'শক্তিপট'এ দীক্ষিত হন স্বামীজির দ্বারা, পরে কুড়ি বছর বয়স থেকে পাকাপাকিভাবে আশ্রমে এসে বিদেশী শিষ্যদের জন্যে স্বামীজির দোভাষীর কাজে লেগে পড়েন, ইতিমধ্যে যোগ-সাধনায় সিদ্ধিলাভও করেন। স্বামী মুক্তানন্দের ইনি শ্রেষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। ১৯৮২তে মহানির্বানের কয়েকমাস আগে স্বামীজি তাঁকে গুরুমাঈ চিদ্বিলাসানন্দ নাম দিয়ে তাঁকে আর তাঁর ছোট ভাই নিত্যানন্দকে যুগ্মভাবে আশ্রম চালানোর দায়িত্ব দিয়ে যান। অবশ্য কিছু বিতর্কিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে ১৯৮৫তে নিত্যানন্দকে আশ্রম ছেড়ে যেতে হয়, আর তখন থেকেই গুরুমাঈ সিদ্ধপীঠ সমেত সমগ্র সিদ্ধযোগা ফাউন্ডেশনের সর্বেসর্বা।
(৪)
আমার সিদ্ধপীঠ আশ্রমে যে কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার কথা তার নাম 'Retreat to Pilgrimage of Heart', বাংলায় বললে 'হৃদয়তীর্থে একান্তবাস'। রিট্রীট কথাটার অনেক অর্থ হয়, স্বামী শিবানন্দ, ইনি জন্মসূত্রে আমেরিকান, বোঝালেন। আমরা যেমন যেমন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি, বুদ্ধি, দৈহিক শক্তি, জ্ঞান, অর্থ এসব এসে হৃদয়বৃত্তিকে দূরে এককোনে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বে অনেক তীর্থস্থান আছে, অনেক দেবতা, অনেক দুর্গম যাত্রা, কিন্তু সেরা তীর্থ আপন হৃদয়। সে যা দেখায় তাই স্বচ্ছ, নির্মল, যা করায় তাই পুণ্যকর্ম, যা ভাবায় তাই অধ্যাত্মচেতনা। আগামী তিনদিন ধরে আমরা বর্তমান জীবন ভুলে ফিরে যাব হৃদয়ের তীর্থে, উপলব্ধি করার চেষ্টা করব শাশ্বত শুদ্ধাত্মাকে যাঁর বাস প্রতি মানুষের হৃদয়ে বা অন্তঃকরণে। কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করা অনেক বড় যোগসাধনার ব্যাপার। আমরা কর্মব্যস্ত মানুষ, সে সব বুঝি না, পারার প্রশ্নই নেই। কিন্তু দেহের এই ষড়চক্রের মাঝে যে অসীম মানসিক শক্তি লুকিয়ে আছে তার একটুকরো অনুভব- এটুকুও যদি পাওয়া যায়! আরো অনেক বিশাল বড় বড় জ্ঞানের কথা শুনেছিলাম সেদিন, অত বুঝি নি, আর কিছু মনেও নেই। এবার একটু আশ্রমবাসীদের প্রসঙ্গে আসি।
এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ছোট-বড় কাজে রত যাদেরকে দেখছি চারপাশে, তারা কিন্তু একটু অন্যরকম, মানে ঠিক কাজের লোক বা মাইনে করা কর্মচারী বলে মনে হচ্ছিল না। কথিত আছে প্রাচীন ভারতে মণ্ডনমিশ্র নামে এক মহাপণ্ডিত ছিলেন যাঁর বাড়িত দাস-দাসীরাও শাস্ত্র আলোচনা করত, খাঁচার পাখিরাও উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করত। প্রথমে তাই ভেবেছিলাম এঁরাও হয়ত পরিবেশ-সাহচর্যে যোগ ও অধ্যাত্ম-শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠেছে, মানসিক ভাবেও অনেক উন্নতিলাভ করেছে। তবে একজন ভদ্রলোক কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশন করছিলেন, জানালেন তাঁর নাম সমীর পারিখ, মুম্বাইয়ের একজন শিল্পপতি। রিসেপশনে যে ভদ্রমহিলা ছবি তুলে আর ফর্ম ভরিয়ে আমাদের রেজিস্ট্রেশন করালেন তিনি নাকি বাঙ্গালোরের একটি সফটোয়্যার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। বক্তৃতা-হলে যিনি চেয়ার সাজাচ্ছিলেন তিনি আই-আই-টি বোম্বের একজন অধ্যাপক! এঁরা সবাই আশ্রমে সেবাদান করছেন নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে। নিউ জার্সি থেকে আগত এক শ্বেতাঙ্গিনী নিত্যপূজার মালা গাঁথছিলেন, আর আমি তাঁকে দেখে অবাক হলাম না। তবে যা জেনে আশ্চর্য লাগল যে অন্ততঃ বেশ কয়েকমাস আশ্রমে যোগশিক্ষার ছাত্র হিসেবে না থাকলে আর দু-একটা রিট্রীটের কার্যক্রমে যোগদান না করলে সেবারও অধিকার নাকি পাওয়া যায় না। বোঝা গেল এঁরা প্রত্যেকেই হয় গুরুকুলের ছাত্র-ছাত্রী আছেন বা ছিলেন কিংবা স্বামী মুক্তানন্দ ও গুরুমাঈয়ের একান্ত ভক্ত।
পরিচয়পর্বের শেষে শুরু হল আশ্রম পরিক্রমণ। গণেশ মন্দিরের মাঠ আগেই ঘোরা হয়ে গেছে। এবার বাকিটুকু ঘুরে দেখলাম। পরিপাটি করে সাজানো ফুল-ফলের বাগান, মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন সন্ত-তপস্বীর মর্মর মূর্তি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মাধবাচার্য, তুলসী, জ্ঞানেশ্বর, নরসি মেহতা তুকারাম, জলারাম, রামকৃষ্ণ পরমহংস, তৈলঙ্গস্বামী, সুরদাস, মীরাবাঈ, শ্রীচৈতন্য, সাঁইবাবা- কে নেই সেই সভায়। সেখানে ধর্ম-জাতের ভেদ নেই, মুসলমান তাঁতী কবীর বা শুদ্র চর্মকার সন্ত রুইদাসও সসম্মানে বিরাজিত- একেবারে সশিষ্য। পুরাকালের ব্যাস-বাল্মীকি-বিশ্বামিত্র-গৌতম-যাজ্ঞবল্ক-মনুও বাদ যাননি, সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিরাও আছেন। হিন্দুধর্মের দিকপালরা ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুরুরা যেমন নানক, খ্রীস্ট, বুদ্ধ, মহাবীরদের মূর্তিও ছিল, কেবল ইসলাম নবী হজরত নেই, থাকার কথাও নয়- তাঁরা মূর্তিপূজার বিরোধী। সবার সুবিধার জন্য মর্মর ফলকে সকলের নাম-পরিচয়-সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনীও লিপিবদ্ধ করা ছিল প্রতি মূর্তির সাথে। সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে হোমকুণ্ড, হঠযোগের অভ্যাস-স্থল, লাইব্রেরি, ধ্যান বা মেডিটেশন সেন্টার, সব ঘুরে দেখে রীতিমত অভিভূত হলাম।
এই করতে করতে সাড়ে এগারটা। লাঞ্চ-ব্রেক। একই নিয়মে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম সবাই মিলে। এরপর শুরু হবে যোগাভ্যাসের ক্লাস।
(৫)
আমাদের গ্রুপে আমি আর যাদবজীই আশ্রমজীবনে নতুন। বাকি সবাই বহুদিন ধরেই গুরুকুলছাত্র বা স্বামী মুক্তানন্দের বা গুরুমাঈয়ের ভক্ত, বহুদিন ধরে গণেশপুরী বা বিশ্বজুড়ে থাকা বিভিন্ন সিদ্ধযোগের শাখা আশ্রম বা কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ত্রিশজনের গ্রুপে অন্ততঃ অর্ধেকই তো শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। আমরা কর্পোরেট-সূত্রে প্রবেশাধিকার পেয়েছি, সুতরাং যোগাভ্যাস প্রণালী, এর রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। তবু স্বামী মহেশানন্দ যোগের ক্লাস গোড়া থেকেই শুরু করলেন।
যোগ কথার সোজা অর্থ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মাকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া। প্রাণত্যাগ করলে জীবাত্মা আপনি তা পায়, কিন্তু জীবদ্দশায় তার অনুভব পেতে সাধনার প্রয়োজন, এই সাধনার অভ্যাসই যোগ। যোগের চারটি পদ্ধতি, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ আর রাজযোগ। প্রথম তিনটি পদ্ধতি মূলতঃ মানসিক। জ্ঞানযোগ শিক্ষার পথ। সাংখ্য, দর্শন, বেদান্ত ইত্যাদি শাস্ত্রপাঠ করে শ্রবণ, মনন আর নিদিধ্যাসনের মধ্য দিয়ে এই পথে এগিয়ে সিদ্ধিলাভ করা যায়। ভক্তিযোগের মূল হল দাস, সেবক, সখা বা প্রেমীরূপে ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মনিবেদন। পূজা, প্রার্থনা, নামগান ও সংকীর্তন জাতীয় ক্রিয়াই ভক্তিযোগের পদ্ধতি বা প্রকরণ। কর্মযোগের কথা গীতাতে বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে। ঈশ্বর, মানুষ, জীবজন্তু, প্রকৃতির প্রতি নিষ্কাম সেবা আর কর্মই এই সাধনার পদ্ধতি, 'মা ফলেষু কদাচন্'- ফলাফল ভগবানকে সমর্পণ করতে হবে।
এছাড়া ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিকশিত করে আত্মোন্নতির মাধ্যমে পরামার্থপ্রাপ্তির যে সাধনা, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার সময় বিশ্বকে জানান, তার নাম 'রাজযোগ'। অন্য পদ্ধতিগুলিতে মন আর হৃদয় ছিল মুখ্য, দেহের ভূমিকা ছিল গৌণ। রাজযোগে মনের সাথে সাথে দেহকেও যুক্ত করে হয় সাষ্টাঙ্গ-সাধনা, এর ফল হয় অনেক বেশি কার্যকর। এই রিট্রীটে রাজযোগের উপর আমাদের আকর্ষণকে কেন্দ্রিত করার কথা বললেন শ্বেতাঙ্গ স্বামী মহেশানন্দ। তিনি বোঝালেন রাজযোগের আটটি অঙ্গ- ১) যম (অহিংসা, সত্য, আস্তেয়, ব্রহ্মচর্য আর অপরিগ্রহ)- জৈনদর্শনে সম্যকচরিত্রের পাঁচটি মহাব্রতের নাম, বৌদ্ধধর্মে যা পঞ্চশীল ২) নিয়ম বা অনুশীলন- শৌচ (পরিচ্ছন্নতা), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় আর ঈশ্বর প্রণিধান ৩) আসন বা দেহের ভঙ্গিমার দ্বারা বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া আর ৪) প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাস্থ্যকর বিধি- এই দুইয়ে মিলে বলা হয় হঠযোগ ৫) প্রত্যাহার বা বিধিসঙ্গত বিরাম, বিশ্রাম ৬) ধারণ বা মনঃসংযোগ ৭) ধ্যান বা একাগ্রচিত্তে পরমাত্মার প্রতি চিত্ত-নিয়োজন ও ৮) সমাধি অর্থাৎ বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আত্মাকে বহিরঙ্গে পরমাত্মার মধ্যে প্রতিস্থাপন। এটি সাধনার উচ্চতম স্তর।
ধীরে ধীরে ঘরের আলো কমে এল। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের মধ্যে। একটা মৃদু ওঙ্কারধ্বনি সুরে বেজে চলেছে। আমরা সকলে মাটিতে আসন পেতে বসেছিলাম। স্বামীজি বললেন মনঃসংযোগ করে চোখ বন্ধ করতে। এরপরে আদেশ হল ওঙ্কারধ্বনির প্রতি কান রেখে পারিপার্শ্বিক ভুলে একমনে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কোন শক্তির কথা ভাবতে। আমরা আজ্ঞা পালন করলাম। এভাবেই অন্ততঃ মিনিট পনের কেটে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ওঙ্কাররব থেমে আলো আগের মত জ্বলে উঠল। স্বামী মহেশানন্দ বললেন, তোমরা কে কী দেখলে একে একে শেয়ার কর, আমরা শুনি।
একজনের বর্ণনা শেষ হতেই আরেকজন। 'আমি এক জ্যোতিঃসমুদ্রের মাঝে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি। উল্টোদিক থেকে একে একে আসছেন সেই সব মহাপুরুষেরা যাঁদের মূর্তি আশ্রমের বাগানে সাজানো আছে।'
'আমি এই ঘর থেকে নড়িনি। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে স্বামী নিত্যানন্দ ধ্যানস্থ হয়ে আছেন আর স্বামী মুক্তানন্দ তাঁর পদসেবা করছেন।'
এবার আমার পালা। 'আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঘরের পরিবেশটা এত মায়াময় হয়ে উঠেছিল, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।' আমার কথায় সবাই হেসে উঠলেন। মহেশানন্দ কিন্তু হাসলেন না। তিনি বললেন-'সেটাই স্বাভাবিক। প্রথম প্রথম ধ্যানে বসে ঘুম আসাটাই নর্ম্যাল। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইয়োর অনেস্টি, মাই ফ্রেন্ড!' আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
'যাক, ধ্যানের একটা ফীল তোমরা পেলে', স্বামীজি বললেন। 'টী ব্রেকের পর লাইব্রেরিতে কিছুক্ষণ বসতে পার। তারপর আমরা যাব স্বামী নিত্যানন্দের সমাধি-মন্দির দর্শনে। ফিরে এসে ডিনার করে আজকের প্রোগ্রামের সমাপ্তি। কালকের দিনটির সম্বন্ধে একটি বিশেষ সূচনা। আগামীকাল এই রিট্রীটের সব ছাত্রের জন্য আছে মৌনব্রত। ক্লাসরুমের মধ্যে প্রয়োজনে কো-অর্ডিনেটার বা লেকচারারের সঙ্গে ছাড়া পারতপক্ষে কেউ কথা বলবে না সারা দিন।'
'আশ্রমের পথে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে?'
২। 'স্বাধিস্থান চক্র', দ্বিতীয় চক্র। লিঙ্গমূলে অবস্থিত। সিঁদুরে লাল রং, যাকে বলে অরুণ ঊষা বর্ণ। যড়্দল অর্থাৎ পদ্মের পাপড়ি ছয়টি।
৩। 'মণিপূরক চক্র' অবস্থিত। সুনীল বা গাঢ় নীল বর্ণ। এর পদ্মের পাপড়ি দশটি।
৪। 'অনাহত চক্র'। এটি অবস্থিত ! পদ্মের কলি অর্থাৎ পদ্মের কুঁড়ির মতো লাল রং। পাপড়ি বারোটি মানে দ্বাদশ দল যুক্ত।
৫। 'বিশুদ্ধ চক্র' কৃষ্ণলোহিত বা কালচে লাল বর্ণ। পদ্মের ষোড়শ দলের সজ্জা অর্থাৎ পাপড়ি ষোলটি।৬। 'আজ্ঞা চক্র'। ষষ্ঠ ও শেষ চক্র। দুই ভ্রু-র মধ্যে অবস্থিত। চন্দ্রসদৃশ শুভ্র বর্ণের। পদ্ম দ্বিদল, পাপড়ি মাত্র দুটি।
(২)
গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের অবস্থান গণেশপুরী গ্রামের পথে মোড় ঘুরতেই। মূল আশ্রম আর গাঁওদেবী মন্দির পড়ে বাঁপাশে আর তার উল্টোদিকে ডানপাশে জনসংযোগ ও রেজিস্ট্রেশন অফিস আর অতিথিশালা ও কর্মচারীদের জন্যে কলোনী। গাঁওদেবী মন্দির কী জানেন তো? ইনি কোন গ্রাম বা জনপদের রক্ষাকর্ত্রী ও ইষ্টদেবী, গ্রামে ঢোকার মুখে এঁর মন্দির থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তা গ্রামের মধ্যে বা কোন পাহাড় বা টিলাতেও থাকে। এই গ্রামদেবীর অধিষ্ঠান আর কল্পন একসময় এ দেশের সর্বত্র ছিল, আজ দাক্ষিণাত্য আর উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশে এখনও রয়ে গেছে। বস্তুতঃ ধার্মিক কারণ ছাড়াও এই গাঁওদেবীর মন্দিরগুলি তৎকালীন হিন্দু রাজ্যসমূহের গ্রামগুলোতে একপ্রকারের সুরক্ষা বা পুলিশ আউট-পোস্টের কাজও করত।
এই গণেশপুরী গ্রামের গাঁওদেবীর মন্দির সেখানে ভগ্নপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিল, স্বামী মুক্তানন্দ সংলগ্ন প্রায় বিশ-ত্রিশ একর জমি নিয়ে আশ্রম তৈরি শুরু করার সময় ওই মন্দিরটির আমূল সংস্কার করে তার উপরেই আশ্রম, যজ্ঞশালা, গুরুদেবের মন্দির, উপাসনা-গৃহ, বিশ্রামালয় ইত্যাদি তৈরি হয়, সংলগ্ন ছবি দেখলেই তা বোঝা যাবে।
আমরা দুজন বাস থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে আশ্রমের মুখোমুখি অফিসে গেলাম। সেখানে আমাদের পরিচয়, কাগজপত্র সব দেখে সাথে-সাথেই ছবি তুলে পরিচয়-পত্র বা আই-কার্ড তৈরি করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তারপর একজন আমাদের সঙ্গে এসে গেস্ট-হাউসে আমাদের একটা দুই-কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে দিল, না তার কোন চাবি নেই, তার দরকারও হয় না।
সাড়ে পাঁচটা বাজছিল। ছ'টায় নৈশাহারের সময়, আমাদিগকে মেন গেট দিয়ে আশ্রমে যেতে বলা হল। আই-কার্ড গলায় ছিল, সুরক্ষা কর্মী কিছু বলল না। ভেতরে সারি সারি চেয়ার-টেবিল পাতা ভোজনালয়। সেলফ-সার্ভিস, যাঁদের পণ্ডিচেরি আশ্রম বা ইস্কনের মায়াপুর আশ্রমের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা কিছুটা বুঝবেন। কাউন্টার থেকে খাবার নিয়ে এসে বসলাম, রুটি, ভাত, ডাল, দুটো তরকারি, পাপড়ভাজা, মিষ্টি আর একবাটি দুধ। কোন ঝাল-মশলা নেই, খাঁটি ঘিয়ের একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম শুধু। খুব খিদে পেয়েছিল, তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার পর বাসন ধোওয়ার জায়গায় নিজেকেই নামিয়ে দিতে হচ্ছিল, খুব চমৎকার আর সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। আমাদের সঙ্গে খাচ্ছিলেন বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। পন্ডি আর মুম্বাইয়ের ইস্কন মন্দিরে এঁদেরকে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে চোখ, তাই কিছু অস্বাভাবিক ঠেকল না তেমন। দুজন শ্বেতাঙ্গ সন্ন্যাসী বা যোগীকেও দেখলাম, পরে জেনেছিলাম ওঁরা মঠের 'যোগা অ্যাণ্ড রিট্রিট' শিক্ষক ও অধীক্ষক স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী মহেশানন্দ। আজ বলে নয়, সেই কোন কালে রবীন্দ্রনাথও এরকমই কাউকে দেখে মজা করে লিখেছিলেন-
"টেরিটিবাজারে তাঁর সন্ধান পেনু
গোরা বোষ্টম-বাবা নাম দিল বিনু।"
পরে এই স্বামীজীদের সঙ্গে বেশ ভাল আলাপ হয়েছিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে দেখি উপাসনালয়ে সমবেতকণ্ঠে নামগান আর ভজন হচ্ছে। আমরাও গলা মেলালাম-
"সদ্গুরু জ্যোত সে জ্যোত জাগাও,
মেরা অন্তর তিমির মিটাও।
হে যোগেশ্বর, হে পরমেশ্বর,
হে জ্ঞানেশ্বর, হে সর্বেশ্বর,
নিজ কিরপা বরসাও।।"
মেন দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। স্বামী মুক্তানন্দের সমাধি-মন্দিরের পাশ দিয়ে গাঁওদেবী মন্দিরের ভেতর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তা পেরিয়ে গেস্ট-হাউসে এসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি আর যাদবজি। এভাবেই একটা দিন, আশ্রমের প্রথম দিন শেষ হল।
(৩)
পরদিন ঘুম থেকে উঠতে হল ভোর সাড়ে তিনটেয়।
প্রাতঃকৃত্য আর স্নান সেরে সোয়া চারটে নাগাদ এলাম প্রার্থনা সভায়। খোল-করতাল-করতালি-হারমোনিয়ম যোগে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুরু-গীতা, বিভিন্ন স্তোত্র আর নামগান হল। সাড়ে-পাঁচটায় ইনডোর কাফেটারিয়ামে গিয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমবেত প্রাতঃভ্রমণে।
সিদ্ধপীঠ আশ্রমের ছবি দেখলে তার লে-আউট কিছুটা বুঝতে পারবেন। মেন-গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে প্রথমেই পড়বে ক্যাফে যেখানে আমরা চা খেলাম। সেটা পেরিয়েই ডানদিকে রান্নাঘর ও ভোজনালয়। তারপর রাস্তা ডানদিকে ঘুরে মুক্তানন্দ স্বামীর সমাধি-মন্দির আর গুরুমাঈয়ের বিশ্রামালয়ের দিকে, তাদেরকে ডানদিকে রেখে বাঁয়ে ঘুরলেই পড়বে যোগাশ্রম, গুরুকুল, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি ইত্যাদি, আরো এগিয়ে গেলে হোমকুণ্ড, হঠযোগাভ্যাস কেন্দ্র, প্রচুর গাছপালা, বাগান ইত্যাদি। ভোজনালয় থেকে সোজা এগিয়ে বাঁদিকে এক বিশাল মাঠ যার চারদিকে আমরা তখন হাঁটছি।
আমরা যেটাকে ভাবছিলাম প্রাতঃভ্রমণ বা মর্নিং-ওয়াক পরে বুঝলাম ঠিক তা নয়। গুরুকুলের এক ছাত্র ছিল আমাদের গাইড। সে বলল এর নাম মন্দির প্রদক্ষিণ। মন্দির? এ তো একটা ফাঁকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ! না, জানা গেল আশ্রম তৈরির খননকার্যের সময় এই মাঠেরই নীচে পাওয়া যায় প্রাচীন এক গণেশ মন্দির, যার নামে ঐ এলাকা ও গ্রামের নাম 'গণেশপুরী'। ভেতরে ক্যামেরা বা ক্যামেরা-যুক্ত মোবাইল আনা নিয়মবিরুদ্ধ, তাই কোন ছবি তোলা যায়নি ওই 'মন্দিরের'। তবে মন্দির-মাঠের চারপাশে দেখলাম প্রচুর ছোট বড় যত্ন করে পালন করা গাছ, প্রতি গাছের তলে একটা প্লেটে লেখা আছে সেই ভক্ত বা ছাত্রের নাম যাঁরা গাছটি দান করেছেন। অনেকে যাঁরা ওখানে এখনও আছেন তাঁরা গাছগুলির নিয়মিত পরিচর্যাও করেন, যদিও সব কিছুই করা হয় একটি নির্দিষ্ট সময় আর নিয়ম মেনে। পরিক্রমার পর আমরা আনীত হলাম চারদিক খোলা শেডের ক্লাসহলে, শুরু হল পরিচয়পর্ব। গুরু শিবানন্দ আশ্রমের রীতিনীতি-পদ্ধতি, যোগা ও ধ্যানের কোর্স, সময়-সারণী, গুরুকুলের আদর্শ, হিন্দুধর্মের আদর্শ ও ঐতিহ্য, প্রাচীন ভারতবর্ষের ধারাবাহিক ইতিহাস- সব বিষয়ে একটা ইন্টারেক্টিভ বক্তৃতা দিলেন, তারপর আটটায় ব্রেকফাস্ট, আবার আমরা উপস্থিত হলাম খাবার ঘরে, দুধ-পাঁউরুটি-কলা-মিষ্টি দিয়ে সারা হল প্রাতঃরাশ।
এবার আশ্রমের প্রশাসন আর কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা কর যাক। আগেই বলেছি, গুরুদেব সিদ্ধপীঠ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ভগবান নিত্যানন্দের শিষ্য স্বামী মুক্তানন্দ। ১৯০৮ সালে মাঙ্গালোরের কাছে ধর্মস্থল গ্রামে তাঁর জন্ম। পনের বছর বয়সে গৃহত্যাগ করার পর সাধনার শেষভাগে তিনি বাবা নিত্যানন্দের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁরই শিষ্যত্ব নিয়ে ১৯৫৬তে গণেশপুরীতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ১৯৬১তে নিত্যানন্দের মহাসমাধির পর তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুসারে তিনি গণেশপুরীর গাঁওদেব মন্দির সংলগ্ন জলা-জঙ্গলের উপর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। দেশবিদেশ থেকে বহু ভক্তসমাগম হতে থাকে, ক্রমে এই যোগাশ্রমের শাখা-প্রশাখা সিদ্ধযোগ ফাউন্ডেশনের নামে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মুক্তানন্দের এক কন্নড় গৃহী ভক্ত পরিবার বোম্বাইয়ে থাকতেন, তাঁরা মাঝে মাঝেই গুরুসন্দর্শনে আসতেন শিশুকন্যাকে নিয়ে। পঞ্চবর্ষীয়া মালতী শেট্টি তখন কী বুঝত কে জানে, চুপ করে মুক্তানন্দের পায়ের কাছে বসে থাকত, তাঁর বাণী-প্রবচন বোঝার চেষ্টা করত। ইনি চৌদ্দ বছর বয়সে আধ্যাত্মিক শিক্ষামন্ত্র 'শক্তিপট'এ দীক্ষিত হন স্বামীজির দ্বারা, পরে কুড়ি বছর বয়স থেকে পাকাপাকিভাবে আশ্রমে এসে বিদেশী শিষ্যদের জন্যে স্বামীজির দোভাষীর কাজে লেগে পড়েন, ইতিমধ্যে যোগ-সাধনায় সিদ্ধিলাভও করেন। স্বামী মুক্তানন্দের ইনি শ্রেষ্ঠ শিষ্য ছিলেন। ১৯৮২তে মহানির্বানের কয়েকমাস আগে স্বামীজি তাঁকে গুরুমাঈ চিদ্বিলাসানন্দ নাম দিয়ে তাঁকে আর তাঁর ছোট ভাই নিত্যানন্দকে যুগ্মভাবে আশ্রম চালানোর দায়িত্ব দিয়ে যান। অবশ্য কিছু বিতর্কিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে ১৯৮৫তে নিত্যানন্দকে আশ্রম ছেড়ে যেতে হয়, আর তখন থেকেই গুরুমাঈ সিদ্ধপীঠ সমেত সমগ্র সিদ্ধযোগা ফাউন্ডেশনের সর্বেসর্বা।
(৪)
আমার সিদ্ধপীঠ আশ্রমে যে কার্যক্রমে যোগ দেওয়ার কথা তার নাম 'Retreat to Pilgrimage of Heart', বাংলায় বললে 'হৃদয়তীর্থে একান্তবাস'। রিট্রীট কথাটার অনেক অর্থ হয়, স্বামী শিবানন্দ, ইনি জন্মসূত্রে আমেরিকান, বোঝালেন। আমরা যেমন যেমন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছি, বুদ্ধি, দৈহিক শক্তি, জ্ঞান, অর্থ এসব এসে হৃদয়বৃত্তিকে দূরে এককোনে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বে অনেক তীর্থস্থান আছে, অনেক দেবতা, অনেক দুর্গম যাত্রা, কিন্তু সেরা তীর্থ আপন হৃদয়। সে যা দেখায় তাই স্বচ্ছ, নির্মল, যা করায় তাই পুণ্যকর্ম, যা ভাবায় তাই অধ্যাত্মচেতনা। আগামী তিনদিন ধরে আমরা বর্তমান জীবন ভুলে ফিরে যাব হৃদয়ের তীর্থে, উপলব্ধি করার চেষ্টা করব শাশ্বত শুদ্ধাত্মাকে যাঁর বাস প্রতি মানুষের হৃদয়ে বা অন্তঃকরণে। কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করা অনেক বড় যোগসাধনার ব্যাপার। আমরা কর্মব্যস্ত মানুষ, সে সব বুঝি না, পারার প্রশ্নই নেই। কিন্তু দেহের এই ষড়চক্রের মাঝে যে অসীম মানসিক শক্তি লুকিয়ে আছে তার একটুকরো অনুভব- এটুকুও যদি পাওয়া যায়! আরো অনেক বিশাল বড় বড় জ্ঞানের কথা শুনেছিলাম সেদিন, অত বুঝি নি, আর কিছু মনেও নেই। এবার একটু আশ্রমবাসীদের প্রসঙ্গে আসি।
এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ছোট-বড় কাজে রত যাদেরকে দেখছি চারপাশে, তারা কিন্তু একটু অন্যরকম, মানে ঠিক কাজের লোক বা মাইনে করা কর্মচারী বলে মনে হচ্ছিল না। কথিত আছে প্রাচীন ভারতে মণ্ডনমিশ্র নামে এক মহাপণ্ডিত ছিলেন যাঁর বাড়িত দাস-দাসীরাও শাস্ত্র আলোচনা করত, খাঁচার পাখিরাও উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করত। প্রথমে তাই ভেবেছিলাম এঁরাও হয়ত পরিবেশ-সাহচর্যে যোগ ও অধ্যাত্ম-শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে উঠেছে, মানসিক ভাবেও অনেক উন্নতিলাভ করেছে। তবে একজন ভদ্রলোক কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পরিবেশন করছিলেন, জানালেন তাঁর নাম সমীর পারিখ, মুম্বাইয়ের একজন শিল্পপতি। রিসেপশনে যে ভদ্রমহিলা ছবি তুলে আর ফর্ম ভরিয়ে আমাদের রেজিস্ট্রেশন করালেন তিনি নাকি বাঙ্গালোরের একটি সফটোয়্যার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। বক্তৃতা-হলে যিনি চেয়ার সাজাচ্ছিলেন তিনি আই-আই-টি বোম্বের একজন অধ্যাপক! এঁরা সবাই আশ্রমে সেবাদান করছেন নিজের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে। নিউ জার্সি থেকে আগত এক শ্বেতাঙ্গিনী নিত্যপূজার মালা গাঁথছিলেন, আর আমি তাঁকে দেখে অবাক হলাম না। তবে যা জেনে আশ্চর্য লাগল যে অন্ততঃ বেশ কয়েকমাস আশ্রমে যোগশিক্ষার ছাত্র হিসেবে না থাকলে আর দু-একটা রিট্রীটের কার্যক্রমে যোগদান না করলে সেবারও অধিকার নাকি পাওয়া যায় না। বোঝা গেল এঁরা প্রত্যেকেই হয় গুরুকুলের ছাত্র-ছাত্রী আছেন বা ছিলেন কিংবা স্বামী মুক্তানন্দ ও গুরুমাঈয়ের একান্ত ভক্ত।
পরিচয়পর্বের শেষে শুরু হল আশ্রম পরিক্রমণ। গণেশ মন্দিরের মাঠ আগেই ঘোরা হয়ে গেছে। এবার বাকিটুকু ঘুরে দেখলাম। পরিপাটি করে সাজানো ফুল-ফলের বাগান, মধ্যে মধ্যে বিভিন্ন সন্ত-তপস্বীর মর্মর মূর্তি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, মাধবাচার্য, তুলসী, জ্ঞানেশ্বর, নরসি মেহতা তুকারাম, জলারাম, রামকৃষ্ণ পরমহংস, তৈলঙ্গস্বামী, সুরদাস, মীরাবাঈ, শ্রীচৈতন্য, সাঁইবাবা- কে নেই সেই সভায়। সেখানে ধর্ম-জাতের ভেদ নেই, মুসলমান তাঁতী কবীর বা শুদ্র চর্মকার সন্ত রুইদাসও সসম্মানে বিরাজিত- একেবারে সশিষ্য। পুরাকালের ব্যাস-বাল্মীকি-বিশ্বামিত্র-গৌতম-যাজ্ঞবল্ক-মনুও বাদ যাননি, সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিরাও আছেন। হিন্দুধর্মের দিকপালরা ছাড়া অন্যান্য ধর্মগুরুরা যেমন নানক, খ্রীস্ট, বুদ্ধ, মহাবীরদের মূর্তিও ছিল, কেবল ইসলাম নবী হজরত নেই, থাকার কথাও নয়- তাঁরা মূর্তিপূজার বিরোধী। সবার সুবিধার জন্য মর্মর ফলকে সকলের নাম-পরিচয়-সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনীও লিপিবদ্ধ করা ছিল প্রতি মূর্তির সাথে। সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে হোমকুণ্ড, হঠযোগের অভ্যাস-স্থল, লাইব্রেরি, ধ্যান বা মেডিটেশন সেন্টার, সব ঘুরে দেখে রীতিমত অভিভূত হলাম।
এই করতে করতে সাড়ে এগারটা। লাঞ্চ-ব্রেক। একই নিয়মে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম সবাই মিলে। এরপর শুরু হবে যোগাভ্যাসের ক্লাস।
(৫)
আমাদের গ্রুপে আমি আর যাদবজীই আশ্রমজীবনে নতুন। বাকি সবাই বহুদিন ধরেই গুরুকুলছাত্র বা স্বামী মুক্তানন্দের বা গুরুমাঈয়ের ভক্ত, বহুদিন ধরে গণেশপুরী বা বিশ্বজুড়ে থাকা বিভিন্ন সিদ্ধযোগের শাখা আশ্রম বা কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ত্রিশজনের গ্রুপে অন্ততঃ অর্ধেকই তো শ্বেতাঙ্গ বিদেশী-বিদেশিনী। আমরা কর্পোরেট-সূত্রে প্রবেশাধিকার পেয়েছি, সুতরাং যোগাভ্যাস প্রণালী, এর রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। তবু স্বামী মহেশানন্দ যোগের ক্লাস গোড়া থেকেই শুরু করলেন।
যোগ কথার সোজা অর্থ আত্মার সঙ্গে পরমাত্মাকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া। প্রাণত্যাগ করলে জীবাত্মা আপনি তা পায়, কিন্তু জীবদ্দশায় তার অনুভব পেতে সাধনার প্রয়োজন, এই সাধনার অভ্যাসই যোগ। যোগের চারটি পদ্ধতি, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ আর রাজযোগ। প্রথম তিনটি পদ্ধতি মূলতঃ মানসিক। জ্ঞানযোগ শিক্ষার পথ। সাংখ্য, দর্শন, বেদান্ত ইত্যাদি শাস্ত্রপাঠ করে শ্রবণ, মনন আর নিদিধ্যাসনের মধ্য দিয়ে এই পথে এগিয়ে সিদ্ধিলাভ করা যায়। ভক্তিযোগের মূল হল দাস, সেবক, সখা বা প্রেমীরূপে ঈশ্বরের কাছে নিঃশর্ত আত্মনিবেদন। পূজা, প্রার্থনা, নামগান ও সংকীর্তন জাতীয় ক্রিয়াই ভক্তিযোগের পদ্ধতি বা প্রকরণ। কর্মযোগের কথা গীতাতে বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে। ঈশ্বর, মানুষ, জীবজন্তু, প্রকৃতির প্রতি নিষ্কাম সেবা আর কর্মই এই সাধনার পদ্ধতি, 'মা ফলেষু কদাচন্'- ফলাফল ভগবানকে সমর্পণ করতে হবে।
এছাড়া ব্যক্তিসত্ত্বাকে বিকশিত করে আত্মোন্নতির মাধ্যমে পরামার্থপ্রাপ্তির যে সাধনা, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার সময় বিশ্বকে জানান, তার নাম 'রাজযোগ'। অন্য পদ্ধতিগুলিতে মন আর হৃদয় ছিল মুখ্য, দেহের ভূমিকা ছিল গৌণ। রাজযোগে মনের সাথে সাথে দেহকেও যুক্ত করে হয় সাষ্টাঙ্গ-সাধনা, এর ফল হয় অনেক বেশি কার্যকর। এই রিট্রীটে রাজযোগের উপর আমাদের আকর্ষণকে কেন্দ্রিত করার কথা বললেন শ্বেতাঙ্গ স্বামী মহেশানন্দ। তিনি বোঝালেন রাজযোগের আটটি অঙ্গ- ১) যম (অহিংসা, সত্য, আস্তেয়, ব্রহ্মচর্য আর অপরিগ্রহ)- জৈনদর্শনে সম্যকচরিত্রের পাঁচটি মহাব্রতের নাম, বৌদ্ধধর্মে যা পঞ্চশীল ২) নিয়ম বা অনুশীলন- শৌচ (পরিচ্ছন্নতা), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় আর ঈশ্বর প্রণিধান ৩) আসন বা দেহের ভঙ্গিমার দ্বারা বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া আর ৪) প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাস্থ্যকর বিধি- এই দুইয়ে মিলে বলা হয় হঠযোগ ৫) প্রত্যাহার বা বিধিসঙ্গত বিরাম, বিশ্রাম ৬) ধারণ বা মনঃসংযোগ ৭) ধ্যান বা একাগ্রচিত্তে পরমাত্মার প্রতি চিত্ত-নিয়োজন ও ৮) সমাধি অর্থাৎ বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে আত্মাকে বহিরঙ্গে পরমাত্মার মধ্যে প্রতিস্থাপন। এটি সাধনার উচ্চতম স্তর।
ধীরে ধীরে ঘরের আলো কমে এল। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল হলঘরের মধ্যে। একটা মৃদু ওঙ্কারধ্বনি সুরে বেজে চলেছে। আমরা সকলে মাটিতে আসন পেতে বসেছিলাম। স্বামীজি বললেন মনঃসংযোগ করে চোখ বন্ধ করতে। এরপরে আদেশ হল ওঙ্কারধ্বনির প্রতি কান রেখে পারিপার্শ্বিক ভুলে একমনে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক কোন শক্তির কথা ভাবতে। আমরা আজ্ঞা পালন করলাম। এভাবেই অন্ততঃ মিনিট পনের কেটে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ওঙ্কাররব থেমে আলো আগের মত জ্বলে উঠল। স্বামী মহেশানন্দ বললেন, তোমরা কে কী দেখলে একে একে শেয়ার কর, আমরা শুনি।
(৬)
'আমি দেখলাম অন্ধকারে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। কিছুই বুঝতে পারছিনা। এমন সময় আমার পাশে গুরুমাঈ এসে দাঁড়ালেন। আমি প্রণাম করতেই হাত ধরে টেনে তুলে আমাকে নিয়ে শূন্যে উড়ে চলতে লাগলেন। তারপর আর মনে নেই।'একজনের বর্ণনা শেষ হতেই আরেকজন। 'আমি এক জ্যোতিঃসমুদ্রের মাঝে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি। উল্টোদিক থেকে একে একে আসছেন সেই সব মহাপুরুষেরা যাঁদের মূর্তি আশ্রমের বাগানে সাজানো আছে।'
'আমি এই ঘর থেকে নড়িনি। কিন্তু চোখ বন্ধ করেও স্পষ্ট দেখলাম আমার সামনে স্বামী নিত্যানন্দ ধ্যানস্থ হয়ে আছেন আর স্বামী মুক্তানন্দ তাঁর পদসেবা করছেন।'
এবার আমার পালা। 'আমার ঠিক মনে পড়ছে না। ঘরের পরিবেশটা এত মায়াময় হয়ে উঠেছিল, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।' আমার কথায় সবাই হেসে উঠলেন। মহেশানন্দ কিন্তু হাসলেন না। তিনি বললেন-'সেটাই স্বাভাবিক। প্রথম প্রথম ধ্যানে বসে ঘুম আসাটাই নর্ম্যাল। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইয়োর অনেস্টি, মাই ফ্রেন্ড!' আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
'যাক, ধ্যানের একটা ফীল তোমরা পেলে', স্বামীজি বললেন। 'টী ব্রেকের পর লাইব্রেরিতে কিছুক্ষণ বসতে পার। তারপর আমরা যাব স্বামী নিত্যানন্দের সমাধি-মন্দির দর্শনে। ফিরে এসে ডিনার করে আজকের প্রোগ্রামের সমাপ্তি। কালকের দিনটির সম্বন্ধে একটি বিশেষ সূচনা। আগামীকাল এই রিট্রীটের সব ছাত্রের জন্য আছে মৌনব্রত। ক্লাসরুমের মধ্যে প্রয়োজনে কো-অর্ডিনেটার বা লেকচারারের সঙ্গে ছাড়া পারতপক্ষে কেউ কথা বলবে না সারা দিন।'
'আশ্রমের পথে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে?'
'চা খেয়ে লাইব্রেরিতে এস। প্রত্যেককে একটা করে ব্যাজ দেওয়া হবে যেটা কাল সারাদিন তোমরা গলায় ঝুলিয়ে রাখবে। ব্যাজের একদিকে হিন্দিতে লেখা 'মৌন', অন্যপিঠে ইংরেজিতে 'Silent'. Do you know that listen and silent use the same letters, they are anagrams? To listen, to truly listen to someone, even to your inner core of the heart, where you are on a pilgrimage to, you must be silent—not only outwardly silent, but also inwardly. Silent লেখা ব্যাজ দেখলে এখানে কেউ তোমাদের প্রশ্ন করবে না, আশ্রমের সবাই এটা জানে।'
নিত্যানন্দের সমাধি আশ্রম থেকে মাইলখানেকের পথ। তনসা নদীর তীরে যেখানে মাটি খুঁড়লেই একটা স্তর থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে আসে উষ্ণস্রোত, সেখানে এক শান্ত মনোরম পরিবেশে ভগবান নিত্যানন্দের সমাধি মন্দির। নিত্যানন্দ নির্জনে সাধনা করতেন, প্রচারের আলোয় কোনদিনই আসতে চাননি। তবে ১৯৬১তে তাঁর মহানির্বানের পরে শিষ্য মুক্তানন্দ আর এখন স্বামী চিদবিলাসানন্দ বা গুরুমাঈ দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর শিক্ষা জনমানসে প্রচার ও প্রসারে। সেখান থেকে ফিরে এসে ডিনার সেরে সান্ধ্য প্রার্থনায় যোগ দিলাম। তারপর প্রায় সাতটায় আমরা আবাসনে ফিরে এলাম। 'মৌন' লেখা ব্যাজ পেয়ে গেছি, কাল সারাদিন কথা বন্ধ। ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠতে হবে, তাই সাড়ে আটটার মধ্যেই শুয়ে পড়লাম।
(৭)
(৭)
পরদিন আমরা 'মৌন' লেখা ব্যাজ বুকে ঝুলিয়ে আশ্রমে এলাম। প্রার্থনাসভায় বসে আধঘণ্টা নামগান আর ভজন শুনলাম, তবে গলা মেলাই নি। তারপর চা-বিস্কুট খেয়ে মন্দির পরিক্রমার নামে মর্নিং ওয়াক, ফিরে এসে শুরু হল যোগা-কেন্দ্রের হলে হঠযোগের অভ্যাস।
হঠযোগ রাজযোগের একটি অঙ্গ যাতে শরীরের সাধনায় মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এর শুরু হয় প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক পদ্ধতি আর অভ্যাস দিয়ে, যেটা বাবা রামদেবের টেলিভিশন আর সিডির কল্যাণে এখন সবার জানা। এর পরের স্টেজ আসন। পদ্মাসন থেকে শুরু, উষ্ট্রাসন, গোমুখাসন, হলাসন, শলভাসন, ময়ূরাসন, সর্বাঙ্গাসন আর সবার মাঝে মাঝে একবার করে শবাসনে কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম। শবাসন জিনিসটা আমার মন্দ লাগে নি, এটা আমি রোজ ৬-৭ ঘন্টা করে থাকি, এখনও! তবে ভয় ছিল শীর্ষাসন নিয়ে, সঙ্গত কারণেই দু-দিনের অতিথিদের জন্যে সেটার শিক্ষাটা বাদ দেওয়া হয়েছিল, বাঁচলাম।
হঠযোগ রাজযোগের একটি অঙ্গ যাতে শরীরের সাধনায় মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। এর শুরু হয় প্রাণায়াম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঠিক পদ্ধতি আর অভ্যাস দিয়ে, যেটা বাবা রামদেবের টেলিভিশন আর সিডির কল্যাণে এখন সবার জানা। এর পরের স্টেজ আসন। পদ্মাসন থেকে শুরু, উষ্ট্রাসন, গোমুখাসন, হলাসন, শলভাসন, ময়ূরাসন, সর্বাঙ্গাসন আর সবার মাঝে মাঝে একবার করে শবাসনে কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম। শবাসন জিনিসটা আমার মন্দ লাগে নি, এটা আমি রোজ ৬-৭ ঘন্টা করে থাকি, এখনও! তবে ভয় ছিল শীর্ষাসন নিয়ে, সঙ্গত কারণেই দু-দিনের অতিথিদের জন্যে সেটার শিক্ষাটা বাদ দেওয়া হয়েছিল, বাঁচলাম।

ক্ষিদে পেয়ে গেছিল। প্রাতঃরাশে দুধ দিয়ে আটার মোটা পাঁউরুটি হাফ-পাউন্ড মেরে দিলাম। তারপর অধ্যাত্ম-বিদ্যার শিক্ষা, ক্লাস নিলেন আই-আই-এম বাঙ্গালোরের একজন প্রফেসার, তিনি কন্নড় কিন্তু পদবীতে বাঙালি। তন্ত্রবিদ্যা দিয়ে শুরু করলেন দেহের ষট-চক্র সম্বন্ধে বক্তৃতা। আমি ঠিক বুঝলাম না, এটা আধ্যাত্মিক, না সত্যিকারের অ্যানাটমি না দুয়ের যোগ। মানুষের মস্তিষ্কের গঠনের একটা বিজ্ঞানসম্মত রূপ, কার্যকারিতা থাকলেও এর শক্তির সীমারেখা মনে হয় কোন অ্যানাটমির নিয়মের ধার ধারে না, আর তাই দেখেই আদিম-কাল থেকেই মানুষের যত কল্পনার উদ্ভব। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে বা তৃতীয় নয়নের উন্মোচন হলে যে কী অঘটন ঘটতে পারে, কী আশ্চর্যজনক অনুভূতি জেগে ওঠে তা বলে বোঝানো যায় না, এদিকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কে দেয়! অগত্যা এমত পরিস্থিতিতে বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ পথ। সঙ্গের ছবিটি দেহের আনুমানিক ছ'টি চক্রের অধিষ্ঠান আর তাদের পরস্পরের সংযোগ-বিবরণ বোঝায়। এই ছয় চক্রের একটু বিশদ পরিচয় দিই, বিশ্বাস করা না করা ব্যক্তিগত বিবেচনা।

এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে মানুষের শরীরের সুষুম্না নাড়ির মধ্যে পদ্মের আকৃতির ৬টি চক্র আছে।ষট্চক্র গুপ্ত ও রহস্যজনক, বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, অলৌকিক এবং অতীন্দ্রিয়, যদিও বর্ণনায় শরীরভিত্তিক হিসাবে বর্ণিত। সংক্ষেপে এগুলো হল-
১। 'মূলাধার চক্র', প্রথম চক্র, মানুষের মূলশক্তি বা 'কুণ্ডলিনী শক্তি'-র আধার ! এর অবস্থান সুষুম্নার অধোমুখে, গুহ্যের অধোদেশে! মূলাধার চক্র দেখতে নাকি রক্তবর্ণ। ওখানকার পদ্ম চতুর্দল অর্থাৎ চারটি পাপড়িবিশিষ্ট! ২। 'স্বাধিস্থান চক্র', দ্বিতীয় চক্র। লিঙ্গমূলে অবস্থিত। সিঁদুরে লাল রং, যাকে বলে অরুণ ঊষা বর্ণ। যড়্দল অর্থাৎ পদ্মের পাপড়ি ছয়টি।
৩। 'মণিপূরক চক্র' অবস্থিত। সুনীল বা গাঢ় নীল বর্ণ। এর পদ্মের পাপড়ি দশটি।
৪। 'অনাহত চক্র'। এটি অবস্থিত ! পদ্মের কলি অর্থাৎ পদ্মের কুঁড়ির মতো লাল রং। পাপড়ি বারোটি মানে দ্বাদশ দল যুক্ত।
৫। 'বিশুদ্ধ চক্র' কৃষ্ণলোহিত বা কালচে লাল বর্ণ। পদ্মের ষোড়শ দলের সজ্জা অর্থাৎ পাপড়ি ষোলটি।৬। 'আজ্ঞা চক্র'। ষষ্ঠ ও শেষ চক্র। দুই ভ্রু-র মধ্যে অবস্থিত। চন্দ্রসদৃশ শুভ্র বর্ণের। পদ্ম দ্বিদল, পাপড়ি মাত্র দুটি।
তান্ত্রিক যোগী সাধনার মাধ্যমে ঐ যট্চক্রের ছয়টি চক্রকে ভেদ করে নিজের মূলাধারের কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগিয়ে তুলে মস্তিষ্কের শীর্ষের সহস্রারপদ্মে শক্তিরূপে গমন করেন। সহস্রার শিরোমধ্যে আছে সহস্রদল পদ্ম। ওখানে পরম শিবের পবিত্র অধিস্থান! তান্ত্রিক যোগী সেখানে শিবের সাথে মিলিত হয়ে সহস্রার-ক্ষরিত অমৃতধারা পান করে অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন। সেটাই নাকি সাধনার সিদ্ধিলাভ। প্রয়োজনে তান্ত্রিক যোগী আবার ষট্চক্র ভেদ করেন ! আবার করেন। আবার করেন.....
তান্ত্রিক যোগী অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! যোগী অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! অনির্বচনীয় পরমানন্দ উপভোগ করেন! পরমানন্দ উপভোগ করেন!
(৮)
এতদূর পর্যন্ত ঠিক ছিল। ভাবছিলাম এর পরের পর্ব আর লিখব কিনা, কারণ তারপরেই শুরু হল এক পরস্পরবিরোধী সংলাপ আর কিছু রহস্যমোচন।
সেদিন মধ্যাহ্নভোজনের পরের পর্বে ভারতের আধ্যাত্মিক, যোগসাধনা আর ধর্ম-সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে খানিক চর্চা হচ্ছিল। স্বামীজির উদ্দেশ্য ছিল উপস্থিত সবাইকে গুরুমাঈয়ের কৃপালাভের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে অনুপ্রেরিত করা। এখানে আমি একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে ফেললাম- গুরুর কৃপায় আমার কী লাভ হবে? উত্তর পেলাম- ঈশ্বরকে পাবার পথ প্রশস্ত হবে। এইবার একটু হোঁচট খেলাম। আমি নাহয় চল্লিশের কোঠায় আছি, যাদবজি ষাটের কাছাকাছি হবেন। আমরা তবু ভগবদ্প্রাপ্তির সাধনা শুরু করতে পারি। কিন্তু এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষের বয়সই ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, নিউজিল্যান্ড থেকে আগত এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি আর দু-একজন তরুণ ছাত্রও আছেন তাদের মধ্যে। তারা হঠাৎ এই কাঁচা বয়সে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সাধনায় মত্ত হয়ে উঠলেন কেন? আমি সেকথা শ্রীমহেশানন্দকে জানালাম। বললাম, আমি তো ঈশ্বরকে পাবার আশায় এখানে আসিনি।
- তাহলে কী জন্যে এসেছেন?
- কেন, সে তো প্রোগ্রামের নামেই রয়েছে- 'হৃদয়-তীর্থে ফিরে তাকানো', আমার ধারণা ছিল ধ্যান আর যোগের মাধ্যমে আত্মিক আর আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটানো ছিল এর উদ্দেশ্য।
- তা তো বটেই। তবে প্রকৃত উদ্দেশ্য তো নির্বাণ আর মোক্ষেরই সাধনার হাতেখড়ি!
বুঝলাম, এঁদের ভাষণ আমাদের অর্থাৎ ভারতীয় হিন্দুদের তেমন কোন কাজেই আসবে না। পাশ্চাত্য উন্নত দেশগুলোতে কর্মব্যস্ত মানুষের কিছুটা শান্তি চাই, কাজ থেকে চাই সাময়িক মুক্তি আর তার চেয়েও বড় কথা অজস্র ডলারের আর ইউরোর বোঝা থেকেও খানিকটা মুক্তি, যে কাজটা আমাদের স্বামীজিরা ভালই বোঝেন। স্বামী বিবেকানন্দও বুঝেছিলেন, তবে তিনি সেটা স্বীকারও করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন রচনাতেই পরিস্ফুট হয়েছে যে পরাধীন দরিদ্র ভারতবর্ষের দুঃখমোচন করতে দরকার সুসংবদ্ধ আর সংহতিপূর্ণ, সুনিয়ন্ত্রিত, নিঃস্বার্থ সেবামূলক কাজের, আর তার জন্যে প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। আমেরিকা-ইউরোপ দেশের মানুষের অর্থ আছে, তারা ভারতের আত্মার সন্ধান পেতে চায়, সেবার ভাবনা তাদের মধ্যেও সংক্রমিত করা যায়, বিভিন্ন বক্তৃতা আর রচনার মাধ্যমে তিনি তাই করেছেন, মূলতঃ তারই ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম সংঘ। তখন হিন্দুত্ব নামক বস্তুটির ধারণা ছিল না বিশ্বের দরবারে, ভারতের ছবি দারিদ্র, সাপুড়ে, কুসংস্কার আর কালা-জাদুর দেশ হিসেবে দেখানো হত পাশ্চাত্য দুনিয়ায়। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ তুলে ধরলেন সনাতন ধর্মের উচ্চ আদর্শকে যা সর্বংসহা মনোভাবের বশবর্তী হয়ে হারতে হারতে আত্মবিশ্বাস খুইয়ে বসেছিল, তিনি তাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন এক অনন্য সম্মানের আসনে, পশ্চিম দুনিয়ার মনোযোগ আর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করল অবহেলিত ভারতবর্ষ আর মানহারা, বিশ্বে প্রায় অপরিচিত সনাতন হিন্দুধর্ম। বিবেকানন্দের সাফল্য উৎসাহিত করল, কিছু ক্ষেত্রে লোভও দেখাল অনেক আধ্যাত্মিক সাধু, যোগী আর সেই সঙ্গে বেশ কিছু ভণ্ডকেও। তারপর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একে একে গড়ে উঠল স্বামী প্রণবানন্দের ভারত সেবাশ্রম সংঘ, চিন্ময় মিশন, স্বামী শিবানন্দ সরস্বতীর দিব্যজীবন সমাজ, শ্রীভক্তিবেদান্তের কৃষ্ণ-চেতনা সমাজ বা ইস্কন ও হাল-আমলের শ্রীশ্রীরবিশংকরের আর্ট-অফ-লিভিং ফাউন্ডেশন। এঁরা মানুষের উপকার করেননি তা নয়, তবে সংঘমূলক দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এঁদের কর্ণধাররা হয়েছেন অগাধ সম্পত্তির অধিকারি, গা ভাসিয়েছেন চরম বিলাসিতায়, অনেকে রীতিমতো বদনামও কুড়িয়েছেন দেশে বিদেশে। যাক, যে পর্যন্ত মানুষ স্বেচ্ছার অর্থ, সম্পত্তি বা শ্রমদান করেন কার কী বলার থাকতে পারে? তবে কিছু ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ভারতের প্রাচীন নির্লোভ আর অনাড়ম্বর জীবনযাপনের ঐতিহ্যের অবনমন হচ্ছে বই কি, তথাকথিত ধার্মিক নেতারা নানা বিতর্ক আর দুর্নামে জড়িয়ে পড়ে এ দেশের কষ্টার্জিত সম্মানহানিরও কারণ হয়েছেন মাঝে মধ্যেই- সে বিতর্ক নাহয় এখন থাক। আমি সামান্য মানুষ, বেশি কিছু বলার ক্ষমতা, বুদ্ধি বা সাহস কোনটাই আমার নেই, যুক্তি দিয়ে ঘটনাপ্রবাহ বোঝার চেষ্টা করি, আর কেউ ভয় দেখালে বা জোরাল গলায় (হোক সে অন্যায়) ধমক দিলে বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকি।
যাকগে সে সব কথা, আমরা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজের কী দরকার? তিনদিনের অনুষ্ঠান কিন্তু সত্যি খুবই উপভোগ করেছিলাম। আশ্রমের পরিবেশ, সাধারণ মানের জীবনযাত্রা আর অসাধারণ উচ্চমানের আধ্যাত্মিক আলোচনা- তুলনাহীন এই দুইয়ের সন্তুলন। আমার কাজে লাগুক বা না লাগুক, প্রাচীন ভারতের গুরুকুল-সংস্কৃতির কিছুটা হলেও আভাস পেলাম এই ক'দিনে, তার স্মৃতি নিয়েই চতুর্থ দিনে বাড়ি ফিরলাম।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment