Tuesday, December 29, 2020

সিমপ্লি ম্যাড- গল্প

সিম্পলি ম্যাড।


এখনও পাগল হইনি বলেই বিশ্বাস করি, কিন্তু প্রায় হতে চলেছিলাম। কিভাবে? তাহলে সেই গল্পই বলি।

অনেক কাল আগের ঘটনা। তখন আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হত ডিসেম্বর মাসে আর তার পরেই দিন পনেরর নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। পড়াশুনো নেই, গরমের দাপট নেই, যতখুশি ছোটাছুটি আর খেলাধূলা। শুধু সন্ধে হতেই বাড়ি ফিরতে হত, তারপর আবার খেলো, মানে ঘরে বসে ক্যারাম, চাইনিজ চেকার আর বড়দাদারা বাগানের লনে যেখানে আলো জ্বালিয়ে আর নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলে সেখানে ঘুরঘুর করা, যদি কোন ফাঁকে একটু খেলার মাঝে ঢুকে পড়া যায়! 

কিন্তু সব কিছুই একসময় একঘেয়ে হয়ে যায়। পেয়ারাগাছে চাপা, ঢিল ছুঁড়ে কুল পাড়া, দিনভর গোবরডান্ডা আর গুলিডান্ডা খেলা, এমনকি ক্রিকেটও আর ভাল্লাগে না। নতুন কোন উত্তেজনার খোরাক চাই। ভাবতে ভাবতে চারজন অসমবয়সী বন্ধু, মানে আমি নাইনে পড়ি, শিং ভেঙে যাদের দলে ঢুকেছি সেই সুনীল সেভেনে, তোতন সিক্সে আর বালখিল্য হলেও শয়তানিতে আমাদের সবার গুরু আট বছরের খোকনা। সবার হাতে একটা করে সদ্য-বানানো গুলতি, জলার ধারে বেশ কিছু বক বসে আছে, শিকার করা যাবে। 

তখন অত পরিযায়ী পাখি-টাখি বুঝতাম না, তাছাড়া ওরা বক না বালিহাঁস ছিল তাও জানতাম না। আমরা তিনজনে যখন কাদায় পা ডুবিয়ে হাঁস-ফাঁস করছি, খোকনা সত্যিকারের দুটো হাঁস না বক জানিনা কী, গুলতি ছুঁড়েই শিকার করে ফেলল। উরিব্বাস, কী আনন্দ! পাখিদুটোকে হাতে ঝুলিয়ে বিজয়ী-বীরের মত ফিরছি, আজ পিকনিক হবে আমাদের বাগানের পেছনে।

ভীড় জমে গেল রীতিমত। আমরা তিন ভাইবোন, তোতন একা, সুনীলরা দুই ভাই আর খোকনারা তিন ভাই আর এক বোন- সবাই জুটে গেল। খোকনার মেয়ে-সদস্য নিতে একটু আপত্তি ছিল, কিন্তু ওর দিদি  থাকলে রান্নার সুবিধে হবে বলে আর ঝামেলা করল না। আমিও আমাদের চাকর বিভূতিকে ডেকে নিলাম, তাহলে আর মাংস-কাটাকুটি, উনুন জ্বালানো- এসব করতে সমস্যা হবেনা। ঠিক হল চাল, মশলা, আলু, পেঁয়াজ, লঙ্কা, রসুন, আদা- সবাই শেয়ার করবে, কয়লা আর মশলাপাতি আমাদের বাড়ির। খোকনা বলল ওর পাখি, তাই আর কিছু বাড়িতে চাইতে পারবে না। তবে ওদের বাগানে লুড়কি বেগুন আর টমাটো ফলেছে, তার কয়েকটা তুলে নিয়ে এল, ভাজা আর চাটনি হবে। আমাদের ওপরতলায় রুমু-ঝুমু দুটি বোন থাকে, তারাও লোভে লোভে এসেছিল নীচে। আমাদের আপত্তি ছিল না, তবে তাদের মা, মানে মিষ্টিকাকি কলকাতার কনভেন্টে পড়া সফিস্টিকেটেড মহিলা, তিনি নাক বেঁকিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বললেন- 'রুমু-ঝুমু, তোমরা কি জানো, বকের মাংস খেলে কী হয়?' বলা বাহুল্য, এসব কথা রুমু-ঝুমুদের স্কুলের কোর্সে নেই, তাই ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
- 'না, অন্য কিছু হয় না, সিম্পলি ম্যাড হয়ে যায়। আমাদের ল্যান্সডাউনের পাড়ায় একটা ম্যাডম্যান ছিল, সে নাকি কখন......'
- 'পাগলা ষাঁড় বলুন, কাকিমা, ম্যাড-অক্স।' উনি আবার কাকিমা বললে চটে যেতেন, আন্টি বলতে হতো, আর তাই আমরা আরো বেশি করে কাকিমা বলতাম, 'রুমু বলছিল ওদের মামাবাড়ি নাকি ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছে।' আমি এটুকু বলতেই কথার খেই হারিয়ে সফিস্টি... ইয়ে মানে মিষ্টিকাকি আমার দিকে কটমট করে একবার তাকিয়েই কেন জানিনা দুই মেয়েকে বগলদাবা করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন। 

তারপর যা পিকনিক হল না! তখনকার দিনে ছেলেরা শখের রান্না একটু-আধটু করলেও, গেরস্থ বাড়ির একটু বড় মেয়েরা রান্নাবান্না গেরস্থালিতে ওস্তাদ হতো। কাক হোক আর বক, আচ্ছা করে ঝালমশলা দিয়ে খোকনার বেবিদি আর আমার বোন মিলে যা দুর্দান্ত একখানা রান্না নামালো, খোলা জায়গায় গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তার গন্ধে চারপাশের বাড়ির জানলা খুলে সবাই উঁকিঝুকি মারতে লাগল। বিভূতি কলাপাতার অভাবে মানকচুর পাতা কেটে ধুয়ে আনল বেশ কিছু। 'হ্যাঁরে, গলা কুটকুট করবে না তো?' - আমি ভয়ে ভয়ে শুধোলাম। বিভূতি চাকর হলেও আমাদিগকে পাত্তা দিত না একদম, বলে- 'কী আর হবে তাহলে, তোমার খাবারটাও আমিই খেয়ে নেব অল্প কষ্ট করে!'

পরিষ্কার ঘাসের লনে আমরা খেতে বসেছি। ভাত, বাগানের বেগুন-ভাজা, আলুভাতে, চাটনি  আর বালিহাঁসের রগরগে ঝাল ঝোল গরম গরম- হ্যাঁ, একফাঁকে খোকনার বাবা এসে দেখে ও দুটোকে বালিহাঁস বলেই সার্টিফাই করে গেছেন। এমন সময় দেখি মিষ্টিকাকি উপর থেকে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে এসে দাঁড়িয়েছে, একাই। বললেন, 'না রে, যা গন্ধ পাচ্ছি ওপর থেকে, ভাবলাম একটু মাংস টেস্ট করেই যাই। রুমু-ঝুমুকে আর আনলাম না। আমার আর কী, এই বয়সে নাহয় ম্যাড হলামই।'

রুমু-ঝুমুর অশেষ সৌভাগ্যই বলতে হবে, ওদের মা-ও সে যাত্রা ম্যাড হতে হতে বেঁচে যায়।   

Wednesday, December 16, 2020

আমাদের প্রয়াগ ভ্রমণ

 

আমাদের প্রয়াগ ভ্রমণ।



(১)
সেটা ১৯৮১ সা্লের ডিসেম্বর। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের পরীক্ষা দিয়েই আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে দিল্লি গেছিলাম একটা ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ ছিল নেহেরু প্লেসে। ভাবলাম রাত্রে হোটেলের খরচা না করে আজই ট্রেন ধরে কেটে পড়লে কেমন হয়? তখন ছাত্র আমরা, বাবার পয়সা আর কত ধ্বংস করব? অন্য কেউ রাজি না হলেও, আমরা পাঁচ জন, মানে আমি, সমীর মুখার্জি, রবিশংকর ব্যানার্জি, অশোক ঝা আর ঈশ্বরচন্দ্র ঝা, সবাই মিলে চেপে বসলাম এলাহাবাদগামী একটা ট্রেনে, কোচ কন্ডাক্টারকে ম্যানেজ করে পাঁচখানা বার্থও পেয়ে গেলাম, হোটেল-ভাড়ার তুলনায় প্রায় জলের দরে।
ট্রেন এলাহাবাদ জংশনে পৌঁছোল সকাল দশটায়। শহরের নাম আজ আর এলাহাবাদ নয়, প্রয়াগরাজ তা সবাই জানে। এই প্রয়াগ কিন্তু হচ্ছে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম অঞ্চলটির নাম, যেখানে প্রতি বারো বছরে একবার করে পূর্ণকুম্ভমেলা হয়। বাকি প্রতি তিন বছর অন্তর হয় হরিদ্বার, উজ্জয়িনী আর নাশিকে। কুম্ভমেলার কী গুরুত্ব তা নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামাইনি, তবে হিন্দি সিনেমা-টিনেমা দেখে এটা নিশ্চিত জানতাম যে যমজ ভাইদের কখনও কুম্ভমেলা দেখতে যেতে নেই, একজন নির্ঘাৎ হারিয়ে যাবে! আমরা মেলার সময় যাইনি, আর যমজ ভাইও ছিল না, তাই তার আর বিবরণ দেব না। তবে কলকাতার ট্রেন আসতে তখনও ছ'ঘন্টা আছে, সেই বিকেল পাঁচটা, সময় কাটাতে হবে না? কোথায় কাটাব, ওয়েটিং রুমে? আমি আবৃত্তি শুরু করে দিলাম-
"ছ'ঘণ্টাকাল থাকতে হবে যাত্রীশালায়,
মনে ভাবলেম, এ এক বিষম বালাই।
বিনু বললে, কেন, এইতো বেশ?
তার মনে আজ নেইকো খুশির শেষ।
পথের বাঁশি পায়ে পায়ে তারে আজি করেছে চঞ্চলা-
আনন্দেতে এক হল তার পৌঁছোন আর চলা।"
এবার ধমক খেলাম বেরসিক রবিশংকরের কাছে। নেমসেক হলেও ও রবি ঠাকুরকে দুচোক্ষে দেখতে পারে না। বলল- 'বসে বসে কবিতা না আউড়ে শহরটা একটু বেড়িয়ে নিলেই তো হয়। অশোক, ঈশ্বর, তুমলোগ এলাহাবাদ দেখা?'
দেখা গেল আনন্দ ভবন আর দু'একটা দর্শনীয় জায়গা ঘোরা থাকলেও সঙ্গম কেউই দেখেনি। তাই একযোগে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মালপত্র ক্লোকরুমে জমা করে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। সকাল থেকে চা ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি, বাইরে রাস্তায় এসে সারি সারি হোটেল দেখে
তাই হঠাৎ খুব খিদে পেয়ে গেল। 'অব ব্রেকফাস্ট কা টাইম কাহাঁ হ্যায়? চলো লাঞ্চ করতে হ্যাঁয়'- ঈশ্বর বলে। অগত্যা একটা মাঝারি দেখে রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম আমরা সকলে।
অশোক আর রবি মাছ-ভাতের অর্ডার দিয়েছে, বাকি সবাই চিকেন-রাইস। কিন্তু আমাদের মুর্গীর ঝোলে মাছের গন্ধ কেন? 'এই তোদের মাছের ঝোলে মুর্গীর গন্ধ আছে?' আমি শুধোলাম রবিকে। ঠিক তা ছিল না, মাছের ঝোলেও মাছেরই গন্ধ। চিৎকার চেঁচামেচি করে জানা গেল- যে ঝোলে মাছ ফোটানো হয়েছে মুর্গীর ঝোল শেষ হয়ে যাওয়াতে সেই উদ্বৃ‌ত্ত মাছের ঝোলই ঢেলে দেওয়া হয়েছে চিকেনে। স্টেশন বাজারের হোটেল আর কত পারফেক্ট হবে? শেষমেশ সবাই মাছ-ভাতই খেলাম। আমরা তিনজন বাঙালি, আর বাকি দুজন মৈথিলি- দ্বারভাঙ্গা মানে দ্বার-বঙ্গের বাসিন্দা অর্থে হাফ-বাঙালি, মাছে অরুচি নেই।
এরপর একটা টাঙ্গা ভাড়া করে সবাই মিলে আসা-যাওয়ার কড়ারে প্রয়াগ রওনা হয়ে গেলাম। তখন বেলা সাড়ে এগারোটা, সমীর বলল, 'বারোটা বাজতে দেরি নেই আর'। কথাটা যে অন্যদিক দিয়ে সত্যি হতে পারে, কে জানত সেটা!

টাঙ্গার কোচোয়ান ছিল আমুদে গপ্পবাজ লোক। এতগুলো নতুন মানুষ পেয়ে ও জ্ঞান দিতে শুরু করেছে। 'বোলিয়ে তো সাহেবলোগ, প্রয়াগ তীর্থ ইতনা ফেমাস কিউঁ হ্যায়?'
- 'তেরে মন কী গঙ্গা ঔর মেরে মন কী যমুনা কা
বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি!' অশোক গেয়ে ওঠে মজা করে। 'গঙ্গা-যমুনা কা সঙ্গম হ্যায় ওহাঁ।'
- 'আরে সাহেব, সিরফ গঙ্গা-যমুনা নাহি, একঠো সরসতী ভি থা কিসি টেম, উ আজকাল জমিন মা ঘুসল গয়িল। বহুত পুণ্যস্থান হ্যায়, সারি কথা তো সুনিয়ে।'
এই বলে টাঙ্গাওলা দিলাওয়র হুসেন ভাই পৌরাণিক আর লোককথা মিলিয়ে মিশিয়ে যে কাহিনী শোনাল, তা বহুশ্রুত, তবু সংক্ষেপে বলছি। আসলে যদ্দিন টি-আর-পি থাকে সিরিয়াল টেনে যেতে হয় কিনা, এ সব টিভিওয়ালারাই শিখিয়েছে, নতুন আর কি!
এ গল্পও নতুন নয়। শোনা কথা আবার নতুন করে বলা। দুর্বাসার শাপে লক্ষ্মীছাড়া হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। লক্ষ্মীদেবী স্বর্গচ্যুত হয়ে বসে রইলেন সমুদ্রের নীচে গিয়ে। দেবলোকে হাহাকার, ব্রহ্মার পরামর্শে নারায়ণের তপস্যায় বসলেন ইন্দ্র। প্রীত হলেন নারায়ণ। সিন্ধু কন্যা রূপে লক্ষ্মী দেবীকে জন্মগ্রহণ করতে আদেশ দিলেন তিনি। তারপর দেবতাদের নিয়ে সমুদ্র মন্থন করতে বললেন দেবতাদেরকে। মন্দার পর্বত হল মন্থন-দণ্ড, নাগরাজ বাসুকীকে বানানো হল দড়ি। আর এ বিশাল কাজ শুধু দেবতাদের পক্ষে করা কিছুতেই সম্ভব নয় বলে সঙ্গে অসুরদেরও নিতে বললেন। কথা হল, মন্থনে যা কিছু সম্পদ উঠবে তা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন দেবতা ও অসুরেরা।
সমুদ্র মন্থন শুরু হল। উঠে এলেন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী, উচ্চৈঃশ্রবা নামে ঘোড়া আর ঐরাবত নামে হাতি। তারপর দেব-বৈদ্য ধন্বন্তরি উঠে এলেন অমৃতে ভরা কুম্ভ হাতে নিয়ে। দেবতাদের পরমধন অমৃতকুম্ভ যাতে দেবতাদের হাতছাড়া হয়ে অসুরদের হাতে না পড়ে, দেবরাজ ইন্দ্র তাই কুম্ভ নিয়ে পালাতে বললেন পুত্র জয়ন্তকে। পিতার আদেশ পাওয়া মাত্র অমৃতকুম্ভ নিয়ে ছুটতে লাগলেন জয়ন্ত, সমুদ্র মন্থনের সার বস্তুই যে অমৃত, যা পান করলে অমরত্ব লাভ করা যায়।
এদিকে অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য ব্যাপারটা লক্ষ করে অসুরদের আদেশ দিলেন জয়ন্তকে ধরতে। আগে আগে জয়ন্ত ছুটছেন অমৃত কুম্ভ নিয়ে- পিছনে ছুটছে অসুররা। এইভাবে সমানে তিনদিন ছোটার পর জয়ন্ত একটু বিশ্রাম নিতে বসলেন গোদাবরী-তীরের নাশিকে। আরো তিনদিন পরে পরে একবার করে বসতে হল রেবাতীরের উজ্জয়িনীতে, গঙ্গাতীরের হরদ্বারে (আপনারা জেনে রাখুন বাবুসায়েব, বাঙালিরা ভুল করে হরিদ্বার বলে, কথাটা কিন্তু হরদ্বার) আর এই ত্রিবেণীসঙ্গম প্রয়াগে- বারো দিন ধরে ছোটাছুটি করে ফিরে আসতে হয় সেই সাগর-তীরে অমৃত বিলি করতে। এই চারটে স্থানই হিন্দুদের কাছে পবিত্র তীর্থ, প্রতি তিন বছরে একবার করে মহাস্নানযোগ আসে একেকটা জায়গায়, যাকে কুম্ভমেলা বলে আর বারো বছরে প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভ রিপিট হয়।
- 'কিন্তু তিন তিন বছরে কেন? ও তো তিন-তিন দিন মে হোনা চাহিয়ে।' আর পূর্ণকুম্ভই বা কী জিনিষ?- আমাদের জিজ্ঞাসা।
- 'হাম মুরখ আদমি হুঁ বাবুসাব, লেকিন ইয়ে শুনা হুঁ কি দেওতা কা এক দিন হামারা এক সাল কে বরাবর হোতা হ্যায়।' সে জন্যে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর চার জায়গায় কুম্ভমেলা হয়, গড়ে একটা পূর্ণ কুম্ভ হয় বারো বছর পরে আর ছ'বছরে অর্ধকুম্ভ। হরিদ্বার আর প্রয়াগে পূর্ণ অমৃত কুম্ভ হয় কুম্ভ নামানোর সময় এই দু-জায়গায় কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল বলে। প্রতি ১৪৪ বছরে নাকি একবার মহাকুম্ভ হয়, জানিনা এর পর কোন সালে হবে সেটা।
- 'লেকিন চৌকন্না রহিয়ে সাবজী, পাণ্ডালোগ বহুত পরেশান করতে হ্যাঁয়'- সচেতন করে দিল টাঙ্গাওলা-ভাই। জানা গেল, আগে ওদের উপদ্রব এমনই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল, ওরা নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কুম্ভমেলার অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেয়নি, অহিন্দু ঘরের বউ বলে। তবে তিনিও কম যান না। মেলা-অনুষ্ঠান সমেত পুরো চক্রটাকে জাতীয় আইনের আওতায় এনে ফেলে ওদের জব্দ করেছেন। এখন তো পুরী, বেনারস, দেওঘর, মথুরা সর্বত্র সরকারি আইনের শৃঙ্খলা, তবু যেহেতু এদেশে আইনের রক্ষকরাও ভক্ষকদের দলে, তাই পাণ্ডা আর তার সাগরেদরা এখনও সুযোগ পেলেই ভালই ঠকাতে থাকে নিরীহ তীর্থযাত্রীদের। পরে জেনেছিলাম ভারত সেবাশ্রম সংঘের মত প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে এলে তেমন সমস্যা হয়না।
গল্পে গল্পে খেয়াল করিনি কখন হনুমানমন্দির ছাড়িয়ে সঙ্গমতীর্থের ঘাটের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের টাঙ্গা।

টাঙা থেকে নেমে যমুনার তীরে এসে দাঁড়াতেই পাণ্ডারা এসে ছেঁকে ধরল। 'আইয়ে বাবুলোগ সঙ্গম কা দর্শন কীজিয়ে...... গঙ্গা মাইয়া কী পূজা চঢ়াইয়ে......পিতৃপুরুষ শ্রাদ্ধ-তর্পণ কীজিয়ে......আইয়ে সাব, নাও রেডি হ্যায়......।
এরই মাঝে ভীড় ঠেলে-ঠুলে জনাচারেক নাপিত এসে জুটেছে। 'বৈঠিয়ে বাবুজি, মুণ্ডন কর দেতে হ্যাঁয়'। আরে মুণ্ডন করব কেন খামখা, পিতৃশ্রাদ্ধই বা কিসের, বাপ-মা বেঁচে আছে আমাদের! তাই শুনে তর্পণ-ওয়ালা পাণ্ডারা পিছিয়ে গেলেও নাপিতরা ছাড়ে না। 'বাবুজি, ফির ভি মুণ্ডন তো করা হি লীজিয়ে। তেল-সিন্দুর-শ্যাম্পু কা খরচা বচেগা, কাংঘি ভি খরিদনা নেহি পড়েগা। কিতনা টেম ভি বচেগা সোচিয়ে!' সমীর আর অশোক দুজনেই লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান ছেলে, ওরা জামার আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে যেতেই সবাই হাওয়া।
নাপিতরা কেটে পড়লেও নৌকো-পার্টি তখনও দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়। একজন এগিয়ে এসে বলল, বাবুজি, আপনারা এখন সঙ্গমের কাছে যমুনার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখুন জলটা গাঢ় নীল, কালো বলা চলে। বাঁদিকে ওই দূরে তাকিয়ে দেখুন, ওই দেখানে লাইন করে খুঁটি পোঁতা আছে, ওখানে যমুনা গিয়ে গঙ্গা-মাইয়াতে মিশছে। গঙ্গাজল সাদা, একটু ঘোলাটে। মাইয়া কী কৃপাসে সঙ্গম এক লাইন সে সাফ পাতা চলতা হ্যায়। চলুন ওখানে নিয়ে যাব, পাটাতন নামিয়ে স্নানের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
এতদূর এসে কিছু না দেখে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। ঈশ্বর দরদস্তুর শুরু করে দিল। 'সির্ফ সাড়ে সাতশো রুপিয়া দীজিয়ে', ওরা বলল। পাগল! আমরা স্টুডেন্ট, অত পয়সা নেই, তিরিশ টাকা দিতে পারি। শেষ পর্যন্ত চল্লিশ টাকায় রফা হল। মনে হয় সেটাও একটু বেশি হয়ে গেল, যাকগে, পাঁচ জনে তো শেয়ার হয়ে যাবে। আমাদের কাছে পয়সা বলতে ধানবাদ থেকে দিল্লির ফার্স্ট-ক্লাসের ভাড়া ধরিয়ে দিয়েছিল ওরা। আমরা তো গেছি স্লীপারে, ইন্টারভ্যুতে কী ফলাফল হবে জানিনা, ওই ডিফারেন্সটুকুই আমাদের লাভ। অগত্যা পাঁচজন মিলে নৌকোতে চড়ে বসলাম।
'কি হে, তোমাদের নৌকো এত ভেজা কেন, বসব কোথায়?' আমি বলি।
'বাবুজি, নাও থেকে আমরা সঙ্গমে গঙ্গাস্নান করাই, তাই এগুলো ভেজা। আপনারাও তিন-নদীর জলে স্নান করে নিন। এই পবিত্র সঙ্গমে স্নান করলে জীবনভরের পুণ্য হয়। নৌকো থেকে পাটাতন নামিয়ে দেব, ওই খুঁটিগুলো ধরে ডুব দিয়ে নেবেন। বোলিয়ে ভাইয়া, সির্ফ পচাশ রুপিয়া হর আদমি কে লিয়ে। আচ্ছা আপলোগ চালিশ হি দীজিয়ে।'
পাগল না পেট খারাপ! বিকেল পাঁচটায় ট্রেন ধরতে হবে, একটা বেজে গেছে, এখন জামা-কাপড় ভেজাই আর কী! বলা-বাহুল্য আমরা কেউই রাজি হলাম না। মাঝি আর তার অ্যাসিস্টেন্ট দুজনেই বেশ মনঃক্ষুণ্ন হল, কিন্তু আমরা কেউ দরাদরিতেও গেলাম না। কিন্তু বিপদ এল অন্যদিক থেকে।     

গঙ্গা এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণে বইছে, যমুনা পূব থেকে পশ্চিমে। আমরা আছি গঙ্গার পশ্চিম আর যমুনার উত্তরের মাঝের জায়গায়। 'গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল'- বলা হয়ে থাকে, তবে বেনারসে গঙ্গা আবার উত্তরবাহিনী। কাশী বা বারাণসীতে গঙ্গা দেখতেই যায় বটে সবাই, কিন্তু বারাণসী নামটা এসেছে বরুণা আর অসী নদীর থেকে। একসময় অসী হয়ত বেশ চওড়া স্রোতস্বিনী নদীই ছিল, আজ তার অবস্থা একটা নালার মত। বরুণা কাশীর উত্তরে আর অসী দক্ষিণে গঙ্গায় এসে মেশে। গঙ্গামাহাত্ম্যের কাছে ম্লান আজ এদের নাম, হয়ত শুধু বইয়ের পাতাতেই দেখি- 'বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস, স্বচ্ছসলিলা বরুণা' (সামান্য ক্ষতি)। অসী আর গঙ্গার সঙ্গমের কাছে অসীঘাট আর তুলসী-ঘাট, যেখানে বসে তিনি রামচরিতমানস লেখেন, দেহও রাখেন-
"সম্বত সোলহশো আসসি, অসী গঙ্গা কে তীর।
সাওন শুক্লা সপ্তমী, তুলসী ত্যজয়ো শরীর।।"
 তবে গঙ্গার পশ্চিমকূল বলে নয়,
 প্রয়াগ-মাহাত্ম্য নিজগুণেই বারানসীর চেয়ে কম কী!
যাক, নৌকো এদিকে পৌঁছে গেছে সঙ্গমস্থলে। এতক্ষণ যমুনা বেশ চওড়া ছিল, কিন্তু গঙ্গা এত শীর্ণ কেন? 'কিঁউ নহি হোগা, গঙ্গাজী নে ইতনি মিট্টি লাঈ, সঙ্গমস্থল পর জলোঢ় দ্বীপ বন গয়া জো!' তাই তো। একটা বিশাল দ্বীপ ঠিক সঙ্গমের মাঝামাঝি। কিন্তু জলোঢ় জিনিষটা কী? জানা গেল তার অর্থ - জল দ্বারা ঢোয়ী মিট্টি। বুঝলাম, এটা alluvial island বা পাললিক দ্বীপ। দ্বীপজুড়ে সাধুসন্তদের অজস্র তাঁবু পড়ে নাকি কুম্ভমেলায়। দেখি যমুনার ঘন নীল জল যেখানে শেষ হয়েছে, গিয়ে মিশেছে গঙ্গায় সাদা ঘোলাটে জলের স্পষ্ট একটা রেখা দেখা যাচ্ছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে দুই নদীর পার্থক্য। তারপর যমুনা আর নেই, আর সরস্বতী? সে নাকি ভূগর্ভ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশছে দুই নদীতে। কিন্তু জলের রঙের এই তারতম্য কেন? ঈশ্বর ঝায়ের অনেক জ্ঞান, বলল, এদেরকে শুধোস না, ব্যাটারা ঈশ্বরের লীলা-টিলা বলে বুঝিয়ে দেবে। আসলে এখানে যমুনা প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর বলে ঘননীল আর গঙ্গা পলিমাটির কারণে আর মাত্র চারফুট গভীর বলে এরকম ঘোলাটে। ঠিক সঙ্গমে সবাই স্নান করতে চায় বলে নৌকো বাঁধার সারিসারি খুঁটি পোঁতা ছিল। এখন শুনলাম চেন-টেনের ব্যবস্থা করেছে, আমরা তেমন কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না।      
নৌকোর দুই মাঝি আর ছোকরা খালাসি দেখলাম বেশ চৌখস, ভাল হিন্দিও বলে, ভোজপুরি ঘেঁসা নয়। হঠাৎ একজন আমাদের জাত জিজ্ঞেস করল। পাঁচজনই ব্রাহ্মণ শুনে খুব খুশি ওরা, কেন ঠিক বুঝলাম না। তখন আমরা চল্লিশ ফুট গভীরতার যমুনায় ভাসছি। ছেলেটা বলে, 'বাবুজি আপলোগ ব্রাহ্মণ হ্যাঁয়, গঙ্গামাতা কো পূজা তো চঢ়াকে হি জাইয়ে।' মানে? কোথায় মন্দির, কোথায় পূজারি, এই মাঝ-নদীতে কিভাবে পুজো করব? হ্যাঁ, আরেকটা নৌকো চলেছে বটে আমাদের সাথে সাথে প্রায়, কিন্তু তাতে কী?
That was the key! বুঝলাম, আর ভালভাবেই বুঝলাম। সঙ্গম দেখে দিলখুশ, মনের আনন্দে গুনগুন করছি-
"মিলবে না কি মোর বেদনা তার বেদনাতে-
গঙ্গাধারা মিশবে নাকি কালো যমুনাতে গো......"
হঠাৎ ঘটাং-ঘট। কেঁপে উঠল আমাদের নৌকো। চমকে পেছন ফিরে তাকালাম সকলে।    

একটা অন্য নৌকো এসে ঠেকেছে আমাদের নৌকোর গায়ে। ঝপ-ঝপ করে তার থেকে লাফিয়ে আমাদের নৌকোয় এসে নামল ষণ্ডাগোছের তিনজন মানুষ, গায়ে নামাবলী, মাথায় বিশাল টিকি। 'গঙ্গা-যমনা-সরসতী মাইয়াকো কিরপা করকে পূজা চড়াইয়ে, বিলকুল কম খর্চে মে'- দাবী তাদের। বলছে বটে কৃপা করে, সেই মুন্নাভাইয়ের 'বিনম্রতা সে'র মত করে, কিন্তু গলার টোনে আর ভাবভঙ্গীতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওদের প্রত্যাখ্যান করলে মাঝনদীতে নৌকাডুবি হয়ে পাঁচটি প্রাণ যাওয়াও বিচিত্র নয় তেমন। তবু সমীর বলে- 'উসব নহি হোগা, হামলোগ স্টুডেন্ট হ্যাঁয়, ফালতু প্যায়সা নেহি কিসিকে পাস।'
ওরা যেন অন্তর্যামী। জানে যে একেবারে নিঃস্ব নই আমরা। তাই একটু কায়দা করে বলে, দেখুন, এখানে তো বারবার আসবেন না। তাছাড়া আপনারা পাঁচজনেই ব্রাহ্মণ (কিকরে বুঝল কে জানে, নিশ্চয় আমাদের মাঝি কিছু ইশারা করেছিল), ঘরে ফিরে গেলে মা-বাপকে কী বলবেন? কমসে কম পাও সের লাড্ডু আউর এক-এক নারিয়েল তো চঢ়াকে যাইয়ে!
আমার ইচ্ছে ছিল না, রবিরও। কিন্তু অশোক আর সমীর কী ভেবে রাজি হয়ে গেল, আর তাই দেখে ঈশ্বরও। অগত্যা আমি আর রবিও হ্যাঁ বলে দিলাম, একযাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন! ভাবলাম নারকেল বড়জোর একটাকা আর একপোয়া লাড্ডু পাঁচটাকা, আর কত হবে? গোটা দশেক খরচ করে যদি কিছুটা পুণ্য পাওয়া যায়, ক্ষতি কী?
হ্যাঁ বলতেই মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে বসিয়ে দিল আমাদের পাঁচজনকে, তারপরে হাতে কিছু ফুল-বেলপাতা আর একটা করে ভিজে নারকেল ধরিয়ে দিল। নারকেলগুলো ভিজে কেন? 'উ ছই কে নীচে রখে থে না, ভিঁগ গয়া'- জবাব এল। পাঁচখানা করে বোঁদের লাড্ডু পাতার ঠোঙায় করে রাখা হল। ওদের মধ্যে যে একটু ভদ্রগোছের, মনে হল তিনিই আসল পুরোহিত, বাকি দুজন গুণ্ডা বা পাণ্ডা- বিড়বিড় করে শঙ্করাচার্যের লেখা গঙ্গাস্তোত্র আউড়াতে শুরু করলেন-
"
দেবি! সুরেশ্বরি! ভগবতি! গংগে ত্রিভুবনতারিণি তরলতরংগে | শংকরমৌলিবিহারিণি বিমলে মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ‖"       
এটুকু শুধু বোঝা গেল, তারপরের কথাগুলো যা শুনলাম- "হুঁ হুঁ হুম 
হুঁ হুঁ হুম হুঁ হুঁ হুম হুম হুম......" ইত্যাদি, মানে আর কিছু ওর মনে নেই, দরকারই বা কিসের! নাম-ধাম-গোত্র বলে পুজো দেওয়া হল। এরপর বলা হল নারকেলগুলো সঙ্গমের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। ও বাবা! যেই না ছুঁড়ে ফেলা, সামনের খুঁটিগুলোতে নোঙর-করা একটা নৌকো থেকে দুটো নুলিয়া-টাইপের বাচ্চা লাফিয়ে পড়ল জলে আর মুহূর্তে সাঁতার কেটে পাঁচখানা নারকেলই তুলে এনে পাণ্ডাদের নৌকোয় রেখে এল। এতক্ষণে ভেজা নারকেলের রহস্য উদ্ধার হল।

সব শেষে টাকা দেওয়ার পালা। হিসেব করে সে ব্যাটা বলে কিনা তিনশো পঁচানব্বই টাকা! কিভাবে? 'পাঁচ গুনা আট- চালিশ নারিয়েল কা, পচাস করকে পাও সের লাড্ডু পাঁচ-লোগ কে ঢাই শো, পাঁচ গুণে ইক্বিশ একশো পাঁচ রুপিয়া পূজা কে লিয়ে। পরনামি ভি থোড়া দে দিজিয়ে অলগ সে।' 

মহা তর্ক লেগে গেল। বাজারে বিশ টাকা কিলো লাড্ডু, নারকেল দু-টাকা, তাও ফেরৎ পেয়ে গেছো। বহু ঝগড়া-ঝাঁটি, ভীতি-প্রদর্শন সবকিছুর পর রফা হল একশো এক টাকায়, নিয়ে বিদায় হল ওরা। হ্যাঁ, একটা করে নাড়ু রেখে চারটে করে প্রসাদ আর কিছু ফুল ফেরত দিয়েছিল। তারপর স্টেশনে ফিরে আসতে কোন ঝামেলা হয় নি। ফেরার সময় সঙ্গমের হনুমান মন্দিরের শায়িত হনুমানজির একনজর দর্শন করে নিয়েছিলাম, তিনি আর কোন বাগড়া দেন নি। তবে টাঙ্গায় ওঠার পর দিলাওয়র ভাই সব শুনে বলল- 'আপলোগকো সংকটমোচন শ্রীহনুমানজি কা দর্শন পহলে কর লেনা চাহিয়ে থা, ফির সঙ্গম-দরশন মেঁ কোই সংকট নহি আতা।

'আমাদের সফরের সেরা অভিজ্ঞতা কী হল বলত?' স্টেশনে ফিরে রবিশংকর বলল। 'টাঙ্গাওয়ালা দিলাওয়র হুসেনের হিন্দু-শাস্ত্রের জ্ঞান।'
বাকি সবাই একযোগে ঘাড় নাড়লাম। অশোক বলল- 'এহি হ্যায় ইন্ডিয়া!'
      

Friday, November 13, 2020

হ্যালোইন- গল্প

 হ্যালোইন
(গল্প)

গত বছরের ৩১শে অক্টোবর, বিকেল পাঁচটা। বেল শুনে দরজা খুলে দাঁড়াতেই প্রায় মুর্ছা খেলাম। এরা কারা? ভয়ানক-দর্শন পাঁচজন, তবে সাইজে ছোট, চার-সাড়েচার ফুট একেকজন। ওরা আমাকে ভয় পেতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠতেই মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। মুখোস পরা আর মুখে চোখে রঙকরে ভূত সাজা পাঁচটি বাচ্চা, পাড়ারই, নিশ্চয় দেখেছি নীচের মাঠে বা পার্কে খেলতে। 
- 'আঙ্কল, ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে! হ্যালোইন, হ্যালোইন- চকোলেট খাওয়াও', ওরা আমাকে ঘিরে লাফাতে লাগল। ও মা, ওদের মধ্যে একজন আবার দেখি মাথায় একটা কুমড়োর খোল চাপিয়ে এসেছে, নাক-মুখ-চোখের জায়গায় ফুটো করা।

এই হয়েছে এক ঝামেলা। আজকালকার এদেশি বাচ্চারা সরস্বতী পূজো, মকর-সংক্রান্তি, ভূত-চতুর্দশীর কথা মনে রাখে না, কিন্তু ভ্যালেন্টাইন ডে, ঈস্টার, বক্সিং ডে, থ্যাঙ্কসগিভিং, ফ্রেন্ডশিপ ডে- সবকিছুর হিসেব রাখে। বছর কয়েক হল ইউরোপ-আমেরিকার খ্রীস্টান সমাজের দেখে অল সেন্টস ডের আগের সন্ধেয় প্রেতাত্মাদের মর্তে আসার উৎসব হ্যালোইন নিয়ে মেতেছে এরা। ওদের দেশে হেমন্ত বা fallএর এই সময়টা নাকি ভূতপ্রেতরা মুক্তি পাবার আগে একবার বাসায় ফেরে, ক'টা দিন সর্বত্র ভূতের উপদ্রব হয় বলে সবাই ঘরে আলো সাজায়, ক্যাম্প-ফায়ার করে। আসলে হয়ত এটা ফসল কাটার প্রস্তুতি হিসেবে একটা হার্ভেস্ট ফেস্টিভাল, বা অন্য কিছুও হতে পারে। আমরা তো চিরকালে নকলনবিশ, আমাদের বাচ্চারা তাই ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার কায়দায় কুমড়োর খোলে চোখ-মুখ এঁকে ভূত সাজানো, ঘরে বা ক্লাবে ভৌতিক আলো-আঁধারির পরিবেশ তৈরি- এসবে বেশ রপ্ত হয়ে, ঘর থেকে নিজেরাও ভূত সেজে এসে পাড়ার ছোট-বড়দের ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। ভয় পেলেই চকলেট খাওয়াও, না থাকলে পয়সা দাও কিনতে। 

- 'ওরে দাঁড়া, দাঁড়া! বাড়িতে কি চকোলেট মজুত থাকে নাকি? আমাদের বাসায় কি ছোটছেলে আছে? ঘন্টাখানেক পরে আসিস, এনে রাখব।' ওরা চলে যেতেই গায়ে জামাটা গলিয়ে পাড়ার দোকান থেকে পাঁচখানা ক্যাডবেরির চকোলেট কিনে নিয়ে এলাম। 

সন্ধের পর আটটা নাগাদ ওরা এল। আমি চকোলেটগুলো এনে দিতেই ওদের একজন বলে উঠল- 'আঙ্কল, পাঁচটা কেন? আমরা তো চারজন!'
- 'কেন ওই ছেলেটা কই, সেই যে পামকিন-হেড সেজেছিল মাথায় কুমড়ো পরে? সবচেয়ে বাচ্চা তো ওটাই ছিল!'
- 'আঙ্কল কী যে বলে না! সারা বিকেল আমরা চারজনেই ঘুরছি।' বলে একটা চকোলেট আমাকে ফেরৎ দিয়ে ওরা হৈচৈ করতে করতে চলে গেল। আমিও ক্যাডবেরিটা নিয়ে আর কী করব ভেবে ফ্রিজে রেখে দিলাম।

মাঝরাতে সেদিন কেন জানিনা খিদে পেয়ে গেল। আসলে আমিও একটা বুড়ো বাচ্চা তো! ফ্রিজে আস্ত একটা চকোলেটের বড় প্যাকেট রাখা আছে, সেটা আর ভুলে থাকতে পারছিলাম না। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুললাম। একি! চকোলেট তো নেই কোথাও।

শুধু ফ্রিজের হ্যান্ডেলে দেখতে পেলাম স্পষ্ট দুটো ছাপ, চকোলেট মাখানো ছোট ছোট দুটো হাতের। 


Friday, October 16, 2020

পুরুলিয়ায় মাইকেল- প্রবন্ধ।

পুরুলিয়ায় মাইকেল 


ভূমিকা।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের (২৫শে জানুয়ারি, ১৮২৪ - ২৯শে জুন, ১৮৭৩) স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়ি, কলকাতা, মাদ্রাজ, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ডের খবর অনেকেই রাখে, কিন্তু তাঁর হ্রস্ব জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যে বাংলার স্বল্পখ্যাত, ব্রাত্যই বলা যায়, মানভূম-পুরুলিয়ায় কেটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ অনেকেই হয়ত জানেন না। গুণীজনের জ্ঞাতার্থে পুরুলিয়া-বিশেষজ্ঞ ও গবেষক শ্রী দিলীপকুমার গোস্বামীর সাহায্য নিয়ে (তাঁর অনুমতিক্রমে) কিছু আলোচনা করছি।
পুরুলিয়ার পঞ্চকোট ভারতের অন্যতম প্রাচীনতম রাজবংশ। ৮০ খ্রীষ্টাব্দে মধ্যভারতের ধার রাজবংশের ভ্রমক্রমে পরিত্যক্ত ও মানভূমের ঝালদার কিছু আদিবাসী সর্দারদের হাতে পালিত সন্তান দামোদরশেখর বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে শিখর রাজবংশের পত্তন করেন। একসময় এই বংশের রাজারা 'সিংদেও' উপাধি গ্রহণ করেন। তারপর দীর্ঘ ১৮০০ বছরে সাতবার রাজধানী পরিবর্তন হয়ে পঞ্চকোটের রাজধানী কাশীপুরে স্থানান্তরিত হবার পর তৎকালীন মহারাজা নীলমনি সিংদেওএর আমন্ত্রণে মাইকেল মধুসূদন আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার হিসেবে এস্টেটের একটি মামলা লড়তে নিযুক্ত হন ও ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দুই সপ্তাহের জন্যে একবার, তারপর মার্চে এসে প্রায় সাড়ে-পাঁচ মাস কাল পুরুলিয়ায় অতিবাহিত করেন। এরপর কলকাতা ফিরে তিনি আর বেশিদিন বাঁচেন নি, ১৮৭৩এর ২৯শে জুন প্রয়াত হন।
আমার এই রচনার উদ্দেশ্য কিন্তু মহাকবির পুরুলিয়া-বাসের বিশদ বিবরণ জানানো নয়, তাঁর এই ছয়মাস পুরুলিয়াবাসের কাল বাংলা সাহিত্যকে কিভাবে আর কতটা পুষ্ট করেছে সেটুকুই আমাদের আলোচ্য এখানে। এই সময়কালে কবি মোট সাতটি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট ও অন্য কবিতা লিখেছেন যা তাঁর একটি স্থানের উপরে লেখা সর্বাধিক। পুরুলিয়ার German Evangelic Lutheran Mission দ্বারা প্রতিষ্ঠিত GEL Church কবির প্রথম প্রবাসেই তাঁকে সম্মানিত করে ও খ্রীষ্টদাস নামে একটি যুবকের ধর্মান্তরণ বা ব্যাপ্টিজম অনুষ্ঠানে তাঁকে যুবকটির অন্যতম ধর্মপিতার (Godfather) দায়িত্ব নিতে বিশেষ অনুরোধ জানায়। এই সম্মানে অভিভূত হয়ে তিনি দু'টি কবিতা লেখেন- একটি পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে, অন্যটি সদ্য ধর্মান্তরিত ধর্মসন্তান খ্রীষ্টদাসের জন্য আশীর্বাণী-রূপে। এছাড়া 'পরেশনাথ গিরি' নামে তিনি একটি সনেট লেখেন যদিও পঞ্চকোট থেকে প্রায় ১০০ কিমি পশ্চিমে পরেশনাথ দূর থেকেও দৃশ্যমান হয় না, আর সেখানে যাত্রার কোন প্রামাণ্য তথ্যও পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়বার পুরুলিয়ার স্থতিকালে তিনি আরও চারটি সনেট লেখেন, সেগুলির সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
(১)
পুরুলিয়া।
পাষাণময় যে দেশ, সে দেশে পড়িলে
বীজকুল, শস্য তথা কখন কি ফলে?
কিন্তু কত মনানন্দ তুমি মোরে দিলে,
হে পুরুল্যে! দেখাইয়া ভকত-মণ্ডলে!
শ্রীভ্রষ্ট সরস সম, হায়, তুমি ছিলে,
অজ্ঞান-তিমিরাচ্ছন্ন এ দূর জঙ্গলে;
এবে রাশি রাশি পদ্ম ফোটে তব জলে,
পরিমল-ধনে ধনী করিয়া অনিলে!
প্রভুর কী অনুগ্রহ! দেখ ভাবি মনে,
(কত ভাগ্যবান তুমি কব তা কাহারে?)
রাজাসন দিলা তিনি ভূপতিত জনে!
উজলিলা মুখ তব বঙ্গের সংসারে;
বাড়ুক সৌভাগ্য তব এ প্রার্থনা করি,
ভাসুক সভ্যতা-স্রোতে নিত্য তব তরী।
(* পুরুলিয়ার খ্রীষ্টান-মণ্ডলীকে লক্ষ্য করে লিখিত। কবি-রচিত চতুর্দশপদী কবিতাবলির এটি ১০৫ নং সনেট। পুরুলিয়ার German Evangelic Lutheran (G.E.L.) Mission সংস্থা প্রকাশিত ১৮৭২এর এপ্রিল সংখ্যা 'জ্যোতিরিঙ্গন' পত্রিকায় সনেটটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।)
১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিভিল কোর্টে বাদীপক্ষের হয়ে একটি মামলা লড়তে কবি প্রথম পুরুলিয়া এসেছিলেন। সেই মাসেরই মাঝামাঝি পুরুলিয়ার খ্রীষ্টান সমাজ, যাঁরা মধুসূদনের কবি-খ্যাতি সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন ছিলেন, কবিকে G.E.L. Church-এ একটি সম্বর্ধনা দেন। জীবনের গোধূলিবেলায় হতাশাগ্রস্ত জীবনে এই আশাতীত সম্মান কবির প্রাণে সঞ্জীবনী সুধার সঞ্চার করেছিল, কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে কবি সনেটটি রচনা করেছিলেন।
কবিতাটির ভাষা সরল, তবু কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। পুরুলিয়ার লৌকিক উচ্চারণ 'পুরুল্যা'। এই শব্দের সংস্কৃতকৃত সম্বোধনে 'পুরুল্যে' - এই লৌকিক শব্দটি এক অলৌকিক মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র মহাকাব্য রচয়িতা কবি (হেমচন্দ্রের 'বৃত্রসংহার' নিয়ে বিতর্ক আছে) শ্রীমধুসূদন এই কবিতায় নিজেকে 'ভূপতিত জন' বলেছেন। অতি ব্যক্তিগত অনুভবের এই প্রকাশ বিস্ময়কর। কবিতাটিতে পুরুলিয়াবাসীর প্রতি অজস্রধারে কবির শুভেচ্ছা ও আশীর্বাণী বর্ষিত হয়েছে, যা স্মরণ করে আজকের পুরুলিয়াবাসী অবশ্যই রোমাঞ্চিত হবেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে পুরুলিয়া যাত্রার সামান্য পূর্বে ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কবি একটি মামলার কাজে ঢাকা যান। এই সুযোগে ঢাকাবাসী সাহিত্যপ্রেমী মানুষ কবিকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে কবি লিখেছিলেন ঢাকাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটি সনেট-
"নাহি পাই নাম তব বেদে কি পুরাণে
কিন্তু বঙ্গ-অলঙ্কার তুমি যে তা জানি
পূর্ব-বঙ্গে।......"
বঙ্গভূষণ কবির চরণধুলিতে ঢাকা শহর পবিত্র হয়েছিল। এবার বঙ্গের প্রত্যন্তপ্রদেশের অবহেলিত উপেক্ষিত পুরুলিয়া সেই গৌরবের অধিকারী হল।
(২)
'পরেশনাথ গিরি'
হেরি দূরে ঊর্দ্ধ্বশিরঃ তোমার গগনে, *
অচল, চিত্রিত পটে জীমূত যেমতি।
ব্যোমকেশ তুমি কি হে, (এই ভাবি মনে)
মজি তপে, ধরেছ ও পাষাণ মূরতি?
এ হেন ভীষণ কায়া কার বিশ্বজনে?
তবে যদি নহ তুমি দেব উমাপতি,
কহ, কোন্‌ রাজবীর তপোব্রতে ব্রতী-
খচিত শিলার বর্ম্মকুসুম-রতনে
তোমার? যে হর-শিরে শশীকলা হাসে,
সে হর কিরীটরূপে তব পুণ্য শিরে
চিরবাসী, যেন বাঁধা চিরপ্রেমপাশে!
হেরিলে তোমায় মনে পড়ে ফাল্গুনিরে
সেবিলে বীরেশ যবে পাশুপত আশে
ইন্দ্রকীল নীলচূড়ে দেব ধূর্জ্জটিরে।
(*- লক্ষ্যণীয় যে বাংলা বানান সংশোধনের আগে লেখা বলে প্রাচীন রীতি- যেমন ঊর্দ্ধ্ব, বর্ম্ম, ধূর্জ্জটি লেখা হয়েছে।)
অস্যর্থ- পটচিত্রে আঁকা মেঘমালার মত দূরে উচ্চশৃঙ্গ একটি পর্বত দেখলাম (কবি মধুসূদন ১৮৭২এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার পুরুলিয়া আসেন বরাকর-পুরুলিয়া রোড ধরে। এই রাস্তা থেকে পরেশনাথ পর্বতের ন্যূনতম রৈখিক দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। আজকের দিনে আকাশ পরিষ্কার না থাকলে পর্বতশৃঙ্গ এতদূর থেকে দেখা যায় না, তবে সে যুগে এত ধুলো-ধোঁয়া বাড়ি-ঘর না থাকাতে হয়ত সেটা সম্ভব হয়েছিল। হয়ত ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য পাহাড়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই কবি এর সম্পর্কে এত আনুকূল্য় দেখিয়েছেন। কবির দেওয়া নাম 'পরেশনাথ গিরি' না হলে যে কোন পাহাড় সম্পর্কেই কবিতাটি প্রযোজ্য হতে পারত।)। তুমি কি মহাদেব, তপস্যার প্রভাবে পাষাণমূর্তি ধরেছ? এই পৃথিবীতে তোমার মত ভীষণমূর্তি আর কারো নেই। তুমি যদি শিব না হও, তবে তুমি কোন তপস্যারত রাজবীর? কুসুম-রতনে শোভিত তোমার অঙ্গে শিলার বর্ম কেন? শিবের মাথায় চন্দ্রকলা শোভা পায়, সেই মহেশ তোমার মস্তকে শোভিত হচ্ছেন। এ উভয়ের শাশ্বত বন্ধন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন পাশুপত অস্ত্র লাভের জন্যে হিমালয়ের ইন্দ্রকীল গিরিশৃঙ্গে সাধনা করেছিলেন, তোমাকে দেখলে এই রূপটি স্মরণে আসে।
এটি কবির সনেটমালার ১০৬ সংখ্যক সনেট, সেক্সপীয়ারীয় ও পেত্রার্কীয় রীতির মিশ্রণে এটি গঠিত।

(৩)
'কবির ধর্ম্মপুত্র' (শ্রীমান খ্রীষ্টদাস সিংহ)
হে পুত্র, পবিত্রতর জনম গৃহিলা
আজি তুমি, করি স্নান যর্দ্দনের নীরে
সুন্দর মন্দির এক আনন্দে নির্ম্মিলা
পবিত্রাত্মা বাস হেতু ও তব শরীরে;
সৌরভ কুসুমে যথা, আসে যবে ফিরে
বসন্ত, হিমান্তকালে। কি ধন পাইলা-
কি অমূল্য ধন বাছা, বুঝিবে অচিরে,
দৈববলে বলী তুমি, শুন হে, হইলা!
পরম সৌভাগ্য তব। ধর্ম্ম বর্ম্ম ধরি
পাপ-রূপ রিপু নাশো এ জীবন-স্থলে
বিজয়-পতাকা তুলি রথের উপরি;
বিজয় কুমার সেই, লোকে যারে বলে
খ্রীষ্টদাস, লভো নাম, আশীর্বাদ করি,
জনক জননী সহ, প্রেম কুতূহলে।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৭২, G.E.L. Church-এ কবি মধুসূদন স্থানীয় কাঙালিচরণ সিংহের পুত্র কৃষ্ণদাসের ধর্মান্তরণ(baptism) অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে ধর্মপিতা(God Father) হিসাবে দায়িত্ব-পালনকালে এই সনেটটি উপহার দেন। কবির সাথে আরো একজন ধর্মপিতা ছিলেন ধর্মপ্রকাশ সাগর ও ধর্মমাতা কৃষ্টপ্রসন্ন সাগর। গির্জার রেকর্ড অনুযায়ী কৃষ্ণদাসের বাড়ি ছিল Chorea গ্রাম, সম্ভবতঃ সেটি পুরুলিয়া-সংলগ্ন ছড়রা হবে।
কবির নিজের জীবনে ধর্মান্তরণ মোটেই সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবীর জীবন এই ধর্মান্তরকরণের ফলে দুর্বিষহ হয়ে ছিল, সাজানো সংসার তছনছ হয়ে যায়। তাঁরা উন্মাদবৎ হয়ে প্রয়াত হয়েছিলেন। তাই ধর্মপুত্র খ্রীষ্টদাসকে তিনি আশীর্বাদ দিচ্ছেন পিতামাতার সাথে প্রেমময় জীবন উপভোগ করার।
জেরুজালেম ও ইস্রায়েলে প্রবাহিত পবিত্র যর্দনের (জর্ডন নদীর) জলে প্রভু যিশুর জন দি ব্যাপ্টিস্ট দ্বারা ধর্মগ্রহণ হয়। তার পরবর্তী যে কেউ খ্রীষ্টকে গ্রহণ করতে চায় তাকে জর্ডনে স্নান বা তার পবিত্র জল শরীরে ছিটিয়ে ব্যাপ্টাইজ করা হয়। কবি খ্রীষ্টদাসের উদ্দেশ্যে লিখছেন যে তাকেও এভাবে খ্রীষ্টের সঙ্গে একাঙ্গীভূত করা হল। পবিত্র আত্মাকে ধারণের জন্যে সে যেন দেহমধ্যে এক মন্দির তৈরি করল, যেন শীতের শেষে ফুলের সৌরভ প্রকৃতিতে ফিরে এল। সৌভাগ্যক্রমে কী ধন সে পেয়েছে তা সে অচিরেই বুঝবে। তাকে কবি আশীর্বাদ করছেন যেন এই ধর্মের বর্ম পরে সে পাপ-রূপী রিপুর নাশ করে জীবনযুদ্ধে বিজয় লাভ করে পিতামাতা নিয়ে সুখে জীবন কাটায়।
সনেটটির ক্রম ১০৭, ১৮৭২ নভেম্বর সংখ্যা জ্যোতিরিঙ্গন পত্রিকায় এর প্রথম প্রকাশ।


(৪)
পঞ্চকোট গিরি
কাটিলা মহেন্দ্র মর্ত্ত্যে বজ্র প্রহরণে
পর্ব্বতকুলের পাখা; কিন্তু হীনগতি
সেজন্য নহ হে তুমি, জানি আমি মনে,
পঞ্চকোট ! রয়েছ যে,- লঙ্কায় যেমতি
কুম্ভকর্ণ,- রক্ষ, নর, বানরের রণে-
শূন্যপ্রাণ, শূন্যবল, তবু ভীমাকৃতি,-
রয়েছ যে পড়ে হেথা, অন্য সে কারণে।
কোথায় সে রাজলক্ষ্মী, যাঁর স্বর্ণ-জ্যোতি
উজ্জ্বলিত মুখ তব? যথা অস্তাচলে
দিনান্তে ভানুর কান্তি। তেয়াগি তোমায়
গিয়াছেন দূরে দেবী, তেঁই হে! এ স্থলে,
মনোদুঃখে মৌন ভাব তোমার; কে পারে
বুঝিতে কী শোকানল ও হৃদয়ে জ্বলে?
মণিহারা ফণী তুমি রয়েছ আঁধারে।
পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে শিখরবংশের তৃতীয় রাজধানী ৯৬২ খ্রীঃ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর ধরে বিরাজিত ছিল। তারপর আভ্যন্তরীণ গৃহবিবাদের ফলে রাজবংশ প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়, বালক রাজপুত্র মণিলাল রাজভক্ত এক রাজকর্মচারীর সাহায্যে প্রাণে বাঁচেন। মণিলাল বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে রাজ্য পুনরুদ্ধার করে মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় হয়ে ১৮৩২ সালে কাশীপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পুরুলিয়ার সেশন কোর্টে একটি মামলা লড়তে বাদীপক্ষের আইনিজীবী হয়ে পুরুলিয়া আসেন। সেসময় মহারাজা নীলমণি সিংদেও কাশীপুরে শিখরবংশী শাসক ছিলেন। তিনি মাইকেলের সুখ্যাতি শুনে কলকাতায় লোক পাঠিয়ে তাঁর একটি মামলার পরামর্শ দিতে আইন-উপদেষ্টা করে কাশীপুরে আমন্ত্রণ জানান। কবি সেসময় ঋণভারে জর্জরিত, জীবনযুদ্ধে প্রায় পরাজিত হতোদ্যম। এই অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণে হতাশাগ্রস্ত কবির জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়, আর্থিক সমস্যারও সাময়িক সুরাহা হয়। তিনি ১৮৭২এর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কাশীপুর রাজসভায় এসে কাজে যোগদান করেন। অকস্মাৎ এই ভাগ্য পরিবর্তনে উচ্ছ্বসিত কবি এসেই পঞ্চকোট রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়ন করলেন, আর এই রাজ্যের গৃহদেবতার বা রক্ষক-প্রহরীর মত শায়িত পঞ্চকোট গিরিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে এই সনেটটি লিখলেন। এটি ১০৮ নং সনেট, পুরুলিয়া বিষয়ে কবির চতুর্থ যদিও রচনার সঠিক তারিখের কোনও উল্লেখ নেই।
যদিও কবির হতাশ ভাব তখনও তাঁকে পশ্চাদ্ধাবন করে চলেছে, এই সনেটে তা প্রচ্ছন্ন, প্রকট নয়। তাঁর প্রতি কাব্যে, সাহিত্যে ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি তাঁর জ্ঞান আর আকর্ষণের প্রমাণ দেখা যায়। পুরাণের মতে পর্বতের এককালে পাখা থাকত, তারা উড়তে পারত। ইন্দ্রদেব তাই সব পর্বতের পাখা কেটে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথের পংক্তি- 'পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ', হয়ত এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, তবে হিমালয়-পুত্র মৈনাক যে সেই ভয়েই যে সমুদ্রের গর্ভে আশ্রয় নেয় তা পুরাণে আছে। তবে কি সুপ্ত কুম্ভকর্ণের মত বিশাল পঞ্চকোট সেই কারণেই হীনবল আজ? কবির বক্তব্য, তা সত্য নয়। পঞ্চকোট একদা রাজলক্ষ্মীর স্বর্ণজ্যোতিতে উজ্জ্বল হত। সেই লক্ষ্মী পঞ্চকোটকে পরিত্যাগ করেছে বলেই তার আজ এই ম্লান দশা, মনোদুঃখে সে মৌন হয়েছে, মণিহারা নাগের মত একাকী অন্ধকারে বিরাজ করছে। তার হৃদয়ের শোকানল প্রবল দহন সৃষ্টি করেছে, একথা কেউ বুঝতে পারছে না।


(৫)
পঞ্চকোটস্য রাজশ্রী
হেরিনু রমারে আমি নিশার স্বপনে;
হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে-
পদ্মাসন উজলিত শতরত্ন-করে,
দুই মেঘরাশি-মাঝে, শোভিছে অম্বরে,
রবির পরিধি যেন। রূপের কিরণে
আলো করি দশ দিশ; হেরিনু নয়নে,
সে কমলাসন-মাঝে ভুলাতে শঙ্করে
রাজরাজেশ্বরী, যেন কৈলাশ-সদনে।
কহিলা বাগ্‌দেবী দাসে (জননী যেমতি
অবোধ শিশুরে দীক্ষা দেন প্রেমাদরে),
"বিবিধ আছিল পুণ্য তোর জন্মান্তরে,
তেঁই দেখা দিলা তোরে আজি হৈমবতী
যেরূপে করেন বাস চির রাজ-ঘরে
পঞ্চকোট;- পঞ্চকোট- ওই গিরিপতি।"
পঞ্চকোটের গৌরবময় ইতিহাসের কাহিনী শ্রীমধুসূদনের কবি মনে এক রোমান্টিসিজমে ঘেরা কল্পলোক তৈরি করেছিল। কাশীপুরের স্বল্পসময়ের বাসেও তিনি যেন শয়নে-জাগরণে স্বপ্নের মত সেই অতীতকে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতেন। এই সনেটের মধ্যেও একটি উৎকৃষ্ট কবিকল্পনা আছে। পঞ্চকোট রাজবংশের আরাধ্যা দেবী রাজরাজেশ্বরী কবিকে যেন রাজ্যের প্রাচীন গৌরবময় কোন এক মুহূর্তসহ দেখা দিয়েছেন।
কবি 'নিশার স্বপন' কথাটির এখানে উল্লেখ করেছেন। তবে আমার মনে হয় নব বর্ষার মেঘমালায় ঈষৎ আচ্ছন্ন পঞ্চকোট শীর্ষকে কাশীপুর বা তার নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে প্রত্যক্ষ করে কবির মনে এই অদ্ভুত ভাবের সমাবেশ হয়। কালিদাসের 'মেঘদূতম্‌' কাব্যে বর্ণিত আছে এরকম একটি মুহূর্ত-
'আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং।
বপ্রক্রীড়া পরিণতং গজপ্রেক্ষনীয়ং দদর্শ।।'
এই বপ্রক্রীড়া সাধারণ মানুষের মনে তেমন কোন ভাবের সঞ্চার না করলেও, কবির রোমান্টিক মনে তার গভীর প্রভাব ফেলতেই পারে। শোনা যায় কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে আমাদের পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পর্যন্ত এধরণের অলৌকিক সৌন্দর্য দেখে ভাব-সমাহিত হতেন। আর মধু-কবি এই মেঘময় হস্তীযূথের শুঁড়ে শুঁড় মিলিয়ে খেলার মাঝে ভাববিভোর হয়ে প্রত্যক্ষ করলেন দেবী লক্ষ্মীকে। মহেশের রূপে সাক্ষাৎ মূর্ত গিরিপতি পঞ্চকোট পর্বতের কোলে তিনি বিরাজিত। মেঘরাশির মাঝে দূর আকাশে তাঁর রূপমাধুরী শোভা পাচ্ছে, তাঁর রূপে দশদিক আলোকিত। পঞ্চকোট-রাজ্যের আরাধ্যা দেবী রাজরাজেশ্বরী রূপ নিয়ে দেবী হৈমবতী ভোলানাথ শঙ্করের মনোলোভনের জন্যে যেন কৈলাসে উপস্থিত আর কবির জন্ম-জন্মান্তরের অর্জিত অসীম পুণ্যবলে তাঁর মানসপটে এই দৃশ্য আজ ধরা পড়েছে।
এই কবিতাটি ১১০ নং সনেটরূপে প্রকাশিত।


(৬)
পঞ্চকোট-গিরি বিদায় সঙ্গীত।
হেরেছিনু, গিরিবর! নিশার স্বপনে,
অদ্ভূত দর্শন!
হাঁটু গাড়ি হাতী দুটি শুঁড়ে শুঁড়ে ধরে,
কনক-আসন এক, দীপ্ত রত্ন-করে
দ্বিতীয় তপন!
সেই রাজকুলখ্যাতি তুমি দিয়াছিলা,
সেই রাজকুললক্ষ্মী দাসে দেখা দিলা,
শোভি সে আসন!
হে সখে! পাষাণ তুমি, তবু তব মনে
ভাবরূপ উৎস, জানি উঠে সর্ব্বক্ষণে।
ভেবেছিনু, গিরিবর! রমার প্রসাদে,
তাঁর দয়াবলে,
ভাঙা গড় গড়াইব, জলপূর্ণ করি
জলশূন্য পরিখায়; ধনুর্ব্বাণ ধরি দ্বারিগণ
আবার রক্ষিবে দ্বার অতি কুতূহলে।
কাব্য বিচারে এটি সনেট নয়, সনেট-কল্প কবিতা।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পুরুলিয়ার কাশীপুরে পঞ্চকোট মহারাজার নীলমণি সিংদেওয়ের রাজসভায় সম্মাননীয় রাজকর্মচারী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসকাল তিনি সেখানে অবস্থান করেন। এই সময় কবি অবসরকালে পঞ্চকোট ইতিহাসের সম্যক চর্চা করেন। পঞ্চকোটের গৌরবগাথা শুনে তাঁর মনে তৈরি হয় এক কল্পলোক। ইতিহাসের উজ্জ্বল কালের যে খণ্ডগুলি কবির মনে রেখে গেছে গভীর প্রভাব, শয়নে-স্বপনে সেই কল্পলোকের হাতছানি তাঁর মনোভূমে দোলা দেয়। এক নিশীথে অদ্ভূত এক দৃশ্যপট কবির সামনে মূর্ত হয়। পঞ্চকোট পর্বতের পশ্চাদ্‌পটে দুটি হাতি যেন শুঁড়ে শুঁড়ে ধরাধরি করে রাজসিংহাসনে উপবিষ্টা রাজলক্ষ্মীর সম্মুখে বসে রয়েছে, রাজ্যের কুললক্ষ্মী দেবী রাজরাজেশ্বরী যেন অসীম করুণা-বশে কবির মনশ্চক্ষে ধরা দিয়েছেন।
এই কয়েকমাসের মধ্যে এই পঞ্চকোট পাহাড়, এই রাজ্য কবির সঙ্গে যে সখ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, কবির মনে তাদের সান্নিধ্য নানা ভাবের উৎস ছিল। তিনি আজ তাদের বিদায় জানাচ্ছেন। কবির স্বপ্ন ছিল পঞ্চকোটের গৌরবময় ইতিহাসকে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাজগড় নতুন করে গড়াবেন, ১২ বর্গমাইল ব্যাপ্ত রাজধানীর তিনদিক ঘিরে যে পরিখা ছিল সেগুলিকে আবার জলপূর্ণ করবেন। রাজধানীতে চারধারে চারটি তোরণ ছিল- দুয়ারবাঁধ, বাজার মহল দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার আর আঁখ দুয়ার- তিনি কল্পনা করছেন ওই তোরণগুলির সামনে ধনুর্বাণ নিয়ে দ্বারীরা পাহারা দেবে।
কিন্তু বাস্তব অতি নির্মম। কঠিন বাস্তব এসে স্বপ্নকে আঘাত করে, কল্পলোক চুরমার হয়ে যায়। তবু কবির এই স্বল্পকালের প্রবাসে তিনি তিনটি কবিতায় পঞ্চকোটের কালজয়ী মহিমাকে কাব্যে অমর করে রেখেছেন, মহিমান্বিত করেছেন এখানকার মাটি, বাতাস, পাহাড়, জল, আকাশ ও মানুষকে। এই গৌরব পুরুলিয়ার, পঞ্চকোট রাজ্যের। এই ভূমিখণ্ড তাঁর লেখনীর জাদুস্পর্শে চিরজীবি হয়ে থাকে।


(৭)
হতাশা-পীড়িত হৃদয়ের দুঃখধ্বনি।
ভেবেছিনু মোর ভাগ্য, হে রমাসুন্দরি,
নিবাইবে সে রোষাগ্নি,-লোকে যাহা বলে,
হ্রাসিতে বাণীর রূপ তব মনে জ্বলে;-
ভেবেছিনু, হায়! দেখি, ভ্রান্তিভাব ধরি!
ডুবাইছ, দেখিতেছি, ক্রমে এই তরী
অদয়ে, অতল দুঃখ সাগরের জলে
ডুবিনু; কি যশঃ তব হবে বঙ্গ-স্থলে?
এটিও সনেট নয়, একটি সনেটকল্প কবিতা। এতে কবি মধুসূদনের বিড়ম্বিত জীবনের যন্ত্রনাময় ছবি প্রতিভাত হয়েছে। শেষ জীবনে প্রায় ঋণভারে জর্জরিত কপর্দকশূন্য অবস্থায় কবি কাশীপুর মহারাজা নীলমণি সিংদেওএর এস্টেটে আইন-উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। সেখানে একজন ব্যারিস্টার রূপে তাঁকে এস্টেটের জটিল মামলাগুলি দেখতে হত। এমনি একটি মামলায় মহারাজ কলকাতা হাইকোর্টে পরাজিত হন। আইনের চোখে রাজার তরফে কেসটি দুর্বল ছিল, তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেও মধুসূদন মামলা জেতাতে পারেন না। এতে রাজার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে যার ফলস্বরূপ কবিকে চাকরি খুইয়ে পঞ্চকোট রাজ্য ছাড়তে হয়। এই চাকরিকে ঘিরে কবির অনেক প্রত্যাশা ছিল যে তিনি ঋণমুক্ত হয়ে আবার সম্মানের জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। ভাগ্যদোষে সে স্বপ্ন তাঁর পূরণ হল না।
এই কবিতাটি সাত পংক্তির, আমার মনে হয় এটি অসম্পূর্ণ, কেমন যেন মধ্যখান থেকে শুরু হয়েছে। গঠনে এটি একেবারে সনেটের মত। হয়ত এটি একটি পরিপূর্ণ সনেট ছিল যার প্রথম সাতটি চরণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য কবির হতাশা অবশিষ্ট সাত পংক্তিতেই পরিস্ফুট। বেশ বোঝা যায় লক্ষ্মীর সঙ্গে বাণী অর্থাৎ সরস্বতীর বিবাদ নিয়ে কবিতার শুরু। কবি মনে করছেন, যেহেতু তিনি বাণীর সাধনা করেন মানে কাব্যরচনা করেন, ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রমা (লক্ষ্মী) তাঁর প্রতি চিরকাল রুষ্ট, জীবনে তিনি কোনদিনই লক্ষ্মীর কৃপা পান নি। তবে কাশীপুরের চাকরি আর রাজ-অনুগ্রহ পেয়ে তাঁর মনে আশা হয়েছিল এবার হয়ত সেই রোষ শান্ত হবে, ভাগ্যের অনুগ্রহে তাঁর জীবনজুড়ে নেমে আসা বিপর্যয়ের অন্ত হবে। কিন্তু তা হয়নি, কবির ভাগ্যতরী দুঃখের সাগরজলে নিমজ্জিত হল। এই বঙ্গভূমিতে যাঁর প্রাপ্য ছিল অসীম যশ ও মর্যাদা, সেই মহাকবির জীবনে ঘনিয়ে এল দুর্বিপাক। তিনি যশ তো পেলেন না, স্বস্তিও পেলেন না।
শেষ।

Saturday, August 22, 2020

ঈশ্বর-দর্শন। (বিশেষ রচনা)

ঈশ্বর-দর্শন।
(বিশেষ রচনা)

খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক সন্তোষ সেনগুপ্ত তাঁর ‘আমার সঙ্গীত ও আনুষঙ্গিক জীবন’ বইয়ে গ্রামোফোন কোম্পানির একজন বড়কর্তা হিসেবে লিখেছেন, "কমবয়সে দেবব্রত বিশ্বাসের গলা এমন একটা দরাজ, বিশাল আর সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল যে গ্রামোফোন কোম্পানির বাপের সাধ্যি নেই তা রেকর্ডে ধরে রাখে।”

তাহলে তো লাইভ শুনতে হয়। আমাদের অল্পবয়সে দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। কিন্তু ঈশ্বরকে পাই কোথা? ভাবতাম কলকাতার বাসিন্দারা ভাগ্যবান, চাইলেই তাঁকে দেখতে পান। আমি থাকি অনেক দূরে, জানিনা ভগবানের ঠিকানা। তাছাড়া খবর পেয়েছি যে তিনি তখন ব্রাত্য, তাঁকে গান গাইতে দেওয়া হয় না, ১৯৭১ সাল থেকে তিনি আর রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেন না, জলসায়-অনুষ্ঠানে যান না। ভাবতাম এটা কি ইংরেজ শাসনের প্রলম্বন, যে সম্ভাবনার কথা নজরুল লিখে গেছিলেন তাই কি সত্যি হল!
'হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি, সর্বনাশী শেখায় এ হীন তথ্য কে রে?'
তাহলে? ১৯৭৮এ হঠাৎই সুযোগ হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখতে যাওয়ার, আমাদের এক বন্ধুর হোস্টেলের অতিথি হয়ে। অজয়-ময়ূরাক্ষী-দামোদরের বন্যার বছর সেটা, বাসে ইলামবাজার পেরোবার সময় গাছের ডালে গরুর কংকাল ঝুলতে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। সেদিন ৭ই পৌষ সন্ধ্যেয় মেলা তখনও জমে নি তেমন। ফেরার পথে স্টেট ব্যাঙ্কের দরজার মুখে সিঁড়িতে এক মাতালকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। বন্ধু বলল, প্রণাম কর, ইনি রামকিংকর বেইজ। সত্যি, কি নেশা আছে এখানকার জলে-হাওয়ায়-মাটিতে দুনিয়ার যত পাগল-মাতাল-নেশাখোর বলরামের চেলারা ভীড় করেছেন এখানে। আমাদের এই ভগবানও তো পাগল, বুঁদ হয়ে আছেন এক অনন্য নেশার বন্ধনে, তার নাম রবি ঠাকুরের গান।
সকালে পৌষালু শীতের কবল থেকে বেরোতে একটু সময় লেগে গেল। মেলার মুখে দেখি আরে, রবি ঠাকুর বেহালা নিয়ে বসে বাজাচ্ছেন- 'তোমার খোলা হাওয়া'। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, ইনি রবি ঠাকুর হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। ইনি হয়ত দাদাঠাকুর বা ধনঞ্জয় বৈরাগী বা 'অচলায়তন' ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই গুরু। বিশ্বভারতীর স্টলে দূর থেকে দেখছি খুব ভীড়। একজন গেরুয়া পরা ভদ্রলোক খোলা গলায় গাইছেন-
"কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সংকেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।"
মনে হল এই শীতের সকালে যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। না, কাছে গিয়ে দেখি সুচিত্রা মিত্র আর অশোকতরু বসে আছেন। জানা গেল, দেবব্রত বিশ্বাস এইমাত্র স্টল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, ঈশ্বরকে পেতে যে সাধনার প্রয়োজন তা হয়ত আমার ছিল না।

Monday, August 17, 2020

সলিলের গানে দুঃখ-বিরহ। প্রবন্ধ ও আলোচনা

সলিলের গানে দুঃখ-বিরহ।

(প্রবন্ধ ও আলোচনা)


(১)
প্রস্তাবনা।।
ফেসবুকেই সলিল চৌধুরির গানের কিছু বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম একদিন। বিষয় ছিল সলিলের গানের গতিময়তা। না, গতিময়তা বলতে এক্ষেত্রে দ্রুতলয় বা চটুল-ছন্দ বা ভাষার লঘুতার কথা বলছি না, সলিল গানের প্রতিটা বিভাগে রেখেছেন নিজস্বতার স্বাক্ষর। জীবন যে চলার নাম, তা কখনও থেমে থাকে না, দুঃখ-মৃত্যু-বিরহ আসে দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মেই এই জিনিষ কথায় আর সুরে বুঝিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অতুল, দ্বিজেন, রজনীকান্ত আর নজরুল- লয় আর যন্ত্রানুষঙ্গে এক নতুন আঙ্গিক যোগ করলেন সলিল চৌধুরি। আমি শুরু করেছিলাম সলিলের একটি জনপ্রিয় গানের কথা দিয়ে, প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ল আরো নানাকথা, সলিল-সমাধি ঘটেছে এমন কিছু গুণী ব্যক্তির সংযোজন, তর্ক-বিতর্ক ক্রমে সমৃদ্ধ করে তুলল এই সূত্রটি। ভাগ্যক্রমে ফেসবুক সব কিছুই ধরে রাখে, মানে এ পর্যন্ত রেখেছে। তবে আমার পোস্টের চেয়েও যে সমৃদ্ধতর এই আলোচনাচক্র, আর তা যাতে হারিয়ে না যায় তাই সবকিছুকে সংকলিত করে উপস্থাপনা করছি বন্ধুদের জন্যে। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আরো কিছু তথ্য-সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এই রচনা।


ভূমিকা।।
আমাদের দেশের সংগীতে গানের কথার ভাব বা বিষয় অনুসারে গানের স্বভাব, গতি আর মেজাজ নির্ভর করে, সে হিসাবে অধিকাংশ সময়ে রাগ, তাল আর লয় নির্ধারিত হয়। প্রাক্‌-রবীন্দ্র বা রবীন্দ্রোত্তর যুগেও এর খুব একটা অন্যথা হয় নি। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ নিজে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন এ ব্যাপারে, অতুলপ্রসাদ বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কখনও বা নজরুল চমক সৃষ্টি করেছেন মাঝে-সাঝে ব্যতিক্রমী সৃষ্টি দিয়ে। সে প্রসঙ্গে আসার আগে প্রচলিত ধারণা বা প্রয়োগ সম্বন্ধে একটু আলোচনা করে নিই।
হিন্দুস্থানী মার্গসংগীতের এক স্বনামধন্য পণ্ডিত তাঁর কিছু বিদেশী শিষ্যদের নিয়ে ভারতীয় রাগসংগীতের বৈচিত্র্য নিয়ে চর্চা করছেন। তিনি বাদ্যযন্ত্রে ভৈরবীর সুর বাজিয়ে জানতে চাইলেন তাঁদের কী মনে হল। উত্তর এল- কার জন্যে সারারাত অপেক্ষা করলাম, সে এল না। আশ্চর্য! সুরটা ছিল বিখ্যাত বন্দিশ 'কা করুঁ সজনি, আয়ে না বালমা'র। তার পরের সুর ভীমপলশ্রী- বিদেশী শিষ্যেরা একবাক্যে বললেন কে যেন প্রিয়মিলনের অভাবে দুঃখে-অভিমানে গুমরে কাঁদছে। সুর ছিল- 'যা যারে অপনে মন্দিরবা'। পুরনো দিনের এক প্রথিতযশা শিল্পী একদিন গল্পচ্ছলে রাগ বিহাগের সম্বন্ধে কিছু বলছিলেন। এটি বিলাওয়ল ঠাটে উড়ব-সম্পূর্ণ জাতির রাত্রি মধ্য-প্রহরে গেয় একটি সুন্দর রাগ, মনকে মোহাবিষ্ট করে ফেলতে এর জুড়ি নেই। দিনে গাইতে নিষেধ কেন? কথিত আছে এক মহিলা এক সকালে নিজের ঘরে মাছ কুটছিলেন, শিশু-সন্তান পাশে শুয়ে খেলা করছে। এমন সময় পাশের বাড়ির ওস্তাদ রাগ বিহাগ ধরলেন। মোহাচ্ছন্ন হয়ে মহিলা বুঝতে পারেননি কখন মাছের পরিবর্তে শিশুটিকে রেখেছেন বঁটিতে। খবর পেয়ে দেশের রাজা সেদিন থেকে দিনে বিহাগ গাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তানসেনের দীপক রাগ গেয়ে আগুন জ্বালানো বা বৈজুর মেঘরাগে বৃষ্টি নামিয়ে তা নেভানো, এসব হয়ত গল্পকথা। তবে লক্ষ্য করেছি যে শ্রী-রাগে গীত দত্তাত্রেয় পলুস্করের ‘হরি কে চরণ-কমল নিশাদিন সুমরো রে’ শুনে মনে হত যেন শেষ দিনের ডাক শুনতে পেয়েছেন তিনি, কেমন যেন একটা বিদায়-ব্যথা-জড়িত ক্লান্তি তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে। সত্যি অসম্ভব গুণী মানুষটি বড় তাড়াতাড়ি যেন চলে গেলেন সংসারের মায়া ছেড়ে।
সংগীতের রাগ-রাগিনীর ব্যবহার নিয়ে এরকমই নানা গল্পকথা ছড়িয়ে আছে এ দেশের পথে প্রান্তরে। ওস্তাদ-পণ্ডিতদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা ছিল না গায়ক-সংগীতকারদের। হিন্দুস্থানী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হিন্দি বলয়ের ওস্তাদদের হাতে এমনভাবে কুক্ষিগত ছিল যে খেয়াল-ঠুমরি-ধ্রুপদের বন্দিশ বাংলায় লেখার কথাও ভাবা যেত না। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শোরী মিঞা ঘরানার অনেক বিরোধিতা সহ্য আর উপেক্ষা করে রামনিধি গুপ্ত লিখলেন বাংলায় টপ্পা, রামমোহন রায় লিখলেন ধ্রুপদ। তারপর কিছুটা হলেও খুলে গেল বাংলা গানে উত্তর আর দক্ষিণ ভারতীয় রাগরাগিনীর সার্থক প্রয়োগ, রামপ্রসাদ-মদন-দাশু রায় ভক্তিগীতিতে যা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাতে যোগ করলেন বাংলার লোকগীতি, বিদেশী সুর, ভাঙলেন উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের যাবতীয় বেড়াজাল।
“সংগীতচিন্তা” বইয়ে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখছেন “আমাদের দেশে সংগীত এমনি শাস্ত্রগত, ব্যাকরণগত, অনুষ্ঠানগত হইয়া পড়িয়াছে, স্বাভাবিকতা হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে যে, অনুভবের সহিত সংগীতের বিচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে, কেবল কতকগুলা সুরসৃষ্টির কর্দম এবং রাগরাগিণীর ছাঁদ ও কাঠামো অবশিষ্ট রহিয়াছে। সংগীত একটি মৃত্তিকাময়ী প্রতিমা হইয়া পড়িয়াছে।“ অন্যত্র আরো বলেছেন, “ক্লাসিক্যাল আমাদের কাছে দাবী করে নিখুঁত পুনরাবৃত্তি। তানসেন কী গেয়েছেন, জানি না, কিন্তু আজ তাঁর গানে আর-কেউ যদি পুলকিত হন, তবে বলব তিনি এখন জন্মেছেন কেন? আমরা তো তানসেনের সময়ের লোক নই, আমরা কি জড়পদার্থ? আমাদের কি কিছুমাত্র নূতনত্ব থাকবে না?” এর অর্থ কী? “আমার এ ঘর বহু যতন করে/ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।” আসলে সংগীত বা শিল্পসাহিত্য-ললিতকলা ততদিনই বেঁচে থাকে, যতদিন সে নিজেকে ঘষে মেজে নতুন করে নিতে পারছে। প্রতিমুহূর্তে সে নিজেকে পালটে নিতে পারছে। গোলমাল তখনই বাধে, যখন, এই ঘষামাজার কর্তবে নতুন সৃষ্টির ‘আনন্দের’ চাইতে, সে সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ব্যাকরণ লঙ্ঘন হল কিনা, সেই তর্কে প্রাজ্ঞ পিতামহ শ্বেত শ্মশ্রু দোলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইতিহাস সাক্ষী, যতবার শিল্পীর প্রতিভার খামতি দেখা দেয়, ততবারই ধ্বংসের ভয়ে ব্যাকরণ টিকিয়ে রাখার ব্রতে মগ্ন হয়ে পড়েন তাত্ত্বিক পণ্ডিত।



(২)
একটি গান, কিছু কথা।

তবু যেন কিছু বাকি ছিল। রবীন্দ্রোত্তর যুগে নজরুল এনেছিলেন আরবী সুর, বাংলায় লিখেছিলেন গজল, কাওয়ালি, কাজরি, ঠুমরি, দাদরা, ইসলামি সংগীত। বাকি ছিল ভাবের সঙ্গে সুর আর লয়ের সামঞ্জস্য। নজরুল কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও প্রচলিত প্রথা যেন সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেললেন সলিল। সুরের বৈচিত্র্য তো বটেই, রাগাশ্রিত গানে বিবাদী সুরের মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার, স্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগের প্রচলিত শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসা, পলিফোনি, এমনকি ভোক্যাল হারমনাইজেশন নিয়ে আসা, একই গানের মধ্যে স্কেল বদল করার সাহস- পূর্বসূরীরা কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও এ সবকিছুর প্রথম সার্থক প্রয়োগ করেন সলিল চৌধুরি। কথা-সুর-লয়-ছন্দের সামঞ্জস্য আর তার বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সলিলের একটি জনপ্রিয় গানের কথা-
'দূর নয় বেশী দূর ওই সাজানো সাজানো বকুল বনের ধারে
ওই বাঁধানো ঘাটের পারে।
যেথা অবহেলা সয়ে সয়ে কিছু ফুল শুকানো শুকানো হয়ে
পড়ে পড়ে আছে তার কিছু দূরে ঘাটের চাতাল ছাড়িয়ে-
ওখানে আমার মাতাল হৃদয় সেদিন গিয়েছে হারিয়ে।।
(যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্)'
বহুশ্রুত গান, বলে দিতে হবে না নিশ্চয় যে কে গেয়েছেন। একে হৃদয়, তায় আবার মাতাল- যাক না হারিয়ে, ক্ষতি কী! তবু কবি থামেন না, অতএব গায়ক শ্যামল মিত্রকে ঠিক কী হারিয়েছে তার বর্ণনা দিতে হয়।
'শুক-সারীরা সেখানে কূজনে কূজনে দুজনে গাহিয়া যেত
ওই নদীটি বহিয়া যেত।
বনহরিণী চকিত চপল চরণে চমক লাগায়ে দিয়ে
তার চেয়ে ভাল চোখ দুটি দেখে যেখানে যেত সে দাঁড়িয়ে-
সেখানে আমার করুণ হৃদয় সেদিন গিয়েছে হারিয়ে।।
(যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্)'
প্রথম পঙ্‌ক্তির মধ্যমিল আর তার পরে 'চ'এর অনুপ্রাস চোখে পড়ার মত, কবিগুরুর 'চলচপলার চকিত চমকে করিছে চরণ বিচরণ' মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু তারও চেয়ে ভাল সেই চোখের বিবরণ যেখানে কবির চোখ পড়েছে, কিন্তু আমাদের এখনও পড়েনি। তাই অনায়াসে বলে উঠি, 'যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌' পরের স্তবকের আশায়।
'মোর মানসী কলস কাঁখেতে লইয়া ওখানে দাঁড়াত এসে,
মুখে মধুর মধুর হেসে।
তার তনুর তীরথে ডুবিয়া মরিতে নদীও উতলা হত
তার ঢেউএ ঢেউয়ে আরো দুটি ঢেউ যেখানে দিত সে বাড়িয়ে-
সেখানে আমার উতল হৃদয় সেদিন গিয়েছে হারিয়ে।।
(যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্)'
এতক্ষনে অনঙ্গ যেন অঙ্গধারণ করলেন। সে মানসীর তনুর তীরথ কথাটা অবশ্য নতুন নয়, নজরুল আগেই লিখে ফেলেছেন- 'বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে'। তবে নারীর বক্ষসৌন্দর্য বর্ণনার জন্যে কোনও কুরুচিকর শব্দ বা আদিরসাত্মক বিতর্কে না গিয়ে কবি লিখে ফেললেন- 'তার ঢেউএ ঢেউয়ে আরো দুটি ঢেউ যেখানে দিত সে বাড়িয়ে' - এখানে সলিল চৌধুরি একজন ওস্তাদ শিল্পী।
'মোর দিবস রজনী হায় গো সজনী ভাবিয়া কাটিয়া যেত,
সবই স্বপ্ন যে মনে হত।
সেই মগন স্বপন সহসা কখন ভাঙিয়া ভাঙিয়া গেল
এই পথ দিয়ে বধূবেশে সেজে যেদিন গেল সে হারিয়ে
সেদিন আমার সজল হৃদয় দু'পায়ে গিয়েছে মাড়িয়ে।।
(যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্)
(যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্)'
এইখানেই আসল ট্রাজেডি। কিন্তু ভগ্নহৃদয়ের হা-হুতাশের বদলে কবি লিখলেন কি- 'যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌, যাক্‌, যা গেছে তা যাক্‌'। গানটিতে দ্রুতলয়ের সাথে চটুল সুরের ব্যবহার কথার সাথে হয়ত খাপ খায় না, তবে এ ব্যাপারে সলিলের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সলিল-বিশেষজ্ঞ তথাগত ভট্টাচার্য, সে কথায় পরে আসছি। এ পর্যন্ত আমরা সঙ্গীতের ভাব, সুর, রাগ, তাল ও লয়ের সমন্বয় নিয়ে যা যা শুনে এসেছি রবীন্দ্র যুগ পর্যন্ত, সবকিছু ধ্যান-ধারণা যেন এক-ঝটকায় বদলে গেল। অবশ্য নজরুলের দু-একটা কাওয়ালি জাতীয় গানে (যেমন- যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি প্রিয়ে) এধরণের একটু আভাস পাওয়া গেছে ইতিপূর্বে, তবে সেটা যেন অন্তরের অভিমানের বহিঃপ্রকাশ, কাওয়ালি বা গজলের তালবিহীন 'শায়রি'তে তার আসল রূপটা মেলে। কিন্তু এটাই সলিল 'দি অরিজিন্যাল'।
সলিল চৌধুরির হাত ধরে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা গান যেন সাবালকত্বে পা রাখল। বন্ধু ভাস্কর বসুকে কৃতজ্ঞতা জানাই সলিল-গীতির এই বিশেষ দিকটি আমার দৃষ্টিতে তুলে ধরার জন্যে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আমরা পরের অংশে কিছুটা আলোচনা করতে চলেছি



(৩)
আলোচনা-পর্ব।।
"গানটিতে দ্রুতলয়ের সাথে চটুল সুরের ব্যবহার কথার সাথে হয়ত খাপ খায় না" – এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সলিল-বিশেষজ্ঞ তথাগত ভট্টাচার্য জানালেন- “শক্তিশালী গীতিকারের (কবি নয়) লেখনীতে সৃষ্ট গানে অনেক সময়েই কথার অতীত কোনো অন্তরাত্মার (spirit) সন্ধান পাওয়া যায়, যা কথাকে অতিক্রম করে যায়। এই অন্তরাত্মার সন্ধান পেলে অনেক সময়েই দেখা যায়, তা গানের নিছক কথার অতিরিক্ত কিছু তো বটেই, অনেক সময় গানের কথার আপাত-বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত! সুরকারের প্রতিভা গানের এই অন্তরাত্মাকেই ধরবার চেষ্টা করে - নিছক কথা কে নয়। এক্ষেত্রেও, সুরকার সলিলের অনন্য প্রতিভা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছে গীতিকার সলিলের অমর সৃষ্টি এই গানের আসল spirit টিকে - যা কিনা ধরা আছে ওই পাঁচটি শব্দের বাক্যবন্ধে -"যাক যা গেছে তা যাক!" পুরোনো স্মৃতির অলস রোমান্টিকতা নিয়ে পড়ে থাকা নয়, সামনে দেখো! এই তো ছিল সলিলের জীবনের মূল মন্ত্র। শ্যামল মিত্রেরই গাওয়া সলিলের অপর এক সৃষ্টিতে দেখি,
"স্মৃতি নিয়ে কি হবে আর, মিছে পুতুল খেলার মোর সাধ নাই
মনে রাখো কি না রাখো, মনে মনে ভাবা মোর কাজ নাই.
এ জীবন মোর আঁধারে আঁধারে মিশে
আলোয় আলোয় মিলে মিশে থাক।"
"স্মৃতির রোমান্টিকতাকে সার্থক সৃষ্টির প্রেরণায় ব্যবহার করো, কিন্তু সেই স্মৃতিডোর যদি দুঃখের সাগরে নিমগ্ন করে পেছনে টেনে ধরে, তো তাকে ছিন্ন করো"- এই দৃপ্ত পৌরুষই এই গানের, এবং সলিলের অন্যতর বহু গানের, অন্তর্নিহিত সুর, আর সেই সুরই ফুটে উঠেছে "যাক যা গেছে তা যাক"এ প্রযুক্ত marching tune এ। তাই দ্রুতলয় আর চটুল সুরের ব্যবহার আমার মতে ব্যাথাময় অতীতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলার সুর।“
আরেক গুণী বন্ধু আশুতোষ ভট্টাচার্য জানালেন তাঁর একটি সুন্দর উপলব্ধি। “সত্যি এই গানের কথা,ছন্দমিল,সুর,মেলোডি আর গায়কী মিলেমিশে অনন্য হয়ে উঠেছিল। 'সেদিন আমার সজল হৃদয় দুপায়ে গিয়েছে মাড়িয়ে',দেখুন গুনগুন করে গেয়ে, মনে হবে যেন সিঁড়ির ধাপে ধাপে নামছেন আর সমতল পেয়েই 'যাক যা গেছে তা যাক' নিতান্ত অবজ্ঞাভরে, পাহাড়ি রাস্তার সর্পিল বাঁকগুলো সন্তর্পণে ধাপে ধাপে নেমে এসে সমতল পেয়েই গাড়ি যেমন নিশ্চিন্তে গতি বাড়িয়ে দেয়।“
বিশিষ্ট কবি পরাগ বরণ পাল জানালেন-
“এই গানটি নানান বিভিন্ন কারণে আমার মতে একটি cult song বাংলা গানের ইতিহাসে। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন সঙ্গীতব্যক্তিত্ব তাঁর একটি লেখায় জানিয়েছেন গানটি নাকি গুরুচন্ডালি দোষে দুষ্ট। আমি আমার একটি লেখায় (আনন্দবাজারে প্রকাশিত) তার প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই লেখাটির আরো অনেক পরিবর্ধিত রূপ পরে অন্যত্র প্রকাশিত। এখানে লিঙ্ক দিলাম।“
ভাস্কর বোস উত্তরে গুরুদেব ও গুরুচণ্ডালী সম্বন্ধে কিছুটা মজার ছলেই লিখলেন-
“গুরুচণ্ডালী কাব্যে ও গীতিকাব্যে অলৌকিকত্ব সৃষ্টি করে সেটা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই অপূর্ব গায়নরীতিতে যখন গাইছিলেন,
"দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।
শুভক্ষনে কাছে ডাকিলে,
লজ্জা আমার ঢাকিলে গো—
তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে!" “
নতুন নতুন শব্দের ব্যবহারেও লিরিসিস্ট কবি হিসেবে সলিল অনবদ্য। সলিলের বিখ্যাত "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা গানে দুটো নতুন শব্দ পাচ্ছি, 'চতুর্পাশে' আর ‘তুষারিত’ "- পরাগবাবু মনে করালেন।
“আমার চতুর্পাশে সব কিছু যায় আসে
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা।।“
ভাস্কর একবার 'মরি হায় গো হায়' গানে 'চৌদিকে' কথাটা নিয়ে লিখেছিলেন, শব্দের প্রয়োগটাও লক্ষ্যণীয় রবি ঠাকুরের 'চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি' র অনুসরণে।
তথাগতর কথার পরিপ্রেক্ষিতে ভাস্কর আরেকটি গানের উল্লেখ করলেন যাতে আছে সেই একই এগিয়ে চলার আপ্রাণ তাগিদ,
"জীবন বৃন্তের থেকে ঝরে
কত না স্বপ্ন না গেছে মরে।
তবুও পথ চলা কবে যে শেষ হবে জানি না"
সেখানে স্মৃতি ভার নয়, অনুপ্রেরণা। 'স্মৃতিরা যেন জোনাকির ঝিকিমিকি, ঝিকিমিকি।।'



(৪)
সলিল চৌধুরী বিরহের গানেও তথাকথিত দুঃখের সুর লাগতে দেন নি। উদাহরণ - "নিশিদিন, নিশিদিন, বাজে স্মরণের দিন" বা "অন্তবিহীন, কাটে না আর যেন বিরহের দিন"!! এমনকি " ও বৌ কথা কও বলে পাখি আর ডাকিস না" - গানেও একটা অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বল ঔদাসীন্য কাজ করে। ওনার দর্শনে সম্ভবতঃ দুঃখ পাওয়া মানে হেরে যাওয়া।
“এই শেষ কথাটা নিয়ে আমি এক সময় বেশ ভেবেছিলাম”, বিজ্ঞানী- সাহিত্যিক অমিতাভ প্রামাণিক জানালেন।“এগুলো কি ইচ্ছে করেই করা? সন্দেহ জাগে। বিদেশী সুরের আর বাজনার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার প্রবল আকর্ষণ থেকে সলিল হয়ত বেরোতে পারেন নি। এই গানগুলো গাওয়ার সময় গায়কের (বা গায়িকার) গলায় সামান্যতম দুঃখের পরশ পাই না। যেন বিরহ কত আনন্দের জিনিস! অথচ 'বিরহ বড় ভালো লাগে'-তে কত্তা কি অসম্ভব মেদুরতা এনেছিলেন!”
ভাস্করের কিন্তু অন্য মত। “বিরহ কিন্তু প্রেমের এমন একটা দিক যেটা ছাড়া প্রেমকে ভাবা যায়না। কালিদাসের মেঘদূতের থেকেই হয়ত পরবর্তী কবিরা বিরহের সৃজনশীলতা কে স্বীকার করেছেন। "নিদ নাহি আঁখিপাতে" - কথাটা খুবই দুঃখের কিন্তু গানে সেইরকম দুঃখের প্রকাশ নেই। সেইরকমই "আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন / তোমাতে করিব বাস । দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস" - এই বিরহীর কি অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়, সুরে ও তা চিহ্নিত। এখানেও মনে হতে পারে - প্রেমিক যেন বিরহের প্রতীক্ষাতে। এমনকি মৃত্যুকেও সেইভাবে দেখা হয়নি, বরং ভাবা হয়েছে তা জীবনেরই এক রূপ- কর্মবাদী মানুষের দুঃখবিলাস সাজেনা - "মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় সে দুঃখের কূপ,/ তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ, আপনার পানে চাই"! সলিল ও তাই হয়ত একই ভাবে বলেছেন - "জীবন বৃন্তের থেকে ঝরে, কত যে স্বপ্ন গেছে মরে / তবু এ পথচলা কবে যে শেষ হবে জানিনা"!!
আমার মনে হয় কথাটা ঠিক। 'আর নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের' গানটি শুনে আগে খটকা লাগত, বোঝা মুস্কিল ছিল যে ওটা প্রেম নয়, তার মায়াজাল কাটিয়ে 'এবার ফেরাও মোরে'র আহ্বান। 'সাত ভাই চম্পা'র prelude শুনলে মনে হয় একটা রূপকথার গল্প শুনতে চলেছি। আবার 'না, মন লাগে না' গানে কিছুটা হলেও বিরহের অভিব্যক্তি আছে। অথচ 'রানার'এর কিছু অংশে সুরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবে 'গাঁয়ের বধু' গানের শেষ অংশে 'আজও যদি তুমি কোনো গাঁয়ে দেখো ভাঙ্গা কুটিরের সারি, জেনো সেইখানে সে গাঁয়ের বধুর আশা-স্বপনের সমাধি।' হেমন্ত বেশ মন-উদাস-করা ভাব এনেই অংশটি গেয়েছেন। জানিনা সলিলের অনুপস্থিতিতে গানটির রেকর্ডিং হয়েছিল বলে কিনা!
ভাস্কর বললেন, “এটা নিয়ে অনেকই বিতর্ক শুনেছি। "আজ নয় গুনগুন" এ যেহেতু আহ্বান টি প্রেমিকার তাই তার মধ্যে আর্তিটাই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। পরের অংশটি শুনলে বোঝা যায় - "তুমি হও একজন তাদেরই কাঁধে আজ তার ভার তুলে নাও, তুলে নাও!!” “
“এই গানটা কে বলা যেতে পারে দুটি ভাবের সংমিশ্রণ। মোহিনী চৌধুরীর একটি খুব বিখ্যাত গান ছিল - পুরুষকন্ঠে - "পৃথিবী আমারে চায়, রেখোনা বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়, খুলে দাও বাহুডোর" - এখানে যেন নারী পুরুষটিকে উলটো ভাবে অনুপ্রাণিত করছে। এর সঙ্গে "প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, " বা "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়" এই দুটি ভাবকে ও রাখা হয়েছে বলে মনে হয়।“
হালকাভাবেই বলি, প্রেমের বন্ধন অনেক সময় পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে যদি প্রেমিক বলে- 'রোগের মতন বাঁধিব তোমায় দারুন আলিঙ্গনে'। তখন সেই যন্ত্রণার থেকে ছাড়া পেতে হয়ত প্রেমিকাকেও বলতে হয়- 'ওগো প্রিয় মোর, খোল বাহুডোর, পৃথিবী তোমাকে যে চায়'। কি জানি এটাও সেই কেস কিনা!
ঠাট্টা নয়, জনশ্রুতি আছে গোস্বামী তুলসীদাস এইরকম ভালবাসতেন স্ত্রীকে। স্ত্রী যেটা করলে লোকে পতিব্রতা বলে প্রশংসা করে, স্বামীদের ক্ষেত্রে একই অবস্থায় জোটে স্ত্রৈণ বলে লাঞ্ছনা। একদিন এমন অবস্থা দাঁড়াল যে স্ত্রী একবেলার জন্যে পিত্রালয় গেছেন, তুলসীদাস থাকতে না পেরে সেই রাত্রেই ছুটে এসেছেন শ্বশুরবাড়ি। লজ্জিতা, অপদস্থা তুলসী-পত্নী তখন ভর্ত্সনা করে তাঁর পতিকে যা বলেছিলেন, তুলসীদাসের লেখা থেকেই বলছি-
"লাজ না লাগত আপকো, দৌড়ে আয়হু সাথ
ধিক, ধিক, এইসে প্রেম কো, ক্যা কহুঁ ম্যয় নাথ।
অস্থি-চর্মময় দেহ মম, তামেই এয়্সী প্রীতি,
এইসা যো শ্রীরাম মে হো, ন হোতী তো ভবভীতি।"
ঘুরে গেল তুলসীর জীবনের মোড়। সংসার ছেড়ে গঙ্গাতীরে বসে তিনি রামচরিত নিয়ে পড়লেন, বাকিটা ইতিহাস।
"সলিল চৌধুরীকে চিনতে গেলে প্রচলিত সুরের ধারণাকে সরিয়ে দিতে হবে"- সাহিত্য-সেবী শ্যামা প্রসাদ সরকার মনে করালেন। "উনি একজন প্রকৃত সুরসাধক। তাই অক্লেশে নিজেই ব্যাকরণ বানিয়ে নেন আর সেটাই নিও ক্ল্যাসিকাল হয়ে যায়। গণসঙ্গীতকেও উনি মেলাতে পারেন প্রেমের সুরে!"
শেষে তাহলে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। গণসঙ্গীত, সলিল চৌধুরি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র ও দেবব্রত বিশ্বাস।
ইতিমধ্যে একজন বন্ধু দেবব্রতের কণ্ঠে সলিল-সংগীত “যদি কিছু আমারে শুধাও” গানটির লিঙ্ক পাঠিয়েছিলেন, সেটা শোনার পর থেকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম, সম্পূর্ণ এক অন্য জগতে পৌঁছে গেছিলাম যেন।
IPTA র সময় থেকে দেবব্রত বিশ্বাস আর সলিল চৌধুরী একসাথে কাজ করেছেন, সলিলের প্রযোজনায় প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে, তাছাড়াও অনেক গান দেবব্রত নিজের খেয়ালেই গেয়ে গেছেন, বিশেষ কোনো যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়াই। সলিলের দু'একটা গণনাট্যের গান যেগুলো হেমন্তের গলায় শুনে এতকাল মুগ্ধ হয়েছি আমরা, পরে শুনেছি দেবব্রতর গলায়। হেমন্তের সঙ্গে তুলনায় যাচ্ছি না, ঈশ্বরীয় কণ্ঠস্বর তাঁর, কিন্তু 'পথে এবার নামো সাথী' বলতে কী বোঝায়, তা দেবব্রতের গলায় সঠিক প্রতিফলিত হয়েছে।
"সবচেয়ে বেশি মনে হয়ে "অবাক পৃথিবী" গানে "এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম" এর উচ্চারণে"- ভাস্কর মনে করিয়ে দিলেন। "পদাঘাত, অবাক, সেলাম! কী অমোঘ, তীব্র উচ্চারণ দেবব্রতর গলাতে।"
এখন ভাবি, গাঁয়ের বধু, পাল্কীর গান, রানার এগুলোর মধ্যে বেশ খানিকটা রোমান্টিসিজম আছে যার জন্যে হেমন্ত বা শ্যামলের বিকল্প নেই, কিন্তু গণসংগীতগুলোর জন্যে বা সুকান্তের 'ঠিকানা', 'অবাক পৃথিবী' এসবের দেবব্রতের রেকর্ড রাখা উচিত ছিল।
এখন ভাবি, গাঁয়ের বধু, পাল্কী র গান, রানার এগুলোর মধ্যে বেশ খানিকটা রোমান্টিসিজম আছে যার জন্যে হেমন্ত বা শ্যামলের বিকল্প নেই, কিন্তু গণসংগীতগুলোর জন্যে বা সুকান্তের 'ঠিকানা', 'অবাক পৃথিবী' এসবের দেবব্রতের রেকর্ড রাখা উচিত ছিল।
ভাস্কর বললেন, ”আমাদের সলিল চৌধুরির ফোরামে এই দুটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। আমার মত অনেকের মনে হয়েছিল, এই গানটি শ্যামলের গলাতেই বেশী খুলেছিল কারণ তাঁর কণ্ঠস্বরের তারুণ্যের ঝংকার, অন্তরা পর্যন্ত পারকাসন যন্ত্রের বর্জন, সুর আর ভাবের আশ্চর্য অভিনবত্ব- সব মিলিয়ে গানটিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। অনেকটা- "যাক যা গেছে তা যাক" বা " ঐ আঁকা বাঁকা পথ" যেরকম প্রেমের গান, এটিও সেইরকম একটি নিপাট প্রেমের গান। হয়ত ঠিক দেবব্রতর উপযোগী নয়। শুরুতেই "যদি কিছু আমারে শুধাও" এর মধ্যেই শ্যামলের গলায় একটি অদ্ভুত অনুরণন আছে! "তাসের দেশ" এ রাজপুত্রের গান শ্যামল কে দিয়ে গাওয়ানো হওয়ার ওইটিই মুখ্য কারণ। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেছিল - দেবব্রতর কন্ঠস্বর, বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও গাম্ভীর্য গানটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল।“
আমিও কথাটা সমর্থন করি। প্রেমের গান হিসেবে ধরলে এখানে কণ্ঠস্বরের তারুণ্য ও মাধুর্যের গুরুত্ব আছে, আর সেদিক থেকে শ্যামল নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবেন। তবু যেন দেবব্রত বিশ্বাসের গলার কী যাদু, কী মোহ আছে, এই অংশটা যখন উনি শুধুমাত্র একটা কী-বোর্ড সহযোগে গাইছেন-
“তেমনি আমার বাণী, সৌরভে কানাকানি…” যেন তাঁর প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠের থেকে একঝলক সুগন্ধী হাওয়া ছুটে আসে।
সলিলকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের শেষ নেই, অপরিসীম প্রতিভা নিয়েও শুধুমাত্র আলস্যের কারণে তাঁর সৃষ্টি যতদূর যেতে পারত হয়ত আমরা তা পাইনি- এই অনুযোগ শুধু আমার নয়, সলিল-শিষ্য কবি গুলজারের। তাই এই আলোচনারও শেষ নেই, মৃত্যুর এতদিন পরেও সলিলের প্রতিভার নিত্য নতুন দিক উন্মোচিত হয়ে চলেছে, হতে থাকবে।
(আপাততঃ এইটুকু)