Wednesday, April 29, 2020

আমার যে দিন...। স্মৃতিচারণ

Image may contain: 4 people, including Dilip Kumar Sachdeva, people standing, tree, plant, flower, house, sky, outdoor and nature

Image may contain: 4 people, including Swarup Ratan Ghosh and Pallab Kumar Chatterjee, people standing, shoes and outdoor

আমার যে দিন...।


বন্ধুরা অনেকে নিজের বাগানের ফুল-ফল-গাছের ছবি পোস্ট করে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, মুগ্ধ হয়ে দেখে যাই শুধু। এখানে মুম্বাইয়ের একচিলতে ফ্ল্যাটবাড়িতে টবে কিছু শৌখিন গাছপালা পুঁতে ফুল-টুল ফোটান বটে আমার গিন্নি, ভাল লাগে, কিন্তু নস্টালজিক মন ছেলেবেলার কথা মনে করে তেমন নাড়া খায় না তা দেখে।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বিহারের (এখন ঝাড়খণ্ড) দামোদর-তীরের ছোট্ট এক আধা-শহরে। এ এক এমন জায়গা যে গুগল ম্যাপে চেষ্টা করেও বাড়ি-ঘর খুঁজে পাবে না সেখানে, মনে হবে যেন গভীর জঙ্গল। হবে না কেন? বেশির ভাগ বাড়িই একতলা নয় দোতলা, অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কয়েকটা তিনতলা হোস্টেল বাদে। ছিল গোটা দুই মস্ত কারখানা- সার আর সিমেন্টের, দ্বিতীয়টা আজও আছে, সারের কারখানা সরকার, শিল্পপতি আর ইউনিয়নের মিলিত চক্রান্তে বন্ধ হয়ে গেছে সতের বছর আগে। কিন্তু কলোনি ছিল চোখ জুড়োন, চৌকো রাস্তা, প্ল্যানমাফিক সাজানো কোয়ার্টার্স আর বাংলোগুলো, আর ছিল সবুজের সমারোহ রাস্তার দুপাশ, বাড়ির বাগান জুড়ে। অজস্র মহীরূহের মাঝে চোখে আর নাকে পড়ার মত ছিল পলাশ-কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া-ছাতিম আর কদম। বসন্তে চারপাশ রঙিন হয়ে উঠত আর বর্ষার মুখে কদমের ডালে মেলা লাগত হলুদ-গোলাপি ফুলের। বর্ষা শেষ হতে না হতেই পুজো আসার অগ্রিম সংবাদ জানা যেত থোকায় থোকায় ফুটে থাকা সপ্তপর্ণী (ছাতিম) ফুলের তীব্র গন্ধে। আমাদের স্কুল ছিল বাসা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। বাস ছিল, কিন্তু এই ফুলগুলোর লোভে প্রায়ই বাস ছেড়ে দিয়ে সবান্ধবে হাঁটা দিতাম, বৃষ্টির প্রথম ধারায় স্নান করাটা ছিল উপরি পাওনা। কদমের ফুল গাছে চেপে পাড়ার ক্ষমতা হত না, তবে যে পরিমাণ পড়ে থাকত গাছের তলায় তলায়, সেগুলোই কুড়িয়ে জমাতাম, অকারণেই। তখন আমাদের প্রথম কদম ফুল দান করার কেউ ছিল না, হয়ত সে বয়সও হয়নি, তাই নিজের ফুল নিজেকেই কুড়োতে হত। অবশ্য দু-চারটে মেয়েও যে থাকত না সে দলে তা নয়, তারই কোন একটিকে দেখে হয়ত জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন-
"কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্‌ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"
একেবারে নিখুঁত ছবি, যদিও উনি এ শহরে কোনদিন এসেছেন বলে শুনিনি।
তবে আসল মজাটা পেলাম হাইস্কুলে যাবার পর। সেখানে দুটো বিল্ডিংএর মাঝে ছিল একটা বিশাল মহুয়া গাছ। আমাদিগকে তখন একটা পেপার হিন্দি আর একটা বাংলা পড়তে হত। হিন্দিভাষী ছেলেদের পড়তে হত দুটো হিন্দির পেপার। তা ওদের হিন্দি-২ এর সময় আমাদের বাংলা থাকত। কিন্তু ক্লাসরুম অত না থাকায় হরিদাস স্যার বা দাস স্যার আমাদের কয়েকজন বঙ্গসন্তানদের নিয়ে পড়াতে বসতেন বাইরে গাছতলায়, একেবারে শান্তিনিকেতনী স্টাইলে। কিন্তু পড়ব কী? 'সেদিন চৈত্রমাস'। সর্বনাশ হওয়ার বা ঘটানোর বয়স আমাদের না হলেও একটা জিনিষ দস্তুরমত টের পাচ্ছি সেটা সবজে কমলা রঙের মহুয়ার ফুল- প্রচুর পড়ে আছে গাছের তলায়। কী মিষ্টি গন্ধ- ঠিক যেন গোবিন্দভোগ চালের পায়েস, ভুর ভুর করছে চারপাশ। বাংলা পড়তে পড়তে অন্যমনস্কভাবে একটা মুখে তুলে নিতাম, এ হে হে- কিছুটা টক, আর বেশ তিতকুটে। এর চেয়ে বরং পাকা নিমফল ভাল! তখনও কি জানতাম এর মাদকতার কথা যেটা না চেখেই হয়ত কবিগুরু এন্তার কথা লিখে গেছেন-
"চৈত্রদিনে তপ্ত বেলা তৃণ-আচঁল পেতে
শূণ্যতলে গন্ধভেলা ভাসায় বাতাসেতে-
কপোত ডাকে মধুকশাখে বিজন বেদনায়।।"
(মধুক মানে যে মহুয়া সেটা তখন জানতাম না)
ঠিক এই গন্ধে ভরা দুপুরগুলোকে আজও মিস করি। ইতিহাস রাখি নি, 'তবু উড়েছিনু, এই মোর উল্লাস'। বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপে কারখানা আবার চালু হতে চলেছে- সেই ছেলেবেলার বন্ধ স্কুলে আজ সেই কন্সট্রাকশন শ্রমিকদের ডেরা, সেই স্কুল, সেই শহর আর আমার নয়। তবু সুযোগ পেলেই এখনকার খাঁচার পাখি তখনকার বনে-জঙ্গলে ছুটে যাই।
আজ করোনাভাইরাসের আতঙ্কে গৃহবন্দী হয়ে এইসব কথাই চিন্তা করছিলাম। তবে না, কদমফুলের সঙ্গে নভেল ভাইরাসের চেহারার মিলটা সেই মুহূর্তে মাথায় আসে নি, এটা নিছক একটা সমাপতন!
মুম্বাই, ১৪২৭।
সঙ্গে ফটো- বুড়োবয়সে আবার দেখতে গেছি বাল্যের শহরকে, সবান্ধবে

Tuesday, April 28, 2020

টু ফর জয়।। অণুগল্প

টু ফর জয়!
(অণুগল্প)
-এই যে, তুই এখানে! আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান।
- কেন রে বাবা, সাতসকালে কিসের কাজ পড়ল? এক মিনিট, ফড়িংটাকে তাক করেছি, নড়াচড়া করলেই ফস্কে যাবে।
- এই রাক্কস! সকাল সকাল এত খিদে কিসের? ফড়িংগুলো দিব্যি খেলছে, কিছুক্ষণ আনন্দে খেলতে দে না বাপু।
- তা কোথায় যেতে হবে? খাবার পাওয়া যাবে?
- হ্যাঁ রে পেটুক! তিন্নিদের বারান্দায়। অনেক গম ছড়িয়ে রেখে মেয়েটা চোখ বুজে দুই শালিক, দুই শালিক করে যাচ্ছে।
- সে কি রে, ফাঁদ নয় তো? আরে আমরা তো আর শালিক নই!
- আমরা শালিক না ময়না সে আর তিন্নি কি বুঝছে? ও দুটো পাখি দেখতে পেলেই খুশি। আজকে ওর স্কুলে পরীক্ষা যে!
- এই, তুই মানুষের বাচ্চাদের এত খবর কোথায় পাস রে? দিনরাত গমের লোভে হাউসিং সোসাইটিগুলোতে ঘোরাঘুরি করিস। কোন দিন জালে ধরা পড়বি সেদিন বুঝবি! খাঁচার মধ্যে রাধেকৃষ্ণ গেয়েই জীবন যাবে। চল, দেখি কোথায় তোর তিন্নি।
দুটি ময়না উড়ে গিয়ে এসে বসল তিন্নিদের ব্যালকনির ধারিতে।
তিন্নি ব্যাগ হাতে চোখ বুজে অপেক্ষা করছিল। ওর মা পাখিদুটোকে দেখে ওর মাথায় একটা টোকা মারতেই ও চোখ খুলল। 'টু ফর জয়! টু ফর জয়!' হাততালি দিয়ে নেচে উঠল তিন্নি।
ময়না দুটো তখন একমনে গম খুঁটে যাচ্ছে।

মহিমা।। অণুগল্প

মহিমা ।।

ভৈরব ঘোষালের বিধবা রাজু বুড়ি মারা গেছেন। একমাত্র পুত্রসন্তান বলরাম ঘোষাল শ্রাদ্ধ করছেন। বলাইবাবু একটু হিসেবি বটেন, তবে তাঁর মিষ্টি কথার গুনে কৃপণ বলে বদনাম রটেনি কখনো। তাই দানসাগর না করলেও বেশ ষোড়শোপচারে মায়ের শ্রাদ্ধ করার মনস্থ করলেন তিনি। তাঁর প্রাণের বন্ধু ভবতোষ শ্রাদ্ধে থাকতে না পারায় তাঁর আক্ষেপ জীবনে যাবে না এমনটি শোনা গেল। তাই পরের সপ্তাহে কাজে যোগদান করে বন্ধুকে সেই গল্প সাড়ম্বরে শোনাতে শুরু করলেন।
- তারপরে বুঝলি ভবা, ঠিক করলাম মায়ের কাজে ত্রুটি রাখব না কোনোকিছুর। সাত গাঁয়ের না হলেও গ্রামের সবাইকে নাপিত পাঠিয়ে নেমন্তন্ন করলাম। মোটা মোটা লুচি, বুটের (ছোলার) ডাল, ডিংলার (কুমড়োর) ছক্কা, বঁদে আর মিষ্টি দই। সব তো ঠিকই ছিল, তা দইয়ের আর অর্ডার দেওয়া হয়নি, একদম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। শেষে যখন মনে পড়ল দোকানে মাত্তর একভাঁড়ই পড়ে ছিল।
- কি কাণ্ড! সারা গাঁয়ের লোক আর একভাঁড় মোটে দই! কিভাবে সামাল দিলি?
- তবে আর বলছি কি? আমি ভাঁড়টা নিয়ে সোজা আলমারিতে তুলে তালা দিয়ে দিলাম। বললাম, মাগো তোমার ছেলের সম্মানরক্ষার ভার তোমার হাতেই গো মা, দেখো যেন বদনাম না হয়!
- তারপর কি হল?
- আর কি বলব ভবা, সবই মায়ের মহিমে রে, ভাবলেই এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। পেরায় হাজার খানেক লোক খেয়ে চলে গেল, বিশ্বাস করবি না, ওই একভাঁড় দই যেমনকার তেমনি রয়ে গেল!
পাশ দিয়ে অবিনাশ ঘোষাল যাচ্ছিল, বলরামেরই ভায়াদ, অতএব চিরশত্রু। সে খানিকটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে ফুট কেটে গেল - তা তোমার যেমন কান্ড বলাইদা। লোককে না খাওয়ালে সে দই খরচ হবে কোত্থেকে শুনি?
- তুই চুপ কর অবু। তোকে বলেছি কিছু?

Saturday, April 25, 2020

পুতুল। অণুগল্প

পুতুল।।

রেহানার বিয়ে আজ, হাসনাবাদ হাই মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী রেহানা। মাদ্রাসা থেকে ফিরে বান্ধবী পরভিনের সঙ্গে পুতুল খেলছিল রেহানা। এমন সময় আম্মির আবির্ভাব, ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে! খেলার আসর থেকে জোর করে তুলে নিয়ে এসে ফ্রক ছাড়িয়ে একটা নতুন রঙচঙে শালোয়ার-কামিজ পরিয়ে দেওয়া হল তাকে। আব্বু ভ্যান-রিক্সা চালায়, দেখা গেল দুল্‌হা আর তার পরিবারকে নিয়ে আসছে তাঁরই ভ্যানে, পাড়ার ছেলে আনোয়ার। খুব সামান্য সাজসজ্জা হলেও উৎসবের পরিবেশ।

রেহানার আব্বা সেলিম নতুন কুটুমদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রেহানার আম্মি বলছিল বটে ও নাকি পড়াশুনায় খুব ভাল, মাদ্রাসার মাস্টারমশায়-দিদিমণিরা অনেক আশা রাখেন তার উপর। কিন্তু মেয়েমানুষকে বেশি পড়িয়ে হবে কী, বিশেষ যখন একটা সাধা রিশতা হাতে এসেছে? না না, এই রোজগারে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। স্ত্রীর বিয়েতে তেমন মত না থাকলেও সেলিমের জেদাজেদিতে রাজি হতে হয়েছে।
সাক্ষী, অতিথিরা এসে গেছে, নিকটস্থ মসজিদ থেকে ইমাম সাহেবও মেহেরবানী করে আসতে রাজি হয়েছেন। দেনমোহরের কথাবার্তা হয়ে গেছে, শুধু নিকাহের কাজটুকু বাকি। কিন্তু দেরি হচ্ছে কেন? রেহানা অবশ্য সকাল থেকেই খুব কান্নাকাটি করছিল, তা মেয়ে যখন পরের বাড়ি যাবার আগে তো কাঁদবেই। সেলিম মিঞা ভেতরে সাকিনাবিবিকে তাগাদা দিতে গেল।

কিন্তু রেহানা কই? সাকিনা এদিক-ওদিক, খাটের তলা আলমারির পেছনে খুঁজে বেড়াচ্ছে, রেহানা কোথায়? 'ও গো কী হবে, রেহানাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না'- কেঁদে ফেলে সাকিনা। আক্রোশে ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকায় সেলিম, 'বল হারামজাদি, কোথায় ভাগিয়েছিস মেয়েটাকে?' সাকিনা উত্তর না দিয়ে কাঁদতে থাকে।
ভেতরে একচিলতে উঠোন আর গোসলখানা, তার এককোণে রেহানার খেলাঘর। পাশেই খিড়কি দরজা খোলা, পালিয়েছে রেহানা। খেলনার বাক্সের পাশে পড়ে আছে গত সপ্তাহে শবেবরাতের মেলায় কেনা ওর নতুন পুতুলখানা- তার ধড়খানা পড়ে একদিকে, গলাটা ছুরি দিয়ে কাটা- মাথা পড়ে আছে অন্য একদিকে। উদ্‌ভ্রান্তের মত ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল সেলিম। একি, পুলিশ কেন?

'শোন হে সেলিম!' দারোগা শাসায়, 'তোমার মেয়ে বসে আছে হাসনাবাদ থানায়, দারোগা বললেন। তোমরা মাইনর মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলে, শালা জেল খাটতে হবে সেটা জানো? বিয়ে হবার আগেই রেহানা ওর এক দিদিমণির সাথে এসে থানায় রিপোর্ট করেছে বলে তুমি বেঁচে গেলে। আঠারোর আগে আর মেয়ের রজামন্দি ছাড়া বিয়ে দেবে না লিখে মুচলেকা দিলে তবেই তুমি রেহাই পাবে, এখন কী করবে তুমিই ঠিক কর।'
তদন্ত করতে একবার ভেতরে এলেন দারোগা সাহেব। গলাকাটা পুতুল আর পাশে পড়ে থাকা ধারালো ছুরি দেখে শিউরে উঠলেন তাঁর মত একজন পোড়খাওয়া মানুষ।

গল্পটা আমার শেষ হয় নি। রেহানাদের গল্প শেষ হয় না, চলতেই থা্কে, চলতেই থাকে যে পর্যন্ত না এরকমই নৃশংসভাবে খুন হয় আরেকটি রেহানার কৈশোর, তার পুতুল খেলার বয়স। আপনারা দেখুন না যদি গল্পটাকে একটা শেষ পরিণতি দিতে পারেন।     

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)