Sunday, May 15, 2016

তেনালি- বাংলা ছোট গল্প।

তেনালি।

(গল্প)
পল্লব চট্টোপাধ্যায়



দুম করে চাকরিটা দিলাম ছেড়ে। আর ভাল লাগছিল না। তাস-পাশার নেশা ছিল না, তেমন কিছু সামাজিকও নই। তবে পরের চাকরি করার আর ইচ্ছে নেই। পয়সাকড়ি যা জমেছে দু'জনের দু'বেলা বাকি জীবনটা বসে খাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তাপসরা একটা এন-জি-ওর মত চালায় পুরুলিয়ার দিকে, ওকে ধরেছি সময় কাটানোর জন্যে কিছু কাজ-টাজ করব বলে। এমনি অবৈতনিক, মাঝে মাঝে টুকটাক গিয়ে ঘুরে আসার ইচ্ছে। তবে তাপস একটু টেড়িয়া মাল, বলে তার জন্যে লোক আছে, শখের সেবায় আমাদের কাজ নেই। পারলে কিছু চাঁদা দিস, কাজে লাগবে। কি অপমানজনক ভাবুন একবার!

হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। উরেব্বাস, শয়তানের নাম করতেই শয়তান হাজির। 'কাল সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া থেকে লালমাটি এক্সপ্রেস, প্লাটফর্মের গেটের কাছে চলে আয়। টিকিট কেটে রাখছি।' এইটুকু বলেই ফোন কেটে দিল তাপস। যাঃ বাবা, এ যে মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল ঠেকছিল না, এই তাড়া কিসের? তবু কৌতূহল বলে ত একটা জিনিষ আছে, তাই ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশনের আঠেরো নম্বর প্লাটফর্মের মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি তাপস ব্যাটা আগে থেকেই সেখানে হাজির।
‘কি রে, এই এমার্জেন্সী কিসের?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
’ট্রেনে যেতে যেতে বলছি চল’, এই বলে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে ওঠাল লালমাটিতে। গাড়িটা খড়গপুর-টাটা হয়ে পুরুলিয়া যায়। হাওড়া ছাড়তেই তাপস শুরু করল ওর গল্প।

‘আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। এমনই এক সকালে আসানসোল এক্সপ্রেসে হাওড়া এসে নেমেছি। তখন আমি ইস্টার্ণ রেলে কন্ট্রাক্টারি করি। অফিস টাইমের যানজট এড়াতে হাওড়া স্টেশনের জেটি থেকে লঞ্চে ফেয়ারলি ঘাটে নেমে ওখান থেকে হেঁটে রেলের হেড অফিসে যেতাম। জেটিতে যাবার মুখে দেখি একটা জটলা, হাওড়ার পুলিশ কতকগুলো জুয়াড়িকে হাতেনাতে ধরেছে, জেটির পায়ারের নীচে বসে তাসের জুয়া খেলছিল। এ তো রোজকার ব্যাপার ভেবে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনি একটা গামছা আর গেঞ্জি পরা লোক বিজাতীয় ভাষায় পুলিশকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। পুলিশের কেউ সে ভাষা বোঝেনা, তারা ওকে টেনে হিঁচড়ে অন্যদের সাথে ভ্যানে তুলল। একঝলকের জন্যে লোকটার চেহারাটা দেখলাম। বছর ত্রিশের কৃষ্ণবর্ণ চেহারা, কপালে একটা মস্ত আঁচিল, মাঝে মাঝে ‘তেনালি, তেনালি’ বলে যাচ্ছে। পুলিশের একটা লোক হয়ত কিছু পড়াশোনা করেছিল, সে ধাক্কা দিয়ে বলল- ‘হাঁ, সমঝা, তু জোকার মাস্টার তেনালিরাম হ্যায়। সালে কলকত্তে আকে জুয়া খেলতা হ্যায়! অব সসুরাল চল।‘ আমার ভূগোল জ্ঞান কিছুটা ছিল, বুঝলাম, অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালিতে ওর বাড়ি। আমি হয়ত কিছুটা সাহায্য করতে পারতাম, কিন্তু সেদিন ফেয়ারলি স্ট্রীট অফিসে একটা টেন্ডার ওপেনিং ছিল, তাই আর পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইনি।‘

‘তারপর’, আমি বললাম, এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলাম।

‘তারপর গত মাসে আমাদের এনজিওতে যাবার সময় ভ্যানে যেতে যেতে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন আষাঢ়ের পয়লা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে এখানে এত শিগ্‌গির ত মনসুন আসেনা। বাইরে তাকিয়ে দেখি রাস্তার বাঁদিক জুড়ে শুধু সবুজ মাঠ আর গাছপালা। রাস্তার ডানদিকে মাটিয়ালা-বাঘমুণ্ডি হয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢাল পর্যন্ত শাল-সেগুন-মহুয়া-পলাশের রাজত্ব ছিল বটে, তবে বাসুডির পশ্চিম প্রান্তে ছিল শুধু টাঁড় আর একফসলি পাথুরে জমি। সেখানে কে আনল এত সবুজের সমারোহ?’

‘আমাদের এনজিওর কর্মী নিখিলকে জিগ্যেস করে জানা গেল ওখানে গত চার-পাঁচ বছর ধরে একটা ম্যাড্রাসি লোক এসে থাকছে। পাগল-ছাগল লোক, তিনকুলে কেউ নেই, একমনে শুধু গাছ লাগিয়ে চলেছে। ওর কাজ দেখে দু-একটা এনজিও ওকে চারা সার এসব দিয়ে সাহায্য করে, ফরেস্ট বাবুরাও এসে উৎসাহ দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। এই দেখুন না, জায়গাটা পুরো সবুজ করে তুলেছে, মনে হচ্ছে এবার থেকে বৃষ্টিও ভালই হবে।
‘কৌতূহল বাড়ল। দু-একদিনের মধ্যেই অফিসের ভ্যানটা নিয়ে বাঘমুণ্ডি থেকে বাসুডি ঘুরে এলাম, লোকটাকেও দেখলাম। একটু ভাল করে দেখতেই চিনতে পারলাম, অবশ্যই কপালের আঁচিলটা দেখে। কিন্তু যে লোকটাকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে হাওড়া পুলিশ ধরেছিল সে এখানে কিভাবে?
‘কথা বললাম। জানতে পারলাম ওরা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে একটা দল এসেছিল কলকাতা বেড়াতে। ফেরার পথে হাওড়া স্টেশানে অপেক্ষা করার ফাঁকে ওর ইচ্ছে হয়েছিল গঙ্গাস্নান করার। ঘাটের কাছে কিছু লোককে তাস খেলতে দেখে দু-চার মিনিট দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছিল ওদের খেলা, আর তখনই পুলিশ এসে পড়ে। তার বিরুদ্ধে কোনও কেসই আনতে পারে নি পুলিশ, অথচ যেহেতু ঘুষ দেবার বা তদ্বির করার কেউ ছিল না, বিনা বিচারে বছরের পর বছর রিমান্ডে রেখে দেওয়া হয় তাকে, সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে।

'কি আশ্চর্য ভাব? এই আমাদের দেশ, এই আমার বাংলা! ভিক্টর হ্যুগোর 'লে মিসেরাবল্‌সে'র নায়ক জ্যাঁ ভালজ্যাঁ তবু পাঁউরুটি চুরি করে জেল খেটেছিল, আর এ ত একেবারে বিনা দোষে।
'তেনালি- যদি সেটাই ওর আসল নাম হয়, এখন দেখলাম মোটামুটি বাংলা বলতে পারে, তবে স্মৃতিশক্তি একেবারেই গেছে। হাজতে যাবার আগের প্রায় কোনও কথাই মনে করতে পারছে না, এমনকি গ্রামের নাম, মা-বাবার নাম, বৌ আছে কিনা, কিচ্ছু না। মনে ছিল শুধু তেনালি কথাটা, সেটা কি ওর নাম না ওর শহরের নাম তাও মনে পড়ছে না। এমন অবস্থায় বছর পাঁচেক আগে ছাড়া পেয়ে সে করোমণ্ডলে চেপে বসে, কিন্তু কি ভেবে খড়গপুরেই নেমে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে। কলকাতায় জেলের বাগানে কাজ করত, সেই কাজ এখানেও শুরু করে। এখানকার লোকেরা গরীব হলেও ভালমানুষ, একবেলা-দুবেলা খাবার জুটেই যায়।‘

‘তা, এতে তোর অপরাধবোধটা কোথায়? তোর করারই বা কি ছিল।‘ আমি শুধোলাম।
‘সেটা নিয়ে কলকাতা ফিরে গিয়ে অনেক ভেবেছি। নিশ্চয় গুন্টুর জেলার তেনালি শহরে ওর বাড়ি। সেখানে খোঁজ নিলে হয়ত কিছু জানা যেতে পারত। ওর উপর যা অবিচার হয়েছে, তাতে সরকারকে বাধ্য করা যেত কিছু করতে। কিন্তু আমি শুধু নিজেদের রাজ্যের কথা ভাবলাম! মনে হল, লোকটা থাকলে পুরো বরাহভূম অঞ্চলটা একদিন সবুজ হয়ে উঠবে। আমরা বিভিন্ন এনজিও আর সরকারি উদ্যমে যা সম্ভব করতে পারিনি, লোকটা নিঃস্বার্থভাবে সে কাজটা করে যাচ্ছে এই বুড়োবয়সে।

ইতিমধ্যে চাণ্ডিল ছাড়িয়েছে। বরাহভূমে অল্পক্ষণের স্টপেজ, নামবার জন্যে আমরা তৈরী হয়ে নিলাম। গাড়ি অপেক্ষা করছিল। বলরামপুর থেকে ঝালদা রোড ধরে আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের গা ঘেঁসে বাঘমুণ্ডির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাঘমুণ্ডিতে তাপসদের এনজিওর হোমে খাওয়া দাওয়া সেরে এবার রওনা হলাম ‘মুখোশ-গ্রাম’ চড়িদার পথে।

বাঘমুণ্ডি অযোধ্যা পাহাড়ের তলায় এক আধা সহর। এ রাজ্যের ছৌ-সংস্কৃতির জন্ম ও বিকাশ শুরু হয় এখান থেকেই। বাঘমুণ্ডি থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গল ঘেরা সর্পিল রাস্তায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে চড়িদা গ্রাম। ঠিকঠাক রাস্তা না চিনলে গ্রামটিকে খুঁজে পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। পথনির্দেশ-এর নামমাত্র চিহ্ন নেই। এই চড়িদা গ্রামে প্রায় একশো পরিবারের বাস, কয়েক প্রজন্ম ধরে যাঁরা একটাই কাজ করে থাকেন- ছৌ নাচের মুখোশ তৈরী করা। খুব আশ্চর্য়ের বিষয়, পুরুলিয়ার ছৌ যে মুখোশের জন্য প্রসিদ্ধ- সেই মুখোশের আঁতুড়ঘর চড়িদার কথা সাধারণ মানুষ শোনেনি বললেই চলে। অথচ, এখানে একের পর এক ছোট ছোট বাড়িতে সারি সারি সাজানো শুধুই রঙ বেরঙের মুখোশ। সাত-আট বছর আগে এখানে বেড়াতে এসে তাপসের খুব খারাপ লাগে। ছৌ-নাচের মতোই মুখোশ তৈরীও যে কত বড় শিল্প, সে-সম্পর্কে সম্যক ধারণা তার ছিল। যেটা ছিল না, সেটা হচ্ছে এই শিল্পীদের হাল-হকিকত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। চড়িদা পৌঁছে ও বুঝল, একসময় যে শিল্পের সঙ্গে যোগ ছিল ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের, আজ সেখানে শুধুই যেন হতাশা আর আশঙ্কা। শহুরে জীবন ছেড়ে হঠাৎ এখানে এসে পড়ে একটা কথাই ওর মনে হয়েছিল, এটাই তো হতে পারত এরাজ্যের অন্যতম বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি। তারপরেই তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হল ‘রাঢ়-বাংলা’ সংস্থা, বাংলার রাঢ় অঞ্চলে শিল্প-সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়ন ও বিপণনের উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমেই এরা একটি কো-অপারেটিভ তৈরি করে সংস্থার তরফ থেকে পুরুলিয়ার নামোপাড়ায় একটা মুখোশের স্টল খোলে। দাম কম থাকায় প্রফিট-অন-ভলিউম ভালই হতে থাকে। এখন বাংলার অন্যান্য শহরেও এখানকার শিল্পীরা পরিচিতি পাওয়ায় পুজো-টুজোতে মূর্তি গড়ার কাজেও ডাক পাচ্ছে এ গ্রামের ছেলে-ছোকরারা। তবে কাজের মধ্যে হিমশৈলের উপরের ভাগটিই হয়েছে শুধু, সমস্যার মূল অনেক গভীরে। পরের বছর থেকে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্প হাতে নেবার কথা আছে, তাহলে কলকাতায়, বৃহত্তর ভারত বা বহির্বিশ্বে ন্যায্য দামে এদের জন্যে বিপণনের সুযোগ করে দেওয়া যায়।

পরদিন গিয়ে তেনালির সাথে আলাপ করে এলাম। পথে চড়িদা গ্রামের মুখে এসে একটা পূর্ণাবয়ব মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়িয়েছি। জীপ থামিয়ে নেমে দেখি আধুনিক ছৌ নাচের পথিকৃৎ পদ্মশ্রী স্বর্গত গম্ভীর সিং মুড়ার মর্মর-মূর্তি। পাশেই একটা বাড়ি থেকে নাচের বোল আর মাদলের আওয়াজ আসছিল। গেলাম সেখানে। দেখি একটা ক্লাবঘরের মত, একজন মধ্যবয়স্ক গ্রাম্য ভদ্রলোক ছৌ-নাচের তালিম দিচ্ছেন। পরিচয় পেলাম- ইনি গম্ভীরজীর সুপুত্র কার্তিক সিং মুড়া। আলাপ হল। দেখলাম একেবারে মাটির মানুষ, বিনয়ী, কথাবার্তায় বোঝা অসম্ভব যে দল নিয়ে কত দেশে বিদেশে অনুষ্ঠান করে এসেছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিটে পৌঁছলাম মুখোশ-গ্রামে। সত্তরোর্ধ্ব শিল্পী গণপতি সূত্রধরের সঙ্গে আলাপ হল। লক্ষ্মণ দত্ত, হরেন, শংকর বেরিয়ে এল আশেপাশের দোকান ছেড়ে, বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা হল মুখোশশিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে।


পরের গন্তব্য বাসুডি। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি একজন শক্তপোক্ত কৃষ্ণবর্ণ বয়স্ক লোক একমনে কিছু চারাগাছের পরিচর্যা করে চলেছে। ইনিই তাহলে তেনালি! বেশ খানিকক্ষণ ধরে গল্পগুজব হল। ভাঙা বাংলায় ও যা বোঝাল তাতে মনে হল ওর আর বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের উপর কোনও টান অবশিষ্ট নেই। তেমন কিছু মনেও পড়ে না। তাছাড়া একটা অভিমানও আছে, ওরা কেউ কোনদিন খোঁজ করল না বলে। তবে ওর হাতের কাজ যা দেখলাম, পুরো পুরুলিয়া না হোক, বরাহভূম অঞ্চলটাকে যে ও বদলে দেবে সময় পেলে তাতে আর কোনও সন্দেহ রইল না আমার।


* * * *  *

এবার কলকাতা ফিরে এসেও তাপসের মনখারাপ ভাবটা যাচ্ছে না। ওকে বোঝালাম, ‘যে অন্যায় ভুলটা পুলিশ বা কলকাতার লিগ্যাল সিস্টেম করেছে তেনালির সাথে, তার দায়িত্ব কি তোর একার?’ ওর বক্তব্য- ‘নাহয় সেদিন টেন্ডার ওপেনিং-এ একটু দেরীতে পৌঁছোতাম, এমন কী ক্ষতি হত তাতে? একটা মানুষের জীবন, বা হয়ত একটা পরিবার এভাবে নষ্ট হয়ে গেল আমার সামান্য একটা ভুলের জন্যে।‘ আমি আর ভাবতে পারলাম না, তাপসকে না জানিয়ে লালবাজারে ক'দিন একটু ছোটাছুটি করলাম আমার এক এসপি বন্ধুর সাহায্য নিয়ে। শেষে তেনালির ফাইল হাওড়াতেই খুঁজে পাওয়া গেল। ওর ত্রিশ বছর আগের ছবিটা স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেওয়া হল গুন্টুর থানায়।
এই ঘটনার ঠিক দুমাস পরে হাওড়া সিটি থানা থেকে ফোন এল, তেনালির পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওর বউ থাকে বিজয়ওয়াড়ায়, ওখানকার ভেঙ্কটেশ মন্দিরে ভোগ রান্নার যোগান দেয়, সেখানেই থাকে। তার একমাত্র ছেলে ট্যাক্সি ড্রাইভার, বউ নিয়ে মুম্বাইয়ে থাকে। তেনালির আসল নাম গুন্ডালু, আগে তেনালি শহরের ভেঙ্কটেশ মন্দিরে মালীর কাজ করত। খুব ধর্মভীরু পরিবার, বাপ-মা-বউ-ছেলে নিয়ে সদলবলে কলকাতা এসেছিল তীর্থ করতে। কালিঘাটের আদিগঙ্গায় তেমন জল ছিল না, তাই ফেরার সময় গঙ্গাস্নান করতে গেছিল হাওড়া স্টেশনে সবাইকে বসিয়ে রেখে, তারপরের ঘটনা তো আমাদের জানা-ই। ওদের দলটা ওর বাবাকে রেখে চলে যায়, তা বুড়ো বাপ আর একা একা কোথায় খুঁজবে, হপ্তাখানেক পরে পয়সার টান পড়ায় সেও ফিরে যায়।

আমি সব শুনে একেবারে করোমণ্ডলে বিজয়ওয়াড়ার দুটো রিজার্ভড টিকিট কেটেই ফিরলাম বাড়ি। তারপর সেবার তাপস যেমন আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল, সেই একইরকম ভাবে ওকে বললাম- ‘পর্শু দুপুর দুটোয় হাওড়া স্টেশনে চলে আয়, করোমণ্ডলে আমরা বিজয়ওয়াড়া যাচ্ছি। তোর টিকিট হয়ে গেছে।'

তেনালি, থুড়ি গুণ্ডালুর বউ কিছুতেই শুনল না, চলে এল আমাদের সঙ্গে। শ্বশুর শাশুড়ী মারা গেছেন, ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে, চিন্তার কিছু নেই। বিজয়ওয়াড়া বড় সহর, ও সেখানে থেকে মোটামুটি ভালই হিন্দি বলতে শিখে গেছে। ........তারপর ত্রিশ বছর পরে স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন, গুণ্ডালুর স্মৃতিশক্তি ফিরে পাওয়া- সেসব সেন্টিমেন্টাল বর্ণনা দিতে গেলে একটা টিভি সিরিয়াল হয়ে যাবে এখন।

যাক, নিশ্চিন্ত যে এক ঢিলে তিন, না না চারটে পাখি মরল। গুণ্ডালু ওর বউ খুঁজে পেল আর তাপসের অপরাধবোধের সমস্যাও মিটল। আর হ্যাঁ, গুণ্ডালু কিছুতেই ফিরতে চাইল না, এ জায়গাটা ওর ভাল লেগে গেছে। গায়ের রঙ কালো বলে ছোটা লাপাং থেকে বাঘমুণ্ডির সাঁওতালরা ত ওকে দেবতা মনে করে, ওর নাম রেখেছে ‘দারে-আপা’ বা গাছ-বাবা। স্বামী-স্ত্রীতে এখন বাসুডি গ্রামেই থাকে। সুতরাং গ্রীন প্রজেক্ট আপাততঃ বন্ধ হচ্ছে না।

আর চার নম্বর পাখি? আমি এইমাত্র বাসুডি থেকে বাঘমুণ্ডি ফিরলাম, ওখানেই মাঝে মাঝে থাকি এসে, ভালই সময় কাটছে এখন। 

Wednesday, May 11, 2016

Bengali Micro-story 42 - Cha.

চা।।

'বুঝলি ঝিঙে, একটু পরে আসছে গোবিন্দপুর। দেখবি খেয়ে, চা কাকে বলে।'
'তুমি এ চায়ের সন্ধান কোথায় পেলে রাণাদা'- ঝিঙের প্রশ্ন। আসলে কিন্তু ওর নাম পটল, ঝিঙে নয়। তবু দু'বেলা নাম নেওয়াটা তোলার থেকে কোনও অংশে কম নয় বলে রাণাদা ওকে ঝিঙে নামেই ডাকেন। পাড়াতুতো দাদা শুধু নয়, জামাইবাবুও বটে। তাই পটল আর ওনাকে ঘাঁটায় না। ওরা মিহিজাম থেকে কল্যাণেশ্বরী-মাইথন ঘুরে একেবারে তোপচাঁচি পর্যন্ত বেড়িয়ে আসবে ঠিক করেছে। গাড়ি রাণাদার, তবে ড্রাইভার চালাচ্ছে। সাথে আছে পটলের দিদি ছিম্মি বা শ্রীময়ী আর পাড়ার বন্ধু মৈনাক। এখন জিটি রোড প্রায় পুরোটাই এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাওয়াতে শ'দেড়শো কিলোমিটার জার্নির সময় বিশেষ লাগে না, ধকলও পড়ে না তেমন।
তা বলে কি চা খেতে হবে না। কিন্তু রাণাদা সেই কবে ইলেকশান ডিউটিতে গিয়ে কোন ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে চা খেয়েছিলেন, তার স্মৃতি আর ভুলতে পারেন না। 'আর একটু, এই তো নিরসা পেরোল'- এইসব বলে চালিয়ে যাচ্ছেন তখন থেকে।
'জানিস, আগের ইলেকশনে প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে এসেছিলাম এই গোবিন্দপুরেই। জিটি রোড থেকে একটা রাস্তা এখান হয়ে ধানবাদ যায় বলে এখানে প্রচুর ট্রাক চলে সারাদিন সারারাত ধরে। তাদের খাতিরদারির জন্যে তাই এখানে আছে বেশ কিছু ধাবা জাতীয় দেশী হোটেল। তার একটাতে রোজ সকাল-সন্ধ্যে চা খেতে আসতাম সবাই মিলে।'
'কেন, কাছাকাছি আর কোনও চায়ের দোকান ছিল না বুঝি?' মৈনাকের প্রশ্ন।
'থাকবে না কেন? তবে এরা বানাতো খাঁটি দুধের আর শেষে ইচ্ছে করেই দুধটাকে একটু পুড়িয়ে দিত। এদের দেখাদেখি অনেকেই সেটা করলেও কারোরটা তেমন জমত না। এই ত এসে গেছি ধানবাদ মোড়, আর মাত্র দু' মিনিট।'
নাঃ, যেখানকার কথা বলছিলেন রাণাদা সেখানে কোনও চায়ের দোকানই নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঢাবাওলাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে বছর দুই আগে। বিক্রি বাড়াবার জন্যেই হোক বা নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করার জন্যে, চায়ের জলে সামান্য আফিম মেশাত সে। নারকোটিক আইনের চোখে এটা নিষিদ্ধ বলে তার কারাদণ্ড হয় ও দোকানটি উঠে যায়।
'না রে, পৃথিবীর কোনও ভাল জিনিষই বোধহয় আইনসম্মতভাবে পাওয়া যায় না।' এতক্ষণে জীবনের একটা গভীর সারতত্ব উপলব্ধি করে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন রাণাদা।

Friday, May 6, 2016

মনের মণিকোঠা থেকে ।। ৮ ।।

মনের মণিকোঠা থেকে।। ৮ ।।

অজয়কে ক্লাস ফোর থেকে দেখে আসছি স্কুলে। তবে সেভেন্থে ওঠার আগে পর্যন্ত ওর বিশেষ কোনও পরিচয় পাইনি। সিক্সথে আমরা এলাম মিডল স্কুলে (তখন তাই ছিল), সেখানে ড্রিল স্যার শূরবাবুর খুব কাছের ছাত্র হয়ে উঠল সে, যাকে আমরা 'টিচার্স পেট' বলি তাই। অবশ্য তাতে আমাদের তেমন চিন্তা ছিল না, তবে মাঝে মাঝে ড্রিলের পিরিয়ডে অজয়কে নেতৃত্বভার দিয়ে যখন শূরস্যার কেটে পড়তেন তখন অজয়ের বাড়াবাড়িতে এত রাগ ধরত যে কিছু বলার নয়। ওর বিশেষ রাগ ছিল মাথুর, বিশ্বজিত বা হাবুলদের মত ভালমানুষদের উপর। একটু হাত-পা নাড়ানো কমবেশি হলেও তাদেরকে মাঠময় রোদের মধ্যে ছোটা করাতো। ভজু ছিল রোগা-পাতলা, কিন্তু ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে ওকে কায়দা করতে পারত না। যাই হোক, অনেকের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে রাগ ছিল, কিন্তু স্যারের কড়া শাসনের ভয়ে কিছু বলার উপায় ছিল না।
জানুয়ারিতে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন উপলক্ষ্যে সেবার শূরস্যার ঠিক করলেন 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকের একটা অংশ অভিনয় করাবেন। 'আমি আলেকজান্ডার', অজয় আগেই জানিয়ে দিল। 'দূর বোকা, নাটকের হিরো তো চন্দ্রগুপ্ত, তুই ছাড়া চন্দ্রগুপ্ত কাকে মানাবে'- স্যার বললেন। কি ভীষণ পক্ষপাতিত্ব! আবৃত্তি-অভিনয়ে বাম্পি-ভজু-কল্যাণদের একটু নাম ছিল, ওরা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকল। তবে রিহার্সেলে নেমেই অজয় সেলুকাস ও আন্টিগোনাসের আসন্ন দ্বন্দ্বযুদ্ধ থামিয়ে কিছুক্ষণ তলোয়ার ঘোরাল। তারপরে সেই ডায়লগ- 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না'- এই অংশটা বলতে পেরে মহাখুশি। সৌমিত্র সবচেয়ে লম্বা বলে ও হয়েছিল সেকেন্দার আর কল্যাণ সেলুকাস। রিহার্সেলের শুরুতেই মজা। প্রম্পটার ছেলেটা- নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ছিল বাঙাল। তার গলা আমরা শুনতে পাচ্ছি না। তবে প্রথম দৃশ্যেই সেকেন্দার শাহ আড়াল থেকে প্রম্পট শুনে বলে উঠলেন- 'সইত্য সেলুকাস, কি বিসিত্র এই দ্যাস!' আর তারপর ঝাড়া তিনমিনিট ধরে হা হা হো হো। আমি বললাম, 'স্যার, এটাই থাকতে দিন, পাবলিক খুব মজা পাবে', স্যার একধমকে চুপ করিয়ে দিলেন। অনেকের ইচ্ছে ছিল চন্দ্রগুপ্ত একটু টাইট খাক, কিন্তু অজয় এমন পিচবোর্ডের তলোয়ার ঘুরিয়ে অভিনয় করতে লাগল, যে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, পড়ার ঝামেলা নেই, তাই আমাদের দিনগুলোও ভালই কাটতে লাগল।
দেখতে দেখতে পুরস্কার বিতরণের দিন এসে গেল। রাবণজ্যেঠু সবাইকে এমন সাজিয়ে দিলেন, টিনের তলোয়ার খাপে নিয়ে কল্যাণ-সৌমিত্র-বাম্পি-দেবু-অজয় গ্রীনরুমে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল যে আমাদের রীতিমত হিংসে হতে লাগল।
নাটক প্রথম থেকেই জমে গেল। এমনকি অ্যান্টিগোনাসের যেখানে চন্দ্রগুপ্তের তরবারির এক চোটেই পরাস্ত হয়ে যাবার কথা, সেখানে ওরা ঝাড়া পাঁচ মিনিট ধরে লড়ে গেল। দর্শকরা তো প্রায় সবাই ছেলেমানুষ, খুব খুশী সবাই। চটাপট হাততালি পড়তে লাগল। গোলমালটা বাধল তার পরে। চন্দ্রগুপ্ত বিদ্যুৎ গতিতে তলোয়ার বের করে বলবে, 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না'। এদিকে কিছুক্ষণ আগের ভয়ানক যুদ্ধের ফলে টিনের তলোয়ার ঈষৎ বেঁকে গেছে, খাপ থেকে আর বেরোচ্ছে না। ফলে অজয় ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে...বধ না করে...বধ না করে' আর তলোয়ার টেনে যাচ্ছে। শেষে সেলুকাস এসে উদ্ধার করল এই বলে, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে......মহারাজ, বোঝা যাচ্ছে ওকে বধ না করে বন্দী করা যাবে না, এখন আপনি যা ভাল বোঝেন।'
বেচারা অজয়! ওর সেরা ডায়ালগটা মাটি হয়ে গেল। ওর মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে শূরবাবু এগিয়ে এসে বললেন- 'মন খারাপ করিসনে, পাবলিক কিচ্ছু বোঝেনি, তোর তলোয়ার টানাটানিতেই প্রচুর তালি পড়েছে।' তবে অজয়ের শত্রুর দল ব্যাপারটা ভালই বুঝেছে। তারা খুব খুশি।
একে একে নিভেছে দেউটি। অজয় নাথচৌধুরী আর সৌমিত্র চক্রবর্তী অনেকদিন আগেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, কারো বন্দীত্ব গ্রহণ না করেই। তারা এখন সব শ্ত্রুতা-মিত্রতার ঊর্ধ্বে। অজয়-সৌমিত্র, তোরা যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস।

কি মজা! বাংলা অণু-গল্প

কি মজা!

শিলচর শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দুরে কুম্ভিরগ্রাম এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে পড়ে শালগঙ্গা গ্রাম। সেখানে দুর্গাদেবীর একটি মন্দিরের সেবাইত ছিলেন ঠাকুর বলরাম গোস্বামী। জানিনা এ  সৌজন্যটা এখনো আছে কিনা, ৯০-৯১ সালে কোনো অতিথিই ঠাকুরের প্রসাদ না খেয়ে সেখান থেকে ছাড়া পেতেন না। প্রসাদ বলতে একেবারে দুপুরের খাবার- ভাত, ডাল, তরকারী চাটনি- সব নিরামিষ। এমনি এক বর্ষার দিনে আমরা সপরিবারে ও সবান্ধবে গেছি, পুজোশেষে গোঁসাই ঠাকুরের অনুরোধে খেতেও বসেছি।

মাটিতে পাতা পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। খাওয়ার স্থানটি শুকনো হলেও দু-সারির মাঝের জায়গাটুকু পরিবেশকদের পায়ে পায়ে ভিজে উঠল। এমন সময় 'দড়াম'! এক আধবুড়ি ভদ্রমহিলা জলে পা পিছলে পপাত ধরণীতলে। একটি বার-তের বছরে মেয়ে খাচ্ছিল। মজা পেয়ে সে হো-হো করে হেসে উঠল। ব্যস আর যায় কোথায়! বাপান্ত গালাগাল শুরু করলেন মহিলাটি।

-আহা এত কথা কেন দিদিমা? আমি পড়লে তুমি হাসতে না? বল সত্যি করে- হাসতে না? তা মনে কর না আমি পিছলে পড়েছি আর তুমি হাসছ।
অকাট্য যুক্তি! এবার আমাদের সবার হাসবার পালা। শেষে আর থাকতে না পেরে মহিলাটিও হেসে উঠলেন। একটা বিশ্রী কান্ড হতে হতেও তার এক মধুর পরিসমাপ্তি ঘটল।

চারপাশের কান্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে আমরা যেন অনেক বদলে যাচ্ছি- স্বাভাবিক সহিষ্ণুতা আর রসবোধটুকু যেন আমরা দিন-দিন হারিয়ে ফেলছি।

বনজ্যোৎস্না।। স্মৃতিচারণ

বনজ্যোৎস্না।।

বিলুকাকুর ছেলে বাবুই শান্তিনিকেতন থেকে গরমের ছুটিতে বাড়ি এলেই শুরু হয়ে যেত উৎসবের পালা। বলতে গেলে আমার গানের আগ্রহের মূল প্রেরণা সেই ছিল। চৈত্রের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গানবাজনা-আবৃত্তি-রবীন্দ্র পরিষদ আর বাবুই-বুড়ো-রিণ্টুদের সাথে কিভাবে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। বাবুই আর তার দুই বোন যে কুঁড়ে ছিল তা বলব না, তবে মাঝে মাঝে সকাল এগারটায় পৌঁছেও দেখতাম ওরা ঘুমোচ্ছে। ভেবে দেখতাম, সত্যিই তো, ছুটির দিনে সকালে উঠে করবেই বা কি?

একদিন সন্ধ্যে নাগাদ কি কাজে যেন ওবাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি বিলুকাকু বাগানে খুরপি হাতে ফুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত, মুখে গুনগুন রবীন্দ্রসংগীত। আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন- কাকু এসো, তোমার কথাই ভাবছিলাম। উনি দেখতাম আমাদের 'কাকু' ডাকটা আমাদিগকেই ফিরিয়ে দিতেন, আজকাল এ ধরণের স্নেহশীল মানুষ পাওয়া দুর্লভ। ভেতরে আসতেই বাবুইকে ডাক দিলেন, ও আর ওর বোন রিংকু ছুটে এল। রিংকু বলল- আজ রাত্রে আমাদের বাগানে বনজ্যোৎস্না, তোমার নিমন্ত্রণ রইল। বনজ্যোৎস্না? এটা কি কোনও শান্তিনিকেতনী ইয়ার্কি নাকি! বলতেই চোখ পড়ল সামনে পুবদিকের দুই বিল্ডিংএর ফাঁকে বিশাল লাল রঙের গোলাটার দিকে। বাবুই বোঝাল, জ্যোৎস্না রাত্রের পিকনিককেই তারা বনজ্যোৎস্না বলে। চাঁদা? নো চাঁদা। বাগান বিলুকাকুর, খরচায় লোধকাকু ও চম্পাটিকাকু। শুধু গানে গলা মেলাতে হবে।

এ কাজটা আমি খুব পারি। চন্দ্রাহত হয়ে পরের দু-তিন ঘণ্টা যে কিভাবে কেটে গেল বোঝাই গেল না। বিশ্বনাথকাকু জোকের ভাণ্ডারি। বাবুইয়ের দুই বোনকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে দেখে লোধকাকীমা গুনগুন করতে করতে হঠাত গেয়ে উঠলেন- "চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে"। তাই শুনে আকাশের চাঁদটাও আনন্দের চোটে আকাশের মাঝামাঝি এসে তার বত্রিশ (নাকি আরও বেশি?) পাটি বিকশিত করে দিল। বাবুই গাইল শচীন কর্তার 'আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে'। তারপর রাত দশটায় সমবেত বেদগান 'সংগচ্ছধ্বম্‌ সংবদধ্বম্‌' এর সাথে সমবেত খিচুড়িভোজন। যা একখানা সন্ধ্যা কেটেছিল না!

আজ এতকাল পরে সেসব কথা মনে পড়ল কারণ কয়েকমাস আগে বাবুই আমাদের ছেড়ে জ্যোতির্লোকে পাড়ি দিয়েছে। জানিনা যাবার আগে এসব কথা তার মনে পড়েছিল কিনা। জানিনা বিশ্বপিতার দরবারে গিয়ে আজ সে কি গান শোনাচ্ছে তাঁকে।

পানের অভিলাষ ।। প্যারডি কবিতা

পানের অভিলাষ।।
পল্লব চট্টোপাধ্যায়


কোন হাটে তুই বিকোতে চাস, ওরে আমার পান,
কোনখানে তোর স্থান?
যাত্রীগণের আনাগোনা ব্যস্ত ইস্টিশনে
ভিড়ভাট্টায় হাজার ঠেলা, তাহারই এক কোণে
হিন্দুস্থানী পানওয়ালার ছোট্ট দোকানখানা-
দেশোয়ালি ভাই, রেল-বাবুদের সদাই আনাগোনা,
লাল পিকে আর চুনের ছোপে রাঙা দেয়ালখান-
পাবি সেথায় মান?
পান তা শুনে সবুজ মাথা নেড়ে নেড়ে কয়
নয়, কখনো নয়!
কোন গলিতে থাকবি রে তুই, ওরে আমার পান,
কোথায় পাবি মান?
আলো-আঁধার পথের মাঝে ব্যস্ত বাড়িগুলো
পথিক চলে নেশার ঘোরে চরণ টলোমলো।
নূপুরধ্বনি হাওয়ায় ভাসে সঙ্গে চটুল সুর
সুরায়-সুরে-গন্ধে মাতাল রূপের মধুপুর
হাজার মজা লুটবি সেথা, যাবি কি? পান কয়-
ছি ছি ছি, কভু নয়!
কোনখানে তুই বাঁধবি ডেরা, ওরে আমার পান,
কে দেবে সন্ধান?
গাইছে গজল গুলাম আলি মস্ত্‌ মেজাজখানা
মৌশিকীর সে আশিয়ানায় হামেশা দেয় হানা
বোল-তারানার মাঝে-মাঝে তান ও তরন্নুম
লখনওঈ জর্দা, হাসিনাদের তবস্সুম।
যাবি সেথায়? মেজাজখানা হয়েই যাবে তর্!
বহুত খুব ওস্তাদ, তাও লাগছে বেজায় ডর-
পান কেঁদে কয়, ভাই,
ক্যাম্‌নে সেথা যাই!
কোন হাটে তুই দিবি হৃদয়, ওরে আমার পান,
ধন্য হবে প্রাণ?
লোলচর্ম গলদঘর্ম বৃদ্ধা যেথায় বসে,
বৃদ্ধটিরে বাক্যবানের ঘা মারছেন কষে -
হঠাৎ যেন পড়ল মনে স্মৃতির চাদর খসে
ষাটটি বছর আগের কোনো তাম্বুলেরই রসে
সিক্ত মধুর রাত্রিখানা, পাবি সেথায় মান?
হঠাৎ খুশী ঝলকে ওঠে, কহে সবুজ পান,
সেইখানে মোর স্থান!
MARCH 8

একটি ছোট্ট ঘটনা ও বিভিন্ন কবিদের মতামত।।


মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(মেঘনাদ-বধ কাব্য়)

বিপাকে পড়িয়া যবে চৌর্য-শিরোমণি
রাজন পড়িল ধরা পুলিশের হাতে
সিংগাপুরে। মিডিয়া, কি হৈল তার পরে?
কহ, কোন কেসে ফেলি পুলিশ তাহারে
পেশিল ন্যায়ের হাতে? নহে তাহা? তবে
সি-বি-আই লয়ে তারে অতি সঙ্গোপনে
লুকাতে চাহে কি তারে দাউদের ভয়ে-
এমতি কহিছে সবে।মুম্বাই পুলিশ
দাউদের ভৃত্য সবে, তাই রাজনেরে
দিল্লি রাখা হল বুঝি! বা এ সরকার
নতুন জামাতা এক পেল এতদিনে,
কাসভের পর। তবে তাই হোক, সখে,
দাউদ থাকুক সুখে পাকিস্তানে। হেথা
রাজন পালিত হোক জামাই-আদরে।।


সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
(ঝর্ণা)

বল মোরে মিডিয়া, সুন্দরি মিডিয়া!
ধরলরে সিবিআই রাজনকে কি দিয়া?
সিংগাপুরে আলোড়ন, দিল্লি কম্পমান
দাউদ পড়বে ধরা এইবার বুঝি বা!

মুম্বাই পুলিশ কি দাউদের টাকা খায়!
তাই সেথা যেতে নাকি রাজন ভয়ে মরে,
তাই বুঝি সিবিআই দিল্লিতে রেখে ভাই,
রাজনে পুষতে চায় জামাইয়ের আদরে?


কাজী নজরুল ইসলাম
(কাণ্ডারী হুঁশিয়ার)

দুর্গম গিরি কান্তার মরু পেরিয়ে সিংগাপুর
রাজনকে যেথা ধরে সিবিআই সে দেশ বহুত দূর!
বলরে মিডিয়া কিভাবে হল এ রূপকথা বাস্তব?
এবার কি তবে দাউদকে ধরা হবে আজ সম্ভব।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছে কাসভ  জেহাদের জয়গান
জাতীয় জামাই হবার স্বপ্ন ভেঙ্গে তার খানখান,
দাউদের ভয়ে মুম্বাই ছেড়ে দিল্লিতে সে রাজন-
দেখি কতকাল জামাই আদরে কাটে তার দিনক্ষণ!!


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(এবার ফিরাও মোরে)

সংসারে সবাই যবে আখের গুছোতে নিজ রত
তুই সেথা সিবিআই দু:সাহসী বালকের মত
অতি দূরে সিংগাপুরে বলত কিভাবে ছুটে গেলি,
চৌর্য চূড়ামনি সেই রাজনেরে পাকড়াও করিলি
মিডিয়া দেখাও মোরে। এ কিভাবে হয়েছে সম্ভব
এবার কি তবে। দাউদ পড়িবে ধরা, কিভাবে ও কবে?
কোন পাকিস্তান মাঝে দাউদ রয়েছে বসে সুখে,
সেসব কি বলা যায়? জানোনা কি, মুম্বাই পুলিশ
দাউদের কেনা সবে? তার চেয়ে ললিপপ মুখে
দিল্লিতে ঘুমোও শুয়ে, জানি তুমি নওকো ফুলিশ।


যোগীন্দ্রনাথ সরকার 
(দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল)

গিয়ে বহুদুর সেই সিংগাপুর
পৌঁছিয়ে হেসে,
চোরাকারবারি ছোটো রাজনেরি
দুয়ারেতে এসে।
পাকড়াও করে লক আপেতে পুরে
দেখাই সবারে,
সিবিআই বলে এই ধরাতলে
কিছুতো আছে রে!
রোগে মৃতপ্রায় রাজন হেথায়
ধরা দিয়েছে যে,
তুই রে মিডিয়া সব বলি দিয়া
ফেলে দিলি লাজে!
জামাই আদরে পুষব তাহারে
দিল্লিতে রেখে,
পাবলিক জালি, দাউদকে কালই
ভুলে যাবে লোকে।


রূপচাঁদ পক্ষী
("Let me go ওরে দ্বারী")

লেট মি সে মিডিয়া ওরে
আই ওয়েন্ট টু সিংগাপুরে
গেছিলাম ইন্ডিয়া হতে
আমি সিবিআই টু মাচ ঘুরে।
সিটিং দেয়ার ইস্মল রাজন
স্টেইং বসে আর কতক্ষণ
আই অ্যাম অল স্মাগলারের যম,
রাজনকে আজ ফেলছি ধরে!
দাউদ ওদের সবারি হেড
পুলিশকে ঢের টাকাও হি পেড
ফর হুম মুম্বাই পিপ্‌ল্‌ ডেড,
দাউদ এবার যাবেই উড়ে।।


শক্তি চট্টোপাধ্যায়
(অবনী, বাড়ি আছো?)

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে সিঙ্গাপুর,
সিবিআই হাঁকে, তখন রাতদুপুর-
রাজন কি বাড়ি আছো?

ঝাঁ-চকচকে রাস্তা চারিধার
তবু এখানে অপরাধীরা ঘোরে,
ছোটা রাজন লুকিয়ে আছে হেথা
যে করে হোক, ধরতে হবে তারে।
ও রাজন, বাড়ি আছো?

দাউদ আছে কোথা পাকিস্তানে
রাজন নাকি সব খবরই জানে,
ধরে ব্যাটাকে দিল্লী নিয়ে গিয়ে
ভাল করে মোচড় দেব কানে।
রাজন হে, বাড়ি আছো??


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।।
(সত্যবদ্ধ অভিমান)

এই হাত খেয়েছে কত শাসকদলের ঘুষ
আমি কি এ হাতে রাজনকে ধরতে পারি?
সিংগাপুরের সেই অভিশপ্ত হোটেলে
তার মুখে পড়েছিল পাঁচ সেল টর্চের আলো
মুহূর্তের মাঝে পড়েছিল হাতে হাতকড়া,
তখনি তাকে চার্টার্ড প্লেনে করে
নিয়ে যেতে চেয়েছি মুম্বাই।
সবে বলেছিল, রাজন ভুগছে রোগে
পলাতক অভিশপ্ত জীবনের থেকে বন্দীদশা ভাল
তাই সে দিয়েছে ধরা, সে যা খুশি বল
শুনতে তা বয়ে গেছে।
কি ভেবেছিলে মিডিয়া আমাকে?
এই হাত খেয়েছে কত শাসকদলের ঘুষ
এ হাতে কি সিবিআই রাজনকে ধরতে পারে!

মনে রেখো মিডিয়া, রাজনের মুখে
ফুটে উঠেছিল ভয়, মুম্বাইয়ের নামে,
সেখানে পুলিশ সবে দাউদের চর। যে হাতে তারা
খেয়েছে তার টাকা, সে হাতে কি তারা
দাউদকে ধরতে পারে? তাই আজ রাজনকে
দিল্লী নিয়ে যাব, সেখানে থাকবে সুখে জামাই আদরে।
যে হাত ধরেছে ছোটো রাজনকে, সে হাতে কি
সিবিআই আর ঘুষ নিতে পারে?!

(আপাততঃ অনেক হল, কবিদের ভুত বিদায় নিয়েছে- এবার জ্যান্ত কবিরাও আসতে পারেন।)

বালক সংগীত ।। স্মৃতিকথা

বালক সংগীত।।

(১)

'এই, দুগ্‌গামেলায় বালক-সংগীত হবেক,যাবি ত? লব-কুশ পালা।' সন্ধ্যের মুখে মিন্টুর ডাক শুনতে পেলাম বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে। ছোট গ্রাম। কাউকে কিছু বলতে হলে একটু উচ্চস্বরে বললেই চলে, ঠিক তার কানে যাবে। তবে মুস্কিল হল গ্রামের প্রায় সবাই দরকার না থাকলেও শুনে ফেলবে সে কথা। নন্দকাকার খোঁজে এসেছেন এক ভদ্রলোক, গাঁয়ে ঢোকার আগেই সেজজ্যেঠি দিল তাকে তাড়িয়ে- 'এ বাবা, নন্দকে এখন কুথাকে পাবে, উ গেইছে হাঁসাপাথর, বিটির সম্বন্ধ কইরতে!' কে বলল? কেন, নন্দ নিজেই। যাবার সময় পাশের বাড়িতে ভাইকে ডাক দিয়ে বলে গেলেন না- 'দুলাল্যা রে, হাঁসাপাথরের সম্বন্ধট যদি লাগ্যে যায় কিছু টাকা ধার লিব তর কাছে।' ব্যস, গোটা গ্রামকে তা জানানো হয়ে গেল।
দূর, কি যে ধান ভানতে শিবের গাজন শুরু করে দিলাম! হচ্ছিল বালক সংগীতের কথা, সেটি যে কি বস্তু আমার ৬-৭ বছর বয়সের বিশাল অভিজ্ঞতায় তার কোনও ধারণাই ছিল না। তবে মিন্টু যাচ্ছে যখন তখন ভালই হবে। সে বড় নাক-উঁচু ছেলে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে আর ক্লাসে বছর বছর ফার্স্ট হয় বলে ও আমার সমকক্ষতা দাবী করে। অবশ্য আমি পড়ি তখন শহরের স্কুলে আর ফার্স্ট কাকে বলে তখনো ঠিক বুঝতাম না, সে খবর আর মিন্টু কিভাবে জানবে! তবে আমার ছুটি-ছাঁটায় গ্রামের বাড়িতে আসা অতি অবশ্য ছিল। না, আমি কিন্তু আত্মজীবনী লিখছি না। সে সময়ের গ্রাম্য জীবনযাত্রা আর সমাজ-সংস্কৃতিকে একটা বাচ্চা ছেলে কি চোখে দেখতে পারে, তাই জানাবার চেষ্টা করছি মাত্র। এর মধ্যে সত্যি আর কল্পনা মিলেমিশে জগাখিচুড়ি হয়ে আছে, সে জট ছাড়ানো আমারই কম্মো নয়, তাই পাঠক যেন তার চেষ্টাও না করেন।

আমার ভরসা ছিল মিন্টু যখন ডেকেছে ঠাকুমা শুনলে না করবেন না। দাদু ত খেয়ালই করবেন না। উনি তখন মানভূমের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণাতেই ব্যস্ত। তাঁর কাজের মাঝে ডুবে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটে গেছে। গ্রামে ছিল খুব বাঁদরের উপদ্রব। বিশাল বিশাল লেজওলা মুখপোড়া হনুমান। একবার এক হনুমানের পায়ের ঠোকর লেগে মস্ত একটা ইঁটের টুকরো ছাত থেকে পড়েছে ঠাকুমার মাথায়। রক্তারক্তি কাণ্ড। দাদু তখন উপরতলায় গবেষণা করছেন। ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন- 'ওগো শিগ্‌গির এসো, বাঁদরের কাণ্ড দেখে যাও, ইঁট ফেলে দিয়েছে মাথায়।' দাদু পুঁথি থেকে মুখ না তুলেই পালটা প্রশ্ন করলেন- 'কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড না লঙ্কাকাণ্ড? যত বাঁদরামো ঐ দুটোতেই পাবে।' ভাগ্যিস আমাদের বাড়িতে ভাড়াটে একজন ডাক্তারকাকু ছিলেন, তিনিই সে যাত্রা সামলান।

সেই দাদু যে হঠাৎ আমাকে ডেকে জিগ্যেস করবেন- 'দাদুভাই, সন্ধের মুখে গুটিগুটি চললে কোথায়?'- এরকমটা ভাবিনি। সত্যি বলছি, মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। সব শুনে তিনি বললেন, 'যেতে পার একটা শর্তে। কি দেখলে, কেমন দেখলে, কাল আমার কাছে লিখে আনবে।' আমি বাধ্য হয়ে ঘাড় নাড়তেই একটা সিকি দিলেন আমার হাতে- 'ওদেরকে চাঁদা দিও'।

আমার কাছে তখন একটা আস্ত সিকি মানে অনেক। ভাবছিলাম কি কি খাওয়া যায় তা দিয়ে। যাকগে, ঠাকুমার বাড়ানো দুধের বাটিটা কোনোমতে শেষ করেই ছুট দিয়েছি দুর্গামেলার দিকে, মিন্টুকে খুঁজে বের করে ওর পাশে গিয়ে বসেছি। ও বাবা, দেখি দাদু আগেভাগেই স্টেজের মাঝখানে একটা চেয়ার পেতে বসেছেন, সাথে সজলের দাদু আর আমাদের ডাক্তার কাকু। আর একজন থুত্থুরে বুড়োকে সবাই মিলে ধরাধরি করে স্টেজে নিয়ে বসাল, দাদু আবার তাঁকে প্রণামও করলেন। শুনলাম ইনিই নাকি ঝুমুরগানের বিখ্যাত কবি শ্রীপতি দত্ত, দাদুর মাস্টারমশাই। বালক সঙ্গীতের কর্মকর্তারা গ্রামের মাতব্বরদের দিব্যি মালা-টালা পরাল, তারপর ওঁরা স্টেজ থেকে নেমে এলেন। দাদুকে তারপর আর দেখতে পেলাম না, বোধহয় বাড়ি চলে গেলেন। হঠাৎ একটা বাঁশী আর হারমোনিয়ম বেজায় বেসুরে বেজে উঠল, বুঝলাম এবার পালা শুরু হবে।

(২)

জমকালো স্টেজের পেছনে আঁকা হয়েছে সীন- তমসা নদী বয়ে চলেছে, দূরে চিত্রকূট পাহাড় দেখা যাচ্ছে, তার একপাশে ঋষি বাল্মীকির আশ্রম। একমুখ পাকা দাড়ি নিয়ে বাল্মীকি যোগাসনে বসে আছেন, জানি খুব কষ্ট হয় ওভাবে একটানা বসে থাকতে- কিন্তু তিনি নির্বিকার। সীতা একটা বঁটি আর একটা বেগুন নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু কুটছেন না- পরে ভেবে দেখেছিলাম ভালই করছেন, একবার কুটলেই তো ফুরিয়ে যাবে, অত বেগুন তিনি পাবেন কোথায়? দুটো বাচ্চা ছেলে, আমার থেকে কিছুটা বড়- বোঝা গেল ওরাই লব-কুশ, রামায়ণ গান গেয়ে শোনাচ্ছে। লক্ষ্মণের হাতে সূর্পনখার হেনস্থার গান শুনে সীতা তো হেসেই কুটিকুটি।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাল্মীকি আর সীতা ভেতরে চলে গেলেন আর তাদের জায়গায় হুপ-হাপ করতে করতে ঢুকল হনুমান। এসেই সে লব-কুশকে ধমক দিয়ে বলল- 'এই ছোঁড়ারা, ঘোড়া কোথায় লুকিয়েছিস, ভালয় ভালয় দিয়ে দে বলছি। এমনভাবে বলছে, যেন হারিয়ে যাওয়া পানের ডিবে খুঁজছে। কিন্তু লব-কুশ মস্ত বীর, বলে- 'সাধ্য থাকে ত আমাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে ঘোড়া নিয়ে যাও'। একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠল, 'বাবা, পরাজিত কে বটে?'- অন্য দর্শকরা 'চুপ চুপ' করে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর লব-কুশ আর হনুমানে কি ভীষণ যুদ্ধ! যাচ্চলে, হনুমান ত হেরে গেল। দুই ভাই খুশীমনে তাকে স্টেজের মুখের কাছে একটা খুঁটিতে বাঁধতে যাচ্ছিল, তার আগে সে হাত দেখিয়ে 'উব্বু' চেয়ে নিল। তারপর স্টেজের ধারের হ্যাজাকটাতে কয়েকবার পাম্প করে এসে আবার ধরা দিল। হনুমানকে বাঁধা হতেই আমরা সবাই পটাপট হাততালি দিয়ে উঠলাম।

হনুমান কিন্তু এই হাততালিতে খুশি নয়। আমাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কট্‌মটিয়ে বলল, ‘খুব তালি দিচ্ছ। কালকে লঙ্কা-দহন পালায় এমন পার্ট করব না, লব-কুশ কেন, রাম-লক্ষ্মণের দিকেও তাকাতে ভুলে যাবে। মিন্টু আমাকে একটা চিমটি কেটে বলে-‘ওরে, তবে কালকেও আসব’। অন্যদিকে মন চলে গেছিল, হঠাত দেখি লব-কুশ ‘মা খিদে পেয়েছে, খেতে দাও’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ‘বাড়িতে চাল-ডাল নেই, একটিমাত্র বেগুন পড়ে আছে- খেতে দেব কি ছাই’- সীতার গলা শোনা যায় ব্যাকস্ক্রীনের আড়াল থেকে। ছেলেদুটো তাতে না দমেই বলল,’ঠিক আছে, আমরা ততক্ষণ কিছু ভিক্ষা করে নিয়ে আসি’ বলে স্টেজ ছেড়ে দর্শকদের মাঝে নেমে পড়ল। পালার দলের অধিকারী কোথা থেকে ছুটে এসে একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে গেল কুশের হাতে, ওরা তাই নিয়েই ‘ভিক্ষা দাও গো, পুরবাসী’ বলে গান গেয়ে পয়সা সংগ্রহ করতে শুরু করে দিল। সবাই দেখি পাঁচ-দশ নয়া পয়সা করে ঠুং-ঠাং ফেলছে বাটিতে। এ ত ভাল জ্বালা! দাদুর কানে যদি খবর যায় যে আমি কিছু দিইনি, তবে আর রক্ষা থাকবে না। অগত্যা আস্ত সিকিটা হাতছাড়া করতে হল।
তখনো পালার ব্রেক চলছে। আমি উঠে গিয়ে ড্রেসিংরুমের ধারে একটু উঁকি মেরে এলাম। দেখি আহা কি অপরূপ দৃশ্য! সীতা আর বাল্মীকি সেখানে বসে বিড়ি খাচ্ছে। আর একপাশে অধিকারী লব-কুশকে ধমক দিচ্ছে- ‘মাত্র চার টাকা তেরো আনা! এতে বালক সংগীত হয়? এবার থেকে আর লব-কুশ পালা নামাবই না।‘ লব মিনমিন করে বলল-‘এ গাঁয়ের লোকেরা কিপ্‌টে!’ ‘থাম তো’, অধিকারী ধমক দিয়ে বলল, ‘যেখানে শ্রীপতি দত্ত, ভোলু ঠাকুরের মত লোক থাকে তারা কিপ্‌টে নয়, ভাল জিনিষের কদর বোঝে। ঐ নাকি কান্না চলবে না, সত্যিকারের ভাল গান গাইতে হবে।‘ আমি মনে মনে ভাবলাম, এদেরকে একবার দাদুর কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়, দু-একটা ভাল ঝুমুর তো শিখতে পারত। এদিকে সীতা বাল্মীকিকে তাড়া দিচ্ছে- ‘চাঁড়ে বিড়িট ফুঁকে লে- ঘন্টি বাজছে।‘ সাথে সাথে ওরা বিড়ি ফেলে ছুটলো। আমিও ফিরে এলাম নিজের জায়গায়।

তারপর হনুমানকে দেখে সীতার দুই ছেলেকে খানিক ধমক-ধামক চলল। রাম-লক্ষ্মণের সাথে লব-কুশের যুদ্ধও খুব জমেছিল। এরপর বাল্মীকির মধ্যস্থতায় ঘোড়া নিয়ে রাম-লক্ষ্মণের ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু কোথায় ঘোড়া? একটা রং-চটা কাঠের ঘোড়া নিয়ে ওরা ফিরে গেল দেখে একটু হতাশই হলাম। তবে শেষ দৃশ্যে সীতার পাতাল প্রবেশটা দারুন জমেছিল। অভিনবত্ব আনতে সীতা পা দুটো রামচন্দ্রের সিংহাসনের পাশ দিয়ে সীনের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন আর পেছন থেকে কারা যেন ওনাকে পেছনে টেনে নিল। তবে হল কি, আস্ত সীতাটা ধীরে ধীরে ড্রপসীনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেও মাথার চুলটা কিন্তু স্টেজেই পড়ে রইল। হনুমান বুদ্ধি করে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে উইংসের আড়ালে চলে গেল।

যাক, পালা তো শেষ, তবে এবার শুরু হল আসল ঝামেলা। দাদু রোজই মনে করাতে থাকেন- ‘ভাইটু, কই কি লিখলে দেখাও।‘ আমি অগত্যা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। একদিন বন্ধুদের সাথে দাঁদার জঙ্গলে গিয়ে অনেক লাল লাল টোপাকুল খেয়ে এসে খুসখুসে কাশি বাধালাম। ভালই হল, কয়েকদিন নিশ্চিন্তি।

(৩)

আমাদের গ্রামের ছেলে হারাধন বা হারা আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে, চাসরোডের কাছে বড়গ্রামে থেকে পড়াশোনা করত। ওর ঠাকুমা আর মা-মরা মাসতুতো ভাই ডুডুন এই গ্রামে থাকত বলে প্রতি ছুটিতেই হারা গ্রামে এসে হাজির হত। কি অনুষ্ঠানে মনে নেই একবার গ্রামে এসে ওর সখের ভিখারির দল নিয়ে মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ল। চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে বাড়ি-বাড়ি চলল ভিক্ষা চাওয়া আর সাথে ওর মিষ্টি গলায় গান-

'‘বিদায় দে গো শচীমাতা আমি সন্ন্যাসেতে যাই,
আমি এইত ভিক্ষা চাই।
পরের মা-কে মা বলিব, পরের দ্বারে ভিক্ষা নিব
যখন যাহা পাই।
তুমি মনেরে বুঝাইয়া রাখ্যো গো,
তোমার নিমাই নাই।।‘'

কতযে গান হারার স্টকে থাকত! ওর প্রিয় গান যার হরিবোলের সাথে খুব নাচ জমত-

"হরিবোল হরিবোল নাম এই বদনে বোল রে।
এই বদনে বোল হরিনাম এই শ্রবণে শোন রে।।
হরিনামের লাগি মহাদেব হলেন যোগী-
ওরে শ্মশানে মশানে ঘোরে হইয়া পাগল রে।।"

আমিও গ্রামে থাকলে বিনা আমন্ত্রণেই হারার দলের সাথে সাথে ঘুরতাম গ্রামের পথে পথে, গলিতে গলিতে। অবশ্য ওর গলার সাথে গলা মেলাতে কখনও সাহস হত না। দেখতাম কাকী-জ্যেঠি-বউদিরা চাল-ডাল, বাগানের ফল-মূল-তরকারি ঢেলে দিচ্ছে হারার ঝোলাতে, গান শুনে সবারই চোখে জল। আমার যে হিংসে হতনা তা নয়, তবে বেলা দুটো নাগাদ জোড়ের ধারের মাঠে ডুডুন আর ঝাবুকাকার ছেলে তরুন মিলে যা খিচুড়ি-লাবড়া রান্না করত তা খাবার পর মনে আর কোনও ক্ষোভ বা খেদ থাকত না। আশ্চর্য হতাম, আমার ওইটুকু বয়সের বোহেমিয়ানা দেখেও ঠাকুমা-দাদু কিছু বলতেন না, শুধু চাইতেন যেন আমি সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে আসি।

এই হারার কথাতেই মনে পড়ল, দুবছর আগে দুর্গাপূজোর মুখে গ্রামের সব ছেলেরা এসে আমার দাদুকে ধরেছে একটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যে। দাদু তখন পুরুলিয়ার ওকালতি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে বাস করতে চলে এসেছেন, এবার ত উনি সময় দিতেই পারেন। দুলালকাকু দাদুর মহাবীর কর্ণকে নিয়ে লেখা নাটক ‘দানবীর’ পড়ে উচ্ছ্বসিত, বলে ‘জ্যেঠাবাবু উটোই করান’। দাদু বললেন, ‘নাটক ত বাংলাভাষায় লেখা। ‘উটো’-বললে ত চলবে না, ‘ওটা’ বলতে হবে'। তবে উনি বললেন, দুর্গাপূজার মধ্যে হবেনা, সময় কোথায়? হ্যাঁ, চেষ্টা করলে কালীপূজায় নামানো যেতে পারে। সবাই তাতেই খুশী। তবে বুড়ো সতীশদাদু কাশতে কাশতে বললেন- ‘ভোলু গাঁয়ের ছেল্যাগুলার মাথা খাছ্যে, ইটো ভাল লয়’। তা কে আর উনাকে পাত্তা দেয়! এই দানবীরে দুটি মেয়ে চাই, কর্ণের মহিষী পদ্মাবতী আর লক্ষ্মীঠাকুর। তখন গাঁয়ে-ঘরে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না, অগত্যা নারুদা লক্ষ্মী আর পরাণদা পদ্মা করতে রাজী হয়ে গেল। কয়েকটি বাচ্চাও পাওয়া গেল। কিন্তু কর্ণপুত্র বৃষকেতু পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সময় হারা এসেছে ছুটিতে। বয়স একটু বেশি হলেও হাইট ছোট, সুন্দর চোখমুখ আর রিনরিনে মিষ্টি গলার জন্যে দাদুর ওকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু হারার বাবার ওর স্কুল কামাই পছন্দ নয় মোটেই। নিশীথদা বললেন, ‘লে লে, কেলাস থিরির আবার পড়া! উ আমিই পঢ়াঞ দিব’। নিশীথদা নারায়ণ সাজছে, ওর কথা ফেলনা নয়। আর হারার বুড়ি ঠাকুমা তো ওকে কাছে রাখতে পারলে আর কিছুই চায় না। কাজেই হারা বৃষকেতু হয়ে থেকে গেল। আমিও কালীপূজোর আগে গ্রামে এসে দেখি পালা জমে উঠেছে। আমাদের উঠোনে রোজ রিহার্সেল হচ্ছে। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগল আমার বাহাত্তুরে দাদুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে, যেন হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছেন। মুখুজ্যেদের দুলাল মস্ত কন্ট্রাক্টার, ওনার দৌলতে হ্যাজাকও (আমরা বলতাম ডে-লাইট) জুটে গেল। রিহার্সেল চলতে লাগল পুরোদমে।

(৪)

‘দানবীর’ মহাভারতের বিতর্কিত চরিত্র সূতপুত্র কর্ণকে নিয়ে একটা পৌরাণিক নাটক, যার মধ্যে আখ্যানভাগ কম আর লেখকের কল্পনাই বেশি ছিল। বন্ধু দুর্যোধনের কাছে অঙ্গরাজ্য উপহার পেয়ে রাজা হয়েছেন কর্ণ, কিন্তু দরিদ্র সারথির ছেলে বলে তিনি মানুষের দুঃখ বোঝেন। তাই প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তাঁর দরবারে কোনও প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করবেন না, নিজের সর্বস্ব দিয়েও তার চাহিদা মেটাবেন। এদিকে দেবর্ষি নারদ ত হাঙ্গামা বাধাবার জন্যে মুখিয়েই আছেন। তাঁর ধারণা, মানুষের ধন থাকলে সে দান করতেই পারে, তাতেই কি প্রকৃত দাতা বা দানবীর হওয়া যায়। বৈকুণ্ঠে গিয়ে তিনি আবদার রাখলেন নারায়ণের কাছে যে কর্ণ প্রকৃত বা আদর্শ দাতা কিনা তার বিচার করতে হবে। ভক্তের ইচ্ছাপূরণ করতে অগত্যা নারায়ণ চললেন মর্তে। লক্ষ্মী আর একা একা বসে কি করবেন, তিনিও পিছে পিছে নেমে এলেন।

তারপর হল কর্ণের আসল পরীক্ষা। এক বুড়ো বামুন একদিন রাজা কর্ণের কাছে এসে ইচ্ছেমত ভালমন্দ কিছু খাবার খেতে চাইলেন। তার আগে আবার তামা-তুলসী দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে তিনি যা খেতে চাইবেন আর যেমনভাবে চাইবেন ঠিক তেমনভাবেই যেন তাঁকে খাওয়ানো হয়। রাজা প্রতিজ্ঞা করতেই তিনি বললেন তিনি নরমাংস খেতে চান। অতএব রাজা-রানী মিলে যেন তাঁদের শিশুপুত্র বৃষকেতুকে বলি দিয়ে তার মাংস রান্না করে খাওয়ান। রাজা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রাজধানীতে কান্নার রোল উঠল। কিন্তু কর্ণ তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখলেন। শেষে অনেক মেলোড্রামা ঘটল, দেখা গেল রাজপুত্র পাঠশালার মাঠে অন্য ছেলেদের সাথে খেলা করছে। সবাই বুঝতে পারল যে ওই বুড়োলোকটিই নারায়ণ, একটা পাগলি কোথা থেকে এসে পড়েছিল- তাকে নিয়ে ছেলেরা খেপাত, তিনিই ছিলেন লক্ষ্মী। শেষ পর্বে লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগলমিলনের দৃশ্য দিয়ে পালা শেষ হয়।

এখানে রাজার বয়স্য মদনমিশ্রের রোলে ছিলেন গগনকাকু, হাসিয়ে মাত করে দিতেন। তাই দেখে দাদু ওনাকে পাঠশালার গুরুমশায়ের রোলটাও করতে দিলেন। সেখানে আরো মজা। গুরু প্রস্ফুটিত বানান করতে দিয়েছেন গোবিন্দকে। সে মাথা চুলকে বলল- প’য়ে র-ফলা-অস্‌- তাতে একটা ফুটি আর ত। গুরুমশাই রেগে উঠে বৃষকেতুকে জিগ্যেস করতেই সে ঠিক বানান বলে দিল। ‘দেখলি ত, একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে, আর তুই পারলি না’-তার জবাবে গোবিন্দ বলে-‘ওযে রাজার বাড়ির ইঁদুর, শুওরের চাইতেও বড়’!

এদিকে কালীপূজোর দুদিন আগে বাবাও এসে পড়েছেন সিন্দ্রি থেকে। ফ্যাক্টরিতে পাওয়া একটা সেফটি শু পায়ে বড় হয়েছিল, কিন্তু ছোট সাইজ স্টকে ছিল না বলে ওটা নিয়ে এসেছেন, যদি কারও কাজে লাগে। কর্ণের লম্বা-চওড়া চেহারা, পায়ে ফিট করে গেল, উনি বাড়ি নিয়ে গেলেন। তাই দেখে নিশীথদার কি রাগ! ‘দুলাল জুতা পাবেক ক্যানে? উ যদি রাজা হয় আমিও নারায়ণ বটি’। অনেক কষ্টে তাঁকে ঠান্ডা করা হল। পালা কিন্তু জমেছিল। আমি স্টেজের একধারে দাদুর সাথে বসে নাটক দেখলাম মনের আনন্দে। একটু আধটু ঝামেলা যে হয়নি তা নয়। বৃষকেতুকে কর্ণ আর পদ্মাবতী মিলে কাটল, বুড়ো বামুনকে খাওয়াবার প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে। কাটার অ্যাকটিং করার পরে কথা ছিল লাইট কমে যাবে আর সেই ফাঁকে বৃষকেতু পালাবে। কিন্তু লাইটম্যান সময়ে গেছে সব ভুলে। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে বাচ্চার দলের চিৎকার শোনা গেল- ‘হারা পালাল রে, হারা মরে নাই- হা ভাল, ঐ তো পালাল।‘ কি কাণ্ড। তবে পালা শেষ হবার পর সবার হাততালিতে বোঝা গেল নাটক সত্যি সবাই বুঝেছে আর সবার ভালও লেগেছে।

(৫)

নাটকের অসামান্য সাফল্যের পর দাদুর নিজের লেখা ও সুর বসানো ‘দানবীর’এর গানগুলো গ্রামের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। দুটো গান তার এখনও কিছুটা মনে আছে, কথাগুলো সেকেলে হলেও নাটকও ত একালের নয়! তার একটা হল কর্ণের রাজসভার বন্দনা গান-

“তুমি ভারত-গগনে তরুণারুণ নবোদিত গরিমায়,
বিতরিছ কৃপা-করুণাচ্ছটা তব নিজ মহিমায়।।
আছ মন্দ্রিত যথা অতল বারিধি দূর দিগন্ত চুমি
আছ গম্ভীর যথা অটল-শৃঙ্গ পরশি স্বর্গভূমি,
তুমি অম্বর সম উদার মহান,
প্রেমে বিগলিত তটিনী সমান-
তুমি ভাস্বর যেন ধ্রুবজ্যোতিসম ঘনঘোর তমসায়।
মোদের জড়িত কণ্ঠ তব জয়গান ব্যাকুলি গাহিতে চায়,
ভাষা না মিলে যে তায়-
আশা না মিটে যে তায়।।“

আর একটা ছিল শেষ গান, লক্ষ্মী-নারায়ণের স্তব-

“এস এস সুন্দর, যুগল-মূরতি ধর, নব নটবর নবরঙ্গে
চাঁচর-চিকুর কেশে রঞ্জিত মৃদু হেসে, বঙ্কিম নয়ন ভ্রূভঙ্গে।।
এস হে প্রবীন এস, হে চির নবীন এস, বাহুপাশে বাঁধা রাধা সঙ্গে-
মধুর মূরলী-স্বর, জরজর অন্তর, অঙ্গ জড়িত দোঁহা অঙ্গে।।...“

গানগুলোর মধ্যে বেশ একটা রজনীকান্ত-রজনীকান্ত ভাব ছিল, এখন বেশ বুঝতে পারি, তাই বোধহয় ওগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

কিন্তু এসব কি? স্বপ্ন, না কল্পনা, না গতজন্মের কাহিনী, কে জানে? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এসব কি সত্যিই ঘটেছিল!

না, দাদু যে তখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন, তা তাঁর ডাকে চিন্তার ঘোর ভাঙ্গতেই টের পেতাম, ‘ভাইটু কই, কি লিখলে, দেখালে না তো!’ সর্বনাশ! বালক সংগীত আমি ভুলে গেলেও দাদু ভোলেন নি দেখছি। বুঝলাম আর পালিয়ে বেড়ানো যাবে না, অগত্যা ‘বালক-সংগীতে লব-কুশের গল্প’ নামে একটা কিছু কোনওমতে খাতায় লিখে তাঁকে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখালাম। দাদু খুশি হয়ে দু-চারজনকে ডেকে দেখালেনও সে হাস্যকর লেখাটা, কিন্তু আমার তখন যে লজ্জায় ছুটে পালাতে ইচ্ছে করত। দাদুর ঐ একটা দোষ ছিল। আমাদের তখন বিহারের স্কুলে হিন্দীও পড়তে হত। বাড়িতে একটু শিক্ষিত লোক বা হিন্দীভাষী কেউ এলেই- ‘ভাইটু’ বলে ডাক দিতেন দাদু। এবার লজ্জার মাথা খেয়ে তাদেরকে শোনাতে হত আবৃত্তি করে-
“হুয়া সবেরা, হুয়া সবেরা,
অব তো ভাগা দূর অন্ধেরা।
ছোড় ঘোঁসলা পঞ্ছী ভাগে,
যো সোয়ে থে, ওয়ে সব জাগে।......”

কাঁহাতক আর এ ভালবাসার অত্যাচার ভাল লাগে? তাই সুযোগ পেলেই একছুটে পালাতাম শক্তিদাদুর দোকানে, দোকান-দোকান খেলতে হত না, সত্যিকারের মুদী হয়ে চাল-ডাল-নুন তেল বিক্রি করতে তাঁকে সাহায্য করতাম- অর্থাৎ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে দিতাম দোকান ঘর। তাও যে শক্তিদাদু বা তাঁর স্ত্রী ভক্তিঠাম্মা আমাকে কিছু বলতেন না, উপরন্তু কেন আরও বেশী করে ভালবাসতেন, তা আমার মাথায় তখন কিছুতেই ঢুকত না। হ্যাঁ আজ বুঝতে পারি, নিঃসন্তান দম্পতির বুকের ফাঁকা যায়গার ব্যথা কিসে জুড়োত। তাঁরা দুজনেই বহুকাল গত হয়েছেন, তাই সে কথা আজ না হয় থাক।

(৬)

শক্তিদাদু আর তাঁর সামনের বাড়ির নিতাইজ্যেঠুর মধ্যে সম্বন্ধ ছিল আদায়-কাঁচকলায়। নিতাইজ্যেঠুরও ছিল মুদীর দোকান আর সেই দোকানের পাশ দিয়েই যেতে হত শক্তিদাদুর বাড়ি। দেখতে পেলে নিতাইজ্যেঠুও ছাড়তেন না, ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন। কিন্তু ওনার দোকানে তামাক থাকত বলে আমি পারতপক্ষে ঢুকতাম না। তবে দোকান ছাড়িয়েই ছিল বাড়ির উঠোন দরজা, সেখানে কিন্তু আমার ছিল অবারিত দ্বার। নিতাইজ্যেঠুর ছোট ছেলে রণু ছিল আমার বন্ধু, যাকে আজকাল আমরা বলি বেস্ট ফ্রেণ্ড। বাড়িতে লোক আসছে দেখতে পেয়েছি, এইবার হয়ত ডাক পড়বে কবিতা শোনানোর জন্যে। আমি কিন্তু ততক্ষণে পগার পার, হয় শক্তিদাদুর দোকানে গুড় ওজন করছি কিংবা রণু আর ওর কাকার মেয়ে ঝুনুর সাথে ক্যারাম বা অন্য কিছু খেলছি।

হ্যাঁ, টানা টানা চোখ নাক, সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারা ছিল রণুর। আজও ওর চেহারাটা মনে না করতে পারলে ‘ডাকঘর’এর অমল বা ‘পথের পাঁচালী’র অপুর কথা ভাবি। তবে ওদের বাড়ি ঘন ঘন ছুটে যাওয়ার মূল কারণ কি ছিল রণু না ঝুনু তা কিছুতেই ঠিক করতে পারতাম না। ঝুনু ছিল খুব মিষ্টি মেয়ে আর পাকা কথার ঝুড়ি। আবার যেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখতাম রণু নেই, একা ঝুনু, সেদিন কিন্তু ওর মুখ থেকে কথা টেনেও বের করা যেত না। ওর এই দুর্বোধ্য আচরণের কারণ আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এখন ভাবি, মেয়েদের কি বিধাতাপুরুষ একটা বিশেষ অনুভূতি দিয়েই মর্তে পাঠান?

একদিন কথায় কথায় দানবীরের গল্প হচ্ছিল, কি আশ্চর্য, রণু গ্রামে থেকেও নাটক দেখে নি। আমি বলি, বলত,
‘কর কিরে পাজী বেটা নচ্ছাড় নিষ্ঠুর তা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা, তুমিও যেন তা’
কথাটার মানে কি? ও বলতে পারল না। আমি বোঝালাম, দানবীরে গুরুমশায় পড়াচ্ছেন আর একটা ছেলে তার উচ্চারণটা ওভাবে করছে। আসল কবিতাটা ছিল-
‘কর কৃপা জীবে টান, ছাড় নিষ্ঠুরতা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা তুমিও জেনো তা।‘
রণু-ঝুনু তাই শুনে ত হেসে আকুল। রণু বলে, ‘দেখিস আমি যখন স্কুলে ভর্তি হব, কক্‌খনও ওরকম ভুলভাল উচ্চারণ করব না’। বলেই হঠাৎ সে গম্ভীর হয়ে গেল। সেদিন আর খেলা জমলই না।

তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলাম আর সত্যিই আশ্চর্য হলাম ভেবে, তাইত আমার বয়সী হয়েও রণু কখনও ত স্কুলে যেত না। গ্রামে অনেকেই দেরীতে লেখাপড়া শুরু করে বটে, তবে সেটা ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের বাড়িতে হবার জো ছিল না। এমনকি ওর থেকে প্রায় বছরখানেকের ছোট ঝুনুও স্কুল যেত। জ্যেঠিকে জিগ্যেস করলে উত্তর পেতাম,’ওর শরীরটা ভাল নেই তো, সুস্থ হয়ে উঠলেই স্কুল যাবে। একদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি আমাদের ভাড়াটে ডাক্তারকাকুর বারান্দায় বসে নিতাইজ্যেঠু রণুকে নিয়ে। ওনার মুখ গম্ভীর থমথমে দেখে আমি ভয়ে কিছু জিগ্যেস করতে পারলাম না। আর রণুই বা কিরকম? এত গরমেও বসে আছে একটা চাদর-মুড়ি দিয়ে।

পরদিন রণুদের বাসায় গিয়ে ওকে পেলাম না, শুনলাম কলকাতা গেছে বাবার সাথে। আমার খুব রাগ হল। আমি কিনা স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি মা-বাবাকে ছেড়ে রণুর সাথে খেলব বলে, আর উনি মনের আনন্দে কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ঝুনু অনেক ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু আমি ওর দিকে ভাল করে না তাকিয়েই রেগেমেগে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন।

একসপ্তাহ পরে নিতাইজ্যেঠু একাই ফিরে এলেন কলকাতা থেকে। শুনলাম, রণু আর ফিরবে না। ওর লিউকোমিয়া হয়েছিল। কলকাতা থেকে নাকি স্বর্গের ট্রেন ছাড়ে, ওর বাবা ওকে সেই ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে এসেছেন।

আর লেখা যাচ্ছে না। দাদুরও বয়স হচ্ছে, নানা রোগ-বালাই লেগেই আছে। বাবা একদিন প্রায় জোর করেই দাদু-ঠাকুমাকে নিয়ে এলেন গ্রাম থেকে। আমিও পড়াশুনার চাপে বা অন্য যে কারণেই হোক, গ্রামে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলাম। পারতাম না। নিতাইজ্যেঠুর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গেলেই কেবলই মনে হত দুটো বড় বড় চোখ যেন ইশারায় ডাকছে। বালক সংগীতের পালা শেষ করে হঠাৎ যেন আমি বড় হয়ে গেলাম।

(শেষ)