Friday, May 6, 2016

বনজ্যোৎস্না।। স্মৃতিচারণ

বনজ্যোৎস্না।।

বিলুকাকুর ছেলে বাবুই শান্তিনিকেতন থেকে গরমের ছুটিতে বাড়ি এলেই শুরু হয়ে যেত উৎসবের পালা। বলতে গেলে আমার গানের আগ্রহের মূল প্রেরণা সেই ছিল। চৈত্রের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গানবাজনা-আবৃত্তি-রবীন্দ্র পরিষদ আর বাবুই-বুড়ো-রিণ্টুদের সাথে কিভাবে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। বাবুই আর তার দুই বোন যে কুঁড়ে ছিল তা বলব না, তবে মাঝে মাঝে সকাল এগারটায় পৌঁছেও দেখতাম ওরা ঘুমোচ্ছে। ভেবে দেখতাম, সত্যিই তো, ছুটির দিনে সকালে উঠে করবেই বা কি?

একদিন সন্ধ্যে নাগাদ কি কাজে যেন ওবাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি বিলুকাকু বাগানে খুরপি হাতে ফুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত, মুখে গুনগুন রবীন্দ্রসংগীত। আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন- কাকু এসো, তোমার কথাই ভাবছিলাম। উনি দেখতাম আমাদের 'কাকু' ডাকটা আমাদিগকেই ফিরিয়ে দিতেন, আজকাল এ ধরণের স্নেহশীল মানুষ পাওয়া দুর্লভ। ভেতরে আসতেই বাবুইকে ডাক দিলেন, ও আর ওর বোন রিংকু ছুটে এল। রিংকু বলল- আজ রাত্রে আমাদের বাগানে বনজ্যোৎস্না, তোমার নিমন্ত্রণ রইল। বনজ্যোৎস্না? এটা কি কোনও শান্তিনিকেতনী ইয়ার্কি নাকি! বলতেই চোখ পড়ল সামনে পুবদিকের দুই বিল্ডিংএর ফাঁকে বিশাল লাল রঙের গোলাটার দিকে। বাবুই বোঝাল, জ্যোৎস্না রাত্রের পিকনিককেই তারা বনজ্যোৎস্না বলে। চাঁদা? নো চাঁদা। বাগান বিলুকাকুর, খরচায় লোধকাকু ও চম্পাটিকাকু। শুধু গানে গলা মেলাতে হবে।

এ কাজটা আমি খুব পারি। চন্দ্রাহত হয়ে পরের দু-তিন ঘণ্টা যে কিভাবে কেটে গেল বোঝাই গেল না। বিশ্বনাথকাকু জোকের ভাণ্ডারি। বাবুইয়ের দুই বোনকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে দেখে লোধকাকীমা গুনগুন করতে করতে হঠাত গেয়ে উঠলেন- "চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে"। তাই শুনে আকাশের চাঁদটাও আনন্দের চোটে আকাশের মাঝামাঝি এসে তার বত্রিশ (নাকি আরও বেশি?) পাটি বিকশিত করে দিল। বাবুই গাইল শচীন কর্তার 'আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে'। তারপর রাত দশটায় সমবেত বেদগান 'সংগচ্ছধ্বম্‌ সংবদধ্বম্‌' এর সাথে সমবেত খিচুড়িভোজন। যা একখানা সন্ধ্যা কেটেছিল না!

আজ এতকাল পরে সেসব কথা মনে পড়ল কারণ কয়েকমাস আগে বাবুই আমাদের ছেড়ে জ্যোতির্লোকে পাড়ি দিয়েছে। জানিনা যাবার আগে এসব কথা তার মনে পড়েছিল কিনা। জানিনা বিশ্বপিতার দরবারে গিয়ে আজ সে কি গান শোনাচ্ছে তাঁকে।

No comments:

Post a Comment