Friday, May 6, 2016

মনের মণিকোঠা থেকে ।। ৮ ।।

মনের মণিকোঠা থেকে।। ৮ ।।

অজয়কে ক্লাস ফোর থেকে দেখে আসছি স্কুলে। তবে সেভেন্থে ওঠার আগে পর্যন্ত ওর বিশেষ কোনও পরিচয় পাইনি। সিক্সথে আমরা এলাম মিডল স্কুলে (তখন তাই ছিল), সেখানে ড্রিল স্যার শূরবাবুর খুব কাছের ছাত্র হয়ে উঠল সে, যাকে আমরা 'টিচার্স পেট' বলি তাই। অবশ্য তাতে আমাদের তেমন চিন্তা ছিল না, তবে মাঝে মাঝে ড্রিলের পিরিয়ডে অজয়কে নেতৃত্বভার দিয়ে যখন শূরস্যার কেটে পড়তেন তখন অজয়ের বাড়াবাড়িতে এত রাগ ধরত যে কিছু বলার নয়। ওর বিশেষ রাগ ছিল মাথুর, বিশ্বজিত বা হাবুলদের মত ভালমানুষদের উপর। একটু হাত-পা নাড়ানো কমবেশি হলেও তাদেরকে মাঠময় রোদের মধ্যে ছোটা করাতো। ভজু ছিল রোগা-পাতলা, কিন্তু ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলে ওকে কায়দা করতে পারত না। যাই হোক, অনেকের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে রাগ ছিল, কিন্তু স্যারের কড়া শাসনের ভয়ে কিছু বলার উপায় ছিল না।
জানুয়ারিতে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন উপলক্ষ্যে সেবার শূরস্যার ঠিক করলেন 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকের একটা অংশ অভিনয় করাবেন। 'আমি আলেকজান্ডার', অজয় আগেই জানিয়ে দিল। 'দূর বোকা, নাটকের হিরো তো চন্দ্রগুপ্ত, তুই ছাড়া চন্দ্রগুপ্ত কাকে মানাবে'- স্যার বললেন। কি ভীষণ পক্ষপাতিত্ব! আবৃত্তি-অভিনয়ে বাম্পি-ভজু-কল্যাণদের একটু নাম ছিল, ওরা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকল। তবে রিহার্সেলে নেমেই অজয় সেলুকাস ও আন্টিগোনাসের আসন্ন দ্বন্দ্বযুদ্ধ থামিয়ে কিছুক্ষণ তলোয়ার ঘোরাল। তারপরে সেই ডায়লগ- 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না'- এই অংশটা বলতে পেরে মহাখুশি। সৌমিত্র সবচেয়ে লম্বা বলে ও হয়েছিল সেকেন্দার আর কল্যাণ সেলুকাস। রিহার্সেলের শুরুতেই মজা। প্রম্পটার ছেলেটা- নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ছিল বাঙাল। তার গলা আমরা শুনতে পাচ্ছি না। তবে প্রথম দৃশ্যেই সেকেন্দার শাহ আড়াল থেকে প্রম্পট শুনে বলে উঠলেন- 'সইত্য সেলুকাস, কি বিসিত্র এই দ্যাস!' আর তারপর ঝাড়া তিনমিনিট ধরে হা হা হো হো। আমি বললাম, 'স্যার, এটাই থাকতে দিন, পাবলিক খুব মজা পাবে', স্যার একধমকে চুপ করিয়ে দিলেন। অনেকের ইচ্ছে ছিল চন্দ্রগুপ্ত একটু টাইট খাক, কিন্তু অজয় এমন পিচবোর্ডের তলোয়ার ঘুরিয়ে অভিনয় করতে লাগল, যে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেছে, পড়ার ঝামেলা নেই, তাই আমাদের দিনগুলোও ভালই কাটতে লাগল।
দেখতে দেখতে পুরস্কার বিতরণের দিন এসে গেল। রাবণজ্যেঠু সবাইকে এমন সাজিয়ে দিলেন, টিনের তলোয়ার খাপে নিয়ে কল্যাণ-সৌমিত্র-বাম্পি-দেবু-অজয় গ্রীনরুমে দাপিয়ে বেড়াতে লাগল যে আমাদের রীতিমত হিংসে হতে লাগল।
নাটক প্রথম থেকেই জমে গেল। এমনকি অ্যান্টিগোনাসের যেখানে চন্দ্রগুপ্তের তরবারির এক চোটেই পরাস্ত হয়ে যাবার কথা, সেখানে ওরা ঝাড়া পাঁচ মিনিট ধরে লড়ে গেল। দর্শকরা তো প্রায় সবাই ছেলেমানুষ, খুব খুশী সবাই। চটাপট হাততালি পড়তে লাগল। গোলমালটা বাধল তার পরে। চন্দ্রগুপ্ত বিদ্যুৎ গতিতে তলোয়ার বের করে বলবে, 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে বন্দী করতে পারবেন না'। এদিকে কিছুক্ষণ আগের ভয়ানক যুদ্ধের ফলে টিনের তলোয়ার ঈষৎ বেঁকে গেছে, খাপ থেকে আর বেরোচ্ছে না। ফলে অজয় ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, 'মহারাজ, আমাকে বধ না করে...বধ না করে...বধ না করে' আর তলোয়ার টেনে যাচ্ছে। শেষে সেলুকাস এসে উদ্ধার করল এই বলে, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে......মহারাজ, বোঝা যাচ্ছে ওকে বধ না করে বন্দী করা যাবে না, এখন আপনি যা ভাল বোঝেন।'
বেচারা অজয়! ওর সেরা ডায়ালগটা মাটি হয়ে গেল। ওর মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে শূরবাবু এগিয়ে এসে বললেন- 'মন খারাপ করিসনে, পাবলিক কিচ্ছু বোঝেনি, তোর তলোয়ার টানাটানিতেই প্রচুর তালি পড়েছে।' তবে অজয়ের শত্রুর দল ব্যাপারটা ভালই বুঝেছে। তারা খুব খুশি।
একে একে নিভেছে দেউটি। অজয় নাথচৌধুরী আর সৌমিত্র চক্রবর্তী অনেকদিন আগেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে, কারো বন্দীত্ব গ্রহণ না করেই। তারা এখন সব শ্ত্রুতা-মিত্রতার ঊর্ধ্বে। অজয়-সৌমিত্র, তোরা যেখানেই থাকিস, ভাল থাকিস।

No comments:

Post a Comment