বালক সংগীত।।
(১)
'এই, দুগ্গামেলায় বালক-সংগীত হবেক,যাবি ত? লব-কুশ পালা।' সন্ধ্যের মুখে মিন্টুর ডাক শুনতে পেলাম বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে। ছোট গ্রাম। কাউকে কিছু বলতে হলে একটু উচ্চস্বরে বললেই চলে, ঠিক তার কানে যাবে। তবে মুস্কিল হল গ্রামের প্রায় সবাই দরকার না থাকলেও শুনে ফেলবে সে কথা। নন্দকাকার খোঁজে এসেছেন এক ভদ্রলোক, গাঁয়ে ঢোকার আগেই সেজজ্যেঠি দিল তাকে তাড়িয়ে- 'এ বাবা, নন্দকে এখন কুথাকে পাবে, উ গেইছে হাঁসাপাথর, বিটির সম্বন্ধ কইরতে!' কে বলল? কেন, নন্দ নিজেই। যাবার সময় পাশের বাড়িতে ভাইকে ডাক দিয়ে বলে গেলেন না- 'দুলাল্যা রে, হাঁসাপাথরের সম্বন্ধট যদি লাগ্যে যায় কিছু টাকা ধার লিব তর কাছে।' ব্যস, গোটা গ্রামকে তা জানানো হয়ে গেল।
দূর, কি যে ধান ভানতে শিবের গাজন শুরু করে দিলাম! হচ্ছিল বালক সংগীতের কথা, সেটি যে কি বস্তু আমার ৬-৭ বছর বয়সের বিশাল অভিজ্ঞতায় তার কোনও ধারণাই ছিল না। তবে মিন্টু যাচ্ছে যখন তখন ভালই হবে। সে বড় নাক-উঁচু ছেলে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে আর ক্লাসে বছর বছর ফার্স্ট হয় বলে ও আমার সমকক্ষতা দাবী করে। অবশ্য আমি পড়ি তখন শহরের স্কুলে আর ফার্স্ট কাকে বলে তখনো ঠিক বুঝতাম না, সে খবর আর মিন্টু কিভাবে জানবে! তবে আমার ছুটি-ছাঁটায় গ্রামের বাড়িতে আসা অতি অবশ্য ছিল। না, আমি কিন্তু আত্মজীবনী লিখছি না। সে সময়ের গ্রাম্য জীবনযাত্রা আর সমাজ-সংস্কৃতিকে একটা বাচ্চা ছেলে কি চোখে দেখতে পারে, তাই জানাবার চেষ্টা করছি মাত্র। এর মধ্যে সত্যি আর কল্পনা মিলেমিশে জগাখিচুড়ি হয়ে আছে, সে জট ছাড়ানো আমারই কম্মো নয়, তাই পাঠক যেন তার চেষ্টাও না করেন।
আমার ভরসা ছিল মিন্টু যখন ডেকেছে ঠাকুমা শুনলে না করবেন না। দাদু ত খেয়ালই করবেন না। উনি তখন মানভূমের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণাতেই ব্যস্ত। তাঁর কাজের মাঝে ডুবে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটে গেছে। গ্রামে ছিল খুব বাঁদরের উপদ্রব। বিশাল বিশাল লেজওলা মুখপোড়া হনুমান। একবার এক হনুমানের পায়ের ঠোকর লেগে মস্ত একটা ইঁটের টুকরো ছাত থেকে পড়েছে ঠাকুমার মাথায়। রক্তারক্তি কাণ্ড। দাদু তখন উপরতলায় গবেষণা করছেন। ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন- 'ওগো শিগ্গির এসো, বাঁদরের কাণ্ড দেখে যাও, ইঁট ফেলে দিয়েছে মাথায়।' দাদু পুঁথি থেকে মুখ না তুলেই পালটা প্রশ্ন করলেন- 'কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড না লঙ্কাকাণ্ড? যত বাঁদরামো ঐ দুটোতেই পাবে।' ভাগ্যিস আমাদের বাড়িতে ভাড়াটে একজন ডাক্তারকাকু ছিলেন, তিনিই সে যাত্রা সামলান।
সেই দাদু যে হঠাৎ আমাকে ডেকে জিগ্যেস করবেন- 'দাদুভাই, সন্ধের মুখে গুটিগুটি চললে কোথায়?'- এরকমটা ভাবিনি। সত্যি বলছি, মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। সব শুনে তিনি বললেন, 'যেতে পার একটা শর্তে। কি দেখলে, কেমন দেখলে, কাল আমার কাছে লিখে আনবে।' আমি বাধ্য হয়ে ঘাড় নাড়তেই একটা সিকি দিলেন আমার হাতে- 'ওদেরকে চাঁদা দিও'।
আমার কাছে তখন একটা আস্ত সিকি মানে অনেক। ভাবছিলাম কি কি খাওয়া যায় তা দিয়ে। যাকগে, ঠাকুমার বাড়ানো দুধের বাটিটা কোনোমতে শেষ করেই ছুট দিয়েছি দুর্গামেলার দিকে, মিন্টুকে খুঁজে বের করে ওর পাশে গিয়ে বসেছি। ও বাবা, দেখি দাদু আগেভাগেই স্টেজের মাঝখানে একটা চেয়ার পেতে বসেছেন, সাথে সজলের দাদু আর আমাদের ডাক্তার কাকু। আর একজন থুত্থুরে বুড়োকে সবাই মিলে ধরাধরি করে স্টেজে নিয়ে বসাল, দাদু আবার তাঁকে প্রণামও করলেন। শুনলাম ইনিই নাকি ঝুমুরগানের বিখ্যাত কবি শ্রীপতি দত্ত, দাদুর মাস্টারমশাই। বালক সঙ্গীতের কর্মকর্তারা গ্রামের মাতব্বরদের দিব্যি মালা-টালা পরাল, তারপর ওঁরা স্টেজ থেকে নেমে এলেন। দাদুকে তারপর আর দেখতে পেলাম না, বোধহয় বাড়ি চলে গেলেন। হঠাৎ একটা বাঁশী আর হারমোনিয়ম বেজায় বেসুরে বেজে উঠল, বুঝলাম এবার পালা শুরু হবে।
(২)
জমকালো স্টেজের পেছনে আঁকা হয়েছে সীন- তমসা নদী বয়ে চলেছে, দূরে চিত্রকূট পাহাড় দেখা যাচ্ছে, তার একপাশে ঋষি বাল্মীকির আশ্রম। একমুখ পাকা দাড়ি নিয়ে বাল্মীকি যোগাসনে বসে আছেন, জানি খুব কষ্ট হয় ওভাবে একটানা বসে থাকতে- কিন্তু তিনি নির্বিকার। সীতা একটা বঁটি আর একটা বেগুন নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু কুটছেন না- পরে ভেবে দেখেছিলাম ভালই করছেন, একবার কুটলেই তো ফুরিয়ে যাবে, অত বেগুন তিনি পাবেন কোথায়? দুটো বাচ্চা ছেলে, আমার থেকে কিছুটা বড়- বোঝা গেল ওরাই লব-কুশ, রামায়ণ গান গেয়ে শোনাচ্ছে। লক্ষ্মণের হাতে সূর্পনখার হেনস্থার গান শুনে সীতা তো হেসেই কুটিকুটি।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাল্মীকি আর সীতা ভেতরে চলে গেলেন আর তাদের জায়গায় হুপ-হাপ করতে করতে ঢুকল হনুমান। এসেই সে লব-কুশকে ধমক দিয়ে বলল- 'এই ছোঁড়ারা, ঘোড়া কোথায় লুকিয়েছিস, ভালয় ভালয় দিয়ে দে বলছি। এমনভাবে বলছে, যেন হারিয়ে যাওয়া পানের ডিবে খুঁজছে। কিন্তু লব-কুশ মস্ত বীর, বলে- 'সাধ্য থাকে ত আমাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে ঘোড়া নিয়ে যাও'। একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠল, 'বাবা, পরাজিত কে বটে?'- অন্য দর্শকরা 'চুপ চুপ' করে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর লব-কুশ আর হনুমানে কি ভীষণ যুদ্ধ! যাচ্চলে, হনুমান ত হেরে গেল। দুই ভাই খুশীমনে তাকে স্টেজের মুখের কাছে একটা খুঁটিতে বাঁধতে যাচ্ছিল, তার আগে সে হাত দেখিয়ে 'উব্বু' চেয়ে নিল। তারপর স্টেজের ধারের হ্যাজাকটাতে কয়েকবার পাম্প করে এসে আবার ধরা দিল। হনুমানকে বাঁধা হতেই আমরা সবাই পটাপট হাততালি দিয়ে উঠলাম।
হনুমান কিন্তু এই হাততালিতে খুশি নয়। আমাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কট্মটিয়ে বলল, ‘খুব তালি দিচ্ছ। কালকে লঙ্কা-দহন পালায় এমন পার্ট করব না, লব-কুশ কেন, রাম-লক্ষ্মণের দিকেও তাকাতে ভুলে যাবে। মিন্টু আমাকে একটা চিমটি কেটে বলে-‘ওরে, তবে কালকেও আসব’। অন্যদিকে মন চলে গেছিল, হঠাত দেখি লব-কুশ ‘মা খিদে পেয়েছে, খেতে দাও’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ‘বাড়িতে চাল-ডাল নেই, একটিমাত্র বেগুন পড়ে আছে- খেতে দেব কি ছাই’- সীতার গলা শোনা যায় ব্যাকস্ক্রীনের আড়াল থেকে। ছেলেদুটো তাতে না দমেই বলল,’ঠিক আছে, আমরা ততক্ষণ কিছু ভিক্ষা করে নিয়ে আসি’ বলে স্টেজ ছেড়ে দর্শকদের মাঝে নেমে পড়ল। পালার দলের অধিকারী কোথা থেকে ছুটে এসে একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে গেল কুশের হাতে, ওরা তাই নিয়েই ‘ভিক্ষা দাও গো, পুরবাসী’ বলে গান গেয়ে পয়সা সংগ্রহ করতে শুরু করে দিল। সবাই দেখি পাঁচ-দশ নয়া পয়সা করে ঠুং-ঠাং ফেলছে বাটিতে। এ ত ভাল জ্বালা! দাদুর কানে যদি খবর যায় যে আমি কিছু দিইনি, তবে আর রক্ষা থাকবে না। অগত্যা আস্ত সিকিটা হাতছাড়া করতে হল।
তখনো পালার ব্রেক চলছে। আমি উঠে গিয়ে ড্রেসিংরুমের ধারে একটু উঁকি মেরে এলাম। দেখি আহা কি অপরূপ দৃশ্য! সীতা আর বাল্মীকি সেখানে বসে বিড়ি খাচ্ছে। আর একপাশে অধিকারী লব-কুশকে ধমক দিচ্ছে- ‘মাত্র চার টাকা তেরো আনা! এতে বালক সংগীত হয়? এবার থেকে আর লব-কুশ পালা নামাবই না।‘ লব মিনমিন করে বলল-‘এ গাঁয়ের লোকেরা কিপ্টে!’ ‘থাম তো’, অধিকারী ধমক দিয়ে বলল, ‘যেখানে শ্রীপতি দত্ত, ভোলু ঠাকুরের মত লোক থাকে তারা কিপ্টে নয়, ভাল জিনিষের কদর বোঝে। ঐ নাকি কান্না চলবে না, সত্যিকারের ভাল গান গাইতে হবে।‘ আমি মনে মনে ভাবলাম, এদেরকে একবার দাদুর কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়, দু-একটা ভাল ঝুমুর তো শিখতে পারত। এদিকে সীতা বাল্মীকিকে তাড়া দিচ্ছে- ‘চাঁড়ে বিড়িট ফুঁকে লে- ঘন্টি বাজছে।‘ সাথে সাথে ওরা বিড়ি ফেলে ছুটলো। আমিও ফিরে এলাম নিজের জায়গায়।
তারপর হনুমানকে দেখে সীতার দুই ছেলেকে খানিক ধমক-ধামক চলল। রাম-লক্ষ্মণের সাথে লব-কুশের যুদ্ধও খুব জমেছিল। এরপর বাল্মীকির মধ্যস্থতায় ঘোড়া নিয়ে রাম-লক্ষ্মণের ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু কোথায় ঘোড়া? একটা রং-চটা কাঠের ঘোড়া নিয়ে ওরা ফিরে গেল দেখে একটু হতাশই হলাম। তবে শেষ দৃশ্যে সীতার পাতাল প্রবেশটা দারুন জমেছিল। অভিনবত্ব আনতে সীতা পা দুটো রামচন্দ্রের সিংহাসনের পাশ দিয়ে সীনের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন আর পেছন থেকে কারা যেন ওনাকে পেছনে টেনে নিল। তবে হল কি, আস্ত সীতাটা ধীরে ধীরে ড্রপসীনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেও মাথার চুলটা কিন্তু স্টেজেই পড়ে রইল। হনুমান বুদ্ধি করে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে উইংসের আড়ালে চলে গেল।
যাক, পালা তো শেষ, তবে এবার শুরু হল আসল ঝামেলা। দাদু রোজই মনে করাতে থাকেন- ‘ভাইটু, কই কি লিখলে দেখাও।‘ আমি অগত্যা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। একদিন বন্ধুদের সাথে দাঁদার জঙ্গলে গিয়ে অনেক লাল লাল টোপাকুল খেয়ে এসে খুসখুসে কাশি বাধালাম। ভালই হল, কয়েকদিন নিশ্চিন্তি।
(৩)
আমাদের গ্রামের ছেলে হারাধন বা হারা আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে, চাসরোডের কাছে বড়গ্রামে থেকে পড়াশোনা করত। ওর ঠাকুমা আর মা-মরা মাসতুতো ভাই ডুডুন এই গ্রামে থাকত বলে প্রতি ছুটিতেই হারা গ্রামে এসে হাজির হত। কি অনুষ্ঠানে মনে নেই একবার গ্রামে এসে ওর সখের ভিখারির দল নিয়ে মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ল। চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে বাড়ি-বাড়ি চলল ভিক্ষা চাওয়া আর সাথে ওর মিষ্টি গলায় গান-
'‘বিদায় দে গো শচীমাতা আমি সন্ন্যাসেতে যাই,
আমি এইত ভিক্ষা চাই।
পরের মা-কে মা বলিব, পরের দ্বারে ভিক্ষা নিব
যখন যাহা পাই।
তুমি মনেরে বুঝাইয়া রাখ্যো গো,
তোমার নিমাই নাই।।‘'
কতযে গান হারার স্টকে থাকত! ওর প্রিয় গান যার হরিবোলের সাথে খুব নাচ জমত-
"হরিবোল হরিবোল নাম এই বদনে বোল রে।
এই বদনে বোল হরিনাম এই শ্রবণে শোন রে।।
হরিনামের লাগি মহাদেব হলেন যোগী-
ওরে শ্মশানে মশানে ঘোরে হইয়া পাগল রে।।"
আমিও গ্রামে থাকলে বিনা আমন্ত্রণেই হারার দলের সাথে সাথে ঘুরতাম গ্রামের পথে পথে, গলিতে গলিতে। অবশ্য ওর গলার সাথে গলা মেলাতে কখনও সাহস হত না। দেখতাম কাকী-জ্যেঠি-বউদিরা চাল-ডাল, বাগানের ফল-মূল-তরকারি ঢেলে দিচ্ছে হারার ঝোলাতে, গান শুনে সবারই চোখে জল। আমার যে হিংসে হতনা তা নয়, তবে বেলা দুটো নাগাদ জোড়ের ধারের মাঠে ডুডুন আর ঝাবুকাকার ছেলে তরুন মিলে যা খিচুড়ি-লাবড়া রান্না করত তা খাবার পর মনে আর কোনও ক্ষোভ বা খেদ থাকত না। আশ্চর্য হতাম, আমার ওইটুকু বয়সের বোহেমিয়ানা দেখেও ঠাকুমা-দাদু কিছু বলতেন না, শুধু চাইতেন যেন আমি সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে আসি।
এই হারার কথাতেই মনে পড়ল, দুবছর আগে দুর্গাপূজোর মুখে গ্রামের সব ছেলেরা এসে আমার দাদুকে ধরেছে একটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যে। দাদু তখন পুরুলিয়ার ওকালতি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে বাস করতে চলে এসেছেন, এবার ত উনি সময় দিতেই পারেন। দুলালকাকু দাদুর মহাবীর কর্ণকে নিয়ে লেখা নাটক ‘দানবীর’ পড়ে উচ্ছ্বসিত, বলে ‘জ্যেঠাবাবু উটোই করান’। দাদু বললেন, ‘নাটক ত বাংলাভাষায় লেখা। ‘উটো’-বললে ত চলবে না, ‘ওটা’ বলতে হবে'। তবে উনি বললেন, দুর্গাপূজার মধ্যে হবেনা, সময় কোথায়? হ্যাঁ, চেষ্টা করলে কালীপূজায় নামানো যেতে পারে। সবাই তাতেই খুশী। তবে বুড়ো সতীশদাদু কাশতে কাশতে বললেন- ‘ভোলু গাঁয়ের ছেল্যাগুলার মাথা খাছ্যে, ইটো ভাল লয়’। তা কে আর উনাকে পাত্তা দেয়! এই দানবীরে দুটি মেয়ে চাই, কর্ণের মহিষী পদ্মাবতী আর লক্ষ্মীঠাকুর। তখন গাঁয়ে-ঘরে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না, অগত্যা নারুদা লক্ষ্মী আর পরাণদা পদ্মা করতে রাজী হয়ে গেল। কয়েকটি বাচ্চাও পাওয়া গেল। কিন্তু কর্ণপুত্র বৃষকেতু পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সময় হারা এসেছে ছুটিতে। বয়স একটু বেশি হলেও হাইট ছোট, সুন্দর চোখমুখ আর রিনরিনে মিষ্টি গলার জন্যে দাদুর ওকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু হারার বাবার ওর স্কুল কামাই পছন্দ নয় মোটেই। নিশীথদা বললেন, ‘লে লে, কেলাস থিরির আবার পড়া! উ আমিই পঢ়াঞ দিব’। নিশীথদা নারায়ণ সাজছে, ওর কথা ফেলনা নয়। আর হারার বুড়ি ঠাকুমা তো ওকে কাছে রাখতে পারলে আর কিছুই চায় না। কাজেই হারা বৃষকেতু হয়ে থেকে গেল। আমিও কালীপূজোর আগে গ্রামে এসে দেখি পালা জমে উঠেছে। আমাদের উঠোনে রোজ রিহার্সেল হচ্ছে। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগল আমার বাহাত্তুরে দাদুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে, যেন হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছেন। মুখুজ্যেদের দুলাল মস্ত কন্ট্রাক্টার, ওনার দৌলতে হ্যাজাকও (আমরা বলতাম ডে-লাইট) জুটে গেল। রিহার্সেল চলতে লাগল পুরোদমে।
(৪)
‘দানবীর’ মহাভারতের বিতর্কিত চরিত্র সূতপুত্র কর্ণকে নিয়ে একটা পৌরাণিক নাটক, যার মধ্যে আখ্যানভাগ কম আর লেখকের কল্পনাই বেশি ছিল। বন্ধু দুর্যোধনের কাছে অঙ্গরাজ্য উপহার পেয়ে রাজা হয়েছেন কর্ণ, কিন্তু দরিদ্র সারথির ছেলে বলে তিনি মানুষের দুঃখ বোঝেন। তাই প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তাঁর দরবারে কোনও প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করবেন না, নিজের সর্বস্ব দিয়েও তার চাহিদা মেটাবেন। এদিকে দেবর্ষি নারদ ত হাঙ্গামা বাধাবার জন্যে মুখিয়েই আছেন। তাঁর ধারণা, মানুষের ধন থাকলে সে দান করতেই পারে, তাতেই কি প্রকৃত দাতা বা দানবীর হওয়া যায়। বৈকুণ্ঠে গিয়ে তিনি আবদার রাখলেন নারায়ণের কাছে যে কর্ণ প্রকৃত বা আদর্শ দাতা কিনা তার বিচার করতে হবে। ভক্তের ইচ্ছাপূরণ করতে অগত্যা নারায়ণ চললেন মর্তে। লক্ষ্মী আর একা একা বসে কি করবেন, তিনিও পিছে পিছে নেমে এলেন।
তারপর হল কর্ণের আসল পরীক্ষা। এক বুড়ো বামুন একদিন রাজা কর্ণের কাছে এসে ইচ্ছেমত ভালমন্দ কিছু খাবার খেতে চাইলেন। তার আগে আবার তামা-তুলসী দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে তিনি যা খেতে চাইবেন আর যেমনভাবে চাইবেন ঠিক তেমনভাবেই যেন তাঁকে খাওয়ানো হয়। রাজা প্রতিজ্ঞা করতেই তিনি বললেন তিনি নরমাংস খেতে চান। অতএব রাজা-রানী মিলে যেন তাঁদের শিশুপুত্র বৃষকেতুকে বলি দিয়ে তার মাংস রান্না করে খাওয়ান। রাজা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রাজধানীতে কান্নার রোল উঠল। কিন্তু কর্ণ তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখলেন। শেষে অনেক মেলোড্রামা ঘটল, দেখা গেল রাজপুত্র পাঠশালার মাঠে অন্য ছেলেদের সাথে খেলা করছে। সবাই বুঝতে পারল যে ওই বুড়োলোকটিই নারায়ণ, একটা পাগলি কোথা থেকে এসে পড়েছিল- তাকে নিয়ে ছেলেরা খেপাত, তিনিই ছিলেন লক্ষ্মী। শেষ পর্বে লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগলমিলনের দৃশ্য দিয়ে পালা শেষ হয়।
এখানে রাজার বয়স্য মদনমিশ্রের রোলে ছিলেন গগনকাকু, হাসিয়ে মাত করে দিতেন। তাই দেখে দাদু ওনাকে পাঠশালার গুরুমশায়ের রোলটাও করতে দিলেন। সেখানে আরো মজা। গুরু প্রস্ফুটিত বানান করতে দিয়েছেন গোবিন্দকে। সে মাথা চুলকে বলল- প’য়ে র-ফলা-অস্- তাতে একটা ফুটি আর ত। গুরুমশাই রেগে উঠে বৃষকেতুকে জিগ্যেস করতেই সে ঠিক বানান বলে দিল। ‘দেখলি ত, একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে, আর তুই পারলি না’-তার জবাবে গোবিন্দ বলে-‘ওযে রাজার বাড়ির ইঁদুর, শুওরের চাইতেও বড়’!
এদিকে কালীপূজোর দুদিন আগে বাবাও এসে পড়েছেন সিন্দ্রি থেকে। ফ্যাক্টরিতে পাওয়া একটা সেফটি শু পায়ে বড় হয়েছিল, কিন্তু ছোট সাইজ স্টকে ছিল না বলে ওটা নিয়ে এসেছেন, যদি কারও কাজে লাগে। কর্ণের লম্বা-চওড়া চেহারা, পায়ে ফিট করে গেল, উনি বাড়ি নিয়ে গেলেন। তাই দেখে নিশীথদার কি রাগ! ‘দুলাল জুতা পাবেক ক্যানে? উ যদি রাজা হয় আমিও নারায়ণ বটি’। অনেক কষ্টে তাঁকে ঠান্ডা করা হল। পালা কিন্তু জমেছিল। আমি স্টেজের একধারে দাদুর সাথে বসে নাটক দেখলাম মনের আনন্দে। একটু আধটু ঝামেলা যে হয়নি তা নয়। বৃষকেতুকে কর্ণ আর পদ্মাবতী মিলে কাটল, বুড়ো বামুনকে খাওয়াবার প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে। কাটার অ্যাকটিং করার পরে কথা ছিল লাইট কমে যাবে আর সেই ফাঁকে বৃষকেতু পালাবে। কিন্তু লাইটম্যান সময়ে গেছে সব ভুলে। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে বাচ্চার দলের চিৎকার শোনা গেল- ‘হারা পালাল রে, হারা মরে নাই- হা ভাল, ঐ তো পালাল।‘ কি কাণ্ড। তবে পালা শেষ হবার পর সবার হাততালিতে বোঝা গেল নাটক সত্যি সবাই বুঝেছে আর সবার ভালও লেগেছে।
(৫)
নাটকের অসামান্য সাফল্যের পর দাদুর নিজের লেখা ও সুর বসানো ‘দানবীর’এর গানগুলো গ্রামের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। দুটো গান তার এখনও কিছুটা মনে আছে, কথাগুলো সেকেলে হলেও নাটকও ত একালের নয়! তার একটা হল কর্ণের রাজসভার বন্দনা গান-
“তুমি ভারত-গগনে তরুণারুণ নবোদিত গরিমায়,
বিতরিছ কৃপা-করুণাচ্ছটা তব নিজ মহিমায়।।
আছ মন্দ্রিত যথা অতল বারিধি দূর দিগন্ত চুমি
আছ গম্ভীর যথা অটল-শৃঙ্গ পরশি স্বর্গভূমি,
তুমি অম্বর সম উদার মহান,
প্রেমে বিগলিত তটিনী সমান-
তুমি ভাস্বর যেন ধ্রুবজ্যোতিসম ঘনঘোর তমসায়।
মোদের জড়িত কণ্ঠ তব জয়গান ব্যাকুলি গাহিতে চায়,
ভাষা না মিলে যে তায়-
আশা না মিটে যে তায়।।“
আর একটা ছিল শেষ গান, লক্ষ্মী-নারায়ণের স্তব-
“এস এস সুন্দর, যুগল-মূরতি ধর, নব নটবর নবরঙ্গে
চাঁচর-চিকুর কেশে রঞ্জিত মৃদু হেসে, বঙ্কিম নয়ন ভ্রূভঙ্গে।।
এস হে প্রবীন এস, হে চির নবীন এস, বাহুপাশে বাঁধা রাধা সঙ্গে-
মধুর মূরলী-স্বর, জরজর অন্তর, অঙ্গ জড়িত দোঁহা অঙ্গে।।...“
গানগুলোর মধ্যে বেশ একটা রজনীকান্ত-রজনীকান্ত ভাব ছিল, এখন বেশ বুঝতে পারি, তাই বোধহয় ওগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
কিন্তু এসব কি? স্বপ্ন, না কল্পনা, না গতজন্মের কাহিনী, কে জানে? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এসব কি সত্যিই ঘটেছিল!
না, দাদু যে তখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন, তা তাঁর ডাকে চিন্তার ঘোর ভাঙ্গতেই টের পেতাম, ‘ভাইটু কই, কি লিখলে, দেখালে না তো!’ সর্বনাশ! বালক সংগীত আমি ভুলে গেলেও দাদু ভোলেন নি দেখছি। বুঝলাম আর পালিয়ে বেড়ানো যাবে না, অগত্যা ‘বালক-সংগীতে লব-কুশের গল্প’ নামে একটা কিছু কোনওমতে খাতায় লিখে তাঁকে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখালাম। দাদু খুশি হয়ে দু-চারজনকে ডেকে দেখালেনও সে হাস্যকর লেখাটা, কিন্তু আমার তখন যে লজ্জায় ছুটে পালাতে ইচ্ছে করত। দাদুর ঐ একটা দোষ ছিল। আমাদের তখন বিহারের স্কুলে হিন্দীও পড়তে হত। বাড়িতে একটু শিক্ষিত লোক বা হিন্দীভাষী কেউ এলেই- ‘ভাইটু’ বলে ডাক দিতেন দাদু। এবার লজ্জার মাথা খেয়ে তাদেরকে শোনাতে হত আবৃত্তি করে-
“হুয়া সবেরা, হুয়া সবেরা,
অব তো ভাগা দূর অন্ধেরা।
ছোড় ঘোঁসলা পঞ্ছী ভাগে,
যো সোয়ে থে, ওয়ে সব জাগে।......”
কাঁহাতক আর এ ভালবাসার অত্যাচার ভাল লাগে? তাই সুযোগ পেলেই একছুটে পালাতাম শক্তিদাদুর দোকানে, দোকান-দোকান খেলতে হত না, সত্যিকারের মুদী হয়ে চাল-ডাল-নুন তেল বিক্রি করতে তাঁকে সাহায্য করতাম- অর্থাৎ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে দিতাম দোকান ঘর। তাও যে শক্তিদাদু বা তাঁর স্ত্রী ভক্তিঠাম্মা আমাকে কিছু বলতেন না, উপরন্তু কেন আরও বেশী করে ভালবাসতেন, তা আমার মাথায় তখন কিছুতেই ঢুকত না। হ্যাঁ আজ বুঝতে পারি, নিঃসন্তান দম্পতির বুকের ফাঁকা যায়গার ব্যথা কিসে জুড়োত। তাঁরা দুজনেই বহুকাল গত হয়েছেন, তাই সে কথা আজ না হয় থাক।
(৬)
শক্তিদাদু আর তাঁর সামনের বাড়ির নিতাইজ্যেঠুর মধ্যে সম্বন্ধ ছিল আদায়-কাঁচকলায়। নিতাইজ্যেঠুরও ছিল মুদীর দোকান আর সেই দোকানের পাশ দিয়েই যেতে হত শক্তিদাদুর বাড়ি। দেখতে পেলে নিতাইজ্যেঠুও ছাড়তেন না, ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন। কিন্তু ওনার দোকানে তামাক থাকত বলে আমি পারতপক্ষে ঢুকতাম না। তবে দোকান ছাড়িয়েই ছিল বাড়ির উঠোন দরজা, সেখানে কিন্তু আমার ছিল অবারিত দ্বার। নিতাইজ্যেঠুর ছোট ছেলে রণু ছিল আমার বন্ধু, যাকে আজকাল আমরা বলি বেস্ট ফ্রেণ্ড। বাড়িতে লোক আসছে দেখতে পেয়েছি, এইবার হয়ত ডাক পড়বে কবিতা শোনানোর জন্যে। আমি কিন্তু ততক্ষণে পগার পার, হয় শক্তিদাদুর দোকানে গুড় ওজন করছি কিংবা রণু আর ওর কাকার মেয়ে ঝুনুর সাথে ক্যারাম বা অন্য কিছু খেলছি।
হ্যাঁ, টানা টানা চোখ নাক, সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারা ছিল রণুর। আজও ওর চেহারাটা মনে না করতে পারলে ‘ডাকঘর’এর অমল বা ‘পথের পাঁচালী’র অপুর কথা ভাবি। তবে ওদের বাড়ি ঘন ঘন ছুটে যাওয়ার মূল কারণ কি ছিল রণু না ঝুনু তা কিছুতেই ঠিক করতে পারতাম না। ঝুনু ছিল খুব মিষ্টি মেয়ে আর পাকা কথার ঝুড়ি। আবার যেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখতাম রণু নেই, একা ঝুনু, সেদিন কিন্তু ওর মুখ থেকে কথা টেনেও বের করা যেত না। ওর এই দুর্বোধ্য আচরণের কারণ আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এখন ভাবি, মেয়েদের কি বিধাতাপুরুষ একটা বিশেষ অনুভূতি দিয়েই মর্তে পাঠান?
একদিন কথায় কথায় দানবীরের গল্প হচ্ছিল, কি আশ্চর্য, রণু গ্রামে থেকেও নাটক দেখে নি। আমি বলি, বলত,
‘কর কিরে পাজী বেটা নচ্ছাড় নিষ্ঠুর তা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা, তুমিও যেন তা’
কথাটার মানে কি? ও বলতে পারল না। আমি বোঝালাম, দানবীরে গুরুমশায় পড়াচ্ছেন আর একটা ছেলে তার উচ্চারণটা ওভাবে করছে। আসল কবিতাটা ছিল-
‘কর কৃপা জীবে টান, ছাড় নিষ্ঠুরতা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা তুমিও জেনো তা।‘
রণু-ঝুনু তাই শুনে ত হেসে আকুল। রণু বলে, ‘দেখিস আমি যখন স্কুলে ভর্তি হব, কক্খনও ওরকম ভুলভাল উচ্চারণ করব না’। বলেই হঠাৎ সে গম্ভীর হয়ে গেল। সেদিন আর খেলা জমলই না।
তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলাম আর সত্যিই আশ্চর্য হলাম ভেবে, তাইত আমার বয়সী হয়েও রণু কখনও ত স্কুলে যেত না। গ্রামে অনেকেই দেরীতে লেখাপড়া শুরু করে বটে, তবে সেটা ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের বাড়িতে হবার জো ছিল না। এমনকি ওর থেকে প্রায় বছরখানেকের ছোট ঝুনুও স্কুল যেত। জ্যেঠিকে জিগ্যেস করলে উত্তর পেতাম,’ওর শরীরটা ভাল নেই তো, সুস্থ হয়ে উঠলেই স্কুল যাবে। একদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি আমাদের ভাড়াটে ডাক্তারকাকুর বারান্দায় বসে নিতাইজ্যেঠু রণুকে নিয়ে। ওনার মুখ গম্ভীর থমথমে দেখে আমি ভয়ে কিছু জিগ্যেস করতে পারলাম না। আর রণুই বা কিরকম? এত গরমেও বসে আছে একটা চাদর-মুড়ি দিয়ে।
পরদিন রণুদের বাসায় গিয়ে ওকে পেলাম না, শুনলাম কলকাতা গেছে বাবার সাথে। আমার খুব রাগ হল। আমি কিনা স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি মা-বাবাকে ছেড়ে রণুর সাথে খেলব বলে, আর উনি মনের আনন্দে কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ঝুনু অনেক ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু আমি ওর দিকে ভাল করে না তাকিয়েই রেগেমেগে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
একসপ্তাহ পরে নিতাইজ্যেঠু একাই ফিরে এলেন কলকাতা থেকে। শুনলাম, রণু আর ফিরবে না। ওর লিউকোমিয়া হয়েছিল। কলকাতা থেকে নাকি স্বর্গের ট্রেন ছাড়ে, ওর বাবা ওকে সেই ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে এসেছেন।
আর লেখা যাচ্ছে না। দাদুরও বয়স হচ্ছে, নানা রোগ-বালাই লেগেই আছে। বাবা একদিন প্রায় জোর করেই দাদু-ঠাকুমাকে নিয়ে এলেন গ্রাম থেকে। আমিও পড়াশুনার চাপে বা অন্য যে কারণেই হোক, গ্রামে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলাম। পারতাম না। নিতাইজ্যেঠুর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গেলেই কেবলই মনে হত দুটো বড় বড় চোখ যেন ইশারায় ডাকছে। বালক সংগীতের পালা শেষ করে হঠাৎ যেন আমি বড় হয়ে গেলাম।
(শেষ)
(১)
'এই, দুগ্গামেলায় বালক-সংগীত হবেক,যাবি ত? লব-কুশ পালা।' সন্ধ্যের মুখে মিন্টুর ডাক শুনতে পেলাম বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে। ছোট গ্রাম। কাউকে কিছু বলতে হলে একটু উচ্চস্বরে বললেই চলে, ঠিক তার কানে যাবে। তবে মুস্কিল হল গ্রামের প্রায় সবাই দরকার না থাকলেও শুনে ফেলবে সে কথা। নন্দকাকার খোঁজে এসেছেন এক ভদ্রলোক, গাঁয়ে ঢোকার আগেই সেজজ্যেঠি দিল তাকে তাড়িয়ে- 'এ বাবা, নন্দকে এখন কুথাকে পাবে, উ গেইছে হাঁসাপাথর, বিটির সম্বন্ধ কইরতে!' কে বলল? কেন, নন্দ নিজেই। যাবার সময় পাশের বাড়িতে ভাইকে ডাক দিয়ে বলে গেলেন না- 'দুলাল্যা রে, হাঁসাপাথরের সম্বন্ধট যদি লাগ্যে যায় কিছু টাকা ধার লিব তর কাছে।' ব্যস, গোটা গ্রামকে তা জানানো হয়ে গেল।
দূর, কি যে ধান ভানতে শিবের গাজন শুরু করে দিলাম! হচ্ছিল বালক সংগীতের কথা, সেটি যে কি বস্তু আমার ৬-৭ বছর বয়সের বিশাল অভিজ্ঞতায় তার কোনও ধারণাই ছিল না। তবে মিন্টু যাচ্ছে যখন তখন ভালই হবে। সে বড় নাক-উঁচু ছেলে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে আর ক্লাসে বছর বছর ফার্স্ট হয় বলে ও আমার সমকক্ষতা দাবী করে। অবশ্য আমি পড়ি তখন শহরের স্কুলে আর ফার্স্ট কাকে বলে তখনো ঠিক বুঝতাম না, সে খবর আর মিন্টু কিভাবে জানবে! তবে আমার ছুটি-ছাঁটায় গ্রামের বাড়িতে আসা অতি অবশ্য ছিল। না, আমি কিন্তু আত্মজীবনী লিখছি না। সে সময়ের গ্রাম্য জীবনযাত্রা আর সমাজ-সংস্কৃতিকে একটা বাচ্চা ছেলে কি চোখে দেখতে পারে, তাই জানাবার চেষ্টা করছি মাত্র। এর মধ্যে সত্যি আর কল্পনা মিলেমিশে জগাখিচুড়ি হয়ে আছে, সে জট ছাড়ানো আমারই কম্মো নয়, তাই পাঠক যেন তার চেষ্টাও না করেন।
আমার ভরসা ছিল মিন্টু যখন ডেকেছে ঠাকুমা শুনলে না করবেন না। দাদু ত খেয়ালই করবেন না। উনি তখন মানভূমের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণাতেই ব্যস্ত। তাঁর কাজের মাঝে ডুবে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটে গেছে। গ্রামে ছিল খুব বাঁদরের উপদ্রব। বিশাল বিশাল লেজওলা মুখপোড়া হনুমান। একবার এক হনুমানের পায়ের ঠোকর লেগে মস্ত একটা ইঁটের টুকরো ছাত থেকে পড়েছে ঠাকুমার মাথায়। রক্তারক্তি কাণ্ড। দাদু তখন উপরতলায় গবেষণা করছেন। ঠাকুমা চেঁচাচ্ছেন- 'ওগো শিগ্গির এসো, বাঁদরের কাণ্ড দেখে যাও, ইঁট ফেলে দিয়েছে মাথায়।' দাদু পুঁথি থেকে মুখ না তুলেই পালটা প্রশ্ন করলেন- 'কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড না লঙ্কাকাণ্ড? যত বাঁদরামো ঐ দুটোতেই পাবে।' ভাগ্যিস আমাদের বাড়িতে ভাড়াটে একজন ডাক্তারকাকু ছিলেন, তিনিই সে যাত্রা সামলান।
সেই দাদু যে হঠাৎ আমাকে ডেকে জিগ্যেস করবেন- 'দাদুভাই, সন্ধের মুখে গুটিগুটি চললে কোথায়?'- এরকমটা ভাবিনি। সত্যি বলছি, মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। সব শুনে তিনি বললেন, 'যেতে পার একটা শর্তে। কি দেখলে, কেমন দেখলে, কাল আমার কাছে লিখে আনবে।' আমি বাধ্য হয়ে ঘাড় নাড়তেই একটা সিকি দিলেন আমার হাতে- 'ওদেরকে চাঁদা দিও'।
আমার কাছে তখন একটা আস্ত সিকি মানে অনেক। ভাবছিলাম কি কি খাওয়া যায় তা দিয়ে। যাকগে, ঠাকুমার বাড়ানো দুধের বাটিটা কোনোমতে শেষ করেই ছুট দিয়েছি দুর্গামেলার দিকে, মিন্টুকে খুঁজে বের করে ওর পাশে গিয়ে বসেছি। ও বাবা, দেখি দাদু আগেভাগেই স্টেজের মাঝখানে একটা চেয়ার পেতে বসেছেন, সাথে সজলের দাদু আর আমাদের ডাক্তার কাকু। আর একজন থুত্থুরে বুড়োকে সবাই মিলে ধরাধরি করে স্টেজে নিয়ে বসাল, দাদু আবার তাঁকে প্রণামও করলেন। শুনলাম ইনিই নাকি ঝুমুরগানের বিখ্যাত কবি শ্রীপতি দত্ত, দাদুর মাস্টারমশাই। বালক সঙ্গীতের কর্মকর্তারা গ্রামের মাতব্বরদের দিব্যি মালা-টালা পরাল, তারপর ওঁরা স্টেজ থেকে নেমে এলেন। দাদুকে তারপর আর দেখতে পেলাম না, বোধহয় বাড়ি চলে গেলেন। হঠাৎ একটা বাঁশী আর হারমোনিয়ম বেজায় বেসুরে বেজে উঠল, বুঝলাম এবার পালা শুরু হবে।
(২)
জমকালো স্টেজের পেছনে আঁকা হয়েছে সীন- তমসা নদী বয়ে চলেছে, দূরে চিত্রকূট পাহাড় দেখা যাচ্ছে, তার একপাশে ঋষি বাল্মীকির আশ্রম। একমুখ পাকা দাড়ি নিয়ে বাল্মীকি যোগাসনে বসে আছেন, জানি খুব কষ্ট হয় ওভাবে একটানা বসে থাকতে- কিন্তু তিনি নির্বিকার। সীতা একটা বঁটি আর একটা বেগুন নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু কুটছেন না- পরে ভেবে দেখেছিলাম ভালই করছেন, একবার কুটলেই তো ফুরিয়ে যাবে, অত বেগুন তিনি পাবেন কোথায়? দুটো বাচ্চা ছেলে, আমার থেকে কিছুটা বড়- বোঝা গেল ওরাই লব-কুশ, রামায়ণ গান গেয়ে শোনাচ্ছে। লক্ষ্মণের হাতে সূর্পনখার হেনস্থার গান শুনে সীতা তো হেসেই কুটিকুটি।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাল্মীকি আর সীতা ভেতরে চলে গেলেন আর তাদের জায়গায় হুপ-হাপ করতে করতে ঢুকল হনুমান। এসেই সে লব-কুশকে ধমক দিয়ে বলল- 'এই ছোঁড়ারা, ঘোড়া কোথায় লুকিয়েছিস, ভালয় ভালয় দিয়ে দে বলছি। এমনভাবে বলছে, যেন হারিয়ে যাওয়া পানের ডিবে খুঁজছে। কিন্তু লব-কুশ মস্ত বীর, বলে- 'সাধ্য থাকে ত আমাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে ঘোড়া নিয়ে যাও'। একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠল, 'বাবা, পরাজিত কে বটে?'- অন্য দর্শকরা 'চুপ চুপ' করে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর লব-কুশ আর হনুমানে কি ভীষণ যুদ্ধ! যাচ্চলে, হনুমান ত হেরে গেল। দুই ভাই খুশীমনে তাকে স্টেজের মুখের কাছে একটা খুঁটিতে বাঁধতে যাচ্ছিল, তার আগে সে হাত দেখিয়ে 'উব্বু' চেয়ে নিল। তারপর স্টেজের ধারের হ্যাজাকটাতে কয়েকবার পাম্প করে এসে আবার ধরা দিল। হনুমানকে বাঁধা হতেই আমরা সবাই পটাপট হাততালি দিয়ে উঠলাম।
হনুমান কিন্তু এই হাততালিতে খুশি নয়। আমাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে কট্মটিয়ে বলল, ‘খুব তালি দিচ্ছ। কালকে লঙ্কা-দহন পালায় এমন পার্ট করব না, লব-কুশ কেন, রাম-লক্ষ্মণের দিকেও তাকাতে ভুলে যাবে। মিন্টু আমাকে একটা চিমটি কেটে বলে-‘ওরে, তবে কালকেও আসব’। অন্যদিকে মন চলে গেছিল, হঠাত দেখি লব-কুশ ‘মা খিদে পেয়েছে, খেতে দাও’ বলে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ‘বাড়িতে চাল-ডাল নেই, একটিমাত্র বেগুন পড়ে আছে- খেতে দেব কি ছাই’- সীতার গলা শোনা যায় ব্যাকস্ক্রীনের আড়াল থেকে। ছেলেদুটো তাতে না দমেই বলল,’ঠিক আছে, আমরা ততক্ষণ কিছু ভিক্ষা করে নিয়ে আসি’ বলে স্টেজ ছেড়ে দর্শকদের মাঝে নেমে পড়ল। পালার দলের অধিকারী কোথা থেকে ছুটে এসে একটা বাটি ধরিয়ে দিয়ে গেল কুশের হাতে, ওরা তাই নিয়েই ‘ভিক্ষা দাও গো, পুরবাসী’ বলে গান গেয়ে পয়সা সংগ্রহ করতে শুরু করে দিল। সবাই দেখি পাঁচ-দশ নয়া পয়সা করে ঠুং-ঠাং ফেলছে বাটিতে। এ ত ভাল জ্বালা! দাদুর কানে যদি খবর যায় যে আমি কিছু দিইনি, তবে আর রক্ষা থাকবে না। অগত্যা আস্ত সিকিটা হাতছাড়া করতে হল।
তখনো পালার ব্রেক চলছে। আমি উঠে গিয়ে ড্রেসিংরুমের ধারে একটু উঁকি মেরে এলাম। দেখি আহা কি অপরূপ দৃশ্য! সীতা আর বাল্মীকি সেখানে বসে বিড়ি খাচ্ছে। আর একপাশে অধিকারী লব-কুশকে ধমক দিচ্ছে- ‘মাত্র চার টাকা তেরো আনা! এতে বালক সংগীত হয়? এবার থেকে আর লব-কুশ পালা নামাবই না।‘ লব মিনমিন করে বলল-‘এ গাঁয়ের লোকেরা কিপ্টে!’ ‘থাম তো’, অধিকারী ধমক দিয়ে বলল, ‘যেখানে শ্রীপতি দত্ত, ভোলু ঠাকুরের মত লোক থাকে তারা কিপ্টে নয়, ভাল জিনিষের কদর বোঝে। ঐ নাকি কান্না চলবে না, সত্যিকারের ভাল গান গাইতে হবে।‘ আমি মনে মনে ভাবলাম, এদেরকে একবার দাদুর কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়, দু-একটা ভাল ঝুমুর তো শিখতে পারত। এদিকে সীতা বাল্মীকিকে তাড়া দিচ্ছে- ‘চাঁড়ে বিড়িট ফুঁকে লে- ঘন্টি বাজছে।‘ সাথে সাথে ওরা বিড়ি ফেলে ছুটলো। আমিও ফিরে এলাম নিজের জায়গায়।
তারপর হনুমানকে দেখে সীতার দুই ছেলেকে খানিক ধমক-ধামক চলল। রাম-লক্ষ্মণের সাথে লব-কুশের যুদ্ধও খুব জমেছিল। এরপর বাল্মীকির মধ্যস্থতায় ঘোড়া নিয়ে রাম-লক্ষ্মণের ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু কোথায় ঘোড়া? একটা রং-চটা কাঠের ঘোড়া নিয়ে ওরা ফিরে গেল দেখে একটু হতাশই হলাম। তবে শেষ দৃশ্যে সীতার পাতাল প্রবেশটা দারুন জমেছিল। অভিনবত্ব আনতে সীতা পা দুটো রামচন্দ্রের সিংহাসনের পাশ দিয়ে সীনের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন আর পেছন থেকে কারা যেন ওনাকে পেছনে টেনে নিল। তবে হল কি, আস্ত সীতাটা ধীরে ধীরে ড্রপসীনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলেও মাথার চুলটা কিন্তু স্টেজেই পড়ে রইল। হনুমান বুদ্ধি করে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে উইংসের আড়ালে চলে গেল।
যাক, পালা তো শেষ, তবে এবার শুরু হল আসল ঝামেলা। দাদু রোজই মনে করাতে থাকেন- ‘ভাইটু, কই কি লিখলে দেখাও।‘ আমি অগত্যা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। একদিন বন্ধুদের সাথে দাঁদার জঙ্গলে গিয়ে অনেক লাল লাল টোপাকুল খেয়ে এসে খুসখুসে কাশি বাধালাম। ভালই হল, কয়েকদিন নিশ্চিন্তি।
(৩)
আমাদের গ্রামের ছেলে হারাধন বা হারা আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে, চাসরোডের কাছে বড়গ্রামে থেকে পড়াশোনা করত। ওর ঠাকুমা আর মা-মরা মাসতুতো ভাই ডুডুন এই গ্রামে থাকত বলে প্রতি ছুটিতেই হারা গ্রামে এসে হাজির হত। কি অনুষ্ঠানে মনে নেই একবার গ্রামে এসে ওর সখের ভিখারির দল নিয়ে মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ল। চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে বাড়ি-বাড়ি চলল ভিক্ষা চাওয়া আর সাথে ওর মিষ্টি গলায় গান-
'‘বিদায় দে গো শচীমাতা আমি সন্ন্যাসেতে যাই,
আমি এইত ভিক্ষা চাই।
পরের মা-কে মা বলিব, পরের দ্বারে ভিক্ষা নিব
যখন যাহা পাই।
তুমি মনেরে বুঝাইয়া রাখ্যো গো,
তোমার নিমাই নাই।।‘'
কতযে গান হারার স্টকে থাকত! ওর প্রিয় গান যার হরিবোলের সাথে খুব নাচ জমত-
"হরিবোল হরিবোল নাম এই বদনে বোল রে।
এই বদনে বোল হরিনাম এই শ্রবণে শোন রে।।
হরিনামের লাগি মহাদেব হলেন যোগী-
ওরে শ্মশানে মশানে ঘোরে হইয়া পাগল রে।।"
আমিও গ্রামে থাকলে বিনা আমন্ত্রণেই হারার দলের সাথে সাথে ঘুরতাম গ্রামের পথে পথে, গলিতে গলিতে। অবশ্য ওর গলার সাথে গলা মেলাতে কখনও সাহস হত না। দেখতাম কাকী-জ্যেঠি-বউদিরা চাল-ডাল, বাগানের ফল-মূল-তরকারি ঢেলে দিচ্ছে হারার ঝোলাতে, গান শুনে সবারই চোখে জল। আমার যে হিংসে হতনা তা নয়, তবে বেলা দুটো নাগাদ জোড়ের ধারের মাঠে ডুডুন আর ঝাবুকাকার ছেলে তরুন মিলে যা খিচুড়ি-লাবড়া রান্না করত তা খাবার পর মনে আর কোনও ক্ষোভ বা খেদ থাকত না। আশ্চর্য হতাম, আমার ওইটুকু বয়সের বোহেমিয়ানা দেখেও ঠাকুমা-দাদু কিছু বলতেন না, শুধু চাইতেন যেন আমি সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে আসি।
এই হারার কথাতেই মনে পড়ল, দুবছর আগে দুর্গাপূজোর মুখে গ্রামের সব ছেলেরা এসে আমার দাদুকে ধরেছে একটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যে। দাদু তখন পুরুলিয়ার ওকালতি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গ্রামে বাস করতে চলে এসেছেন, এবার ত উনি সময় দিতেই পারেন। দুলালকাকু দাদুর মহাবীর কর্ণকে নিয়ে লেখা নাটক ‘দানবীর’ পড়ে উচ্ছ্বসিত, বলে ‘জ্যেঠাবাবু উটোই করান’। দাদু বললেন, ‘নাটক ত বাংলাভাষায় লেখা। ‘উটো’-বললে ত চলবে না, ‘ওটা’ বলতে হবে'। তবে উনি বললেন, দুর্গাপূজার মধ্যে হবেনা, সময় কোথায়? হ্যাঁ, চেষ্টা করলে কালীপূজায় নামানো যেতে পারে। সবাই তাতেই খুশী। তবে বুড়ো সতীশদাদু কাশতে কাশতে বললেন- ‘ভোলু গাঁয়ের ছেল্যাগুলার মাথা খাছ্যে, ইটো ভাল লয়’। তা কে আর উনাকে পাত্তা দেয়! এই দানবীরে দুটি মেয়ে চাই, কর্ণের মহিষী পদ্মাবতী আর লক্ষ্মীঠাকুর। তখন গাঁয়ে-ঘরে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না, অগত্যা নারুদা লক্ষ্মী আর পরাণদা পদ্মা করতে রাজী হয়ে গেল। কয়েকটি বাচ্চাও পাওয়া গেল। কিন্তু কর্ণপুত্র বৃষকেতু পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সময় হারা এসেছে ছুটিতে। বয়স একটু বেশি হলেও হাইট ছোট, সুন্দর চোখমুখ আর রিনরিনে মিষ্টি গলার জন্যে দাদুর ওকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু হারার বাবার ওর স্কুল কামাই পছন্দ নয় মোটেই। নিশীথদা বললেন, ‘লে লে, কেলাস থিরির আবার পড়া! উ আমিই পঢ়াঞ দিব’। নিশীথদা নারায়ণ সাজছে, ওর কথা ফেলনা নয়। আর হারার বুড়ি ঠাকুমা তো ওকে কাছে রাখতে পারলে আর কিছুই চায় না। কাজেই হারা বৃষকেতু হয়ে থেকে গেল। আমিও কালীপূজোর আগে গ্রামে এসে দেখি পালা জমে উঠেছে। আমাদের উঠোনে রোজ রিহার্সেল হচ্ছে। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগল আমার বাহাত্তুরে দাদুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে, যেন হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছেন। মুখুজ্যেদের দুলাল মস্ত কন্ট্রাক্টার, ওনার দৌলতে হ্যাজাকও (আমরা বলতাম ডে-লাইট) জুটে গেল। রিহার্সেল চলতে লাগল পুরোদমে।
(৪)
‘দানবীর’ মহাভারতের বিতর্কিত চরিত্র সূতপুত্র কর্ণকে নিয়ে একটা পৌরাণিক নাটক, যার মধ্যে আখ্যানভাগ কম আর লেখকের কল্পনাই বেশি ছিল। বন্ধু দুর্যোধনের কাছে অঙ্গরাজ্য উপহার পেয়ে রাজা হয়েছেন কর্ণ, কিন্তু দরিদ্র সারথির ছেলে বলে তিনি মানুষের দুঃখ বোঝেন। তাই প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তাঁর দরবারে কোনও প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করবেন না, নিজের সর্বস্ব দিয়েও তার চাহিদা মেটাবেন। এদিকে দেবর্ষি নারদ ত হাঙ্গামা বাধাবার জন্যে মুখিয়েই আছেন। তাঁর ধারণা, মানুষের ধন থাকলে সে দান করতেই পারে, তাতেই কি প্রকৃত দাতা বা দানবীর হওয়া যায়। বৈকুণ্ঠে গিয়ে তিনি আবদার রাখলেন নারায়ণের কাছে যে কর্ণ প্রকৃত বা আদর্শ দাতা কিনা তার বিচার করতে হবে। ভক্তের ইচ্ছাপূরণ করতে অগত্যা নারায়ণ চললেন মর্তে। লক্ষ্মী আর একা একা বসে কি করবেন, তিনিও পিছে পিছে নেমে এলেন।
তারপর হল কর্ণের আসল পরীক্ষা। এক বুড়ো বামুন একদিন রাজা কর্ণের কাছে এসে ইচ্ছেমত ভালমন্দ কিছু খাবার খেতে চাইলেন। তার আগে আবার তামা-তুলসী দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে তিনি যা খেতে চাইবেন আর যেমনভাবে চাইবেন ঠিক তেমনভাবেই যেন তাঁকে খাওয়ানো হয়। রাজা প্রতিজ্ঞা করতেই তিনি বললেন তিনি নরমাংস খেতে চান। অতএব রাজা-রানী মিলে যেন তাঁদের শিশুপুত্র বৃষকেতুকে বলি দিয়ে তার মাংস রান্না করে খাওয়ান। রাজা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রাজধানীতে কান্নার রোল উঠল। কিন্তু কর্ণ তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখলেন। শেষে অনেক মেলোড্রামা ঘটল, দেখা গেল রাজপুত্র পাঠশালার মাঠে অন্য ছেলেদের সাথে খেলা করছে। সবাই বুঝতে পারল যে ওই বুড়োলোকটিই নারায়ণ, একটা পাগলি কোথা থেকে এসে পড়েছিল- তাকে নিয়ে ছেলেরা খেপাত, তিনিই ছিলেন লক্ষ্মী। শেষ পর্বে লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগলমিলনের দৃশ্য দিয়ে পালা শেষ হয়।
এখানে রাজার বয়স্য মদনমিশ্রের রোলে ছিলেন গগনকাকু, হাসিয়ে মাত করে দিতেন। তাই দেখে দাদু ওনাকে পাঠশালার গুরুমশায়ের রোলটাও করতে দিলেন। সেখানে আরো মজা। গুরু প্রস্ফুটিত বানান করতে দিয়েছেন গোবিন্দকে। সে মাথা চুলকে বলল- প’য়ে র-ফলা-অস্- তাতে একটা ফুটি আর ত। গুরুমশাই রেগে উঠে বৃষকেতুকে জিগ্যেস করতেই সে ঠিক বানান বলে দিল। ‘দেখলি ত, একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও জানে, আর তুই পারলি না’-তার জবাবে গোবিন্দ বলে-‘ওযে রাজার বাড়ির ইঁদুর, শুওরের চাইতেও বড়’!
এদিকে কালীপূজোর দুদিন আগে বাবাও এসে পড়েছেন সিন্দ্রি থেকে। ফ্যাক্টরিতে পাওয়া একটা সেফটি শু পায়ে বড় হয়েছিল, কিন্তু ছোট সাইজ স্টকে ছিল না বলে ওটা নিয়ে এসেছেন, যদি কারও কাজে লাগে। কর্ণের লম্বা-চওড়া চেহারা, পায়ে ফিট করে গেল, উনি বাড়ি নিয়ে গেলেন। তাই দেখে নিশীথদার কি রাগ! ‘দুলাল জুতা পাবেক ক্যানে? উ যদি রাজা হয় আমিও নারায়ণ বটি’। অনেক কষ্টে তাঁকে ঠান্ডা করা হল। পালা কিন্তু জমেছিল। আমি স্টেজের একধারে দাদুর সাথে বসে নাটক দেখলাম মনের আনন্দে। একটু আধটু ঝামেলা যে হয়নি তা নয়। বৃষকেতুকে কর্ণ আর পদ্মাবতী মিলে কাটল, বুড়ো বামুনকে খাওয়াবার প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে। কাটার অ্যাকটিং করার পরে কথা ছিল লাইট কমে যাবে আর সেই ফাঁকে বৃষকেতু পালাবে। কিন্তু লাইটম্যান সময়ে গেছে সব ভুলে। হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে বাচ্চার দলের চিৎকার শোনা গেল- ‘হারা পালাল রে, হারা মরে নাই- হা ভাল, ঐ তো পালাল।‘ কি কাণ্ড। তবে পালা শেষ হবার পর সবার হাততালিতে বোঝা গেল নাটক সত্যি সবাই বুঝেছে আর সবার ভালও লেগেছে।
(৫)
নাটকের অসামান্য সাফল্যের পর দাদুর নিজের লেখা ও সুর বসানো ‘দানবীর’এর গানগুলো গ্রামের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। দুটো গান তার এখনও কিছুটা মনে আছে, কথাগুলো সেকেলে হলেও নাটকও ত একালের নয়! তার একটা হল কর্ণের রাজসভার বন্দনা গান-
“তুমি ভারত-গগনে তরুণারুণ নবোদিত গরিমায়,
বিতরিছ কৃপা-করুণাচ্ছটা তব নিজ মহিমায়।।
আছ মন্দ্রিত যথা অতল বারিধি দূর দিগন্ত চুমি
আছ গম্ভীর যথা অটল-শৃঙ্গ পরশি স্বর্গভূমি,
তুমি অম্বর সম উদার মহান,
প্রেমে বিগলিত তটিনী সমান-
তুমি ভাস্বর যেন ধ্রুবজ্যোতিসম ঘনঘোর তমসায়।
মোদের জড়িত কণ্ঠ তব জয়গান ব্যাকুলি গাহিতে চায়,
ভাষা না মিলে যে তায়-
আশা না মিটে যে তায়।।“
আর একটা ছিল শেষ গান, লক্ষ্মী-নারায়ণের স্তব-
“এস এস সুন্দর, যুগল-মূরতি ধর, নব নটবর নবরঙ্গে
চাঁচর-চিকুর কেশে রঞ্জিত মৃদু হেসে, বঙ্কিম নয়ন ভ্রূভঙ্গে।।
এস হে প্রবীন এস, হে চির নবীন এস, বাহুপাশে বাঁধা রাধা সঙ্গে-
মধুর মূরলী-স্বর, জরজর অন্তর, অঙ্গ জড়িত দোঁহা অঙ্গে।।...“
গানগুলোর মধ্যে বেশ একটা রজনীকান্ত-রজনীকান্ত ভাব ছিল, এখন বেশ বুঝতে পারি, তাই বোধহয় ওগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
কিন্তু এসব কি? স্বপ্ন, না কল্পনা, না গতজন্মের কাহিনী, কে জানে? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এসব কি সত্যিই ঘটেছিল!
না, দাদু যে তখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন, তা তাঁর ডাকে চিন্তার ঘোর ভাঙ্গতেই টের পেতাম, ‘ভাইটু কই, কি লিখলে, দেখালে না তো!’ সর্বনাশ! বালক সংগীত আমি ভুলে গেলেও দাদু ভোলেন নি দেখছি। বুঝলাম আর পালিয়ে বেড়ানো যাবে না, অগত্যা ‘বালক-সংগীতে লব-কুশের গল্প’ নামে একটা কিছু কোনওমতে খাতায় লিখে তাঁকে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখালাম। দাদু খুশি হয়ে দু-চারজনকে ডেকে দেখালেনও সে হাস্যকর লেখাটা, কিন্তু আমার তখন যে লজ্জায় ছুটে পালাতে ইচ্ছে করত। দাদুর ঐ একটা দোষ ছিল। আমাদের তখন বিহারের স্কুলে হিন্দীও পড়তে হত। বাড়িতে একটু শিক্ষিত লোক বা হিন্দীভাষী কেউ এলেই- ‘ভাইটু’ বলে ডাক দিতেন দাদু। এবার লজ্জার মাথা খেয়ে তাদেরকে শোনাতে হত আবৃত্তি করে-
“হুয়া সবেরা, হুয়া সবেরা,
অব তো ভাগা দূর অন্ধেরা।
ছোড় ঘোঁসলা পঞ্ছী ভাগে,
যো সোয়ে থে, ওয়ে সব জাগে।......”
কাঁহাতক আর এ ভালবাসার অত্যাচার ভাল লাগে? তাই সুযোগ পেলেই একছুটে পালাতাম শক্তিদাদুর দোকানে, দোকান-দোকান খেলতে হত না, সত্যিকারের মুদী হয়ে চাল-ডাল-নুন তেল বিক্রি করতে তাঁকে সাহায্য করতাম- অর্থাৎ সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে দিতাম দোকান ঘর। তাও যে শক্তিদাদু বা তাঁর স্ত্রী ভক্তিঠাম্মা আমাকে কিছু বলতেন না, উপরন্তু কেন আরও বেশী করে ভালবাসতেন, তা আমার মাথায় তখন কিছুতেই ঢুকত না। হ্যাঁ আজ বুঝতে পারি, নিঃসন্তান দম্পতির বুকের ফাঁকা যায়গার ব্যথা কিসে জুড়োত। তাঁরা দুজনেই বহুকাল গত হয়েছেন, তাই সে কথা আজ না হয় থাক।
(৬)
শক্তিদাদু আর তাঁর সামনের বাড়ির নিতাইজ্যেঠুর মধ্যে সম্বন্ধ ছিল আদায়-কাঁচকলায়। নিতাইজ্যেঠুরও ছিল মুদীর দোকান আর সেই দোকানের পাশ দিয়েই যেতে হত শক্তিদাদুর বাড়ি। দেখতে পেলে নিতাইজ্যেঠুও ছাড়তেন না, ডাকাডাকি শুরু করে দিতেন। কিন্তু ওনার দোকানে তামাক থাকত বলে আমি পারতপক্ষে ঢুকতাম না। তবে দোকান ছাড়িয়েই ছিল বাড়ির উঠোন দরজা, সেখানে কিন্তু আমার ছিল অবারিত দ্বার। নিতাইজ্যেঠুর ছোট ছেলে রণু ছিল আমার বন্ধু, যাকে আজকাল আমরা বলি বেস্ট ফ্রেণ্ড। বাড়িতে লোক আসছে দেখতে পেয়েছি, এইবার হয়ত ডাক পড়বে কবিতা শোনানোর জন্যে। আমি কিন্তু ততক্ষণে পগার পার, হয় শক্তিদাদুর দোকানে গুড় ওজন করছি কিংবা রণু আর ওর কাকার মেয়ে ঝুনুর সাথে ক্যারাম বা অন্য কিছু খেলছি।
হ্যাঁ, টানা টানা চোখ নাক, সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারা ছিল রণুর। আজও ওর চেহারাটা মনে না করতে পারলে ‘ডাকঘর’এর অমল বা ‘পথের পাঁচালী’র অপুর কথা ভাবি। তবে ওদের বাড়ি ঘন ঘন ছুটে যাওয়ার মূল কারণ কি ছিল রণু না ঝুনু তা কিছুতেই ঠিক করতে পারতাম না। ঝুনু ছিল খুব মিষ্টি মেয়ে আর পাকা কথার ঝুড়ি। আবার যেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখতাম রণু নেই, একা ঝুনু, সেদিন কিন্তু ওর মুখ থেকে কথা টেনেও বের করা যেত না। ওর এই দুর্বোধ্য আচরণের কারণ আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এখন ভাবি, মেয়েদের কি বিধাতাপুরুষ একটা বিশেষ অনুভূতি দিয়েই মর্তে পাঠান?
একদিন কথায় কথায় দানবীরের গল্প হচ্ছিল, কি আশ্চর্য, রণু গ্রামে থেকেও নাটক দেখে নি। আমি বলি, বলত,
‘কর কিরে পাজী বেটা নচ্ছাড় নিষ্ঠুর তা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা, তুমিও যেন তা’
কথাটার মানে কি? ও বলতে পারল না। আমি বোঝালাম, দানবীরে গুরুমশায় পড়াচ্ছেন আর একটা ছেলে তার উচ্চারণটা ওভাবে করছে। আসল কবিতাটা ছিল-
‘কর কৃপা জীবে টান, ছাড় নিষ্ঠুরতা,
মেষ বৃষ ছাগ যাহা তুমিও জেনো তা।‘
রণু-ঝুনু তাই শুনে ত হেসে আকুল। রণু বলে, ‘দেখিস আমি যখন স্কুলে ভর্তি হব, কক্খনও ওরকম ভুলভাল উচ্চারণ করব না’। বলেই হঠাৎ সে গম্ভীর হয়ে গেল। সেদিন আর খেলা জমলই না।
তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করলাম আর সত্যিই আশ্চর্য হলাম ভেবে, তাইত আমার বয়সী হয়েও রণু কখনও ত স্কুলে যেত না। গ্রামে অনেকেই দেরীতে লেখাপড়া শুরু করে বটে, তবে সেটা ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের বাড়িতে হবার জো ছিল না। এমনকি ওর থেকে প্রায় বছরখানেকের ছোট ঝুনুও স্কুল যেত। জ্যেঠিকে জিগ্যেস করলে উত্তর পেতাম,’ওর শরীরটা ভাল নেই তো, সুস্থ হয়ে উঠলেই স্কুল যাবে। একদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি আমাদের ভাড়াটে ডাক্তারকাকুর বারান্দায় বসে নিতাইজ্যেঠু রণুকে নিয়ে। ওনার মুখ গম্ভীর থমথমে দেখে আমি ভয়ে কিছু জিগ্যেস করতে পারলাম না। আর রণুই বা কিরকম? এত গরমেও বসে আছে একটা চাদর-মুড়ি দিয়ে।
পরদিন রণুদের বাসায় গিয়ে ওকে পেলাম না, শুনলাম কলকাতা গেছে বাবার সাথে। আমার খুব রাগ হল। আমি কিনা স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি মা-বাবাকে ছেড়ে রণুর সাথে খেলব বলে, আর উনি মনের আনন্দে কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ঝুনু অনেক ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু আমি ওর দিকে ভাল করে না তাকিয়েই রেগেমেগে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
একসপ্তাহ পরে নিতাইজ্যেঠু একাই ফিরে এলেন কলকাতা থেকে। শুনলাম, রণু আর ফিরবে না। ওর লিউকোমিয়া হয়েছিল। কলকাতা থেকে নাকি স্বর্গের ট্রেন ছাড়ে, ওর বাবা ওকে সেই ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে এসেছেন।
আর লেখা যাচ্ছে না। দাদুরও বয়স হচ্ছে, নানা রোগ-বালাই লেগেই আছে। বাবা একদিন প্রায় জোর করেই দাদু-ঠাকুমাকে নিয়ে এলেন গ্রাম থেকে। আমিও পড়াশুনার চাপে বা অন্য যে কারণেই হোক, গ্রামে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলাম। পারতাম না। নিতাইজ্যেঠুর বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গেলেই কেবলই মনে হত দুটো বড় বড় চোখ যেন ইশারায় ডাকছে। বালক সংগীতের পালা শেষ করে হঠাৎ যেন আমি বড় হয়ে গেলাম।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment