।। স্মৃতি সততই ।।
শিলচরে 'রাবিন্দ্রিকী' গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দামের কাছে আমার স্ত্রী তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতেন। স্বামী রূপক ও কন্যা সোহিনীকে নিয়ে বেশ একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল গুরুচরণ কলেজ রোডের ঐ বাড়িটিতে। ওখানেই দেখেছি সাহিত্যিক দেবেশ রায়কে, 'তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত' উপন্যাসের জন্যে সদ্য তিনি তখন আকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। দেখেছি গৌরী ঘোষকে, সাংবাদিক অশোক দাশগুপ্ত ও ঢাকার প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞা প্রফেসর সন্জিদা খাতুনকে। ১৯৯১র মে মাসের এক বৃষ্টির দিনে রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীর প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা জমেছিল। রূপকদা ও কিশোর শিল্পী রাহুল দত্ত গেয়ে চলেছে একের পর এক বর্ষার গান। তখনই মৈত্রেয়ীদি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে উঠলেন- 'রবি ঠাকুর কি সব একেকটা বর্ষাঋতুর উপর গান লিখেছেন, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে জুটেছে একটিই'।
- 'সে আবার কি?' সবাই হৈ হৈ করে উঠি। 'আমাদের ভাগ্যে মানে?'
- 'আর কিতা! ওই 'ঝর ঝর বরিষে বারিধারা। হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।' '
- 'সে আবার কি?' সবাই হৈ হৈ করে উঠি। 'আমাদের ভাগ্যে মানে?'
- 'আর কিতা! ওই 'ঝর ঝর বরিষে বারিধারা। হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।' '
সবাই হো হো করে হেসে উঠলেও কথাটা যে কতটা সত্যি তা বোঝা গেল ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠানের দিনেই। 'প্রভু আমার, প্রিয় আমার' নামে একটা গীতি-আলেখ্য চলছিল। রবি ঠাকুরের গানে যে প্রভু আর প্রিয়র মধ্যে বিশেষ ভেদ নেই, প্রেম আর পূজা পর্যায় কোথায় যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে, গানে গানে সেটাই যেন বোঝানো হচ্ছিল ইনিয়ে-বিনিয়ে। গিন্নী এই অনুষ্ঠানে নেই, তিনি বাপের বাড়িতে, আর আমি বসে দর্শক আসনে। এমন সময় রূপকদা হন্ত-দন্ত হয়ে এসে বল্লেন- 'ব্যস, কাম সারসে। শিলচরের দ্যাবতা হাতে-নাতে দেখাইয়া দিসেন- তাইনের 'প্রেমে আঘাত আছে, নাইক অবহেলা।'
- তার মানে?
- বরাক নদীর বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে......আইজকার প্রোগ্রামের এখানেই ইতি।
- তার মানে?
- বরাক নদীর বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে......আইজকার প্রোগ্রামের এখানেই ইতি।
ব্যস, দশ মিনিটে হল খালি। জল ঢুকতে লাগলো হু হু করে। কোনোমতে স্কুটার চালিয়ে বাড়ি পৌছলাম। বাসায় শুধু মা ছিলেন, তাঁকে আর সে রাত্রে কিছু বললাম না।
পরদিন সকালে উঠেই দেখি ধুন্ধুমার কাণ্ড। সামনের রাস্তায়, তখনো ঠিক পাকা হয় নি, মোরাম-ঢালা ছিল, এক হাঁটু জল ও ক্রমশঃই বর্ধমান। পঞ্চায়েত রোডে আমাদের ভাড়া-বাড়ি, মালিক ব্যাঙ্কের অফিসার, নরসিংটোলায় থাকেন। সযত্নে বানানো বাড়ি্র বাগানটি রাস্তার লেভেল থেকে অনেকটা উঁচুতে, তারও আড়াই ফুট উঁচু বাড়ির প্লিন্থ। খুব বড়সড় বন্যা না হলে অতদূর জল ওঠা অসম্ভব, তাই বেশ নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু এর একটা অন্য দিক ছিল, সেটা এবার টের পেলাম। পনের মিনিটের মধ্যেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল আমার ঠিকে ঝি, কাচ্চা-বাচ্চা, তোলা উনুন, কাপড়-চোপড় নিয়ে একেবারে সপরিবারে। এক্ষেত্রে না বলা সঙ্গত নয়, এটাই কাছাড়ের দস্তুর। তারপর বন্ধুবান্ধবরা স্কুটার রাখতে আসতে লাগলো। ধীরে ধীরে আটটি স্কুটার নিয়ে আমার বাড়িটি অচিরাত একটি স্কুটার গ্যারেজে পরিণত হল।
(২)
এইবার চিন্তা হল অফিস যাব কি ভাবে। ছুটি ডিক্লেয়ার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কর্মীরই দায়িত্ব হল যেনতেনপ্রকারেন দপ্তরে পৌঁছিয়ে কাজ বন্ধ করাবার জন্যে দরবার করা। তারপর যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ছুটি পাওয়া যায় তবে দুর্যোগ আর উপভোগে তফাৎ কতটুকু? এদিকে পাজামা গুটিয়ে বাজারের দিকে একটু এগিয়ে দেখে এলাম চ্যাং-কুড়ি রোডের কাঠের পুলটুকু বাকি আছে বটে, তবে দুপাশের রাস্তা জলমগ্ন। তাকিয়ে দেখি পাশের বাড়ি প্রফেসর রঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়ির বারান্দায় তিনি প্রফেসার বন্ধু শ্যামলদার সাথে বসে চা খাচ্ছেন। আজ কলেজ ছুটি, ওঁরা জানালেন। 'সে কি, আপনাদের কলেজ তো টিলার উপরে, জলে ডোবার তো কথা নয়' আমি বলি।
- আরে ভাইটি, গরু-বাছুরগুলো না আসতে পারলে আমরা চরাব কাদের?' শ্যামলদা বললেন। প্রসঙ্গতঃ জানাই যে গুরুচরণ কলেজকে ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে 'গরু-চরানো' কলেজ বলতেন মজা করে এবং ছাত্রেরা সেটা ঠিক পছন্দ না করলেও অধ্যাপকেরা নিজেদেরকে ব্রজের সেই রাখালরাজার সাথে তুলনা করে যারপরোনাস্তি আনন্দ পেতেন। কিম্বা হয়ত সিলেটিরা স্বভাবতঃই খুব বুদ্ধিমান প্রাণী, অন্ততঃ মানুষের থেকে তো বটেই, তাই কথাটার অসম্ভবতা অনুমান করেই মজা পেতেন। আমি তাঁদের দলে যোগ দেব কিনা ভাবছিলাম, এমন সময় দেখি, অঙ্কের অধ্যাপক যাদব ভট্টাচার্য ধুতিখানা গুটিয়ে সেদিকপানেই আসছেন। তিন ভট্টাচার্যের ত্র্যহস্পর্শ থেকে ত্রিপাদদোষ লেগে যেতে পারে ভেবে আমি আর সেদিকপানে এগোলাম না।
হঠাত মনে হল কেউ যেন গেট খুলছে। তাকিয়ে দেখি আমাদের সহকর্মী গৌরীশংকর দত্ত গুটিগুটি পায় ঘরে ঢুকছে। 'কি রে, তুই এখনও ঘরে বসে', দত্ত আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল। 'কেন, তুই কি অফিস যাবার জন্যে নৌকো ভাড়া করে এনেছিস?' আমি জানতে চাই।
- ঠিক ধরেছিস তো! ডিঙ্গি নৌকোটা কাঠের পুলে বেঁধে রেখে এসেছি। সকালে জি-এমের ফোন এসেছে বাড়িওলা মারফত, বন্ধুবান্ধবরা বন্যায় কে কেমন আছে তার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে। তাই বেরিয়ে পড়েছি। তুই তো এখন ঝাড়া হাত পা, চল আমার সাথে।
আমি তো একপায়ে খাড়া। মাকে জানিয়ে ওর সাথে নৌকো করে বেরিয়ে পড়লাম।
- ঠিক ধরেছিস তো! ডিঙ্গি নৌকোটা কাঠের পুলে বেঁধে রেখে এসেছি। সকালে জি-এমের ফোন এসেছে বাড়িওলা মারফত, বন্ধুবান্ধবরা বন্যায় কে কেমন আছে তার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে। তাই বেরিয়ে পড়েছি। তুই তো এখন ঝাড়া হাত পা, চল আমার সাথে।
আমি তো একপায়ে খাড়া। মাকে জানিয়ে ওর সাথে নৌকো করে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমে কলেজ রোডে আশিস বিশ্বাসের বাড়ি। ঘরের একতলায় জল থৈ থৈ। ও থাকে দোতলায়। মালিক একতলায় ছিল, জল ঢুকতেই তিনিও উঠে পড়েছেন ওপরে। আমরা হাঁক-ডাক করতেই বিশ্বাস দোতলার বারান্দা থেকে মই ঝুলিয়ে দিল, আমরা তাই বেয়ে বাসায় ঢুকলাম। ওর চিন্তা ছিল স্কুটারখানা নিয়ে, গৌরি বলল, 'চ্যাটার্জির বাগানে অন্ততঃ সাতটা স্কুটার দেখে এলাম। চল সেখানেই রেখে আসি, চিন্তা নেই, কোনও ভাড়া লাগবে না'। 'ভাড়া কেন, কুলি খরচও লাগবে না, আমরা আছি তো, শিক্ষিত কুলি', আমি আশ্বস্ত করলাম। তারপর তিনজনে মিলে ধ্বস্তাধস্তি করে স্কুটারকে নৌকোয় চাপিয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে এসে রাখা হল।
ফেরার সময় আবার একই পথ ধরলাম। এবার আমরা তিনজন। হঠাৎ খেয়াল হল, নীহারের খবর তো নেওয়া দরকার, ওর জ্বর ছিল দু-তিনদিন ধরে। যদিও ওরা থাকে কলেজের পেছনে টিলার ঢালু অংশটিতে, সেখানে কোনদিনই বন্যা আসবে না। তবু ওরা কেমন আছে খবরটা নেওয়া প্রয়োজন মনে করে আমরা রাস্তার ধারে নৌকো 'পার্ক' করে নীহার ব্যানার্জির বাসার কড়া নাড়ালাম।
(৩)
নীহার বেরিয়ে এল, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। আমরা ওকে স্মোক করতে কখনো দেখিনি। 'বুলা, তুমি নীহারকে সিগারেট ধরিয়েছ?' গৌরী হাঁক পাড়ল অন্তরালবর্তিনীর উদ্দেশ্যে।
'ওহ্, আমার কি ক্ষমতা ওকে কিছু ধরাই বা ছাড়াই! ওর ধারণা একটানা সিগারেট খেলে জল তাড়াতাড়ি নেমে যাবে'- বুলা দেবী এবার সরোষে প্রকট হলেন, হাতে ধূমায়িত কাপের ট্রে।
- আসলে আমার জলে একটা আতঙ্ক আছে...না, না কুকুরের কামড় থেকে নয়, ছোটবেলায় খড়গপুরে দেখা একটা ভয়াবহ বন্যার ঘটনা থেকে। পরের বছরও যদি এরকম দেখি, আমি এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাব- নীহারের বক্তব্য।
'ওহ্, আমার কি ক্ষমতা ওকে কিছু ধরাই বা ছাড়াই! ওর ধারণা একটানা সিগারেট খেলে জল তাড়াতাড়ি নেমে যাবে'- বুলা দেবী এবার সরোষে প্রকট হলেন, হাতে ধূমায়িত কাপের ট্রে।
- আসলে আমার জলে একটা আতঙ্ক আছে...না, না কুকুরের কামড় থেকে নয়, ছোটবেলায় খড়গপুরে দেখা একটা ভয়াবহ বন্যার ঘটনা থেকে। পরের বছরও যদি এরকম দেখি, আমি এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাব- নীহারের বক্তব্য।
আমি ছোটনাগপুরের পাহাড়ি শহরে মানুষ, বর্ষায় তোড়ে জল বয়ে যেতে দেখেছি। সেই সময় সাধারণ অবস্থায় লাফ দিয়ে পার হওয়া যায় এমন এক নালার জলের স্রোতে শুধু মানুষ নয়, আস্ত একটা বাস ভেসে যেতে দেখেছি চোখের সামনে দিয়ে। পুরো ঘটনাটা হৃদয়-বিদারক, তবে এটুকু বলতে পারি যে বাস ড্রাইভার ভাল অঙ্ক জানত না, ভেলোসিটি প্যারালেলোগ্রামের ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। যাক সে কথা। তবু একবার আরেক পাহাড়ি শিল্প-শহর জামসেদপুরের সোনারি অঞ্চলে বন্যা দেখেছিলাম সে কোন ১৯৭৪ সালে। সেও নেহাৎ শহুরে বাবুদের শখ-চরিতার্থের বন্যা। সুবর্ণরেখা-খড়কাই-এর সঙ্গমস্থলে হঠাৎ জল বেড়ে এক কাণ্ড, অপ্রস্তুত গৃহবাসীদের অবাক করে ফ্রীজ-সোফাসেট-আলমারি সব ভাসিয়ে নিয়ে এসেছিল ঘরের বাইরে, সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুজুগে দর্শনার্থীদের ভীড় লেগে গেল শহরের একপ্রান্তের এই অঞ্চলটিতে। সেই শ্রাবণে অনেকে পৌষমাস দেখে ফেলল, যেমন ফুচকা-অলা, বেলুন-বাঁশীওলা ইত্যাদি। রথ দেখা আর কলা-বেচা একসাথে চলতে থাকল। শুনেছিলাম একটা নাগরদোলাও নাকি এসেছিল, ভেজা মাঠে সাহস করে খুঁটি পুঁততে পারেনি বলে ফিরে যেতে হয়েছিল তাদের!
সেই আমার চোখের সামনে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জল শুধু জল। আমার তো ভালই লাগছিল দেখতে, জানিনা নীহারের চিত্ত কেন হয়েছে বিকল। ওকে অনেক বলেও বাড়ি থেকে বের করা গেল না। অগত্যা আমরা এবার সৎসঙ্গ আশ্রমের জলপথ ধরলাম, সেখানে আছে দুই গুজরাটি পরিবার, হরিয়ানি আর উকিল। দুজনের নামেরই কোনও ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ভরতভাই হরিয়ানির সাথে হরিয়ানার কোনো সম্বন্ধ নেই, আর মিঃ উকিল ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। যাই হোক, তাঁরা সপরিবারে ভালই আছেন, গুজুভাইদের বাসায় সর্বদা অন্ততঃ একমাসের চাল-ডাল-নুন-তেল স্টক করাই থাকে, তাই ওদের বিশেষ চিন্তা নেই। তবে ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করছে, গুজরাটে একসাথে এত জল দেখা যায় না কিনা! আমরা অগত্যা ফিরলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য বিবেকানন্দ রোড, স্বপন দাস এণ্ড কোং।
(৪)
শিলচরের বিবেকানন্দ রোড তখন ত্রিশ ফুট চওড়া একটি নদী। একপ্রান্তে রামকৃষ্ণ মিশন রোড ও তারাপুরের দিক থেকে ঢাল নেমেছে, অন্যদিকে অনুকুল ঠাকুরের সত্সঙ্গ আশ্রম রোড আর উত্তরে কলেজ রোড ঢালু হয়ে বিবেকানন্দ রোডের সাথে মিশেছে যে তেমাথায়, সেখানে একটি মাছ-সবজির বাজার বসে। আজ সেখানে বিশ বাঁও জলের আনুকূল্যে আর মরা নয়, জ্যান্ত মাছ ধরছে পাড়ার দুঃসাহসী ছেলেরা। সেখান থেকে নৌকোয় বিবেকানন্দ রোডে ঢুকেই বাঁদিকে প্রথমে পড়ল প্রদীপ মন্ডলের বাড়ি। ওর বিয়ের তখনও বর্ষপূর্তি হয় নি, বলতে গেলে হানিমুন কাপল। ওর বাড়িওলা জানালেন, কাল রাতে জল বাড়তে দেখেই প্রদীপ আজ ভোরে সস্ত্রীক এয়ারপোর্ট রওনা হয়ে গেছে, টিকিট পেলেই সোজা কলকাতা। বেচারা, একটা থ্রিলিং হনিমুন অন এ রিভার ক্রুজের চান্স মিস করলো! তার ওপাশের বাড়িতে থাকে আশিস বসাক। হুজুগে মানুষ, একটু ডাকাডাকি করতেই বৌয়ের গজগজানি কর্ণপাত না করে আমাদের 'বজরা'য় এসে বসল।
উল্টোদিকের একটা গলিতে একতলা বেশ বড় একখানা বাড়িতে স্বপন দাস থাকে বউ-বাচ্চা ও বাবা-মাকে নিয়ে। ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি একতলার অর্ধেকের উপর জলের তলায়। ওরা গেল কোথায়? তখনই যেন স্বর্গ থেকে দৈববাণী হলো- 'নৌকোর মুখটা সোজা সিঁড়িঘরে ঢুকিয়ে দে'। ওপরে তাকিয়ে দেখি স্বপন নির্দেশ দিচ্ছে ছাদ থেকে। অগত্যা সেইভাবেই সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে এলাম।
স্বপনদের ছাদের উপরে এসে দেখি এলাহী কান্ড! তিনখানা তাঁবু পাতা হয়েছে বিশাল ছাদ জুড়ে। তার একটাতে তিন পরিবারের বারোয়ারী রান্না চড়েছে, খিচুড়ি আর ইলিশের ঝাল। পাওয়ার নেই বটে, তবে স্ট্যান্ড-বাই জেনারেটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশ পিকনিকের মেজাজ।ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালার বড়ছেলে সাইকেলে করে গোটা চার-পাঁচ ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে এলো, রাতের খোরাক হিসেবে। রিমি আর স্বপন খেয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ করছিল বার বার, লোভ যে হয়নি তাও নয়, কিন্তু আমরা তো কেউ একা নই, তাছাড়া বাসায় খবর যে পাঠাব, তখন এমন ঘরে ঘরে ফোন ছিলনা, মোবাইল তো দুরের কথা। অগত্যা সবিনয়ে তাদের প্রত্যাখ্যান করতে হল। মেসোমশাই অবশ্য অন্য একটা লোভ দেখাচ্ছিলেন। আমি থাকলে চারজন পার্টনার হয়ে যেত আর তাহলে বেশ ব্রিজ খেলা যেত খেয়ে-দেয়ে। কদিনের রসদ আর কদিনেরই বা আনন্দ! তবু ওদের মানিয়ে নেওয়া দেখে বেশ ভাল লাগলো। চা আর পকোড়ি খেয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।
'আজকের মত অনেক ঘোরা হল', এই বলে গৌরী আমাকে আর বসাককে যথাস্থানে নামিয়ে দিয়ে নৌকো নিয়ে মালুগ্রামে নিজের বাসায় রওনা দিল। আমার বাড়ির উল্টোদিকের দোতলা বিল্ডিংটা হল সরকারী বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আঞ্চলিক হেড অফিস। দেখি সেখানে আলোর মালা সাজানো হচ্ছে। ওদের ইলেকট্রিসিয়ান দত্তগুপ্ত তদারকি করছে। জিজ্ঞেস করলাম- 'কি ভাই, আপনাদের এখন পৌষমাস নাকি?' ব্যঙ্গের খোঁচাটুকু মাঠে মারা গেল। উত্তর পেলাম- 'না দাদা, আমরার এনুয়াল ডে হইত আজ সৈন্ধায়, আইয়েন নিশ্চয়'।
এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ অফিসটি বরাক-অববাহিকায় বন্যা প্রতিরোধ ও তত্কালীন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছিল কয়েকবছর আগে। কিন্তু দেখা গেল প্র্যাকটিক্যালি সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বন্যা-আমন্ত্রণ বিভাগ' আর সেটা যে অমূলক নয় বন্যার সময় কর্মচারীদের মুখ-চোখের উদ্দীপ্ত ভাব থেকেই তা বোঝা যেত। ৯১-৯৩-৯৪ এর ক্রমবর্ধমান বন্যার থেকে শিক্ষা নিয়ে শুনেছি নাকি ১৯৯৫ সালে এই অফিসটি তুলে দেওয়া হয়। আমি শিলচরের পাট উঠিয়ে বদলি হয়ে পন্ডিচেরি চলে আসি ১৯৯৪-এ। বন্ধুদের মুখে শুনেছি তার পরে নাকি বরাকে তেমন উল্লেখনীয় বন্যা আসেনি- আজ পর্যন্ত !
(শেষ)
No comments:
Post a Comment