কুবের, কন্দর্প ও কোয়টাস ।।
(১)
'কোয়টাস !!' কথাটা শুনে একটু অস্বস্তি নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকান সুন্দরমূর্তি। হ্যাঁ, ইনি সেই বিখ্যাত টেকনোসিস কোম্পানির মালিক ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মি: সুন্দরমূর্তি আয়ারই বটেন। কথা হচ্ছিল তাঁর সফটওয়ের বিভাগের মাথা দুর্দান্ত প্রতিভাবান হ্যান্ডসাম যুবক অনঙ্গ দেশাইয়ের সাথে। ছেলেটিকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। এই বয়েসেই যা সব ইনোভেটিভ গ্যাজেট তৈরী করে দুনিয়ার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, তাতে তিনি অনঙ্গকে তাঁর কোম্পানির আদর্শ উত্তরাধিকারী রূপে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। অপুত্রক ও বিপত্নীক তিনি। নিজের বলতে একমাত্র কন্যা মালিনী। তিনি তো অনঙ্গকে বেশ কয়েকদিন ধরে চোখে চোখে রাখছেন, এখন তাঁর মেয়েটির এদিকে একটু নজর পড়তেই যা বাকি।
না, মেয়ে তাঁর পাগল বা কুরূপা নয়। টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে রীতিমত পড়াশুনা করে এসেছে আমেরিকা থেকে। এখন বাবার সাথে অফিসে বসে হাতে-কলমে কাজ শিখছে। আয়ার সাহেবের ইচ্ছে আছে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মেয়ে জামাইকে একত্রে নিজের কোম্পানির দায়িত্ব ধরিয়ে দেন। কিন্তু মেয়ে তার কথায় আমল দিলে তো! তার নেশা মোবাইলে বসে শুধু বন্ধুদের সাথে হোয়াটস-অ্যাপ বা গুগলে চ্যাট করা। তাই বলে ভাববেন না যে সে তাদের কারো সাথে প্রেম করে। মালিনী হয়ত তার অর্ধেক বন্ধুর দিকে মুখ তুলে তাকায়ইনি কখনো। তাই এই মা-মরা মেয়েটিকে নিয়ে মি: আয়ারের চিন্তা হওয়ারই কথা। তবে এই অনঙ্গ ছেলেটিকে তিনি ছাড়তে রাজী নন। আপাত নির্লোভ আর সচ্চরিত্র হলেও যে কোনও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার হিম্মত আছে অনঙ্গের। তাই অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা জয়ের একটা চ্যালেঞ্জের আভাস দিয়ে তাকে আটকে রেখেছেন কোনমতে, নইলে বিদেশী কোম্পানিগুলো তো ওকে লোফার জন্যে হাত উঁচু করেই আছে। তাই কিছুটা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য নিয়েই জানুয়ারি মাসের এক সুন্দর সকালে অনঙ্গকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অফিসে মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু হবু জামাই যে প্রথমেই 'কোয়টাস' বা যৌন-সঙ্গম জাতীয় কিছু একটা বলে বসবে সেকথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
'স্যার, আপনি যা ভাবছেন তা নয়', মিঃ আয়ারকে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে দেখে এবার অনঙ্গের ব্যাখ্যা করার পালা, 'কোয়টাস একটা এপ্লিকেশন সফটওয়্যার, যার পুরো নাম 'ক্লোজার অফ ইন্টারনেট টেলিকম ইউজার্স সফটওয়্যারস' (Closure Of Internet Telecom Users' Softwares), যা বিশেষ ধরনের স্মার্ট ফোনের সাহায্যে ব্যবহার করা যায়। প্লিজ, এ ব্যাপারে এখন আর কিছু জানতে চাইবেন না, এখন এটা এক্সপেরিমেন্টাল স্টেজে আছে'।
'তবু ব্যাপারটা কি একটু বলবে তো, না কি নিজস্ব পেটেন্ট নিতে চাইছ?' একটু রসিকতার ছলেই বললেন আয়ার। তাঁর বিশ্বাস আছে ছেলেটির উপর।
'স্যার, এই টেকনোলজির যুগে মানুষ যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো হারিয়ে ফেলতে বসেছে- যার জন্যে আজ পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর জনসংখ্যা কমতে কমতে এলার্মিং অবস্থায় ঠেকেছে এসে, তার বিরুদ্ধে কাজ করবে এই অ্যাপ। এবার আপনি শুধু বলুন, মিস মালিনী সম্বন্ধে আপনার প্ল্যানটা কি? বাকি কাজটুকু আমার উপর ছেড়ে দিন।'
'দাঁড়াও, একটু ভাবা দরকার। তুমি বরং লাঞ্চের পর একবার এস।'
অনঙ্গ চলে গেলে এসি বন্ধ করে অফিসের জানালাটা খুলে দিলেন মিঃ আয়ার। অন্য আইটি ও কম্প্যুটার কোম্পানীগুলোর থেকে কিছুটা তফাৎ রেখেই বছর দশেক আগে এখানে হেড অফিস বানিয়েছিলেন তিনি, তখন শহরের প্রায় বাইরে ইয়ালাহাঙ্কাতে। স্যাটেলাইট টাউনশিপের ৩ নং ক্রশ রোডের এই অফিসের জানালায় দাঁড়ালে দেখা যায় নয় নম্বর জাতীয় সড়ক আর নিউ টাউন মেন রোডের শৃঙ্খলাবদ্ধ গাড়ির মিছিল, গ্রেটার বাঙ্গালোর ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশনের তত্বাবধানে যার মধ্যে কোন ত্রুটি পাওয়াই ভার। যার ফলে তিনি মাল্লেশ্বরমে নিজের বাড়ি যাবার জন্যে নয় নম্বর হাইওয়ে না ধরে এ পথেই যাওয়া আসা করেন। নতুন এয়ারপোর্টটাও কাছে পড়ে। এখন ত পুরনো আই-টি পার্কের মালিকরা রীতিমত হিংসে করে তাঁকে আর মনে মনে তারিফ করে দূরদর্শিতার জন্যে। তবে মিঃ আয়ার জানেন যে হেড অফিসের অবস্থানের সাথে কোম্পানীর উন্নতির কোনও সম্বন্ধ নেই, তার জন্যে অনং নামের এই রত্নটিকে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্ত কিভাবে? জানলার বাইরে তিন নম্বর ক্রস রোডে কি আছে এই সমস্যার সমাধান? তিনি চিন্তিতমনে মোবাইলে একের পর এক নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন। তারপর একসময় টিফিন বাক্স বের করে হাল্কা লাঞ্চ সেরে নিলেন।
লাঞ্চ আওয়ারের পর অনঙ্গ এল দেখা করতে। তবে তারপর প্রায় আধঘন্টা ধরে ইয়ালাহাঙ্কার অফিসে বসে বাঙ্গালুরু সিলিকন সাম্রাজ্যের একজন অধীশ্বর আর তাঁর কোম্পানির 'মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলার'এর মধ্যে কি কথা হল তা আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না।
(২)
১৪ই ফেব্রুয়ারির বিকেল পাঁচটায় মি: আয়ার মেয়েকে নিজের অফিসঘরে ডেকে বললেন, 'মা, আমি আজ ইউনিয়ানের মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকব, ফিরতে অনেক রাত্রি হবে। তুই বরং অনঙ্গের সাথে অফিসের গাড়িটাতে করে চলে যা, ওকে মাল্লেশ্বরমে ড্রপ করে দিস। মেয়ে বাবাকে চেনে, তাই আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে চলে গেল অনঙ্গের অফিসের দিকে।
সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে ওরা দুজনে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে বাইরে আসতেই দেখে তিন নম্বর ক্রস রোড থেকে নিউ টাউন মেন রোডের রাস্তায় সবকটা গাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। সাধারণত: এ সময়টা একটু জ্যাম হয়, তা বলে এত। গাড়ি তো গেট ছেড়ে নড়তেই পারছে না। বাঁদিকে ঘুরতে পারলে একটা না একটা রেডিয়াল রোড অনায়াসে ধরা যায়, কিন্তু গাড়ি এগোলে তো! ড্রাইভার যথেষ্ট অভিজ্ঞ, সে পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয় স্যার, এখন ঘন্টা দুই মনে হচ্ছে বাঁদিকে এগোনো যাবে না, চলুন বরং ডানদিকে ঘুরে হাইওয়ে ধরি। কিন্তু সেখানেও বিপদ। শেষাদ্রিপুরম কলেজের কাছে এসে আর গাড়ি এগোয় না, এত ট্র্যাফিক। শেষে যেন কিছুটা নিরুপায় হয়েই অনঙ্গ বলল, 'ম্যাম, এখন আর গাড়িতে বসে কি হবে, চলুন সামনের সি-সি-ডি'তে গিয়ে ততক্ষণ আসল কলোম্বিয়ান কফির স্বাদ নিয়ে আসি'। 'চলুন', অনিচ্ছাসত্ত্বেই বলল মালিনী, তার চোখ তখনও মোবাইলের দিকে।
ওরা দুজনে কাফেতে গিয়ে বসেই আছে, যেন একে অপরকে চেনেই না। মালিনী নিবিষ্টমনে ফোন নিয়ে হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট করছে আর অনঙ্গ ওকে একমনে দেখে যাচ্ছে। ইস, এমনিভাবে যদি মালিনী ওকে দেখত! কনভেন্ট পড়া মেয়ে, নিশ্চয়ই অনঙ্গ কথাটার মানে জানে না। হঠাৎ কি খেয়াল হওয়ায় নিজের স্মার্টফোন বের করলো অনঙ্গ। 'এ কি এসময় নেট চলে গেল যে' - অবাক হয়ে বলল মালিনী। 'আমার তো সাবস্ক্রাইবার কানেকশন, সিটি ওয়াই-ফাই তো নয়!'
'আপনি বসুন, ম্যাম, আমি দেখছি, এদের ওয়াই-ফাই আছে কিনা', বলে উঠল অনঙ্গ।
'আপনি বসুন তো', এতক্ষণে বোধহয় মুখ তুলে তাকাল মালিনী অনঙ্গের দিকে। আরে, বেশ হ্যান্ডসাম ছেলেটি তো, নম্র, ভদ্রও বটে। 'কি ম্যাম ম্যাম করছেন তখন থেকে? আমার নাম মালিনী, আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। এত তাড়া কিসের, নাহয় কিছুক্ষণ গল্পই করলে আমার সাথে', হাত ধরে টেনে ওকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল মালিনী। তারপরে ঘণ্টা দুয়েক যে কিভাবে কোথা থেকে কেটে গেল, কেউই তা টের পেল না। একে ত জেট-সাইবার যুগের ছেলেমেয়ে, তার উপরে ভ্যালেন্টাইনের সন্ধ্যা, কখন, কোথায়, কি হয়ে যায় তা কে জানে। রবি ঠাকুরের আমলে এই দিনটি থাকলে মনের কথাটি তারে বলার জন্যে আর ঘনঘোর বরষার অপেক্ষা না করলেও চলত।
পরদিন সকাল সকাল মিঃ আয়ারের চেম্বারে অনঙ্গ, সঙ্গে মালিনী, এই প্রথম একসাথে। 'স্যার, কনগ্রাচুলেট মি, স্যরি, মানে আমাদের দুজনকেই আশীর্বাদ করুন। আমরা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আদর্শে দীক্ষা নিয়েছি গতকাল'। অনঙ্গ বলল । 'বাকি কাজটা এবার আপনার হাতে'। আনন্দ ও বেদনার যুগপৎ অনুভবে মিঃ আয়ারের মন ভরে উঠল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে।
'আমি আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী বাবা', মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন মি: সুন্দরমূর্তি আয়ার। একফাঁকে একটু চোখ টিপে দিলেন অনঙ্গের দিকে তাকিয়ে।
ওরা দুজনে চলে গেল। এখন অনেক কাজ মি: আয়ারের। চিন্তা কি ছিল না! রেডিয়াল আর ক্রশ রোডের নেটওয়ার্ক দিয়ে ইয়েলাহাঙ্কা সার্কেলের প্ল্যানটাই এমনভাবে করেছে বাঙ্গালুরু কর্পোরেশন যে বিজিয়েস্ট আওয়ারেও কখনো জ্যাম হয় না। কাল সেটাও সম্ভব হয়েছে। সুতরাং আয়ার সাহেবের প্রথম কাজ হল ডি সি ট্রাফিকের বাসায় অন্তত: পাঁচলাখ টাকার একটা তোফা পাঠান- অবশ্যই অতি গোপনে, গতকাল তিন নম্বরের মুখ থেকে সবকটা ট্রাফিক পুলিশকে ঠিক সময়ে ঘন্টা তিনেকের জন্যে তুলে নেবার জন্যে। তারপর ক্যাফে কফি ডে'র ম্যানেজারকে হাজার দশেক, সার্ভিং-এ দেরী করানোর জন্যে। ড্রাইভারকে তার সুন্দর অভিনয়ের জন্যে একটা স্পেশ্যাল বোনাস দেওয়া যেতেই পারে, ব্যাটা এক্সপার্ট হয়েও বলে কিনা এগোনো যাবে না হুজুর!
আর অনঙ্গকে- তার 'কোয়টাস' এর জন্যে? তা আর বলতে! সে ছোঁড়াই তো সবচেয়ে বড় দাঁওখানা মারলো। তাহলে কুবের আর কন্দর্পের খেলায় জিতল কে? ছি ছি, জিতল কিনা একটা সফটওয়ার, যার কোনও ভূমিকা থাকারই কথা নয় এখানে!
Kuwait, 13th April, 2015.
No comments:
Post a Comment