সবটা মোটেও গল্প না
(১)
রাজ্যারোহনের সাঁইত্রিশ বছর পরে প্রভাস থেকে খবর এল যে পাণ্ডবদের মামাতো ভাই আর পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই দেহরক্ষা করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আর কেন ভাইসব, অনেক তো রাজ্যভোগ হল, চল এবার আমরাও যাই। সত্যি বলতে কি, কৌরবরা নেই, জরাসন্ধ-শিশুপাল-কীচকের মত বীরও আর দেখা যায় না। যুদ্ধ কার সাথে করি আর এই ঐশ্বর্য দেখাই বা কাকে! তা তোমার কি মত, বৃকোদর।‘ ভীম বসে থেকে থেকে আর রাজভোগ খেয়ে পেল্লায় একটি ভুঁড়ি বানিয়েছেন এতদিনে। তিনি পেটে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘দাদা, ইচ্ছে ছিল কেসি দাস বা হলদিরামের মত একটা জমাটি দোকান খুলে বসি হস্তিনাপুরে, তা আর হল না। আগ্রা থেকে আনানো পঞ্ছীর মোরব্বা খেয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেয়ে মনে হয় স্বর্গে যাওয়াই ভাল। শুনেছি ওখানকার পারিজাতের মধু থেকে তৈরি মাধ্বী নাকি দারুন, একবার চেখে দেখতেই হচ্ছে!’
অর্জুন অবাক। ‘বল কি মেজদা, তুমি এখনও ওসব ছাইপাঁশ হজম করতে পার? আমার তো অম্লশূল শুরু হয়েছে। স্বর্গবৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের ছেলে মানে আমাদের ছোট ভাই নকুল-সহদেবের তৈরি ক্ষারক-চূর্ণ না থাকলে এমনিতেই আমার স্বর্গপ্রাপ্তি হত। তা, বড়দা যখন বলছেন, আমার আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদীকে ছেড়ে আমি কোথাও নড়ছি নে।‘ নকুল তো বরাবরই চুপচাপ। আর পাশাখেলার সময় দ্রৌপদীর অপমান দেখে সহদেব একবার চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই তাঁর শেষ প্রতিবাদ। দ্রৌপদী আড়াল থেকে সব শুনছিলেন। তিনি মহা উৎসাহে চুল বাঁধতে গেলেন। তারপর অর্জুনের নাতি পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে শুভদিন দেখে একদিন পাঁচভাই-বৌ মিলে রওনা হয়ে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। সে পথের বর্ণনা তো মহাভারতেই ভাল আছে, তাই তার আর পুনরাবৃত্তি করলাম না, আমাদের গল্প তাই নিয়ে যা মহাভারতে নেই।
(২)
পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর থেকে হিমালয়ের পথ ধরলেন। ভীমের ইচ্ছেয় পাণ্ডবরা ভীমদত্ত, পশুপতিনগর হয়ে কৈলাস-মানসের পথ ধরলেন। এই ভীমদত্ত একসময় বৃকোদর ভীমের রাজত্ব ছিল। জতুগৃহ পুড়ে যাবার পর পাণ্ডবরা যখন চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় কুমায়ূন অঞ্চলের উপজাতীয় রাক্ষসবংশীয় সর্দার হাড়িম্বকে ঘটনাচক্রে মেরে তাঁর বোন হাড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন ভীম। তারপর বছরখানেক সেই অঞ্চলেই থেকে রাজত্ব চালান তিনি। পুত্র ঘটোৎকচের জন্মের পর হাড়িম্বা(তিনি আদর করে বলতেন হিড়িম্বা, আমরাও তাই বলব)কে রাজ্যভার দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন ভাইদের কাছে। রুদ্রপুর পেরিয়েই ভীমের রাজ্য শুরু হল। পথে পড়ল ভীমতাল সরোবর, যেটা তিনি পাহাড়ের একদিক থেকে বেঁধে জল ধরে রাখার জন্যে তৈরি করিয়েছিলেন। সেখানে স্নানাদি সেরে তাঁরা ভীমদত্ত শহরে এসে হিড়িম্বার দেখা পেলেন।
হিড়িম্বা তো ভীমকে কিছুতেই ছাড়বেন না। মহাপ্রস্থানে যাবার জেদ ধরে বসে আছেন। ‘কৃষ্ণাদি যেতে পারে, আর আমি গেলেই দোষ! কেন, দিদি কি আমার চেয়ে বেশি ফর্সা? আমি পাহাড়ি মেয়ে, তোমাদের থেকে ভাল এসব পারি, তা জান? নন্দনকাননের রাস্তা চেন তোমরা?’ অনেক কষ্টে, অনেক ভুজুং-ভাজাং দিয়ে তাঁকে কাটান হল। তিনি কচি মোষের কলজে ভাজা অনেকটা আর সেই সাথে সেদ্ধ-ভুট্টা গেঁজানো মদ দিতে চেয়েছিলেন সাথে, শরীর গরম থাকবে বলে। ‘আমরা তো মরতেই যাচ্ছি, তার আগে কি ওই ছাই-পাঁশগুলো না খেলেই নয়’, এই বলে অর্জুন কাটিয়ে দিলেন। ওঁরা এগিয়ে গেলেন। ‘মন দিয়ে প্রজাদের দেখাশুনো কর, আর খুব ক্ষিদে না পেলে তাদের মাংস খেয়ো না’ এই উপদেশ দিয়ে ভীম ভাইদের পিছু নিলেন। গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল, রাগের চোটে তাকেই ফুটন্ত দুধের মধ্যে ফেলে হিড়িম্বা পায়েস বানাতে লেগে গেলেন।
একজালা পায়েস খেয়ে হিড়িম্বার ক্ষুধা আর রাগ মিটলেও তাঁর মন শান্ত হল না। ‘দূর ছাই’ বলে তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে উলটোপথে হাঁটা দিলেন ও বেশ কদিন পরে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গঙ্গোত্রী-গোমুখে এসে হাজির হলেন। নাম শুনে ভেবেছিলেন, বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট কিছু গোবৎস পাওয়া যাবে সেখানে, পেট ভরে খাওয়া জুটবে বহুদিন পরে। কিন্তু দেখলেন কি? গরুর হাঁ-এর মত একটা গুহা, সেখান থেকে ভীষণ বেগে বেরিয়ে আসছে বরফ-জলের স্রোত, আর তার পাশেই এক ছাগল-দাড়িওলা মুনিঠাকুর চোখ বুজে বসে আছেন। হিড়িম্বা ভাবলেন আজ এটাকে দিয়ে জলখাবার খেলে কেমন হয়! বেচারা, তিনি কি করে জানবেন যে ঐ মুনিঠাকুরটি আর কেউ নন, মানুষে তাড়ানো দেবতায় খেদানো পরম নাস্তিক জাবালি ঋষি।
(৩)
জাবালি মুনির পরিচয় কিছু দিতে হবে কি? তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছিলেন, বিধিমত পৈতেও হয়েছিল। তারপর অন্য মুনি-ঋষিদের মত একজায়গায় বসে ধ্যান-টান করার বদলে দুনিয়ার সারসত্যটা জানার তাঁর খুব ইচ্ছে হল। ঈশ্বর বলে কেউ আছে কিনা, থাকলেও তাঁর বাসা কোথায়, দেবতারা কি অমর, তাঁরা কি সত্যিই ভগবান? স্বর্গ-নরক কোথায়, আত্মা কি বস্তু, পুনর্জন্ম সত্যি আছে কিনা এসব প্রশ্ন সবাইকে শুধিয়ে বেড়াতে লাগলেন। লোকে বিরক্ত হয়, আরে বাবা ব্যাদ পড় না কেন, ব্যাদেই তো সব পাবে, তাঁরা বোঝান। কিন্তু উনি দেখলেন বেদ মানে স্বতঃসিদ্ধ কিছু ধারণা মাত্র, এগুলো সব সত্যি বলে মেনে নিয়েই তা লেখা হয়েছে, আসলে তার কোন প্রমাণ নেই। ব্রাহ্মন, আরণ্যক আর উপনিষদে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু গল্প-গাথা আর শ্লোক আছে, তবে সেগুলো নিছক নীতিশাস্ত্র আর মন্ত্র-তন্ত্র, যদিও কাব্যমাধুর্য তাদের ভালই। তখন উনি খুঁজে খুঁজে দেবতাদের ঠিকানা জোগাড় করে ছদ্মবেশে সব ঘুরে-টুরে দেখে এলেন। তারপর ফিরে এসে পৈতে ছিঁড়ে ফেললেন, আর প্রচার করতে লাগলেন- দেবতা-টেবতা সব ফাঁকিবাজি। একদল ফর্সা লোক, চেহারা ভাল, হিমালয়ের ওপারে কৈলাসপাহাড়ের তলায় মানসসরোবরের তীরে নন্দনকাননে থাকে, তারাই নিজেদেরকে দেবতা বলে। তাদের মধ্যেও জন্মমৃত্যু-আহার-নিদ্রা-মৈথুন সব আছে। ইন্দ্র-অগ্নি-বরুণ এগুলো শুধু তাদের পদনাম, ইন্দ্র মরলে আর একজন ইন্দ্র হয়, বরুণ মরলে তার ছেলে বা অন্য কেউ বরুণ হয়। এঁদের আসলে অস্ত্র-বল আর চাতুর্য যথেষ্ট পরিমাণে আছে, তাই দিয়ে এরা ব্রাহ্মণদের দিয়ে বেদ লিখিয়েছেন আর ক্ষত্রিয়দের দিয়ে ক্রিয়াবিধিগুলো করিয়ে তাতে করে নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রেখে সবার উপরে ছড়ি ঘোরাতে থাকেন। স্বর্গ-নরক বলে মারা যাবার পরে আলাদা করে কিছু নেই, যা আছে তা এই জীবনেই আছে। ভগবান যদি থাকেনও তাঁর সম্বন্ধে মানুষ যা জানে, দেবতারা তার বেশি কিছু জানে না। তাঁর কথা শুনে কেউ কানে আঙুল দিল, কেউ বা ঝাঁটা হাতে তেড়ে এল। দেবতা আর অন্য ঋষিমুনিরা মিলে তাঁকে একঘরে করে দিল।
এই সেই জাবালি মুনি যিনি পিতৃসত্য রক্ষা করতে বনবাসে যাওয়ার সময় রামকে বেশ দামী-দামী উপদেশ দিয়েছিলেন, যেগুলো বাল্মীকিমুনি চক্ষুলজ্জার খাতিরেও বাদ দিতে পারেন নি। উনি পষ্টোভাষায় বলেছিলেন-‘দেখ বাপু, রাজার কাজ হল মন দিয়ে রাজ্যশাসন করা। প্রজা সুখে থাকলেই রাজার সার্থকতা, এই শুধু তার নৈতিক দায়িত্ব। তা না রাম, তুমি চলেছ বনে, কি না পিতৃসত্য পালন করবে। আরে বাবা, ভেবে দেখ কে তোমার মা-বাবা? একটি শুক্রকীট আর একটি ডিম্বানুই তোমার মা, তোমার বাবাও। আর তুমি যেহেতু ক্ষত্রিয়, শত্রুশাসনই তোমার ধর্ম। তুমি রাজা, প্রজারঞ্জনই তোমার কর্ম- এর বাইরে তোমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তাছাড়া যে মরেছে তাকে পিণ্ডদান করেই বা কার কি লাভ? মরা মানুষকে যদি তুমি ভাত খাওয়াতে পার তাহলে তো বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়েও আমার খাওয়া-পরার কোন চিন্তা থাকবে না, বৌ আমাকে ঘরে বসেই রোজ খাইয়ে দেবে!‘ রাজা দশরথ যতদিন বেঁচেছিলেন, জাবালির রুজিরুটির কোনও অভাব হয় নি, তিনি মুচকি হেসে সব শুনতেন, তর্কও জুড়তেন মাঝে মাঝে। রাম কিন্তু এসব শুনে চড়াত করে রেগে উঠলেন। তিনি মুনিকে যা নয় তাই বলে গালাগাল দিলেন। পারিষদদলে বলে তার শতগুণ! অগত্যা অন্য মুনিরা তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে একেবারে সরযূ-গোমতী পার করিয়ে দিয়ে এলেন।
এখন জাবালি কি করেন? হৃষিকেশে গঙ্গাতীরে বসে তিনি আবার বেদ পড়তে শুরু করলেন। ঋষিপত্নী আগেই গত হয়েছেন, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই, দু-চারটে গাঁজাখোর শিষ্য জুটতেও দেরি হল না। তা একদিন জাবালি ঋগ্বেদে চার্বাক বা চারুবাক বলে এক তার্কিক পণ্ডিতের সম্বন্ধে পড়লেন। কি আশ্চর্য, তিনিও তো সেই একই কথা বলছেন-
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য
পুনরাগমনম্ কুতঃ।।‘
ইতিমধ্যে পিপ্পলাদ বলে তাঁর একটি শিষ্য জুটেছে। তাকে তিনি মহা উৎসাহে এই নতুন খুঁজে পাওয়া দর্শন বোঝাতে লাগলেন। মাসছয়েক শাস্ত্র-আলোচনার পর তিনি এই নতুন দর্শনটি পিপ্পলাদকে প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে গঙ্গোত্রী ছাড়িয়ে গোমুখে অলকানন্দার তীরে আরাম করছেন, এমন সময় খবর পেলেন শিষ্যটি ব্রাহ্মণ আর ঋষিদের চাপে পড়ে জাবালি-উপনিষদ নামে একখানা বই লিখে ফেলেছে। তাতে আবার তত্ব, জীব, আত্মা আর বিভূতি নিয়ে জ্ঞান গম্ভীর বিশ্লেষণ ঢুকিয়েছে একগাদা। ঈশ্বর আর মোক্ষ নিয়েও নাকি অনেক এঁড়েমি করেছে ব্যাটা। নাস্তিকের নীতিজ্ঞান জিনিষটা অবশ্য জাবালিরও পছন্দের। নাস্তিক যদি বিবেক বিসর্জন দেয় তবে তার আর পশুর মধ্যে তফাৎটা আর রইল কোথায়। তবু তিনি কোথায় ভেবেছিলেন চার্বাকের দর্শনকে আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাবেন, পিপ্পলাদ দিল সব তপস্যার ফল নষ্ট করে।
তাই তিনি ইদানীং আর কারো সাথে কথাবার্তা বলেন না বিশেষ। শুনেছেন নেপালের তরাই অঞ্চলে নাকি বোধিসত্ব বা তথাগত বলে একদল নব্য সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা বেদ সত্য নয় বলে প্রচার চালাচ্ছে। যাকগে, বয়স একশো পেরিয়ে গেছে, এই বয়সে না তো তাঁর বুদ্ধ-বোধিসত্ব হবার দেহবল আছে আর না নতুন করে ঈশ্বর-ভজনা শুরু করতে পারবেন। এখন তাঁর অলস প্রহর কাটে এই অলকানন্দার তীরের ছোট্ট বাসাখানায় বসে বসে আর ক্বচিৎ দু-একটা পাখির ডাক শুনে। কিন্তু সামনে যে এই বিশাল জন্তুটি, দেখে অবশ্য কোন পাহাড়ি উপজাতির মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, বিশাল হাঁ করে এগিয়ে আসছে, তার কি করা
যায় এখন!
(৪)
‘আহা, আজ যেন অসময়ে চাঁদ উঠল, তাও এই মর্ত্যলোকে, বরফের উপত্যকায় যেন পারিজাত ফুটল। কে গো মা তুমি?’ ঋষি নাস্তিক হলেও তাঁর রাক্ষসীর পেটে যাবার ইচ্ছে নেই, আর প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা কে না বলে।
তবে কাজ হল তাতে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হিড়িম্বা থমকে দাঁড়ালেন। ‘আরে এ তো একটা চিম্সে বুড়ো! দূর ছাই, চিবোনোই যাবে না, দাঁতেরই গুষ্টিনাশ হবে শুধু’, তিনি ভাবলেন। যদিও বুড়োর কথাবার্তা ভাল, অনেকদিন নিজের সম্বন্ধে এরকম সত্যি কথা শোনেন নি, তবু ভাবলেন, ‘নাঃ, যখন এগিয়ে এসেছি, একটু তো ভয় দেখাতেই হবে- নইলে মান থাকে না।‘ কিন্তু তার আগেই জাবালি বলে উঠলেন, ‘উঃ কত বছর ধরে এই দেহভার থেকে মুক্তি পাবার আশায় এখানে বসে আছি। আজ মনে হয় আমার ইচ্ছে পূর্ণ হল। এখানে যে আসে সেই কিছু না কিছু বর চায়। আমিও বর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখন তুমি আমাকে খেয়ে উদ্ধার করলেই আমি বাঁচি।‘
বরের নামে হিড়িম্বা এবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপরেই হঠাৎ ‘আমার বর, আমার বর’ বলে কেঁদে উঠলেন। ‘কি হল মা, তোমার বুঝি ক্ষিদে নেই এখন?’ মুনি বললেন। ‘না না, মুনিঠাকুর বলছিলাম কি আমার বর, মানে মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন আমায় ফেলে মহাপ্রস্থান করতে চলে গেছেন। এবার আমার কি হবে!’
‘সে কি গো কন্যে? না না, এ বর আমি তো দিতে পারব নি। তবে অন্য কিছু ইচ্ছে থাকে তো বল। যদিও ভগবানের সঙ্গে আমার আড়ি, তবু বলা যায় না, লেগে যেতেও পারে।‘
‘ঠাকুর, কত কি ভেবেছিলাম করব, তা আর এ জন্মে হল না। গান গাইতে, কাব্য লিখতে, ছবি আঁকতে, তা আর হল কই! বৃকোদর চলে যাওয়ায় একা রাজ্য চালাতে হল। ছেলেটাও অকালে মরে গেল, দাদার তো বিয়েই হয়নি, বংশরক্ষাও হলনা। আর কি এ জন্মে সেসব পাব?’
‘এ জন্মে হবে না তো কি আছে, পরের জন্মে হবে’ মুনি বলছেন আর মনে ভাবছেন- এরকম অবস্থায় পড়েই তো মানুষ হয় গাদাগুচ্ছেক মিথ্যে বলে বা ভগবানকে ডাকে। ভগবান বা পুনর্জন্ম না মানার ভাল শাস্তি পাচ্ছি আজ, বাধ্য হয়ে সব মানতে হচ্ছে। ‘আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি পরের জন্মে তুমি রাজ্যশাসন করছ। ভীম তোমাকে এ জন্মে কষ্ট দিয়েছে তাই পরজন্মে তুমি অনূঢ়া থাকবে। ভাইয়ের বংশরক্ষা হয়নি বলছ, নাহয় একটি ভাইপোও থাকবে। আর কি চাও?’
‘আর অন্য ইচ্ছেগুলো?’
‘আরে, আমাকে কি ভূতের রাজা পেয়েছ! হবে হবে, সব হবে’ বলে জাবালি একটু মুচকি হাসলেন। ‘বৎসে, আমার বরে পরজন্মে তুমি গলা খুল্লেই মিঞা তানসেন, রঙের তুলি ধরলেই দা-ভিঞ্চি আর কলম ধরলেই শেক্ষপীয়ার বা কালিদাস হবে। এবার যাও দেখি, আমার ঘুম পেয়েছে।‘
‘আর কোথায় যাব, ঋষিঠাকুর? তোমার এখানেই থাকি না, তোমার পদসেবা করেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিই।‘
‘ওরে বাবা!’ জাবালি আঁতকে উঠলেন। ‘না না এখানে নয়। এখানে কি মানুষ থাকে? তুমি বরং আরো উত্তর পশ্চিমে চলে যাও বিতস্তা নদীর তীর ধরে। মানালি নামে সেখানে একটা গ্রাম আছে, যেখানে একসময় বৈবস্বত মনু থাকতেন। ওখানকার রাক্ষসজাতির মধ্যে কোন বড় নেতা নেই, সবাই খাওয়া-খাওয়ি করে মরছে। সেখানে তুমি তোমার নতুন রাজধানী বসাও। পরজন্মে নেতৃত্ব করার প্রাথমিক পাঠটাও সেখানেই হয়ে যাবে।
(৫)
এরপরের ঘটনা মহাভারতে নেই বটে, তবে হিড়িম্বা যে মনুলীলাভূমি বা মানালিতে গিয়ে একজন নামজাদা শাসক হয়ে উঠেছিলেন তা সেখানকার হিড়িম্বা আর ঘটোৎকচ মন্দির দেখলেই বোঝা যায়। আর জাবালির বর? যে ভদ্দরলোক পুনর্জন্মেই বিশ্বাস রাখেন না তাঁর বর যে ফলতেই হবে তার কোনও মানে আছে নাকি? তবে এ দুনিয়ার অনেক জায়গাতে অনেক কিছুই তো ঘটে থাকে। তাই যদি কাকতালীয়ভাবে কোথাও কিছু ঘটতে দেখাও যায়, তবে তা কি জাবালির দোষ?
রাজ্যারোহনের সাঁইত্রিশ বছর পরে প্রভাস থেকে খবর এল যে পাণ্ডবদের মামাতো ভাই আর পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই দেহরক্ষা করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আর কেন ভাইসব, অনেক তো রাজ্যভোগ হল, চল এবার আমরাও যাই। সত্যি বলতে কি, কৌরবরা নেই, জরাসন্ধ-শিশুপাল-কীচকের মত বীরও আর দেখা যায় না। যুদ্ধ কার সাথে করি আর এই ঐশ্বর্য দেখাই বা কাকে! তা তোমার কি মত, বৃকোদর।‘ ভীম বসে থেকে থেকে আর রাজভোগ খেয়ে পেল্লায় একটি ভুঁড়ি বানিয়েছেন এতদিনে। তিনি পেটে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘দাদা, ইচ্ছে ছিল কেসি দাস বা হলদিরামের মত একটা জমাটি দোকান খুলে বসি হস্তিনাপুরে, তা আর হল না। আগ্রা থেকে আনানো পঞ্ছীর মোরব্বা খেয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেয়ে মনে হয় স্বর্গে যাওয়াই ভাল। শুনেছি ওখানকার পারিজাতের মধু থেকে তৈরি মাধ্বী নাকি দারুন, একবার চেখে দেখতেই হচ্ছে!’
অর্জুন অবাক। ‘বল কি মেজদা, তুমি এখনও ওসব ছাইপাঁশ হজম করতে পার? আমার তো অম্লশূল শুরু হয়েছে। স্বর্গবৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের ছেলে মানে আমাদের ছোট ভাই নকুল-সহদেবের তৈরি ক্ষারক-চূর্ণ না থাকলে এমনিতেই আমার স্বর্গপ্রাপ্তি হত। তা, বড়দা যখন বলছেন, আমার আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদীকে ছেড়ে আমি কোথাও নড়ছি নে।‘ নকুল তো বরাবরই চুপচাপ। আর পাশাখেলার সময় দ্রৌপদীর অপমান দেখে সহদেব একবার চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই তাঁর শেষ প্রতিবাদ। দ্রৌপদী আড়াল থেকে সব শুনছিলেন। তিনি মহা উৎসাহে চুল বাঁধতে গেলেন। তারপর অর্জুনের নাতি পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে শুভদিন দেখে একদিন পাঁচভাই-বৌ মিলে রওনা হয়ে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। সে পথের বর্ণনা তো মহাভারতেই ভাল আছে, তাই তার আর পুনরাবৃত্তি করলাম না, আমাদের গল্প তাই নিয়ে যা মহাভারতে নেই।
(২)
পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর থেকে হিমালয়ের পথ ধরলেন। ভীমের ইচ্ছেয় পাণ্ডবরা ভীমদত্ত, পশুপতিনগর হয়ে কৈলাস-মানসের পথ ধরলেন। এই ভীমদত্ত একসময় বৃকোদর ভীমের রাজত্ব ছিল। জতুগৃহ পুড়ে যাবার পর পাণ্ডবরা যখন চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় কুমায়ূন অঞ্চলের উপজাতীয় রাক্ষসবংশীয় সর্দার হাড়িম্বকে ঘটনাচক্রে মেরে তাঁর বোন হাড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন ভীম। তারপর বছরখানেক সেই অঞ্চলেই থেকে রাজত্ব চালান তিনি। পুত্র ঘটোৎকচের জন্মের পর হাড়িম্বা(তিনি আদর করে বলতেন হিড়িম্বা, আমরাও তাই বলব)কে রাজ্যভার দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন ভাইদের কাছে। রুদ্রপুর পেরিয়েই ভীমের রাজ্য শুরু হল। পথে পড়ল ভীমতাল সরোবর, যেটা তিনি পাহাড়ের একদিক থেকে বেঁধে জল ধরে রাখার জন্যে তৈরি করিয়েছিলেন। সেখানে স্নানাদি সেরে তাঁরা ভীমদত্ত শহরে এসে হিড়িম্বার দেখা পেলেন।
হিড়িম্বা তো ভীমকে কিছুতেই ছাড়বেন না। মহাপ্রস্থানে যাবার জেদ ধরে বসে আছেন। ‘কৃষ্ণাদি যেতে পারে, আর আমি গেলেই দোষ! কেন, দিদি কি আমার চেয়ে বেশি ফর্সা? আমি পাহাড়ি মেয়ে, তোমাদের থেকে ভাল এসব পারি, তা জান? নন্দনকাননের রাস্তা চেন তোমরা?’ অনেক কষ্টে, অনেক ভুজুং-ভাজাং দিয়ে তাঁকে কাটান হল। তিনি কচি মোষের কলজে ভাজা অনেকটা আর সেই সাথে সেদ্ধ-ভুট্টা গেঁজানো মদ দিতে চেয়েছিলেন সাথে, শরীর গরম থাকবে বলে। ‘আমরা তো মরতেই যাচ্ছি, তার আগে কি ওই ছাই-পাঁশগুলো না খেলেই নয়’, এই বলে অর্জুন কাটিয়ে দিলেন। ওঁরা এগিয়ে গেলেন। ‘মন দিয়ে প্রজাদের দেখাশুনো কর, আর খুব ক্ষিদে না পেলে তাদের মাংস খেয়ো না’ এই উপদেশ দিয়ে ভীম ভাইদের পিছু নিলেন। গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল, রাগের চোটে তাকেই ফুটন্ত দুধের মধ্যে ফেলে হিড়িম্বা পায়েস বানাতে লেগে গেলেন।
একজালা পায়েস খেয়ে হিড়িম্বার ক্ষুধা আর রাগ মিটলেও তাঁর মন শান্ত হল না। ‘দূর ছাই’ বলে তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে উলটোপথে হাঁটা দিলেন ও বেশ কদিন পরে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গঙ্গোত্রী-গোমুখে এসে হাজির হলেন। নাম শুনে ভেবেছিলেন, বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট কিছু গোবৎস পাওয়া যাবে সেখানে, পেট ভরে খাওয়া জুটবে বহুদিন পরে। কিন্তু দেখলেন কি? গরুর হাঁ-এর মত একটা গুহা, সেখান থেকে ভীষণ বেগে বেরিয়ে আসছে বরফ-জলের স্রোত, আর তার পাশেই এক ছাগল-দাড়িওলা মুনিঠাকুর চোখ বুজে বসে আছেন। হিড়িম্বা ভাবলেন আজ এটাকে দিয়ে জলখাবার খেলে কেমন হয়! বেচারা, তিনি কি করে জানবেন যে ঐ মুনিঠাকুরটি আর কেউ নন, মানুষে তাড়ানো দেবতায় খেদানো পরম নাস্তিক জাবালি ঋষি।
(৩)
জাবালি মুনির পরিচয় কিছু দিতে হবে কি? তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছিলেন, বিধিমত পৈতেও হয়েছিল। তারপর অন্য মুনি-ঋষিদের মত একজায়গায় বসে ধ্যান-টান করার বদলে দুনিয়ার সারসত্যটা জানার তাঁর খুব ইচ্ছে হল। ঈশ্বর বলে কেউ আছে কিনা, থাকলেও তাঁর বাসা কোথায়, দেবতারা কি অমর, তাঁরা কি সত্যিই ভগবান? স্বর্গ-নরক কোথায়, আত্মা কি বস্তু, পুনর্জন্ম সত্যি আছে কিনা এসব প্রশ্ন সবাইকে শুধিয়ে বেড়াতে লাগলেন। লোকে বিরক্ত হয়, আরে বাবা ব্যাদ পড় না কেন, ব্যাদেই তো সব পাবে, তাঁরা বোঝান। কিন্তু উনি দেখলেন বেদ মানে স্বতঃসিদ্ধ কিছু ধারণা মাত্র, এগুলো সব সত্যি বলে মেনে নিয়েই তা লেখা হয়েছে, আসলে তার কোন প্রমাণ নেই। ব্রাহ্মন, আরণ্যক আর উপনিষদে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু গল্প-গাথা আর শ্লোক আছে, তবে সেগুলো নিছক নীতিশাস্ত্র আর মন্ত্র-তন্ত্র, যদিও কাব্যমাধুর্য তাদের ভালই। তখন উনি খুঁজে খুঁজে দেবতাদের ঠিকানা জোগাড় করে ছদ্মবেশে সব ঘুরে-টুরে দেখে এলেন। তারপর ফিরে এসে পৈতে ছিঁড়ে ফেললেন, আর প্রচার করতে লাগলেন- দেবতা-টেবতা সব ফাঁকিবাজি। একদল ফর্সা লোক, চেহারা ভাল, হিমালয়ের ওপারে কৈলাসপাহাড়ের তলায় মানসসরোবরের তীরে নন্দনকাননে থাকে, তারাই নিজেদেরকে দেবতা বলে। তাদের মধ্যেও জন্মমৃত্যু-আহার-নিদ্রা-মৈথুন সব আছে। ইন্দ্র-অগ্নি-বরুণ এগুলো শুধু তাদের পদনাম, ইন্দ্র মরলে আর একজন ইন্দ্র হয়, বরুণ মরলে তার ছেলে বা অন্য কেউ বরুণ হয়। এঁদের আসলে অস্ত্র-বল আর চাতুর্য যথেষ্ট পরিমাণে আছে, তাই দিয়ে এরা ব্রাহ্মণদের দিয়ে বেদ লিখিয়েছেন আর ক্ষত্রিয়দের দিয়ে ক্রিয়াবিধিগুলো করিয়ে তাতে করে নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রেখে সবার উপরে ছড়ি ঘোরাতে থাকেন। স্বর্গ-নরক বলে মারা যাবার পরে আলাদা করে কিছু নেই, যা আছে তা এই জীবনেই আছে। ভগবান যদি থাকেনও তাঁর সম্বন্ধে মানুষ যা জানে, দেবতারা তার বেশি কিছু জানে না। তাঁর কথা শুনে কেউ কানে আঙুল দিল, কেউ বা ঝাঁটা হাতে তেড়ে এল। দেবতা আর অন্য ঋষিমুনিরা মিলে তাঁকে একঘরে করে দিল।
এই সেই জাবালি মুনি যিনি পিতৃসত্য রক্ষা করতে বনবাসে যাওয়ার সময় রামকে বেশ দামী-দামী উপদেশ দিয়েছিলেন, যেগুলো বাল্মীকিমুনি চক্ষুলজ্জার খাতিরেও বাদ দিতে পারেন নি। উনি পষ্টোভাষায় বলেছিলেন-‘দেখ বাপু, রাজার কাজ হল মন দিয়ে রাজ্যশাসন করা। প্রজা সুখে থাকলেই রাজার সার্থকতা, এই শুধু তার নৈতিক দায়িত্ব। তা না রাম, তুমি চলেছ বনে, কি না পিতৃসত্য পালন করবে। আরে বাবা, ভেবে দেখ কে তোমার মা-বাবা? একটি শুক্রকীট আর একটি ডিম্বানুই তোমার মা, তোমার বাবাও। আর তুমি যেহেতু ক্ষত্রিয়, শত্রুশাসনই তোমার ধর্ম। তুমি রাজা, প্রজারঞ্জনই তোমার কর্ম- এর বাইরে তোমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তাছাড়া যে মরেছে তাকে পিণ্ডদান করেই বা কার কি লাভ? মরা মানুষকে যদি তুমি ভাত খাওয়াতে পার তাহলে তো বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়েও আমার খাওয়া-পরার কোন চিন্তা থাকবে না, বৌ আমাকে ঘরে বসেই রোজ খাইয়ে দেবে!‘ রাজা দশরথ যতদিন বেঁচেছিলেন, জাবালির রুজিরুটির কোনও অভাব হয় নি, তিনি মুচকি হেসে সব শুনতেন, তর্কও জুড়তেন মাঝে মাঝে। রাম কিন্তু এসব শুনে চড়াত করে রেগে উঠলেন। তিনি মুনিকে যা নয় তাই বলে গালাগাল দিলেন। পারিষদদলে বলে তার শতগুণ! অগত্যা অন্য মুনিরা তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে একেবারে সরযূ-গোমতী পার করিয়ে দিয়ে এলেন।
এখন জাবালি কি করেন? হৃষিকেশে গঙ্গাতীরে বসে তিনি আবার বেদ পড়তে শুরু করলেন। ঋষিপত্নী আগেই গত হয়েছেন, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই, দু-চারটে গাঁজাখোর শিষ্য জুটতেও দেরি হল না। তা একদিন জাবালি ঋগ্বেদে চার্বাক বা চারুবাক বলে এক তার্কিক পণ্ডিতের সম্বন্ধে পড়লেন। কি আশ্চর্য, তিনিও তো সেই একই কথা বলছেন-
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য
পুনরাগমনম্ কুতঃ।।‘
ইতিমধ্যে পিপ্পলাদ বলে তাঁর একটি শিষ্য জুটেছে। তাকে তিনি মহা উৎসাহে এই নতুন খুঁজে পাওয়া দর্শন বোঝাতে লাগলেন। মাসছয়েক শাস্ত্র-আলোচনার পর তিনি এই নতুন দর্শনটি পিপ্পলাদকে প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে গঙ্গোত্রী ছাড়িয়ে গোমুখে অলকানন্দার তীরে আরাম করছেন, এমন সময় খবর পেলেন শিষ্যটি ব্রাহ্মণ আর ঋষিদের চাপে পড়ে জাবালি-উপনিষদ নামে একখানা বই লিখে ফেলেছে। তাতে আবার তত্ব, জীব, আত্মা আর বিভূতি নিয়ে জ্ঞান গম্ভীর বিশ্লেষণ ঢুকিয়েছে একগাদা। ঈশ্বর আর মোক্ষ নিয়েও নাকি অনেক এঁড়েমি করেছে ব্যাটা। নাস্তিকের নীতিজ্ঞান জিনিষটা অবশ্য জাবালিরও পছন্দের। নাস্তিক যদি বিবেক বিসর্জন দেয় তবে তার আর পশুর মধ্যে তফাৎটা আর রইল কোথায়। তবু তিনি কোথায় ভেবেছিলেন চার্বাকের দর্শনকে আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাবেন, পিপ্পলাদ দিল সব তপস্যার ফল নষ্ট করে।
তাই তিনি ইদানীং আর কারো সাথে কথাবার্তা বলেন না বিশেষ। শুনেছেন নেপালের তরাই অঞ্চলে নাকি বোধিসত্ব বা তথাগত বলে একদল নব্য সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা বেদ সত্য নয় বলে প্রচার চালাচ্ছে। যাকগে, বয়স একশো পেরিয়ে গেছে, এই বয়সে না তো তাঁর বুদ্ধ-বোধিসত্ব হবার দেহবল আছে আর না নতুন করে ঈশ্বর-ভজনা শুরু করতে পারবেন। এখন তাঁর অলস প্রহর কাটে এই অলকানন্দার তীরের ছোট্ট বাসাখানায় বসে বসে আর ক্বচিৎ দু-একটা পাখির ডাক শুনে। কিন্তু সামনে যে এই বিশাল জন্তুটি, দেখে অবশ্য কোন পাহাড়ি উপজাতির মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, বিশাল হাঁ করে এগিয়ে আসছে, তার কি করা
যায় এখন!
(৪)
‘আহা, আজ যেন অসময়ে চাঁদ উঠল, তাও এই মর্ত্যলোকে, বরফের উপত্যকায় যেন পারিজাত ফুটল। কে গো মা তুমি?’ ঋষি নাস্তিক হলেও তাঁর রাক্ষসীর পেটে যাবার ইচ্ছে নেই, আর প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা কে না বলে।
তবে কাজ হল তাতে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হিড়িম্বা থমকে দাঁড়ালেন। ‘আরে এ তো একটা চিম্সে বুড়ো! দূর ছাই, চিবোনোই যাবে না, দাঁতেরই গুষ্টিনাশ হবে শুধু’, তিনি ভাবলেন। যদিও বুড়োর কথাবার্তা ভাল, অনেকদিন নিজের সম্বন্ধে এরকম সত্যি কথা শোনেন নি, তবু ভাবলেন, ‘নাঃ, যখন এগিয়ে এসেছি, একটু তো ভয় দেখাতেই হবে- নইলে মান থাকে না।‘ কিন্তু তার আগেই জাবালি বলে উঠলেন, ‘উঃ কত বছর ধরে এই দেহভার থেকে মুক্তি পাবার আশায় এখানে বসে আছি। আজ মনে হয় আমার ইচ্ছে পূর্ণ হল। এখানে যে আসে সেই কিছু না কিছু বর চায়। আমিও বর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখন তুমি আমাকে খেয়ে উদ্ধার করলেই আমি বাঁচি।‘
বরের নামে হিড়িম্বা এবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপরেই হঠাৎ ‘আমার বর, আমার বর’ বলে কেঁদে উঠলেন। ‘কি হল মা, তোমার বুঝি ক্ষিদে নেই এখন?’ মুনি বললেন। ‘না না, মুনিঠাকুর বলছিলাম কি আমার বর, মানে মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন আমায় ফেলে মহাপ্রস্থান করতে চলে গেছেন। এবার আমার কি হবে!’
‘সে কি গো কন্যে? না না, এ বর আমি তো দিতে পারব নি। তবে অন্য কিছু ইচ্ছে থাকে তো বল। যদিও ভগবানের সঙ্গে আমার আড়ি, তবু বলা যায় না, লেগে যেতেও পারে।‘
‘ঠাকুর, কত কি ভেবেছিলাম করব, তা আর এ জন্মে হল না। গান গাইতে, কাব্য লিখতে, ছবি আঁকতে, তা আর হল কই! বৃকোদর চলে যাওয়ায় একা রাজ্য চালাতে হল। ছেলেটাও অকালে মরে গেল, দাদার তো বিয়েই হয়নি, বংশরক্ষাও হলনা। আর কি এ জন্মে সেসব পাব?’
‘এ জন্মে হবে না তো কি আছে, পরের জন্মে হবে’ মুনি বলছেন আর মনে ভাবছেন- এরকম অবস্থায় পড়েই তো মানুষ হয় গাদাগুচ্ছেক মিথ্যে বলে বা ভগবানকে ডাকে। ভগবান বা পুনর্জন্ম না মানার ভাল শাস্তি পাচ্ছি আজ, বাধ্য হয়ে সব মানতে হচ্ছে। ‘আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি পরের জন্মে তুমি রাজ্যশাসন করছ। ভীম তোমাকে এ জন্মে কষ্ট দিয়েছে তাই পরজন্মে তুমি অনূঢ়া থাকবে। ভাইয়ের বংশরক্ষা হয়নি বলছ, নাহয় একটি ভাইপোও থাকবে। আর কি চাও?’
‘আর অন্য ইচ্ছেগুলো?’
‘আরে, আমাকে কি ভূতের রাজা পেয়েছ! হবে হবে, সব হবে’ বলে জাবালি একটু মুচকি হাসলেন। ‘বৎসে, আমার বরে পরজন্মে তুমি গলা খুল্লেই মিঞা তানসেন, রঙের তুলি ধরলেই দা-ভিঞ্চি আর কলম ধরলেই শেক্ষপীয়ার বা কালিদাস হবে। এবার যাও দেখি, আমার ঘুম পেয়েছে।‘
‘আর কোথায় যাব, ঋষিঠাকুর? তোমার এখানেই থাকি না, তোমার পদসেবা করেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিই।‘
‘ওরে বাবা!’ জাবালি আঁতকে উঠলেন। ‘না না এখানে নয়। এখানে কি মানুষ থাকে? তুমি বরং আরো উত্তর পশ্চিমে চলে যাও বিতস্তা নদীর তীর ধরে। মানালি নামে সেখানে একটা গ্রাম আছে, যেখানে একসময় বৈবস্বত মনু থাকতেন। ওখানকার রাক্ষসজাতির মধ্যে কোন বড় নেতা নেই, সবাই খাওয়া-খাওয়ি করে মরছে। সেখানে তুমি তোমার নতুন রাজধানী বসাও। পরজন্মে নেতৃত্ব করার প্রাথমিক পাঠটাও সেখানেই হয়ে যাবে।
(৫)
এরপরের ঘটনা মহাভারতে নেই বটে, তবে হিড়িম্বা যে মনুলীলাভূমি বা মানালিতে গিয়ে একজন নামজাদা শাসক হয়ে উঠেছিলেন তা সেখানকার হিড়িম্বা আর ঘটোৎকচ মন্দির দেখলেই বোঝা যায়। আর জাবালির বর? যে ভদ্দরলোক পুনর্জন্মেই বিশ্বাস রাখেন না তাঁর বর যে ফলতেই হবে তার কোনও মানে আছে নাকি? তবে এ দুনিয়ার অনেক জায়গাতে অনেক কিছুই তো ঘটে থাকে। তাই যদি কাকতালীয়ভাবে কোথাও কিছু ঘটতে দেখাও যায়, তবে তা কি জাবালির দোষ?
12/june/2015
No comments:
Post a Comment