Sunday, April 15, 2018

অভিজ্ঞতা। (সনেট)

অভিজ্ঞতা।
(সনেট)


এতক্ষণে, দিদিমণি কহিলা হরষে,
বুঝিনু কেমনে জেতা যায় ভোট-রণে।
উন্নয়ন-শিল্পায়ন, যত বাজে কথা-
বাঙালী চাকুরি হ'তে সহস্র যোজনে...
দাঁড়ায়ে পাড়িবে গালি শিল্পপতি জনে,
বুর্জোয়া তারা তো সবে। এসেছে লুটিতে
এই বঙ্গপ্রদেশের মামাটিমানুষে।
শিল্প নয়, কাজ নয়, চায় যে জু্টিতে
বাইক-বাহিনী রূপে; কিম্বা সিণ্ডিকেটে।
দু-টাকায় চাল দাও, ক'টা সাইকেল
ক্লাবে দাও অনুদান দুই-চা্রি লাখ।
এই ছন্দে লিখে গেছে কবে মাইকেল!
কিবা 'পয়োজন' মোর এলিট ভাষায়?
স্ল্যাং মেরে কাজ্জোসিদ্ধি- যা বোঝে চাষায়!

জয় বাবা ভোটনাথ- অণুগল্প

জয় বাবা ভোটনাথ!
অণুগল্প

'ভোট এস্যেছে। কাল গরুর গাড়ি লিয়ে আইসব, খুড়িমা-জ্যেঠিমারা সব ভোট দিতে যাবেন গো'- হাঁক দিল মটর, বাবুগাঁয়ের মটর দত্ত। এ সেই ছাপ্পান্ন, না না, বোধহয় সাতান্নর বাংলার নির্বাচন। ছাপ্পা-ভোট ছিল কিনা জানিনা, তবে কংগ্রেসেরই বোলবালা তখনও।
ভৈরব ঘোষালের বুড়ি বেধবা রাজেশ্বরী, যাঁকে গাঁয়ের ছেলে-ছোকরারা ডাকে রাজু-বুড়ি, সামনে অবশ্য রাজু-ঠাম্মা, তিনি মটরকে ডেকে ভোটের খবরাদি নিলেন। 'হ্যাঁরে, ভোট দিলে কি হয়?' তাঁর প্রশ্ন। 'পেরজাতন্ত্রে ভোট বড় যন্তর ঠাম্মা, নিজের রাজা নিজেই বাছো, ইচ্ছেমত কাজ করাবে তার পর।' এর বেশী কি মটর নিজেই জানে, ছাই? তবে বুড়ীর অত শোনার শখ নেই। গতমাসে তাঁর একমাত্র পুত্র সুদামের তিন নম্বর কন্যা জন্মাবার পর থেকেই ছেলের জন্যে পুন্নাম নরকের ভয় চেপে বসেছে বুড়ীর মনে, নানা জায়গায় মানত করে যাচ্ছেন তিনি ক্রমাগত।
যথাসময়ে গাঁয়ের বউ-ঝিরা রাজু-ঠাম্মার নেতৃত্বে সদলবলে এসে ভোটগাড়ি, থুড়ি, গরুর গাড়ির সওয়ার হলেন। পুরুষরা আগেই রওনা হয়ে গেছে হেঁটে বা সাইকেলে। গোবিন্দপুরের ইস্কুলে যখন পৌঁছল তারা, বেলা বেড়ে গেছে, সুয্যিমামা সওয়ার মাথার উপরে। না, মেয়ে-বউদের আলাদা লাইন হলেও বয়েসের সম্মানে ঠাম্মাকে লাইন দিতে হলনা, গদাই আর পটলা- কংগ্রেস আর জনসঙ্ঘের এজেন্ট, তখনও ছিপিম বা সিপিএম নামেনি মাঠে, ধরাধরি করে নিয়ে এল রাজুবুড়িকে পোলিং বুথের ভিতরে। 'ওটা কি মাখায় রে আঙ্গুলে? সিঁদুর লয় তো? আমি বেধবা মাগী, সিঁদুর পরাস নে যেন হতভাগা!' আঙ্গুলে টিপ পরার পর ঠাম্মা বাক্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। আদ্রার পোস্টমাস্টার সেনবাবু, প্রিসাইডিং অফিসার, যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে বুড়ীকে ধরে ধরে নিয়ে গেলেন বাক্সর কাছে- 'মাসিমা, এই কাগজটায় আপনার পছন্দমত চিহ্নে ছাপ মেরে...হ্যাঁ, এভাবে মুড়ে বাক্সে ফেলবেন। আমরা বাইরেই আছি, কোনও দরকার হলে ডাকবেন।' ঠাম্মা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন বাক্সের দিকে।

কিন্তু, একি! বুড়ী আগে গিয়েই ভোটবাক্সকে সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ করলেন। তারপর আঁচলের গিঁঠ খুলে বের করলেন সওয়া পাঁচ আনা পয়সা, ফুল বেলপাতা, চারটি দুর্বাঘাস, সিঁদুর আর বাতাসা। ভাল করে ভোটবাক্সে সিঁদুর মাখিয়ে তিনি ছাপমারা কাগজটি বাক্সে ফেললেন। তারপর নমস্কার করে মানত করলেন- 'হেই ভোটবাবা, ভোট তো দিল্যম। দেখো বাবা ইবারে যেন আমার সুদামের একটি ব্যাটা হয়'।
বলা বাহুল্য, হতভম্ব সেনবাবু আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন যখন যাবার আগে ঠাম্মা তাঁকে পুরুতের বরাদ্দ সোয়া-পাঁচ আনা দক্ষিণা হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন।

খেলা, আমি নেই।। কবিতা

খেলা।

পাখিটা বুনেছে বাসা গাছের কোটরে,
খড়কুটো, লতাগুল্ম এটা-ওটা ভরে
শিল্পশোভার কি অবাক নিদর্শন
দেখে মন শান্ত হয়ে থাকে কতক্ষণ?
...
চাকরকে পাঠালেম, গাছের উপরে
বাসাটা কোটর থেকে নিয়ে এল পেড়ে।
খানদুই ডিম ছিল, কী হবে তা দিয়ে!
দিই ফেলে, বাসাখানা যত্নে আসি নিয়ে।

বাবুই পাখির বাসা আমার দেয়ালে
শোভা পায়, আমি থাকি আপন খেয়ালে,
হরিণের ট্যাক্সিডার্মি, বাঘছাল খানা
আছে গজদন্ত বান্দীপুর হ'তে আনা।

এ খেলা সবাই খেলে সারা দুনিয়ায়
তোমার কষ্টে মোর কী বা আসে যায়!
তোমার প্রাণের চিন্তা, আমার দেয়ালা
চিরকাল ধরে চলে এ করুণ খেলা।


আমি নেই।

আমি নেই এ জগতে, ট্রামখানা চলে গেছে
চুকিয়ে তাহার ঋণ। কখন-
তা বলে তো থেমে নেই কিছু!
অবশ্য হয়েছে কিছু অদলবদল কিছু ইতরবিশেষ;
কার্তিক মাসের মাঠে মহীনের ঘোড়াগুলি
খেত ঘাস, আজ তারা নেই।
মহীন চালায় অটো উল্টোডাঙার রুটে-
ভুলে গেছে , আজকাল চেনে না আমাকে!
ধানসিঁড়ি কোথা কে বা জানে, মনে নেই,
জানি আছে ইছামতী-বিদ্যাধরী-হোগল-মাতলা।
শঙ্খচিল, সোনালি ডানার চিল-
নিশ্চিন্তে উড়ে করে এপার ওপার।
সন্ধ্যা নামে।
ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।
খেটে খাওয়া মজুরের দল বর্ডারের সেপাইকে প্রণামীটা দিয়ে ফেরে ঘর কাঁটাতার পারে,
পাশে আজ নেই কেউ। তবু ভাবি সেকি বসে আছে
নাটোরের আত্রাই নদীর তীরে? সব ভুল-
কেউ বসে নেই!

রাতের গাড়ি।। কবিতা

রাতের গাড়ি।।
পল্লব চট্টোপাধ্যায়

সশব্দে চলেছে রাতের গাড়ি
ঘুমিয়ে পড়া গ্রামগুলোর বুকের উপর দিয়ে,
নৈশ নিস্তব্ধতাকে খান খান করে।
মাঝে মাঝে কোন খালি প্লাটফর্মের ধারে...
দেখা যায় ছোট ছোট লাল ঘরবাড়ি,
জানি ওগুলোতে ইস্টিশনের বাবুরা থাকে
গার্ড-সায়েব, স্টেশন মাস্টার, টিকিট চেকার।
এখন ওগুলোকে দেখে মনটা খারাপ লাগছে,
ওদের পরিবার এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
দেখল না তারা আজ রাতের জগতটাকে।

হঠাৎ আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়ে,
নাকি অজানা গ্রহের থেকে আসা উড়ন্ত পিরিচ;
হয়ত কিছু এলিয়েন আছে তার মধ্যে।
তারাও আজ দু-চোখ ভরে দেখছে
ঘুমন্ত এই গ্রহের নিষ্পাপ সৌন্দর্য।
ওরা বুঝি নিজের বিশ্বে ফিরে জানাবে অন্যদের
এই পৃথিবীতে কত শান্তি, কত আনন্দ।
আমি তাকিয়ে থাকি রেলগাড়ির জানলা দিয়ে
আকণ্ঠ পান করি নিবিড় একাকীত্বকে।

কাল সকাল হলেই আবার মানব-মিছিল,
কল-কারখানার জঙ্গী ধোঁয়া, বাজারের শোরগোল
তখন আর মনে থাকবে না, স্বপ্ন মনে হবে,
আজ রাতে যেসব কথা ভেবে চলেছিলাম-
চিন্তা করে নিজেরই হাসি পাবে তখন।

ব্লাইন্ড-স্পট (অণুগল্প)


ব্লাইন্ড-স্পট 
 (অণুগল্প)

পুলককে ঠিক ভুলোমনা বা তালকানা কোনটাই হয়ত বলা ঠিক হবে না। তবে ওর একটা ভয়ংকর বদ স্বভাব হল জিনিষপত্র কোথায় রেখেছে প্রায়ই তা ভুলে যাওয়া। ক্লাস থ্রি-তে পড়া কিশলয়ের কবিতা কণ্ঠস্থ, কিন্তু আর্বিট্রেশনের জন্যে কন্ট্রাক্ট পড়ার দু-ঘন্টার মধ্যে তার বিবাদাস্পদ ক্লজগুলো ভুলে যেতে তার জুড়ি নেই। পুলক কর্পোরেট ল-ইয়ার। তাই ক্লায়েন্টদের নাম-ঠিকানা-কন্ট্রাক্টের ডিটেল, আইনের ধারা- কিছুই তার ভুললে চলে না। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

সঙ্গত কারণেই পুলকের বাড়ি তার অফিসেরই যেন এক্সটেন্সন। বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে কন্ট্রাক্ট আর সংশ্লিষ্ট ফাইলগুলি পড়ে বুঝে রাখতে হয়, পরদিন সকালেই হয়ত থাকবে আরবিট্রেশনের কেস। তার কর্পোরেট আইনের জ্ঞান আর বিবাদের কারণগুলো বিশ্লেষণের ক্ষমতার ফলে সে এখন রুস্তম অ্যান্ড জিজিভয় সলিসিটার ফার্মের একজন সিনিয়ার কনসাল্ট্যান্ট। কিন্তু মোটা মোটা ফাইলগুলোর কোন পাতায় কি আছে তা মনে রাখার জন্যে তাকে প্রচুর পরিমাণে হলুদ কাগজের স্টিকিং নোট ব্যবহার করতে হয়। অবশ্য এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, এ কাজ সবাই করে থাকে।

আশ্চর্যের কথা হল এটাই যে স্টিকিং নোটের গুচ্ছটা কোথায় রাখা আছে মাঝে মাঝে পুলক সেটাই খুঁজে পায়না। ইনস্যুরেন্সের ধারাটাতে চোখ রাখতে হবে, দুটো ভাইটাল পয়েন্ট আছে, কিন্তু মার্ক করবে কি দিয়ে, ইয়েলো স্টিকারের গোছাটা কই? খোঁজ, খোঁজ......নাঃ, কোত্থাও নেই। প্রিন্টারের উপরে কাগজপত্র ডাঁই হয়ে আছে, অন্ততঃ চারবার তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল সব। ক্লায়েন্টের কন্ট্রাক্টারের বিজনেস কার্ডটা হারিয়ে যাওয়ায় আরেকটা চেয়ে নেবে ভাবছিল পরের মিটিং-এ, সেটা হঠাৎ পেয়ে গেল বিছানার এক কোনায়, কিন্তু স্টিকারগুলো নেই।

- 'বারোটা বেজে গেছে, এবার তো শুয়ে পড়', অঙ্গনা তাড়া দেওয়া শুরু করেছে। রাগ হয়ে গেল পুলকের- নির্ঘাৎ ওর কাজ, সকালে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কোথাও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
- 'কোথায় রেখেছ বলত হলুদ স্টিকারগুলো, খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও?'- গজগজ করে উঠল পুলক।
- 'কোথায় আবার থাকবে, হয় ল্যাপটপের তলে, নয় প্রিন্টারের ওপরে- দেখেছ ওগুলো?'
- 'সব তিন-চারবার করে দেখা হয়ে গেছে'।
- 'তাহলে এটা কি?' বলতে বলতে প্রিন্টারের উপরে পুলকের চোখের সামনে থেকেই স্টিকারের গোছাটা উদ্ধার করে অঙ্গনা।

অপ্রতিভ পুলক। কিন্তু হার মানবার পাত্র নয় সে। ফিজিক্স পড়েছে স্কুলে। বলল, 'চোখের নার্ভগুলো যেখানে গোছা বেঁধে রেটিনার বাইরে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ে, সেই জায়গায় কোন কিছুর প্রতিবিম্ব পড়ে না। তাই সেটাকে বলে ব্লাইন্ড স্পট। ইয়েলো স্টিকারের গোছাটার ইমেজ নিশ্চয় আমার সেই ব্লাইন্ড স্পটে পড়েছিল, তাই দেখতে পাই নি।'
অঙ্গনা চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল দুজনে।

আপাততঃ তর্কে জিতে গেলেও একটু পরেই অনুতাপবোধ শুরু হল পুলকের। ছিঃ, অঙ্গনা যদি জানতে পারে যে মানুষ দুই চোখ দিয়ে দেখলে ব্লাইন্ড স্পটের কোনও প্রভাব থাকে না, আর পুলক তো আর কানা নয়। ভাবল একবার অন্ততঃ মুখ ফুটে স্যরি বলে দিই।
- 'বুঝলে অঙ্গনা, কথাটা না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না......'
- 'বুঝেছি, আর বলতে হবে না......তোমাকে ভগবান দুটো চোখ দিয়েছেন, মাথা একখানা আস্ত, আর......'
- 'আর কি?'
- 'হৃদয় মাত্র আধখানা।'
- 'তাহলে এসো, যদিদং হৃদয়ং তব-'
বাতি নিভে গেল। ওরা দুজনে ঘন হয়ে এল।

সকালে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল পুলকের। অঙ্গনা ঘরে ঢুকল। ওর এরই মধ্যে স্নান হয়ে গেছে, একটা বড় দেখে লাল টিপ পরেছে কপালে।
- 'অঙ্গনা', ডাকল পুলক।
- 'কি?'
- 'সত্যি হয় আমি অন্ধ ছিলাম, নয় আমি এক বিশাল ব্লাইন্ড স্পট নিয়ে জন্মেছিলাম। তাই জীবন-ভর এত আইনের বই দেখলাম, কন্ট্রাক্টের ফাইলের প্রতি পাতায় হলুদ কাগজ চেটালাম; শুধু-
- 'আবার কি?'

- 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া-
 বিছানা হইতে দুই পা ফেলিয়া
একটি লজ্জা-অরুণ কপালে
একটি সিঁদুর বিন্দু।'

বইমেলার গপ্পো-সপ্পো ।। চার বছর আগে


বইমেলার গপ্পো-সপ্পো ।। চার বছর আগে

কিভাবে জানিনা রোব্‌বার দুপুরে পৌঁছে গেলাম কলকাতা বইমেলায় । সাথে ছোটভাই শংকর ও খুদে ভাইপো- 'দেব'এর চাঁদের পাহাড় কিনতে চায় । 'মিলন মেলা' স্টপে নেবে দেখি ধুন্ধুমার কাণ্ড, বাইপাস থেকে সায়েন্স সিটি পর্যন্ত অজস্র বইয়ের ভীড়, মিনি বইমেলা বল্লেও কম বলা হয়- একশো টাকায় রামায়ণ-মহাভারত-বঙ্কিম-শরৎ, ত্রিশ টাকায় দেব, সিংহ ও কিলিমাঞ্জারোর ছবিসহ চাঁদের পাহাড়, কি নেই ? যা হোক, ভীড়... ঠেলে কোনমতে ভেতরে ঢোকা গেল ।

আমরা, অর্থাৎ মুম্বাইয়ের লোকেরা কলকাতা বইমেলার ব্যাপারে রীতিমতো গাঁইয়া । শুনেছিলাম, 'আগামীকাল'এ আমাদের রঞ্জনদার অনুগল্প বেরিয়েছে, ভাবলাম, অভীক দত্তর নাম করলেই কেউ দেখিয়ে দেবে । কে চেনে কাকে! যাক, ম্যাপ দেখে মোটামুটি সব খুঁজে পেলাম । 'চলো যাই' পেলাম, ভেবেছিলাম, দোলনচাঁপাকেও দেখতে পাব, ছিল না । ব্যস্ত মানুষ, না থাকাই স্বাভাবিক । খুঁজে খুঁজে রামকৃষ্ণদার 'দোতালা বাস...', অমিতাভর 'হাফ সেঞ্চুরি...' ও দোয়েলপাখি সম্পাদিত 'রসাতল'ও পেয়ে গেলাম ও কিনে ফেললাম একটা করে । ক্রমে ব্যাগ ভরে উঠল বইপত্তরে । ভাই এবার ফেরার তাড়া দিতে শুরু করল ।

'সাহিত্যম্‌'এর স্টলে শংকরের লেখা নতুন বই 'অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ' এককপি নিয়ে বেরোচ্ছি, একজন দেখে বললেন, 'ও মশাই, লেখক বসে আছেন স্টলের এককোনায়, বইতে সই করিয়ে নিতে পারেন । আমি দেখলাম, ভাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে । ভাবি ওকে ডেকে জানিয়ে দি- শংকর, শংকর বলে ডাক দিলাম । হঠাৎ দেখি আমার প্রিয় সাহিত্যিক বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে- 'আমায় ডাকছেন ?'
কি লজ্জা, এটা তো ভাবি নি । একটা প্রণাম করে বইখানা এগিয়ে দিলাম । উনি মৃদু হেসে সই করে দিলেন । গতবার শ্রী বুদ্ধদেব গুহকে পেয়েছিলাম, এটাই ছিল এবারের মেলায় আমার বিশেষ পাওনা ।

ফাদার ললারের গল্প।। প্রবন্ধ (রম্যরচনা)


ফাদার ললারের গল্প।।


(এক)

রাঁচীর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের খ্রীশ্চান অধ্য়াপকদের মধ্য়ে ১৯৭৪-৭৬ সালে চারজন আমাদের সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁরা হলেন জীবিতকালে কিংবদন্তী সম হিন্দী ও সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ডা: কামিল বুলকে, ইংরেজীর বিভাগাধ্য়ক্ষ ফাদার জি পি ললার, তৎকালীন প্রিন্সিপাল ফাদার ওয়াল্টার প্রুস্ট আর ফিজিক্সের অধ্য়াপক ফাদার সি ডি'ব্রাওয়ার। আমরা যখন পড়তে আসি, ফাদার বুলকে পড়ানো প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফাদার প্রুস্ট আর ডি'ব্রাউয়ারের কথা পরে বলা যাবে। এই মুহূর্তে একজনের কথাই বেশি মনে পড়ছে, তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, জন্মসূত্রে আইরিশ ফাদার জিপি ললার।

তখন তিনি প্রায় ৯৭। একটি মোপেড চালিয়ে সমস্ত রাঁচি চষে বেড়ান আর আদিবাসী-অধ্য়ুষিত জেলার গ্রামে-গঞ্জে কুসংস্কারের ভূত ভাগান। মাঝে মাঝে আমাদের ইংরেজি টিউটোরিয়াল ক্লাশ নেন, যার উদ্দেশ্য় হল কোর্স শেষ করা নয় (তার জন্য়ে তো প্রফেসার বগলা চক্রবর্তী, কুজুর আর প্রাণনাথ পণ্ডিত আছেনই), বরং একটি বিদেশী ভাষা থেকে আমাদের ভয়ের ভূত ভাগানো। এর পরে যেটুকু সময় থাকে তিনি ইংলিশ লাইব্রেরিতেই বসে কাটান।

তখনকার দিনে এমন অলিতে গলিতে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিলনা, আর থাকলেও সেগুলোর খরচা আমাদের অভিভাবকদের সীমিত সাধ্যের বাইরে ছিল। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিই, মাতৃভাষা-মাধ্যমের স্কুলগুলো কিন্তু ফ্যালনা ছিল না, সেখানকার শিক্ষকরাও আমাদের 
সাধ্যমত যত্ন নিয়ে পড়াতেন। তবু বলতে দ্বিধা নেই, আমরা বিদেশি ভাষা বলে ইংরেজিতে ছিলাম যথারীতি কাঁচা। অতএব আমাদের মাথা থেকে এই ভয়ের ভূত ভাগানোর কাজটা এই ঋষিতুল্য বৃদ্ধ ভালই করতেন। মূলতঃ তাঁর প্রচেষ্টায় সেন্ট জেভিয়ার্সে একটা ইংরেজি সাহিত্যের লাইব্রেরি খোলা হয়েছিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থাকা সত্বেও। নিয়ম করা হয়েছিল যেন প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেকে অন্ততঃ একটা করে বই পড়ে। প্রতি সপ্তাহে একটা! তাই কি পারা যায়? তা হলেও মাঝে মাঝে লাইব্রেরি গিয়ে দু-একটা বই ইস্য়ু করিয়ে নিয়ে এসেছি।

একদিন ওখানে বইয়ের লিস্টে দেখি একটা চেনা নাম- ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর লেখা রিপ ভ্য়ান উইংকেল। মনে পড়ল খুব ছোটবেলায় দাদুর কাছে গল্পটা শুনেছিলাম। কী যেন গল্পটা, ঠিক মনে করতে না পেরে বইটা ইস্যু করিয়ে নিয়ে এলাম। তারপর বইটা নিয়ে এসে পড়ার পর একদিন ওটা আমার হোস্টেলের রুম থেকে চুরি হয়ে গেল না হারিয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি এবার ভয়ে আর ইংরেজি লাইব্রেরি যেতে পারছি না, ফাদার মারাত্মক বকবেন, ফাইন করবেন-পয়সা কোথায় যে ফাইন দেব?

তবু একদিন যেতে হল। ফাদার আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে আমার নামের ইস্য়ুর লিস্ট দেখতে লাগলেন। 'চারমাসে চারটে বই? ট্য়ুটোরিয়ালের ক্লাস আছে এখন, চল সেখানে কথা হবে।' আমি ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালাম।


(দুই)
ফাদার ললারের ক্লাসে আসার আগে তাঁর পড়ানোর কায়দা নিয়ে দুটো কথা না বলে নিলে আমার এই প্রসঙ্গের কোনও মানেই থাকে না। তাই বরং ঘুরে আসা যাক তাঁর ট্যুটোরিয়ালের এক ক্লাসরুমে, তিনি পড়াচ্ছেন ওয়ার্ডসোয়ার্থের সলিটারি রীপার।

- 'Behold her' কথাটার মানে কে বলতে পারবে।
- 'See her, father' একজন বলে উঠল।
- তাহলে তো 'সী' লিখলেই চলত, নয় কি? এত কষ্ট করে 'বিহোল্ড' লেখার কি প্রয়োজন ছিল?...
সেদিন জানা গেল, রোমান্টিসিজমের অমর কবি স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ড অঞ্চল দিয়ে যেতে যেতে একটি মেয়েকে ফসল কাটতে কাটতে আপন মনে গাইতে দেখে তাঁকে দু-চোখ দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
- আচ্ছা তোমরা রোম্যান্টিক কথাটার অর্থ জান?
- আর্ট, কালচার, সাহিত্য আর সঙ্গীত মিলেমিশে ১৭ থেকে ১৯ শতকের এলিটরা ইয়ুরোপে একটা বৈপ্লবিক যুগ নিয়ে এসেছিল। সেটাই মনে হয় রোম্যান্টিসিজম?- একটি চশমা পরা মেয়ে উত্তর দিল।
- তোমার কথার প্রতিবাদ করবনা, ইয়ং লেডি! তবে ওয়ার্ডসোয়ার্থের রোম্যান্টিক দুনিয়া মূলতঃ মানুষ আর প্রকৃতিকে নিয়ে। তিনি সরলমনে কোথাও প্রকৃতির পার্সনিফিকেশন করেছেন আবার কোথাও বা মানুষের তুলনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে করেছেন, যেমন- 'I wandered lonely as a cloud'।
এরপর প্রসঙ্গ ধরে চলে আসত personification কথাটার অর্থ, কিভাবে প্রাকৃতিক জড়পদার্থ, গাছপালা, এমনকি মানসিক অবস্থার মত নির্ব্যক্তিক ভাবও কবির কল্পনায় চেতনা পায়। অথবা হাওয়ার দোলায় নেচে চলা প্রান্তরব্যাপী ফুটে থাকা ড্যাফোডিল বা কখনও রামধনুর সৌন্দর্য দেখে নেচে ওঠা কবির হৃদয়-
"Getting and spending we lay waste our powers,
Little we see in Nature that is ours."

এই প্রকৃতিকে, এই পার্থিব সৌন্দর্যকে, এই  জীবনটাকে ঠিকমত উপভোগ করার জন্যে সত্তর বছরের জীবনটাও যেন বড় কম- কে বলেছিলেন বল ত?

কে জানে? একটি কুড়ি বছর বয়সী কিশোর কবির উপলব্ধি, ফাদার নিজের মনেই যেন বললেন-
"Now, of my threescore years and ten,
Twenty will not come again,
And take from seventy springs a score,
It only leaves me fifty more.
And since to look at things in bloom
Fifty springs are little room..."
হাউস্ম্যানের কবিতা, দি চেরী ট্রী। কাল পড়াব। আমার বয়স সাতানব্বই হয়ে গেল, এখনও কত কি দেখতে বাকি।

'হায়, জীবন এত ছোট ক্যানে!'
(তিন)

আগের ঘটনার সূত্র ধরেই বলছি, পরের দিন যথারীতি ফাদার ললারের ট্য়ুটোরিয়াল ক্লাসে এসেছি। ফাদার দেখি আগে থেকেই ক্লাসরুমে এসে ব্ল্য়াকবোর্ডে দাঁড়িয়ে কী যেন করছেন। তারপর একটু সরে দাঁড়াতেই আমরা চমৎকৃত, দেখি হালকা আসমানী পশ্চাৎপটের ওপর দক্ষ হাতে আঁকা হয়েছে থোকা থোকা সাদা ফুলে শোভিত একটি চেরী গাছ। ফুলগুলোতে একটা হাল্কা গোলাপী আভা জানিনা কিভাবে এনেছেন তিনি, নাকি তা শুধু আমাদের কল্পনা? গাছভর্তি ফুল, তাছাড়া মাটিতে ঝরে পড়ে আছে আরো কত, বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি যেন।

- ওয়েল, আমার প্রিয় বন্ধুরা, আমি চেরী গাছের উদ্দেশ্য়ে লেখা হাউসম্য়ানের এই কবিতাটি পড়াব না, কারণ পড়ানোটা আমার ঠিক আসে না। শুধু তোমরা বল, এই ছবিটা দেখে কী মনে হচ্ছে তোমাদের?
- ছবিটা খুব সুন্দর আর খুব রিয়েল, আমি অনেক কষ্ট করে বললাম।
- আর কিছু?
- It is showing life in one hand and death in the other, কারণ কিছু ফুল ফুটে আছে আর কিছু ঝরে পড়েছে, প্রদীপ জানাল।
এবার মনে হয় হয় ফাদার একটু খুশী হলেন।
- ঠিক বলেছ। খুব সুন্দর ফুল, চীনদেশে একে নারী আর সৌন্দর্যের প্রতীক মনে করা হয়। তবে তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে এই ফুলের আয়ু খুবই কম, মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহ। জাপানে এই ফুলকে বলা হয় সাকুরা, সৌন্দর্য, আয়ূর স্বল্পতা, গৌরবময় মৃত্য়ু- সৈনিকের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্য়ু, যাকে তারা 'বুশিদো' (The way of the warrior) বলে আর হল পুনর্জন্মের সিম্বল- সব একসঙ্গে।

- না, আর কিছু বলব না, বেশী বোঝালে আবার তোমাদের নিজেদের চিন্তাধারাটা তৈরি হয়ে উঠবে না। এই বলে ফাদার ব্ল্য়াকবোর্ডের উপর একটা কথা লিখলেন ইংরেজি অক্ষরে- 'Carpe diem' (seize the day)। তারপর ছাত্রদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন- হাউসম্য়ান তেয়াত্তর বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু নিজেকে কোনদিন কবি বলে মনে করেননি, তাই তাঁর কবিতা বিশ্বের লোক বহুদিন পরে জানতে পেরেছে। আমি জানিনা তিনি এই কাজটা ভাল করেছিলেন কিনা- বলে কারো কাছে কোন উত্তরের প্রত্য়াশা না করে ফাদার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে।

A.E. Housman-এর বহুদিন পরে, তারাশঙ্কর তাঁর কবি উপন্য়াসের নিতাই কবিয়ালকে দিয়ে একই কথা বলিয়েছেন-
'ভালবেসে সাধ মিটিল না এ জীবনে,
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?'

ল্য়াটিন ফ্রেজ Carpe diem-এর অর্থ পরে জেনেছিলাম- get everything you can out of today, because you may not be here tomorrow."
কী আশ্চর্য, কয়েকবছর আগে করণ জোহরের হিন্দি ছবি 'কাল হো না হো' তে ঠিক একইরকম একটা গান শুনলাম।
"হর ঘড়ি বদল রহী হ্যায় রূপ জিন্দগী
ছাওঁ হ্যায় কহীঁ কহীঁ হ্যায় ধূপ জিন্দগী
হর পল ইয়াহাঁ জী ভর জিও
জো হ্যায় সমাঁ, কাল হো না হো!"
(চার)

বলতে শুরু করেছিলাম বই হারানোর শাস্তির কথা, কিসের থেকে কোন কথায় চলে এলাম! এখন তো আবার রীতিমত সন্দেহ হচ্ছে এত কথা তখন ফাদার ললার বলেছিলেন কিনা। আমি আজ বুঝি সব বানিয়ে বানিয়ে লিখছি, বা হয়ত ফাদারের আত্মা তাঁর না বলা বাণী আমার হাত দিয়ে সাজিয়ে যাচ্ছেন। যাই হোক, তাঁর পড়ানোর কথা বলেছি, এবার না পড়ানোর প্রসঙ্গে আসি।
সেদিনকার টিউটোরিয়ালে 'মার্থা' পড়ানোর কথা। উনি হঠাৎ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন- 'আচ্ছা তোমাদের মনে হয় না, যে মেয়ারের এই কবিতাটিতে বিষয়বস্তু অতি সরল, বোঝার কিছুই নেই; তাহলে এটাকে ইন্টারমিডিয়েটের কোর্সে কেন রাখা হল?' ভেবে দেখলাম, সত্য়িই তো, একটি মেয়ে গল্প বলে চলেছে আর কয়েকটি শিশু তাকে ঘিরে বসে শুনছে, এর মধ্য়ে কী এমন গভীরত্ব আছে যে আমাদিগকে আজ পড়তে হচ্ছে?

- ঠিক আছে, আর ভাবতে হবে না। আমি পড়ছি, তোমরা শুনে যাও শুধু, তাহলেই বুঝতে পারবে। বললেন বটে, কিন্তু না পড়ে তিনি বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর কয়েকটি দক্ষ আঁচড়ে দ্রুত ফুটিয়ে তুললেন একটি ছবি। একটি যুবতী মেয়ে কিছু গাছের ছায়ায় দুই হাত দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে, আর কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে শুয়ে-বসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে- বোঝাই যাচ্ছে যে গল্পবলার আসর চলছে। 'এই হল মার্থা, আর এই শিশুদের মধ্য়ে একজন হল ওয়াল্টার নিজেই- তার মানে এটা বুঝি একটা বাল্য়ের স্মৃতিচারণ। হয়ত এরই মাঝে নিহিত আছে মেয়ারের কবি হয়ে ওঠার প্রেরণাটুকু। এটা তো তাহলে তাঁর জীবনদর্শনের একটা অঙ্গ, তাই না? কবির বড় হয়ে ওঠার মধ্যেই যে তাঁর জীবনের কবিতা, তার আবেগটুকু ফুটে ওঠে তা তো তোমরা মান, না কি? '

'কিন্তু কবি তাঁর নিজের দর্শন পাঠকের মনের মধ্য়ে সঞ্চারিত করবেন কেন? তাঁর কাজ হল পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজের আনন্দের, অভিজ্ঞতার, সুখ-দু:খের ভাগ দেওয়া। তা কি তিনি করেছেন? 'Poetry, good or bad, depends for it's very life on the hospitable readers, as tinder awaits the spark'- এই কথাটা স্বয়ং মেয়ারের।'

আমরা আর কী বলব। মেয়ার যে তাঁর উদ্দেশ্য়ে একশোভাগ সফল তার প্রমাণ তো আমাদের চোখের সামনে- ঐ ছবি। ফাদার একটা কথা বলেছিলেন- picturesque। আমার চোখের সামনে তখন ভাসছে অন্য় একটা ছবি, রবীন্দ্রনাথের একটা গান-
"চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়,
উড়ে উড়ে যায় পাখি,
সারা দিন ধরে বকুলের ফুল
ঝরে পড়ে থাকি থাকি।"

একটি মেয়ে জানলার পাশে বসে আনমনে কী যেন ভেবে চলেছে। হাতের উপরে রেখেছে সে তার মাথাখানি, 'কোলে ফুল পড়ে রয়েছে সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা'। গান তো নয়, একটা নিখুঁত ছবি! কী বলব একে বাংলায়, চিত্রানুগ না চিত্রকল্প?


(পাঁচ)

নয় নয় করেও অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। ফাদার ললার কিন্তু একদম জ্ঞান দিতেন না। ওনার প্রশ্ন করার ধরণ শুনলে মনে হত, কোথায় যেন আটকে গেছেন, কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, কেউ একটু সাহায্য় করলে ভাল হত। এর পর আর কে উৎসাহিত না হয়ে থাকতে পারে?

সেদিনও ঠিক তাই হল। আমাকে দেখে উনি যেন হঠাৎই মনে পড়েছে এভাবে বললেন-'আচ্ছা রেজিস্টারে দেখলাম তুমি সেদিন রিপ ভ্য়ান উইঙ্কেল বইটা নিয়েছিলে। বইটা কি নিয়ে একটু বলতে পার?'
- ফাদার, গল্পে আছে রিপ ভ্য়ান নামে এক ভদ্রলোক নিউইয়র্কের কাছে একটা পাহাড়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সে ঘুম তাঁর ভাঙে ঠিক কুড়ি বছর পরে।
- আচ্ছা, আর কে পড়েছে বইটা?
- আমি পড়েছি, ফাদার, প্রিয়তোষ হাত তুলল।
- আর কেউ?
- আমি গল্পটা ছোট করে পড়েছিলাম, আমাদের নাইনের rapid-এ ছিল- প্রদীপ হাত তুলল। ওদের নেতারহাট স্কুলে অনেক বই পড়ানো হত যা আমাদের জানা থাকতো না।
- আচ্ছা, টোয়েন্টি ইয়ার ঘুমিয়েছিল- এটা কি সত্য়ি হতে পারে? কেমন গল্প এটা?

এবার ওই চশমা পরা মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। এতদিনে জেনেছি, ওর নাম সুষমা, 'ফাদার, আমি বলি?'
- হ্য়াঁ, নিশ্চয় বলবে। দেখছনা, আমরা কেউ পারছি না।
- আসলে গল্পটা একটা রূপক- ডায়নামিক মেটাফর বলা যেতে পারে। ওই কুড়ি বছরের মধ্য়ে আমেরিকান বিপ্লব ঘটে গেছিল। ১৭৬৫ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্য়ে হয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতার লড়াই। আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে ১৭৭৪ সালে, রিপ ভ্য়ান তখনও ঘুমিয়ে।
- বা:, সুন্দর বলেছ তো! এসব কি বইতে লেখা আছে?
- না ফাদার, বোধহয় নেই।
- তাইত! তাহলে কথাটা কিভাবে জানা গেল? প্রিয়তোষ জান?
- ফাদার, বাড়িতে ফিরে এসে রিপ দেখল ছবিটা বদলে গেছে- প্রিয়তোষ বলে।
আমি তাই শুনে উৎসাহিত হয়ে বললাম, 'হ্য়াঁ, ফাদার, কিং জর্জ থার্ড বদলে জর্জ ওয়াশিংটন হয়ে গেছে'।
- তাহলে 'The Sketch Book of Geoffrey Crayon, Gent' বইটা কোথায় গেল? কে কে বলতে পারবে?
প্রদীপ আর সুষমা, মানে ঐ চশমা পরা মেয়েটি হাত তুলল।
- ঠিক আছে, তবে আমি যা জানি বলি, ফাদার বললেন। ওই বইটার কথা প্রিফেসে ছিল, দু:খের বিষয়, আমাদের লাইব্রেরিতে রাখা কপিতে সেই পাতাটাই নেই।

পরদিন ফাদার আমাকে লাইব্রেরিতে ডেকে পাঠালেন। 'চোর ধরা পড়েছে- সে নিজে এসে বই ফেরৎ দিয়ে গেছে', বলে ফাদার আমাকে একত্রে চার-চারটে বই গছিয়ে দিলেন।
- কম বই পড়ার শাস্তি! এগুলো সময়ে পড়ে ফেরৎ দিতে হবে। আর যেন চুরি না হয়।

বলা বাহুল্য়, আমরা বুঝলেও ফাদার নিজে একবারও বই-চোরের নামটা প্রকাশ্য়ে আনেন নি।

ফাদার ললার অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন ১৯৮০রও আগে। শেষ গেছেন ভ্যান ডি'বল্ডি ও ডি'ব্রাওয়ার, আজ আর রাঁচীর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে কোন শ্বেতাঙ্গ প্রফেসার নেই। বলছি না যে আমাদের এদেশি অধ্যাপকরা তাঁদের থেকে কোন অংশে কম, কিন্তু সুদূর আয়ার্ল্যান্ড বা বেলজিয়াম থেকে এসে এ দেশকে ভালবেসে, এখানকার অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলোকে আপন করে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন যাঁরা, তাঁদের একেবারে ভুলে যাওয়াও কি এতই সহজ?

(শেষ)
মনের মণিকোঠা থেকে ।।১১।।


অগ্রজপ্রতিম সুজন দাশগুপ্ত মানুষ চেনা বা না চিনতে পারা নিয়ে নিজের জীবনের একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করেছেন সেদিন। আমারও বয়স হচ্ছে, সুতরাং এরকম দুয়েকটা ঘটতেই থাকবে। তবে সুজন আর ক'জন হয়? আমার একদিনের দুটো ঘটনা মনে পড়ল- চার দশক আগেকার, তবে একটু অন্যধরণের।
১৯৭৭ সালের অক্টোবর। পুজোর ছুটিতে আমেদাবাদ গেছিলাম কাকার কাছে। এক রবিবার গুজরাট স্টেডিয়ামে গেছি ওঁর সঙ্গে, উদ্দেশ্য কিছু খেলা দেখা। সেদিন ছিল স্টেট ব্যাঙ্কের ন্যাশনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার শেষ দিন। পূর্বাঞ্চল বনাম পশ্চিমাঞ্চল। আমাদের দেশে জাতীয় টিম নিয়ে যা উন্মাদনা তার শতাংশও ছিল না সেখানে, তবু দেখলাম পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ধীরাজ পরসানাকে, রামনাথ পার্কারও ছিলেন, অজিত ওয়াদেকার তখন টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছেন, তবু কেন জানিনা ছিলেন দেশের বাইরে। মাঠ ফাঁকা, পূর্বাঞ্চলের টেন্টে কাকা আমাকে বসিয়ে পাশের স্টেডিয়ামে কি চলছে তার খোঁজ নিতে গেলেন। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম সুব্রত গুহর সঙ্গে, নিতান্ত বালক হলেও বাঙালি দেখে খুশিই হলেন। গোপাল বোস ব্যাটিং করছিলেন, তপনজ্যোতি ব্যানার্জি অটোগ্রাফ দিলেন। ইতিমধ্যে ওঁদের ক্যাপ্টেন আউট হয়ে প্যাভেলিয়ানে ফিরলেন। 'জানো উনি কে? সুবিমল গোস্বামী', তপনজ্যোতি বললেন। আমি তেমন গা করলাম না। কিছুক্ষণ পরে কাকা এসে বললেন, 'কি রে, আমাদের পূর্বাঞ্চলের ক্যাপ্টেনের খেলা কেমন লাগল?'
'আচ্ছা কাকা, অম্বর রায়, গোপাল বোস থাকতে কে একজন সুবিমলকে ক্যাপ্টেন করা হল কেন? অবশ্য ভালই খেলেন ভদ্রলোক।' আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কাকা হাঁ। 'সে কি রে! তুই চুনী গোস্বামীকে চিনতে পারলি না? সুবিমলেরই ডাক নাম চুনী।'
চিনব কোত্থেকে! তখন কি টিভি কমেন্ট্রি ছিল? আর খবরের কাগজের ছবিতে তো সবাই সমান।

কাকার ইন্টারেস্ট ছিল টেনিসে, নিজে খেলতেনও নিয়মিত। পাশের মাঠে চলছে জুনিয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপ, মেয়ে-পুরুষ দু-দলেরই। মেয়েদের খেলা দেখছি। তখনকার দিনে আজকের সানিয়া মির্জার ধারে-কাছে ঘেঁসার মত কোন মেয়ে ছিলনা ভারতের টেনিস-দুনিয়ায়। ফলে যা ফাইনাল খেলা হচ্ছিল, আজকের বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েরাও তা দেখে হাসবে। উঁচু-উঁচু লব, ভলি নেই, স্ম্যাশ নেই- খুব মজা পাচ্ছে সবাই। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি নন্দন বল আর রমেশ কৃষ্ণন- তখন জুনিয়ার টেনিসে ভারতের দুই ও এক নম্বর যথাক্রমে, খুব হাসছে দুজনে। কিছুক্ষণ পরেই ফাইনাল খেলবে ওরা, সাধারণ পোষাকেই ঘোরাফেরা করছে।
এত ঠাট্টা-ইয়ার্কি এক বয়স্ক ভদ্রলোক ঠিক সহ্য করতে পারছিলেন না। উনি রমেশকে ডেকে বললেন, 'মাই বয়, টেনিস খেলাটা যদি শিখতে, তাহলে বুঝতে এটা কত কঠিন খেলা- এভাবে হাসতে না!'

অপ্রত্যাশিত অভিযোগে রমেশ তো হতভম্ব। এদিকে তাকিয়ে দেখি আমার কাকা এবং আরো কয়েকজন ভদ্রলোক আর কিছুতেই হাসি থামাতে পারছেন না।

মনের মণিকোঠা থেকে ।।১০।।

মনের মণিকোঠা থেকে ।।১০।।


 আমাদের ক্লাসের শংকরের কথা মনে আছে? শংকর সিংহ, যে আমাদের শিক্ষক- ছাত্র থেকে দারোয়ান- ফুচকাওয়ালা, সবাইকে তার আনপ্রেডিক্টেব্‌ল্‌ উইট দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। ইতিমধ্যে তার চার-পাঁচটি গল্প বন্ধুদের মধ্যে প্রচার করেছি, তারপর পেলাম অবাক করা প্রতিক্রিয়া! বন্ধু-অবন্ধু নির্বিশেষে সবাই খোঁজ পেতে চায় শংকরের, কোথায় আছে, কী করছে ইত্যাদি। ওদের তিনবন্ধুদের মধ্যে শুধু জিতুকে দেখি এখনও স...েই পুরোনো শহরেই বাঁশ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে, মানে ঐ বাঁশ ভাড়া, মণ্ডপ তৈরি ইত্যাদির ব্যবসা করছে আর কী। তপন চ্যাটার্জির কোন সন্ধান নেই।
তারপর যেন মিরাকল ঘটে গেল। একদিন সিন্দ্রি থেকে পিকুদা জানালেন শংকরের সন্ধান পাওয়া গেছে, তারপর রঘুনাথপুর থেকে সুবীর জানাল সে নাকি এখন দুর্গাপুরে থাকে আর পরের দিনই দুর্গাপুর থেকে অরুণ জানাল ওর ফোন নম্বর। আশ্চর্য ব্যাপার শংকরের মত মহাপুরুষ গত দশ বছর ধরে দুর্গাপুরে, অথচ ওরা কেউ জানে না। অবশ্য একটা গাইগার কাউন্টার থাকলেই ঠিক জানা যেত, তেজস্ক্রিয়তাকে তো আর খড় চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় না!
অতএব এবার আমার সঙ্গেও পুনঃ যোগাযোগ হল। তারপর কিভাবে জানি না হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল যে আমাদের এক পুরনো বন্ধুর ছেলের বিয়ের বউভাতে আমরা সিন্দ্রি যাব, আমরা মানে আমি, অরুণ, দীপংকর, অনির্বাণ আর শংকর। দীপংকর গাড়িতে পেট্রল ভরিয়ে নিয়ে এল।

নাঃ, এ শংকরকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। যার সম্বন্ধে স্বয়ং হরিদাস স্যার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে সে হয় আইনস্টাইন নয় হাজি মস্তান হবে- সে কিনা একটা সদাগরি কোম্পানীর ম্যানেজার! জানিনা কোন গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে সে কিনা একদম ভালমানুষ বনে গেছে, অর্থাৎ কাপ্তানির 'ক' নেই, মুখে খিস্তির 'খ' নেই, গোঁয়ার্তুমির 'গ' নেই, সব যেন ঘেঁটেঘুঁটে 'ঘ' হয়ে গেছে! অরুণকে চিরকাল ভদ্র-ভালমানুষ বলেই জানি, সেও কিছুটা মুখখারাপ করে ওকে তাতাবার চেষ্টা করল, সব বৃথা। শেষে আমি ভাবলাম, কিছু পুরনো স্মৃতি উস্কে দিই, বললাম, হ্যাঁরে, তপনের কোনও খবর জানিস?
শংকর কেমন যেন চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তাই তো! আমাদের মাণিকজোড় বলত লোকে, সেই তপনটা কোথায় হারিয়ে গেল? জানিস, আজ চল্লিশ বছর ধরে অনেক খোঁজ করেছি ওর, কিন্তু কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারেনি।
'আমি তো ওকে কাগজ বিক্রি থেকে জলের কল সারাই পর্যন্ত করতে দেখেছি একসময়' আমি বললাম, 'তারপর কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল ছেলেটা।' অবশ্য জব্বলপুর স্টেশনে পাঁউরুটি-ওমলেট বিক্রি করত যে ছেলেটি তার প্রসঙ্গ আর তুললাম না, কারণ তার নাম তপন হলেও সে যে আমাদের তপন নয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত এখন।

এরপর যখন আমরা পাঁচজনে পৌঁছলাম আমাদের ছোটবেলার সেই পুরনো শহরে, আমাদের শৈশবের লীলাভূমি আর যৌবনের উপবনে (না, বার্ধক্যের বারাণসী আর বানাতে চাইনা তাকে), পলাশ-কৃষ্ণচূড়া কুঁড়ি, আমের মুকুল আর মহুল ফুলের মাতালকরা গন্ধ আমাদের আবার যেন ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই হারানো বাল্যকালের দিনগুলোতে।

'তোদের ঘোঁচুকে মনে আছে?'- শংকর যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই এবার মুখ খুলল। বৌভাতের বাড়িতে পেট পুরে খেয়ে কাছেই গেস্ট হাউসে শুতে এসে জমেছে আড্ডা- শংকরের কথায় সবাই নড়েচড়ে বসলাম।


'ঘোঁচু?' দীপংকর অবাক। 'এরকম নামের কাউকে তো মনে পড়ছে না।'
'ঝোড়ো কাকের ডানার মত উস্কো-খুস্কো চুল, কাদাখোঁচা পাখির মত চেহারা, হাসি-হাসি শয়তানী চাউনি- চেহারাটা মনে পড়ছে', আমি বললাম, 'আরে ওর নামও তো তপন'।
'হ্যাঁ, তপন মণ্ডল। তবে ওর আসল নামটা খুব কম ছেলেই জানত, ঘোঁচু নামেই বিখ্যাত ছিল। ও দেখি ক'দিন ধরে তপনা মানে তপন চ্যাটার্জির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, এদিকে আমাকে কিন্তু এড়িয়ে চলছে।... ভাবলাম ব্যাপারটা কি জানতে হচ্ছে, জিতুকে বললাম একটু গোয়েন্দাগিরি করতে।'
'তারপর?' আমাদের সমবেত প্রশ্ন, 'কি জানা গেল?'
'আর বলিস না, সে ভীষণ কাণ্ড! উড়নচন্ডী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার প্রতিপত্তি ঘোঁচুর ঠিক সহ্য হচ্ছে না। ওর ধারণা, আমাকে ছেড়ে ওর তাঁবেদারি করলে জিতেন, অশোক, তপন, অজয় সবাই লাভবান হবে, কম পড়ে বেশি নম্বর পাবে আর বেশি দুষ্টুমি করেও কম শাস্তি হবে। গোপনে সেটা আবার সবাইকে বুঝিয়েও ফেলেছে।'
'আমি আর কিছু বললাম না। ভান করলাম যেন ওর লীডারশিপ মেনে নিয়েছি।'
এবার শংকরের ওপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে চোখের কোনা দিয়ে ঝলকানো সেই চিরপরিচিত পাগলা-দাশুমার্কা হাসিটা দেখতে পেলাম। আন্দাজ করলাম কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে।

'আচ্ছা, অশোককে তো রাস্টিকেট করা হয়েছিল কী একটা মারপিটের চক্করে। তোর সাথেও ত ওর হেব্বি মারপিট হয়েছিল', দীপংকর বলল, 'ও তোর গ্রুপে ঢুকল কিভাবে?' ওর মন থেকে ধন্দ দূর হয় না।
'দ্যাখ গুরু, ওয়ান স্টোরি অ্যাট এ টাইম। একজন সমস্ত ঘটনাগুলো মনে মনে নোট করে চলেছে, ওকে কনফিউজ করা চলবে না।' শংকর বলে চলে। 'আমি তপনকে বললাম, কি রে, আমাকে ছেড়ে দিলি?'
'গুরু, ঘো-ঘো-ঘোঁচুর না হেভি বুদ্ধি! ব-ব্বলে, ফারস্ট আর শেষ পিরিয়ডে রোল কল হয়- আমরা তার মধ্যে ক-ক্ক-কল্পনায় গিয়ে একটা মর্নিং-শোও দে-দ্দেখে আসতে পারি।- জানিস বোধহয়, তপনা একটু তোৎলাতো। তা আমি বললাম, কে-ওয়ানে আমার কাকার বাড়িতে যা পেয়ারা হয়েছে না! কাল আয় না ঘোঁচুটাকে নিয়ে।'
'তপনা তো খুব খুশি। পরের দিন তিনজনে আমরা সেকেন্ড পিরিয়ডে কাট মারলাম।'

'আমরা মিনিট পনেরো হেঁটে কে-ওয়ান পাড়ায় একটা বাগান-ঘেরা বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির পেছনদিকের বাগানে দেখা যাচ্ছে গোছা-গোছা ডাঁশা পেয়ারা ঝুলছে। একটা আম গাছে বিস্তর পাকা আম। এতক্ষণে ঘোঁচুর মনে আমার উপরে একটু শ্রদ্ধা জেগেছে মনে হল। বলল, হ্যাঁরে, তোর কাকা কিছু বলবে না যদি পেয়ারা পাড়ি? আমি বললাম, দূর ওদের বাড়িতে খাবারই লোক নেই- পাখিতেই খায় সব। যা তোরা চুপিচুপি গাছে উঠে পড়- কাকা নাইট ড্যুটি করে ঘুমোচ্ছে বোধহয়, আমি একবার কাকিমার সঙ্গে কথা বলে আসি।'
'তারপর ওদেরকে গাছে উঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি দরজার কড়া নাড়লাম। কৌন বা- এ রামগিধৌড়োয়া, তনি কেওয়াড়িয়া খোল হো! ভোজপুরি ভদ্রলোক দরজা খুলতেই আমি খুব ইনোসেন্ট মুখ করে বললাম- চাচাজি, পিছোয়াড়ে পে দোঠো লাইকা আমরুদ তোড়ল......হাঁ, সচ !'

'তারপর?' আমরা চারজনেই উদগ্রীব।
'তারপর তিনদিন পরে দেখা তপনার সঙ্গে। মাথায় ব্যান্ডেজ। আরও দুদিন পরে ঘোঁচু স্কুল এল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। ক্লাসে চিঠি দিল বাথরুমে পড়ে পা মচকেছিল।'

'কি বে তুই? নিজের বন্ধুদের সঙ্গে এরকম গদ্দারি করলি!' অনির্বান এতটাও নিতে রাজী নয়। 'এরপরে বল আর দোস্তি থাকে?'
'তোরা কিছুই বুঝিস না এসবের' শংকর বলে। 'উলটে ঘোঁচুও এর পর থেকে আমার দলে পার্মানেন্ট হয়ে গেল। আরে ইয়ার, হীরের বদলে কাঁচের আংটি পরলে চোখ ধাঁধায় কম, আঙুল কাটে বেশি!' কথাটা মানতেই হল।

'হ্যাঁরে শংকর, তুই বিভূতি মুখার্জির 'বরযাত্রী' পড়েছিস?' আমার এদের গল্প শুনে কেন জানিনা গণশা আর ঘোঁৎনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
'না না, ওসব পড়িনি। পড়ার বইয়ের আধখানার বাইরে কোনদিনই কিছু পড়িনি- অবশ্য এখন রোজ গুরুমন্ত্র পড়ি।'
বোঝা গেল, এমনি এমনিই গল্প লেখা যায় না- শংকরের মত একজন 'হিরো' না পেলে!