মনের মণিকোঠা থেকে ।।১০।।
আমাদের ক্লাসের শংকরের কথা মনে আছে? শংকর সিংহ, যে আমাদের শিক্ষক- ছাত্র থেকে দারোয়ান- ফুচকাওয়ালা, সবাইকে তার আনপ্রেডিক্টেব্ল্ উইট দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। ইতিমধ্যে তার চার-পাঁচটি গল্প বন্ধুদের মধ্যে প্রচার করেছি, তারপর পেলাম অবাক করা প্রতিক্রিয়া! বন্ধু-অবন্ধু নির্বিশেষে সবাই খোঁজ পেতে চায় শংকরের, কোথায় আছে, কী করছে ইত্যাদি। ওদের তিনবন্ধুদের মধ্যে শুধু জিতুকে দেখি এখনও স...েই পুরোনো শহরেই বাঁশ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে, মানে ঐ বাঁশ ভাড়া, মণ্ডপ তৈরি ইত্যাদির ব্যবসা করছে আর কী। তপন চ্যাটার্জির কোন সন্ধান নেই।
তারপর যেন মিরাকল ঘটে গেল। একদিন সিন্দ্রি থেকে পিকুদা জানালেন শংকরের সন্ধান পাওয়া গেছে, তারপর রঘুনাথপুর থেকে সুবীর জানাল সে নাকি এখন দুর্গাপুরে থাকে আর পরের দিনই দুর্গাপুর থেকে অরুণ জানাল ওর ফোন নম্বর। আশ্চর্য ব্যাপার শংকরের মত মহাপুরুষ গত দশ বছর ধরে দুর্গাপুরে, অথচ ওরা কেউ জানে না। অবশ্য একটা গাইগার কাউন্টার থাকলেই ঠিক জানা যেত, তেজস্ক্রিয়তাকে তো আর খড় চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখা যায় না!
অতএব এবার আমার সঙ্গেও পুনঃ যোগাযোগ হল। তারপর কিভাবে জানি না হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল যে আমাদের এক পুরনো বন্ধুর ছেলের বিয়ের বউভাতে আমরা সিন্দ্রি যাব, আমরা মানে আমি, অরুণ, দীপংকর, অনির্বাণ আর শংকর। দীপংকর গাড়িতে পেট্রল ভরিয়ে নিয়ে এল।
নাঃ, এ শংকরকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। যার সম্বন্ধে স্বয়ং হরিদাস স্যার ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে সে হয় আইনস্টাইন নয় হাজি মস্তান হবে- সে কিনা একটা সদাগরি কোম্পানীর ম্যানেজার! জানিনা কোন গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে সে কিনা একদম ভালমানুষ বনে গেছে, অর্থাৎ কাপ্তানির 'ক' নেই, মুখে খিস্তির 'খ' নেই, গোঁয়ার্তুমির 'গ' নেই, সব যেন ঘেঁটেঘুঁটে 'ঘ' হয়ে গেছে! অরুণকে চিরকাল ভদ্র-ভালমানুষ বলেই জানি, সেও কিছুটা মুখখারাপ করে ওকে তাতাবার চেষ্টা করল, সব বৃথা। শেষে আমি ভাবলাম, কিছু পুরনো স্মৃতি উস্কে দিই, বললাম, হ্যাঁরে, তপনের কোনও খবর জানিস?
শংকর কেমন যেন চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তাই তো! আমাদের মাণিকজোড় বলত লোকে, সেই তপনটা কোথায় হারিয়ে গেল? জানিস, আজ চল্লিশ বছর ধরে অনেক খোঁজ করেছি ওর, কিন্তু কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারেনি।
'আমি তো ওকে কাগজ বিক্রি থেকে জলের কল সারাই পর্যন্ত করতে দেখেছি একসময়' আমি বললাম, 'তারপর কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল ছেলেটা।' অবশ্য জব্বলপুর স্টেশনে পাঁউরুটি-ওমলেট বিক্রি করত যে ছেলেটি তার প্রসঙ্গ আর তুললাম না, কারণ তার নাম তপন হলেও সে যে আমাদের তপন নয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত এখন।
এরপর যখন আমরা পাঁচজনে পৌঁছলাম আমাদের ছোটবেলার সেই পুরনো শহরে, আমাদের শৈশবের লীলাভূমি আর যৌবনের উপবনে (না, বার্ধক্যের বারাণসী আর বানাতে চাইনা তাকে), পলাশ-কৃষ্ণচূড়া কুঁড়ি, আমের মুকুল আর মহুল ফুলের মাতালকরা গন্ধ আমাদের আবার যেন ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই হারানো বাল্যকালের দিনগুলোতে।
'তোদের ঘোঁচুকে মনে আছে?'- শংকর যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই এবার মুখ খুলল। বৌভাতের বাড়িতে পেট পুরে খেয়ে কাছেই গেস্ট হাউসে শুতে এসে জমেছে আড্ডা- শংকরের কথায় সবাই নড়েচড়ে বসলাম।
'ঘোঁচু?' দীপংকর অবাক। 'এরকম নামের কাউকে তো মনে পড়ছে না।'
'ঝোড়ো কাকের ডানার মত উস্কো-খুস্কো চুল, কাদাখোঁচা পাখির মত চেহারা, হাসি-হাসি শয়তানী চাউনি- চেহারাটা মনে পড়ছে', আমি বললাম, 'আরে ওর নামও তো তপন'।
'হ্যাঁ, তপন মণ্ডল। তবে ওর আসল নামটা খুব কম ছেলেই জানত, ঘোঁচু নামেই বিখ্যাত ছিল। ও দেখি ক'দিন ধরে তপনা মানে তপন চ্যাটার্জির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, এদিকে আমাকে কিন্তু এড়িয়ে চলছে।... ভাবলাম ব্যাপারটা কি জানতে হচ্ছে, জিতুকে বললাম একটু গোয়েন্দাগিরি করতে।'
'তারপর?' আমাদের সমবেত প্রশ্ন, 'কি জানা গেল?'
'আর বলিস না, সে ভীষণ কাণ্ড! উড়নচন্ডী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার প্রতিপত্তি ঘোঁচুর ঠিক সহ্য হচ্ছে না। ওর ধারণা, আমাকে ছেড়ে ওর তাঁবেদারি করলে জিতেন, অশোক, তপন, অজয় সবাই লাভবান হবে, কম পড়ে বেশি নম্বর পাবে আর বেশি দুষ্টুমি করেও কম শাস্তি হবে। গোপনে সেটা আবার সবাইকে বুঝিয়েও ফেলেছে।'
'আমি আর কিছু বললাম না। ভান করলাম যেন ওর লীডারশিপ মেনে নিয়েছি।'
এবার শংকরের ওপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে চোখের কোনা দিয়ে ঝলকানো সেই চিরপরিচিত পাগলা-দাশুমার্কা হাসিটা দেখতে পেলাম। আন্দাজ করলাম কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে।
'আচ্ছা, অশোককে তো রাস্টিকেট করা হয়েছিল কী একটা মারপিটের চক্করে। তোর সাথেও ত ওর হেব্বি মারপিট হয়েছিল', দীপংকর বলল, 'ও তোর গ্রুপে ঢুকল কিভাবে?' ওর মন থেকে ধন্দ দূর হয় না।
'দ্যাখ গুরু, ওয়ান স্টোরি অ্যাট এ টাইম। একজন সমস্ত ঘটনাগুলো মনে মনে নোট করে চলেছে, ওকে কনফিউজ করা চলবে না।' শংকর বলে চলে। 'আমি তপনকে বললাম, কি রে, আমাকে ছেড়ে দিলি?'
'গুরু, ঘো-ঘো-ঘোঁচুর না হেভি বুদ্ধি! ব-ব্বলে, ফারস্ট আর শেষ পিরিয়ডে রোল কল হয়- আমরা তার মধ্যে ক-ক্ক-কল্পনায় গিয়ে একটা মর্নিং-শোও দে-দ্দেখে আসতে পারি।- জানিস বোধহয়, তপনা একটু তোৎলাতো। তা আমি বললাম, কে-ওয়ানে আমার কাকার বাড়িতে যা পেয়ারা হয়েছে না! কাল আয় না ঘোঁচুটাকে নিয়ে।'
'তপনা তো খুব খুশি। পরের দিন তিনজনে আমরা সেকেন্ড পিরিয়ডে কাট মারলাম।'
'আমরা মিনিট পনেরো হেঁটে কে-ওয়ান পাড়ায় একটা বাগান-ঘেরা বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির পেছনদিকের বাগানে দেখা যাচ্ছে গোছা-গোছা ডাঁশা পেয়ারা ঝুলছে। একটা আম গাছে বিস্তর পাকা আম। এতক্ষণে ঘোঁচুর মনে আমার উপরে একটু শ্রদ্ধা জেগেছে মনে হল। বলল, হ্যাঁরে, তোর কাকা কিছু বলবে না যদি পেয়ারা পাড়ি? আমি বললাম, দূর ওদের বাড়িতে খাবারই লোক নেই- পাখিতেই খায় সব। যা তোরা চুপিচুপি গাছে উঠে পড়- কাকা নাইট ড্যুটি করে ঘুমোচ্ছে বোধহয়, আমি একবার কাকিমার সঙ্গে কথা বলে আসি।'
'তারপর ওদেরকে গাছে উঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি দরজার কড়া নাড়লাম। কৌন বা- এ রামগিধৌড়োয়া, তনি কেওয়াড়িয়া খোল হো! ভোজপুরি ভদ্রলোক দরজা খুলতেই আমি খুব ইনোসেন্ট মুখ করে বললাম- চাচাজি, পিছোয়াড়ে পে দোঠো লাইকা আমরুদ তোড়ল......হাঁ, সচ !'
'তারপর?' আমরা চারজনেই উদগ্রীব।
'তারপর তিনদিন পরে দেখা তপনার সঙ্গে। মাথায় ব্যান্ডেজ। আরও দুদিন পরে ঘোঁচু স্কুল এল খোঁড়াতে খোঁড়াতে। ক্লাসে চিঠি দিল বাথরুমে পড়ে পা মচকেছিল।'
'কি বে তুই? নিজের বন্ধুদের সঙ্গে এরকম গদ্দারি করলি!' অনির্বান এতটাও নিতে রাজী নয়। 'এরপরে বল আর দোস্তি থাকে?'
'তোরা কিছুই বুঝিস না এসবের' শংকর বলে। 'উলটে ঘোঁচুও এর পর থেকে আমার দলে পার্মানেন্ট হয়ে গেল। আরে ইয়ার, হীরের বদলে কাঁচের আংটি পরলে চোখ ধাঁধায় কম, আঙুল কাটে বেশি!' কথাটা মানতেই হল।
'হ্যাঁরে শংকর, তুই বিভূতি মুখার্জির 'বরযাত্রী' পড়েছিস?' আমার এদের গল্প শুনে কেন জানিনা গণশা আর ঘোঁৎনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
'না না, ওসব পড়িনি। পড়ার বইয়ের আধখানার বাইরে কোনদিনই কিছু পড়িনি- অবশ্য এখন রোজ গুরুমন্ত্র পড়ি।'
বোঝা গেল, এমনি এমনিই গল্প লেখা যায় না- শংকরের মত একজন 'হিরো' না পেলে!
No comments:
Post a Comment