ব্লাইন্ড-স্পট
(অণুগল্প)
পুলককে ঠিক ভুলোমনা বা তালকানা কোনটাই হয়ত বলা ঠিক হবে না। তবে ওর একটা ভয়ংকর বদ স্বভাব হল জিনিষপত্র কোথায় রেখেছে প্রায়ই তা ভুলে যাওয়া। ক্লাস থ্রি-তে পড়া কিশলয়ের কবিতা কণ্ঠস্থ, কিন্তু আর্বিট্রেশনের জন্যে কন্ট্রাক্ট পড়ার দু-ঘন্টার মধ্যে তার বিবাদাস্পদ ক্লজগুলো ভুলে যেতে তার জুড়ি নেই। পুলক কর্পোরেট ল-ইয়ার। তাই ক্লায়েন্টদের নাম-ঠিকানা-কন্ট্রাক্টের ডিটেল, আইনের ধারা- কিছুই তার ভুললে চলে না। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
সঙ্গত কারণেই পুলকের বাড়ি তার অফিসেরই যেন এক্সটেন্সন। বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে কন্ট্রাক্ট আর সংশ্লিষ্ট ফাইলগুলি পড়ে বুঝে রাখতে হয়, পরদিন সকালেই হয়ত থাকবে আরবিট্রেশনের কেস। তার কর্পোরেট আইনের জ্ঞান আর বিবাদের কারণগুলো বিশ্লেষণের ক্ষমতার ফলে সে এখন রুস্তম অ্যান্ড জিজিভয় সলিসিটার ফার্মের একজন সিনিয়ার কনসাল্ট্যান্ট। কিন্তু মোটা মোটা ফাইলগুলোর কোন পাতায় কি আছে তা মনে রাখার জন্যে তাকে প্রচুর পরিমাণে হলুদ কাগজের স্টিকিং নোট ব্যবহার করতে হয়। অবশ্য এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, এ কাজ সবাই করে থাকে।
আশ্চর্যের কথা হল এটাই যে স্টিকিং নোটের গুচ্ছটা কোথায় রাখা আছে মাঝে মাঝে পুলক সেটাই খুঁজে পায়না। ইনস্যুরেন্সের ধারাটাতে চোখ রাখতে হবে, দুটো ভাইটাল পয়েন্ট আছে, কিন্তু মার্ক করবে কি দিয়ে, ইয়েলো স্টিকারের গোছাটা কই? খোঁজ, খোঁজ......নাঃ, কোত্থাও নেই। প্রিন্টারের উপরে কাগজপত্র ডাঁই হয়ে আছে, অন্ততঃ চারবার তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল সব। ক্লায়েন্টের কন্ট্রাক্টারের বিজনেস কার্ডটা হারিয়ে যাওয়ায় আরেকটা চেয়ে নেবে ভাবছিল পরের মিটিং-এ, সেটা হঠাৎ পেয়ে গেল বিছানার এক কোনায়, কিন্তু স্টিকারগুলো নেই।
- 'বারোটা বেজে গেছে, এবার তো শুয়ে পড়', অঙ্গনা তাড়া দেওয়া শুরু করেছে। রাগ হয়ে গেল পুলকের- নির্ঘাৎ ওর কাজ, সকালে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কোথাও ঢুকিয়ে দিয়েছে।
- 'কোথায় রেখেছ বলত হলুদ স্টিকারগুলো, খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও?'- গজগজ করে উঠল পুলক।
- 'কোথায় আবার থাকবে, হয় ল্যাপটপের তলে, নয় প্রিন্টারের ওপরে- দেখেছ ওগুলো?'
- 'সব তিন-চারবার করে দেখা হয়ে গেছে'।
- 'তাহলে এটা কি?' বলতে বলতে প্রিন্টারের উপরে পুলকের চোখের সামনে থেকেই স্টিকারের গোছাটা উদ্ধার করে অঙ্গনা।
অপ্রতিভ পুলক। কিন্তু হার মানবার পাত্র নয় সে। ফিজিক্স পড়েছে স্কুলে। বলল, 'চোখের নার্ভগুলো যেখানে গোছা বেঁধে রেটিনার বাইরে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ে, সেই জায়গায় কোন কিছুর প্রতিবিম্ব পড়ে না। তাই সেটাকে বলে ব্লাইন্ড স্পট। ইয়েলো স্টিকারের গোছাটার ইমেজ নিশ্চয় আমার সেই ব্লাইন্ড স্পটে পড়েছিল, তাই দেখতে পাই নি।'
অঙ্গনা চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল দুজনে।
আপাততঃ তর্কে জিতে গেলেও একটু পরেই অনুতাপবোধ শুরু হল পুলকের। ছিঃ, অঙ্গনা যদি জানতে পারে যে মানুষ দুই চোখ দিয়ে দেখলে ব্লাইন্ড স্পটের কোনও প্রভাব থাকে না, আর পুলক তো আর কানা নয়। ভাবল একবার অন্ততঃ মুখ ফুটে স্যরি বলে দিই।
- 'বুঝলে অঙ্গনা, কথাটা না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না......'
- 'বুঝেছি, আর বলতে হবে না......তোমাকে ভগবান দুটো চোখ দিয়েছেন, মাথা একখানা আস্ত, আর......'
- 'আর কি?'
- 'হৃদয় মাত্র আধখানা।'
- 'তাহলে এসো, যদিদং হৃদয়ং তব-'
বাতি নিভে গেল। ওরা দুজনে ঘন হয়ে এল।
সকালে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল পুলকের। অঙ্গনা ঘরে ঢুকল। ওর এরই মধ্যে স্নান হয়ে গেছে, একটা বড় দেখে লাল টিপ পরেছে কপালে।
- 'অঙ্গনা', ডাকল পুলক।
- 'কি?'
- 'সত্যি হয় আমি অন্ধ ছিলাম, নয় আমি এক বিশাল ব্লাইন্ড স্পট নিয়ে জন্মেছিলাম। তাই জীবন-ভর এত আইনের বই দেখলাম, কন্ট্রাক্টের ফাইলের প্রতি পাতায় হলুদ কাগজ চেটালাম; শুধু-
- 'আবার কি?'
- 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া-
বিছানা হইতে দুই পা ফেলিয়া
একটি লজ্জা-অরুণ কপালে
একটি সিঁদুর বিন্দু।'
No comments:
Post a Comment