Thursday, January 22, 2015

বাংলা অণু-গল্প- ৩৯ ।। কস্তে পুত্রঃ ।।

কস্তে পুত্র: ||
(গল্প)


রিটায়ার করার পর মানুষটা বড় একা হয়ে গেছেন।

অবশ্য আগেও যে খুব একটা মিশুকে ছিলেন ছাতুবাবু তা নয়। হ্যাঁ, ছাতুবাবু নামেই তাঁকে ডাকে পাড়ার লোক। আসল নাম সত্যেন পান্ডে লোকে বোধহয় ভুলেই গেছে। বিয়ে করেননি বলে যে তাঁর খুব একটা একাকিত্ব বোধ ছিল তা মনে হয় না, তবু কি অপত্য-স্নেহবঞ্চিত বুকের কোথাও একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগেনা কখনো জীবনের এই সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়িয়ে? উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার মানুষ, সেই কোনকালে মহাজনের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। শেয়ালদা স্টেশনে কুলিগিরি করে আর অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সে যুগে। তারপর হাওড়ার বি-এন-আরের শালিমার ইয়ার্ডে ছোট্ট একটা চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে শেষে মুম্বাই। সেন্ট্রাল রেলের প্যারেল ইয়ার্ডে ইয়ার্ড-মাস্টারি করেই তো কেটে গেল চাকরি জীবনের শেষ বারোটা বছর। ভোজপুরি আর হিন্দি ছাড়াও বাংলাটা ভালই শিখেছিলেন, এখন কিছুটা ইংরেজি আর মরাঠিও বলতে পারেন। তবে রিটায়ার করেও একটা নেশা যায়নি। সকালে ছিঁড়ে-ছাতু সহযোগে জলপান সেরে হিন্দু কলোনির ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িটা থেকে রোজ বেলা দশটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন দাদার স্টেশনে। সেখানে দেশোয়ালি কুলিদের সাথে বসে টানা একঘন্টা তাদেরকে তুলসীর রামায়ণ আর দোহা শোনান, এমন মুগ্ধ শ্রোতা মুম্বাইয়ে পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না!

কিন্তু তারপর? সারা দিনটা যে পড়ে থাকে কর্মহীন অবসরের জন্যে, তার তো অভ্যেস ছিল না তাঁর। ওয়াডালা স্টেশনের ধারে বাচ্চাদের একট স্কুল আছে, বলা বাহুল্য, অবৈতনিক- ভিখারী-কুলি-মজুর আর কিছু নিম্নশ্রেনীর বারাঙ্গনাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। তিনি কদিন গিয়ে তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে হিন্দি পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় নেতার ভয় হল, তিনি বুঝি ভোটে দাঁড়াতে চান- তাই গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁকে তাড়ানো হলো। নেতাকেও দোষ দেওয়া যায় না, বিনা স্বার্থে কেউ কিছু করতে চায়, এই সত্যি কথাটা এযুগে বসে তাঁর হজম হবে কেন? তাছাড়া তিনি আবার সে স্কুলের বোর্ড প্রেসিডেন্ট!

সেদিন সকাল থেকে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়লেও ছাতুবাবুর রুটিনের অন্যথা হয়নি। কিন্তু এগারোটা বাজতে চলল, কুলিভাইদের কারো দেখা নেই কেন? একটু খোঁজ নিতেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। তিন নম্বর আপ কলকাতা-এলাহাবাদ-মুম্বাই মেল এক নম্বরের জায়গায় চারে আসছে, তাই সব ব্যাটা দৌড় দিয়েছে সেদিকে। ওই তো গাড়ি ঢুকছে চার নম্বরে, তিনিও কি ভেবে ফুট ওভারব্রিজে উঠে পড়লেন। ছাতুবাবু রিটায়ার করেছেন বটে, তবে তাঁর কাছে প্ল্যাটফর্ম টিকিট চায় এমন রেলকর্মী কেউ নেই এ স্টেশনে।
গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে চলেও গেছে। এখানে কেউ খামোখা বসে থাকে না। 'সময় হল, সময় হল, যে যার আপন বোঝা তোলো' বলে কুলিরা কেটে পড়েছে। কিন্তু যারা প্যাসেঞ্জার পায়নি তারা আবার ওই হুইলারের স্টলটার সামনে দাঁড়িয়ে কিসের জটলা করছে? এরকম তো কথা ছিল না। ছাতুবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। হায় রাম, এই কান্ড! এক ষাটোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ি নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা কুলিদের মুখের সামনে একটা কাগজ নেড়ে ক্রমাগত কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে। কুলিদের কাজ কাগজ নিয়ে মাথা ঘামানো নয়, তারা মাল তুলতে পারলেই খুশি। তিনি এগিয়ে যেতেই ওরা সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিল। তাঁকে দেখেই বুড়ো-বুড়ি কেঁদে ফেলল। বুড়ো লোকটি হাউমাউ করে বাংলায় যা বলতে লাগলো তার অর্থ মোটামুটি এই বোঝা গেল যে, তাদের বড় ছেলে তাদেরকে বর্ধমানে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে বোম্বাইএ কাজ করে, তার দাদার স্টেশনে মা-বাপকে নিতে আসার কথা, কিন্তু এখানে নেমে অবধি কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষাও কেউ বোঝে না, ওরা নিজেরাও গাঁয়ের মানুষ, বাংলা ছাড়া কিছু জানে না।

'রুকিয়ে, রুকিয়ে, বাবুজি, আপনার হাথে উটা কিসের কাগজ?' ছাতুবাবু জানতে চাইলেন।
'এই দেখো, এটাই তো দেখাতে চাইছিলাম আপনাদের এতক্ষণ। আমার ছোটছেলে ব্যস্ত মানুষ, যদি না আসতে পারে, এই ভেবে বড় ছেলে ওর ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল আমার হাতে। তা আমরা মুখ্যুসুখ্খু মানুষ, ইংরেজি কি পড়তে পারি! একটু দেখুন না সায়েব, কি লেখা আছে', বুড়ো লোকটি কাতরভাবে অনুরোধ করলেন।
উনি কৌতূহল-বশত: চিঠিটা পড়েই চমকে উঠলেন। তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, 'বাবুজি, যে বস্তির ঠিকানা এখানে দেওয়া আছে তা তো কবে উঠে গেছে। সেখানে এখন মস্ত হোটেল। তা, আপনার যদি আর কুনো জায়গা না থাকে আমার সাথেই চলুন না আমার বাসায়, তারপর ধীরে-সুস্থে আপনার ছেলেটাকে খুঁজা যাবে। কি বোলেন?' বুড়ো-বুড়ি হাঁ করে তাকিয়েই আছে, তাদের যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। কুলিরা তা বুঝে তাড়া ও ভরসা দিল-' আরে মাজি, সোচনে কা নেহি, হামারা সত্তুবাবু রামজি কা অবতার আছেন, আপ বিন্দাস যাইয়ে।' শুধু বলেই ক্ষান্তি নয়, দুজন কুলি সাথে সাথে তাদের জিনিসপত্র তুলে হাঁটা দিতে লেগেছে হিন্দু কলোনির দিকে।
'আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম। আপনার স্ত্রী ছেলে-পুলে......'
'কুছু ভাববেন না। হামার কেউ নেই। এখন আপনি আমার বড়া ভাই, আর ইনি আমার ভাভী আছেন। আপনার ছেলেটাকে না পাওয়া অব্দি বাড়ির রান্না খাওয়া যাবে। কি ভাভিজি, বাঙালি রান্না খাওয়াবেন তো?'

এতদিনে ছাতুবাবুর বোধহয় ছেলেপুলে না থাকার দু:খ ঘুচলো। কাগজটাতে যে পষ্ট ইংরেজিতে এই কথাটা লেখা ছিল- 'এই বুড়ো-বুড়িকে দয়া করে কোনো দাতব্য বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দেবেন'।

এপ্রিল ৩, ২০১৫, কুয়েত।

Wednesday, January 21, 2015

বিবিধ প্রসঙ্গ ।। ১-৩

(১)
বিভীষণ

কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলেই আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, 'ঘরভেদী বিভীষণ'। এই বিভীষণ কি অন্যায় বা অনৈতিক কাজ করেছিলেন দেখা যাক। তিনি সীতাকে বন্দী করে রাখার ব্যাপারটা সমর্থন না করে চেয়েছিলেন রাবণ সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিক। এই নিয়ে তর্কাতর্কি চলাকালীন রাবণ রাগের চোটে ছোট ভাইকে লাথি মেরে বসেন। এই অপমান সহ্য না করতে পেরে বিভীষণ রাবণকে ছেড়ে চলে এসে রামের দলে যোগ দেন।
এছাড়া বিভীষণের কি আর কোনও উপায় ছিল না? ছিল। যদি তিনি রাবণের সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতেন, তাহলে তিনি রাবণের পরাজয় চাইতেন, কিন্তু নিজে তার কারণ হয়ে উঠে রামের দলে যোগ দিতেন না। তিনি বরং নিরপেক্ষ হয়ে থাকতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি, কারণ তাঁর রাজ্যের লোভ ছিল। লঙ্কার অধীশ্বর হতে গেলে পুত্রপৌত্রাদিসহ রাবণের মৃত্যু জরুরী ছিল আর বিভীষণ এও জানতেন যে তাঁর সাহায্য ছাড়া রামের প্রসঙ্গ কাজ করা অসম্ভব হত।
আজ এ দেশের রাজনীতিতে এ খেলা অবিরত চলে আসছে। মমতার সাথে চার বছর সুখে ঘর করার পর যখন মনে হল দিদির এবার জেতার আশা কম, অমনি বনগাঁর ঠাকুরের খেয়াল হল পদ্মফুলের গন্ধ ঘাসফুলের চেয়ে মিষ্টি, ফলে তিনি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করলেন। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হবার লোভে কেজরীওয়াল ছেড়ে কিরণ বেদিও ভাজপার পতাকাতলে এলেন। এঁরা কিন্তু নির্লোভ হলে দলত্যাগ করে নিরপেক্ষও থাকতে পারতেন, আর সেটাই হত অন্যায়নীতির বিরুদ্ধে সঠিক প্রতিবাদ। যদি নীতিগত প্রশ্নে বিভেদ ঘটে, নির্দলীয় হয়ে দাঁড়ালেই হয়!
তবে আমাদের দেশের জনতা চিরকাল বিভীষণকেই ভোট দিয়ে এসেছেন, এবং এবারও দেবেন, কারণ তিনি ভগবান রামের দলে এসেছেন যে! আর রামের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বিভীষণের চরিত্রটিকে নিখুঁতভাবে অধ্যয়ন করে তাঁর কাছ থেকে নিজের ছেলে তরণীসেনকে মারার ট্রিকটুকুও বলিয়ে নিয়েছেন কথায় কথায়। তাই তো তিনি ভগবান!


(২)
কর্ণ


নাঃ, খুব ভালগার হয়ে গেল শীর্ষকটি। কিন্তু কিছু করার নেই। যে হারে সুবিধাবাদী ও বিক্ষুব্ধ নেতারা নিজের নিজের দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে সাইন করছেন, হয়ত সেখানে গিয়ে শাইনও করবেন, সে সব দেখে দৈনন্দিন মলত্যাগে অভ্যস্ত সাধারণ জনতাও অস্বস্তি ফীল করছেন। মাতুয়া শিরোমণি শ্রীমঞ্জুল বা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশবাবু বা সাধন পাণ্ডেরা এতদিনে বুঝতে পারলেন-
কিসের মাটি, কিসের মানুষ, কিসের তৃণমূল,
কাল যে ছিল নয়নমণি, আজ সে চক্ষুশূল।
কেউ কেউ বলছেন, জনতার অপমান আর অভিশাপ বয়ে আর ও দলে থাকা যায় না। সত্যিই যায় না। আসল কারণ অবশ্য টাকা রোজগারের কায়দা হিসেবে সারদার পর নতুন কোনও ইনোভেটিভ আইডিয়ার উদ্ভব না করতে পারা, দু-নম্বর ভাজপা-কে কংগ্রেস ভেবে মমতার ভুল করে সভার মাঝে মোদিকে আজেবাজে কথা বলা (উপায় নেই, অভ্যাস হয়ে গেছে, মুখ খুললেই ওগুলো বেরিয়ে পড়ে) আর তিন নম্বর- তৃণমূল নেত্রীর সঠিক সময়ে একটু নত হয়ে কংগেসের সাথে জোট না করতে পারা। এরপরও লোকে থেকে যেতেন, যদি দলের কোনও আদর্শ থাকত- মনে করে দেখুন দল থেকে বিতাড়িত নেতা সোমনাথবাবুকে, যিনি অনায়াসে সেসময় কংগ্রেস বা অন্য দলে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু বাম আদর্শ যাঁর মজ্জাগত হয়ে গেছে তিনি কি তা করতে পারেন! কম্যুনিষ্ট পার্টির দুর্ভাগ্য, এরকম একটা মানুষ থাকতে হরকিষেন বা কারাটের মত লোকেরা পলিটব্যুরোর শীর্ষে থাকেন বা বুদ্ধদেববাবুর মত দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ বঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হন!

এই প্রসঙ্গে ভেবে দেখলে মহাভারতের যুদ্ধের আগের দল-বদল পর্ব এখনও প্রাসঙ্গিক। মদ্ররাজ শল্য নকুল-সহদেবের মামা হলেও যেহেতু দুর্যোধনের অনুরোধ আগে পান, তাঁর দলেই যোগ দেন। কৃষ্ণকে নিয়ে হেড-টেল টস হয়, ও অর্জুন যেতেন। বলদেবের আশীর্বাদ প্রিয়শিষ্য দুর্যোধনের পক্ষে থাকলেও, ভাইএর কথায় তিনি থাকেন নির্দলীয় হয়ে। তবে রগড় শুরু হয় যুদ্ধ শুরু হবার পর। কর্ণের শৌর্য-বীর্যের কাছে পেরে না উঠে কৃষ্ণ তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে তাঁর বংশ-পরিচয় দিয়ে আসেন আর তার পরেই কুন্তী-মা গিয়ে তাঁকে দল-বদলের আহ্বান জানিয়ে আসেন। তিনিও তখন অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারতেন, এলে বেঁচে যেতেন, রাজাও হতেন হয়ত। কিন্তু সেই কবে বন্ধু দুর্যোধন অপমানিত অবহেলিত মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো একটি সূত-পুত্রকে রাজার মর্যাদা দিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতাবশে তিনি দলত্যাগ করলেন না। এ যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এ যে কত বড় স্বার্থত্যাগ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
যাক গে, তৃণমূল ভাঙ্গুক, আআপ ভেঙে কিরণ বেদী বেরিয়ে এসে দিল্লীর বিধানসভার দিকে হাত বাড়ান বা নাই বাড়ান, ভাজপার বৃহস্পতি এই মুহূর্তে তুঙ্গে। যে দলই জিতুক কিছু যায় আসে না, শুধু চাইব তারা যেন জনতাকে 'বনলতা সেন'এর মত 'দু দণ্ড শান্তি' দিতে পারে।


(৩)

ঈশ্বর

সদ্য দেখা 'পি কে' ছবিতে একটা খুব জনপ্রিয় উক্তি ছিল। তপস্বী-বাবা বলছেন, 'বিধর্মীদের হাতে চুড়ান্ত অপমানের হাত থেকে আমরা ঈশ্বরকে রক্ষা করব'। তার উত্তরে ভিন-গ্রহ থেকে আসা লোকটা বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে প্রকারান্তরে বলেই ফেলল- 'যে ভগবান বিশ্ব-সৃষ্টি করেছেন তাঁকে রক্ষা করবে তুমি, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! চিন্তা কোরো না, ঈশ্বরের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ঠিকই আছে, তার জন্যে তোমার চিন্তার প্রয়োজন হবে না।'
আজ একালের ঈশ্বর বারাক ওবামা নিজের হাতে নিজের রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এ গাঁয়ের মোড়লমশাইকে অশেষ দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করেছেন। মোড়লমশাই তাঁর মোড়লজীবনের প্রথম গণতন্ত্রদিবসের সমারোহে প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে গুণ্ডাদের নিয়ে বড্ড চিন্তায় ছিলেন। এদিকে আধুনিক ঈশ্বরের কাছে স্বমহিমা প্রচারের এরকম সুযোগ ছাড়তেও পারছিলেন না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে উৎপাত থেকে তাঁকে রক্ষা করবে কে? আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে এ দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করলেন। প্রতিবেশী দেশের মোড়লমশাইকে একটি বার্তায় তিনি স্পষ্টরূপে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর উপস্থিতিতে দিল্লী বা তার আসেপাশে কোনরকম অশান্তি বা নাশকতামূলক কাজকর্ম তিনি চাননা। আমরা অগত্যা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কিন্তু এই একটা ঘটনা কি কি প্রমাণ করল দেখা যাক্‌-
১- ঈশ্বরকে মানিনা ইত্যাদি বলে গালাগাল দিলেও তাঁকে খুশী রাখতে রাম ও রাবণ দুজনেই চায়। তাই কুরুক্ষেত্রের প্রাক্কালে অর্জুন আর দুর্যোধন দুজনেই কৃষ্ণকে নিজের নিজের দলে টানতে দ্বারকা পৌঁছে গেছিলেন।
২- নিজেকে রক্ষার ভার ঈশ্বর নিজেই নিতে পারেন। তাই তাঁর রক্ষার জন্যে চিন্তিত না হয়ে তাঁকে নিয়ে এসো নিজের কাছে, এতে করে তুমি নিজেও সুরক্ষিত থাকবে।
৩- এই গ্রহে যাবতীয় নাশক-অনাশক, শুভাশুভ কর্মকাণ্ডের নায়ক তিনিই। তিনি না চাইলে কাশ্মীরের এক ইঞ্চিও ভারত পায় না, আবার আল-কায়দাও কোনও কায়দা-কানুন দেখাতে পারে না।
৪- এটাও জানা গেল যে বিভিন্ন সংগঠিত-অসংগঠিত, ন্যায্য-অন্যায্য নাশক-শ্রেণীর গুপ্তচক্রগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিবেশী দেশের মোড়লের হাতে আছে, আর এটা স্বয়ং ভগবানও জানেন।
৫- সুতরাং দু-দেশের মোড়লেরই উচিৎ হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা বলে নিজেদের মধ্যে লাফালাফি না করে ঈশ্বরের ইচ্ছাটি কি তা জানার দিকেই নজর কেন্দ্রিত রাখা। অবশ্য জনতাকে ভাঁওতা দিতে একটু চেঁচামেচিরও দরকার আছে, মানতে হবে।
তাহলে টুইন টাওয়ারে কি হয়েছিল। কেন, ছেলেপুলেরা কি বাপ-মায়ের অবাধ্য হয়না মাঝে মাঝে? তার ফলও তারা পায় হাতে-নাতে।
অলমিতি বিস্তারেন!

কবিতা - মন চায়

মন চায়
(রোমান্টিক কবিতা)

গরমের বিষন্ন বিকেলে-
মাঝে মাঝে মনে হয় ডালহৌসি থেকে
বাসের লাইন ছেড়ে ভেগে পড়ি
শুধু তুমি আর আমি,
চলে যাই জনতার ভীড় ঠেলে ইডেন গার্ডেনে,
কিম্বা বাবুঘাটে।
চক্ররেল পিছে ফেলে আমরা দুজনে
বসি মুখোমুখি।
সম্মুখেতে স্রোতস্বিনী ভাগিরথী, সেদিকে না চেয়ে
তাকাই পেছনে, বড়ই মধুর দৃশ্য, হাতে হাত রেখে

দুজনে সেখানে যাই-
প্রেমপূর্ণ স্বরে
কানের লতির কাছে অধর ছুঁইয়ে
মৃদুকন্ঠে শুধোই তোমাকে-
'ডার্লিং, ফুচকা খাওয়াবে?'


মনে করে দেখ প্রায় শতবর্ষ আগে
এমনই মধুর এক দিনে,
বসে ছিল মুখোমুখি লাবণ্য,
শোভনলাল সাথে।
মধুকণ্ঠে বলেছিল,
'শোভন, ফুচকা খাওয়াবে?
ছিল সেই কনে দেখা আলো
সেই হিন্দুস্থানি ফুচকাওলা,
সেই হাঁড়ি লাল শালু ঢাকা, সেই গঙ্গাতীর।
সবই ছিল, ছিলনাক শুধু
দুটি টাকা শোভনলালের মানিব্যাগে।
ফিরে গেল লাবণ্য মুখ হাঁড়ি করে
বহুদূরে, শিলং পাহাড়ে।
অমিত রায়ের সাথে হয়েছিল দেখা,
বিত্তশালী বাপের ব্যাটা সে,
কিন্তু কি মুশকিল,
সে শোনায় শুধুই কবিতা,
কথায় কথায় আনে ডন, নিবারণ,
কে বোঝাবে তাকে
আলুকাবলি আর তেঁতুলজলের স্বাদ!

এমন সময় কোথা থেকে
হাজির শোভনলাল
পকেট বোঝাই টাকা, গোঁফ ধরে টেনে আনে
বিহারী সে ফুচকাওলাকে।
কণ্ঠে মধু ঢেলে বলে তারে-
'এ ভাইয়া, ফুচকা খিলাও।'

তাই বলি, প্রিয়তম, এ পৃথিবী মাঝে
যতদিন আছে সেই লাল-শালু মোড়া
হাঁড়ি আর তেঁতুলের জল
আর বীটনুন, ঝাল লঙ্কার গুঁড়ো,
হেলা কোরোনাক তারে,
প্রেমিকার হাত ধরে ময়দানে যখনি যাবে
বা মেমোরিয়ালে, শুধাবে তাকে
প্রেম-মাখা স্বরে,
'ডার্লিং, ফুচকা খাবে??'

১৫ই জানুয়ারি, ২০১৫।

অবসরে প্রকাশিত রচনা- পশিত আকাশবাণী শ্রবণে http://www.abasar.net/radioissuepallab.html

http://www.abasar.net/radioissuepallab.html

বিবিধ আলোচনা- ১- ৬

(১)

নীল-সাদাতে সোনার বাংলা করল আবার যে ছারখার
মদ না খেয়েই মদনা গেল হাসপাতালেই মাস কাবার,
নীল মানে যে শূন্য, দিদির মাথায় সেটা ধরল না,
মা-মাটি-মানুষের মাঝে ফাঁকটিও তাই ভরল না।
সেই ফাটলের গহ্বরেতে ডুবল বুঝি ঘাসের মূল,
পচা-পানার খানাডোবায় মারছে উঁকি পদ্মফুল!

মূল কবিতাটি উনবিংশ শতাব্দীর কোনও অখ্যাত কবির লেখা, প্রথম লাইন দুটো দিচ্ছি। যদি কেউ পুরোটা জানেন বা কবির নাম জানাতে পারেন, খুব ভাল হয়।
'নীল বানরে সোনার বাংলা করল যে আজ ছারখার,
অকালেতে হরিশ ম'ল, লং-এর হল কারাগার।' (হরিশ- বাগ্মী হরিশ মুখার্জি, লং- রেভারেণ্ড জেম্‌স্‌ লং- যিনি 'নীলদর্পণ' এর ইংরাজি অনুবাদের দায় নিজের উপর নিয়েছিলেন)

(২)

দম নেই কলিজায়, জিভ তবু চাঙ্গা-
রে বাঙালী, কত আর হবি তুই নাঙ্গা!
অমৃতসর-হাওড়া ট্রেন চলেছে পাটনার দিকে। এক বাঙালী যাত্রী চলেছেন কলকাতা সপরিবারে, মোগলসরাইয়ে জল নিয়ে যখন উঠলেন, দেখেন এক ষণ্ডামার্কা বিহারি বসে আছে তাঁর সীট জুড়ে। 'এ হামার জায়গা, নামো তুম', বলায় লোকটি বলল, সে আরায় নেমে যাবে, ততক্ষণ একধারে তিনি বসে পড়ুন না। তাতে বাঙ্গালিবাবুর রাগ বেড়ে গেল। 'এক থাপ্পড় মারকে তুমরা দাঁতকপাটি ভাঙ্গেগা' ইত্যাদি বলায় উলটে বিহারি বাবুই তাকে এক চড় মেরে বসল।
'এতনা সাহস, গায়ে হাত তুলতা হ্যায়! আচ্ছা, মেরা জানানা কো মারকে দেখাও'- বাবুটির হুমকি।
'ইমে কঊন বড়ি বাত বা? লো, অভিয়ে মার দেত'- বলেই মহিলাটিকেও এক চড়।
'বহুত অসভ্য আদমি হ্যায়, আউরত কো মারতা। আচ্ছা হামরে বাচ্চাদুটোকো মারকে দেখাও তো!'
বলা বাহুল্য, বাচ্চারাও চড় খেল। 'আচ্ছা, কলকাতা আও, তুমকো দেখেগা' বাবুটি গজগজ করতে থাকলেন। ইতিমধ্যে আরা এসে পড়ল, লোকটি নেমে গেল।

'মশায়, নিজে চড় খেলেন, খেলেন, ঘরগুষ্টি সবাইকে না খাওয়ালে চলছিল না', এক সহযাত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
'আরে মশায়, বোঝেন না কেন', বাবুটি তাঁর কানের কাছে মুখ এনে বল্লেন, 'এসব না করলে কাল সারা পাড়া রাষ্ট্র হয়ে যেত- বাবা মার খেয়েছে, বাবা মার খেয়েছে!'

(৩)

এ তো বড় রঙ্গ যাদু, এ তো বড় রঙ্গ,
চারজন এয়ার দিতে পারো, যাব তোমার সঙ্গ।
সুদীপ্ত হ্যায়, কুণাল ভি হ্যায়, আভি গয়া সৃঞ্জয়,
দাদা-দিদি কাতার মে হ্যায়, ফালতু তোদের এই ভয়!
দু-জোড়া তাস ভেজিয়ে দেবো, খেলিস টোয়েন্টি-নাইন,
ফিকর না কর, একলা না তুই, পিছে লম্বা লাইন!!


(৪)


একটা পুরাতনী গান শুনছিলাম রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কোনও শিষ্যের গলায় -
"শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদনমোহন,
সারি বলে আমার রাধা বামে যতক্ষণ
- নইলে শুধুই মদন।"
মদন আর মদনমোহনের পার্থক্যটা তখনই বুঝতে পারলাম।

(৫)

কাক-দর্পণ
কেমন করে বললি কাগা,
দিদি পিকাসো, দা ভিঞ্চি?
সে ছবি শিশুর করা আঁকিবুকি
তার বাড়া নয় এক ইঞ্চি!

তোর কাক বেচে তো চলত ভালই,
সারদায় কি প্রয়োজন,
গখ-রাফায়েল কিনছে চ্যানেল
শুনেছে কেবা কখন?
ব্যাটা আঁকবি ছবি, পয়সা নিবি-
কেন খোসামুদি অকিঞ্চিৎ!
কেমন করে বললি কাগা,
দিদি পিকাসো, দা ভিঞ্চি?
(কবিয়াল ভোলা ময়রার অনুসরণে)





(৬)

আমায় প্রশ্ন করে ওই গোয়েন্দারা
বল কতদিন জনতার টাকা মারা
চলে এই ধারা?
জবাব তেমন কিছু দিতে পারি নি বলে
বরণ আমায় করে নিল এই কারা ।।
কারা যেন সারদাকে ভাল বলেছিল
তাই শুনে লোকে সেথা টাকা ঢেলেছিল।
সারদা ছড়ায় নোট, জনতা বিলোয় ভোট
এইভাবে হল সুদীপ্ত সর্বহারা !।
আমি ভুল করিনি দিদির কথা শুনে
কে আর আপন আছে দিদি তুমি বিনে,
আমার চোখের পাশে কত মাল যায় আসে
ও দিদি, কেমনে বাঁচি লাল পানি ছাড়া ।।
(সলিল চৌধূরির কাছে যথাবিহিত ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)
 

বিশেষ রচনা - নীরস জীবন কিছুদিনের

।। নীরস জীবন কিছুদিনের ।।




(১)

যখনকার ঘটনা বলছি, তখন পশ্চিমবঙ্গে সূর্যটা একটু বাঁ দিকে হেলে উঠত। গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার জন্ম হয়নি, পশ্চিমবঙ্গের আসল রাজধানী ছিল মস্কো আর দু’জন দাস ছিলেন বিখ্যাত, কেসি দাস আর ‘দাস কাপিটাল’। আমি বিহারের একটি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি, মাঝে মাঝেই টেস্ট আর ইন্টারভ্যু দিতে কলকাতা ছুটতে হয়। আর তখনও ছাত্রজীবন। বাবারও অত টাকা নেই কলকাতায় হোটেলে উঠতে দেবার। তবে হ্যাঁ, তখনকার দিনে আত্মীয়স্বজনরা ভাল ছিলেন। সবারই বড় সংসার, কে একজন এল না গেল, তাতে করো কিছু যায়-আসতো না। তাই মাসি-মামা-জ্যাঠা জিন্দাবাদ বলে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসতাম।

একদিন এরকমই জম্মু-তাওই থেকে নামছি শেয়ালদায়, একটা বাস ধরে বেহালায় জ্যেঠুর বাড়ি যাব, হঠাৎ পিঠে কার একটা হাত পড়তেই তাকিয়ে দেখি আমার পিসতুত ভাই লাটাই।
লাটাই ওরফে বোধিসত্ব তখন নীল রতন মেডিক্যাল কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে। বাঁকুড়ার ক্রিশ্চান কলেজে পড়ার সময়ই মার্কামারা ছাত্রনেতা ছিল, আর এই বাঁদিক ঘেঁসে চলার অভ্যেস ওরা বংশপরম্পরায় পেয়েছে, বলতে গেলে ওদের রক্তে আছে। এদেরই এক জ্যেঠতুত ভাইয়ের কথা একবার বলেছিলাম, মানবাজারে ছাতে লাল পতাকা দেখে যাদের বাড়ি চিনেছিলাম, অবশ্য পরে জেনেছিলাম ওর ছাতে মেলা লুঙ্গিটা হাওয়ায় উড়ে অ্যান্টেনায় আটকে গেছিল।
‘কিরে, তুই এখানে? অবশ্য তোর তো কলেজ কাছেই, ষ্টেশনে বেড়াতে এসেছিলি বুঝি’, আমি শুধোই।
‘না রে, সন্ধ্যে হয়ে গেছিল, এসেছিলাম ক্লাসের একটা মেয়েকে কৃষ্ণনগর লোকালে তুলে দিতে’ অম্লানবদনে ও বলল। আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট হলেও আমাদের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অবশ্য মেয়ে বন্ধুদের ব্যাপারে ওর সংকোচ কোনকালেই ছিল না। উদারপন্থী বাবা-মা, এ ব্য়াপারে যথেষ্ট ছাড় ছিল। কিন্তু লাটাই আর আমাকে ছাড়ল না, পরপর দু’দিন ছুটি, জোর করে হোস্টেল নিয়ে এল।

‘জাস্ট একটা কথা এখানে মনে রাখিস, আমি এখানে লাটাই নই, বোধিসত্ব ব্যানার্জি। যতীন চক্রবর্তী, বিমান বসু আমাকে ছোট ভাইএর মত দেখে, আমার বাবা বাঁকুড়া জেলা কমিটির সিনিয়ার মেম্বার- এগুলো সব আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর উটকো লোকের সাথে একদম কথা না।‘ নীলরতনে ঢোকার আগেই লাটাই আমাকে বেশ করে বুঝিয়ে দিল।
‘কিন্তু কেন বল তো, যদিও কথাগুলো অন্ততঃ পঞ্চাশ ভাগ সত্যি, সেটা আমি জানি।‘
‘হোস্টেলে যেতে যেতেই দেখতে পাবি’ ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
কলেজের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা পোস্টার চোখে পড়ল। ‘বোধিসত্বকে মানছি না, মানব না’, ‘এস-এফ-আই-এর কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’। হোস্টেলের বাইরের দেয়ালে আরেক চমক যেটার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না- ‘এস-এফ-আই’এর গুণ্ডা বোধিসত্ব ব্যানার্জির মাথা চাই।‘ এবং একটা নয় দু-পাশের দেয়ালে এই পোস্টার অজস্র।
আমি ততক্ষণে বেশ ভালরকম ঘাবড়ে গেছি। আমাদের ওখানেও আছে বামঘেঁসা ছাত্র ইউনিয়ন বি-এস-এ বা বিহার স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশন, আমি তার দু-একটা মীটিঙএও গেছি, কিন্তু তাতে কোনও ভয়াবহতা নেই, খুনখারাপির ধমকি তো নয়ই। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাটাই হোস্টেলে না ঢুকে তার বাঁ-দিকে ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন একটা ছোট রুমে তালা খুলে ঢুকল। কি আশ্চর্য! দেখি তালাবন্ধ ঘরের ভিতর একটি ছেলে একমনে পোস্টার এঁকে চলেছে। ‘একি রে, ওর দরকার পড়লে বাইরে যাবে কি করে?’ আমি জিগ্যেস করলাম। ‘বাথরুমের ভেতর দিয়ে দরজা আছে’, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেলাম। পাঁচ মিনিট পরে ছেলেটি উঠে চলে গেল।

‘বাঃ, তোর রুম টা তো বেশ! তবে হোস্টেলের বাইরে কেন?’ আমার প্রশ্ন।
‘আসলে আমার সিংগল সীট পাওয়ার কথা নয় সেকেণ্ড ইয়ারে। এই রুমটা ছিল লাশকাটার স্পেশ্যাল টিউটরিয়াল ক্লাশ, সেটা এখন উঠে যাওয়ায়, এটা খালি তালামারা অবস্থায় পড়ে ছিল। আমার রুম কাম এস-এফ-আই গোপন অফিস করার জন্যে দাদারা জবরদখল করে দিয়েছে এটা আমার জন্যে। তোর চিন্তা নেই, খাটিয়াটা আমার হাইটের হিসেবে ছোট পড়ে বলে আমি ডিসেকশন টেবিলটাতেই শুই।‘ কি সাংঘাতিক কথা, আতঙ্কে আমার লোম খাড়া হয়ে উঠল, লাটাইএর কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নাই।
যাক, হোস্টেলেই খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা রুমে এসে বসলাম। লাটাই শুরু করল ওর ছাত্রনেতা হয়ে ওঠার বিস্তারিত কাহিনী। ছাত্র পরিষদ অধ্যুষিত কলেজে ঢুকেই কিভাবে প্রায় জোর করে বড় একজন বামপন্থী নেতাকে ধরে সংগঠনটাকে ঢেলে সাজানো হল। চে গুয়েভারা, হো-চি-মিন্‌হ্‌ আর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার আবৃত্তি ক্লাসে-ক্লাসে শোনাতে গিয়ে একটা বিশ্রী মারামারিতে জড়িয়ে পড়া, তারপর পুলিশ কাস্টডি ও সেখান থেকে অলৌকিকভাবে ছাড়া পাওয়ার পর সিপির ছেলেমেয়েরা ক্ষেপে যায়। তখনি ঐ ‘মুণ্ডু’ চাই এর পোস্টার পড়ে দেয়ালে দেয়ালে।
- তার পরেই বুঝলি, হঠাৎ করে আমি হিরো হয়ে গেলাম। এমনকি ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরাও দেখি বেশ সমীহ করতে লেগেছে।
- কিন্তু এসব করে পড়ার ক্ষতি হচ্ছে না?
- হয়, আবার পুষিয়েও নিতে হয়। তখন রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের পড়ার স্টাইলটা কাজে আসে। ভয় একটাই, যদি কোনও সিপির হাতে পরীক্ষার কোনও খাতা যায়। মার্কামারা হয়ে গেছি কিনা!
- সে কি? প্রফেসারদের স্টুডেন্ট ইউনিয়ানের সাথে কি সম্পর্ক? তাদের তো নিরপেক্ষ থাকার কথা।
- বিশাল। পক্ষপাতিত্বের বহরটা ক্লাস করার সময়ই টের পাওয়া যায়। যাক, এখন শুয়ে পড়, কাল তো তোর আবার ইন্টারভ্যু আছে।
- ইন্টারভ্যু না, রিটেন টেস্ট। ঠিক আছে, গুডনাইট।


(২)
পরদিন সকালে চা-জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম মোয়রা স্ট্রিটে হিন্দী বয়েস হাই স্কুলে। ওখানেই হবে টেস্ট। সব শেষ হতে বিকেল চারটে। নীলরতনে ফিরতে পাঁচটা বাজল। ফিরে দেখি দরজা ভেজানো, আর আমার ভাই কমরেড লাটাই ডিসেক্‌শন টেবিলের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। আমার চেয়ে বয়েসে ছোট হলেও কলকাতার অলিগলি ওর চেনা, আর কম্যুনিজমের পাঠে আমার গুরু, যদিও জানি বঙ্গে না থাকলে এ শিক্ষা আমার কোনও কাজেই লাগবে না। আমার জ্ঞান ছিল দাস কাপিটালের সোসিও-ইকনোমিক ও সারপ্লাস ভ্যালু থিওরি থেকে কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো পর্যন্ত, অর্থাৎ যেটুকু ইকোনমিক্স আর ফিলসফিতে পড়তে হয়েছিল। সেখনেও হেগেলের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (dialectic materialism) নিয়ে এমন জগাখিচুড়ি পাকানো হয়েছিল, যে পুরো ব্যাপারটার থেকে ইন্টারেস্টটাই চলে যায়। লাটাই ওদের গ্রাসরুট কর্মী হলেও দেখি তাত্বিক ব্যাপারগুলো বেশ বোঝে, এখনকার পশ্চিমবাংলার কম্যুনিস্টদের মত শুধু যেমন-তেমন ভাবে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মাতত না। বাঁকুড়ায় থাকতে ওদের সিনিয়ার ছাত্রনেতা কমঃ শ্যামলদা, শীলাদিদের সাথে পরিচয় হয়েছিল, খুব একটা ব্যবহারিক না হলেও বেশ কিছু উচ্চস্তরের কথাবার্তার চাষ হত সেখানে, বিশেষ কিছু না বুঝলেও ভালই লাগত।
- কিরে, এই সময় ঘুমোচ্ছিস, আমার প্রশ্ন।
- না, রাতে মীটিং আছে, অনেকক্ষণ জাগতে হতে পারে, তাই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি- ওর উত্তর।
- আমি তাহলে রাত্রের বম্বে মেল বা দুন ধরে বেরিয়ে পড়ি, ভোরের আগেই ধানবাদ পৌঁছে যাব।
- আরে তুই এখন যাবি কোথায়? ভাবলাম, দু-বছর পরে দেখা, কোথায় বেশ ভাল করে আড্ডা হবে......কলেজ নেই তো?
- না, একটা গোলমালে কলেজ এখন বন্ধ, ‘সাইনে ডাই’- জানিনা কবে খুলবে।
- তাহলে আর কি? মামুকে একটা টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি, থাক এখন কদিন।
- কিন্তু আমি তো বেশী টাকাও আনি নি।
- তাহলে তো আরো ভাল। লিমিটেড টাকা দিয়ে আমরা হোস্টেলের স্টুডেন্টরা কিভাবে মাসের শেষদিনগুলো চালাই, সেটাও তোর দেখা হয়ে যাবে।
- সেকি! পিসেমশাই তোকে এত কম টাকা দেন? আমার কথায় অবিশ্বাসের ঝলক।
- না তা নয়। তবে যতই দিক, ২৩-২৪ তারিখে পকেট অবধারিতভাবে গড়ের মাঠ। তারপরেই শুরু হয় কৃচ্ছ্রসাধনের পালা - কথাটা ঠিক বললাম তো? একবার ঠেকায় পড়ে একটা ট্যুশনও ধরেছিলাম, রাজাবাজারের কাছে একটা ক্লাশ নাইনের মেয়েকে। ভাল লাগত না, পড়ানোর সময়ে একটা ভোঁদাগোছের চাকর আগাগোড়া পাহারা দিত। কিন্তু পকেটে এক্সট্রা পয়সা আসামাত্র আমার খরচাও বেড়ে গেল। তাই দুম করে ওটা দিলাম ছেড়ে। আর এখন তো এমন ব্যস্ত ট্যুশনির কথা ভাবতেও পারিনা। চল আজকে পদ্মায় ইলিশ খেয়ে আসি।
- কলকাতায় পদ্মা? ঠাট্টা করছিস!
- আরে সে পদ্মা নয়। শেয়ালদার পদ্মা হোটেল। দারুণ বানায়। তবু আমাদের হোস্টেলের মেসের থেকে বেশী খরচ পড়েনা।
- মেসে তবু তো পয়সা দিতে হবে !
- আগের থেকে বলে রাখলে লাগে না। এখন থেকে জানুয়ারির বাকি কটা দিন বাইরে খাওয়া যাবে। আরে.........বলেই কিছুক্ষণ ‘পজ’ দিয়ে ওর মনে পড়ল-‘তুই যাবি কোথায়? আজ বইমেলা শুরু হয়েছে......থেকে যা দুটো দিন’।

এরপর তো আমার আর চলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কলকাতা সম্বন্ধে একটা ‘ফোবিয়া’ ছিল মনে মনে, কখনও থাকতে চাইতাম না। কিন্তু এখন লাটাই আছে, ভয় কি? ন’টা নাগাদ পদ্মা হোটেল থেকে গরম গরম ভাপা ইলিশ-ভাত খেয়ে এলাম। বাজারে এখন ইলিশ দুষ্প্রাপ্য, তবু ওরা কোত্থেকে জোটায় কে জানে! শেয়ালদা স্টেশন থেকে আচার্য জগদীশ বসু বা লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে ঘিঞ্জি বাজার, সেখানেই গঙ্গা-মেঘনা-পদ্মা-ইস্টবেঙ্গল-অশোক নানা নামের ছোট-বড় ভাতের হোটেল আর অজস্র সস্তার লজ ছিল, এখনও আছে। তখন রাজাবাজার-থেকে শেয়ালদা হয়ে পার্ক সার্কাসের ট্রামলাইন বন্ধ, অথচ ফ্লাইওভারটাও চালু হয় নি। বিশ্রী অবস্থা একেবারে। তবু ভাগ্যিস বর্ষাকাল ছিলনা।
ঠিক সাড়ে নটায় এস-এফ-আইএর মেম্বাররা আসতে শুরু করল লাটাইএর রুমে, বেশী নয়, কোর কমিটি (আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম পলিটব্যুরো)র ছ-সাতজন মোটে। দুরূহ কার্যপ্রণালী নিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় তুমূল তর্কবিতর্ক চলল ঘণ্টাদুয়েক ধরে। যেটুকু বোঝা গেল, লাটাইকে ওরা জি-এসের জন্যে দাঁড় করাতে চায়, আর নতুন যে ছাত্রছাত্রীর দলটা এসেছে তাদের ব্রেনওয়াশটা কিভাবে হবে তার প্ল্যানিং করতে হবে। উপায়ান্তর ছিল না, আমিও নির্লিপ্ত মুখ করে শুনে গেলাম।


(৩)

মেম্বারদের যেতে যেতে প্রায় বারোটা। ভাবলাম এবার ঘুমনো যাবে। হঠাৎ লাটাই বলল, তোর তো বাংলা হাতের লেখা ভালই, ছবিও আঁকতিস ছোটতে, টা পোস্টার আঁকতে পারবি না। হায়রে, হাতের লেখা ভাল হওয়ার শেষে কিনা এই পুরস্কার! কি আর করা যায়, পড়েছি মোগলের হাতে! রাত্রি বারোটায় এস-এফ-আইএর পোস্টার আঁকতে বসলাম দুজনে।। দেড়টা নাগাদ খুব ঘুম পেতে লাগল। লাটাই প্রস্তাব দিল, , চা খেয়ে আসি।


চা- রাত দেড়টায়? মেট্রো লাইফ কাকে বলে তখনও আমার ঠিক জানা ছিল না। গেটের বাইরে এসে দেখি, নীরসের কম্পাউণ্ড ওয়াল ঘেঁষে অজস্র চা-পাউঁরুটি-ফলের দোকান, খেয়াল পড়ল, আরে এটা তো বড় হাসপাতালও বটে। হস্টেলের ছাত্র, নাইট শিফ্‌টের হাউস-স্টাফ, রোগীদের আত্মীয়স্বজন, শেয়ালদার প্যাসেঞ্জার, হকার- কারা চা খাচ্ছে না।
তবু বেশীক্ষণ জাগা গেল না। আড়াইটে নাগাদ কাজ যেটুকু পারা গেল করে আমরা শুয়ে পড়লাম, সাথে সাথেই ঘুম।
পরদিন আটটায় ঘুম ভাঙল। খিদেও পেয়েছিল। একে গঙ্গার হাওয়া, তায় গোটাদিন টো-টো। গেটের সামনের হোটেল থেকে দুজনে চা-সিঙ্গাড়া-জিলিপি খেয়ে এলাম।
-
এখন তো এখানে কোনও কাজ নেই। চবইমেলা ঘুরে আসি।
-
কিন্তু কি বই কিনব, তাছাড়া টাকাও তো গোনাগুনতি।
-
আরে, বইমেলা যাওয়ার সাথে বইকেনার কি সম্বন্ধ। গতবছর থেকে জাস্ট শুরু হয়েছে, অল ইণ্ডিয়ায় এরকম আর কোথাও পাবিনা।
-
ঠিক আছে।
-
তাহলে চানটা সেরে নে, আমি পোস্টার যে কটা হয়েছে, ডিসপ্লের জন্যে দিয়ে আসি।
লাটাই পোস্টারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল।


ময়দানের মেলায় সেবার বা সেদিনের জন্যেই বুঝি এন্ট্রি ফ্রী ছিল। রবিবার বলে বিশাল ভীড়। পেছন পেছন আসছে একটা মেয়েদের দঙ্গল। একটা চেনা গলা মনে হতেই পেছন ফিরে দেখি আমার আরেক কাজিন, পিসতুত বোন সুজয়া। লেডি ব্রাবোর্ণে বিএ পড়ে হোস্টেলে থেকে। ওর কথা আমার মাথাতেই ছিল না, হোস্টেলের বান্ধবীদের সাথে ছুটির দিনে বইমেলা বেড়াতে এসেছে, খুব খুশী আমাদের দেখতে পেয়ে। তখন শুধু আমার কেন, কলকাতারও বেশীরভাগ বাসিন্দার কাছেই বইমেলার ঠিক স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবু ভীড় হয়েছিল দেখবার মত। যাঁরা বই লেখেন, তাঁরা যে রক্তমাংসের মানুষ এবং তাঁদেরও যে চর্মচক্ষে দেখা যায় এ ধারণাই তখনও হয়নি। এর আগে নামকরা সাহিত্যিকদের মধ্যে শুধু আশুতোষ আর শংকরকে দেখেছিলাম। এবার তো গীল্ডের টেন্টে গিয়ে দেখি চাঁদের হাট বসে গেছে। আশাপূর্ণা দেবীকে জ্ঞানপীঠ (যদিও সেটা উনি ৭৬এই পেয়েছিলেন) পাওয়া নিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, সুনীল-বুদ্ধদেব গুহ আছেন, বোধহয় বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবি-সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় ছিলেন সভাপতি। আমাদের হাতে অত সময় ছিলনা, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম কফি খাওয়ার জন্যে। একফাঁকে খাওয়া-দাওয়াটাও আমরা সেরে নিলাম বইমেলার ক্যাণ্টিন থেকে। গণশক্তির একজন সহ-সম্পাদকের সাথে লাটাই খুব জমে গেছে দেখলাম, তিনিই আমাদের দোসা খাইয়ে দিলেন নিজের পকেট থেকে খরচা করে। কিছু বইও কেনা হল, বিশেষ করে লিট্‌ল ম্যাগাজিন জিনিষটা আমার খুব ভাল লেগে গেছিল। বেশ উচ্চস্তরের লেখা, দামও কম, অথচ লোকে দেখে চলে যাচ্ছে, খুব একটা কিনছে না। বুঝলাম, নামী লোকেদের দামি বইই বাজারে কাটে, বাকি সব পোকায়।

সেখান থেকে আকাদেমি হলে নাটক। কি একটা লেফ্‌টি গ্রুপের করা ইবসেনের ডলস্‌ হাউসছিল বলে এন্ট্রি ফ্রী ছিল, অথচ তেমন ভীড় ছিল না। বুঝলাম বঙ্গে বামপন্থীদের পায়ের তলার জমি ক্রমশঃই শক্ত হচ্ছে।
রাত্রে ফেরার সময় আমরা ফতুর। একটা বাসে উঠে পড়লাম ও কণ্ডাক্টার ভাড়া চাইবার আগেই ধর্মতলা-ওয়েলিংটনে নেমে পড়লাম। বীফ খাস’, লাটাই জানতে চাইল। না রে, ওইটা এখনও অভ্যেস করিনি। তুই খাস নাকি?’ আমি বললাম।
-
এখনও শুরু করিনি। বাঁকুড়ায় সুযোগ ছিল না। কিন্তু বীফ না খেলে পাকা কম্যুনিস্ট হওয়া যায় না বলে শুনেছি, দেখি একদিন শুরু করব। যে কোনও মাংসের থেকে অনেকটা শস্তা পড়ে। চল আজ ফুটপাথের রুটি খাওয়া যাক।
মাত্র দেড় টাকায় ছটা রুটি, ডাল আর আলু-পেঁয়াজের তরকারি । তার পরেও বিহারি স্টল ওয়ালাটি নিজের লাভ রাখে, ভাবা যায়? আর ক্ষিধের মুখে অসাধারণ স্বাদ- মশলা বলতে তো শুধু একটুকরো হিং আর পাঁচফোড়ন।

অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরদিন সকালে ধানবাদ ফিরে গেলাম।


(৪)

আরেকটা পর্ব না লিখলে আমার নীরস অধ্যায় শেষ হয়না। সে বছর, অর্থাৎ ১৯৮১র গরমের ছুটিতে লাটাই এসেছিল আমাদের বাড়ি। আমাকে যাবার সময় বার বার করে বলে গেল কলকাতা গেলেই ওর হোস্টেলে যেন উঠি। এবার ও জি-এস হয়ে গেছে, আর পোস্টার লিখতে হবে না। আমার অবশ্য পোস্টারে নয়, ভয় ছিল ওর মড়া কাটা তক্তপোষটিতে, যদি একা ও ঘরে কখনও শুতে হয় তাহলেই গেছি!

তবে অদৃষ্টে যোগ একটা ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে একটা ইন্টারভিউ পড়ল কলকাতায়। লাটাইকে লিখতেই ও আগের দিনের জম্মু- তাওয়াইয়ে যেতে লিখে দিল। বলল, চলে অ্যায় একটা সারপ্রাইজ আছে।
পরদিন জানা গেল কি সেই সারপ্রাইজ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের আই-এফ-এ শীল্ডের ফাইনাল। ময়দানে মোহনবাগান-এরিয়ান্স মাঠে বিকেল সাড়ে চারটে থেকে। আমার ইন্তারভিউ ছিল ক্যামাক স্ট্রীটের ইন্ডাস্ট্রি হাউসে। ঠিক হল, ও তিনটে নাগাদ থিয়েটার রোডের মুখে চলে আসবে, সেখান থেকে আমরা একসাথে যাব।
সেটা বোধহয় ২৬শে সেপ্টেম্বর ছিল। আমার বেরোতে বেরোতে সাড়ে তিনটে হয়ে গেল। থিয়েটার রোডের মুখে লাটাইএর সাথে দেখা। ছোট, ছোট। খেলা সাড়ে চারটে থেকে আর এখন জাস্ট সাড়ে তিন। এত তাড়ার কি আছে? আমি যতদূর জানি পার্টিরই এক দাদা দুটো কমপ্লিমেন্টারি টিকিট দিয়ে গেছে ওকে, সুতরাং টিকিট কাটারও কোনও ঝামেলা নেই।
- বুঝতে পারছিস না, মোহনবাগান স্ট্যাণ্ড ভরে গেলেই বিপদ, তখন বসতে হবে ইষ্টবেঙ্গলের সাপোর্টারদের সাথে। এবং যেখানে বাঘের ভয় ঠিক সেখানেই সন্ধ্যেটা হল।

বিপদটা তখনও আমার মাথায় ঢোকেনি ঠিকমত। ঠিক আছে, আমরা দুজনেই নাহয় মোহনবাগানের সাপোর্টার, নাহয় ইস্টবেঙ্গলের লোকেদের সাথে বসলামই। খেলা দেখার কি অসুবিধে তাতে? তবে ব্যাপারটা টের পেলাম খেলা শুরু হতেই। মোহনবাগান একটা ভাল মুভ করছে- চেঁচাবার উপায় নেই! শ্যাম থাপা একটা বাইসাইকেল করেছে, কি প্রদীপ চৌধুরী একটা দারুণ শট নিয়েছে। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছি, পেছন থেকে এক ঠেলা। ‘করছিস কি, বসে পড়। মনে রাখ, তুই এখন ইস্টবেঙ্গল’, লাটাই আমাকে চুপি-চুপি জ্ঞান দিল।
ইতিমধ্যে মোহনবাগানের অরূপ দাস একটা গোল করল। দেখি মোহনবাগান গ্যালারিতে সবাই নাচানাচি করছে, কিন্তু আমাদের উপায় নেই- মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে হচ্ছে। কলকাতার ক্রিকেটের দর্শকদের স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের এত প্রশংসা করে সবাই, কিন্তু ফুটবলে, বিশেষ করে তিন প্রধানের খেলা থাকলে তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যেত না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গলের সোমনাথ ব্যানার্জি গোল শোধ দিল, আর হাফ-টাইমের পরেই চন্দ্রবাহাদুর থাপা চমৎকার বানানা কিকে ওদেরকে এগিয়ে দিল। আমার খেয়াল ছিল না, লাটাই ইশারা করল, দেখছিস কি, নাচ। না নাচলেই ধাক্কা মেরে গ্যালারি থেকে ফেলে দেবে হয়ত। অগত্যা অনিচ্ছাসত্বেও ধেই ধেই করে কিছুক্ষণ লাফাতে হল। হঠাৎ দেখি সামনে দিয়ে একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোককে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হল। একটি ছেলে কিছুক্ষণ আগেই নাচছিল, হঠাৎ ‘বাবা’ বলেই গ্যালারি থেকে নেমেই পড়ি কি মরি করে ছুটল ওদের পেছনে। ব্যাপারটা জানা গেল পরদিনের কাগজ পড়ে। নগেন দে নামে এক মধ্যবয়স্ক মোহনবাগান সাপোর্টার ইস্টবেঙ্গল এক গোলে এগিয়ে যাওয়া মাত্র শোকের ধাক্কায় করোনারি অ্যাটাকে মারা যান, ছেলে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার তখন অন্য গ্যালারিতে নাচছে! এই ছিল কলকাতার ফুটবল। মফঃস্বলের মানুষ আমি, এ উন্মাদনা কোথায় পাব!
তবে আমাদিগকেও হতাশ হয়ে ফিরতে হয় নি । মোহনবাগানের ফ্রান্সিস ডিসুজা শেষ মুহূর্তের গোলে সমতা ফিরিয়ে আনেন ও টাই ব্রেকারের সিস্টেম না থাকায়, দু-দলকেই যুগ্ম বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বেচারা নগেনবাবু জেনে গেলেন না যে তাঁর মোহনবাগান হারে নি।


- কি রে আজ কোথায় খাবি, লাটাই যেতে যেতে শুধোয়। আমার তো মাসের শেষ সপ্তাহ, ধর্মতলা না শেয়ালদা?
- আজকে চাং হোয়া, আমার পকেট বোঝাই আজ। কয়েকমাস একটা ট্যুশনি করেছিলাম, বাবার হোটেলে খাই, প্রায় সব টাকাটাই জমেছে।
- হুররে, ডি লা গ্রাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস......বলে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল লাটাই, না, টেনিদা ধারে কাছে নেই।
- ইয়াক ইয়াক। আমি বলে উঠলাম।
আমরা দুজনেই হঠাৎ ভুলে গেছি যে আমরা হাইস্কুলের নই, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।


(শেষ)

বাংলা অণুগল্প ৩৮ - মহাজন

মহাজন ।।


'অমাবস্যার রাতে হ'ল চাঁদের পোয়াবারো,
ধর ধর ত বলে সবাই, সাধ্য থাকলে ধরো!'
আরে না না, এটা মোটেও কোনও পাগলের প্রলাপ নয়। এ হল কেওটিয়া গ্রামের প্রচলিত স্থানীয় ছড়া, কোনও অজানা গ্রাম্য কবির রচনা। কেওটিয়া হল কেওট অর্থাৎ কৈবর্তপ্রধান গ্রাম, তাদের মধ্যেই শ্রীমান চন্দ্রবদন ধর ওরফে চাঁদ ধর কিভাবে জানিনা পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে নিশিকুটুম্বিতাকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে তার জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী পর্যায়ে উঠে গেছিল। রাতের, বিশেষ করে অমাবস্যার অন্ধকারে নেংটি পরা তেল চুপচুপে কালো শরীরটাকে দেখার ভাগ্য আশপাশের পাঁচটা গ্রামের লোকেদের খুব একটা না হয়ে উঠলেও তার হাতের কাজের প্রশংসা বা নিন্দা লুণ্ঠিত গৃহকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশের বড়কর্তা পর্যন্ত করতে বাধ্য হতেন।
তা এই স্বনামধন্য চন্দ্রবদন একটি জায়গায় এখনও সুবিধে করে উঠতে পারেনি, সে হল কালবোসে গ্রামের বণিকপ্রধান অতুল্য সাহার বাসা। সাহামশায়ের মহাজনী কারবার, টাকার লেখাজোখা নেই। স্বামী-স্ত্রীর সংসার, শোনা যায় খাওয়ার মুখ বাড়বে বলে ছেলেপুলের ঝামেলাতেই যাননি অতুল্য সাহা। তাই আশেপাশের দশটা গ্রামে হাড়কঞ্জুষ আর অপয়া বলে তিনি বিখ্যাত, তবে বিচলিত নন একফোঁটাও। বলা বাহুল্য বাড়ীতে চাকর-বাকরের সংখ্যাও অপ্রতুল। তাই এক অমানিশার শুভলগ্ন দেখে কালবোসে গ্রামের সাহাবাড়িতে পড়ল চাঁদের পায়ের ধূলো। এ অঞ্চলের প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী চাঁদের সিঁদকাঠি আলাদিনের জিনের থেকেও দ্রুত ও নিঃশব্দে কাজ করে। আধঘণ্টার মধ্যেই সে বাইরে থেকে সটান ঢুকে পড়ল সাহামশায়ের পালংকের তলায়। কিন্তু একি! সাহামশাই আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই জেগে, এত রাতে- এমনটাতো সে আশা করেনি। কি আর করা যায়, চুপচাপ সে গর্তের মধ্যে শরীরটা ঢুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে করতে তাদের কথা শুনতে লাগল।
- হ্যাঁগা, আমি বলচি তুমি আরেকটা বিয়ে কর। আমার আর কিচু হবেনা বুজতে পেরেচি, তোমার পরকালের তো একটা হিল্লে হোক। তাছাড়া এতো সম্পত্তি আমরা ম'লে আর কোন কাজে লাগবে? সাহা-গিন্নীর সকরুণ উক্তি শুনতে পায় চাঁদ। এরপরেই আসে সাহামশায়ের উত্তর।
- সে চেষ্টা কি আমি করিনি, তুমি মনখারাপ কোরনা গিন্নি। ডাক্তার দেখিয়েছি শহরে গিয়ে। দোষটা ত তোমার নয়, আমারই। কি লাভ, আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে?
- তাইলে একটা দত্তক নাও। তোমায় লোকে হাড়-কিপ্টে, অপয়া বলে, আমার মোটেও ভাল্লাগে না।
- তাহলে তোমাকে লোকে বাঁজ বলবে, গিন্নি। আর সেটা শুধু তোমার কেন, আমারও কি শুনতে ভাল লাগবে? মরদের দোষে ছেলেপুলে হচ্ছেনা, এ কথা গাঁয়ের লোকে বিশ্বাস করবে ভেবেছ বুঝি!
- কিন্তু এই বিষয়-আশয় আমরা গেলে আর কি কাজে আসবে শুনি, ও ত পাঁচ ভূতে লুটে খাবে!
- সম্পত্তি কি গো! একটু যেন কাষ্ঠহাসি হাসলেন সাহামশাই। কলকেতায় যে ডাক্তারের কাছে গিছলাম, বুঝলে গিন্নি, সে নাকি মস্ত রিসাচ করছে যাতে কিনা বাঁজা মাগ-ভাতারেরও ছেলেপুলে হবে। তার কাজটি আমার বড় ভাল লাগল, তবে এই রিসাচ না কি যেন- বড় খরচের কাজ। কাউকে বোলোনা তাকে আমি মাসে মাসে পাঁচশো টাকা বরাদ্দ করে এসেছি। আমাদের যা হয় হবে, আহা, ভবিষ্যতের বাঁজা বউদের একটা হিল্লে হোক।
ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে চাঁদ। সে তস্কর হয়েও মানব-চরিত্রের বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আজ মহাজ্ঞানী। আর তার চোখে অতুল্য সাহা আজ সত্যিকারের মহাজন, মনে মনে তাঁকে প্রণাম জানাল চন্দ্রবদন। আজ আকাশে চাঁদও নেই, তাই এ ঘটনার কোনও সাক্ষী রইল না।


মুম্বাই, ১৪ই জানুয়ারি, ২০১৫।

বাংলা অণুগল্প ৩৭ - ঘোগ (অফিসের গল্প- ৪)

ঘোগ


সবে এসে বসেছি অফিসে, চিফ ইঞ্জিনিয়ার বনিক সায়েবের ফোন। 'মুখার্জি, তোমার ওয়ার্কশপের কয়েকটা কন্টিঞ্জেন্ট ছেলেকে পাঠিয়ে দাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, জি-এম ড্রিলিঙএর বাংলোয়, আর্জেন্ট।'
জানতাম এই কাজটাও করতে হবে। রেগুলার ওয়ার্কাররা পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে, সমস্ত হ্যাপা পোয়াতে হয় ওই জনা পাঁচ-ছয় অস্থায়ী কর্মীদেরকে। তার উপর এই সব বরাত। কেউ গাড়ি নিয়ে আসে ধোওয়াবার জন্যে, কখনও ক্রিসমাস পার্টির জন্যে ক্লাব সাজানোর লোক চাই। সবাইকে খুশী করে সাইটের থেকে আসা যন্ত্রপাতিগুলো সারানোর দায়িত্ব, একেবারে থ্যাঙ্কলেস জব!
- দাদা, আজ ষোলো নম্বরে টুল পাঠাতে হবে, নইলে শাট ডাউন। আমি বারোটা নাগাদ নিজে ওদের নিয়ে পৌঁছে যাব, চিন্তা নেই- আমাকে বলতেই হল।

এসে দেখি এলাহি কাণ্ড। জি-এম দত্তসাহেব মাস-দুই হল বদলি হয়ে পণ্ডিচেরির এই অফিসে এসেছেন। প্রচণ্ড রাগী মানুষ, আমরা আড়ালে 'রয়াল বেঙ্গল টাইগার' বলেই ডাকতাম। এর আগে যাঁরা ছিলেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর চক্কোরে তাঁদের কেউই পরিবার নিয়ে আসেননি। ইনিও মাস দুই একাই ছিলেন, তবে বাঙালির পেট তো, ক্যাণ্টিনের আর হোটেলের মাদ্রাজি খাবার টানতে পারলেন না বেশিদিন, আজ ওঁর স্ত্রী এসে পৌঁছেছেন, সাথে বেশ কিছু মালপত্র। এতদিনের ব্যাচেলার রেসিডেন্সে ফ্যামিলি নিয়ে থাকতে হলে যা হয়, যাবতীয় অনাবশ্যক আবর্জনা ক্লিয়ার করতে হবে এখন, ছেলেরা লেগে পড়ল। আমিও সুযোগ বুঝে লাঞ্চ সারতে বাসায় চলে এলাম।
ফিরে এসে দেখি বণিকও এসে পড়েছেন, ছেলেরা হল, বেডরুম পরিষ্কার করে লফ্‌টের উপর উঠেছে। দেখি মিঃ ও মিসেস দত্ত দুজনের মুখই হাঁড়ি। কি হল আবার কে জানে! এদিকে লফ্‌টের উপর থেকে বেরোচ্ছে একের পর এক খালি বোতল, নানা ব্র্যাণ্ডের নানা মালের। আমি আর বণিক সাহেব মুগ্ধ হয়ে বোতল দেখছি, 'এত বোতল', বণিক অবাক হয়ে বললেন। হঠাৎ কি ভেবে নিজের অসামান্য জেনারেল নলেজের পরিচয় দিতে আমি বলে উঠলাম, 'দেখুন স্যার, ওই ওয়াইনের বোতলগুলো ডিমেলো সায়েবের, ওঁর গোয়ার পোর্ট ছাড়া চলত না। ভাল স্কচগুলো চোপড়া সাহেবের আর ওই দেশীগুলো করুণাকরণের। কয়েকটা বিয়ারের বোতলও দেখছি, ওগুলো নিশ্চয় মিঃ নাম্বুদ্রিপাদের, তবে উনি খেতেন না, বোধহয় গেস্টদের জন্যে আনাতেন। আমি তো পেছনের বাড়িতেই থাকি, সবই প্রায় দেখা যেত।'
এইবার দত্তসায়েবের মুখে কথা ফুটল। বেশ ঝাঁঝের সাথে উনি শ্রীমতিকে বললেন, 'দেখ, এবার বিশ্বাস হল? বলছি, আমি সবে দু'মাস এসেছি, এর মধ্যে হার্ডলি ছ-সাতটা শনিবার ড্রিঙ্ক করেছি। বোলোনা, মুখার্জিকে আমি শিখিয়ে দিয়েছি এসব বলতে!' 'তোমার প্রমোশন এবার আটকায় কে'- বণিক একফাঁকে চুপিচুপি আমাকে বললেন।
কি বললেন, প্রমোশন হয়েছিল কিনা? সে এক অন্য কাহিনী, পরে শোনানো যাবে।

কুয়েত, ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৪।

বাংলা অণুগল্প ৩৬ - স্বর্গীয় ব্যাপার

স্বর্গীয় ব্যাপার ।।


শিবঠাকুরের অসম্ভব মাথাব্যথা। ব্রেনে শর্ট-সার্কিট হয়েছে, অশ্বিনীকুমাররা মত দিলেন, ব্রেন অপারেশন করতে হবে। তবে সে তো আর স্বর্গের হাসপাতালে হবে না, সেখানে একটা স্টেথো আর প্রেসার মাপার যন্ত্র ছাড়া যে আর কিছুই নেই। 'এই, যা তো রে, মর্ত্য থেকে একটা ভাল ডাক্তার ধরে নিয়ে আয়', শিবঠাকুর নন্দীকে আদেশ দিলেন। 'কিন্তু গুরুদেব, ভাল ডাক্তার চিনব কি করে', নন্দীর প্রশ্ন। 'আরে ব্যাটা রুগীর ভীড় দেখলেই বুঝবি, কি গুরু, ঠিক বলিনি', ভৃঙ্গি শুধোয়।
- তোরা দুটোই গাড়ল। দাঁড়া, আমি তোকে একটা দিব্যদৃষ্টি দিচ্ছি। গিয়েই ডাক্তারের চেম্বারের কোনাটা দেখবি, ওর হাতে যে রোগীরা মরেছে তাদের ছায়াশরীর দেখতে পাবি সেখানে। সেই দেখে হিসেবেমত একটা ডাক্তার নিয়ে আসিস।

ঘন্টাদুয়েক পরে নন্দী ফিরল একটি ছোকরামত ডাক্তারকে নিয়ে। 'একিরে, এ কাকে নিয়ে এলি', শিবঠাকুর শুধোন, 'এর গায়ে তো এখনও মেডিক্যাল কলেজের স্টাফ নার্সদের জামায় লাগা পারফিয়ুমের গন্ধ লেগে! কি হে, ইন্টার্নশিপ শেষ করেছ তো?'
- গুরু সব ডাক্তারের চেম্বারেই দেখি মরা রুগীদের ভীড়। এর ওখানে মাত্র দুটো ছিল- নন্দী বলে।
- আজ্ঞে, কালকেই ইন্টার্নি শেষ করে ডাক্তারি শুরু করেছি, তাই এখনও বেশী রুগী মারতে পারিনি- ডাক্তারের সলজ্জ উত্তর। তা মশায়ের নামটা.....অদ্ভুত ড্রেস করেছেন, যাত্রাপালায় অভিনয় করতে যাচ্ছিলেন বুঝি?
- অ্যাই, চোপরাও। আমি শিব।
- চোখ রাঙাবেন না, আমি নীরস মেডিক্যাল কলেজে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সেক্রেটারি ছিলাম। কি আমার ভি-আই-পি রে, ওইটুকু নামেই চিনবে লোকে। আপনি কি মদন-মুকুল-মমতা যে একডাকে চিনবে সবাই? পুরো নাম বলুন।
- মদন? সে তো পুড়ে ছাই কোনকালে। আমার পুরো নাম শিবচন্দ্র দেবাদিদেব মহাদেব মহেশ্বর।
- বাপ্‌স্‌, এ যে রেলগাড়ি! মাথার কোথায় ব্যথা? ব্রহ্মতালুতে? প্রেসার তো অ্যাবনর্মালি হাই! হুম যা ভেবেছি। এ ঠিক ড্রাগের রি-অ্যাকশন। কি খান? চণ্ডু, চরস না ব্রাউন সুগার?
- ক্যানো, তাতে তোমার কি হে ছোকরা, নিজের পয়সায় খাই।
- আমার যা মনে হচ্ছে গাঁজার ধোঁয়া ব্রহ্মতালুতে উঠে আটকে গেছে, বেরোবার রাস্তা পাচ্ছে না। এই যে শিববাবু, শুনুন, ওসব নিষিদ্ধ ড্রাগ বন্ধ করুন। নতুন সরকার আসায় সাধু-সন্ন্যাসিদের তো এখন পোয়াবারো। যা খুশী তাই চলছে খুলে-আম! এই যে, ছ'মাস এ সব বন্ধ না রাখলে কিন্তু তালু ফটাস! আমার হাতে তখন তিন নম্বর হয়ে যাবেন।
- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। ওরে ভিরিঙ্গি, ব্যাটা ওকে ভিজিটটা দিয়ে এবার বিদেয় কর।
খানিকক্ষণ পরে শিব তখনও ফুঁসছেন। হুঁ, ডাক্তার না আরো কিছু! এসেছে আমাকে মদনার গল্প শোনাতে যাকে আমি কোনকালে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছি, তা নিয়ে কুমারসম্ভব-টম্ভভ কি সব লেখাও হয়ে গেল মর্ত্যে! যাকগে, মাথাটা ছেড়েছে মনে হচ্ছে। ওরে নন্দি, এক ছিলিম সাজা বাপ আমার!

২৯শে নভেম্বর, ২০১৪।

বাংলা অণুগল্প ৩৫ - সন্দেহ

সন্দেহ ।।

বুকের ব্যথাটা বাড়ছেই অধিরথবাবুর । এই সময়টা যদি মনুকে কাছে পাওয়া যেত। অধিরথ জানেন যে তার উপায় নেই। মনু, মানে মনোরমা তাঁকে আর ভালবাসে না, সে এখন অন্য ঘরে বসে উপন্যাস পড়ছে। ছেলে হস্টেলে চলে যাবার পর স্ত্রীকে যতটা কাছে পাবেন ভেবেছিলেন, হয়েছে ঠিক তার উলটো। তাঁর ধারণা, একজন তৃতীয় ব্যক্তি নিশ্চয় এসেছে তাঁদের মাঝে যার জন্যে মনু তাঁকে আজকাল এড়িয়ে চলে। ওই লোকটাকে হাতে নাতে না ধরা পর্যন্ত শান্তি নেই অধিরথের।
এইত, এখন মনে হচ্ছে ব্যথাটা অনেকটা কমেছে। নাঃ, সরবিট্রেট ছাড়াই কাজ হয়েছে। রাত খুব একটা বেশী হয়নি, যাই চারপাশটা একটু বেড়িয়ে আসি, অধিরথ ভাবলেন। একটু পায়চারি করলে শরীর-মন দুটোই ভাল থাকবে। মনু বই রেখে বেডরুমের দিকে গেল, বাইরে যেতে যেতেই তিনি দেখলেন।
রাস্তাঘাট ফাঁকাই ছিল, দ্রুত এক চক্কর মেরে আধঘণ্টার মধ্যেই তিনি বাসায় ফিরলেন। শোবার ঘরে গিয়ে দেখেন, একি! তাঁর বিছানায় কে শুয়ে আছে? মনোরমা লোকটার মুখের উপর ঝুঁকে পাগলের মত তাকে ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে! এইত, আজ বাছাধন ধরা পড়েছ, এইবার দেখ কি করি। সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেছি, এরই ফাঁকে...বলিহারি সাহস মনোরমার! দাঁড়াও, আগে চাঁদমুখটি দেখি অতিথি মহাশয়ের ।

ঐ ত, মনু লোকটার বুক থেকে উঠে পড়েছে, ফোনে ডায়াল করে কাকে যেন ধরার চেষ্টা করছে। আরে যাচ্চলে, লোকটা ত তার বিছানায় ধুমিয়ে পড়েছে, একেবারে নিঃসাড়। মুখটা কিন্তু খুব চেনা চেনা লাগছে। বাঁদিকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা চোখে পড়ল। যা ভেবেছিল, কোন প্রতিবিম্বই নেই তাতে।

মুম্বাই, ২৮শে নভেম্বর, ২০১৪ ।