কস্তে পুত্র: ||
(গল্প)
রিটায়ার করার পর মানুষটা বড় একা হয়ে গেছেন।
অবশ্য আগেও যে খুব একটা মিশুকে ছিলেন ছাতুবাবু তা নয়। হ্যাঁ, ছাতুবাবু নামেই তাঁকে ডাকে পাড়ার লোক। আসল নাম সত্যেন পান্ডে লোকে বোধহয় ভুলেই গেছে। বিয়ে করেননি বলে যে তাঁর খুব একটা একাকিত্ব বোধ ছিল তা মনে হয় না, তবু কি অপত্য-স্নেহবঞ্চিত বুকের কোথাও একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগেনা কখনো জীবনের এই সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়িয়ে? উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার মানুষ, সেই কোনকালে মহাজনের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। শেয়ালদা স্টেশনে কুলিগিরি করে আর অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সে যুগে। তারপর হাওড়ার বি-এন-আরের শালিমার ইয়ার্ডে ছোট্ট একটা চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে শেষে মুম্বাই। সেন্ট্রাল রেলের প্যারেল ইয়ার্ডে ইয়ার্ড-মাস্টারি করেই তো কেটে গেল চাকরি জীবনের শেষ বারোটা বছর। ভোজপুরি আর হিন্দি ছাড়াও বাংলাটা ভালই শিখেছিলেন, এখন কিছুটা ইংরেজি আর মরাঠিও বলতে পারেন। তবে রিটায়ার করেও একটা নেশা যায়নি। সকালে ছিঁড়ে-ছাতু সহযোগে জলপান সেরে হিন্দু কলোনির ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িটা থেকে রোজ বেলা দশটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন দাদার স্টেশনে। সেখানে দেশোয়ালি কুলিদের সাথে বসে টানা একঘন্টা তাদেরকে তুলসীর রামায়ণ আর দোহা শোনান, এমন মুগ্ধ শ্রোতা মুম্বাইয়ে পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না!
কিন্তু তারপর? সারা দিনটা যে পড়ে থাকে কর্মহীন অবসরের জন্যে, তার তো অভ্যেস ছিল না তাঁর। ওয়াডালা স্টেশনের ধারে বাচ্চাদের একট স্কুল আছে, বলা বাহুল্য, অবৈতনিক- ভিখারী-কুলি-মজুর আর কিছু নিম্নশ্রেনীর বারাঙ্গনাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। তিনি কদিন গিয়ে তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে হিন্দি পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় নেতার ভয় হল, তিনি বুঝি ভোটে দাঁড়াতে চান- তাই গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁকে তাড়ানো হলো। নেতাকেও দোষ দেওয়া যায় না, বিনা স্বার্থে কেউ কিছু করতে চায়, এই সত্যি কথাটা এযুগে বসে তাঁর হজম হবে কেন? তাছাড়া তিনি আবার সে স্কুলের বোর্ড প্রেসিডেন্ট!
সেদিন সকাল থেকে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়লেও ছাতুবাবুর রুটিনের অন্যথা হয়নি। কিন্তু এগারোটা বাজতে চলল, কুলিভাইদের কারো দেখা নেই কেন? একটু খোঁজ নিতেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। তিন নম্বর আপ কলকাতা-এলাহাবাদ-মুম্বাই মেল এক নম্বরের জায়গায় চারে আসছে, তাই সব ব্যাটা দৌড় দিয়েছে সেদিকে। ওই তো গাড়ি ঢুকছে চার নম্বরে, তিনিও কি ভেবে ফুট ওভারব্রিজে উঠে পড়লেন। ছাতুবাবু রিটায়ার করেছেন বটে, তবে তাঁর কাছে প্ল্যাটফর্ম টিকিট চায় এমন রেলকর্মী কেউ নেই এ স্টেশনে।
গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে চলেও গেছে। এখানে কেউ খামোখা বসে থাকে না। 'সময় হল, সময় হল, যে যার আপন বোঝা তোলো' বলে কুলিরা কেটে পড়েছে। কিন্তু যারা প্যাসেঞ্জার পায়নি তারা আবার ওই হুইলারের স্টলটার সামনে দাঁড়িয়ে কিসের জটলা করছে? এরকম তো কথা ছিল না। ছাতুবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। হায় রাম, এই কান্ড! এক ষাটোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ি নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা কুলিদের মুখের সামনে একটা কাগজ নেড়ে ক্রমাগত কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে। কুলিদের কাজ কাগজ নিয়ে মাথা ঘামানো নয়, তারা মাল তুলতে পারলেই খুশি। তিনি এগিয়ে যেতেই ওরা সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিল। তাঁকে দেখেই বুড়ো-বুড়ি কেঁদে ফেলল। বুড়ো লোকটি হাউমাউ করে বাংলায় যা বলতে লাগলো তার অর্থ মোটামুটি এই বোঝা গেল যে, তাদের বড় ছেলে তাদেরকে বর্ধমানে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে বোম্বাইএ কাজ করে, তার দাদার স্টেশনে মা-বাপকে নিতে আসার কথা, কিন্তু এখানে নেমে অবধি কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষাও কেউ বোঝে না, ওরা নিজেরাও গাঁয়ের মানুষ, বাংলা ছাড়া কিছু জানে না।
'রুকিয়ে, রুকিয়ে, বাবুজি, আপনার হাথে উটা কিসের কাগজ?' ছাতুবাবু জানতে চাইলেন।
'এই দেখো, এটাই তো দেখাতে চাইছিলাম আপনাদের এতক্ষণ। আমার ছোটছেলে ব্যস্ত মানুষ, যদি না আসতে পারে, এই ভেবে বড় ছেলে ওর ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল আমার হাতে। তা আমরা মুখ্যুসুখ্খু মানুষ, ইংরেজি কি পড়তে পারি! একটু দেখুন না সায়েব, কি লেখা আছে', বুড়ো লোকটি কাতরভাবে অনুরোধ করলেন।
উনি কৌতূহল-বশত: চিঠিটা পড়েই চমকে উঠলেন। তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, 'বাবুজি, যে বস্তির ঠিকানা এখানে দেওয়া আছে তা তো কবে উঠে গেছে। সেখানে এখন মস্ত হোটেল। তা, আপনার যদি আর কুনো জায়গা না থাকে আমার সাথেই চলুন না আমার বাসায়, তারপর ধীরে-সুস্থে আপনার ছেলেটাকে খুঁজা যাবে। কি বোলেন?' বুড়ো-বুড়ি হাঁ করে তাকিয়েই আছে, তাদের যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। কুলিরা তা বুঝে তাড়া ও ভরসা দিল-' আরে মাজি, সোচনে কা নেহি, হামারা সত্তুবাবু রামজি কা অবতার আছেন, আপ বিন্দাস যাইয়ে।' শুধু বলেই ক্ষান্তি নয়, দুজন কুলি সাথে সাথে তাদের জিনিসপত্র তুলে হাঁটা দিতে লেগেছে হিন্দু কলোনির দিকে।
'আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম। আপনার স্ত্রী ছেলে-পুলে......'
'কুছু ভাববেন না। হামার কেউ নেই। এখন আপনি আমার বড়া ভাই, আর ইনি আমার ভাভী আছেন। আপনার ছেলেটাকে না পাওয়া অব্দি বাড়ির রান্না খাওয়া যাবে। কি ভাভিজি, বাঙালি রান্না খাওয়াবেন তো?'
এতদিনে ছাতুবাবুর বোধহয় ছেলেপুলে না থাকার দু:খ ঘুচলো। কাগজটাতে যে পষ্ট ইংরেজিতে এই কথাটা লেখা ছিল- 'এই বুড়ো-বুড়িকে দয়া করে কোনো দাতব্য বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দেবেন'।
এপ্রিল ৩, ২০১৫, কুয়েত।
(গল্প)
রিটায়ার করার পর মানুষটা বড় একা হয়ে গেছেন।
অবশ্য আগেও যে খুব একটা মিশুকে ছিলেন ছাতুবাবু তা নয়। হ্যাঁ, ছাতুবাবু নামেই তাঁকে ডাকে পাড়ার লোক। আসল নাম সত্যেন পান্ডে লোকে বোধহয় ভুলেই গেছে। বিয়ে করেননি বলে যে তাঁর খুব একটা একাকিত্ব বোধ ছিল তা মনে হয় না, তবু কি অপত্য-স্নেহবঞ্চিত বুকের কোথাও একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগেনা কখনো জীবনের এই সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়িয়ে? উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার মানুষ, সেই কোনকালে মহাজনের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। শেয়ালদা স্টেশনে কুলিগিরি করে আর অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সে যুগে। তারপর হাওড়ার বি-এন-আরের শালিমার ইয়ার্ডে ছোট্ট একটা চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে শেষে মুম্বাই। সেন্ট্রাল রেলের প্যারেল ইয়ার্ডে ইয়ার্ড-মাস্টারি করেই তো কেটে গেল চাকরি জীবনের শেষ বারোটা বছর। ভোজপুরি আর হিন্দি ছাড়াও বাংলাটা ভালই শিখেছিলেন, এখন কিছুটা ইংরেজি আর মরাঠিও বলতে পারেন। তবে রিটায়ার করেও একটা নেশা যায়নি। সকালে ছিঁড়ে-ছাতু সহযোগে জলপান সেরে হিন্দু কলোনির ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িটা থেকে রোজ বেলা দশটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন দাদার স্টেশনে। সেখানে দেশোয়ালি কুলিদের সাথে বসে টানা একঘন্টা তাদেরকে তুলসীর রামায়ণ আর দোহা শোনান, এমন মুগ্ধ শ্রোতা মুম্বাইয়ে পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না!
কিন্তু তারপর? সারা দিনটা যে পড়ে থাকে কর্মহীন অবসরের জন্যে, তার তো অভ্যেস ছিল না তাঁর। ওয়াডালা স্টেশনের ধারে বাচ্চাদের একট স্কুল আছে, বলা বাহুল্য, অবৈতনিক- ভিখারী-কুলি-মজুর আর কিছু নিম্নশ্রেনীর বারাঙ্গনাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। তিনি কদিন গিয়ে তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে হিন্দি পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় নেতার ভয় হল, তিনি বুঝি ভোটে দাঁড়াতে চান- তাই গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁকে তাড়ানো হলো। নেতাকেও দোষ দেওয়া যায় না, বিনা স্বার্থে কেউ কিছু করতে চায়, এই সত্যি কথাটা এযুগে বসে তাঁর হজম হবে কেন? তাছাড়া তিনি আবার সে স্কুলের বোর্ড প্রেসিডেন্ট!
সেদিন সকাল থেকে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়লেও ছাতুবাবুর রুটিনের অন্যথা হয়নি। কিন্তু এগারোটা বাজতে চলল, কুলিভাইদের কারো দেখা নেই কেন? একটু খোঁজ নিতেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। তিন নম্বর আপ কলকাতা-এলাহাবাদ-মুম্বাই মেল এক নম্বরের জায়গায় চারে আসছে, তাই সব ব্যাটা দৌড় দিয়েছে সেদিকে। ওই তো গাড়ি ঢুকছে চার নম্বরে, তিনিও কি ভেবে ফুট ওভারব্রিজে উঠে পড়লেন। ছাতুবাবু রিটায়ার করেছেন বটে, তবে তাঁর কাছে প্ল্যাটফর্ম টিকিট চায় এমন রেলকর্মী কেউ নেই এ স্টেশনে।
গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে চলেও গেছে। এখানে কেউ খামোখা বসে থাকে না। 'সময় হল, সময় হল, যে যার আপন বোঝা তোলো' বলে কুলিরা কেটে পড়েছে। কিন্তু যারা প্যাসেঞ্জার পায়নি তারা আবার ওই হুইলারের স্টলটার সামনে দাঁড়িয়ে কিসের জটলা করছে? এরকম তো কথা ছিল না। ছাতুবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। হায় রাম, এই কান্ড! এক ষাটোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ি নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা কুলিদের মুখের সামনে একটা কাগজ নেড়ে ক্রমাগত কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে। কুলিদের কাজ কাগজ নিয়ে মাথা ঘামানো নয়, তারা মাল তুলতে পারলেই খুশি। তিনি এগিয়ে যেতেই ওরা সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিল। তাঁকে দেখেই বুড়ো-বুড়ি কেঁদে ফেলল। বুড়ো লোকটি হাউমাউ করে বাংলায় যা বলতে লাগলো তার অর্থ মোটামুটি এই বোঝা গেল যে, তাদের বড় ছেলে তাদেরকে বর্ধমানে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে বোম্বাইএ কাজ করে, তার দাদার স্টেশনে মা-বাপকে নিতে আসার কথা, কিন্তু এখানে নেমে অবধি কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষাও কেউ বোঝে না, ওরা নিজেরাও গাঁয়ের মানুষ, বাংলা ছাড়া কিছু জানে না।
'রুকিয়ে, রুকিয়ে, বাবুজি, আপনার হাথে উটা কিসের কাগজ?' ছাতুবাবু জানতে চাইলেন।
'এই দেখো, এটাই তো দেখাতে চাইছিলাম আপনাদের এতক্ষণ। আমার ছোটছেলে ব্যস্ত মানুষ, যদি না আসতে পারে, এই ভেবে বড় ছেলে ওর ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল আমার হাতে। তা আমরা মুখ্যুসুখ্খু মানুষ, ইংরেজি কি পড়তে পারি! একটু দেখুন না সায়েব, কি লেখা আছে', বুড়ো লোকটি কাতরভাবে অনুরোধ করলেন।
উনি কৌতূহল-বশত: চিঠিটা পড়েই চমকে উঠলেন। তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, 'বাবুজি, যে বস্তির ঠিকানা এখানে দেওয়া আছে তা তো কবে উঠে গেছে। সেখানে এখন মস্ত হোটেল। তা, আপনার যদি আর কুনো জায়গা না থাকে আমার সাথেই চলুন না আমার বাসায়, তারপর ধীরে-সুস্থে আপনার ছেলেটাকে খুঁজা যাবে। কি বোলেন?' বুড়ো-বুড়ি হাঁ করে তাকিয়েই আছে, তাদের যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। কুলিরা তা বুঝে তাড়া ও ভরসা দিল-' আরে মাজি, সোচনে কা নেহি, হামারা সত্তুবাবু রামজি কা অবতার আছেন, আপ বিন্দাস যাইয়ে।' শুধু বলেই ক্ষান্তি নয়, দুজন কুলি সাথে সাথে তাদের জিনিসপত্র তুলে হাঁটা দিতে লেগেছে হিন্দু কলোনির দিকে।
'আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম। আপনার স্ত্রী ছেলে-পুলে......'
'কুছু ভাববেন না। হামার কেউ নেই। এখন আপনি আমার বড়া ভাই, আর ইনি আমার ভাভী আছেন। আপনার ছেলেটাকে না পাওয়া অব্দি বাড়ির রান্না খাওয়া যাবে। কি ভাভিজি, বাঙালি রান্না খাওয়াবেন তো?'
এতদিনে ছাতুবাবুর বোধহয় ছেলেপুলে না থাকার দু:খ ঘুচলো। কাগজটাতে যে পষ্ট ইংরেজিতে এই কথাটা লেখা ছিল- 'এই বুড়ো-বুড়িকে দয়া করে কোনো দাতব্য বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দেবেন'।
এপ্রিল ৩, ২০১৫, কুয়েত।