Wednesday, January 21, 2015

বিবিধ প্রসঙ্গ ।। ১-৩

(১)
বিভীষণ

কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলেই আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, 'ঘরভেদী বিভীষণ'। এই বিভীষণ কি অন্যায় বা অনৈতিক কাজ করেছিলেন দেখা যাক। তিনি সীতাকে বন্দী করে রাখার ব্যাপারটা সমর্থন না করে চেয়েছিলেন রাবণ সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিক। এই নিয়ে তর্কাতর্কি চলাকালীন রাবণ রাগের চোটে ছোট ভাইকে লাথি মেরে বসেন। এই অপমান সহ্য না করতে পেরে বিভীষণ রাবণকে ছেড়ে চলে এসে রামের দলে যোগ দেন।
এছাড়া বিভীষণের কি আর কোনও উপায় ছিল না? ছিল। যদি তিনি রাবণের সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতেন, তাহলে তিনি রাবণের পরাজয় চাইতেন, কিন্তু নিজে তার কারণ হয়ে উঠে রামের দলে যোগ দিতেন না। তিনি বরং নিরপেক্ষ হয়ে থাকতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি, কারণ তাঁর রাজ্যের লোভ ছিল। লঙ্কার অধীশ্বর হতে গেলে পুত্রপৌত্রাদিসহ রাবণের মৃত্যু জরুরী ছিল আর বিভীষণ এও জানতেন যে তাঁর সাহায্য ছাড়া রামের প্রসঙ্গ কাজ করা অসম্ভব হত।
আজ এ দেশের রাজনীতিতে এ খেলা অবিরত চলে আসছে। মমতার সাথে চার বছর সুখে ঘর করার পর যখন মনে হল দিদির এবার জেতার আশা কম, অমনি বনগাঁর ঠাকুরের খেয়াল হল পদ্মফুলের গন্ধ ঘাসফুলের চেয়ে মিষ্টি, ফলে তিনি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করলেন। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হবার লোভে কেজরীওয়াল ছেড়ে কিরণ বেদিও ভাজপার পতাকাতলে এলেন। এঁরা কিন্তু নির্লোভ হলে দলত্যাগ করে নিরপেক্ষও থাকতে পারতেন, আর সেটাই হত অন্যায়নীতির বিরুদ্ধে সঠিক প্রতিবাদ। যদি নীতিগত প্রশ্নে বিভেদ ঘটে, নির্দলীয় হয়ে দাঁড়ালেই হয়!
তবে আমাদের দেশের জনতা চিরকাল বিভীষণকেই ভোট দিয়ে এসেছেন, এবং এবারও দেবেন, কারণ তিনি ভগবান রামের দলে এসেছেন যে! আর রামের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বিভীষণের চরিত্রটিকে নিখুঁতভাবে অধ্যয়ন করে তাঁর কাছ থেকে নিজের ছেলে তরণীসেনকে মারার ট্রিকটুকুও বলিয়ে নিয়েছেন কথায় কথায়। তাই তো তিনি ভগবান!


(২)
কর্ণ


নাঃ, খুব ভালগার হয়ে গেল শীর্ষকটি। কিন্তু কিছু করার নেই। যে হারে সুবিধাবাদী ও বিক্ষুব্ধ নেতারা নিজের নিজের দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে সাইন করছেন, হয়ত সেখানে গিয়ে শাইনও করবেন, সে সব দেখে দৈনন্দিন মলত্যাগে অভ্যস্ত সাধারণ জনতাও অস্বস্তি ফীল করছেন। মাতুয়া শিরোমণি শ্রীমঞ্জুল বা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশবাবু বা সাধন পাণ্ডেরা এতদিনে বুঝতে পারলেন-
কিসের মাটি, কিসের মানুষ, কিসের তৃণমূল,
কাল যে ছিল নয়নমণি, আজ সে চক্ষুশূল।
কেউ কেউ বলছেন, জনতার অপমান আর অভিশাপ বয়ে আর ও দলে থাকা যায় না। সত্যিই যায় না। আসল কারণ অবশ্য টাকা রোজগারের কায়দা হিসেবে সারদার পর নতুন কোনও ইনোভেটিভ আইডিয়ার উদ্ভব না করতে পারা, দু-নম্বর ভাজপা-কে কংগ্রেস ভেবে মমতার ভুল করে সভার মাঝে মোদিকে আজেবাজে কথা বলা (উপায় নেই, অভ্যাস হয়ে গেছে, মুখ খুললেই ওগুলো বেরিয়ে পড়ে) আর তিন নম্বর- তৃণমূল নেত্রীর সঠিক সময়ে একটু নত হয়ে কংগেসের সাথে জোট না করতে পারা। এরপরও লোকে থেকে যেতেন, যদি দলের কোনও আদর্শ থাকত- মনে করে দেখুন দল থেকে বিতাড়িত নেতা সোমনাথবাবুকে, যিনি অনায়াসে সেসময় কংগ্রেস বা অন্য দলে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু বাম আদর্শ যাঁর মজ্জাগত হয়ে গেছে তিনি কি তা করতে পারেন! কম্যুনিষ্ট পার্টির দুর্ভাগ্য, এরকম একটা মানুষ থাকতে হরকিষেন বা কারাটের মত লোকেরা পলিটব্যুরোর শীর্ষে থাকেন বা বুদ্ধদেববাবুর মত দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ বঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হন!

এই প্রসঙ্গে ভেবে দেখলে মহাভারতের যুদ্ধের আগের দল-বদল পর্ব এখনও প্রাসঙ্গিক। মদ্ররাজ শল্য নকুল-সহদেবের মামা হলেও যেহেতু দুর্যোধনের অনুরোধ আগে পান, তাঁর দলেই যোগ দেন। কৃষ্ণকে নিয়ে হেড-টেল টস হয়, ও অর্জুন যেতেন। বলদেবের আশীর্বাদ প্রিয়শিষ্য দুর্যোধনের পক্ষে থাকলেও, ভাইএর কথায় তিনি থাকেন নির্দলীয় হয়ে। তবে রগড় শুরু হয় যুদ্ধ শুরু হবার পর। কর্ণের শৌর্য-বীর্যের কাছে পেরে না উঠে কৃষ্ণ তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে তাঁর বংশ-পরিচয় দিয়ে আসেন আর তার পরেই কুন্তী-মা গিয়ে তাঁকে দল-বদলের আহ্বান জানিয়ে আসেন। তিনিও তখন অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারতেন, এলে বেঁচে যেতেন, রাজাও হতেন হয়ত। কিন্তু সেই কবে বন্ধু দুর্যোধন অপমানিত অবহেলিত মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো একটি সূত-পুত্রকে রাজার মর্যাদা দিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতাবশে তিনি দলত্যাগ করলেন না। এ যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এ যে কত বড় স্বার্থত্যাগ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
যাক গে, তৃণমূল ভাঙ্গুক, আআপ ভেঙে কিরণ বেদী বেরিয়ে এসে দিল্লীর বিধানসভার দিকে হাত বাড়ান বা নাই বাড়ান, ভাজপার বৃহস্পতি এই মুহূর্তে তুঙ্গে। যে দলই জিতুক কিছু যায় আসে না, শুধু চাইব তারা যেন জনতাকে 'বনলতা সেন'এর মত 'দু দণ্ড শান্তি' দিতে পারে।


(৩)

ঈশ্বর

সদ্য দেখা 'পি কে' ছবিতে একটা খুব জনপ্রিয় উক্তি ছিল। তপস্বী-বাবা বলছেন, 'বিধর্মীদের হাতে চুড়ান্ত অপমানের হাত থেকে আমরা ঈশ্বরকে রক্ষা করব'। তার উত্তরে ভিন-গ্রহ থেকে আসা লোকটা বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে প্রকারান্তরে বলেই ফেলল- 'যে ভগবান বিশ্ব-সৃষ্টি করেছেন তাঁকে রক্ষা করবে তুমি, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! চিন্তা কোরো না, ঈশ্বরের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ঠিকই আছে, তার জন্যে তোমার চিন্তার প্রয়োজন হবে না।'
আজ একালের ঈশ্বর বারাক ওবামা নিজের হাতে নিজের রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এ গাঁয়ের মোড়লমশাইকে অশেষ দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করেছেন। মোড়লমশাই তাঁর মোড়লজীবনের প্রথম গণতন্ত্রদিবসের সমারোহে প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে গুণ্ডাদের নিয়ে বড্ড চিন্তায় ছিলেন। এদিকে আধুনিক ঈশ্বরের কাছে স্বমহিমা প্রচারের এরকম সুযোগ ছাড়তেও পারছিলেন না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে উৎপাত থেকে তাঁকে রক্ষা করবে কে? আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে এ দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করলেন। প্রতিবেশী দেশের মোড়লমশাইকে একটি বার্তায় তিনি স্পষ্টরূপে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর উপস্থিতিতে দিল্লী বা তার আসেপাশে কোনরকম অশান্তি বা নাশকতামূলক কাজকর্ম তিনি চাননা। আমরা অগত্যা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কিন্তু এই একটা ঘটনা কি কি প্রমাণ করল দেখা যাক্‌-
১- ঈশ্বরকে মানিনা ইত্যাদি বলে গালাগাল দিলেও তাঁকে খুশী রাখতে রাম ও রাবণ দুজনেই চায়। তাই কুরুক্ষেত্রের প্রাক্কালে অর্জুন আর দুর্যোধন দুজনেই কৃষ্ণকে নিজের নিজের দলে টানতে দ্বারকা পৌঁছে গেছিলেন।
২- নিজেকে রক্ষার ভার ঈশ্বর নিজেই নিতে পারেন। তাই তাঁর রক্ষার জন্যে চিন্তিত না হয়ে তাঁকে নিয়ে এসো নিজের কাছে, এতে করে তুমি নিজেও সুরক্ষিত থাকবে।
৩- এই গ্রহে যাবতীয় নাশক-অনাশক, শুভাশুভ কর্মকাণ্ডের নায়ক তিনিই। তিনি না চাইলে কাশ্মীরের এক ইঞ্চিও ভারত পায় না, আবার আল-কায়দাও কোনও কায়দা-কানুন দেখাতে পারে না।
৪- এটাও জানা গেল যে বিভিন্ন সংগঠিত-অসংগঠিত, ন্যায্য-অন্যায্য নাশক-শ্রেণীর গুপ্তচক্রগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিবেশী দেশের মোড়লের হাতে আছে, আর এটা স্বয়ং ভগবানও জানেন।
৫- সুতরাং দু-দেশের মোড়লেরই উচিৎ হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা বলে নিজেদের মধ্যে লাফালাফি না করে ঈশ্বরের ইচ্ছাটি কি তা জানার দিকেই নজর কেন্দ্রিত রাখা। অবশ্য জনতাকে ভাঁওতা দিতে একটু চেঁচামেচিরও দরকার আছে, মানতে হবে।
তাহলে টুইন টাওয়ারে কি হয়েছিল। কেন, ছেলেপুলেরা কি বাপ-মায়ের অবাধ্য হয়না মাঝে মাঝে? তার ফলও তারা পায় হাতে-নাতে।
অলমিতি বিস্তারেন!

No comments:

Post a Comment